চারুপাঠ (তৃতীয় বর্ষ)—বিষয়ঃ বাংলার যুদ্ধ--সম্পাদকঃ জয়দেব দাস; খড়ি প্রকাশনী, কলকাতা-১২; প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর, ২০২৪; ISBN 978-93-93833-59-4
অষ্টাদশ শতকের প্রুশিয় সেনানায়ক কার্ল ফন ক্লজউইজকে আধুনিক সমরশাস্ত্রের জনক বলতে ভালোবাসে পশ্চিমা বিশ্ব, কিন্তু খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর চৈনিক সমরতাত্ত্বিক সুন শু তো তাঁর চেয়েও দুই হাজার বছর আগেকার মানুষ—-ইঙ্গনামে তাঁর আর্ট অব্ ওয়র বইটিকে সমরশাস্ত্রের আদিতম ট্রিটিজ হিসেবে তো তবে মানতেই হয়। বইমেলায় কেতাবখানি দেখতে পেয়ে উল্টেপাল্টে আবার রেখে দিই—সূচীপত্র দেখে ও ব্লার্ব পড়ে কিছু ঠাহর হল না বিশেষ।
কিন্তু, ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে ‘যুদ্ধ’ বিষয়টাই খুব টানে। সেই কোথাকার কোন্ ছোট্ট গ্রীসদেশের মানুষ আলেক্সান্দার—প্রবল পরাক্রমশালী পারস্যরাজকে হারিয়ে যুদ্ধ করতে করতে আরো পুবে আরো পুবে পাঞ্জাব পর্যন্ত এসে গেল! আমাদের বঙ্গদেশেও সেই সাতসমুদ্র-তেরোনদী পেরিয়ে এসে ক্লাইব সাহেব চৌগুণ শক্তিশালী নবাব সিরাজকে পলাশীতে পটকে দিলেন!
মানে, যুদ্ধু করাটাই একটা বিশেষ আর্ট—যেটা শিখতে হয়, জানতে হয়। মিলিটারি ইস্কুলে সেসব শেখায় বটে। কিন্তু আমরা সাধারণ পাঠক সে সম্বন্ধে একটু পড়তে-জানতে পারি কী করে?
বাংলা ভাষায় ‘যুদ্ধ’ নিয়ে খুব বেশি সংখ্যায় বইপত্তর হয়েছে বলে তো জানি না।
অনেক বছর আগে ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ’-এর বাংলার আদি সমরেতিহাসের উপরে একটা বই পড়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। বর্তমান বইখানি এ’ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বটে, তাই ‘পরবাস’-এর পাঠকদের সামনে এ’সম্বন্ধে দু’-কথা লিখতে ইচ্ছা করি।
***
প্রথমেই জানানো যাক্ যে এটা কিন্ত কোনো ‘বই’ নয়, একটি পত্রিকার একটি ‘নিবেদিত সংখ্যা’। পৃথুলা; ৪২০ পৃষ্ঠা সম্বলিত।
ভাবতে ভালো লাগে যে বাণিজ্যের দিকটির তেমন পরোয়া না করে, কিছু মানুষ এইভাবে সাহিত্যসেবা করে চলেছেন। এর আগে পরবাসের ৬৯ সংখ্যায় আমরা ‘দীপন’ পত্রিকার নিবেদিত ‘কমিকস’ সংখ্যার কথা পড়েছিলাম, বা ৯১ সংখ্যায় ‘অথচ’ পত্রিকার কথা।
শুধু ‘বাংলার যুদ্ধ’-এর উপরে যে এমন একটা ঢাউস পত্রিকা করা যায়, এবং সেটা গোগ্রাসে গেলবার যোগ্য—সেটা এ’খানি হাতে না পেলে বিশ্বাস করতাম না।
***
‘বাংলার যুদ্ধ’—মানে কী?
প্রথমেই মনে হয়, বাংলায়, মানে আমাদের এই অখণ্ড বঙ্গদেশের বুকে যে সব উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়েছে তাদের কথা। এই ভাবটিকেই বাড়িয়ে নিয়ে বাঙালিরা যে যে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ করেছে—সেটা বাংলার মাটিতে না হলেও—তাদের কথা। যেমন, নবম শতকে সম্রাট দেবপাল কাশ্মীরবিজয় করতে সেই সহস্রাধিক ক্রোশ দূরের দেশে গিয়েছিলেন (প্রশ্নচিহ্ন আছে, অবিশ্যি, এই অভিযানে)। আছে, এ’বইয়ে সে যুদ্ধের কথাও (যদিও বাংলা থেকে কাশ্মীর যেতে হিমালয় ডিঙোতে হয় না)। আবার, যে বাংলা নাকি এখন আর ‘আমার’ নয়, সেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম ও বিলোনিয়া (ত্রিপুরা-সীমান্ত) রণাঙ্গনের ইতিহাস চমৎকার বিধৃত হয়ে রয়েছে এ’কেতাবে।
সুচিপত্রটির দিকে তাকাইঃ
পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত মোট বত্রিশটি নিবন্ধ পড়তে পাই এখানেঃ
—প্রাচীন বাংলায় যুদ্ধ (১৩টি নিবন্ধ)
—পলাশী থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ (৯টি নিবন্ধ)
—রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ (২টি নিবন্ধ)
—মুক্তিযুদ্ধ (৪টি নিবন্ধ)
—যুদ্ধ ও বাংলার সংস্কৃতি (৪টি নিবন্ধ)
কয়েকটি নিবন্ধের শিরোনাম তো তৎক্ষণাৎ উৎসাহ জাগায় পড়তে, যেমনত, ‘কবি জয়দেবের লেখনীতে সেনযুগের যুদ্ধরীতি’, বা ‘ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাতে জঙ্গলমহলের যুদ্ধ’, বা ‘লোকসংগীতে বাংলার যুদ্ধ’। কোন্টা ছেড়ে কোন্ লেখাটার কথা যে বলব এখানে!
সেন-আমলের পতন ঘটিয়ে বখতিয়ার খিলজির নদীয়াবিজয় তো বাংলার ইতিহাসের এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য মোড় কারণ সেই যে বিদেশী শাসন শুরু হল ভারতীয়রা তো আবার ১৯৪৭এর আগে বাংলার শাসনভার ফিরে পায়নি। এই বিষয়ের উপরে দুইটি নিবন্ধ রয়েছে। প্রথম প্রবন্ধটির লেখক শ্রী মানস শেঠ বখতিয়ারের আক্রমণকে ‘মধ্যবাংলার এক রাবণ রাত্রি’ বলেছেন, যদিও লক্ষ্মণসেন যখন নাকি মধ্যাহ্নভোজ ছেড়ে উঠে খিড়কিদোর দিয়ে পূর্ববঙ্গে পালান তখন ঘোর দ্বিপ্রহর ছিল। প্রবন্ধখানি অতি সুলিখিত, যেমন রাজর্ষি মহাপাত্র লিখিত দ্বিতীয়টিও, যদিও তিনি এটাকে ‘খিলজি-লক্ষ্মণ যুদ্ধ’ বলেছেন। কিন্তু মিনহাজউদ্দিন লিখিত কাহানী মোতাবেক সম্মুখসমর তো এক্ষেত্রে আদৌ ঘটেনি।
এত ভিন্ন-ভিন্নতর ‘যুদ্ধ’ নিয়ে নিবন্ধাবলী সংকলিত হয়েছে যে পড়তে পড়তে বিস্মিত হতে হয়, অবাকও হতে হয় তাদের মান দেখে। যেমন, ১৯৩২-এ বীরবালিকা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কর্তৃক চট্টগ্রাম পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাব অভিযানের কাহিনী! এবং তাঁর প্রাণ-বলিদান। যদিও প্রশ্ন জাগে মনে, এহেন অতর্কিত আক্রমণ কি ‘যুদ্ধ’? এবং, এহেন এক সংকলনে ঠাঁই পেতে পারে?
যেমন, সোমব্রত সরকারের সুলিখিত ‘ভাষার যুদ্ধ ঃ আট শতক থেকে উনিশ শতক’ নিবন্ধটি। অতি সুলিখিত, সন্দেহ নেই, কিন্তু এ’সংকলনের পক্ষে অনুপযুক্ত। সোমব্রতের লেখার সঙ্গে আমরা পূর্বপরিচিত; ৭১-সংখ্যায় ওঁর গ্রন্থ-সমালোচনা পড়েছিলাম আমরা।
দুইটি রচনার বিশেষ উল্লেখ এখানে না করলে অন্যায় হবে। এক. ‘লোকসংগীতে বাংলার যুদ্ধ’ ও ‘চলচ্চিত্র পটে যুদ্ধের কথা’। দীর্ঘতর আলোচনার সুযোগ এ’স্থলে নেই। যেমন, বিশ্বেন্দু নন্দের মুঘল রণকাঠামোর উপরে লেখাটি। অসাধারণ। যেমন, মেদিনীপুরের রাণী ভবশঙ্করীর উপরে নিবন্ধটিও।
***
এমনিতে বইখানির উপস্থাপনা উত্তম, যদিও পৃষ্ঠাসংখ্যাক্রমের বিচ্যুতি ঘটে গেছে ১১৪-র পর থেকে। অনেক নিবন্ধের শেষে সূত্র-নির্দেশের গ্রন্থতালিকা দেওয়া আছে, বেশিরভাগে নেই। লেখক পরিচিতি নেই। দরকার ছিল।
***
ভয়ংকর আর জি কর কাণ্ডের সমসাময়িক এই বইটির প্রকাশনা। প্রতি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ‘তিলোত্তমারা বিচার পাক’ শ্লোগান তোলা হয়েছে। কুর্নিশ এই প্রতিবাদে!
অবনী বহিয়া যায়—সেমিমা হাকিম; স্মেল অফ বুকস প্রকাশন, কলকাতা-৪৯; প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর, ২০২৪;
ISBN 978-81-971963-8-6
‘তরল’—বোধহয় এই একটি শব্দ দিয়ে যেকোন সাধারণ নারীকে বর্ণনা করা যেতে পারে। যখন যে অবস্থায় থাকে সে নিজেকে সেই ধাঁচে ঢেলে নিতে পারে। অসাধারণ কোনো নারী, অবিশ্যি, বাঁধা ধাঁচ ভেঙে নিজের মতো করে গড়ে নেয় নিজস্ব আধার। তাঁরা আদর্শ, কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা অত্যল্প। এই উপন্যাস তেমন কোনো অনন্যা নারীকে নিয়ে নয়, বরং এখানে…[(ব্লার্ব) ]
বরং এখানে এমন নারীকে বা নারীদের গল্প করা হয়েছে যাঁদের আমরা যেমন শ্যামা-ট্রিলজীতে দেখেছি, বা সত্য-সুবর্ণ-বকুলকথায়, তেমনি নূরন্নেছা খাতুনের স্বপ্নদ্রষ্টা উপন্যাসে (রশীদা) বা মা-রোকেয়ার পদ্মরাগ-এ (সিদ্দিকা)।
হয়ত আমার মায়ের ডায়েরিতেও।
তাই এই অবনী বহিয়া যায় উপন্যাসে কোথায় যেন সত্যবতী-জয়নব-সুফিয়া মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়!
***
এ’উপন্যাসের প্রেক্ষা কিন্তু প্রায় তিনটি প্রজন্ম জুড়ে। সেখানে যেমন ময়না আর তার ঠমকদার কন্যে রুবিনা আছে তেমনি ঐ রুবিনার মেয়ে নাজু যে কিনা নায়িকা সুফিয়ার ঘরে থাকে হাত-নুড়কুৎ হয়ে। গ্রামের একটি হতদরিদ্র মেয়ের শহরে এসে স্বাচ্ছল্যের মধ্যে ক্রমে ক্রমে বেড়ে ওঠা—সেটা যদিও পাশ-আয়না—যেখানে কিনা নায়িকার জীবনের ছায়া এসে পড়েছে। স্বচ্ছল মুসলিম ঘরের বাপ-মায়ের একমাত্র মেয়ে…সুশিক্ষিত…যাকে উচ্চ-চাকুরে স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে হয়…শাশুড়িরও, যদিও তেনার সাথে একত্রবাস নয়। কাহিনি-ধারার এ’সব কুট-কচালে এখানেই বলে দিলে রসভঙ্গ করা হবে, তার চাইতে লিখন-স্টাইল নিয়ে দু’কথা বলা যাক্ যা মন কেড়েছে।
সর্বপ্রথম তো অতি-চালু ঘরোয়া শব্দের বহুল ব্যবহার। ‘হাঁটার ছটক’ (স্টাইল), ‘হুট কথায়’ (আকস্মিক), ‘চুয়াড়ে খাওয়া’ (গোগ্রাসে), বা, ‘পোঁয়ে পোঁ ধরা’ (সমর্থন করা)—ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দের সুপ্রযোজ্যতা, যা কাহিনীর মূলসুরটাকে মোক্ষম তুলে ধরে। এমন এমন শব্দের ব্যবহার না করে সুভাষিত শব্দাবলী লিখলে কি আর কাহিনী এতটা মনোলোভা হতে পারত?
দ্বিতীয়ত, যে অনায়াস ভঙ্গীতে লেখিকা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে চলে গেছেন গল্পচ্ছলে, বা এক স্থান (শহর) থেকে অন্যত্র (গ্রাম)—বা, শিক্ষিত পরিমণ্ডল থেকে ‘গাঁইয়া’ কালচারে—তা তাঁর গপ্প বলার স্বাভাবিক ক্ষমতাকে তুলে ধরে। এটি না থাকিলে যতই অন্তর্দৃষ্টি থাক্ বা যতই না সমাজ-বীক্ষা বা গবেষণা—সবই মাঠে মারা যাইত। প্রথম বিচারে পাঠক একখান উপন্যাস পড়তে বসেছেন কিনা, তারপরে তার গভীরতা, মুসলিম অন্তঃপুরে গতায়াত বা আধুনিকতার ঝলক। অতএব, কাহিনী ও তার গতির বিচার সর্বাগ্রে হবে, বাকি সব পরে। এখানে দশে দশ পান নূতন লেখিকা। (এটি লেখিকার দ্বিতীয় উপন্যাস।) যদিও একটা সতর্কবাণী থাক্ঃ আত্মজীবনীমূলক কাহিনী লিখে দশে দশ পাওয়া সহজ, কিন্তু সব লেখা তো আর তেমন হবে না। তাই এই মান ভবিষ্যতে ধরে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ!
নূতন প্রকাশনালয়ের কাজ ভালো লেগেছে, ৩-য় প্রচ্ছদে উত্তমপুরুষে লেখা ‘পরিচিতি’ সহ।
প্রচ্ছদ? মুসলিম গল্প হলেই কি উর্দু-নাসতালিক ক্যালিগ্রাফিক স্টাইল আনতে হবে? গল্প তো পুরোপুরি ঘটি বাঙালির।
যদিও, প্রচ্ছদটি দেখতে ভালোই লাগছে।
The Cinema of Tapan Sinha—-Amitava Nag; Om Books International, Noida 201301; First published in 2021; ISBN 978-93-85252-86-0
এটা তাঁর জন্মশতবর্ষ চলছে!
যদিও ঢক্কানিনাদ তার অত্যল্প, যদিও সেকালের আর তিন দিকপাল বাঙালি চিত্রপরিচালকের থেকে তপন কোনো অংশে কম তো ছিলেনই না, বরং কোথাও যেন এগিয়ে (যেমন, সুরকার হিসেবে)।
আসব সে-কথায়।
সত্যজিৎ (জ. ১৯২১), ঋত্বিক (জ. ১৯২৫), মৃণাল (জ. ১৯২৩) ছিলেন সমবয়সী; তিনজনই দক্ষিণ-কলকাতাবাসী, এবং তিনজনেরই প্রথম ছবি ১৯৫০-এর দশকে। তবু প্রথম তিনের যা বিশ্বজোড়া খ্যাতি তার আলোতে তপন যেন ম্লান। সেটা অনুচিত। সেটা অন্যায়! এ’ বইয়ের একটি নিবন্ধে লেখক তা নিয়ে তুল্যমূল্য আলোচনাও করেছেন বটে। আর হ্যাঁ, বাণিজ্যিক সাফল্যে তপন সিনহা নিশ্চয়ই বাকি তিনের থেকে এগিয়ে। এ’বইয়ের লেখক বলেছেন বটে, তপন যেন একদিকে ঐ-ত্রয়ী, ও অপর দিকে বাণিজ্যসফল অজয়কর-অসিতসেন-তরুণমজু.-দের মধ্যে এক সেতু-স্বরূপ ছিলেন!
***
গঙ্গাতটের বিহারী শহর ভাগলপুর সেকালে উচ্চবর্ণীয় বামুন-কায়েত বাঙালির পীঠস্থান তো ছিলই, ব্রাহ্ম ও বাঙালি-ক্রিশ্চানদেরও। অশোককুমার-বনফুল এখানকার ভূমিপুত্র, যেমন তপনসিনহা-দিব্যেন্দুপালিত। প্রবাদপ্রতিম ডাঃ কাদম্বিনী বসু গাঙ্গুলি ও প্রীতিশনন্দীও ভাগলপুরজাত। তপনেরও স্কুলশিক্ষা এখানেই; এবং সেকালে কলি.-বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের এম. এস. সি. আর কেউ ফিল্ম-ইণ্ডাস্ট্রিতে যোগ দিয়েছিলেন বলে মনে পড়ে না। আর হ্যাঁ, বম্বের তিন টপ-হিরোর (রাজ-দিলীপ-দেবানন্দ) একজনই বাংলা সিনেমায় হিরোর রোল একবার করেছিলেন—তপনের ‘সাগিনা মাহাতো’-তে দিলীপকুমার!
১৯৬১-র (‘তিন কন্যা’) পর থেকে সত্যজিৎ নিজের ছবির সঙ্গীত-পরিচালনাও করেছেন, তপনও করেছেন ‘অতিথি’-র (১৯৬৫) পর থেকে। এবং ‘হারমোনিয়াম’-এর মতো ছবিতে কমার্শিয়াল হিট গানও দিয়েছেন—সুরকার-ও-গীতিকার হিসেবে। এক কমপ্লিট চলচ্চিত্রকার তপন সিনহার কৃতিত্বের এই এই দিকগুলি হামেশাই চাপা পড়ে যায়ঃ ‘মন বলে আমি মনের কথা জানি না/ তারায় তারায় উড়ে বেড়ায় মাটিতে সে নামে না।। ’
***
এটা দুঃখের যে তপন-চর্চা বাংলাভাষায় খুবই কম হয়েছে, ইংরেজিতে তো নয়ই। বইমেলায় ‘ঘুঞ্চু কীর্তন’ বলে একটা বই দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নিয়েছিলাম, যাতে নানান ফিল্ম-ব্যক্তিত্ব নিয়ে সরস লিখেছিলেন শ্রীমান অমিতাভ নাগ। উনি কবিতাও লেখেনঃ ‘ভালোবাসার শব্দ খুঁজে ফেরার’! তবে ওঁর বর্তমান এই বইটির মতো জনপ্রিয় আর কোনটিই হয়নি। তার কারণও আছে। এ’বইয়ের মুখবন্ধে মানিকের-‘অপু’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘…he is the one who actually taught me some of the basics of acting.’ শাবানা আজমী লিখছেন, ‘Tapan-da was more in the classic mould’.
দিলীপকুমারের কলমে ‘…working with Tapan Sinha was a many-splendoured experience because he himself was a man of excellent literary calibre.’
বারোটি ছোট ছোট অধ্যায়ে এই সুউচ্চ ফিল্ম-ব্যক্তিত্বকে ধরতে চেয়েছেন লেখক। বেশ সুখপাঠ্য, বিশেষ করে ওঁর শিশুকিশোর-চলচ্চিত্রের উপরে অধ্যায়টি। উল্লেখ্যঃ চারটি এ’গোত্রের ছবি করেছিলেন তপনঃ সফেদ হাথি, সবুজ দ্বীপের রাজা, আজ কা রবিনহুড ও আনোখা মোতি।
বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর সাদাকালো ছবি রয়েছে বইটিতে—মায়ের সঙ্গে তপন, দিদির সঙ্গে তপন, সত্যজিতের সঙ্গে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। একটা ছবিতে যদিও মনে হচ্ছে লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সঙ্গে (উনিও ভাগলপুরের), যদিও পরিচিতি দেওয়া হয়েছে অরুন্ধতী দেবী বলে।
১৯৯৫তে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে (‘মনে পড়ে’) উনি লণ্ডনে স্যর লরেন্স অলিভিয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন—সব নাটকই মঞ্চস্থ করা যায়, যেমন সব গল্প থেকেই সিনেমা করা যায়। ‘অংকুশ’ থেকে ‘হাটে-বাজারে’, ‘আপনজন’ থেকে ‘হুতোমের নকশা’—-তপন সিনহার ছবির খতিয়ান দেখতে দেখতে এ’কথার যথার্থতা নিয়তই মনে পড়ে।
আনন্দ শতকঃ আনন্দবাজার পত্রিকা--সম্পাদকঃ ঈশানী দত্তরায়; আনন্দ;
প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি, ২০২৩;
ISBN 978-93-5425-322-5
সন ১৩২৮-এর ফাগুন মাস।
ইং মতে ১৯২২-এর মার্চ।
চৌরিচৌরা ঘটনার পর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেও গান্ধিজী সদ্য জেলে চলে গেছেন। টগবগ করে ফুটছে সারা ভারতবর্ষ!
দোলযাত্রার দিনে লাল কালিতে ছেপে দুই বন্ধু প্রফুল্লকুমার ও সুরেশচন্দ্র যেদিন উত্তর কলকাতার শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস থেকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ প্রথম বের করলেন তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবেননি যে কেবল সংবাদের আঙিনা ছেড়ে সাহিত্যক্ষেত্রেও এই পত্রিকা একদিন বঙ্গজীবনের ধ্বজাধর হয়ে দাঁড়াবে! ইংরেজ সরকার অবিশ্যি সেই লাল রঙে দোলের ফাগ নয়, রাজদ্রোহিতার রক্তরং দেখেছিল, কারণ সুরেশ মজুমদার ততদিনে জেলফেরত স্বদেশী, এবং শুধুমাত্র দেশসেবা করতেই প্রফুল্ল সরকার ঢেনকানলের রাজ-দেওয়ানী ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছেন।
***
আনন্দবাজার পত্রিকার ইতিহাস লেখা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, তার জন্য তো অন্য গ্রন্থ আছে।
২০২২-এ প্রবাদপ্রতিম এই সংস্থার শতবর্ষপূর্তিতে উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ-কবিতা নিয়ে অন্য তিন-তিনখানি বৃহৎ-কলেবর সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেছে এই সংস্থা।
তবে বর্তমান গ্রন্থটি কী?
শতবর্ষ উপলক্ষ্যে সারা বছর জুড়ে ‘বাঙালির মন ও মনন, মেধা, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, শিল্পবোধ, খেলা, রাজনীতি, বাণিজ্য’--এমন এমন বিষয়ের উপরে একাধিক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল আনন্দবাজার। তা থেকেই নির্বাচিত কিছু নিবন্ধের সংকলন এই গ্রন্থটি।
‘কিছু’ মানে কত?
বঙ্গসমাজ থেকে রাজনীতি-অর্থনীতি, সাহিত্য-বিজ্ঞান থেকে চলচ্চিত্র ও খেলা--এবং জীবনযাপন--কী নয়--এমন এমন তেরোটি বিভাগে প্রায় দ্বিশত নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে দুই মলাটের মধ্যে (ঠিক গুণলে ১৯৫টি)। পাঁচশত পৃষ্ঠাধিক গ্রন্থে একই সঙ্গে অমর্ত্য সেন থেকে সুমিত সরকার, তসলিমা নাসরিন থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়তে পাওয়া কম পাওয়া নয়।
আর এমন এমন লেখা…!
‘বাঙালির প্রাণভ্রমরা’ নিবন্ধে দীপেশ চক্রবর্তী বাংলা-শিশুসাহিত্যের ও পুবের ভাষা-আন্দোলন থেকে মুজিবের শপথের (১৯৭১) জয়গান গান! মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব বাঁচার একমাত্র পথ খুঁজে পেতে লেখেন, ‘…গরিবরা ঋণ নিয়ে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারবে, এটা অর্থনীতিশাস্ত্র স্বীকার করে না।’, বা, পি সি সরকার তোলেন তাজমহল ভ্যানিশ করে দেবার গপ্প!
চমৎকার সুখপাঠ!
***
তবে, লেখা দশে ছয় পেলে ছবি পায় দশে দশ!
কত কত ছবি!
সাদাকালো ছবির যে একটা নিজস্ব মাধুর্য আছে পাতা উল্টোতে উল্টোতে তা ফিরে ফিরে অনুভব করতে হয়। সেখানে যেমন সাঁতারের পোশাকে মুনমুন সেন আছেন (পাশে মা সুচিত্রা), তেমনি বড়ুয়া-আনন্দ দ্বৈরথ! ১৯৯২তেই বাঙালি দিব্যেন্দুর 'এলো' রেটিং ২৫৫৫।
’৬৯-এর ইডেনে শর্মিলা এসেছেন পটৌডির খেলা দেখতে! আছে ১৯২০তে তোলা গুরু ভীমরাও শাস্ত্রীর কাছে শিষ্য শান্তিদেবের গানের ক্লাসের ছবি; ওপাশে আবার ২০১৬-তে সিঙুরে টাটার কারখানা ভাঙার ছবি! দুই মলাটের মধ্যে বাঙালির শত বছরের ইতিহাসের লেখা-রেখার এহেন সংকলন যেকোন উৎসাহী পাঠকের তাকে নয়, হাতে হাতে ফিরবে।
কারণ এ বই পড়া অমন চট করে শেষ হয়ে যাবার নয়।
তাই, এই বইয়ের কোনো গ্রন্থ-সমালোচনা হয় না।