১. কিছু গোড়ার কথা
এই নিবন্ধে আমি আমার মতো ক'রে অনেক প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আজকের প্রযুক্তি-চালিত বিশ্বে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিষয়ে :
১. আমরা মানুষেরা কেন একই মাপের, একই ধরনের নই?
২. কেন আমাদের ভিন্ন হতে হবে? এমনটা হতে দেওয়া উচিত কি?
৩. আমাদের চারপাশে যে সব টেকনোলজি বা প্রযুক্তি সচল রয়েছে, এবং প্রায় আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, তারা কি আমাদের এই ভিন্নভাবে থাকতে দেবে?
৪. নাকি, তারা আমাদের জাতিগত বর্ণগত ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যকে ধুয়ে মুছে ফেলবে?
যারা ভাষাগত টেকনোলজি বা প্রযুক্তি নির্মাণে ও তার উত্তরোত্তর মান-উন্নয়নে ব্যস্ত বা যারা সেগুলির প্রয়োগের জন্য প্রচার করছে (কারণ ভাষাগত প্রযুক্তির ধর্মই হলো যত ব্যবহার হবে, ততই তারা মানব-মনকে বুঝে উঠতে পারবে এবং ধীরে ধীরে আরও উন্নত মানের টেকনিক হয়ে দাঁড়াবে), তাঁরা যুক্তি দেবেন এই ব'লে যে হয়তো বহুল প্রচার ও বাজারের স্বার্থে কিছু কিছু প্রযুক্তি অসাবধানতাবশত বৈচিত্র্য মুছে ফেলার ক্ষেত্রে অবদান রেখে থাকতে পারে, তবে এটি প্রযুক্তির কোনও অন্তর্নিহিত গুণ নয়, অবিচ্ছেদ্য চরিত্র নয়। কে এবং কোন উদ্দেশ্যে সরঞ্জামগুলি তৈরি করে অথবা কোন ধরনের ব্যবহারে তাদের কাজে লাগে এবং কেন লাগে এসব তাদের উপরই নির্ভর করবে।
সত্যি কথা বলতে কি, প্রযুক্তির পক্ষের বা সমর্থনে যুক্তি হলো তা নিজের মতো করে বিভিন্ন উপায়ে বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি উভয় কাজই করবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে, দেখা যাক প্রযুক্তি কী কী করতে পারে:
প্রথমত, সংস্কৃতি সংরক্ষণঃ বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং ইতিহাস নথিভুক্ত তথ্য সংরক্ষণের জন্য যে গবেষণা হয়ে থাকে, তার কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল আর্কাইভ, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ভার্চুয়াল জাদুঘরগুলি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় সহায়তা করতে পারে। একথা আজ আর কারুর অজানা নয়।
দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক যোগাযোগঃ বেশ কিছু প্রযুক্তি এমন হয় যে তারা বিভিন্ন পটভূমির মানুষকে ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম ক'রে সংযোগ এবং যোগাযোগ করতে ও করাতে সক্ষম এটা আজ আর অজানা নয়। বরং আজকের গল্প সিনেমা তৈরি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক, ভাষাবিদ ও নভশ্চরেরা কীভাবে আকাশযানে অন্য বিশ্বের মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারে তা নিয়ে। ফলে, প্রযুক্তি আমাদের ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ঐতিহ্যের বিনিময়কে সহজতর করতে পারে, বৈচিত্র্যের জন্য আরও বেশি সদর্থক চিন্তা-ভাবনা গড়ে তুলতে পারে।
তৃতীয় উপযোগিতা হলো ‘পহুঁচ’ (reach) বাড়ানো বা প্রযুক্তিকে অ্যাক্সেস- যোগ্য ক’রে তোলা। প্রযুক্তির অগ্রগতি (technological progress) প্রতিবন্ধী-সহ বিভিন্ন পটভূমির ব্যক্তিদের জন্য তথ্য এবং নিয়ম-কানুন, পরিষেবা ও সব ধরনের সংস্থানগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে - যাকে আমরা ইংরেজিতে বলব আরও বেশি ‘অ্যাক্সেস’যোগ্য করে তুলেছে - সর্বত্র। আমরা কাউকে ধরাধরি না করেও সেখানে সোজাসুজি অন্তর্জালের মাধ্যমে পৌঁছতে পারছি। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ ক’রে দিয়ে প্রযুক্তি যেকোনো ক্ষেত্রে ও প্লাটফর্ম-এ আমাদের অংশীদারি ও অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়।
বৈচিত্র্যময় প্রতিনিধিত্বঃ প্রতিটি প্রযুক্তি আত্মপ্রকাশের জন্য কোনো না কোনো সচল সহজলভ্য প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে এবং এভাবে সবার কাছে সহজলভ্য হয়ে সেইসব মানুষজন ও সমাজের কণ্ঠস্বরকে জোরদার ও প্রশস্ত করে যারা পিছিয়ে রয়েছে। ফলে কম প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠীগুলিকে তারা আরো অনেক ক্ষমতাশীল করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন ফোরাম এবং ডিজিটাল গল্প-বলা ব্যক্তিদের তাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে সাহায্য করতে পারে। এবং ঠিক এভাবেই প্রযুক্তিগুলি আজ আমাদের পরম্পরায় যত স্টেরিওটাইপগুলি জড়ো হয়েছে এত কাল ধরে, তাদের চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম করে।
যাইহোক, একথা মানতেই হবে যে বৈচিত্র্যের উপর প্রযুক্তির প্রভাব কীভাবে স্থাপন করা যেতে পারে এবং অন্যপক্ষে কে এবং কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করবে তার উপর নির্ভর করবে দেশের, দশের, অর্থনীতির পরিবর্তন কোন পথে আসবে বা আসতে চলেছে - পরবর্তী কালে আমরা বুঝতে পারব যে তা সদর্থক হবে না নঙর্থক। পক্ষপাতিত্ব এবং বৈষম্য মোকাবেলার সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়া, কিছু প্রযুক্তি অসাবধানতাবশত বিদ্যমান বৈষম্যকেই স্থায়ী করতেও পারে বা বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। অতএব, প্রযুক্তি যাতে বৈচিত্র্য মুছে ফেলার পরিবর্তে ইতিবাচক অবদান রাখে তা নিশ্চিত করার জন্য প্রযুক্তি শিল্পেই কিছু নৈতিক অনুশীলন, বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নকশার নীতিগুলি প্রচার করা আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আজকাল তাই AI-এর এথিক্স বা নীতিশাস্ত্র নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে।
২. প্রযুক্তি কখন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হবে
এটাও সত্যি, এবং অনেক মানুষ অভিযোগও করেন যে প্রযুক্তিগুলি আমাদের অদ্যাবধি প্রচলিত (আজ অবধি চলে আসছে এমন) নিয়মগুলিকে ব্যাহত করে ও এমনও বলা হয়ে থাকে যে এগুলি যেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উদ্দেশ্যেই সেগুলিকে তৈরি করা হয়েছে। তারা বিদ্যমান নিয়ম, ব্যবস্থা এবং শিল্পগুলিকে যেন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে এবং চ্যালেঞ্জ করে। একদিক থেকে, এটি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক, উভয় পরিণতি-সহ “মানুষের দ্বারা” ও “মানুষের প্রতি” একটি বিঘ্নজনক উদ্ভাবনও বটে। এই কথাগুলি কিছুটা ভারী ও দুর্বোধ্য মনে হতে পারে, তাই একথাগুলিকে বুঝতে গেলে দেখা যাক কীভাবে ও কতভাবে প্রযুক্তি আমাদের পক্ষে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে :
প্রথমত,যে কোনও বিঘ্নজনক প্রযুক্তি (disruptive technology) এমন এমন উদ্ভাবনী ধারণাগুলি থেকে উদ্ভূত হবে যা যেকোনো পরম্পরাগত জ্ঞান বা স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবেই। যে-কোনো প্রাচীন ও মহান সভ্যতার সমস্ত সাংস্কৃতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হল বিদ্যমান সমস্যাগুলির নতুন সমাধান প্রদান করা বা সম্পূর্ণ নতুন সুযোগ তৈরি করা, যা আগে অকল্পনীয় ছিল। এখন এর সদর্থক দিকও রয়েছে কেননা নতুন কিছু গড়তে গেলে পুরোনো ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে ফেলেই তা করা সম্ভব। 'বিঘ্ন' মানে এক্ষেত্রে বিপজ্জনক বা বিপদ ঘটানোর জন্য প্রযুক্তির কথা বলা হচ্ছে না, এই অর্থে যাকে আজকে পশ্চিম বিশ্ব 'ডিসরাপটিভ' বলছেন (আমরা অনুবাদে বলছি 'বিঘ্ন-জনক'), তারা যেন আমাদের জমে থাকা বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে গোড়া থেকে ধরে তুলে ফেলে আমাদের ঝাঁকিয়ে একটা নতুন কিছু ভাবার বা তৈরি করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত,এখানে বিদ্যমান নিয়ম, আইন, ব্যবস্থা এবং অনুশীলনের 'দক্ষতা' এবং সেগুলির 'উন্নতি'-রও একটি প্রশ্ন উঠবে। যাকে আমরা আজকে 'বিঘ্ন'জনক বা 'ডিসরাপটিভ' প্রযুক্তি বলছি সেগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা, কার্যকারিতা এবং অ্যাক্সেসযোগ্যতাকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করতে পারে। প্রক্রিয়াগুলিকে সুবিন্যস্ত ক’রে, খরচ হ্রাস ক’রে বা সুবিধা বৃদ্ধি করে, এগুলি আমাদের জীবনযাপন ও কাজের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির দিকেও পরিচালিত করতে পারে। এই দিক থেকে দেখতে গেলে ইংরেজি 'ডিসরাপটিভ' কথাটির বাংলা অনুবাদ 'বিঘ্ন'জনক প্রযুক্তি ঠিক নয়। কিন্তু এর থেকে ভালো কোনো সংজ্ঞার সন্ধান পাওয়া গেলে আমরা সেটা পাল্টে দেব। আপাতত, বিষয়টা বোঝাতে পারলেই হলো।
তৃতীয়ত,‘ক্ষমতায়ন”-এর (empowerment) প্রশ্নও রয়েছে। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে বলতে হয় - কিছু বিঘ্নজনক প্রযুক্তি সম্পদ, তথ্য এবং সুযোগগুলিতে প্রবেশাধিকারকে ‘গণতান্ত্রিক’ ক’রে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়িত করে, অর্থাৎ তাদের হাতে ক্ষমতা এনে দেয় বা তাদের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে সেই সব সত্যিকারের পদ্ধতি ও ঘটনার কথা যেখানে দেখা যাচ্ছে যে একটি বন্ধু অন্য বন্ধুকে যে প্রযুক্তি-পদ্ধতিতে যোগাযোগ করতে পারে এমন পিয়ার-টু-পিয়ার প্ল্যাটফর্ম বা মানব-বাঁধন তৈরি করতে পারে যেখানে সাধারণ মানুষজনের থেকে কোনো কাজের জন্য জোগাড় করা ধনরাশি, যাকে ইংরেজিতে বলে 'ক্রাউডফান্ডিং’ পাওয়া সম্ভব। আর এভাবেই অনেক 'মুক্ত-স্রোত' পদ্ধতি বা ওপেন সোর্স সফ্টওয়্যার তৈরি হয়েছে - যা মানবসম্পদ উন্নয়নে নাগরিক সমাজের প্রচেষ্টা সহ সমস্ত ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে বৃহত্তর অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা করতে সক্ষম হবে।
চতুর্থত,পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার এই ব্যাপারটা যে-কোনো গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বিকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে বাস করে। সমাজ ও অর্থনীতি ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে এবং এইসব নব নব তথাকথিত 'ডিসরাপটিভ' (বিঘ্নজনক) প্রযুক্তিগুলি এই পরিবর্তনগুলির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের সহায়তা করতে পারে। তারা যে-কোনো সমাজ, সমূহ ও গোষ্ঠীর পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং চ্যালেঞ্জগুলির প্রতিক্রিয়ায় নমনীয়তা, স্থিতিস্থাপকতা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে।
এখানে এটাও স্বীকার করা জরুরি যে, এইসব উদ্ভাবনী ('বিঘ্ন'সৃষ্টিকারী) প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকও থাকতে পারে, যেমনঃ (১) এটির প্রভাব এমন হতে পারে যে তা কোনো জাতিগত গোষ্ঠী বা বিশেষভাবে দক্ষ গোষ্ঠীর সদস্যদের চাকরি হারানোর জন্য দায়ী হতে পারে বা তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে বিচ্যুত ক’রে ‘স্থানচ্যুতি’র দিকে নিয়ে যেতে পারে। অটোমেশন এবং ডিজিটালাইজেশন কোনো কোনো শিল্পে মানুষের বিকল্প খোঁজা বা মানুষের বদলে যন্ত্রের ব্যবহারের মতো কোনো নীতি - বা, প্রতিস্থাপনের দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা অনেকের জীবিকাকে প্রভাবিত করতে পারে। এই মানুষের চাকরি হারানো বা জীবিকা হারানোর বিষয়টি একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; (২) এটি আরও অন্য ধরনের আর্থ-সামাজিক ব্যাঘাতও সৃষ্টি করতে পারে; (৩) নৈতিক বিবেচনার বিষয়টিও রয়েছে। এই ধরনের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, ন্যায্যতা এবং জবাবদিহিতা সম্পর্কিত নৈতিক প্রশ্নও উত্থাপন করতে পারে। তথ্যের অপব্যবহার, বীজগাণিতিক অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত এবং অনিচ্ছাকৃত পরিণতির মতো বিষয়গুলির যত্ন সহকারে সমাধান করা দরকার - নাহলে অন্যায় করা হবে ; (৪) এর একটি 'সাংস্কৃতিক প্রভাব'ও থাকতে বাধ্য, কারণ প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ সাংস্কৃতিক নিয়ম ও মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যা কখনও কখনও আমাদের সামাজিক উত্তেজনা বা পরিবর্তনের প্রতিরোধের দিকেও পরিচালিত করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত, কোনো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন উপকারী হবে না ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে তা নির্ভর করবে এটি কীভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে তার উপর, সেইসাথে এটি মানুষের কল্যাণ, সমতা এবং স্থায়িত্বকে কতটা উন্নীত করে তার উপরেও। ইতিবাচক সামাজিক রূপান্তরের জন্য 'বিঘ্ন'জনক প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উদ্ভাবন এবং দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাটা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর আবার একটা নেতিবাচক দিকও আছে। এই সমস্ত কিছু এক ধরনের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। এর ফলে ভাষাগত অবলুপ্তি বা মাতৃভাষা পরিত্যাগের দিকেও মানুষ পরিচালিত হতে পারে। অবশ্যই, 'সাংস্কৃতিক অবক্ষয়' ধারণাটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত মতামতের ব্যাপার হতে পারে, এতে মতভেদ থাকতেই পারে যা কোনো না কোনো বিষয়ে হতে পারে। এবং সবই নির্ভর করবে আমরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বা কেমন দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিষয়টির ব্যাখ্যা করছি তার উপরে।
৩. যেক্ষেত্রে প্রযুক্তি সংস্কৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে
সম্ভাব্য অবক্ষয় বোঝার জন্য, আসুন কিছু উদাহরণ নেওয়া যাক যেখানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সংস্কৃতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রথমত, উপার্জনের ঐতিহ্যবাহী উপায় যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এমন কোনও বিশেষ সম্প্রদায় বা পরিবার বা কোনও জাতি বা গোষ্ঠী - এমন সব দক্ষতা ও অনুশীলনের ক্ষতি হতে পারে যা তাদের একেবারে নিজস্ব কৌশল। দেখা যাচ্ছে, দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুশীলন, রীতিনীতি, দক্ষতা এবং আচার-অনুষ্ঠানের পতন বা পরিত্যাগের দিকে যেন আমাদের ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা আমাদের এমনভাবে পরিচালিত করতে পারে, যেখানে সৃজনশীলতা থাকার দরকার নেই - আগেকার প্যাটার্ন বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেই কাজ চলে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল বিনোদনের প্রচলন, যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষজন পরস্পরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন "রীল" দেখে চলেছে নিজেদের মুঠোফোনে। এর ফলে, পারফর্মিং আর্টস বা গল্প বলার ঐতিহ্যবাহী রূপগুলির প্রতি আগ্রহ হ্রাস করতে পারে; অথচ, এও সত্যি যে একশো বছরের ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তিগত অনুষ্ঠানের পরে আমরা বুঝতে পেরেছি যে থিয়েটার এবং পারফরম্যান্সের কোনও বিকল্প নেই।
দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতির সমজাতীয়করণ - যেখানে সব বিভেদ মুছিয়ে ফেলে সবাইকে এক-জাতীয় করে তোলা হবে, এমনটা দেখার সুযোগও রয়েছে। এটা সত্যি যে প্রযুক্তি দ্বারা সমর্থিত বিশ্বায়ন কখনও কখনও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের ক্ষয়ের কারণ হতে পারে, যেখানে স্থানীয় ঐতিহ্য এবং পরিচয় প্রভাবশালী বৈশ্বিক প্রবণতাগুলির দ্বারা আগ্রাসিত হয়, অথবা তার দ্বারা ছাপিয়ে যায়। এর ফলে বৈচিত্র্য হ্রাস পেতে পারে এবং সর্বক্ষেত্রে একটা অনন্য সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হ্রাস পেতে পারে। এই সম্ভাবনা বা তত্ত্বটা কতটা সমর্থনযোগ্য তা ভেবে দেখতে হবে।
তৃতীয়ত, ‘গণমাধ্যমের’ উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আবার পাল্টা-উৎপাদনশীল (counter-productive) হতে পারে। তথ্য এবং বিনোদনের জন্য ডিজিটাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের উপর বর্ধিত নির্ভরতা এই ধরনের ধারণার প্রসারে অবদান রাখতে পারে যা কোনো বিজাতীয়, বিদেশী বা বিভাষী ‘মানক’কে বা এলিয়েন স্ট্যান্ডার্ড-কে এবং তার অনুরূপ সমজাতীয় সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তুকে নিশ্চিত করে। মানে, আমাদের মতো করে মাপলে চলবে না, "ওদের" মতো করে ওদের স্কেলে মাপতে হবে। এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা, বা টেলিভিশন চ্যানেল বা পরিবেশন সংস্থাগুলি প্রায়শই অনুরূপ থিম্যাটিক এবং বিষয়বস্তু নিয়ে আসে যা অনাবিষ্কৃত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে থেকে এলে পরে হয়তো 'খুব নতুন' ধরনের হতে পারত। তা না হলে এটি মূলধারার আখ্যানগুলির প্রাধান্য এবং বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির প্রান্তিকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই পুরো ব্যাপারটা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সৃজনশীলতাকে বেশ ভালোমতো দমিয়ে দিতে পারে।
চতুর্থত, ভোগবাদ এবং বস্তুবাদ প্রায়ই একটি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের ভাগ্য নির্ধারণ করে। বিজ্ঞাপন এবং বিপণনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রায়শই ভোগবাদ এবং বস্তুবাদকে উন্নীত করে, আর এমন প্রশ্রয় দেয় যা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতা বা সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিবর্তে ভোগ এবং বস্তুগত সম্পদের চারপাশে চক্রবৎ ঘুরতে থাকা একটা ‘অপসাংস্কৃতিক’ মূল্যবোধ তৈরি করে। এটি আমাদের ধীরে ধীরে একটি 'অগভীর', বা 'বস্তুবাদী' সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যেতে পারে যার কোনো গভীর অর্থ এবং সার্বভৌম উদ্দেশ্য থাকবে না।
পঞ্চমত, অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত বিশ্ব যা ইদানীং ‘গ্লোবাল সাউথ’ নামে জনপ্রিয়, তার সঙ্গে প্রথম বিশ্বের যে একটা বিরাট ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ রয়েছে, সেই বিষয়টিকে সাংস্কৃতিক কর্মীদের আরেকটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট অথবা সাজানো তাক-লাগানো মন্তব্য হিসেবে সহজভাবে গ্রহণ করা যায় না। প্রযুক্তিতে অসম পরিস্থিতির ফলে যার উচ্চতর প্রয়োগবিধির বিশাল ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার নেই, অ্যাক্সেস নেই, সে এই বিদ্যমান অসমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং এমন একটি ডিজিটাল বা সংগণনের বিভাজন তৈরি করতে পারে, এর ফলে যেখানে কোনো কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে বা গোষ্ঠীকে বা জনসংখ্যাকে ডিজিটাল বিশ্বের হাজারো লাখো সুযোগ সুবিধা পাওয়া থেকে, সেইসব কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়। এটি তথ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সুযোগগুলিতে অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে আরও স্থায়ী করে তুলতে পারে, যা সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং ক্ষমতার গণতন্ত্রীকরণকে প্রভাবিত করে।
ষষ্ঠত, আমরা দেখতে পাই যে প্রায় ব্যাপক স্তরে সামাজিক বন্ধনের ক্ষয় হচ্ছে। অনিবার্য কিন্তু প্রায় আসক্তিমূলক ডিজিটাল যোগাযোগ এবং মনোযোগ আকর্ষণকারী সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচলন সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার ঐতিহ্যগত রূপের ক্ষয় নিশ্চিতভাবে ঘটাতে পারে। ভার্চুয়াল সংযোগগুলি মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়াগুলির জন্য একটা বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে পারে, যার ফলে বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব এবং অনেকের সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে সংযোগ-বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুভূতি হয়। এটি এমন নির্জন মুহূর্ত যখন মানুষকে তার স্বাতন্ত্র্যবোধ, তার নিজস্ব ঐতিহ্যগত পদ্ধতি এবং পরস্পরের সঙ্গে মুখোমুখি এবং বাস্তব বা সত্যিকারের যোগাযোগের গুরুত্ব কতটা তা বুঝিয়ে দেয়।
এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কিন্তু যেমনভাবে সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং সত্যতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনি এটির সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন, উদ্ভাবন এবং ক্ষমতায়নের সুযোগও ক'রে দিতে পারে। চিন্তাশীলভাবে এবং অন্তর্ভুক্তির কথা মনে রেখে (অর্থাৎ কেউ যেন বাদ না পড়ে যায় সেদিকে চোখ রেখে) গঠনমূলকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করে, সম্প্রদায়গুলি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুবিধাগুলি গ্রহণ করার সাথে সাথে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার এবং উদযাপনও করতে পারে।
উদ্ভাবনের আলিঙ্গনের সাথে ঐতিহ্যের সংরক্ষণের ভারসাম্য বজায় রাখা হল সঠিক সাংস্কৃতিক বিবর্তন যা নিশ্চিত ভাবে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
৪. এই 'বিকৃতি'গুলি আসে কোথা থেকে?
একথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে 'বিকৃতি'র (distortion) একটা নিজস্ব শক্তি আছে বা আকর্ষণ আছে। প্রশ্ন হলো : বিকৃতি কোথা থেকে আসে, যা হঠাৎ হঠাৎ চলে এসে প্রায়শই সাংস্কৃতিক পরিবেশকে বিরক্ত করে বা বিনষ্ট করে? হতে পারে, আমাদের মনে ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে এই বিকৃতিগুলি বিভিন্ন উৎস থেকে চলে আসছে, প্রায়শই প্রযুক্তি, সামাজিক গতিশীলতা, অর্থনৈতিক শক্তি এবং ব্যক্তিগত আচরণের মধ্যে লুকিয়ে থাকে যে মিথস্ক্রিয়া ও দুঃস্বপ্ন তার থেকে উদ্ভূত হয়। সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক প্রবণতাগুলির মধ্যে একটি হল 'ওয়ার্টি' (Worty) বা 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার' - বছরের হইচই ফেলে দেয়ার মতো সব থেকে চালু হওয়া শব্দ।
এটি একটি প্রযুক্তি-চালিত অনুসন্ধান যা আমাদের বলে যে ২০২৩-বর্ষের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনপ্রিয় বা ব্যবহৃত শব্দ হিসেবে মারিয়াম-ওয়েবস্টারের যা পছন্দ তা হল: 'সত্য-প্রমাণিত' (authentic) - যা হিন্দি-ওলারা বলবে 'সত্যাপিত'। 'প্রমাণিত' - এই শব্দটি সেই বছরের জন্য Google অনুসন্ধানে সাড়ে ঊনপঞ্চাশ কোটি বার এসেছে, এটি এমন একটি অভিব্যক্তি যার উপরে রয়েছে সর্বাধিক অনুসন্ধান করা অবধারণা - 'AI' অথবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (যার খোঁজ করা হয়েছে ১৩৮৮ কোটি বার)। এটা আমাদের সকলের সত্যিকারের সাংস্কৃতিক উদ্বেগের মত মনে হয়েছে। হয়তো আমাদের ক্রমাগত পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে সাংস্কৃতিক 'আদর্শ' থেকে কোনও কারণে আমাদের কোনও বিরাট বিচ্যুতি ঘটেছে কিনা - বিশেষ ক'রে যখন একই সাথে, এই ধরনের বিকৃতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা অপ্রত্যাশিত, সেখানে অবশ্যই কিছু না কিছু চাবিকাঠি থাকতেই হবে।
আমরা এর পিছনে এই সমস্ত চিন্তাধারা বা পরিস্থিতির কথা ভাবতে পারি, কী কী পরিস্থিতি হতে পারে?
প্রথমত, এখানে অবস্থার জন্য বা পরিস্থিতির জন্য কিছু প্রযুক্তিগত প্রভাব থাকতে পারে। অনেক সময়ে, আমরা দেখতে পাই যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির নতুন রূপ, যোগাযোগের ধরন এবং রূপক, এবং এইজাতীয় ধারণাগুলির ব্যাপক ব্যবহার প্রবর্তন করেছে বা মূলভূত পরিবর্তন আনছে। এগুলির সঙ্গে আজকের বিদ্যমান সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং মূল্যবোধের সাথে সংঘর্ষ হতেই পারে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থান কিছু সাংস্কৃতিক প্রবণতাকে প্রসারিত করে, আবার হতে পারে অন্যদের প্রান্তিক ক'রে তোলে, যার ফলে সংস্কৃতিকে কীভাবে অনুভূত এবং প্রেরণ করা হয় তাতে একটা বিরাট পরিবর্তন, বা একটা বিকৃতি তো ঘটবেই।
দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক বাজার এবং ভোগবাদী প্রবণতা দ্বারা চালিত সংস্কৃতির বাণিজ্যিকীকরণ সাংস্কৃতিক প্রতীক, অনুশীলন এবং পরিচয়ের 'পণ্যায়ন' (commodification) ঘটাতে পারে। এর ফলে বাণিজ্যিক লাভের জন্য সাংস্কৃতিক উপাদানের অপব্যবহার বা ভুল উপস্থাপন হতে পারে, তাদের মূল অর্থ ও তাৎপর্য বিকৃত করাও হতে পারে - যদি তাতে বাণিজ্যিক লাভ হয়।
তৃতীয়ত, টেলিভিশন, ফিল্ম এবং বিজ্ঞাপন সম্পর্কিত ‘মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন’ আমাদের সাংস্কৃতিক উপলব্ধি এবং বর্ণনার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন 'বোরোলিন' বিজ্ঞাপনটি শুরুতে অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে বা এআইআর-এ এসেছিল, একটি ঝাঁঝালো গানের সাথে, তখন অনেক মায়ের পক্ষে সেই সুরটি গুনগুন করা অস্বাভাবিক ছিল না - যখন যখন তারা শিশুদের ঘুমানো সহ দৈনন্দিন কাজে নিয়োজিত হতেন - তখনই শোনা যেতো "খুশবুদার এন্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলিন" পঙ্ক্তিটি। যাইহোক, মিডিয়া উপস্থাপনাগুলি প্রায়শই বাণিজ্যিক স্বার্থ, রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং সাংস্কৃতিক স্টেরিওটাইপ দ্বারা প্রভাবিত হয়, যার ফলে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সংস্কৃতিগুলিকে কীভাবে চিত্রিত করা হয় এবং বোঝা যায় তাতে বিকৃতি ঘটে।
চতুর্থত, আমরা প্রায়শই একটি গান বা একটি কবিতা বা একটি নাটকের ‘সাংস্কৃতিক উপযোগিতা’ দেখতে পাই বিজ্ঞাপনের পৃথিবীতে - প্রায়শই আধিপত্য বা প্রসঙ্গের বাইরে যখন তা ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক-কালে সবচেয়ে গোলমাল হয়েছিল যখন ডি.এল. রায়ের দেশাত্মবোধক 'ধন-ধান্য পুষ্প ভরা' গানটি যখন একটি বিল্ডিং গ্রুপ তাদের নতুন পণ্যের প্রচারের জন্য হুগলি নদীর তীরে ব্যবহার করেছিল একটি দৃশ্যশ্ৰব্য প্রচারে যেখানে পরিবর্তিত গানটি গাওয়া মুখগুলি খুব সুপরিচিত চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ছিল। এই মুহূর্তে শ্রীজাতর বক্তব্য তেমনি বহুল প্রচারিত হয়েছে যেখানে একটি জনপ্রিয় হিন্দী টেলিভিশন প্রোগ্রামে রবীন্দ্রনাথের 'একলা চলো রে' গানটির বিকৃত প্যারোডি গাওয়া ও তাতে নাচ হয় – সেই ব্যাপারটি নিয়ে।
এই ধরনের গ্রহণ, বর্জন, বিপণন এবং বিকৃতি তখনও ঘটে, যখন অন্য সংস্কৃতির সদস্যরা তাদের সমাজে বিদ্যমান নয় এমন কিছু সাংস্কৃতিক অনুশীলনকে উপযুক্ত মনে ক'রে সেগুলিকে আমদানি করতে চায় ও করে। বাঙালি পরিবারের বিবাহ উদযাপনে পাঞ্জাবি ‘সঙ্গীত (অনুষ্ঠান)’ প্রবর্তন করা এমনই একটি হালের ঘটমান বর্তমান উদাহরণ। এটি সাংস্কৃতিক প্রতীক, অনুশীলন এবং ঐতিহ্যের অর্থ এবং তাৎপর্যের বিকৃতি ঘটাতে পারে, সেইসাথে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং স্টেরিওটাইপগুলিকে স্থায়ী করতে পারে। অবশ্য, এসবই একেবারে চরম পরিণতি হবে।
পঞ্চমত, এই সব গোলমালের পটভূমিতে কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক মতাদর্শ, সামাজিক আন্দোলন এবং সমাজের মধ্যে ক্ষমতার গতিশীলতাও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বিকৃতিতে অবদান রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি নীতি, সেন্সরশিপ, এবং প্রচার প্রচেষ্টা সাংস্কৃতিক আখ্যান গঠন করতে পারে এবং সমাজের মধ্যে কণ্ঠস্বর এবং দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্যকে সীমিত করতে পারে।
ষষ্ঠত, বিস্থাপন অথবা মাইগ্রেশন এবং এদেশীয়দের পৃথিবীর অন্য দেশে বসবাস করতে থাকা ‘ডায়াস্পোরা’ (হিন্দিতে বলে 'আপ্রবাসী' গোষ্ঠী) সম্প্রদায়গুলি প্রায়ই তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং তাদের নতুন বাসভূমি অথবা যাকে বলা যায় 'স্বাগতিক দেশ' (host country) - সেখানকার সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে একটা জটিল মিথস্ক্রিয়ার নির্মাণের মধ্যে দিয়ে যায়। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ, অভিযোজন এবং পুনর্ব্যাখ্যার দিকে পরিচালিত করতে পারে, কখনও কখনও এর ফলে স্থানীয় এবং গৃহীত উভয় সংস্কৃতির বিকৃতি বা ভুল বোঝাবুঝি হয়।
সবশেষে, আন্তঃপ্রজন্মগত পরিবর্তনও হতে পারে। সাংস্কৃতিক পরিবেশ মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের প্রজন্মগত পরিবর্তনের দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে। যেহেতু তরুণ প্রজন্ম নতুন প্রযুক্তি, জীবনধারা, এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনগুলি স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে, তারা হয়তো তাদের মতো ক'রে ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক নিয়মগুলিকে পুনরায় ব্যাখ্যা করতে বা চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যা সমাজের মধ্যে উত্তেজনা এবং বিকৃতির সৃষ্টি করতে পারে।
আসলে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিকৃতির মোকাবেলা করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন হয় যাতে সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া, বৈচিত্র্য এবং সম্মানের প্রচার জড়িত থাকে, তারই পাশাপাশি তা সাংস্কৃতিক আখ্যান এবং উপস্থাপনা গঠনে প্রযুক্তি, মিডিয়া, বাণিজ্য এবং শক্তির গতিশীলতার ভূমিকাকেও সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা করে। কথোপকথন, অন্তর্ভুক্তি এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা বিকৃতিকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে এবং আরও খাঁটি এবং ন্যায়সঙ্গত সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপ কেমন ক'রে তৈরি করা যায় তা প্রচার করতে সহায়তা করতে পারে।
৫. এই প্রবৃত্তির প্রতিরোধ এবং বিকৃতিকে আটকানোর প্রয়াস
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যেকোনো ধরনের বিকৃতিকে আটকানোর জন্য প্রকৃতপক্ষে একটি ব্যাপক ও বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। প্রথমত, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার প্রচারে শিক্ষামূলক প্রোগ্রামগুলিকে একীভূত করা দরকার, যা সহানুভূতি, বিশ্ব সচেতনতা এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর জোর দেয়। এই প্রোগ্রামগুলি ব্যক্তিদের স্টেরিওটাইপ হিসেবে না দেখে বা যেকোনো ধরনের অতি সরলীকরণের বাইরে অন্যান্য সংস্কৃতির জটিলতাগুলি বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে সহায়তা করতে পারে। এও ঠিক যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মিডিয়ার উপস্থাপনা, পাবলিক ডিসকোর্স এবং শিল্পকলার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে উদযাপন করা উচিত। অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং মূল্যবোধগুলিকে বিশেষ করে প্রকাশে আনাও দরকার যাতে তারা দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে সংকীর্ণ না করে, অথবা সমজাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে প্রসারিত করে।
যেকোনো আধুনিক সমাজে সৃজনশীল শিল্প ও প্রযুক্তির মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক আখ্যান নির্মাণ হয়। এর মধ্যে যাকে আমরা আজকে বলছি নানান সামাজিক সঞ্চার-মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া, তাদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় এর প্রাথমিক বাহন। আমরা আজকাল আর সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝগড়া দেখে আশ্চর্য হই না। যেভাবে ঝগড়া হচ্ছে, তার উল্টোদিকে অনেককে পর্দার এই সব বিতর্কে ঝগড়া মিটিয়ে নিতেও দেখি, তার জন্য যে দাম দিতে হয় দেবেন। ঠিক তেমনি মিডিয়াতে তথ্যের হেরফের দেখে আর অবাক হই না। গণমাধ্যমের চাঞ্চল্যকর উপস্থাপনা অনেক সময়ে কোনো-না-কোনো সমষ্টি, স্বার্থ-গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দল সম্পর্কে জনগণের ধারণাকে বিকৃত করে।
এই ধরনের অবমাননাকে আটকাতে বা এমন অবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য একটি সমালোচনামূলক পদ্ধতির প্রয়োজন, যা মিডিয়া সাক্ষরতা শিক্ষাকে সাধারণ পড়াশোনার সঙ্গে জড়িত করবে; যে কোনো নাগরিকের শ্রুত বা কথিত বা জ্ঞাত তথ্যের উৎসের মূল্যায়ন করতে, এর মধ্যে কোনো পক্ষপাত রয়েছে কি না তা নির্ণয় করতে এবং একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে বের করতে সক্ষম করবে। সেখানে একটি স্বাধীন সাইবার-প্রহরী বা ‘ওয়াচ-ডগ’ অথবা একটি স্বতন্ত্র কমিশন থাকতে পারে যারা নিয়ন্ত্রক নীতিগুলি তৈরি করবে, এবং যা ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত করতে, ক্ষতিকারক স্টেরিওটাইপগুলির প্রভাবকে সীমিত করতে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করতে পারে।
এটা নিশ্চিত যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ এই ধরনের সাংস্কৃতিক বিকৃতিতে একটা প্রধান ভূমিকা পালন করে, যখনই এবং যেখানেই এমন বিকৃতি ঘটবে একটু ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে পরে সেটা আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড এবং বিনোদন শিল্পগুলি প্রায়শই লাভের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতীকগুলিকে ব্যবহার করে, এক্ষেত্রে তাদের মূল উদ্দেশ্য বা অর্থ থেকে ছিনিয়ে নিতে তারা কোনো দ্বিধা করে না, এবং তার জন্য তারা একটুও দুঃখিত বা অনুতপ্ত নয়। এই ব্যাপারটাকে আমরা কিভাবে আটকাব? এটি প্রতিহত করার জন্য, স্থানীয় শিল্পী, ব্যবসা এবং সাংস্কৃতিক উদ্যোগকে সমর্থন করা অপরিহার্য। এমন নৈতিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা যা সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত ঐতিহ্যকে সম্মান করে এবং সম্প্রদায়কে ফিরিয়ে দেয় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির সত্যতা - তার গুরুত্ব অসীম। এসবই সাংস্কৃতিক কথনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্থায়িত্বকে উন্নীত করতে পারে।
আরেকটা ব্যাপার হলো ক্ষমতার দখলের লড়াই যাকে ইংরেজিতে বলে 'পাওয়ার ডাইনামিকস'। এই ক্ষমতা দখলের লড়াই শুধু বাইরের গোষ্ঠী বা সমূহ বা সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘাত নয়, এটা একই ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যে যাঁরা থাকেন, তাঁদের নিজেদের ভিতরের সংঘাতও হতে পারে - যা যেকোনো বহু-জাতিগত দেশে ও বহুভাষী সমাজের মধ্যে হওয়া আশ্চর্য় নয়। একটু ভালো করে লক্ষ করলে পুরোটা বিশ্ব জুড়ে এদের খেলা দেখতে পাওয়া যায়। এটি বিশ্বব্যাপী বিকৃতিকে আরও নিষ্ঠুর, আরও স্থায়ী করতে পারে, কারণ এসবই কোনো না কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর (এবং তাদের পেটোয়া ইতিহাসবিদদের) আখ্যানের মধ্যে রয়েইছে। তাদের প্রকৃতিতেই রয়েছে প্রান্তিক সংস্কৃতির উপর তাদের গল্পকথা, ধ্যান-ধারণা ও তাদের বর্ণনা চাপিয়ে দেওয়া।
কীভাবে সামান্যজন এই ধরনের প্রভাবকে অস্বীকার করবে? অনেকাংশে, জনগণের নীতি, ন্যায্য মিডিয়া অ্যাক্সেস, এবং নিম্ন-প্রতিনিধিহীন কণ্ঠস্বর প্রসারিত করার মাধ্যমে - একথা প্রচার করা হয় যে এই তো, প্রতিনিধিত্বে সবার মধ্যে সমতা রয়েছে - এই ভারসাম্যহীনতাগুলিকে মোকাবেলা করতে হতে পারে। যা প্রয়োজন তা হল উন্মুক্ত সংলাপ - খোলা মত-বিনিময় এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ব্যবস্থা করা। এই ধরনের পদক্ষেপগুলি সমাজে সবার অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করে এবং ভুল বোঝাবুঝি হ্রাস করে। যদি পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক বিনিময় তৈরি হয় তাহলে তো বহুতারই জয়। যদি তা সম্ভব হয় এবং যখন এটি ঘটবে, তখন তা যেকোনো দেশকে একটি সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ-নির্মাণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এমন সব পদক্ষেপ থেকে একটি আরও খাঁটি এবং ন্যায়সঙ্গত সাংস্কৃতিক ছবির নিৰ্মাণ সম্ভব হবে৷
৬. ভাষিক সমাজের অবক্ষয়
ভাষার অবক্ষয়ের যে বিশেষ দৃষ্টিকোণ রয়েছে তাকে যোগ করা সাংস্কৃতিক বিকৃতি সম্পর্কে আমরা যা বলেছি তাকে আরো বিস্তারের দিকে নিয়ে যায়। আমরা জানি যে ভাষা মানব-সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয়; ভাষা অভিব্যক্তি এবং সংরক্ষণের একটি মৌলিক উপাদান হওয়ায়, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব বা সৃষ্টি হতে পারে যেখানে ভাষাগুলি তাদের সমৃদ্ধি, স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলবে বা তারা বিলুপ্তির সম্মুখীন হবে। এমনিতে এই ব্যাপারটা প্রায়শই সাংস্কৃতিক সমজাতকরণ, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনেরই জন্য হয়। দেখা যাচ্ছে যে মাত্র কয়েকটি বৈশ্বিক ভাষার আধিপত্যের ফলে মিডিয়া এবং বাণিজ্য যেখানে আমাদের বিনাশের দিকে ধাক্কা দিতে থাকে। এই অধঃপতন যেকোনো অনন্য সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ঐতিহ্যগত জ্ঞান এবং প্রকাশের পদ্ধতিকে অবলুপ্তি ও ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা সাংস্কৃতিক বিকৃতিকে আরও প্রসারিত করবে। এই কাঠামোর মধ্যে ভাষার অবক্ষয় মোকাবেলা করার জন্য, সাংবিধানিক গ্যারান্টির মাধ্যমে ভাষাগত বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করা এবং ভাষা সংরক্ষণকে সরকারিভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে জনহিতকর প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রচার করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এর মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা, ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন প্রকল্প এবং মিডিয়া প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে বিপন্ন ভাষার সমর্থক অধ্যয়ন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। অন্য কথায় বলতে গেলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী সম্প্রদায়গুলিকে ছোটখাট ভাষা-গোষ্ঠীগুলিকে বিভ্রান্তিকর হিসাবে না দেখে তাদের লালন করা এবং সম্মান করতে শিখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, পাঠ্যক্রম এবং মিডিয়াতে আদিবাসী ভাষা এবং উপভাষাগুলিকে একীভূত করা ভাষাগত বৈচিত্র্য বজায় রাখতে এবং সেই ভাষাগুলির সাথে আবদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিচয় বৈধ করতে সহায়তা করতে পারে। সেই প্রেক্ষাপটে, মধ্যস্থতাকারী বা অনুবাদকদের সাথে ছোট বক্তৃতা গোষ্ঠীর গল্প বলার সেশনগুলি একটি বড় সাহায্য হতে পারে।
ভাষার উপর প্রযুক্তির প্রভাব, বিশেষ করে গ্লোবাল মিডিয়া এবং ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক এবং প্ল্যাটফর্মের উত্থানের সাথে যা প্রায়শই ইংরেজি বা অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষাকে প্রায় অনিবার্য বা ডিফল্ট হিসেবে মেনে নেয়, তার ফলে যে ভাষা সরলীকরণ হতে থাকে তার প্রভাবে স্থানীয় উপভাষার ক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। প্রায়ই যখন আমরা "ঘাতক ভাষাসমূহের" (killer languages) বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা শুনি, তখন এই ছবিটিই আমাদের মনে আসে। অনলাইনে বহুভাষিকতাকে উৎসাহিত করা, অনুবাদের সরঞ্জামগুলি অফার করা এবং সংখ্যালঘু ভাষার জন্য ডিজিটাল সঞ্চয় তৈরি করা - এসব এমন কিছু কৌশল যা এই অবক্ষয়ের প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। মিডিয়া সাক্ষরতা শিক্ষাও সচেতনতাকে উৎসাহিত করতে পারে। কীভাবে কোনো ভাষা তার পছন্দের সাংস্কৃতিক উপলব্ধিকে রূপ দেয়, তা বোঝাবার জন্য সাধারণ মানুষের জ্ঞাতার্থে অনেক সময়ে সেই সব ভাষাদের একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক চিত্রায়ন করা দরকার হয়।
ভাষার অবক্ষয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার গতিশীলতার সাথেও জড়িত, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে উপনিবেশিত বা প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলি আর্থ-সামাজিক গতিশীলতার জন্য প্রভাবশালী ভাষাগুলিকে নিজেদের ভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য চাপ অনুভব করতে পারে, প্রায়শই তাদের মাতৃভাষার বদলে আদমশুমারিতে যা দেখা যায়। আমরা অনেক উন্নয়নশীল আফ্রিকান দেশে এটি ঘটছে বা ঘটেছে এমনটা লক্ষ্য করেছি। দ্বিভাষিক সংকেত, সংখ্যালঘু ভাষার সরকারি স্বীকৃতি এবং ভাষা ও স্ক্রিপ্ট পুনরুজ্জীবনের জন্য অর্থায়নের মতো ভাষাগত অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং সমর্থন করে এমন নীতির প্রচার এই সম্প্রদায়গুলিকে ক্ষমতায়ন করতে পারে। এর ফলে, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মূল প্রমাণ হিসেবে ভাষাগত বৈচিত্র্যকে বৈধ বলে দেখতে হবে ও তার সংরক্ষণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ছবিটা স্পষ্ট করে ফুটে উঠবে। আর এমনটা হলেই একটি ন্যায়সঙ্গত বহুবাচনিক সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপকে সমর্থন করা যাবে। ছোট ছোট ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষজন এ বিষয়ে আরও উদ্যোগের দাবি জানান। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের উদ্যোগে ভাষা সংরক্ষণের প্রচেষ্টাকে অন্তর্ভুক্ত করা আন্তঃসাংস্কৃতিক কথোপকথনকে আরও সমৃদ্ধ করা এসবের সহায়ক হয়, এবং প্রত্যেক ভাষা সম্প্রদায়কেই তাদের ধারণাগুলির একটি বিস্তৃত এবং খাঁটি বিনিময়ের অনুমতি দেয়। এইভাবে, ভাষার অবক্ষয়ের মোকাবেলা সাংস্কৃতিক বিকৃতিকে প্রতিরোধের আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায়। এসবের ফলে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রচারে এই সব পদক্ষেপ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
যদিও সমস্ত ভাষা পরিকল্পকদের জন্য সব থেকে বড় সমস্যা হলো সমন্বয়-সাধনের চ্যালেঞ্জ - তারা কাগজে-কলমে যা চায় বা যা বলে এবং ভাষিক সম্প্রদায়গুলি যা চায় তার মধ্যে তাদের একটি সেতু তৈরি করতে হবে। ইউনেস্কো আমাদের বলেই দিয়েছে - "সব ভাষাই গুরুত্বপূর্ণ!" বা "ভাষা মাত্রেই গুরুত্বপূর্ণ"!”১ তাই, 1986 সালের ভারত সরকারের শিক্ষা সংক্রান্ত নথিতে (National Policy on Education: Programme of Action)২ ভাষা শিক্ষার উপর এত জোর দেওয়া হয়েছিল : শিক্ষা মন্ত্রকের (ভারত সরকার) কর্মসূচী এবং মানবসম্পদ মন্ত্রক দ্বারা ইদানীং কালে তৈরি জাতীয় শিক্ষা নীতি 2020 (NEP2020)৩ উভয় ক্ষেত্রেই সম্প্রতি ভাষাসমূহের উন্নয়নের উপর জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন উদ্বিগ্ন পিতামাতার কাছে মাতৃভাষার এই গুণটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, তারা হয়তো সেকথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করবে না, গ্রহণও করবে না। তাদের নিজেদের সন্তানদের জন্য প্রশ্ন বা আকাঙ্ক্ষা এমন শিক্ষার জন্য হবে যা শিশুকে দক্ষতার সাথে দ্রুত সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে সাহায্য করবে বা যতটা সম্ভব কম সময়ে একটি শালীন জীবনযাপন করতে সাহায্য করবে। যদি আদৌ মাতৃভাষায় সাক্ষরতা এবং এর উপযোগিতা বুঝতে হয়, তবে আমাদেরকে ফ্রান্সিস কোডি (2013) দ্বারা উল্লিখিত উদাহরণগুলির দিকে নজর দিতে হবে। এখানে, দলিত মহিলারা তামিলনাড়ুর প্রত্যন্ত কোণে অনেক কষ্টে পড়তে এবং লিখতে শিখেছিল শুধু এই জন্য যে তারা যাতে তাদের মৌলিক প্রয়োজন সম্পর্কে সপ্তাহে একবার জনতা দরবারে জেলা কালেক্টরের কাছে সমষ্টিগত প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়: তারা এমন নিয়মের সমর্থন চাইছিল যাতে তারা এমন জমি পাবে যেখানে তাদের মৃতদের কবর দিতে পারবে - “to get passage to the land where they could bury their dead”৪ .
উপসংহারে, আমি শুধু একথাই বলতে চাই যে সম্প্রতি মহীশূরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস-এ ৫৩তম প্রতিষ্টা দিবসের বক্তৃতায় আমি যা বলেছিলাম তা পাঠকদের মনে করাতে চাই, এ হলো যা গত কয়েক হাজার বছর ধরে যা ঘটছে তার একটি উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ। যেহেতু আমরা আমাদের ভাষার জন্য লেখার একটা পদ্ধতি - যাকে আমরা লিপি বলছি, তার আবিষ্কার করেছি:
"আজ, প্রধানত 'মৌখিক' এবং 'চিরোগ্রাফিক' (লিপিনির্ভর) সংস্কৃতির সহ-অস্তিত্ব আমাদের কাছে একটি সাধারণ জ্ঞান। যেখানে বাচন জ্ঞান ও সৃজনশীলতার মৌখিক চাষের জন্ম দিয়েছে কমপক্ষে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, সেখানে লেখার প্রচলন হয় দেখা যাচ্ছে কেবল ছয় হাজার বছর আগে।
তারপর থেকে, উভয়ই সহ-অবস্থান করেছে - কখনও কখনও পারস্পরিক একচেটিয়া সমাজে, এবং কখনও কখনও - আরও সাধারণভাবে, আমাদের অনেক আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে - জোর কদমে, একসাথে। ইলেকট্রনিক যুগের আবির্ভাবের সাথে প্রতিটি ঐতিহ্যের গুণাবলীর সাথে তারাও অনেকাংশে মিশে গেছে। এই কথাটা ভুলে চলবে না। ” (Singh, ২০১৯)
গ্রন্থনির্দেশ:
Cody, Francis. (2013) The Light of Knowledge: Literary Activism and the Politics of Writing in South India. Ithaca: Cornell University Press.
Singh, Udaya Narayana Singh (2019) ‘Linguistic Utopia: Nostalgia for the Future.’ 53rd Foundation day Lecture, delivered at the CIIL, Mysuru; July 17.
১) 2008 সালে UNESCO ধারাবাহিক কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, যা জাতিসংঘে একটি ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয়েছিল, যেখানে আমাকে তিনজন বিশেষজ্ঞের একজন হিসাবে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এছাড়াও, দেখুন:: https://www.sil.org/about/why-languages-matter or Pearson (UK) position at https://www.pearson.com/uk/educators/schools/subject-area/modern-languages/why-languages-matter.html
২) https://www.education.gov.in/sites/upload_files/mhrd/files/upload_document/npe.pdf
৩) https://www.education.gov.in/sites/upload_files/mhrd/files/NEP_Final_English_0.pdf
৪) এছাড়া ফ্রান্সিস কোডি (2013) বর্ণিত কাট্রামপট্টিতে অ্যারিভোলি আইয়াক্কামের অধীনে কার্যক্রম দেখুন: The Light of Knowledge: Literacy Activism and the Politics of Writing in South India. Cornell University Press.