—তোমার না সবটাতেই বাড়াবাড়ি। কতবার বললাম, গত জন্মদিনে তোমাকে যে লাল শাড়িটা উপহার দিয়েছি, ওটা পরে এসো। গতকালও বাড়ি যাবার আগে বলে দিয়েছি, রাতে টেলিফোন করেও বলেছি, সকালে মেসেজ লিখে পাঠিয়েছি, তবু আমার একটা কথা রাখলে না তুমি!
—লালই পরতে হবে কেন? আজ কী বিশ্ব লাল-দিবস, জনাব?
—তেমন কোনো দিবস-টিবস জানি না। কিন্তু আজ তোমাকে আমি লাল গোলাপের মতো উজ্জ্বল রূপে দেখতে চেয়েছিলাম। মানে, আমার মন চেয়েছিল আরকি।
—লাল রং তোমার প্রিয় হলেও আমার পছন্দ না। আর তাছাড়া তুমি বললেই আমাকে গোলাপ, বেলি, মাধবীলতার মতো করে ফুটতে হবে কেন? আমার তো ঘাস হতেই বেশি ভালো লাগছে আজ।
—আচ্ছা, ঘাস হয়েও মন্দ করোনি কিন্তু। পার্কে বসে বাদাম খাওয়ার সময় আচমকা গড়িয়ে নিই যার বুকে, সে তো ওই সবুজের মাঠটাই, তাই না! আজ তাহলে ঘাস মনে করে তোমার বুকে মাথা রাখতে দিও।
—জি না। এসব বায়না করে লাভ নেই মশাই। আমি যদি ঘাসের মাঠ হই তাহলে আমার প্রতিটি ডগায় একটা করে লাল পিঁপড়া আছে। ধরতে এলেই কামড়ে দিবে তোমাকে।
—আমি তাহলে বাতাস হবো আগে। তীব্র বাতাসে তোমাকে দোলাব আমার দিকে। স্বেচ্ছায় তুমি হেলে পড়বে আমার কোলে।
—তার আগে, ওই বাদামওয়ালাকে একটু ডাকো তো। চীনাবাদামের জন্য প্রাণ কেমন করছে। আমার কাছে এই মুহূর্তে তোমার চেয়ে ওই বাদাম বেচা ছেলেটাকেই বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।
—আমি জানি, প্রেমিকার আদেশের সামনে প্রেমিককে সর্বদা নতজানু থাকতে হয়। আমি তার অন্যথা করি, সে সাহস কোথায় আছে বলো। এই ছেলে, এই বাদাম, এদিকে এসো তো!
—দেখো সরফরাজ, মানুষের জীবনটা অনেকটা এই বাদামের মতো। একটা গরম কড়াইয়ে উষ্ণ বালির সাথে ভাজতে ভাজতে একসময় সে মুচমুচে হয়ে পরিবেশনযোগ্য হয়। তারপর সে সমগোত্রীয়দের সাথে ঠোঙায় ঠোঙায় ভরে পৌঁছে যায় নানা মানুষের মাঝে। একই ঠোঙার ভিতরে একেকটা বাদাম, কিন্তু কোনটার ভিতরে যে তুমি পুরুষ্ট বাদাম পাবে, আর কোনটাতে খোসার ভিতরে ফাংগাস পড়ে আছে, হু নোজ! উল্লাস নাকি হতাশা, কোনটা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য, ইউ ডোন্ট নো ম্যান!
—বাপরে, তুমি এত কঠিন দার্শনিক, আগে জানা ছিল না আমার। এত কিছু থাকতে, জীবনটাকে খোসাওয়ালা বাদামের সঙ্গে তুলনা! বাহ্ বাহ্।
—কেন, আমার চিন্তাশক্তি নিয়ে তোমার সন্দেহ ছিল নাকি আগে? আমি জানতাম না!
—সন্দেহ না সোনা। কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবাসো না।
—কে বলেছে?
—আমি বলছি।
—কীভাবে বুঝলে?
—তাহলে আমি যেমন তোমার সব কথা শুনি, তুমিও মাঝে মাঝে আমার কিছু কথা শুনতে।
—আমি তোমার সব কথা শুনতে পাই। আমি কানে খাটো না।
—আবার ফাজলামো করছ। দুই মাস পর আমাদের বিয়ে। বিয়ের পরে আমরা রাঙামাটি যাব হানিমুন করতে। মনে আছে তো!
—মনে আছে। আগেও বলেছ কথাটা, অন্তত পঞ্চাশ বার।
—ওখানে আমরা প্যাদা টিংটিং-এ থাকব।
—কেমন হাস্যকর একটা নাম, প্যাদা টিংটিং!
—এগুলো চাকমা শব্দ, যার অর্থ পেট টান টান। একটা সেগুন বাগানকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। ওখানে তোমাকে কিছু নতুন খাবার খাওয়াব যেগুলো তুমি ঢাকায় কোনোদিন খাওনি। যেমন বাম্বু চিকেন, বিগল বিচি…
—বিয়ে উপলক্ষ্যে আমার বড় মামা আর দুই খালা আসবেন কানাডা থেকে। উনাদেরকেও সাথে নিয়ে গেলে কেমন হয়? তারাও নতুন কিছু খাবার খেল আমাদের সাথে?
—তুমি এখন আমার প্রেমিকা বলে তোমার সব কথাতেই আমি সায় দিচ্ছি সোনা, তার মানে এই না যে বিয়ের পর আমি স্ত্রীরও সব কথাতে সায় দিয়ে যাব।
—তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করব কেন? আমি তোমার প্রেমিকা হয়েই থাকতে চাই আজীবন?
—তোমার যা ইচ্ছা হয় করো, কিন্তু বিয়ের পরে আমি মামাশ্বশুর, খালাশাশুড়িদের নিয়ে হানিমুন করতে যেতে পারব না। দয়া চাই, দোয়াও চাই।
—আর তোমার দশ বছরের ছোট বোনটা যদি আমাদের সাথে যেতে বায়না ধরে? ওকে না বলবে কেমন করে?
—সেটা তোমার দায়িত্ব। যেভাবেই হোক, তুমি ওকে ম্যানেজ করবে।
—তোমার বোন, তুমি ম্যানেজ না করে আমাকে দায়িত্ব দিচ্ছ ওকে ম্যানেজ করতে, বাহ্! বেশ দারুণ তো!
—অবশ্যই, ওটা তোমাকেই করতে হবে ময়না। নইলে হানিমুন গিয়ে তুমি নিজেই যে বাচ্চা-ননদের সামনে লজ্জায় পড়বে।
—কেন? আমি লজ্জায় পড়তে যাব কেন?
—বারে, প্রতিদিন সকালে গালে আর গলায় লাভ-বাইটের দাগগুলো ফুল হয়ে ফুটে থাকবে যে!
—ফাজলামো করলে একটা দিবো তোমাকে।
—দাও, এক্ষুনি।
—তুমি যা ভাবছ, তা না। আমি মারের কথা বলেছি স্যার।
—সাড়ে চার বছরের প্রেমের জীবনে চুমুর বদলে প্রেমিকার হাতে শুধু মারই খেয়ে গেলাম, বিয়ের পরেও যদি একই পরিণতি হয়, তাহলে আর আমার বেঁচে থেকে লাভ কী বলো, আমি বরং এক্ষুনি গিয়ে ওভারব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ি।
—যাও না, কে ধরে রেখেছে তোমাকে!
—প্লিজ লক্ষ্মীটি এমন বউ হয়ো না, যেন সত্যি আমার এসব করতে ইচ্ছে করে। তোমাকে ছেড়ে থাকতেই পারব না আমি।
—আচ্ছা, বিয়ের পরে সত্যি যদি তোমার এমন মনে হয় কোনোদিন? মনে করো, আমাদের দুজনের বনিবনা হলো না। আমাদের খুব ঝগড়া আর ঝগড়া আর খুব অশান্তি চলছে। অথবা মনে করো, আমাকে পেয়ে তুমি ঠিক পরিতৃপ্ত হলে না, মনের ভিতরে কোথাও একটা শূন্যতা রয়েই গেল, আমাকে তুমি যেমন মেয়ে ভেবেছিলে, আমি ঠিক সেইভাবে তোমার সামনে আজীবন অভিনয় করে যেতে পারলাম না, তখন কি আমরা ডিভোর্স নিবো? তখন যদি আমাদের একটা কি দুটো বাবু থাকে, ওদের তখন কী হবে গো?
—বড্ডো বেশি ভেবে ফেলছ তুমি ইলোরা। ভবিষ্যতের চিন্তা রেখে বাস্তবে ফিরে এসো। তোমার ঠোঙার বাদামগুলো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নাও, কয়েকটা বাদাম ছিলে জলদি খাইয়ে দাও আমাকে।
—তুমি বিকলাঙ্গ নাকি? নুলো! চলনশক্তিরহিত! তোমাকে আমার খাইয়ে দিতে হবে কেন?
—মানে? রোমান্টিক মুভিতে দেখোনি, প্রেমিকা প্রেমিককে যত্ন করে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, আর দুষ্টামির ভঙ্গিতে প্রেমিক তার প্রেমিকার আঙুলে কামড় দিচ্ছে।
—না, ওসব আমি দেখি না।
—দেখবে?
—না, বিয়ের আগে দেখতে চাই না।
—হা হা হা। প্রেম, আদর, সোহাগ সবকিছুই আমরা জমিয়ে রেখেছি বিয়ের জন্য। সবকিছু বিয়ের পরে হবে। তাই তো!
—হুম। আর ডিভোর্সটাও, হলে সেটা বিয়ের পরেই হবে।
—আমি বুঝলাম না, আমরা এসেছি ডেটিং করতে। প্রেম ভালোবাসার কথা বলতে। আমাদের আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতি আর হানিমুনের আলোচনা সারতে। অথচ তুমি কী-সব নেগেটিভ কথা বলে যাচ্ছ কেবল। আর ইউ ওকে টুডে! এনিথিং রং মাই লাভ!
—না, আমি ঠিক আছি।
—তাহলে একটু সহজ হও এবারে। আর একটু হাসো দেখি।
—এই যে হাসলাম। এখন তোমার কথা বলো।
—কী শুনতে চাও তুমি? প্রেমের কথা, নাকি ভালোবাসার কথা?
—প্রেম আর ভালোবাসা আলাদা নাকি? পার্থক্য কী দুটোতে?
—এই যে এখন আমরা দুজন বসে ডেটিং করছি, এটা হচ্ছে প্রেম করা। আর যা কিছু তুমি আমাদের বিয়ের সময় পর্যন্ত জমিয়ে রেখেছ, আর আমাকেও জমে থাকতে বাধ্য করেছ ওগুলোর নাম ভালোবাসা। এখন আমরা প্রেম করছি আর বিয়ের পর ভালোবাসাবাসি করব।
—তোমার শুধু একদিকেই টান। আমি যাই বলি না কেন, সবকিছুকেই টেনে ওই একই কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।
—তা বলতে পারো তুমি, ওটাই আমার মক্কা। আমার পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল। যাত্রা যেখান থেকেই আরম্ভ হোক না কেন, গন্তব্য আমার ওটাই।
—বুঝেছি।
—বোঝার জন্য ধন্যবাদ।
—এই পাঞ্জাবিটা তোমাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।
—তোমাকে আবারও ধন্যবাদ, সুন্দর এই পাঞ্জাবিটা আমাকে উপহার দেয়ার জন্য।
—ইউ ওয়েলকাম। দোকানে একটা ম্যানিকুইনের গায়ে এই পাঞ্জাবিটা দেখে তোমার কথা মনে হয়েছিল। আমি যেন কল্পনা করতে পারছিলাম এটাতে তোমাকে চমৎকার মানাবে।
—আর কোনো রং ছিল না এটার?
—আসলে ম্যানিকুইনের গায়ে এই পাঞ্জাবিটাই ছিল, কিন্তু নীল রঙের? লাল তোমার প্রিয় রং, তাই আমি সেলসম্যানকে বলে ভিতর থেকে লাল বের করে আনিয়েছিলাম। কেন, তোমার পছন্দ হয়নি?
—হয়েছে। কিন্তু তোমার যে লাল ভালো লাগে না?
—লাল ভালো লাগে না, ঠিক তা না।
—তাহলে কী? এত করে বললাম, আজ একটা লাল শাড়ি পরে আসতে, তাহলে আমরা দুজনে এই সবুজ ঘাসের মাঠে লালে লাল ম্যাচিং হয়ে বসে থাকতাম দুটো লাল ফড়িঙের মতো, কথা শুনলে না তুমি।
—ইচ্ছে করেই লাল পরিনি আজ।
—কেন? আমাকে কষ্ট দিতে?
—ঠিক তা না।
—তাহলে?
—ভাল্লাগে না। প্রতিমাসে মেয়েদের একবার করে পিরিয়ড হয়। পিরিয়ডের রক্তের রং লাল।
—বাল। আমার বাল।
—না, সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো।
—হ্যাঁ, বিশ্বাস করলাম। আর তুমিও বিশ্বাস করো, প্লিজ বিশ্বাস করো, আমার এই গলাটা এখন একটা ছুরি দিয়ে কেটে ফেললে গলগল করে নীল রক্ত বের হবে। দেখতে চাও তুমি?
—না, চাই না। কিন্তু, তুমি আমার সাথে এইসব ঠাট্টা করবে না। প্লিজ।
—আর তুমিও আমার সাথে এইসব ইয়ার্কি করবে না। খুব রাগ লাগে আমার। পিরিয়ডের রক্তের রং লাল, আমার বাল।
—বাহ্, কী সুন্দর ছন্দ মেলাতে পারো তুমি! কবিতা লেখো নাকি?
—লিখি তো। পাশের বাড়ির রুমকি, তার পাশের বাড়ির ঝুমকি, তোমার বান্ধবী চুমকি, আমার খালাতো বোন কেতকী--এদের সবাইকে গোপনে কবিতা লিখি আমি।
—শুধু আমাকেই লেখো না। আমি তোমার প্রেমিকা হয়ে ভুল করেছি দেখছি।
—তা একটু করেছ বইকি।
—একটা কথা বলবে, সরফরাজ?
—বলব।
—আজ আমি লাল শাড়ি পরে আসিনি বলে তুমি খুব মাইন্ড করেছ?
—হুম। না, আসলে ঠিক মাইন্ড করিনি। বলতে পারো, কষ্ট পেয়েছি। এতবার করে অনুরোধ করলাম তোমাকে, তবুও আমার সামান্য একটা ইচ্ছা তুমি পূরণ করলে না।
—আমি সরি।
—তোমার কাছে আমি তো বিশেষ করে তেমন কিছু চাই না কোনোদিন, সোনা। যখন যেখানে যে অবস্থাতেই থামতে বলেছ আমাকে, বিনা তর্কে সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেছি আমি। আমার কোনো অনুরোধ উপরোধের কি এতটুকুও মূল্য নেই তোমার কাছে!
—আমি সরি। অবশ্যই মূল্য আছে।
—আমার তা মনে হয় না। অন্তত আজকের পরে তো না-ই।
—আজকের প্রসঙ্গে আমার একটা গল্প আছে। গল্পটা শুনবে?
—বলো।
—ফাতেহাবাদ গ্রামের যে হাইস্কুল থেকে আমি মেট্রিক পাশ করেছিলাম, সেই স্কুলে আমার একটাই অন্তরঙ্গ বান্ধবী ছিল। সুলতানা। সুলতানার আব্বা একটা গার্মেন্টসে কাজ করত। ওর মা মানুষের বাড়িতে আয়া-বুয়ার মতো টুকটাক কাজকর্ম করত। গরিব ঘরের মেয়ে হলেও লেখাপড়ায় সুলতানার খুব মাথা ছিল। ওর সাথে অংক করে পারত না কেউ। মেধার কারণে হোক অথবা ওর সুন্দর শরীরের কারণেই হোক, সুলতানার জন্য অনেক ছেলেরা আগ্রহী ছিল। যদিও সুলতানার জেদ ছিল ভালো রেজাল্ট করে একটা কলেজে ভর্তি হবে, তবুও কীভাবে যেন সে এলাকার এক বড়ো ভাইয়ের সাথে প্রেমে জড়িয়ে গিয়েছিল। সুলতানাকে অনেক লোভ দেখিয়েছিল ছেলেটা। টুকটাক জুয়েলারি, কামিজ আর খাবার দিয়ে চোখের সাথে হৃদয়টাকেও জয় করে নিয়েছিল। সুলতানা রাজি না থাকলেও ছেলেটা ঠিক ওকে পালিয়ে যেতে রাজি করিয়ে ফেলে একসময়। আমাদের মেট্রিক পরীক্ষার মাত্র তিন মাস আগে একদিন, সুলতানা আমাকে বলল, জামালের সাথে সে পালিয়ে যাবে, কারণ জামাল ওকে বলেছে বিয়ে করবে আর ঢাকায় নিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করতে দিবে। আমি ওকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু ভয়ে কথাটা আমি নিজেও বড়োদের কাউকে জানতে দেইনি।
—ছেলেটা প্রতারণা করেছিল তোমার বন্ধুর সাথে? আসেনি সে সুলতানাকে বিয়ে করতে?
—এসেছিল।
—তাহলে?
—সেদিন সকালে সুলতানা আমাদের বাড়িতে এসেছিল। হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগে করে কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিল।
—বিয়ের জিনিস?
—হ্যাঁ। জামাল নামের ছেলেটা ওগুলো উপহার দিয়েছিল সুলতানাকে। একটা শাড়ি, ব্লাউজ, চুড়ি, ক্লিপ এইসব।
—তোমাদের বাড়ির কেউ সেদিন সুলতানাকে দেখেনি?
—দেখেছিল, কিন্তু কেউ কিছু সন্দেহ করেনি। তাছাড়া সে আমার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রেডি হয়েছিল। তারপর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সময়মতো।
—এর পর?
—এর পর, সন্ধ্যার সূর্যটা ভালো করে ডুবে যাওয়ার আগে পৃথিবীটা যেমন মাঝে মাঝে লাল, নীল, বেগুনি রং ধারণ করে, ঠিক সেইভাবে সুলতানাও গ্রামে ফিরে এসেছিল, সর্বাঙ্গে বহুবিধ রং মাখিয়ে। এলাকায় একটা শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। যেন কোথাও একটা ডাকাত ধরা পড়েছে। সবাই দৌড়ে গিয়েছিল ওকে দেখতে।
—আর তুমি?
—আমিও। দেখলাম একটা খোলা ভ্যানে শুয়ে আছে সুলতানা। চোখ দুটো বন্ধ। সুন্দর মুখটাতে কী বীভৎস সব দাগ, থেঁতলে গিয়েছিল ডান চোখের নিচ থেকে চিবুক পর্যন্ত।
—আহা!
—আহা, ইস, মেয়েটা।
—একসিডেন্ট করেছিল?
—বিয়ের নাম করে তুলে নিয়ে গিয়ে জামাল আর তার বন্ধুবান্ধব ওকে গ্যাং রেপ করেছিল। পরে সুলতানার ডেডবডি বস্তিতে ফেলে রেখে ছেলেগুলো পালিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে আমাদের গ্রামে নিয়ে এসেছিল।
—পুলিশ মেয়েটাকে চিনেছিল কীভাবে?
—হয়তো ওর ব্যাগে কোনো কাগজপত্র ছিল।
—আহারে!
—জানো, ভ্যানের উপর সুলতানার নির্জীব শরীরটা পেঁচানো ছিল সেই শাড়িটা দিয়ে, সকালে আমাদের বাড়িতে যেই শাড়িটা সে পরেছিল পরম যত্ন নিয়ে। জামাল ছেলেটার কিনে দেয়া একটা সস্তা বিয়ের শাড়ি।
—আর সেই শাড়িটার রং নিশ্চয় লাল ছিল?
—হ্যাঁ। টুকটুকে লাল। লাল জরি আর চুমকির কাজ করা ছিল তাতে।
—সুলতানার গল্প আগে কোনোদিন বলোনি তুমি। আমি সরি সোনা, তোমাকে লাল শাড়ি পরতে জোর করা উচিত হয়নি আমার।
—তুমি সরি হবে কেন, মাই লাভ। আমি ভেবেছিলাম, সুলতানার গল্পটা শুধু আমার নিজের কাছেই থাকুক। কিন্তু আজ তোমাকে বলতেই হলো। একটা কারণে তুমি এত কষ্ট পাচ্ছিলে, তাই বললাম।
—আর কোনোদিন বলব না, দেখো।
—আজ বারোই সেপ্টেম্বর। সুলতানার মৃত্যুবার্ষিকী। তাই আজ রেডি হবার সময় যতবার আমি তোমার দেয়া লাল শাড়িটা পরতে চেষ্টা করছিলাম, বার বার কেন যেন নিজেকে আমার সুলতানা বলে মনে হচ্ছিল। বছরের এই একটা দিন আমি নাহয় আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটার কথা মনে করে লাল রং থেকে দূরে থাকলাম। বাকি দিনগুলো সব রংধনুর সাত রং। শুধু একটা দিন আমার বন্ধু সুলতানার জন্য থাকুক, লাল-হীন।
—আমিও নাহয় তাই করব, ইলোরা। আমাদের দুজনের জন্যেই একটা দিন থাকবে সুলতানার জন্য শোকপালন। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।
—আর ভালোবেসে।
—আমাকে তুমি ভালোবাসো তো, ইলোরা?
—হ্যাঁ, এই মুহূর্তে অবশ্যই ভালোবাসি।
—আচ্ছা তাহলে বলো, দুজন আলাদা মানুষের একসাথে হয়ে সংসার করতে গেলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় কোন জিনিসের?
—শুধু একটা কিছু নিয়েই যে সারা জীবন একসাথে থাকা যায়, আমার তা মনে হয় না সরফরাজ। আমার মনে হয় বিশ্বাস, ভালোবাসা, আস্থা, নির্ভরতা, সহমর্মিতা এমন আরো অনেকগুলো মানবীয় বোধের অল্পবিস্তর সমন্বয় ঘটলেই একটা কাপল সংসার নামক কঠিন সম্পর্কটাকে জিইয়ে রাখতে পারে আর সেটাকে উপভোগ করতে পারে।
—বেশ বলেছ তো কথাটা। এখন চলো আমরা উঠি। সন্ধ্যা হয়ে এলো। আলো থাকতেই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। আমি আমার ভালো মেয়ে-জামাইয়ের খেতাবটা হারাতে চাই না।
—বলো হবুজামাই!