আমি বাসে উঠতে ভয় পাই। তাই ট্রেনই আমার একমাত্র ভরসা। অফিস থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে অফিস - মোট দুইবার আমাকে স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করতে হয়। প্রতিদিন প্রতিবারই লোকটিকে দেখি; একমনে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ট্রেনের অপেক্ষা করেন তা বলা যাবে না। কারণ, ট্রেনের অপেক্ষা করলে অন্তত তাঁকে ট্রেনের জন্য উদ্বিগ্ন দেখাত। কিছুক্ষণ পরপর হয়ত হাতের ঘড়ি দেখতেন, অন্য যাত্রীরা যেমনটি করে। কিন্তু তাঁর কোনো তাড়া নেই। ঘণ্টা বাজে, কুলি হাঁকে, বাঁশিতে ফুঁ পড়ে, অমনি পুউউউউউ গর্জন তুলে কেবলই জেগে ওঠা সরীসৃপের মতো ট্রেন ধীরে চলা শুরু করে। জগতের সব ব্যস্ততা গিলে ট্রেন আস্তে আস্তে গতি বাড়ায়। তবু লোকটি স্থির। আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে প্রতিবারই তাঁকে দেখি।
আমার বউকে প্রায়ই আমি অদ্ভুত এই লোকটির কথা বলতাম। ও কখনো হাঁ-হুঁ উত্তর করত, কখনো কোনো উত্তরই করত না; যেন কিছুই শোনেনি। প্রসঙ্গ এড়িয়ে প্রায়ই সে বলত তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের ছেলেবন্ধুটি - যে তাকে প্রথম বর্ষে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল - জীবনে কতটা উন্নতি করেছে; উন্নতি মানে অনেক টাকা-পয়সা। আচ্ছা, এসব বলে আমাকে খোঁটা দেয় না তো! আমি আবার বেশি বেশি ভাবি মাঝেমধ্যে। আমারও তো অনেক টাকা। প্রতিমাসে যা বেতন পাই তাতে বাড়িভাড়া, খাওয়া, সপ্তাহে একদিন ঘোরা, এমনকি ওর সাজগোজের প্রসাধনী বাবদ খরচ করার পরও হাজার পাঁচেক টাকা বেঁচে যায়। সেটা সোজা ব্যাংকে। ওর বান্ধবীরা যেমন ফ্ল্যাটে থাকে - টোকিওস্কোয়ারে - তেমন একটা ফ্ল্যাট কিনব সে টাকা দিয়ে। তারপর তার কোনো এক জন্মদিনে বন্ধুর বাড়ি ঘুরতে যাব বলে সেই ফ্ল্যাটে নিয়ে যাব, ভেতরে ঢুকেও সে বুঝবে না কিছুই। বিশাল ড্রয়িং রুমের রেশমি পর্দা দেখে ওর চোখ ছলছল করবে, ছাদ থেকে ঝোলানো বড় ঝাড়বাতিতে ওর চোখ ঝলসে যাবে, আগ্রহ নিয়ে একটার পর একটা দামি শো-পিস দেখতে দেখতে হুট করে চোখ পড়বে উত্তর দিকের ফাঁকা দেয়ালটার দিকে। তেলরঙে আঁকা ১৫ ফিট বাই ২০ ফিট বিশাল একটা পোর্ট্রেট। পোর্ট্রেট দেখেও সে চিনবে না, চিনলেও তৎক্ষণাৎ বুঝে উঠতে পারবে না, কিছুক্ষণ পরই যখন সে বুঝবে পোর্ট্রেটটি তারই, আরও কিছুক্ষণ পর যখন বুঝবে এই ফ্ল্যাটটিও তার তখন সে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে চুমু খাবে ঘণ্টা খানেক। সবই হবে, তার জন্যই তো এতো দৌড়ঝাঁপ, টাকার সঞ্চয়।
গ্রীষ্মের জন্য আমার এক-জোড়া সাদা শার্ট বরাদ্দ। একটা নোংরা হলে আরেকটা পরে অফিসে যাই। কোনো কোনোদিন ট্রেনের ভেতর এত মানুষ আর এত গরম হতো যে শার্ট ভিজে আমার ভেতরের স্যান্ডো গেঞ্জি দেখা যেত। মন চাইত এসি কেবিনে গিয়ে উঠি। কিন্তু মনের কথা শুনেই কোনো কাজ করা উচিত নয়; বিশেষত যখন আপনি লক্ষ্য অর্জনে অবিচল। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা না জমাতে পারলে মুশকিল! এত ভিড়ের মাঝেও স্টেশনে বসে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটিকে দেখি। তারও সাদা চেক শার্ট, অবশ্য আমার মত ঘামে-ভেজা অবস্থা নয়, যথেষ্ট ফিটফাট। হাতে চকচকে রুপালি চেইনের ঘড়ি।
প্রতিদিন একই মানুষকে একইভাবে দেখাটা রোজ রোজ বলার মত কোনো বিশেষ ঘটনা নয়। আমি তবুও বলি। ভ্যাপসা গন্ধ আর ঘ্যানঘ্যানে বিরক্তিকর অফিসের গল্প বলার কিছু নেই। ট্রেন থেকে নেমে যতটা পারি শ্বাস নিই, দম বন্ধ রেখে কোনোমতে অফিসের বিরক্তিকর কাজগুলো করি, তারপর বেরিয়ে আবার শ্বাস নিই। এর মাঝে বলার মত যা থাকে তা হলো অফিসে যাওয়া-আসার পথের গল্প। এতেই ঐ অদ্ভুত লোকটা এসে যায় অনিবার্যভাবে। আমি বলতে না চাইলেও এসে যায়। সেজন্যই এসব উড়োকথার কোনো পাত্তা দেয় না আমার বউ। এমনকি মন রাখার জন্যও হাঁ-হুঁ পর্যন্ত করে না কখনও কখনও। কোনো কোনো বর্ষার দিনে, যদি তার মন চায় তো, অফিসে যাওয়ার আগে আমাকে ছাতা এগিয়ে দেয়। এটাই যেন পরম পাওয়া। মনে হয়, এইতো সে আমাকে ভালোবাসে এটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ, নাহয় নিজের কাজ ফেলে আমার কথা ভেবে ছাতা এগিয়ে দেবে কেন! আমিও পরম যত্নে ছাতাটা ধরে স্টেশনে যাই। প্রতিদিনের মত লোকটি একটা বেঞ্চে বসে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সাদা চেক শার্টের ওপরে নীল রেইনকোট, হাতে দামি অ্যাটলাস ছাতা। আমার মনও আজ ফুরফুরে - ভাবলাম লোকটার সাথে কথা বলি। সে কেন রোজ এভাবে অকারণে বসে থাকে! দু'পা এগোতেই ঘণ্টা, বাঁশিতে ফুঁ আর রেলগাড়ির পুউউউউ ঝিক ঝিক, মানুষজনের একমুখী স্রোত। অন্যদিকে যাওয়া অসম্ভব। আমিও স্রোতে ভেসে ট্রেনে উঠি। জানালা দিয়ে কোনোমতে তাঁর কিছুটা চুল উঠে যাওয়া চকচকে বড় ফর্সা কপাল দেখি।
যেহেতু আমার সুখী হতে অনেক টাকা দরকার, সেহেতু আমি কোনো বাজে খরচা করি না, সঞ্চয় করি। শীতকালে যখন জ্যাকেটের প্রয়োজন, তখনও আমি সোয়েটারে কাজ চালাই। আর স্টেশনে বসে থাকা লোকটার সাদা চেক শার্টের সাথে যোগ হয় কালো ব্লেজার আর একটা জীর্ণ-শীর্ণ মাংকি টুপি। আরোও শীত বাড়লে যোগ হয় একটা চিকন চাদর। আর আমি তখন সর্বোচ্চ একটা মাফলার কিনি ফুটপাতের দোকান থেকে। আরোও শীত বাড়লে আমি বাবার উলের সোয়াটারটা পরি। বাবা যেটা পনেরো বছর পরেছেন। এমনকি হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর হাসপাতালে যাবার সময়ও এই সোয়েটার পরে ছিলেন; মরে যাবার সময়ও। দশ বছর আগের কথা বলছি। বাবাকে হাসপাতালে একা ফেলে আমাকে অফিসে যেতে হয়েছিল, অফিস থেকে ফিরে লাশ নিয়ে একা ফিরেছি বাড়িতে। আমি বাবার মত জীবন কখনোই চাই না; অতি নিম্নমানের জীবন। মায়ের সাথে কথা বলে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারতেন না। বেশিরভাগ কথা হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। অনেক টাকা নিয়ে বাড়িতে আসতে পারতেন না বলে লজ্জায় অপমানে মাথানিচু করে ঘরে ঢুকতেন। একদিন অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝি এ বাড়িতে শুধু আমি আর বাবা থাকি।
কিন্তু এখন এ বাড়িতে শুধু আমি আর আমার বউ থাকি। ষাট বছরের পুরোনো জীর্ণ বাড়ি। সব খসে শুধু কংকালটা কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। খুব শীঘ্রই যখন আমরা টোকিওস্কোয়ারের আলিশান ফ্ল্যাটটায় উঠব, এ বাড়িটাকে খুব মিস করব; বাবার আটপৌরে আসবাব, বাবা-মায়ের অসফল বিয়ের সাদাকালো ফ্যাকাশে ছবি, আর নানার থেকে যৌতুক পাওয়া বাবার ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সাদাকালো টিভিটা।
২
ইদানীং লোকটাকে আর স্টেশনে দেখি না। বিরক্তিকর চাকরিটাও ছেড়েছি। আমাকে নিষ্কর্মা ভাবার কোনো কারণ নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই আমি এরচেয়ে বেশি বেতনের চাকরি পেয়েছি। মজার ব্যাপার হলো, আমার বউ কিচ্ছু টের পায়নি; কবে চাকরি ছেড়েছি আর কবে চাকরি পেয়েছি। আগের মত আর প্রতিদিন স্টেশনে যেতে হয় না। আমার অফিস এখন ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, সেখানে কোনো রেলস্টেশন নেই, এমনকি সিএনজিতেও যাওয়া সম্ভব নয়। আর বাসে চড়লেও আমার পাশে বসা ঐ মহিলাটার কথা মনে পড়ে - দুর্ঘটনার পর যার মগজের কিছু ছিটাফোঁটা আমার গালে লেগে ছিল। সেদিন বুঝেছিলাম মানুষের রক্তের গন্ধও গোরুর রক্তের গন্ধের মতই। সুতরাং, চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।
কিন্তু বউ জানলে সমস্যা। প্রথমেই আমাকে ম-বর্গীয় যত গালাগালি আছে তার সবই প্রয়োগ করবে। তারপর লাগেজ গুছিয়ে সোজা বড়লোক বাপের বাড়িতে চলে যাবে। অথচ আমি বাবার মত একা জীবন কখনোই চাই না। তাছাড়া আমার বউকে আমি ভালোবাসি। আমার ব্যাংকে জমেছে ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৫৮৭ টাকা৷ চাকরি ছাড়া অনায়াসে বছর পার করে দেওয়া যাবে। বউ টেরই পাবে না৷ আর অফিসের নাম করে বেরিয়ে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত রেলস্টেশনে বসে অনায়াসে এই চকচকে রেললাইনের দিকে তাকিয়ে পার করে দেওয়া যাবে। আচ্ছা, এই টাকা শেষ হওয়ার আগে যদি মনোমতো কোনো চাকরি না পাই? ফর্মাল শার্ট পরা, ফিটফাট, হাতে রুপালি চেইনের ঘড়ি আর চকচকে বড় কপালের লোকটিকে এখনো রেলস্টেশনে দেখছি না - যাকে আমি দিনের পর দিন অফিসে যাওয়া আর আসার সময় দেখে অভ্যস্ত। তিনি এখন কোথায়? ইদানীং রেললাইনের দিকে তাকিয়ে এইসব ভেবে ভেবে দিন কাটাই।