• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | গল্প
    Share
  • গোধূলিনগরের পরী : দেবাশিস দাস

    গোধূলিনগর জায়গাটার কথা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে ধূলিধূসরিত রাস্তায় বাসে ঘন্টা দুয়েক চলার পর এক প্রান্তরে এসে নামবেন। সেখানে নেমে যতক্ষণে ভাববেন ‘এ কোথায় এলেন?’, ততক্ষণে আপনার বাসটা উধাও হয়ে গেছে। বাসের রাস্তাটাও কিছুদূর গিয়ে ধুলো মাটিতে মিশে গেছে। আপনি রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকের মাঠে নামলেই দেখতে পাবেন মাঠের ঘাসের মধ্যে জেগে আছে একটা পায়ে-চলা পথ। পথটা কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে, কোথাও দেখা যাচ্ছে। সে পথের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই পৌঁছে যাবেন ধু-ধু মাঠের অপর প্রান্তে এক গ্রামের বটতলায়। বটতলার একটা ঝুপড়ি দোকানে দুপুরের খাওয়া সেরে বেঞ্চে বসে ঢুলতে ঢুলতেই দেখবেন পড়ন্ত বেলায় একটা টোটো এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। টোটোতে গ্রামের রাস্তা ছাড়িয়ে একটা গাছগাছালি ভরা জঙ্গল পার হয়ে পৌঁছবেন এক গঞ্জে। এটাই গোধূলিনগর।

    ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর টোটো আপনাকে নামিয়ে দিয়েছে একটা পুরনো আমলের বিশাল দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটার ফটকে লেখা আছে ‘রায়বাড়ি।’ আশপাশের বাড়িগুলো এত বড় না হলেও এই বাড়ির মতোই ভাঙাচোরা, সংস্কারহীন। এরও কিছুক্ষণ পরে অন্দরমহলে ঢুকে বৈঠকখানার আরামকেদারায় বসা যে বৃদ্ধ মানুষটির সামনে আপনি দাঁড়াবেন তিনি বাড়ির কর্তা সূর্যনারায়ণ রায়। ঘরে টিমটিম করে একটা বাল্‌ব জ্বলছে। কর্তার চুলের সাদা রং পুরনো বাড়ির সঙ্গে বেশ মানানসই। এমন গা-ছমছমে পরিবেশে আপনার একটু ভয়-ভয় করতেই পারে।

    এই আলো আঁধারিতে মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে অতীন কিন্তু ভয় পেল না, কারণ এই বয়স্ক মানুষটি অতীনের দাদু। ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পর সে এই মামাবাড়িতেই মানুষ। বাবা আর বিয়ে করেননি। তিনি কলকাতা শহরেই থাকতেন। মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যেতেন অতীনের সঙ্গে। অবশ্য অতীনও চাকরি পাবার পর এখন শহরেই থাকে এবং এখানেও বহুদিন আসা হয়নি তার। বস্তুত কলকাতাতেই তাকে তার বন্ধু অলকেশ বলেছিল এই গোধূলিনগরে আসার কথা। তার সঙ্গে অলকেশেরও আসার কথা ছিল। কিন্তু ওর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত ও আসতে পারেনি। দু-একদিনের মধ্যেই বাবাকে একটু সুস্থ করে এখানে আসবে এমনই ঠিক করা আছে।

    অতীনের বান্ধবী, কৃতি, হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে অতীনের রিলেশনশিপটা বেশ কিছুটা এগিয়েছিল কিন্তু সবকিছু সেটল হওয়ার মুখেই কৃতি নিখোঁজ। কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মেট্রোতে আর দেখা হয় না, ওর হাসপাতালেও খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে বেশ কিছুদিন সে সেখানে আসছে না। কৃতির শহরের আস্তানার প্রতিবেশীরাও অতীনকে তার অন্তর্ধান সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানাতে পারেনি। সে শুধু জানতে পারল কৃতি চাকরি পেয়ে এই দু’-কামরার ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ঠিক করেছিল কিছুদিন বাদে তার মাকে নিয়ে আসবে এখানে।

    বেশ কয়েকদিন ধরে কৃতির খোঁজ করতে করতে অতীন যখন পুলিশের তদন্তে আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, তখনই তার বন্ধু অলকেশ জানাল কৃতিকে নাকি গোধূলিনগরের আশপাশে দেখা গেছে। সেইমতো নিজের অফিসে কয়েকদিন ছুটির দরখাস্ত করে অতীন এসে পৌঁছল গোধূলিনগরে তার দাদুর বাড়িতে।

    **********

    ভোরবেলা রায়বাড়ির পিছনের বড় পুকুরের ঘাটে দাঁড়িয়ে স্মৃতির ঝুলি খুলে গেল অতীনের। বিশেষ করে মনে পড়ছিল তার স্কুলজীবনের কথা। পুকুর পারের সূর্যোদয় কোনদিন দেখা হয়নি। দৃশ্যটা যে এতটা সুন্দর সেটা কল্পনাও করেনি অতীন। পারে দাঁড়িয়েই দেখল চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছে। পুকুরের জলের নিচের প্রাণীগুলোও ধীরে ধীরে স্পন্দিত হয়ে উঠছে বাইরের আলোর আভাস পেয়ে। একটা জোলো বাতাস শরীরে একটা ভেজা ভাব সৃষ্টি করছে। মনটাও আর্দ্র হয়ে উঠছে সঙ্গে সঙ্গে। একটা নূপুরের আওয়াজ কি উঠে এল জল থেকে? কিন্তু কারও উপস্থিতি টের পায়নি তো সে? কোন পরী কি উঠে এল এই রাত আর দিনের সন্ধিক্ষণে? পরীর কথা মনে জাগিয়ে দিল অনেকদিন আগেকার এক স্মৃতি। সে এই পুকুরেরই কথা।

    সাঁতার সে ভালোই জানত। ক্লাস এইটে পড়ার সময় এই বড় পুকুর সাঁতরে এপার ওপার করতে পারত। তবু মাঝপুকুরে একদিন দম ফুরিয়ে গেল। সেদিন একাই সাঁতরে পারাপার করছিল সে। হঠাৎই বিপদ ঘনিয়ে এল। মনে হল চারদিকের সবুজ জল তাকে যেন ক্রমাগত তলিয়ে যেতে বলছে। ভেসে থাকার অনন্ত সংগ্রামের বদলে বরণ করতে বলছে জলের নিচের অপার শান্তি। ওই যে দেখা যাচ্ছে পুকুর পারের নিশ্চিন্ত জীবন। কেউ কাপড় কাচছে, কেউ স্নানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এই মুহূর্তে তার কাছে সেই জীবন যেন অনেক দূরের। মাথাটা ভাসিয়ে রাখাই বড় কষ্টের। হাত তুলে পারের কাউকে ডাকার চেষ্টা করল সে, কেউ দেখল না। মৃত্যুভয় তাকে গ্রাস করে ফেলেছে ততক্ষণে। আজ কি তবে জলের নিচে গিয়েই শুয়ে থাকতে হবে তাকে? বুকের ভিতরটা বাতাসের জন্য আঁকুপাঁকু করছে, মাথায় প্রচণ্ড চাপ, হৃদযন্ত্র প্রায় ফেটে যাবার জোগাড়। মনের সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রচণ্ড ভারী হয়ে আসা হাতদুটো দিয়ে জল কেটে পারের দিকে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করল অতীন। তার বিশ্বাস সে পারে পৌঁছবেই। জলের নিচে তলিয়ে যেতে যেতে সে বুঝল উপরের সূর্যালোকের আভাস মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মন বলছে এভাবে শেষ হতে পারে না সবকিছু। তবু এক অমোঘ আকর্ষণ যেন তাকে টেনে নিচ্ছে জলের গভীরে এক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে।

    ঠিক তখনই হাল্কা বোধ হল তার। শরীরের চাপ কমে, মাথাটাও আস্তে আস্তে ভেসে উঠল উপরে। আলোর রাজ্যে আবার ফেরত এলো অতীন। দেখল তারই পাশে পাশে অদ্ভুত ছন্দে ভেসে চলেছে একটি শ্বেতশুভ্র পরী। নীল তার চোখ। এক হাতে আলতো স্পর্শে তাকে ভাসিয়ে রেখেছে সে। জলের, শ্যাওলার গন্ধ ছাপিয়ে এক স্বর্গীয় সুবাস নাকে এসে লাগছে তার। কোথাও যেন বাঁশি বাজছে একটা। চেতন অচেতনের মাঝে হারিয়ে গেল অতীন।

    বেশ কিছুক্ষণ পরে একটা ঘোরের থেকে চেতনায় ফিরে, সে নিজেকে আবিষ্কার করল পুকুরঘাটের পাশে ঘাসে শায়িত অবস্থায়। মনে হল পারের লোকজন বুঝতেই পারেনি যে অতীন জলে তলিয়ে যাচ্ছিল। শ্বেতপরী ততক্ষণে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে। শুধু নাকে ভেসে আছে তার আশ্চর্য সুঘ্রাণ। পরী কি সাঁতার কাটে? ওর পিঠে কি ডানা ছিল এক জোড়া? মনে নেই তার।

    আর কোনদিন দেখা হয়নি এই গোধূলিনগরের পরীর সঙ্গে। আজ কি আবার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে?

    **********

    পিছন ফিরে অতীন দেখল পরী নয়, ঝিনুক এসে দাঁড়িয়েছে সকালবেলার আলো গায়ে মেখে। এ-বছরই গঞ্জের কলেজে ভর্তি হয়েছে সে। রায়েদের সঙ্গে ঝিনুকরাও এই পুকুরের আর এক শরিক।

    ‘কী ভাবছ অতীনদা? মাছ ধরবে নাকি?’

    ‘ধরলে হয়। কিন্তু ছিপটিপগুলো কোথায় কে জানে?’

    ‘তুমি ছিপ না পেলে বাবার ছিপ তোমাকে দিয়ে যাব।’

    ‘কিন্তু তোমাকে তো থাকতে হবে। না হলে মাছ আসবে কী দেখে?’ নিজের কথার মজা নিজেই উপভোগ করল অতীন।

    ‘কেন? আমি কি মাছের টোপ নাকি?’

    ‘আহা তা কেন?’

    ‘আর কি? মাছ ধরার লোকটাই টোপ গিলল না, তো মাছ কেন গিলবে?’

    কোনও দীর্ঘশ্বাস ছিল কি মজার কথার পিছনে? মনে পড়ল, ওদের বাড়ি থেকে আসা তার সঙ্গে ঝিনুকের এক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দাদু নাকচ করে দিয়েছিলেন একসময়।

    এর পর দুই পরিবারের সম্পর্কেও একটা চোরা ফাটল জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু এতে তার আর ঝিনুকের মেলামেশায় কোন প্রভাব পড়েনি। ঝিনুকদের বাড়িতে অবশ্য এর পরও মাঝে মাঝে যেত অতীন। ওর মা অতীনের চাকরি ইত্যাদির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতেন।

    ‘কৃতির কোন খোঁজ পাওয়া গেল?’ আচমকা প্রশ্ন করল ঝিনুক। তার আর কৃতির বন্ধুত্বের ব্যাপারটা ঝিনুক জানে।

    ‘পুলিশ তো খোঁজ করছে, কিন্তু এখনও তারা কোন ক্লু পায়নি।’

    ‘কোথায় যেতে পারে বলো তো?’

    ‘ওকে নাকি গোধূলিনগরের আশপাশে দেখা গেছে।’ পুকুরের দিকে তাকিয়েই বলল অতীন।

    ‘এখানে এলে তো আমি জানতেই পারতাম। ও তো আমার স্কুলের বন্ধু। আর এখানে এলে লুকিয়েই বা থাকবে কেন সে? ওর মা কিন্তু খুব ভেঙে পড়েছেন।’ ঝিনুকের সুন্দর মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল।

    ‘হ্যাঁ ওর বাড়িতেও যাব। পাশেই তো ওদের গ্রাম। দেখা যাক কোন খোঁজ পাওয়া যায় কিনা।’

    ‘জানিনা কী হল মেয়েটার। তবে ও কিন্তু খুব সাহসী মেয়ে। দেখবে ঠিক ফিরে আসবে।’ ঝিনুক আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল।

    পরদিন বিকেলে অলকেশের ফোন এল। ওর বাবার অবস্থার অবনতি হয়েছে তাই ও এযাত্রা এখানে আসতে পারছে না। অলকেশ আরও জানাল যে কৃতির ব্যাপারে কলকাতার পুলিশ এখনও কোন খবর দিতে পারেনি। যদিও তারা খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। কৃতির চাকরিজীবন, নিজস্ব জীবন ইত্যাদি নানা দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

    কৃতি কোথায় কে জানে? পুলিশ কি সেভাবে খোঁজ করছে তার? চিন্তার সমুদ্রে ডুবে গেল অতীন। তাকে তো কৃতি কখনও হাসপাতালের কোনরকম গণ্ডগোল বা তার নিজের কোন অসুবিধার আভাস দেয়নি। তবে এখন তার মনে হয় ইদানীং কৃতিকে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা গ্রাস করে ফেলছিল।

    **********

    সবাই বলে এই রায়বাড়িতে নাকি স্বাস্থ্য ও সম্পদ উপছে পড়ছে। কারণ এই বাড়িতে আছে এক বিষধর সাপের মাথার মণি। অতীন শুনেছে অনেক বছর আগের এক গ্রীষ্মের দুপুরে, শোবার ঘরে পালঙ্কের নিচে রাখা বাক্সর পিছনে নাকি একটা সাপ ঢুকে গিয়েছিল। হয়ত ইঁদুর ধরার জন্য ঢুকেছিল। কিন্তু আর বেরোচ্ছিল না সে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল তার নড়াচড়ার আওয়াজ। বাড়ির কাজের মেয়ে ঝাড়ু দিতে গিয়ে শুধু তার লেজটা দেখেছিল পালঙ্কের নিচের অন্ধকারে। মনে হয়েছিল বিরাট কালো রঙের একটা সাপ। ভয়ে তারপর কেউ সেই ঘরে ঢুকছিলই না। কোথা থেকে এক সাপুড়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল সেদিন। সাপুড়ে আসাতে সাপ ধরা পড়ল। বিরাট গোখরো সাপ। সে কী ফোঁসফোঁসানি তার! রাগে ফণা তুলে সবাইকে ভয় দেখাতে লাগল সে। সাপটাকে ধরে সাপুড়ে বলল, এই সাপের রয়েছে একটা মণি। তাই তার এত রাগ। সাপুড়ে একটা ছুরি চাইল দিদিমার কাছে। ছুরি দিয়ে চেঁছে সাপের মুখের দিক থেকে কালচে পুঁতির মতো কী যেন একটা বার করল। বলল সেটাই নাকি সাপের মণি। সবাই দেখতে লাগল সেই অদ্ভুত কাণ্ড। অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে ততক্ষণে। এর আগে কেউ সাপের মণি দেখেনি। একটা আয়নার মধ্যে কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল ঢেলে তার উপরে মণিটা রাখা হল। মৃদু এক আলো যেন বের হতে থাকল মণির থেকে। আর মণিহারা নিস্তেজ সাপটাকে সাপুড়ে চালান করে দিল একটা বস্তার মধ্যে। তারপর দিদিমার দিকে আয়নাসুদ্ধ সাপের মণিটা এগিয়ে দিয়ে বলল--

    ‘মা, কথায় বলে এই মণি হল সাত রাজার সম্পদ। আসলে এ মণি কিন্তু জমে থাকা কঠিন বিষ। যারা বিশ্বাস করে তারা ভাবে, এ জিনিস যার কাছে থাকে তার সংসারে স্বাস্থ্য ও ধন বৃদ্ধি হয়। আপনার বাড়িতে যেহেতু সাপ ধরা পড়েছে, তাই আপনাকেই আমি মণিটা দিতে চাই। যদি আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করেন তবে এই মণি একটা কৌটোতে ভরে বাড়িতে রাখতে পারেন। তবে এর বদলে কিছু দাম আমাকে ধরে দিতে হবে। লোকে বলে দাম না দিলে কোন ফল হয় না।’

    সাপুড়ের কথা শুনে উপস্থিত সবাই দিদিমাকে বলল এটা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার এবং মণিটা তার রেখে দেওয়া উচিত।

    দিদিমা সেদিন সাপুড়েকে কিছু টাকা দিয়ে রেখে দিয়েছিলেন মণিটা। দিদিমাকে পরে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘এরকম একটা আজগুবি ব্যাপার শুনে কেন টাকা দিলেন।’ তিনি বলেছিলেন মণি নয়, আসলে বিশ্বাসই সৌভাগ্য বহন করে আনে। মানুষের সেই বিশ্বাসই তিনি ধরে রেখেছেন মণিটার মধ্যে। সৌভাগ্য যদি কিছু আসে তবে তা এই এলাকার সব মানুষেরই কল্যাণ করবে। মণিই এই বাড়ির সৌভাগ্য বহন করে আনল কিনা কে জানে। দিদিমার শ্বশুরমশাই সেই সময় বিছানায় পড়ে ছিলেন স্ট্রোক হয়ে। বসিয়ে দিলে কোনরকমে বসতে পারতেন চেয়ারে। কিন্তু মণি বাড়িতে আসার কয়েকদিন পরেই এক রাতে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে পারলেন নিজে নিজেই।

    এরপর থেকে মাঝে মাঝে সাপুড়ে এই বাড়িতে আসত। সকলের কুশল জানতে চাইত। মণিটার কথা জিজ্ঞেস করত। সেই সাপটাকে ঝুলি থেকে বের করত। সাপটা কেন জানা নেই আনন্দে ফণা তুলে দাঁড়াত। হয়ত বুঝতে পারত এ বাড়িতে তার মণিটার উপস্থিতির কথা। যাবার সময় দিদিমা সাপুড়েকে খাবার খাওয়াত, টাকাপয়সা দিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাপুড়ের এবাড়িতে যাতায়াতও কমতে থাকল। পরের দিকে সে আসলেও সাপটাকে আর আনত না। জিজ্ঞেস করলে বলত সাপটাকে সে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছে। সবাই মনে করে যে সাপটা হয়ত কোনদিন নিজেই আসবে তার মণিটার খোঁজ নিতে। মণিটা হয়ত রাখা আছে দিদিমার সিন্দুকের ভিতরে। যদিও দিদিমা কোনদিন কাউকে বলেননি মণি কোথায় রাখা আছে। এমনকি দাদুকেও না। কালের নিয়মে একদিন দিদিমাও চলে গেলেন ইহজগৎ ছেড়ে। মানুষের বিশ্বাস রয়ে গেল মণিটাকে জুড়ে। অতীন মনে করে সাপ বা তার বংশধররা আছে এ বাড়ির আনাচে কানাচেই। আর তারা খোঁজ করে চলেছে নিজেদের বংশের মণিটির। সে এও বিশ্বাস করে যে তাকে যে গোধূলিনগরের পরী জলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে, তাও ওই মণিটির আনা সৌভাগ্যের ফল। মণিই গোধূলিনগরে এনেছে পরীকে।

    **********

    কলেজে পড়ার সময় একবার গোধূলিনগরের হাটে গিয়ে কৃতিকে প্রথম দেখেছিল অতীন। মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় তার। সবচেয়ে ভালো লেগেছিল তার আকাশের মতো বড় বড় দুটো চোখ। মেয়েটি এসেছিল তার দুই বান্ধবীর সঙ্গে। এদের মধ্যে একজন ছিল তাদের পাশের বাড়ির ঝিনুক। সেদিন আলাপ করা হয়ে উঠল না। সেই রাতে স্বপ্ন দেখল, গোধূলিনগরে তাদের উঠোনে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে মেয়েটি। কাঁধে তার রয়েছে দুটো ডানা। জীবনে ভালো কিছু হলেই গোধূলিনগরের পরীর কথা মনে পড়ে তার।

    ভোরে ঘুম ভেঙে উঠোন-বাগানে ছুটে গেল সে। দেখতে চেষ্টা করল কোথাও কোন চিহ্ন পরী ফেলে গেছে কি না। না, সেরকম কিছু পাওয়া গেল না। সেদিন ছিল হাটের দিন। দরকার সেরকম না থাকলেও মেয়েটির দেখা পেতে হাটে গেল সে। মেয়েটি আসেনি সেদিন। পরে একদিন ঝিনুককে জিজ্ঞেস করে জানল মেয়েটির নাম কৃতি। সে এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। পাশেই এক গ্রামে তাদের বাড়ি।

    এর পরে মেয়েটির সঙ্গে আর দেখা হয়নি অতীনের। সে শুধু জানতে পেরেছিল কৃতি নাকি মাধ্যমিকের পর কোনও কোর্সে ভর্তি হয়ে চলে গেছে শহরে। এর অনেকদিন পর কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে হঠাৎ এক বিকেলে মেট্রোতে দেখতে পেল কৃতিকে। ও তখন নার্সিং পাশ করে এক হাসপাতালে নার্সের চাকরিতে যোগ দিয়েছে। অতীন সেই প্রথম আলাপ করল। দুজনেরই বাড়ি গোধূলিনগরে। কাজেই যাওয়া-আসার পথে আলাপ জমে উঠল তাদের। কিন্তু অদৃষ্ট নিশ্চয়ই হেসেছিল। একদিন হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে গেল কৃতি।

    **********

    অতীনের কলেজের একজন প্রফেসর প্রবাবিলিটির ক্লাসে একবার বলেছিলেন, জীবন হল কতগুলোর সম্ভাবনার সমষ্টি। মানুষ সবসময়েই কতগুলো সম্ভাবনার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে তার জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে। প্রত্যেকের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে এই মোড়-ঘোরানো ব্যাপারগুলো। কোনোটা দুঃখের কোনোটা আনন্দের। কোন্‌ মানুষ কার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে, কী সুযোগ পাবে, কোথায় গিয়ে পড়বে, কার সঙ্গে মিলন হবে বা বিচ্ছেদ, এ সবই সম্ভাবনার ব্যাপার। কোন মানুষের জীবনে যা যা ঘটছে তা না ঘটে অন্য কিছুও ঘটতে পারত। ভালো-মন্দ সব মিলিয়েই অপার সম্ভাবনার এই জীবন যাপন।

    অতীন ভাবে গোধূলিনগর এক আশ্চর্য জায়গা। এখানে কোথাও এক সাপের মণি আছে। লোকে বিশ্বাস করে এই মণি সকলের সৌভাগ্য বহন করে আনছে। অতীন জানে দিদিমার সাপের মণি পাওয়া, তার জীবনে পরীর দেখা পাওয়া, বড়দাদুর হঠাৎ ভালো হয়ে যাওয়া, এমনকি তার সঙ্গে কৃতির সম্পর্ক, কৃতির হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য সমস্ত ব্যাপারস্যাপার, সবই সম্ভাবনার খেলা। অতীন বিশ্বাস করে যে গোধূলিনগরের পরী তাদের সমস্ত ভালো সম্ভাবনাগুলো সত্যি করে তুলছে। এটাকে জাদু বলে মনে হলেও এটাই হল জীবন।

    **********

    নানা জায়গায় কৃতির খোঁজ করল অতীন। স্থানীয় থানাতেও গেল। দোকানে, বাজারে তার সঙ্গে দেখা হওয়া চেনা লোকেদের, কৃতির গ্রামের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে সে জানল, এখানে মাস খানেকের মধ্যে কোথাও দেখা যায়নি কৃতিকে। কারা দেখেছে তবে তাকে? গঞ্জের থানার বড়বাবু বললেন এখানকার সব সম্ভাব্য জায়গায় খোঁজ করেও কৃতির কোন খবর পাওয়া যায়নি। কলকাতার পুলিশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। কোন খবর পেলেই তারা কৃতির মাকে জানাবে। এদিকে অতীনের ছুটি শেষ হয়ে আসছে। দু’-দিন পরেই তাকে অফিসে যোগ দিতে হবে।

    **********

    একটা কবিতার খাতা টেবিলের উপর রাখা। সামনে চেয়ারে বসে অতীন দেখছিল কৃতির ঘরের চারদিক। বেশ অগোছালো মনে হল ঘরটা। হয়ত পুলিশ এসেছিল এখানে তদন্ত করতে। ডান দিকের জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে একটা ছোট নদী দেখা যাচ্ছে। মৃদু হাওয়া জানলা দিয়ে ঢুকে বেশ আরাম দিচ্ছে এই গরমের সকালে। জানলার পাশের বই-এর তাকে কিছু বই উল্টোপাল্টা করে দাঁড় করানো। বেশিরভাগই পড়ার বই। দু’-একটা শুধু গল্প আর কবিতার। সেখানেই এক কোণে সে পেয়েছিল এই কবিতার খাতাটি। খাতা খুলে কিছু কবিতা পড়েছে অতীন। সে কবিতা বোঝে না। তবে তার মনে হয়েছে কবিতাগুলোতে সব মিলিয়ে যেন এক আশ্চর্য বিপন্নতা আছে। কবিতার শব্দের চয়ন যেন একটা বিষণ্ণ ভাব বয়ে নিয়ে আসছে। না জানি কত রকমের বিপন্নতা থাকে মানুষের জীবনে। মনে হল, গোধূলিনগরের পরীর সঙ্গে যদি কৃতির দেখা করানো যেত একবার!

    সামনের দরজা দিয়ে চা নিয়ে ঢুকলেন কৃতির মা। পাশে রয়েছে ঝিনুক। আজ কলেজে শনিবারের ছুটি থাকাতে সে অতীনের সঙ্গে কৃতিদের বাড়িতে এসেছে।

    ‘আবার চা কেন মাসিমা? আমরা তো শুধু কৃতির খোঁজ নিতে এসেছিলাম।’

    ‘আরে তা কী করে হয়। চা-ই তো শুধু। কোথায় যে গেল মেয়েটা? কলকাতায় নেই, এখানে নেই। পুলিশও পাচ্ছে না। আমাকে না জানিয়ে তো কোথাও যায় না ও। বেশ কিছুদিন আগে যখন বাড়িতে এসেছিল, তখনও তো ওকে স্বাভাবিক লাগল। তবে কি কোন বিপদ হল মেয়েটার? চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারছি না।’ চায়ের কাপ টেবিলের ওপর নামিয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে উৎকণ্ঠা গোপন করার চেষ্টা করলেন মাসিমা।

    চা পান করতে করতে কৃতির কবিতার খাতাটা দেখছিল অতীন। মলাটের উপর সুন্দর একটা গোল আলপনা আঁকা, যার কেন্দ্রে রয়েছে একটা চক্র। ভালো করে দেখে বুঝতে পারল আলপনার প্রতিটা বাঁকা লাইন শেষ হয়েছে যেন এক একটা সাপের মুখ দিয়ে। প্রতিটি সাপের মাথার উপর দেওয়া রয়েছে একটা করে ফুটকি। ওগুলো কি সাপের মণি? মনে একটা অদ্ভুত ভাবনা এল। কবিতাগুলো কি তবে এক একটা সাপ যারা বিপন্নতার বেড়াজাল তাদের মণি দিয়ে ভাঙতে চাইছে?

    ‘মাসিমা আজ উঠি তাহলে। একটু থানায় যেতে হবে। কোন খবর পেলে নিশ্চয়ই আপনাকে জানাব। আপনি চিন্তা করবেন না। কৃতি ঠিক ফিরে আসবে।’

    খাতাটা বইয়ের তাকে রাখতে গিয়ে সেটা একটা পেনস্ট্যান্ডে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে গেল। খাতা কুড়িয়ে নেবার সময় দেখল একটা আলাদা ভাঁজ করা কাগজ তার ভিতর থেকে মাটিতে পড়ে গেছে। খাতার কবিতাগুলো পড়লেও কাগজটা কোনভাবে তার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। ভাঁজ খুলে দেখল এই কাগজেও একটা ছোট কবিতা লেখা আছে। বড় অদ্ভুত কবিতা। নিচের তারিখ দেখে বুঝল এখানে কৃতি শেষবার যখন এসেছিল তখনকার লেখা। এটাই সম্ভবত শেষ কবিতা এই খাতার।

    মণিহারা সাপের ঘর,

    নদীর পাশে বালুর চর।

    সাপুড়ে নাই ঘরে,

    সে জঙ্গলে সাপ ছাড়ে।

    সাপ খোঁজে মণি,

    যা বিশ্বাসেরই খনি।

    ভালোবাসার এক সে দেশ,

    নাহি সেথা লোভ দ্বেষ।

    স্বপ্ন দেখি তথা যাই,

    পরীর দেখা যদি পাই।

    কৃতির বাড়ির থেকে ফেরার সময় কবিতার লাইনগুলোই ভাবতে লাগল অতীন।

    ‘বেশ অদ্ভুত কবিতা। তাই না ঝিনুক?’ অতীন ঝিনুককেও পড়িয়েছিল কবিতাটা।

    ‘হ্যাঁ। অন্যরকম। মণিহারা সাপের ঘর ব্যাপারটা কী বলো তো?’ ঝিনুক জেজ্ঞেস করল।

    অতীন তাদের সাপের মণির ব্যাপারটা কৃতিকে বলেছিল এক সময়। কাজেই মণিহারা সাপের ব্যাপারটা কৃতি জানত। কিন্তু এখানে মণিহারা সাপ কে? কবি নিজেই? কী হারিয়েছে তার? হয়ত বিশ্বাসটাই হারিয়েছে সে। এর থেকে দামি মণি কী আর থাকে মানুষের। কিন্তু কোন পরীর দেখা পেতে চায় কৃতি? গোধূলিনগরের পরীর কথা তো কোনদিন অতীন বলেনি কৃতিকে? তবে কি কৃতি নিজেই পেয়েছে পরীর দেখা? তবে কি ...? ভাবতে ভাবতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ-মুখ। ঝিনুকের প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে গেল সে।

    ‘কোথায় যেতে চায় কবি? যেখানে পরীর দেখা পাওয়া যাবে? মানে কী?’ উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করল ঝিনুক।

    ‘সে এক অদ্ভুত ভালোবাসার দেশ ঝিনুক। পরীর দেখা পাওয়া যায় সেখানে। ভালোবাসা আর বিশ্বাস থাকলে গোধূলিনগরও হয়ে উঠতে পারে সেই দেশ।’ অতীনের গলার স্বরে ভরপুর বিশ্বাস খেলা করছে এখন।

    বেলা বেড়েছে। বাড়ছে রোদ্দুরের তেজ। দুজনেই চলার গতি বাড়াল।

    **********

    গ্রামের প্রান্তে বিশাল একটা মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়াল অতীন। পাশে নদী। কিছুটা দূরে গভীর জঙ্গল। গোধূলির সিঁদুরে আলোতে স্বপ্নময় হয়ে গেছে চরাচর। কী জানি কীসের টানে পায়ে পায়ে মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল অতীন। অনেকটা ভিতরে ঢুকে জঙ্গলের মাঝে একটা খোলা জায়গায় পৌঁছল সে। রাত নামছে। গাছগাছালির উপর থেকে চুঁইয়ে নামা জ্যোৎস্নায় ধুয়ে গেছে জায়গাটা। কোথায় যেন জেগে উঠেছে একটা মাতাল বাঁশির সুর। সহসা হাল্কা নীল আলোয় ভরে গেল চারদিক। অতীন দেখল এক পরী নিজের ডানায় ভেসে খোলা জায়গার মাঝে এসে দাঁড়াল। নীল আলো ঠিকরে বের হচ্ছে তারই শরীর থেকে। অতীন হঠাৎ টের পেল, সে কথা বলতে পারছে না, নড়তে পারছে না। খানিক পরে মনে হল পরী যেন একা নেই। তার হাত ধরে খেলছে কৃতি। অপার আনন্দ তার চোখে মুখে। প্রাণপণে অতীন বলার চেষ্টা করল- ‘কৃতি, তুমি এখানে কী করছ? এই পরীকে আমি চিনি। ও আমাকে জলের নিচের অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরিয়ে এনেছে।’ গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না তার। একটা আনন্দময় কষ্ট হতে থাকল শরীরে। তবে কি গোধূলিনগরের পরী এসেছে কৃতির জীবনে?

    ‘তুমিও কি অন্ধকারে ছিলে কৃতি?’ আবার কথা ফুটল না তার।

    সে শুধু ভাবতে লাগল, এ কোন সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে কৃতি?

    ধীরে ধীরে যেন ফেড-আউট করে গেল পুরো দৃশ্যটা। বাঁশির আওয়াজ কি আরও তীব্র হয়ে উঠল এবার?

    **********

    ফোনের রিংটোনে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল অতীনের। দেখল মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অলকেশের নাম। বাইরে এখন সবে ভোর হচ্ছে। ফোন ধরতেই খুব উত্তেজিত কণ্ঠে অলকেশ বলল,

    ‘একটা ডেডবডি শনাক্ত করার জন্য পুলিশ কৃতির কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে নিয়ে যেতে বলেছে। এক যুবতীর লাশ পাওয়া গেছে মাতলা নদীর পারে এক জঙ্গলের মধ্যে। কে বা কারা তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করে, খুন করে বডি ফেলে রেখে গেছে।’

    অলকেশ আরও জানাল, পুলিশ নাকি কৃতির বাড়িতে ওর লেখা একটা কবিতা পেয়েছিল। ‘মণিহারা সাপের ঘর’ না কি যেন কবিতাটা। সেই কবিতা থেকেই নাকি তারা ক্লু পেয়েছিল কৃতি তার জীবনে হতাশ হয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। সেই সূত্র ধরে ওর হাসপাতালেও নানা গণ্ডগোলের আভাস পেয়েছে পুলিশ। তারা মনে করছে হাসপাতালের কিছু দুর্নীতির ব্যাপারে কৃতি নিশ্চয়ই কিছু জেনে গিয়েছিল। সে ছিল জুনিয়র নার্স, সবে চাকরিতে ঢুকেছে। হয়ত হুমকি বা থ্রেট আসছিল ওর ওপর। ওদিকে চাকরিও ছাড়তে পারছিল না। চারদিক থেকে প্রচণ্ড চাপ আর সহ্য করতে পারছিল না সে।

    অলকেশের আবেগ-মিশ্রিত শেষের কথাগুলো ছিল এইরকম- ‘প্রাথমিকভাবে লাশ কৃতির বলে মনে হলেও মুখ পুরোপুরি বিকৃত হবার কারণে একশো ভাগ নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছে না। একমাত্র মাসিমাই হয়ত পারবেন নিশ্চিতভাবে লাশ শনাক্ত করতে। আর শনাক্তকরণের পরই শুরু করা যাবে খুনের তদন্ত। থানা থেকে বলছে লাশ শনাক্ত করার জন্য তুই কৃতির মাকে নিয়ে এখানে আজই চলে আয়। ওখানকার পুলিশ তোদের সাহায্য করবে।’

    মনে মনে হাসল অতীন। সে জানে এই অশনাক্ত মৃতদেহ কৃতির হতে পারে না। ভালো সম্ভাবনা সেটাই বলছে। কারণ পরী রয়েছে কৃতির সঙ্গে। মনের মধ্যে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য, কৃতিকে পিঠে নিয়ে অন্ধকার থেকে আলোভরা পৃথিবীতে উড়িয়ে নিয়ে আসছে গোধূলিনগরের পরী। বাঁশির শব্দে মাতাল হয়ে উঠছে চারদিক।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments