• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | গল্প
    Share
  • দীনবন্ধু কিংবা ঈশ্বরের কাহিনী : দিবাকর ভট্টাচার্য

    "সে কি! তোমার কোনো কাহিনী নেই? এতকাল পৃথিবীতে কাটালে, তোমার কোনো কাহিনী নেই? ভারি তাজ্জব লোক তো তুমি!" - স্বর্গরাজ্যের পাহারাদার দেবদূতটি এইকথা বললো দীনবন্ধুকে। দীনবন্ধু চুপ করে র‌ইলো।

    খানিক আগেই দীনবন্ধুর ইহজীবন শেষ হয়ে গেছে। দীনবন্ধুকে কে যেন বললো - "তুমি এবার স্বর্গের দিকে যেতে পারবে।" দীনবন্ধু হঠাৎ দেখলো সে একটা অদ্ভুত জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেটা একটা মাঠ না পাহাড়ের চূড়া তার কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু বুঝতে পারলো যে জায়গাটা বিশাল। আর বিরাট আকাশের নীচে।

    দীনবন্ধু দেখলো সেখানে তার মতো আরো অনেকে এসে হাজির হয়েছে। দীনবন্ধুর মনে হলো - 'তার মানে এরাও সবাই নিশ্চয়ই স্বর্গে যাবে বলে এখানে এসেছে।' হঠাৎ সে দেখতে পেল সুপুরুষ চেহারার একজন তাদের মধ্যে এসে হাজির হয়ে গমগমে গলায় বললো - "আমি দেবদূত। তোমাদের সবাইকে বলছি - এভাবে নয় - এভাবে নয় - সবাই এক‌-এক করে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ো।"

    এই কথার সঙ্গেসঙ্গে যারা সেখানে ছিলো সবাই দুদ্দাড় করে লাইনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। দীনবন্ধুর চোখের সামনে সেই লাইন বিরাট লম্বা হয়ে গেল। দীনবন্ধু সবার পিছনে এসে দাঁড়ালো। তারপর দেখতে পেল তার পিছনেও এক‌-এক করে লোকেরা এসে দাঁড়াচ্ছে। দীনবন্ধু ভাবলো - 'যাক। আমিই তাহলে শেষজন ন‌ই।' তারপর তার মনে হলো - 'আর শেষজন হলেই বা কী হতো? যাবো তো সব এক‌ই জায়গায়।'

    একটু বাদেই এক‌-এক জন করে ডাকা শুরু হলো। বেশ খানিকক্ষণ পরে দীনবন্ধুর ডাক এল। "কী নাম তোমার?" - ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করলেন সেই দেবদূত। "দীনবন্ধু। দীনবন্ধু দাস" - একটু ভয়ে ভয়েই উত্তর দিলো সে। দেবদূত এবার আরো গমগমে গলায় দীনবন্ধুকে জিগ্যেস করলেন - "কোথায়? তোমার কাহিনী কোথায়?"

    "কাহিনী? আমার কাহিনী?" - থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো দীনবন্ধু। দেবদূত অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন - "তোমার কাহিনী নয়তো কি আমার কাহিনী জানতে চেয়েছি? আশ্চর্য কথা।" দীনবন্ধু খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললো - "কাহিনী? মানে আমার নিজের কাহিনী? সে তো -" দেবদূতের গম্ভীর কন্ঠস্বরে দীনবন্ধুর মিনমিনে কথা থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন - "আনোনি? স্বর্গে আসতে যাচ্ছো অথচ নিজের কাহিনী আনোনি? কেন? আনোনি কেন?" এইবার দীনবন্ধু মরিয়া হয়ে উত্তর দিলো - "আমার তো কোনো কাহিনী নেই। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।"

    দীনবন্ধুর কথা শুনে দেবদূত বললেন - "সে কি হে! এতবছর পৃথিবীতে কাটালে - অথচ তোমার কোনো কাহিনী নেই - এই রকম আবার হয় নাকি?" দীনবন্ধু হাতজোড় করে হাউমাউ করে কেঁদে বললো - "হ্যাঁ প্রভু। সত্যি বলছি। আমার কোনো কাহিনী নেই। বিশ্বাস করুন।" দেবদূত দীনবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অবাক হয়েই বললেন - "সে আবার কী কথা! আমি কস্মিনকালেও শুনিনি এরকম।" তারপর একটু থেমে, হয়তো দীনবন্ধুর উপর একটু দয়াপরবশ হয়ে, নরম গলায় দীনবন্ধুকে বললেন - "এখানে যারা আসে পৃথিবী থেকে সবার কিছু না কিছু কাহিনী থাকে। কারো কারো আবার অনেক কাহিনী থাকে। কিন্তু তিনটির বেশি কাহিনী কেউ আনতে পারবে না - এখানকার নিয়ম। একটু আগেই তো এক রাজা আর এক কবি এসেছিল। ওদের দুজনেরই সঙ্গে অনেক কাহিনী। প্রত্যেককে তিনটি করে কাহিনী সঙ্গে করে নিয়ে যেতে দেওয়া হলো। তাই যাইহোক, তোমার একটাও কাহিনী নেই, অথচ পৃথিবীতে কাটিয়ে ছিলে এতগুলো বছর, তা কী করে সম্ভব হয় সেটা তো আমি বুঝতে পারছি না কিছুতেই।" দীনবন্ধু আবার হাতজোড় করে বললো - "সেটাই হয়েছে প্রভু।"

    দেবদূত এবার কঠিন গলায় দীনবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন - "তুমি কখনো কোনো নারীর প্রতি আসক্ত হ‌ওনি? কোনো সুন্দরীর দিকে মুগ্ধচোখে তাকাওনি?" দীনবন্ধু হাতজোড় করে বললো - "না প্রভু! আমি লোকের অচ্ছুত কাজ করতাম কিন্তু মন দিয়ে - ওসব দিকে তাকাইনি কখনো?" "চুরি করোনি কখনো পেটের দায়ে?" - আরো কঠোরভাবে বললেন দেবদূত। দীনবন্ধু বললো - "না প্রভু। দিন-রাত এক করে খাটতাম। তাতে আমার পেট চলে যেত। চুরিটুরি কখনো করিনি কোনোদিন।" দেবদূত বললেন – “কোনো পুণ্যকাজ করেছো কোনো দিন? কোনো ঈশ্বরসাধনা করেছো? কোনো আর্ত মানুষের চোখের জল মুছিয়েছো?" দীনবন্ধু হতাশ হয়ে উত্তর দিলো - "নাহ্। সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না আমার।" দেবদূত এবার ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন - "তাহলে কী করেছো এতকাল পৃথিবীতে থেকে?"

    দীনবন্ধু বলতে শুরু করলো - "জন্মেছিলাম খুব গরীব ঘরে। শুনেছিলাম বাপ-মা দুজনেই চলে গেছে আমার জ্ঞান হ‌ওয়ার আগেই। তাই অন্যের কাঁধে বোঝা হয়ে দিন-রাত এক করে খাটতাম পেটের দায়ে। এইভাবে কতদিন কেটে গেল কে জানে। একদিন বোশেখ মাসের দুপুরে লোকের জমিতে চষতে চষতে হঠাৎ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। চোখে অন্ধকার দেখলাম। তারপর আর কিছুই যেন নেই কোত্থাও।" দেবদূত বললেন - "এরপর? এরপর কী হলো কিছুই মনে পড়ছে না তোমার?" দীনবন্ধু খুব আস্তে করে বললো - "অনেক পরে - মনে হলো শুনলাম - কেউ যেন বলছে - 'উঠে এসো - উঠে এসো এখানে।' চোখ মেলে দেখলাম এই বিরাট জায়গাটা। নিজেকে কিন্তু দেখতে পেলাম না আর। সে যাক গে। এরপর আপনার কথা শুনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।" এইবার একটু থেমে দীনবন্ধু বললো - "শুনলেন তো? এর সব সত্যি। আমার কোনো কাহিনী নেই প্রভু। দয়া করে আমাকে বিশ্বাস করুন।" বলে আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো দীনবন্ধু।

    দীনবন্ধুর কথায় দেবদূত এবার বেশ অস্বস্তিতে পড়লেন। তারপর বললেন - "বুঝলাম। কিন্তু এখানকার নিয়ম বলে তো একটা কথা আছে। প্রত্যেককে নিজের নিজের কাহিনী নিয়েই স্বর্গে ঢুকতে হয়। এমন‌ই হয়ে আসছে বরাবর। সবার ক্ষেত্রেই এক‌ নিয়ম। সবাই যে যার কাহিনী নিয়ে আসে। তোমায় নিয়ে বেশ মুস্কিলে পড়লাম তো।" দীনবন্ধু এবার হাতজোড় করে বললো - "সে রকম নিয়ম হয়ে থাকলে আমি না হয় স্বর্গে না-ই গেলাম।" দীনবন্ধুর কথায় দেবদূত একটু চুপ করে থেকে বললেন - "নাহ্। তা হয় না। আমার কাছে তোমার বিষয়ে যা দেখছি তাতে তোমার স্বর্গে যাওয়ার কথা। আমি তো সেটা অগ্রাহ্য করতে পারবো না। কিন্তু তোমাকে নিয়ে এখন আমি যাই কোথায়?"

    দীনবন্ধু বললো - "কোথাও কোনো উপায় নেই?" দেবদূত উত্তর দিলেন - "উপায় তো আছেই। কারো থেকে একটা কাহিনী জোগাড় করে নিয়ে তোমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই হলো। কিন্তু সেটা তো তোমার কাহিনী হবে না।" তারপর একটু থেমে বললেন - "মিথ্যাচার করে স্বর্গে আসা যায় কিন্তু স্বর্গের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার করা যায় না।" দীনবন্ধু বললো - "না না। ছি ছি! যা আমার নয় সেটা নিজের বলে চালাবো কেন?" দেবদূত বললেন - "না না। সেসব করতে হবে না। তুমি বরং এখানে একটু অপেক্ষা করো। আমি আমার প্রভুর থেকে জেনে আসি তোমার ব্যাপারে কী করা উচিত।"

    এরপর দেবদূত ঈশ্বরের কাছে কাছে গিয়ে সব জানালেন। ঈশ্বর সাধারণত কোনো উত্তর দেন না। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেন কী বলতে চাইছেন। ঈশ্বর সব শুনে দেবদূতকে ইশারায় বললেন দীনবন্ধুকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে। দেবদূত খুব অবাক হলেন। 'ঈশ্বর তো কাউকে তাঁর কাছে আসতে বলেন না। তাহলে? তাহলে কি ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হলেন? শাস্তি দেবেন দীনবন্ধুকে?' - ভাবতে ভাবতে দেবদূত দীনবন্ধুর কাছে ফিরে গেলেন। দীনবন্ধু সাগ্রহে জানতে চাইলো - "কী হলো? ঈশ্বর কী বললেন?" দেবদূত একটা রাস্তা দেখিয়ে বললেন - "এই দিক দিয়ে সোজা চলে যাও।" - বলেই কোথায় যেন চলে গেলেন। দীনবন্ধু জিজ্ঞেস করার সুযোগই পেল না যে কতদূর যেতে হবে বা ওই পথ ধরে ঠিক কোনখানে যেতে হবে।

    খানিকক্ষণ হাঁটার পর দীনবন্ধুর হঠাৎ চোখে পড়লো কেউ একজন বসে রয়েছেন একটা বড়ো পাথরের উপর - মাথা নীচু করে - হাতের তালুর উপর মুখ রেখে - মনে হয় যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছেন। দীনবন্ধু তাঁর কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো - "ঈশ্বরের কাছে যাবো - কোন রাস্তা দিয়ে কতদূর যেতে হবে বলতে পারেন?" যিনি ওইভাবে পাথরের উপরে বসেছিলেন তিনি দীনবন্ধুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে বসতে বললেন। দীনবন্ধু বললো - "নাহ্। আমার তো বসলে চলবে না। আমাকে তো ঈশ্বর ডেকেছেন। যাই। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি ওনার দেখা পাওয়া যায় কিনা।" যিনি পাথরের উপর বসেছিলেন তিনি এবার দীনবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার হাতের ইশারায় তাকে বসতে বললেন।

    দীনবন্ধু কী মনে করে তাঁর সামনে বসে খুব আস্তে করে বলতে শুরু করলো - "আসলে ঘটনাটা কি জানেন - আমার তো কোনো কাহিনী নেই। স্বর্গে আসতে হলে সবার নাকি অন্তত একটা করে কাহিনী থাকতে হয়। আমার তো সত্যিই কোনো কাহিনী নেই। তাই দেবদূত আমাকে স্বর্গের ভিতরে আসার অনুমতি দিলেন না। আমি তো এখান থেকে চলে যেতে রাজি আছি। কিন্তু দেবদূত বলছেন যে আমায় ফের মর্ত্যে ফিরে যেতে দেওয়া যাবে না। এদিকে আবার আমার নরকে যাওয়ার‌ও অনুমতি নেই। তাই উনি বললেন যে আমি যেন এই পথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু কোথায় কতদূর যেতে হবে তা কিছুই বলেননি উনি। তাই হাঁটতে হাঁটতে এতদূর এলাম।" এই কথাগুলো বলে দীনবন্ধু ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব কাতরভাবে প্রশ্ন করলো - "আচ্ছা আপনার কী মনে হয়? ঈশ্বর কী বলবেন আমায়? শাস্তি দেবেন নাকি? আমার কোনো কাহিনী নেই শুনে?"

    যিনি পাথরের উপরে মুখ নীচু করে বসেছিলেন এতক্ষণ তিনি ধীরে ধীরে মুখ তুলে দীনবন্ধুর চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন - "আমার‌ও নেই। কোনো কাহিনী।" দীনবন্ধু যেন মনে একটু সাহস পেয়ে বললো - "আপনার‌ও নেই? তাই বুঝি ঈশ্বর আপনাকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন?” উনি কোনো উত্তর না দিয়ে ম্লান হাসলেন। ওই হাসিতে দীনবন্ধু যেন আরো খানিকটা ভরসা পেলো। ওনার দিকে তাকিয়ে বললো - "তাহলে আমিও বসি আপনার পাশে। উনি তো আপনাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাহলে তো আমাকেও তাই করবেন।" আবার একটু চুপ করে থেকে দীনবন্ধু খানিকটা ইতস্তত করেই বললেন - "তাহলে কি আর যাওয়ার দরকার আছে ঈশ্বরের কাছে?" উনি কোনো উত্তর দিলেন না। মাথা নীচু করেই বসে র‌ইলেন। তারপর দীনবন্ধুর দিকে মুখ তুলে বললেন - "নাহ্। দরকার নেই।" তারপর উনি দীনবন্ধুর দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে করে বললেন - "তোমার কোনো কাহিনী নেই কেন?" দীনবন্ধু একটু থতমত খেয়ে বললো - "না - মানে - নেই তাই নেই - কিন্তু তার কারণ -" বলে দীনবন্ধু যেন আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। ফ্যালফ্যাল করে ওনার দিকে তাকিয়ে র‌ইলো। উনি দীনবন্ধুর চোখে চোখ রেখে বললেন - "কারণ আমি।" দীনবন্ধু খুব অবাক হয়ে বললো - "আপনি? আপনি এর কারণ? না না। তা কী করে হয়?" উনি এক‌ইভাবে দীনবন্ধুর চোখে চোখ রেখে খুব আস্তে করে বললেন - "হ্যাঁ। তাই-ই হয়েছে। আমিই তোমার জন্মের পর তোমার সব কাহিনী কেড়ে নিয়েছি।" দীনবন্ধু এই কথার কিছুই বুঝতে পারলো না। আগের মতোই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে র‌ইলো ওনার মুখের দিকে। উনি বললেন - "কেন জানো? আমি যে চাই তুমি আমার পাশে এসে বসো।" দীনবন্ধু কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। উনি খুব আস্তে বললেন - "আমি খুব একা তো তাই।"

    হঠাৎ দীনবন্ধুর চোখে পড়লো দূরে অজস্র সাদা পাখি উড়ে যাচ্ছে - উড়ে যাচ্ছে - আর উড়ে যাচ্ছে - যেন অপার সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো - অগুনতি অফুরান। দীনবন্ধু বললো - "ওগুলো কী?" উনি বললেন - "ওরা কাহিনী - নানা জনের - নানা কাহিনী হয়ে ওরা এসেছিলো এখানে - এখন মুক্তি পেয়ে চলে যাচ্ছে।" দীনবন্ধু জিজ্ঞেস করলো - "কোথায়?" উনি বললেন -"শূন্যে - সমস্ত কাহিনী যে শূন্যে লোপ পায় সেই শূন্যের জগতে - - যেখানে শূন্যের সঙ্গে শূন্যের যোগ হয়, বিয়োগ হয়, গুণ হয়, ভাগ হয়, অজস্র সম্পর্ক হয় সেই মহাগণিতে।" দীনবন্ধু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর খুব ভয়ে ভয়ে বললো - "কে আপনি?"

    উনি দীনবন্ধুর দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে বললেন - "আমায় চিনতে পারছো না? তুমি যে আমায় ডেকেছিলে - সেইসময়ে - যখন সেই দুপুরবেলায় ভয়ঙ্কর রোদে চারিদিক ঝলসে যাচ্ছিলো - তোমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো - শরীর থরথর করে কাঁপছিলো - চোখে অন্ধকার নেমে আসছিলো - তখন তুমি আমায় ডেকেছিলে।" দীনবন্ধু হাঁ করে শুনছিলো কথাগুলো। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিলো সেই মুহূর্তের কথাগুলো - কী মারাত্মক কষ্ট হচ্ছিলো তার ওই মুহূর্তে -কেউ ছিলো না তার ধারেকাছেও - সে কেবল কাতর স্বরে বলছিলো - "ঠাকুর! একটু জল দেবে ঠাকুর!" কেউ আসেনি। তারপর একটা গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিলো চারিদিক। সবটাই হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল দীনবন্ধুর। দীনবন্ধু পরমবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো ওনার দিকে।

    উনি বললেন - "তোমার জীবনে কোনো কাহিনী রাখিনি আমি। কোনো ঘটনা নেই। শুধু ক'টা দিন আগাছার মতো কোনোক্রমে বেঁচে থাকা ছাড়া।" এই পর্যন্ত বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর মাথা নীচু করে বললেন - "শুধু শেষটা। শেষটায় এত করে ডেকেছিলে তুমি। আমি যেতে পারিনি। এ অতি ক্ষুদ্র অতি ভয়ঙ্কর কাহিনী।" এই কথা বলে তিনি দীনবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন - "কিন্তু তুমি এসব বোঝো না। তাই তোমার কাছে তোমার কোনো কাহিনী নেই।"

    এবার তিনি দীনবন্ধুর আরো কাছে এসে যেন ছলছলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন - "তুমি বসবে আমার পাশে এসে? আমার হাতটা ধরবে? দ্যাখো - দ্যাখো - আমার হাতটা ধরে দ্যাখো - তোমার মতোই - একেবারে খালি - কোনো কাহিনী নেই আমার‌ও - এইভাবে বসে আছি অনন্তকাল ধরে।"

    দীনবন্ধু সেই হাতদুটো সন্তর্পণে স্পর্শ করে অস্ফুটে বললো - "ঈশ্বর! ঈশ্বর!"

    এবার দূরের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বর বললেন - "আমরা দুজনে মিলে ওই উড়ে যাওয়া পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবো - যেখানে তোমার বা আমার জন্য একটাও পাখি নেই।"



    অলংকরণ (Artwork) : রঞ্জন ভট্টাচার্য
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments