১
কাশ্মীরের প্রাচীন ইতিহাস জানতে যে বইখানি অপরিহার্য তার নাম রাজতরঙ্গিণী। ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে রচনা শেষ হওয়া গ্রন্থটি সংস্কৃতভাষায় লিখিত যুগপৎ কাব্য ও ইতিহাস। এর রচয়িতা কল্হন। কাশ্মীরের সুপ্রাচীন কাল থেকে একাদশ শতক অবধি ইতিহাস এই গ্রন্থে ধরা আছে। ইতিহাস-কাব্যটি আটটি তরঙ্গে অর্থাৎ সর্গে বিভক্ত, প্রতি তরঙ্গের শুরুর শ্লোকটি অর্ধনারীশ্বর শিবের প্রশংসা, এবং প্রতিটি তরঙ্গের শেষে কবি নিজের পরিচয় লিখে গেছেন। এ থেকে জানা যায় যে কল্হন ধর্মে শৈব ছিলেন, এবং তাঁর পিতা চম্পকপ্রভু ছিলেন কাশ্মীররাজের মহামাত্য। রাজতরঙ্গিণীর কয়েকটি সিকুয়েলও আছে—দ্বিতীয়টি জোনরাজের রচিত, তৃতীয়টি তাঁর শিষ্য শ্রীবরের জৈন রাজতরঙ্গিণী, এই দুটোতে মিলে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। এরপর কবি প্রাজ্যভট্ট চতুর্থ রাজতরঙ্গিণী আরম্ভ করেন এবং তাঁর শিষ্য শুক সেখানা সম্পূর্ণ করেন। এই অংশে ষোড়শ শতক অবধি কাশ্মীরের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ আছে।
কল্হন-এর নাম কোথাও কোথাও কহলন লেখা দেখতে পাই। রাজস্থানী পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদের সম্পাদিত সংস্কৃত রাজতরঙ্গিণীতে (পিডিএফ ইন্টারনেটে লভ্য) দেখলাম, দেবনাগরীতে ‘কহলন’ লেখা রয়েছে। দেবনাগরীতে যেমন লেখা হয়, হ-এর পেটে -ল এতে -হ্ল-ই দাঁড়ায়। বাংলা অনুবাদ যেটা পড়লাম, সেখানেও কহ্লন, অনুবাদক হরিলাল চট্টোপাধ্যায়। হরিলাল চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ পড়তে ভাল এবং মূলানুগ। তাছাড়া রাজতরঙ্গিণীর পূর্ণ ইংরেজি অনুবাদ, কাব্যের প্রেক্ষিতে কলহনের সময়কার ভূগোল, ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে বিশদ গবেষণা করে গেছেন হাঙ্গেরীয়-ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যর মার্ক অরেল স্টাইন (Marc Aurel Stein)। দু’ খণ্ডে লেখা তাঁর বই Kalhan’s Rajtarangini—A chronicle of the Kings of Kashmir একখানি আকর গ্রন্থ। তাঁর লেখায় ‘কল্হন’ নামটিই ব্যবহৃত দেখা যাচ্ছে। যেহেতু বেশিরভাগ জায়গাতে কল্হন আছে, আমি কল্হন নামই অবলম্বন করলাম। স্টাইন মনে করেন, কল্হন শব্দটি ‘কল্যাণ’ শব্দের অপভ্রংশ। পুরো রাজতরঙ্গিণী জুড়ে অপভ্রংশ নামের ছড়াছড়ি। এমনকি একাধিক রাজার নামেও অপভ্রংশ রয়েছে।
রাজাদের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে রাজতরঙ্গিণীতে দুটো অব্দের ব্যবহার করা হয়েছে---লৌকিকাব্দ এবং কল্যব্দ। কল্হন বলেছেন, তাঁর অব্দগণনা ও কালনির্ণয় ‘বৃহৎ সংহিতা’ (বরাহমিহির রচিত) অনুসারে করা। কলিযুগের শুরু থেকে যে বর্ষগণনা তাকে কল্যব্দ বলা হয়। কল্যব্দ শুরুর ২৫ বৎসর অতিক্রান্ত হলে লৌকিকাব্দ শুরু হয়। লৌকিকাব্দ কাশ্মীরের নিজস্ব বর্ষগণনা। এই বর্ষগণনা অনুসারে কলিযুগের ৬৫৩ বৎসর অতীত হলে কুরুপাণ্ডবের আবির্ভাব হয়েছিল, যা আমাদের সাধারণ্যে প্রচলিত দ্বাপর ও কলিযুগের হিসেব থেকে কিছুটা ভিন্ন। রাজতরঙ্গিণীতে বর্ণিত প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম গোনন্দ, কল্হনের মতে কুরুপাণ্ডবের সমসাময়িক ছিলেন। তবে এখানে প্রথমদিকের রাজাদের জন্ম, মৃত্যু, সিংহাসনে আরোহণ ইত্যাদি প্রধান প্রধান ঘটনাতেও অব্দের উল্লেখ করা হয়নি, শুধু রাজা কত বছর রাজত্ব করেছিলেন তার উল্লেখ কোথাও কোথাও করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজা ৩০০ বছর রাজত্ব করেছেন—এমন কথাও বলা হয়েছে। এর কারণ হল, প্রথমদিকের তথ্যের ক্ষেত্রে কবিকে১ কিংবদন্তী, পূর্বতন কবিদের গ্রন্থ এবং পুরাণের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। চতুর্থ তরঙ্গের শেষের দিক থেকে রাজাদের মৃত্যুর তারিখ পাওয়া যাচ্ছে লৌকিকাব্দে, তবে কারো ক্ষেত্রেই জন্মতারিখের উল্লেখ নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারিখের সঙ্গে ভারতীয় গণনার মাস, তিথি ইত্যাদিরও উল্লেখ করা হয়েছে। কল্হন বলেছেন, তাঁর পূর্বতন কবিরা আগের যা কিছু লিখিত ইতিহাস ছড়ানো ছিটানো ছিল, সেগুলোকে গুছিয়ে এবং সংক্ষিপ্ত আকার দিতে গিয়ে নিজেদের ‘দুষ্টবৈদুষ্যে’ পূর্ণ করে ফেলেছেন, কেউ বা অসাবধানে বা বেশি কবিত্ব করতে গিয়ে মূল কথাটাই বাদ দিয়েছেন। সেজন্য তাঁকে পুরোনো রাজাদের মন্দির প্রতিষ্ঠার দানপত্র, শাসনপত্র, প্রশস্তিপত্র অর্থাৎ তখনকার ঐতিহাসিক দলিলগুলো পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে পুরোনো গ্রন্থে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের গ্রন্থ লিখতে হয়েছে। যে রাজাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাননি, সে কথা উল্লেখ করে তাদের বাদ দিয়েছেন, অযথা কল্পনার জাল বুনে ইতিহাস গড়েননি।২
কাব্যের শুরুতে কল্হন কিছু ভৌগোলিক বিবরণ ও স্থানমাহাত্ম্যের বর্ণনা দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি পূর্বতন নীলমতপুরাণ থেকে সাহায্য নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। যদিও যে কোনো পুরাণের ভিত্তি কিংবদন্তী, লোককথা ও কল্পনানির্ভর, সেই সুপ্রাচীন যুগের ইতিহাস লিখতে পাথুরে প্রমাণ পাওয়া কলহনের সম্ভবপর ছিল না। নীলমতপুরাণে বলা হয়েছে যে কাশ্মীর উপত্যকা প্রাচীনকালে জলমগ্ন ছিল। সেই বিশাল জলার নাম ছিল সতীসর। সেখানে জলোদ্ভব নামক অসুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে নীল নামে নাগরাজ ঋষি কশ্যপকে আমন্ত্রণ করেন, কশ্যপের অনুরোধে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর আদি দেবতারা আসেন, তাঁদের সহায়তায় ও কশ্যপের ইচ্ছেয় অনন্তনাগ, (রাজতরঙ্গিণীতে বলরাম) পাহাড় কেটে সেই জলকে প্রবাহিত করে দেন। জল সরে যাবার পর কশ্যপ সেখানে লোকবসতি স্থাপন করেন। তবে কশ্যপের অস্ত্বিত্বের ভিত্তি যদিও শুধুমাত্রই পৌরাণিক৩, কাশ্মীর উপত্যকার বেশিরভাগই যে একসময় জলের নিচে ছিল তার ভূতাত্ত্বিক ভিত্তি আছে। এখনো অনেকগুলো হ্রদ এখানে বর্তমান। বৃহত্তম উলার হ্রদ, (মূল শব্দ সংস্কৃত ‘উল্লোল’, অর্থ বড় বড় ঢেউ) প্রাচীনকালে মহাপদ্ম সরোবর বলে খ্যাত ছিল। যুগ যুগ ধরে নদীতে আনা পলি জমা হয়ে, বসতির চাপে এবং জলবায়ুর বিবর্তনে হ্রদগুলোর আয়তন কমে আসছে। হ্রদগুলো প্রায়ই নদীখাতে অবস্থিত, যাতে বোঝা যায় নদীর গতিপথে প্লাবনের জলে হ্রদগুলোর উদ্ভব হয়েছে। ভঙ্গিল পর্বতের গভীর ভাঁজে বরফ গলা জলরাশি আটকেও হ্রদের উদ্ভব হওয়া বিচিত্র নয়।
এখানে আরেকটা মজার কথা বলি। তবে এটা নীলমত পুরাণের কাহিনি, রাজতরঙ্গিণীর নয়। আমরা জানি, কিছুদিন আগে অবধি কাশ্মীরের বাইরের লোকের, এমনকি বাকি ভারতীয়দেরও সেখানে স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে থাকার অধিকার ছিল না যেরকম আমাদের দেশের অনেক রাজ্যেই আছে, বিভিন্ন কারণে। সেই কিংবদন্তীর কশ্যপের সময়ও ওখানকার অধিবাসীদের উপত্যকার বাইরের মানুষ সম্পর্কে এইধরনের মনোভাব ছিল। যখন উপত্যকায় জলাভূমিই ছিল, তখন সেখানে নাগবংশীয়েরা রাজত্ব করত। এবারে নীলমত পুরাণ থেকে একটু বেরিয়ে গিয়ে বলি, সাধারণত নাগ বলতে সাপকে বোঝায়, তবে অনেক রকম জলজ প্রাণী, ও সরীসৃপ যেমন কাঁকড়া, কচ্ছপ, তক্ষক, শঙ্খ, এমনকি পদ্ম মহাপদ্ম ও নাগদের মধ্যে পড়ে (ধারাপাত বইয়ের অষ্টনাগ স্মর্তব্য, এবং আমার মনে হয় এই অষ্টনাগ ধারণাটা মিঠাজলে থাকা প্রধান প্রধান প্রাণী/উদ্ভিদের সম্বন্ধেই), এবং হাতিরও প্রতিশব্দ নাগ! তবে কিন্তু এই রাজত্ব করা নাগবংশীয়রা, বাস্তবে ভাবতে গেলে, সেই প্রাণীগুলোর কোনোটাই হতে পারে না। ‘নাগ’ শব্দকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নগ+অ=নাগ, (নগ- যা যায় না, যেমন পর্বত বা বৃক্ষ, নগ+অ= নাগ)। তাই ‘নাগ’ হল যারা পাহাড়পর্বত বা কোটর অবলম্বন করে বাস করে, যেমন সাপ। আরেকটা কথা, কাশ্মীরে প্রচুর প্রস্রবণ আছে, মাটির নীচ থেকে ফোয়ারার মত ওঠা জলকে বহু ফণাওলা সাপের মতোই লাগে৪, তাই হয়তো প্রস্রবণকে নাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়। কাশ্মীরের প্রধান নদী বিতস্তা একটি প্রস্রবণ ভেড়িনাগ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ওখানে প্রত্যেকটা নদীসঙ্গম তীর্থ ছিল, প্রতিটি নদীকে দেবীদের জলশরীর বলা হত, যেমন বিতস্তা পার্বতীর, বিশোকা লক্ষ্মীর। প্রস্রবণগুলোর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা ছিল কোনো-না-কোনো পৌরাণিক নাগ। কাশ্মীরী মানুষেরাও সেইসব ‘নাগ’দের সান্নিধ্যে থাকত, নাগদের অলৌকিক শক্তির অধিকারী ভেবে তাদের পুজো করত, নিজেদের নাগবংশীয় বলে পরিচয় দিত। শীতল আবহাওয়ায় বাস করার দরুন শারীরিক বৈশিষ্ট্যে কিছুটা আলাদা ছিল, রঙ ফর্সা, পাহাড়ি হওয়ায় মেদহীন, ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গ অথচ অধিক শারীরিক শক্তিসম্পন্ন। নিজেদের প্রায়-দেবতা ভেবে তারা সমতলবাসী তাদেরই মত দুপায়ের উপর দাঁড়ানো জীবকে তাদের সমজাতীয় ভাবত না, তাদের ‘মানুষ’ বলত। এই মানুষেরা মানুষোচিত কাজকর্ম বেশি জানত, অর্থাৎ বেশি ‘সভ্য’ ছিল। নীলমত পুরাণের অনুসারে, জল সরে যাবার পর কশ্যপ সেখানে সেই ‘মানুষ’দের বসবাস করানোর প্রস্তাব করেন, কিন্তু নাগেরা ‘নিচুজাতীয়’ জীবেদের সঙ্গে বাস করতে রাজি হল না। তখন কশ্যপ তাদের অভিশাপ দিয়ে বললেন, তাহলে তোমরা পিশাচদের সঙ্গে থাক। এখন, পিশাচেরাও কিছু অতিপ্রাকৃত জীব নয়, যা বুঝলাম, তারা হল আরো উত্তরের পাহাড়ের ওপারের মরুভূমির দেশ থেকে শীতকালে কাশ্মীর উপত্যকায় নেমে আসা মানুষ, যাদের শরীর নাকি ‘মলাবৃত’ অর্থাৎ তারা ভীষণ নোংরা। হয়তো তারা কোনো যাযাবর গোষ্ঠী ছিল, রুক্ষ শীতল মরুভূমিতে জল ও খাদ্যাভাবের জন্য শীতকাল কাটাতে কাশ্মীরের সবুজ সজল উপত্যকায় চলে আসত। অভিশাপ পেয়ে নাগেরা কশ্যপের কাছে কান্নাকাটি করল, তখন কশ্যপ তাদের তাঁর শর্ততে কিছুটা ঢিলে দিয়ে বললেন, তাহলে মানুষেরা তোমাদের এখানে গ্রীষ্মকালে আসবে, শীতকাল পড়তেই সমতলে চলে যাবে, এমনিতেই তাদের অত শীত সইবে না। শীতকালে পিশাচেরা আসবে, তারা গ্রীষ্মকাল পড়তে চলে যাবে। তবে এভাবে তোমাদের সঙ্গে চার যুগ থেকে তোমাদের রীতিনীতিতে অভ্যস্ত হলে তারা এখানকার অধিবাসী হতে পারবে, তোমাদের তখন আপত্তি থাকতে পারবে না। তারা আর কী করে, রাজি হল। পুরাণের মতে এভাবেই কাশ্মীরে জনবসতি শুরু হয়েছিল।
এবার রাজতরঙ্গিণীর প্রসঙ্গে ফিরি। প্রথম তরঙ্গেই কাশ্মীরের মাহাত্ম্যের কথা কলহন কয়েকটি শ্লোকে বর্ণনা করেছেন— কাশ্মীর পুণ্যবলেই বিজয় করা যায়, শস্ত্রবলে নয়—বিজীয়তে পুণ্যবলৈর্বলৈর্যস্তু ন শস্ত্রিনাম্। কাশ্মীরে শীতকালে আছে উষ্ণ স্নানাগার, আর স্রোতোজলের জন্য এখানকার নদীতে সেতু বাঁধা আছে, নদী হিংস্র জীবজন্তুশূন্য, তাই স্নানের জন্য নিরুপদ্রব। এখানে গরম নেই, কারণ পিতা কাশ্যপের নির্মিত জেনে সূর্যদেব এখানে তীব্র তেজ বিকীরণ করেন না, এখানে শিক্ষার জন্য উচ্চমানের বিদ্যাপীঠ আছে, ভাল কুঙ্কুম (অর্থাৎ কেশর) এখানেই পাওয়া যায়, এখানকার শীতল পানীয়জল এবং সুস্বাদু দ্রাক্ষাফল স্বর্গেও দুর্লভ। জগতে রত্নপ্রসবিনী পৃথিবী শ্রেষ্ঠ, পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ কুবেরশাসিত উত্তরদিক, উত্তরদিকের মধ্যে হিমালয়, এবং হিমালয় অঞ্চলের মধ্যে কাশ্মীরমণ্ডল হল শ্রেষ্ঠ। তাহলে ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’ শুধু আমরা বাঙালিরাই বলি না!
রাজতরঙ্গিণী নামও সার্থক। এটা শুধু একটি বংশের ইতিহাস নয়, বহু যুগ ধরে বহু বংশের রক্ত মিলে এক-একটি রাজবংশ হয়েছে, এক বংশের পর অন্য বংশ যেন একটি নদী অন্য নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে অন্য নাম ধারণ করেছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে এক-একটা রাজবংশ রাজসিংহাসনের দখল নিয়েছে, এক-একটা বংশে বহু বংশ মিলে গেছে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। আশ্চর্যের কথা এই যে এইসব রাজবংশ স্থাপনার ব্যাপারে জনগণের ভূমিকাও কম নয়। অনেক অকর্মণ্য বা অত্যাচারী রাজাকে প্রজারা উৎখাত করেছে, যোগ্য বিকল্প না থাকলে দূর রাজ্য থেকে যোগ্য ব্যক্তিকে এনে সিংহাসনে বসিয়েছে।
মাঝে মাঝে রাজাদের পূর্ব ইতিহাস জেনে চমকে যেতে হয়। কেউ উপপত্নীর পুত্র, কেউ বা সমাজের নিম্নশ্রেণীর, যেমন শুঁড়ির পুত্রের বংশজাত। রাজা দেবদাসী, নর্তকীর কন্যা, এমন কি চণ্ডালকন্যাকে রাজমহিষী করেছেন, অন্যপূর্বা নারীকে বিয়ে করে মহিষীর মর্যাদা দিয়েছেন, সাধারণ ভারতীয় সতীত্বের ধারণা, যা আমাদের মহাকাব্যগুলো বিজ্ঞাপিত করেছে, তার থেকে বেশ আলাদা এবং একুশ শতকের ভারতেও বেশ অভাবনীয়। যোগ্যতা থাকলে যে কোনো বর্ণের মানুষ, এবং বর্ণবহির্ভূত বিদেশিও মন্ত্রীপর্যায়ে নিযুক্ত হয়েছে। প্রয়োজনে পণ্ডিত ব্রাহ্মণ, গাড়োয়ান, কৃষক, কারিগর এবং শিল্পীরাও অস্ত্র ধরেছে। চণ্ডালী সুয্যার পালিত বংশপরিচয়হীন পুত্রের লেখাপড়া করতে বাধা নেই, সে নিজের চেষ্টায় প্রকৌশলী হয়ে দেশের বন্যানিবারণ প্রকল্প করেছে, নিজের নামে নগর এবং নিজের পালিকা মায়ের নামে সেতু এবং গ্রাম বানিয়েছে। রাজাদের অনেকেই যেমন হিন্দু দেবতাদের মন্দির বানিয়েছেন, তেমনি বৌদ্ধবিহার, বড় বড় বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করিয়েছেন। আরেকটা চমকে দেবার মতো তথ্য হল, এই রাজাদের, এবং রানিদেরও কেউ কেউ অর্থের প্রয়োজনে বহুমূল্য রত্নখচিত সোনারুপোর দেবমূর্তি, মন্দিরসজ্জার মূল্যবান ধাতু ইত্যাদি ভেঙ্গে ধাতু গলিয়ে, মন্দির বা ব্রাহ্মণকে দেওয়া অগ্রহার (নিষ্কর জমি) বাজেয়াপ্ত করে নিজেদের প্রয়োজনে লাগিয়েছেন, এবং এইসব কাজে প্রজাদের থেকে তেমন কোনো বাধা ছিল না।
বেশ ক’জন নারী শাসকও কাশ্মীরে রাজত্ব করেছেন, কেউ স্বামীর সঙ্গে যুগ্মভাবে, কেউ নিজেই সিংহাসনে বসে, কেউ বা শিশুরাজার প্রতিভূ হয়ে। রানি বা রাজমাতা দুই বিবদমান রাজার মধ্যে রাজদূতের কাজ করেছেন এমন উদাহরণও আছে। বিবাহিত নারীর একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, একাধিক বিবাহ, ইত্যাদিও বিরল নয়, তেমন নারীও রাজমহিষী হয়েছেন। পরিবার, সমাজ ও রাজ্য তাঁদের মেনে নিয়েছে। কবিও তেমন কোনো অনুদার মন্তব্য করেন নি, অল্পতেই ছেড়ে দিয়েছেন। এতে তৎকালীন কাশ্মীরীদের যৌনজীবনেও বেশ উদারতা ছিল বোঝা যায়। রাজা ও রাজপুরুষেরা অবশ্য বহুবিবাহ করত। বিবাহ-বহির্ভূত নারীও অন্তঃপুরে রাখা হত উপপত্নী হিসেবে, তাদের ‘অবরুদ্ধা’ বলা হত। প্রথমদিকে সহমরণ প্রথার উল্লেখ পাই না, পরের দিকে প্রচুর উল্লেখ আছে। তবে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই রানির ইচ্ছাধীন ছিল, অনেক ক্ষেত্রে আবার অমাত্যদের ইচ্ছায় ও সহযোগিতায় সংঘটিত হত। সহমরণে শুধু রানি নয়, ভৃত্যেরাও যেত।
২
কলহন তাঁর কাব্যে মুখ্যত চারটি রাজবংশের উল্লেখ করেছেন। প্রথমে গোনন্দবংশ তারপর কার্কোটক বংশ, তারপর উৎপল বংশ, তারপর লোহর বংশ (এর অন্তর্গত মল্লবংশ, উদয়রাজ বংশ, কান্তিরাজ বংশ)। মধ্যে দুএকজন অন্য বংশের মানুষ রাজা হয়েছেন, যেমন যশস্কর, যিনি কোনো রাজবংশের ছিলেন না। ষষ্ঠ তরঙ্গে যশস্কর এবং তাঁর পরিবার অমাত্য ও তাদের বংশধর মিলে নানা বংশের ক’জন রাজা রাজত্ব করেছেন। তারপর লোহর বংশের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। কান্তিরাজ বংশের জয়সিংহদেবের সময় পর্যন্ত গাঁথা এই ইতিহাস।
গোনন্দ বংশ—নারীর সিংহাসনে আরোহণ
কলহন প্রথমদিকের ইতিহাসের প্রামাণিক তথ্য পাননি, তাই কিংবদন্তী ও পুরাণের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর মতে, গোনন্দ বংশের প্রথম রাজা গোনন্দ মহাভারতের কুরুপাণ্ডবদের সমসাময়িক। কিংবদন্তী হলেও এই দিকটা কিছু কারণে স্মর্তব্য। সেটা হল নারীর সিংহাসনে বসা সম্পর্কিত। রাজা প্রথম গোনন্দ গোনন্দবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জরাসন্ধের আহ্বানে যুদ্ধে যোগ দিয়ে কৃষ্ণের দাদা বলরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন ও তাঁর হাতে নিহত হন। তাঁর পুত্র দামোদরও পরে কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। তারপর কৃষ্ণ দামোদরের গর্ভবতী পত্নী যশোবতীকে সিংহাসনে বসালেন। কিন্তু অমাত্যেরা একজন নারী সিংহাসনে বসবে-- এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে শ্রীকৃষ্ণ তাদের নিরস্ত করেন। তাদের বলেন যে সিংহাসনে আসীন নারীকে ভোগ্য বস্তু জ্ঞান না করে তাকে মাতা পার্বতীর ন্যায় গণ্য করবে। যশোবতীর সিংহাসনে আরোহণ নিঃসন্দেহে প্রাচীন ভারতে একটা বড় বিষয়, যদিও পুত্রের জন্ম হবার পর তিনি তাকে সিংহাসনে বসিয়ে অমাত্যদের পরামর্শে রাজ্য চালাতে থাকেন। যশোবতীর পুত্রের নামও গোনন্দ। এই দ্বিতীয় গোনন্দের পরের ৩৫ জন রাজার কোনো খবর পাওয়া যায় না, একথা কল্হন নিজেই বলেছেন, এবং এদের পরেও বেশ ক’জন রাজার সম্পর্কে এক-দু লাইনে তাদের পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষ ছাড়া আর কোনো খবর দিতে পারেননি। বিলুপ্তনাম রাজাদের পর আরো আট জন রাজার শুধু নাম ও পিতৃনাম পাওয়া যায়, তারপর যে রাজার নাম পাওয়া যায় তিনি অশোক। এই অশোকও মৌর্য অশোকের মত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ধর্মপ্রচারে সাহায্য করেন। তিনিই শ্রীনগরের প্রতিষ্ঠাতা। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও এই অশোক শিবের মন্দিরও স্থাপন করেছিলেন।
গোনন্দবংশের প্রথমদিকের রাজাদের নামে রামায়ণ ও মহাভারতের নাম প্রচুর-- রাবণ, লব, কুশ, জনক, ইন্দ্রজিত, বিভীষণ, দামোদর, যুধিষ্ঠির, অভিমন্যু ইত্যাদি। কাব্যের অনেক জায়গায়ই রামায়ণ মহাভারত থেকে উপমা, উদাহরণ ইত্যাদি দেখা যায়। তাই মনে হয়, দ্বাদশ শতকের বহু আগে থেকেই রামায়ণ মহাভারতের প্রভাব কাশ্মীরে ভালরকমই ছিল। বৌদ্ধ সংস্কৃতির থেকেও অনেক নাম পাওয়া যায়, এবং সেই সময় হুণ ও কুষাণেরাও বেশ প্রভাব ফেলেছিল। ইতিহাসে যাদের কুষাণরাজ বলে পাওয়া যায়, সেই হুষ্ক (হুবিষ্ক) জুষ্ক ও কণিষ্কের উল্লেখ পাই, এঁদের এখানে ‘তুরুষ্কদেশীয়’ (স্টাইন যে দেশকে তুর্কমেনিস্তান বলেছেন, সেখানকার) বলা হয়েছে, যদিও এদের আগমনের সময়ে তেমন যুদ্ধের খবর পাই না। কলহনের মতে এঁদের রাজত্বকাল হল শাক্যসিংহ বুদ্ধের নির্বাণলাভের দেড়শ’ বছর অতীত হবার পর। গোনন্দবংশীয় রাজা দ্বিতীয় দামোদর ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে মারা গেলে এই কুষাণ রাজারা কাশ্মীর শাসন করেছিলেন। এঁরা বৌদ্ধ ছিলেন, কলহন এঁদের পুণ্যাত্মা বলেছেন, এঁরা অনেক মঠ এবং চৈত্য স্থাপন করেন।
এঁদের পরবর্তীতে রাজা অভিমন্যুর সময়ে বৌদ্ধেরা স্থানীয়দের চিরাচরিত ধর্মাচরণে প্রচুর ব্যাঘাত করেছিল। পরে গোনন্দবংশীয়রা আবার প্রভাবশালী হয়, এবং বৌদ্ধপ্রভাব খর্ব করে পুরাতন ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার করে। সেইসময়ই চন্দ্রদেব নামে ব্রাহ্মণ (যার উল্লেখ নীলমতপুরাণেও আছে), পুরাণ অনুসারে নাগপূজার প্রচলন করেন।
ইতিহাসে যে হুণরাজ মিহিরকুল ইত্যাদির কথা পড়ি, তাদেরও রাজতরঙ্গিণীর প্রথম তরঙ্গে দেখতে পাই। মিহিরকুল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী রাজা ছিলেন, ইনি নির্বিচারে শুধু নরহত্যাই নয়, যেকোনো জীব হত্যা করতেন, এমন কি পাহাড় থেকে তাড়িয়ে হাতিদের খাদে ফেলে মরতে বাধ্য করতেন! গোনন্দ বংশের আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা—বক নামে এক রাজা ভট্টা নামে এক যোগিনীর মাতৃকাচক্রে নিমন্ত্রিত হয়ে পুত্র-পৌত্রদের সঙ্গে নিয়ে যান, এবং সেখানে তাঁদের বলি দেওয়া হয়! নরবলির প্রথা এর পরেও আরো দু-একবার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এত ব্যাপক বলি নয়। প্রথম তরঙ্গের শেষে গোনন্দবংশের রাজা প্রথম যুধিষ্ঠির, যার চোখ ছোট ছোট বলে লোকে তাঁকে ‘কাণ’ বলত, স্বেচ্ছাচারিতা ও অকর্মণ্যতার জন্য প্রজারা তাঁকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে একই বংশের অন্য রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসায়।
দ্বিতীয় তরঙ্গে আমরা কাশ্মীর উপত্যকায় একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের খবর পাই। তখন রাজা তুঞ্জীন ও তাঁর রানি বাক্পুষ্টা একসঙ্গে রাজ্যশাসন করতেন। সেইসময় শরৎকালে ধান পাকার সময়ে হঠাৎ করে আবহাওয়া খারাপ হয়, অকালে বরফ পড়ে মাঠের ফসল মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়। দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের খাদ্যাভাব দূর করার জন্য রাজা নিজের এবং মন্ত্রীদের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে অন্য জায়গা থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনে প্রজাদের মধ্যে বিলোতে থাকলেন, রাজকোষ খালি হয়ে গেল, কিন্তু দুর্ভিক্ষের শেষ হল না। রাজা প্রজাদের বাঁচাতে অক্ষমতার দুঃখে প্রাণত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। তখন রানি রাজাকে নিরস্ত করে রাজার অজ্ঞাতসারে এক কাজ করলেন, প্রতিদিন প্রচুর পায়রা মেরে প্রজাদের বাড়িতে বাড়িতে ফেলবার ব্যবস্থা করলেন। রাজার অজান্তে কাজটা করতে হয়েছিল, কারণ রাজা জীবহিংসার বিরোধী ছিলেন। পায়রার মাংস খেয়ে প্রজারা শরীরে বল পেল, এবং কিছুদিনের মধ্যে আবহাওয়ার উন্নতি হলে দুর্ভিক্ষের প্রকোপও কমল।
তৃতীয় তরঙ্গে দেখা যায় রাজা তুঞ্জীন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে প্রজারা গান্ধারদেশ থেকে রাজা হবার উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে আসে। সেই রাজা মেঘবাহনের রানি ছিলেন লো-রাজ্যের কন্যা, লো সম্ভবত লাদাখের প্রাচীন নাম। মেঘবাহনের সময়েও কাশ্মীরে কেউ কেউ দেবী দুর্গা বা চণ্ডিকার কাছে নরবলি দিয়ে পূজা করত- - এমন খবর পাচ্ছি। এই বংশের তোরমানই প্রথম কাশ্মীরে দীনার নামক মুদ্রার প্রচলন করেন, কিন্তু সেই মুদ্রায় তাঁর বড় ভাই হিরণ্যের নামের বদলে নিজের নাম খোদিত করান। এই কারণে হিরণ্য ক্রুদ্ধ হয়ে তোরমানকে কারারুদ্ধ করেন। তোরমানের অন্তঃসত্ত্বা পত্নী পালিয়ে গিয়ে এক কুম্ভকারের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে এক পুত্রের জন্ম দেন। প্রবরসেন নামে এই বালক বড় হয়ে নিজের পরিচয় জেনে পিতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন, কিন্তু পিতা মুক্ত হয়ে শীঘ্রই মারা গেলে তিনি বৈরাগ্যযুক্ত হন। তাঁর মাতা অঞ্জনাও দুঃখে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে চাইলে প্রবরসেন বারণ করেন। এরপর তিনি দীর্ঘদিন তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করেন। এরই মধ্যে হিরণ্যও মারা গেলে রাজ্য অরাজক হয়ে পড়ে, তখন উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর বিশ্বস্ত বিদ্বান ও কবি মাতৃগুপ্তকে কাশ্মীরের রাজা করে পাঠিয়ে দেন। কয়েক বছর পর প্রবরসেন ফিরে এলে মাতৃগুপ্ত তাঁকে রাজ্য সমর্পণ করে নিজে তীর্থে চলে যান। প্রবরসেনই কাশ্মীরে প্রথম বিতস্তার উপর মহাসেতু নির্মাণ করান, কয়েকটা নৌকো জুড়ে তার উপর দিয়ে সেই সেতু নির্মিত হয়েছিল।
গোনন্দ বংশের আরেক রাজা নরেন্দ্রাদিত্য তাঁর দুই মন্ত্রীর সহযোগে ‘লিখিতস্থিতি’ অর্থাৎ রাজার আয়-ব্যয় আদান-প্রদান ইত্যাদির লিখিত রেকর্ড রাখার জন্য অধিকরণ অর্থাৎ অফিস তৈরি করেন। এই বংশের শেষ রাজা বালাদিত্য। তাঁর পুত্র ছিল না, তাই কন্যা অনঙ্গলেখার স্বামী দুর্লভবর্ধন শ্বশুরের সিংহাসনে বসেন।
৩ কার্কোটক বংশ
চতুর্থ তরঙ্গের প্রথম রাজা দুর্লভবর্ধনের পিতা কার্কোটক একজন নাগ ছিলেন, তাই নতুন রাজবংশ হল কার্কোটক বংশ। রানি অনঙ্গলেখা বিবাহিত হয়েও প্রথম যৌবনে মন্ত্রী খঙ্খকে ভালবাসতেন। স্বামী প্রমাণ পাবার পরেও স্ত্রীকে কোনো দণ্ড দেননি বা অন্য কোনো বিয়ে করেননি, যা আমাদের ভারতীয় সমাজের পক্ষে বেশ দৃষ্টান্তমূলক।
অনঙ্গলেখা ও দুর্লভবর্ধনের বংশের রাজা চন্দ্রাপীড়ের চরিত্রের উদারতা মনে রাখার যোগ্য। তাঁর অমাত্যেরা একটি মন্দির নির্মাণ শুরু করেছিল, কিন্তু নির্মাণ আরম্ভ হবার পর দেখা গেল জমি কিছুটা কম পড়বে। তাই তারা জমির গায়ে ঘেঁষা একজন চর্মকারের বাড়ি মন্দিরের নামে দখল করতে চেয়েছিল। কিন্তু চর্মকার যখন বাড়ি দিতে অস্বীকার করল, তখন তারা অর্থ তাকে দিয়ে বাড়িটা কিনতে চাইল, তবুও সে রাজি হল না। মন্ত্রীরা রাজাকে গিয়ে চর্মকারের স্পর্ধার কথা কথা বললে তিনি তাদের তিরস্কার করে বললেন, চর্মকারের কোনো দোষ নেই, কারণ অমাত্যেরা তার অনুমতি না নিয়েই সেখানে কাজ আরম্ভ করেছিল, ও পরে তাকে তার বাড়িটা ছেড়ে দিতে বলেছিল। তাই অমাত্যের এই কাজ স্থগিত রাখা উচিত, আর নইলে অন্য জমির খোঁজ করতে হবে। মন্ত্রীরা আবার চর্মকারের নিকট দূত পাঠাল। সে সেই দূতমুখে বলে পাঠাল, সে সমাজে নিচুজাতি, তবুও রাজা যদি তাকে দেখা দেন, তাহলে সে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আসবে। তার স্পর্ধায় মন্ত্রীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন। কিন্তু রাজা তাকে আসতে বলে পাঠালেন। পরদিন সে এলে রাজা তার সঙ্গে দেখা করে বললেন, সে যদি বাড়িটা দেয়, তাহলে রাজা তাকে এর চাইতে ভাল বাড়ি অথবা তার চাহিদামত অর্থ দিতে প্রস্তুত। চর্মকার এবারে নিমরাজি হল, তবে তার কথাও সে বলতে ছাড়ল না। সে বলল, মহারাজ, আপনার রাজধানী যেমন আপনার কাছে সুন্দর, আমার কুটিরও আমার কাছে তেমনি সুন্দর। নিজের বাড়ি নিজের মায়ের মত, আজন্ম সুখদুঃখের সাক্ষী। সেই বাড়ি ভাঙ্গা পড়লে আমার দুঃখ হবেই। তবুও আপনি যদি চান, আমার বাড়িতে গিয়ে আমার কাছে আমার কুটির চাইতে হবে। রাজা তাই করলেন। চর্মকারের বাড়িতে নিজে গিয়ে তার বাড়িটা চাইলেন, সে রাজি হলে তাকে তার চাহিদামত অর্থ দিয়ে বাড়িটা কিনে নিলেন। সেই বাড়ির জমিতে মন্দিরের বাকি অংশ তৈরি হল। দুর্ভাগ্যবশত এই ন্যায়বান রাজা চন্দ্রাপীড় তাঁর ভাই তারাপীড় ও এক ব্রাহ্মণের মিলিত ষড়যন্ত্রে প্রাণ হারালেন।
চন্দ্রাপীড়ের এক ভাই ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় বেশ যুদ্ধবাজ রাজা ছিলেন। ইনি আফগানিস্তান থেকে উত্তর ভারত হয়ে কর্ণাট পর্যন্ত দিগবিজয়ে বের হয়েছিলেন। তবে কলহন জানাচ্ছেন, তিনি একটি দোষের কাজও করেন। নিজের আরাধ্য পরিহাস-কেশবের মন্দিরে দেবতাকে সন্ধির সাক্ষী রেখেও গৌড়ের রাজাকে বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক বধ করেন। গৌড়রাজের অনুচরগণ এই হত্যার প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনা করেছিল। রাজার অনুপস্থিতির সুযোগে তারা কাশ্মীরে ঢুকে পরিহাস-কেশবের মন্দির ঘেরাও করবার জন্য আসে। পুরোহিত মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেন। তারা ভুল করে সামনের অন্য মন্দিরে ঢুকে পরিহাস-কেশবের মূর্তির বদলে রামস্বামীর মূর্তি তুলে এনে ভেঙ্গে চুরমার করে ছড়িয়ে দেয়। তারপর সৈন্যরা নগর থেকে বের হয়ে গৌড়ীয়দের আক্রমণ করে, এবং তারা যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ হারায়। কলহন তাদের রাজভক্তির, তাদের বীরত্ব ও দৃঢ় চরিত্রের প্রশংসা করেছেন, যদিও তিনি আক্রমণকারী হিসেবে তাদের গৌড়রাক্ষস বলে অভিহিত করেছেন।
এই বংশের আরেক রাজা জয়াপীড়ের সঙ্গেও বঙ্গের সংযোগ আছে। জয়াপীড় রাজ্যজয়ের পাশাপাশি ছদ্মবেশে একা ঘুরে বেড়াতেও ভালবাসতেন। সেরকম ভ্রমণ করতে করতে একবার গৌড় রাজ্যের প্রতিবেশী পৌণ্ড্রবর্ধনে ঢুকে পড়লেন। সেখানে কার্তিকেয় মন্দিরে নাচ দেখবার জন্য সামনেই পাথরের উপর বসে পড়লেন। সেই মন্দিরের প্রধান নর্তকী কমলা তাঁকে দেখতে পেল। অন্যধরনের অভিজাত চেহারা, এবং মাঝে মাঝেই যেন হাত কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে যাচ্ছে, যা দেখে সে বুঝল, ইনি রাজপুরুষ হবেন, কারণ রাজাদের কিছুক্ষণ পর পর তাম্বুল নেবার অভ্যাস থাকে, আর সে তাম্বুল দেবার জন্য একজন দাসী সব সময়েই পিছনে করঙ্ক হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই দেখে কমলা তার একজন সখীকে জয়াপীড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে হাতে তাম্বুল দিতে বলল। অভ্যাসবশত জয়াপীড় হাত পিছনদিকে নিলে কমলার সখী তাঁর হাতে তাম্বুল দিতেই তিনি সেটা মুখে দিয়ে পিছনের দিকে তাকালেন, ও সখীকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। সখী তাঁকে কমলার কথা বলল এবং তার ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে কমলা তাঁর খুব আতিথেয়তা করল এবং দুজনেই দুজনকে ভালবাসলেন। কিন্তু সেই সময়ে শোনা গেল যে রাজ্যে একটি ভয়ঙ্কর নরখাদক সিংহ বেরিয়েছে, সে অনেক মানুষ ও পশু মেরে ফেলছে, যার জন্য রাজা থেকে প্রজা কেউই রাতের বেলা বেরোতে পারে না। জয়াপীড় সিংহকে শুধু দুহাত ও একখানি ক্ষুরের সাহায্যে মেরে ফেললেন, তবে তাঁর হাতে সিংহের দাঁতের ক্ষত হয়েছিল। পৌণ্ড্রের রাজা সিংহ নিহত হয়েছে শুনে দেখতে গিয়ে পশুটির মুখে একটি সোনার বাজুবন্ধ পেলেন যাতে রাজা জয়াপীড়ের নাম খোদাই করা ছিল। পৌণ্ড্ররাজ বুঝতে পারলেন, জয়াপীড়ই এই সিংহকে হত্যা করেছেন। তিনি মনে মনে স্থির করলেন, এই জয়াপীড়ের সঙ্গেই তাঁর কন্যা কল্যাণদেবীর বিয়ে দেবেন। তারপর খোঁজ নিয়ে জানলেন জয়াপীড় নর্তকী কমলার বাড়িতে আছেন। রাজা তাঁকে ডেকে এনে নিজের প্রস্তাব দিলেন, জয়াপীড় রাজার মেয়েকে বিয়ে করলেন, আর কাছাকাছি পাঁচটি ছোট রাজ্য জয় করে শ্বশুরকে উপঢৌকন দিলেন। তারপর আরো কিছুদিন সেখানে থেকে কমলা ও কল্যাণদেবীকে নিয়ে কাশ্মীরে ফিরলেন। এই কল্যাণদেবীর পুত্র সংগ্রামপীড় কাশ্মীরের সিংহাসনে বসে সাত বছর রাজত্ব করেছিলেন।
জয়াপীড় ন্যায়-অন্যায় বিচারের জন্য ‘ধর্মাধিকরণ’ নামে এক নূতন কর্মস্থান, এবং দূরদেশে যুদ্ধযাত্রার সময়ে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানের জন্য ‘চলগঞ্জ’ নামে কোষাগার প্রচলিত করেন। এভাবে দেখা যাচ্ছে যুগের এবং সরকারের প্রয়োজনে অফিসের উদ্ভব হচ্ছে। জয়াপীড়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল তিনি উত্তরপশ্চিম দিকের প্রতিবেশী ক্রমরাজ্য থেকে তামা আনিয়ে তামার দীনার প্রস্তুত করান ও নিজরাজ্যে তার বহুল প্রচলন করেন।
অতিরিক্ত উচ্চাশায় অকারণ যুদ্ধবিগ্রহের ফলে রাজকোষে টান ধরে। বুদ্ধিমান জয়াপীড় শেষের দিকে প্রচণ্ড অত্যাচারী হয়ে ওঠেন এবং উৎপন্ন ফসলে কৃষকদের ভাগ-সহ সমস্ত ফসল বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করেন। এর ফলে দুর্ভিক্ষ ও অনাহারে প্রজারা মরতে শুরু করে। ব্রাহ্মণেরা এই অত্যাচারের প্রতিবাদ শুরু করেন, কেউ কেউ অত্যাচারী রাজাকে কটাক্ষ করে শ্লেষাত্মক শ্লোক লিখতে থাকেন। রাজা তাঁদের অগ্রহার বাজেয়াপ্ত করেন, অনেককে হত্যা করাতে থাকেন। বহু ব্রাহ্মণ প্রতিবাদে নদীজলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। রাজা তখন ব্রাহ্মণদের অগ্রহার নেওয়া বন্ধ করলেন বটে, কিন্তু সাধারণ প্রজাদের ভাগ নেওয়া বন্ধ করলেন না। রাজ্যে অসন্তোষ জ্বলতে লাগল, একসময় জয়াপীড় বিদ্রোহী ব্রাহ্মণদের হাতে নিহত হলেন।
৪
উৎপল বংশ
কার্কোটক বংশের শেষের দিকেড় রাজারা ভোগাসক্ত ও অযোগ্য ছিলেন। মন্ত্রীদের সমর্থনে তাঁদের সরিয়ে উৎপল রাজবংশ কাশ্মীরের সিংহাসনে এসেছিল। এখানে পঞ্চম তরঙ্গের শুরু। উৎপল বংশের প্রথম রাজা অবন্তিবর্মা, এঁর পিতামহ উৎপল একজন শুঁড়ির ছেলে ছিলেন, এবং উৎপলের বোন সুন্দরী জয়াদেবী ছিলেন জয়াপীড়ের বংশের রাজা ললিতাপীড়ের উপপত্নী। বোনের সংযোগেই উৎপল ও তার ভাইয়েরা রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে বংশ যে গুণের ব্যত্যয় ঘটায় না, তার পরিচয় অবন্তিবর্মার চরিত্রে পাওয়া যায়। কাশ্মীরের ইতিহাসে একজন আগাগোড়া সৎ, সুদক্ষ প্রশাসক ও প্রজারঞ্জক রাজা ছিলেন অবন্তিবর্মা। এঁর আমলে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য কাজ হল উপত্যকার বন্যানিয়ন্ত্রণ। অবন্তিবর্মার পূর্বের বেশ ক’জন রাজা বন্যা নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করেননি। বিশেষ করে এক ভূমিকম্পে বিতস্তায় দুদিক থেকে ধস নেমে নদীর প্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গ্রীষ্মের শুরুতে বরফ গলে মহাপদ্ম (উলার) হ্রদে জল নামলে সেই জল নামবার পথ না থাকায় উপত্যকা প্লাবিত হত, কৃষিক্ষেত্র ডুবে গিয়ে চাষবাস করা মুস্কিল ছিল। দেশে দুর্ভিক্ষের মত অবস্থা হয়েছিল।
বন্যানিয়ন্ত্রণে সুয্যের ভূমিকা
রাজা প্রতিকারের কথা আলোচনা করছিলেন, সেই সময় সূ্য্য নামে এক তরুণ বন্যানিয়ন্ত্রণের উপায় জানে বলে রাজার কাছে খবর এল। রাজা তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন সে কী করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করবে। সে তার কৌশলের কথা প্রকাশ না করে রাজাকে শুধু বলল, কিছু অর্থ পেলে সে কাজ শুরু করতে পারবে। অমাত্যেরা সন্দেহপ্রকাশ করলেও রাজা তাকে রাজকোষ থেকে ইচ্ছেমত দীনার নিয়ে যেতে দিলেন। সুয্য কয়েকটা দীনারের ভাণ্ড নিয়ে নৌকো করে দক্ষিণদিকের মড়ব রাজ্যের নন্দকে গেল। সেখানে নদীজলে প্লাবিত অঞ্চলে এক ভাণ্ড দীনার জলের মধ্যে ফেলে দিল। তারপর গেল নদীর উত্তর দিকে, ক্রমরাজ্যে, বরাহমূলের নিকটে। সেখানে ধস নেমে নদীগর্ভে পাথর-মাটি পড়ে স্রোত প্রায় বন্ধ ছিল, সেদিকেও কয়েক ভাণ্ড ফেলে দিল। সুয্যের অনুমানমত দু-দিকের দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকেরা যারা দীনার খুঁজবার জন্য এসেছিল তারা নদীগর্ভ থেকে ধসে পড়া পাথর তুলে জলের আটকে যাওয়া স্রোত ছেড়ে দিল। নদীর অন্য ধারে সুয্য সেইসব পাথর সাজিয়ে নদীগর্ভে আড়াআড়ি আলের মত পাথরের সেতু বাঁধল। সেতুর নিচের দিকে জল কমে যাওয়াতে সুয্য নিয়ে নদীর একদিকের পারে পাথরের বেড়িবাঁধ বাঁধল। নদীগর্ভের একদিকের পাথর তুলে নেওয়ায় সেদিকে নদীখাত গভীর হল, তখন স্রোতকে সেদিকে চালিয়ে দেওয়া গেল। এবারে অন্যদিকের পাথর তুলে সেদিকের পার বাঁধা হল। সেদিকটাও গভীর হয়ে গেল। তখন সুয্য সেতু ভেঙে দিলে নদীর স্রোত তুমুল শব্দে গভীর খাতে বইতে থাকল। প্লাবনের জন্য যেখানে যেখানে জলা হয়েছিল, সেসব জায়গা থেকে জল নেমে কাদা বেরিয়ে গেল। দীনারের ভাণ্ডগুলোও পাওয়া গেল। নতুন কৃষিজমি বেরোল, পুরোনো কৃষিজমি বন্যার থেকে রক্ষা পেল। আরো নিচের দিকেও বন্যায় যে সমস্ত স্থানে ভাঙনের সম্ভাবনা ছিল, সেইসব জায়গায় নদীর ভিতরের পাথর তুলে গভীরতা বাড়ানো হল, এবং পাড়ের দিকে বেড়িবাঁধ বাঁধা হল। পূর্বের বিখ্যাত রাজা ললিতাদিত্যের রাজধানী পরিহাসপুরের নিকটে নদীসঙ্গম ছিল, সেখানে সিন্ধু (সিন্ধু নদ নয়, এটি বিতস্তার উপনদী, সিন্ধুনালাও বলে) মিলিত হত। সেখানে ত্রিগ্রামী নামক জায়গাতে দুই নদীর জলে গ্রাম ডুবে গিয়ে জলার আকার নিয়েছিল। সুয্য সিন্ধুনদীর ধারাকে আরো উত্তরে বইয়ে দিয়ে সুন্দরীভবনের নিকটে (বর্তমান সাদিপুর) নূতন সঙ্গম তৈরি করল। আগের সঙ্গমে একটি বিষ্ণুমন্দির ছিল ও বড় বড় গাছ ছিল যেগুলোতে লোকে নৌকো বাঁধত, তাই জায়গাটির নামই ছিল নৌবন্ধন। সঙ্গম পালটে দেওয়াতে সেখানকার বিষ্ণুমন্দিরের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। তাই সুয্য নতুন সঙ্গমে যোগশায়ী হৃষীকেশের মন্দির নির্মাণ করিয়ে দিল। নতুন সঙ্গমের জন্য ত্রিগ্রামী অঞ্চলের জলা থেকে কৃষিজমি মুক্ত হল, সেখানে গ্রাম বসল। আরো উত্তরপশ্চিমে বিতস্তা মহাপদ্ম (উলার) হ্রদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত। নদীর ভাঙন রুখতে সুয্য হ্রদের নিচের দু’ দিকে সাত যোজন অর্থাৎ বিয়াল্লিশ মাইল দীর্ঘ পাথরের বাঁধ নির্মাণ করল, এবং এদিকেও নদীর গর্ভ থেকে পাথর ও পলি উঠিয়ে নদীখাত গভীর করে দিল। বাঁধ দেওয়াতে নদীর জল নির্দিষ্ট খাতে প্রবল স্রোতে বইতে লাগল, হ্রদের আশপাশের গ্রামগুলো বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেল। তবুও প্রতিটি গ্রামের চারপাশে বন্যা প্রতিহত করার জন্য আলাদা করে গোল বাঁধ দেওয়া হল, ফলে গ্রামগুলোকে কুণ্ডলের মত দেখাত। সূয্য মহাপদ্ম সরোবরে পাখি ও মাছ শিকার করা নিষিদ্ধ করে দিল। ফলে বাঁধগুলো মানুষের অতিরিক্ত নৌবাহন ও বিচরণজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা পেল।
সুয্য আরো একটি বিজ্ঞানসম্মত কাজ করেছিল। সে প্রতিটি গ্রামের মাটি আনিয়ে সেই মাটি শুকিয়ে পরীক্ষা করল কোন মাটি কতদিনে শুকোয়। এতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের মাটির জলধারণ ক্ষমতা নির্ণয় হল, এবং বোঝা গেল কোন জমিতে কত জলসেচের দরকার। তথ্য জানার পর সে প্রতিটি গ্রামে কৃষির জন্য উপযুক্ত জলসেচের ব্যবস্থা করেছিল। সেই অনুসারে নদী ও উপনদী থেকে গ্রামগুলো পর্যন্ত সেচের ছোটবড় নালা কাটা হল। এখন আর কৃষির জন্য বৃষ্টির উপর বেশি নির্ভর করতে হত না, ফলে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন অনেক গুণ বৃদ্ধি পেল। কলহন জানাচ্ছেন, দুর্ভিক্ষের সময় একখারি ধানের দাম যেখানে দুশো দিনার ছিল, সূয্যের নদীসংস্কারের পর কৃষির উন্নতি হওয়ায় ধানের দাম কমে এক খারীতে৫ মাত্র ছত্রিশ দীনার হয়ে দাঁড়াল। যেখানে বিতস্তা নদী মহাপদ্ম থেকে বেরিয়েছে, সেখানে সুয্য নিজের নামে সুয্যপুর (বর্তমান সোপোর) নামে নগর স্থাপন করল, মায়ের নামে একটি সেতু নির্মাণ করে নাম দিল সুয্যাসেতু, একটি গ্রামের নাম রাখল সুয্যাকুণ্ডল, ও সেই গ্রাম ব্রাহ্মণকে দান করল। কবির মতে, প্রজাপতি কশ্যপ এবং অনন্তনাগ কাশ্মীরের বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য যা করেছিলেন, সুয্য একাই তাদের চাইতে বেশি কাজ করেছিলেন, এবং মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাই তিনি অন্নপতি সূর্যের মতই মহান।
অবন্তিবর্মার পর তাঁর ছেলে শঙ্করবর্মা রাজা হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি স্বভাবে ছিলেন পিতার বিপরীত-- অধার্মিক এবং প্রজাপীড়ক। রাজ্য সমৃদ্ধ, তাই প্রজার প্রতি রাজার আর দায়িত্ব নেই, এই বিবেচনায় ইনি রাজ্যজয়ে বের হলেন। ছলে বলে কয়েকটি রাজ্য দখল করে কিছু ধন সংগ্রহ করে নিজ নামে নূতন নগর পত্তন করলেন, তবে পুরাতন নগর পরিহাসপুরের সমস্ত ধনসম্পত্তি নিয়ে নূতন নগরকে সমৃদ্ধ করলেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ ও আমোদপ্রমোদের জন্য এঁর নিত্য অর্থাভাব হত, তাই প্রথমত ইনি দেবোত্তর স্থাবর এবং অস্থাবর দুরকম সম্পত্তিই আত্মসাৎ করলেন, তারপর মন্দিরে দেবপূজার জন্য ধুপ, দীপ, তেল চন্দন ইত্যাদি পুজোর জিনিষ বিক্রিতে যা অর্থাগম হত সেই অর্থে কর বসালেন। সভাসদদের খাদ্য ও কম্বলের জন্য বার্ষিক ভাতা এক-তৃতীয়াংশ করে দিলেন। রাজার মোট বইবার জন্য নিয়মিত ভারিক ছিল, তাদের বাৎসরিক বেতন দেওয়া হত। তাদের কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার গ্রামসুদ্ধ মানুষের উপর জরিমানা বসানো হল। এই জরিমানা দিতে না পারলে ভারবহন বিনা পারিশ্রমিকে করে দিতে হত। তার উপর গ্রামবাসীদের থেকে আরো নানারকম ট্যাক্স আদায় করা হত, ফলে অবন্তিবর্মার সময়কার সমৃদ্ধ গ্রামগুলো নির্ধন হয়ে গিয়েছিল।
কাশ্মীরে সাধারণ রাজকর্মচারী যারা গ্রামগুলো থেকে কর আদায় করত, তারা কায়স্থ নামে পরিচিত ছিল। শঙ্করবর্মা কায়স্থদের উপর নজর রাখতে নূতন নূতন পদের সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন দিবির, যারা হিসেব রাখে, আর গঞ্জবর, মানে স্থানীয় কোষাধ্যক্ষ। এরা সবাই রাজার পাওনা দিত বটে, কিন্তু উৎকোচের জন্য প্রজাদের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার করত। প্রজাদের উপর শঙ্করবর্মার কোনো দরদ ছিল না, তবে পুত্র কিশোর গোপালবর্মা পিতার আচরণের প্রতিবাদ করায় রাজা তাকে উলটে অপমান করলেন। শঙ্করবর্মা তাঁর রাজ্যের গুণীদেরও কদর করতেন না, এবং সবসময় বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহে থাকতেন। একসময় যুদ্ধে গিয়ে এক চণ্ডালের দূর থেকে ছোঁড়া তির গলায় বিঁধে তিনি মারা গেলেন। কিন্তু রাজার অত্যাচারের জন্য বিদ্রোহের ভয় এতটাই ছিল যে রাজা মারা যাবার পরবর্তী ছদিন পর্যন্ত সংবাদ গোপন রাখা হল এবং মৃত শরীরের মাথাটি যন্ত্রের সাহায্যে উঠিয়ে রাখা হল যেন দেখলে মনে হয় রাজা বসে আছেন।
এই কাহিনিতে সহমরণের প্রথা রীতিমত প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এর আগে নিঃসন্তান রাজা তুঞ্জীন মারা গেলে তাঁর স্ত্রী বাকপুষ্টা আগুনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, সেটার কারণ কী তাতে মতভেদ আছে--একথা কলহন নিজে বলেছেন। প্রবরসেনের জননী সহমৃতা হতে চাইলে তাঁর পুত্র বারণ করেছিলেন। শঙ্করবর্মার প্রিয়তমা স্ত্রী রানি সুগন্ধা সহমরণে যাননি, রাজা মৃত্যুর সময় তাঁকে ডেকে তাঁর হাতে পুত্র গোপালবর্মার ভার দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই মনে হয় সুগন্ধা গোপালবর্মার গর্ভধারিণী ছিলেন না, রাজা তাঁকে বিশ্বাস করতেন। শঙ্করবর্মার অন্য দুজন রানি সহমরণে গিয়েছিলেন, এবং দুজন ভৃত্য যারা একসময় উপকার পেয়েছিল, রাজার সঙ্গে সহমরণে গিয়েছিল--এটাও নতুন খবর।
গোপালবর্মা রাজা হলেন, কিন্তু মাত্র দুবছরের জন্য। তিনি রানিমা সুগন্ধার তত্ত্বাবধানে রাজ্য চালাতে লাগলেন। বিধবা রানি রাজমাতা হয়ে মন্ত্রী প্রভাকরদেবের প্রেমে পড়লেন, এবং গোপালবর্মা জানতে পারলে রাজাকে অভিচারে (অর্থাৎ যাদুটোনা করে) হত্যা করা হল; মনে হয় গুপ্তভাবে বিষপ্রয়োগে কাজটি করা হয়েছিল। এরপর গোপালবর্মার ভাই সঙ্কট রাজা হলেন। তাকে মাত্র দশ দিনের মধ্যে হত্যা করা হল। এরপর রানি সুগন্ধা নিজে সিংহাসনে বসলেন এবং উত্তরাধিকারীর খোঁজ করতে লাগলেন। দুবছর নিজে রাজ্য চালানোর পর মন্ত্রী, সামন্ত ও সেনানায়কেরা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করল। পালিয়ে যাবার পর আবার তাঁর পক্ষীয় সৈন্যরা তাঁকে আবার রাজ্যে নিয়ে এল, কিন্তু বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করল, এবং গোপালবর্মার জ্ঞাতি পঙ্গু নির্জিতবর্মার পুত্র পার্থ নামে এক দশ বৎসর বয়স্ক বালককে রাজা বানাল। এই সময় থেকে অনবরত রাজা পরিবর্তন, রাজাদের জ্ঞাতিবিরোধ, পিতাপুত্রে, ভাইয়েভাইয়ে, সিংহাসনের জন্য লড়াই, চরিত্রহীনতা, লাম্পট্য, মদ, অকর্মণ্যতা ও লোভের ফলে রাজ্যে অধঃপতন হচ্ছিল। একের পর এক অল্পসময়ের জন্য রাজা হলেন, আবার প্রাণ হারালেন। রাজা থেকে অমাত্য, রাজকর্মচারী ইত্যাদি কারোরই প্রজাদের প্রতি কোনো মমতা ছিল না। রাজা ও বড় বড় রাজপুরুষেরা কায়স্থ, অর্থাৎ সাধারণ রাজকর্মচারীদের মত উৎকোচ নিয়ে শুধু প্রজাদেরই নয়, একজন আরেকজনের ক্ষতি করতে লাগলেন। পরস্পরকে উৎপাটিত করতে তাঁরা ভাড়াটে সৈন্য খাটাতেন। প্রত্যেক রাজপুরুষই প্রজাদের থেকে ধনসম্পদ কেড়ে নিতে লাগলেন। এর উপরে শরৎকালে ফসল তোলবার সময় প্রবল বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হল। দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি দেখা দিল। প্রচুর মানুষ জলে ভেসে গেল, কিন্তু মন্ত্রী ও তন্ত্রীরা নিজেদের জমা-করা শস্য বহু মূল্যে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করল। যে ব্যক্তি রাজাকে বেশি অর্থ দিতে পারত, রাজা তাকেই মন্ত্রী বানাতেন। এদিকে রানিরা নিজ নিজ সন্তানকে উত্তরাধিকারী বানানোর জন্য প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা করতেন, টাকা দিতেন। এইভাবে কাশ্মীর রাজের অন্তঃপুরও দুর্নীতি ও লাম্পট্যে ছেয়ে গেল।
এখানে আমরা তন্ত্রিসৈন্যের উল্লেখ পাচ্ছি, যাদের এই অকর্মণ্য ও নির্ধন রাজারা নিজস্ব সৈন্যের অভাবে ভাড়া নিতেন। এরা ছিল বিশেষ এক জনজাতি, যারা প্রাথমিকভাবে রাজার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করত। রাজাদের অর্থাভাব, তাই এদের হুণ্ডির সাহায্যে টাকা দেওয়া হত। আর পাচ্ছি প্রতাপশালী ডামরদের, যাদের প্রথম উল্লেখ পাই ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের শেষ বার্তায়। সেখানে তিনি নিজের উত্তরাধিকারী পুত্রের উদ্দেশ্যে বলছেন, কৃষক প্রজাদের কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা হলে তারা ডামরে পরিণত হবে। ডামর বলতে কী বোঝায় কলহন তার কোনো আক্ষরিক ব্যাখ্যা দেননি। তবে অবন্তিবর্মার সময়ে এক ডামরের উল্লেখ পাই, যে ধন-জন-সম্পদে বলীয়ান হয়ে রাজার আদেশ বারে বারে উল্লঙ্ঘন করছিল এবং শেষপর্যন্ত তাকে হত্যা করতে হয়েছিল। তাই বোঝা যাচ্ছে, ডামরেরা ছিল কাশ্মীরের সম্পন্ন কৃষক থেকে আধাসামন্ত সর্দাররূপে উন্নীত প্রজা। এরা বাস করত পাহাড়ের ছোট ছোট উপত্যকায়, তাই এদের গহ্বরবাসী বলা হত, এরা যুদ্ধবাজ, এবং গৃহযুদ্ধ বাঁধলে এক বা অপর পক্ষ অবলম্বন করত। ধীরে ধীরে ডামরদের প্রভাব এবং প্রতাপ বৃদ্ধি পেতে লাগল।
শঙ্করবর্মার সময় থেকেই রাজ্যের আর্থিক অবস্থা নামতে নামতে পার্থের সময় দুরবস্থার চরম হয়েছিল। এর পরপর পার্থের পিতা পঙ্গু নির্জিতবর্মা, চক্রবর্মা, শূরবর্মা, ঘুরে ঘুরে রাজত্ব করলেন। এই রাজাদের কেউ কেউ আপন সুরক্ষার জন্য ডামরদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে নিজের পক্ষভুক্ত করলেন। রাজা চক্রবর্মা একসময় তাঁর পক্ষের ডামরদেরও বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করেছিলেন। লাম্পট্যের কারণে তিনি প্রজা এবং নিজের অন্তঃপুরিকাদের মধ্যেও ঘৃণিত ছিলেন। শেষপর্যন্ত রানিদের সমর্থনে ডামরেরা তাঁকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। এরপর রাজ্যহারা রাজা পার্থের পুত্র উন্মত্তাবন্তি রাজা হয়, সে নিজের পিতামাতাকে পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। তারপর একটি শিশুকে রাজপুত্র পরিচয় দিয়ে সিংহাসনে বসানো হয়, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই অমাত্যদের গণ্ডগোল বাঁধলে সেই শিশুরাজা শূরবর্মাকে নিয়ে তার মা পালিয়ে যায়। তারপর ব্রাহ্মণেরা রাজবংশের বাইরে কাউকে সিংহাসনে বসাল, এর নাম যশস্কর।
ষষ্ঠ তরঙ্গ
রাজা যশস্কর প্রথমটা ভালই ছিলেন, তিনি বুদ্ধিমান, রাজবংশীয় না হয়েও রাজা হওয়াতে নিজের সৌভাগ্যের জন্য বিনয়ী ছিলেন। সবচাইতে বড় কথা, যে ব্রাহ্মণেরা তাঁকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও তাঁদের দূরে থাকতে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁদের দ্বারা পরিচালিত হতে অস্বীকার করেন। তাঁর সময় প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজ করতে পারতেন, রাস্তাঘাটে নির্ভয়ে লোক চলাচল করত, দোকানপাট রাতেও দরজা বন্ধ করত না। পুর্বতন যুগের পণ্ডিতদের কটাক্ষ করে কলহনের স্মরণীয় শ্লোক--
ন মূর্খগুরবো মৎস্যাপূপযাগবিধায়নঃ।
চক্রিরে স্বকৃতৈঃ গ্রন্থৈঃ তর্কাগমপরীক্ষণম্।। ১১,ষষ্ঠ তরঙ্গ
শ্লোকটির অর্থ – ( যশস্করের সময়) কোন মূর্খগুরু মৎস্যাপূপ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে পারতেন না, এবং প্রাচীন শাস্ত্রের মধ্যে নিজের লেখা গ্রন্থ প্রক্ষিপ্ত করতে পারতেন না। বোঝা যাচ্ছে, অনেক গুরুই মূর্খ ছিলেন আজকালকার মত, যারা কোনো বিধিবিধান না জেনেই শিষ্যদের কাছে গৌরব দেখাতে ধর্মীয় কৃত্য করতেন! ভাল কিছু লিখতে না পারলেও পুরোনো গ্রন্থের মধ্যে নিজের মনগড়া নিম্নমানের রচনা ঢুকিয়ে শাস্ত্রকে নিজের মত করে প্রচার করতেন!
রাজতরঙ্গিণীতে শাসক যশস্করের সুবিচারের দুটো উদাহরণস্বরূপ দুটো গল্পের অবতারণা করা হয়েছে। এই গল্পগুলো থেকে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে বণিকদের চরিত্রের আভাস পাওয়া যায়। প্রথমটি এইরকম: এক ব্যক্তি সুবিচারের আশায় অনশন করছিল। রাজার লোকজন তাকে ধরে রাজার কাছে নিয়ে এল। রাজা তার অনশনের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, প্রায় কুড়ি বছর আগে সে ঋণগ্রস্ত হয়ে এক বণিকের কাছে বাড়ি বিক্রি করেছিল। বাড়ির সঙ্গে ভিতরে ধাপকাটা একটি কুয়ো ছিল, সেই কুয়োটি সে বিক্রি করেনি, তার স্ত্রীর ভরণপোষণের খরচের জন্য রেখে দিয়েছিল-- কাশ্মীরে গ্রীষ্মকালে মালিরা ফুল-পাতা তাজা রাখবার জন্য এইধরনের কুয়োর ভিতরে রাখত, কুয়োর মালিককে সেজন্য ভাড়া দিত। এরপর সেই ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করে বিদেশে চলে যায়। কুড়িবছর পর কিছু টাকা জমিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে সে দেখল, তার সাধ্বী স্ত্রী লোকের বাড়ি দাসীবৃত্তি করে অতিকষ্টে জীবন ধারণ করছে। সে কারণ জিজ্ঞেস করলে স্ত্রী বলল, স্বামী চলে যাবার পর বণিক তাকে কুয়োর অধিকার দেয়নি, উপরন্তু লাঠি দিয়ে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আর উপায় না দেখে সে দাসীবৃত্তি করে কোনোরকমে জীবন ধারণ করছে। একথা শুনে লোকটি বিচারের জন্য বিচারপতিদের দ্বারে দ্বারে বিচারের জন্য ঘুরেছে, কোথাও সুবিচার পায়নি, সবাই বণিকের পক্ষে রায় দিয়েছে। তাই সে অনশন ছাড়া প্রতিবাদের আর রাস্তা দেখছে না। সে দরিদ্র, ন্যায়ের কিছুই জানে না, তবে কুয়োটি যে তার, সেকথা শপথ করে বলতে পারে।
রাজা তার কথা শুনে প্রত্যর্থী বণিককেও ডাকিয়ে নিয়ে বিচারপতিদের সঙ্গে বিচার করতে বসলেন। বিচারপতিরা বললেন, মহারাজ, বাদী লোকটি ধূর্ত, এ ন্যায়ের সম্মান রক্ষা করেনি। লোকটি এমনকি তার বিক্রয়পত্রে যেখানে আমরা কোনো দোষ দেখিনি, তাতে দোষারোপ করছে। তাই এর দণ্ডবিধান করা উচিত। রাজা নিজে বিক্রয়পত্র পড়লেন, তাতে লেখা আছে সোপানকূপ সহিত গৃহ বিক্রীত হল। রাজসভার সভ্যরাও স্পষ্ট দেখল, একই কথা। কিন্তু রাজা বুঝলেন, এতে কিছু গলদ আছে। একটু চিন্তা করে অন্যকথায় গিয়ে সভাসদদের মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন, তারপর হাসতে হাসতে সবাইকে বললেন, আপনাদের আংটিগুলো দেখি তো? সবাই যার যার আংটি খুলে রাজাকে দিলেন। রাজা সবাইকে অপেক্ষা করতে বলে হাসতে হাসতে সবকটা আংটি নিয়ে, পা ধুতে হবে এই ছল করে ভিতরে গেলেন, সেখান থেকে সেই বণিকের আংটি দিয়ে একজন ভৃত্যকে বণিকের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। রাজার ভৃত্য বণিকের হিসাবরক্ষককে সেই আংটি দেখিয়ে যে বছর বিক্রয়পত্র লিখিত হয়েছিল, সেই গণনাপত্রিকা চাইল। হিসাবরক্ষক কারণ জিজ্ঞেস করাতে রাজভৃত্য বলল, বিবাদের মীমাংসা করতে কাগজটার (এখানে ভূর্জপত্র) দরকার আছে। তখন হিসাবরক্ষক আংটি রেখে কাগজটা দিল। ভৃত্যের কাছ থেকে নিয়ে রাজা কাগজে পড়লেন, অধিকরণলেখককে (দলিলপত্র যে লেখে) হাজার দীনার দেওয়া হল। রাজা বুঝলেন, এই কাজের যা পারিশ্রমিক, তার চাইতে অনেক বেশি দেওয়া হয়েছে। কারণ অনুসন্ধানে রাজা বুঝতে পারলেন, লেখায় দুএকটা অক্ষরকে পরিবর্তন করে -র-এর জায়গায় -স লিখা হয়েছে। সভ্যদের পত্রখানা দেখিয়ে লেখককে ডাকলেন, এবং তাকে অভয় দিয়ে বললেন সত্য বলতে। সে সত্য বলল, অর্থাৎ বোঝা গেল যে ‘সহিত’ নয়, ‘রহিত’ হবে। (দেবনাগরী অক্ষরে র-কে সহজেই স করা যায়।) তখন রাজা বিচারার্থীকে কুয়োসহ বাড়ি প্রত্যর্পণ করলেন, এবং প্রবঞ্চক বণিককে নির্বাসিত করলেন।
দ্বিতীয় গল্পটি এরকম: একদিন এক ব্রাহ্মণ বিচারের জন্য রাজার দ্বারে এসেছিল। তখন বিচারসভা সবে শেষ হয়েছে, রাজা মধ্যাহ্নভোজন করতে উঠেছেন, তাই দ্বারপাল ব্রাহ্মণকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ তখন আত্মহত্যা করতে উদ্যত হওয়ায় দ্বারপাল ভয়ে ভয়ে তক্ষুনি রাজার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছে। রাজা ভোজন বন্ধ রেখে ব্রাহ্মণকে ডাকালেন এবং আসবার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ব্রাহ্মণ বলল, সে নানা জায়গা ঘুরে একশত স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করেছিল। দেশে সুশাসন হয়েছে শুনে দেশে ফিরে আসছিল, দেশে এখন চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই। রাস্তায় লবণোৎস নামক স্থানে এক উদ্যানের গাছতলায় নিরুপদ্রবে ঘুমিয়েছে, তবে ঘুম থেকে ওঠার পর একটি ঘাসে ঢাকা কুয়োতে হঠাৎ তার কাপড়ে বাঁধা সোনা পড়ে গেল। সে কাঁদছিল, ভাবছিল কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে মরবে। তার কান্না শুনে একজন লোক এসে বলল, আমি যদি তোমার সোনা উঠিয়ে দিই, তুমি কী দেবে? ব্রাহ্মণ ব্যাকুল হয়ে বলল, যা দিতে হয় হয় তা-ই আমাকে দিও। সেই ব্যক্তি কুয়োয় নেমে সব মুদ্রা উঠিয়ে তার থেকে ব্রাহ্মণকে দুটো মাত্র দিয়ে বাকি সব নিজে নিল। ব্রাহ্মণ প্রতিবাদ করাতে অন্য লোকেরা যারা ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল, তারাও বলল, রাজা যশস্করের শাসনে বাক্যানুযায়ী ব্যবহার হবে। ব্রাহ্মণ রাজাকে বলল, আমি ভদ্র ব্যবহার করে সব হারালাম, আপনার এই নিয়মের কারণে। তাই আপনার দুয়ারে আমি প্রাণ দেব। রাজা ব্রাহ্মণকে সেই ব্যক্তির নাম জিজ্ঞেস করলেন। ব্রাহ্মণ বলল, নাম জানি না, তবে লোকটাকে দেখলে চিনতে পারব। রাজা তাকে আশ্বস্ত করে নিজের পাশে বসিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করালেন।
পরদিন লবণোৎসের সব পুরুষকে রাজা রাজধানীতে ডাকলেন। কোন লোকটির বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণের অভিযোগ তাকে চিহ্নিত করতে বললেন। ব্রাহ্মণ তাকে দেখালে পর রাজা তাকে ঘটনা জিজ্ঞেস করলেন। সে ঠিকঠাক সব কথা বলল। রাজার সভ্যেরা কথা ও কার্যের পার্থক্য বুঝতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। তখন রাজা বিচারাসনে বসে বললেন, তুমি দুই মুদ্রা ও বাকি ব্রাহ্মণ পাবে। যা দিতে হয় দিবে, একথার মানে হল, যা সঙ্গত তা নেবে, আর দেবে। এই ব্রাহ্মণ ভেবেছিল দুই স্বর্ণমুদ্রা সঙ্গত পারিশ্রমিক। তাই কথার ফাঁক ধরে তোমার এত মুদ্রা নেওয়া উচিত হয় নি। লোকটি বাধ্য হয়ে আটানব্বই মুদ্রা ব্রাহ্মণকে ফেরত দিল। বিচার হয়ে গেল।
যশস্কর যদিও বুদ্ধিমান ছিলেন, রাজ্যের ভিতরে শান্তি স্থাপন করেছিলেন, নিজের অন্তঃপুর ও সভাসদদের দমন করতে পারেননি, দেবতার সামনে তরবারি রেখেও তন্ত্রিদের হত্যা করেছিলেন। রাজা নিজের ন্যায়নীতি নিজের কাজে অনুসরণ করতেন না। চার জন নগরাধ্যক্ষ নিযুক্ত করে বহু অর্থ সংগ্রহ করলেন, অর্থাৎ নগরাধ্যক্ষরা প্রজাপীড়ন করে এই অর্থ আদায় করেছিল। এইখানে কবি একটা সুন্দর উপমা দিয়েছেন, পরস্যোপদিশন্ পথ্যমপথ্যাশীব রোগহৃৎ --যেভাবে রোগহৃৎ অর্থাৎ বৈদ্য অপরের সম্বন্ধে পথ্যাপথ্যের বিচার করে, কিন্তু নিজে অপথ্য ভোজন করে, যশস্করও তেমনি করতেন। রানিদের প্রতি বিশ্বাস ছিল না বলে নিজের সন্তান সংগ্রামদেবকে ঔরসজাত বলে অস্বীকার করে পিতামহের ভাইয়ের ছেলে বর্ণটকে উত্তরাধিকারী করেছিলেন। সেইসময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, কিন্তু বর্ণট রাজপ্রাসাদে বাস করেও তাঁর খোঁজ নিল না। এই কর্তব্যচ্যুতির অপরাধে বর্ণটকে একরাত রাজসভায় বন্দী করে রাখলেন, তারপর তাকে রাজ্যচ্যুত করে ছেড়ে দিলেন। আবার অমাত্যদের কথায় সংগ্রামদেবকে রাজ্য দিলেন। পেটের অসুখে অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তিনি রাজ্য ছেড়ে নিজের মঠে শেষ দিনগুলো কাটাতে যাচ্ছিলেন, সঙ্গে কিছু স্বর্ণমুদ্রা ছিল। সেগুলো স্বজন ও ভৃত্যরা কেড়ে নিল। এরপর তিনি মঠে কিছুদিন বেঁচেছিলেন, কিন্তু অমাত্য, মন্ত্রী-পরিজন কেউ তাঁর খবর নিত না, একসময় তাদেরই কেউ বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করল। তিনি মাত্র ন’বছর রাজত্ব করেন। একজন রানি ত্রৈলোক্যদেবী তাঁর সহমৃতা হলেন।
যশস্করের ছেলে সংগ্রামদেবকে সপরিবারে হত্যা করে অমাত্য পর্বগুপ্ত রাজা হল। কবির কথায় --পর্বগুপ্ত নিজের ঘাসের মত দাড়িতে কেশরের রং লাগাত, ফলে তার দাড়ি দেখতে উষ্ট্রশিশুর পিঠের পিঙ্গল লোমের মত দেখতে হত! কামুক এবং ভয়ঙ্কর অত্যাচারী এই রাজাকে কল্হন পাপাত্মা বলেছেন। এরপর তার ছেলে ক্ষেমগুপ্ত রাজা হল, চরিত্রে একই প্রকার। এই রাজা আবার বৌদ্ধবিহার দগ্ধ করে মূর্তিগুলোর পিতল এবং পাথর নিয়ে বিহারের কাছেই নিজের নামে শিবমন্দির করেছিল, বিহারের বাকি জমি খশ রাজাকে দিয়ে দিয়েছিল। ক্ষেমগুপ্ত লোহর দুর্গের রাজা শাহিবংশীয় সিংহরাজের কন্যা দিদ্দাকে বিয়ে করেন, বিয়ের পর পত্নীর অত্যন্ত বাধ্য হয়ে পড়ায় লোকে পরিহাস করে তাঁকে দিদ্দাক্ষেম বলত। ক্ষেমগুপ্ত অস্ত্রশস্ত্র চালনায় বিশেষ পটু ছিলেন না, যুদ্ধের ভল্ল দিয়ে শেয়াল শিকার করতে যেতেন। সেই সঙ্গে ডোমেরা কুকুর ও জাল নিয়ে যেত। শেয়াল মারতে মারতেই তাঁর সময় কাটত। একসময় গুটিবসন্ত রোগে এই রাজার মৃত্যু হয়।
রানি দিদ্দা
এবার ক্ষেমগুপ্তের ছেলে অভিমন্যু রাজা হলেন, এবং নাবালক রাজার অভিভাবক হলেন দিদ্দা। দিদ্দা রাজপুরুষদের সহায়তায় রাজ্য চালাতেন, কিন্তু চট করে ভালমন্দ বুঝতে পারতেন না। মন্ত্রী ফল্গুন যে এমনিতে মন্ত্রী হিসেবে বিচক্ষণ ছিল, তার সম্পর্কে দিদ্দার দ্বেষ ছিল, কারণ সে অন্য রানিদের মত তাঁকেও স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে উপদেশ দিয়েছিল। কিন্তু আরেক অমাত্য নরবাহন তাঁকে মানা করে, দিদ্দা বেঁচে যান। ফল্গুনের যোগ্যতার জন্য অন্য মন্ত্রীদেরও তার প্রতি দ্বেষ ছিল। তাই আরেক মন্ত্রী রক্ক দিদ্দাকে গোপনে বোঝাল যে ফল্গুন রাজ্য দখল করতে পারে। ফল্গুন ভয়ে রাজধানী থেকে পালিয়ে গেল এবং শস্ত্র ত্যাগ করে দিদ্দা যে মনে মনে তার বিদ্রোহের আশঙ্কা করতেন, তা দূর করল। সে যাবার পর দিদ্দা সন্দেহের বশে অনেক মন্ত্রী, অমাত্য, ও সেনাকে কখনো যুদ্ধে, কখনো বা গুপ্তঘাতকের হাতে হত্যা করালেন। একসময় তাঁর ছেলে রাজা অভিমন্যু যক্ষারোগে মারা গেল। তার পর থেকে দিদ্দা তিন নাতিকে পর পর সিংহাসনে আরোহণ করিয়ে তাদের নিজের মনোমত না হওয়ায় হত্যা করালেন, এবং তারপর নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করলেন। তাঁর শাসনকার্যের সারাটা সময়ই বিদ্রোহী অমাত্যদের যড়যন্ত্র এবং তার দমনে ব্যয় হয়েছিল। তিনি শত্রুর শেষ রাখতেন না। ক্রুরতা, সন্দেহপ্রবণতা এবং কূটনীতিতে তিনি তাঁর পূর্বতন পুরুষ শাসকদের সমকক্ষ ছিলেন।
শেষটায় উত্তরাধিকারী খুঁজতে যোগ্য রাজপুত্রদের বুদ্ধি নির্ণয়ে দিদ্দার পরীক্ষা বেশ চমকপ্রদ। তিনি তাঁর নির্বাচিত কয়েকজন বালককে একত্র করে তাদের মধ্যে কতকগুলো পালেবত ফল অর্থাৎ আপেল নিয়ে বললেন, দেখি তোমরা কে কতগুলো ফল কুড়োতে পার, বলে আপেলগুলো গড়িয়ে দিলেন। দেখলেন, একটি ছেলে অনেকগুলো ফল পেয়েছে, বাকি কেউই দুয়েকটার বেশি পায়নি, বরং কাড়াকাড়ি করে অল্পস্বল্প জখম হয়েছে। দিদ্দা যে ছেলেটি সব চাইতে বেশি পেয়েছে অথচ একটুও চোট পায়নি, তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করে তুমি এতগুলো ফল পেলে? সে বলল, আমি ওদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে নিজে সরে রইলাম, ওরা ঝগড়া করতে লাগল। মাঝখান থেকে আমি ফলগুলো নিয়ে নিলাম, চোটও পেলাম না। দিদ্দা তার বুদ্ধি দেখে আশ্চর্য হলেন, এবং তাকেই নিজের উত্তরাধিকারী স্থির করলেন। সেই ছেলেটি দিদ্দার ভাই লোহর দুর্গের অধিপতি উদয়রাজের ছেলে ছিল, নাম সংগ্রামরাজ। এর থেকে লোহর রাজবংশের উদয়রাজ শাখা কাশ্মীরের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হল, এবং রাজতরঙ্গিণীর সপ্তম তরঙ্গের সূচনা।
৫
লোহর রাজবংশ
সপ্তম ও অষ্টম তরঙ্গের মিলিত আয়তন প্রথম ছয়টি তরঙ্গের চাইতে বেশি। প্রথম দিকের তরঙ্গগুলোতে (অন্তত তৃতীয় তরঙ্গ অবধি) প্রামাণ্য ইতিহাসের অভাবে পুরাণ ও কিংবদন্তীর মিশ্রণ ঘটেছে। সময় যত এগিয়েছে, কবির বর্ণনা তত কাল্পনিক বর্ণনারহিত ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সপ্তম ও অষ্টম তরঙ্গের চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন, যাদের কাছ থেকে কবি সাক্ষাৎ দর্শক হিসেবে তথ্য পেয়েছেন--স্বয়ং তাঁর পিতা চম্পক, উদয়রাজবংশীয় রাজা হর্ষের অমাত্য ছিলেন, তাঁর পক্ষে যুদ্ধে একাধিকবার অংশগ্রহণ করেছেন, এবং পিতৃব্য কনক, যিনি হর্ষের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা করেছিলেন। অনুমান হয় জয়সিংহের অন্যতমা রানি কল্হনিকা, যাঁকে জয়সিংহ বিদ্রোহী ভ্রাতুষ্পুত্র ভোজদেবের কাছে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, এবং যাঁর বাল্যকাল থেকে চারিত্রিক গুণাবলীর কথা কবি বেশ বিস্তরে বর্ণনা করেছেন, তিনি কলহনের নিজের কন্যা। অষ্টম তরঙ্গে যে যুদ্ধের এবং দুর্গ অবরোধের বর্ণনা পড়ি, তা একেবারে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের মতই প্রতিভাত, হয়তো কবি নিজে সেইসব জায়গা পরিদর্শন করেছিলেন, বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
কোশপান প্রথা
ষষ্ঠ তরঙ্গের শেষদিকে রানি দিদ্দা তাঁর নির্বাচিত উত্তরাধিকারী সংগ্রামরাজকে রক্ষা করতে তুঙ্গ নামে সবচাইতে শক্তিধর ও বিশ্বস্ত মন্ত্রীকে পরস্পর রক্ষা করবার জন্য কোশপান করিয়ে শপথে আবদ্ধ করেছিলেন। পঞ্চম তরঙ্গ থেকেই এই প্রথার উল্লেখ দেখতে পাচ্ছি, রাজা বা রাজপুরুষেরা হাতে খোলা তরবারি নিয়ে পরস্পরের তরবারির কোশ চুম্বন করে পারস্পরিক সুরক্ষা দেবার শপথ নিতেন, সাক্ষী থাকতেন কোনো অভিভাবক রাজা বা দেবতার বিগ্রহ। ডামরদের সঙ্গে কোশপানে একটি ভেড়ার রক্তমাখা চর্মে পা রেখে এই শপথ নেওয়া হত। এই কোশপান যার যার পক্ষভুক্তদের পারস্পরিক রক্ষার চুক্তি ছিল, যা সহজে কেউ ভঙ্গ করত না।
সংগ্রামরাজের রাজত্বে ব্রাহ্মণদের কুটিল ষড়যন্ত্র বেশ সামনে এসেছে --মন্ত্রী ও সেনাপতি তুঙ্গকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইর্ষান্বিত ব্রাহ্মণেরা অন্য মন্ত্রীর সহযোগে অনশন করতে আরম্ভ করেছিল। তারা ভয় দেখাচ্ছিল-- তুঙ্গকে পদচ্যুত না করলে তারা রাজাকেও সিংহাসনচ্যুত করবে। রাজা এই সমাবেশকে বিপজ্জনক বুঝে তাদের সঙ্গে কথা বললেন, তারা তাদের দাবি থেকে সরল না। যখন রাজা বাধ্য হয়ে সম্মত হলেন, তারা বলল, তুঙ্গের পীড়নে এক ব্রাহ্মণ প্রাণত্যাগ করেছে। তার অগ্নিসৎকার করতে হবে—এই বলে কুয়ো থেকে একটি মৃতদেহ উঠিয়ে তুঙ্গের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। রাজা বুঝলেন, এসব ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। তাই তাঁর সেনারা ষড়যন্ত্রকারীদের উপর চড়াও হলে তারা তাদের পরামর্শদাতা মন্ত্রী রাজকলসের বাড়িতে পালিয়ে গেল। রাজকলস তখন যুদ্ধে নামল, কিন্তু ব্রাহ্মণেরা পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে নিজেদের বাড়িতে চলে গেল। মূল ষড়যন্ত্রকারী রাজকলস বন্দি হল, তার সহযোগী ব্রাহ্মণ শ্রীধরের সাত ছেলে যুদ্ধ করে প্রাণ হারাল। রাজকলসকে রাজা নির্বাসিত করলেন। তার ভাই ভূতিকলস কিছুদিন গা ঢাকা দেবার পর রাজার হিতৈষী সেজে এল, এবং তুঙ্গকে হত্যা করবার জন্য গুপ্তঘাতক নিযুক্ত করতে পরামর্শ দিল। তুঙ্গ ভিতরের কথা জেনে রাজাকে বলে দেওয়ায় রাজা ভূতিকলসকেও নির্বাসিত করলেন। এইভাবে সংগ্রামরাজের সমস্ত রাজত্বকালই মন্ত্রীদের পারস্পরিক ইর্ষা, হত্যার ষড়যন্ত্র, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদিতে কেটেছিল। এই প্রভাবশালী লোকগুলো সকলেই প্রজাপীড়ন করে অর্থ সংগ্রহ করত। রাজাও তার অংশ পেতেন। কাজের মধ্যে কাজ ছিল মন্দির, মঠ, বিহার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা, কারণ প্রতিষ্ঠাকারী ভাবত এসব করলে তার পুণ্য হবে, পাপ কেটে যাবে। আরেকটা ব্যাপার দেখি, সৈন্যদলে বিদেশিরাও থাকত, ‘তুরুস্ক’দের কথা প্রায়ই পাই। ‘তুরুস্ক’ হল আধুনিক তুর্কমেনিস্তানের অধিবাসী, স্থানের নাম তখনকার কাশ্মীরী ভাষায় তুঃখার।
সংগ্রামরাজের পুত্র হরিরাজ রাজা হবার মাত্র বাইশ দিন যেতেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রাণ হারালেন, ষড়যন্ত্রী ছিলেন স্বয়ং রাজমাতা ক্ষমতালোভী শ্রীলেখা। এর মধ্যে সংগ্রামরাজের ভাই বিগ্রহরাজ রাজ্য আক্রমণ করলেন। শ্রীলেখা সৈন্য পাঠিয়ে তাঁকে হত্যা করে রাজ্য নিষ্কণ্টক করলেন। এরপর সংগ্রামরাজের ছোট ছেলে অনন্ত রাজা হলেন। রানিমা যদিও রাজ্যলোভী ছিলেন, কিন্তু এবারে অমাত্যদের সতর্কতায় বিশেষ এগোতে পারলেন না, তাই মঠ স্থাপনে মন দিলেন। অনন্ত তাঁর বয়স্যদের সঙ্গে রাজকোষের ধন ওড়াতে লাগলেন, রাজস্ব শেষ হয়ে যাবার উপক্রম। দু-একজন বয়স্য তো টাকার জন্য মন্দিরের বহুমূল্য প্রতিমা ভাঙারও চিন্তা করতে লাগল। সেরকম সময়ে অনন্তদেব রুদ্রপাল নামে এক বয়স্যের পরামর্শে তারই পত্নী আসমতীর বোন সূর্যমতীকে বিয়ে করলেন। অনন্ত প্রথম বয়সে উন্মার্গগামী হলেও সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। বিদ্রোহী সেনাপতি ডামরদের সঙ্গে মিলে রাজ্য দখল করার চেষ্টা করলে অনন্ত তাদের পরাজিত করে তাড়িয়ে দিলেন। রাজার বয়স্যেরা কেউ অমাত্য, কেউ সেনাপতি ছিল, তারা রাজার উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য সচেষ্ট থাকত এবং অনর্থক যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হত। শেষপর্যন্ত এদের অনেকে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে রাজার মুখ্য উপদেষ্টা হলেন রানি সূর্যমতী। রাজা যেহেতু অশ্বপ্রিয় ছিলেন, ঘোড়াশালের রক্ষকেরা প্রায়ই নতুন ঘোড়া আনাত, একদিকে রাজার থেকে, অন্য দিকে প্রজাদের থেকে অর্থ লুণ্ঠন করে দ্বিগুণ দাম নিত। এক বিদেশী ব্যবসায়ীর থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তাম্বুলপ্রিয় রাজা তাম্বুল নিতেন। রাজার আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ হয়ে পড়েছিল যে সেই ব্যবসায়ীর কাছে রাজমুকুট ও রাজসিংহাসন বাঁধা রাখা ছিল, মাসের ঠিক মাঝখানে একদিনের জন্য সেগুলো তার বাড়ি থেকে রাজসভায় আনানো হত। রানি সূর্যমতী নিজের অর্থে রাজার ঋণ পরিশোধ করে এই অব্যবস্থা দূর করলেন। রানির হস্তক্ষেপে অশ্বশালার অধ্যক্ষ ও অন্যান্য শোষকেরাও দমিত হল। এর পর থেকে থেকে রাজা অনন্ত রানির কথামত কাজ করতেন।
সূর্যমতী হলধর নামে একজন বৈশ্যকে প্রধান অমাত্যের পদে নিযুক্ত করলেন। এই হলধরের কর্মকুশলতায় রাজার ভাণ্ডারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটল, এবং প্রজাশোষকদের দণ্ড দেওয়াতে রাজ্যে শান্তি ফিরল। কিন্তু রাজা আবার পররাজ্য দখল করতে যুদ্ধে গেলেন, সেই সময়ে নিজের রাজ্যে নানা অত্যাচার শুরু হল। হলধর যেহেতু রানির আদেশ নিতেন, অন্য রাজপুরুষেরা রানির সঙ্গে জড়িয়ে মিথ্যা অপবাদে তাঁকে একবার কারাগারে পাঠাল, যদিও কিছুদিন পর তিনি মুক্ত হলেন। রাজা যুদ্ধফেরত এসে রানির কথামতই কাজ করতেন। রানি চাইলেন যে রাজা তরুণ পুত্র কলসকে সিংহাসন ছেড়ে দেন। হলধর ও অন্যান্য মন্ত্রীদের আপত্তি সত্ত্বেও রাজা পুত্রকে সিংহাসন ছেড়ে দিলেন, কিন্তু তাদের পীড়াপীড়িতে আবার রাজ্যের ভার নিলেন, কলস নামমাত্র রাজা হয়ে রইল। পুত্র রাজা হতেই পুত্রবধূরা নিজেদের রানি ভাবতে শুরু করেছিল, পরে কলসের গুরুত্ব কমে গেলে শাশুড়ি সূর্যমতী বধূদের পুনর্মূষিক করলেন, এমনকি তাদের রানির উচিত বসনভূষণও পরতে দিতেন না, তাদের দিয়ে দাসীর কাজ--ঘর মোছা পর্যন্ত করাতেন! বউকাঁটকি শাশুড়ির উদাহরণ কাশ্মীরের রাজবংশেও ছিল, কলহনের চোখ তাও এড়ায়নি।
সেই সময়ে রাজার পিতৃব্যপুত্র লোহর দুর্গের অধিপতি ক্ষিতিরাজ নিজের ছেলের আচরণে বিরক্ত হয়ে কলসের শিশুপুত্র উৎকর্ষকে রাজ্য দিয়ে পণ্ডিতদের সঙ্গে তীর্থভ্রমণে বের হলেন। রাজা অনন্তের জ্ঞাতিভাই প্রত্যেকেই রাজসুখ উপভোগ করত। জিন্দুরাজ নামে এক জ্ঞাতিকে সেনাপতির পদ দেওয়া হল। কিছুদিন পর তার কাজকর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে রাজা তাকে নির্বাসনে পাঠালেন, কিন্তু সে ডামরদের সঙ্গে মিলে রাজ্য আক্রমণ করতে পারে এই ভয়ে রানি তাকে দেশে ফিরিয়ে মন্ত্রীর পদ দিলেন। এরপর জিন্দুরাজ একজন প্রভাবশালী ডামরকে হত্যা করলে রাজা তাকে প্রধান সেনাপতির পদ দিলেন। এইভাবে রাজা অনন্ত ও রানি সূর্যমতীর দোলাচলে রাজশক্তির দুর্বলতা সূচিত হচ্ছিল। এর মধ্যে বিশ্বস্ত মন্ত্রী হলধর মারা গেল, মরবার আগে সে রাজাকে জিন্দু ও অন্যান্য রাজপুরুষদের সম্পর্কে সাবধান করে গেল। কলসও সঙ্গীদের প্রভাবে বিপথে পদার্পণ করল। এই সময় কিছু লোক তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ অভ্যাস করে গম্যাগম্য, খাদ্যাখাদ্য কোনো বিষয়ে সামাজিক নিয়মের ধার ধারত না। তারা মদমাংসে অতিভোজন করত, গৃহস্থের বাড়ি গিয়ে তাদের বউ-মেয়েকে ধর্ষণ করত। তাদের সংস্পর্শে যুবরাজ কলসও কুপথে পদার্পণ করলেন। রাতের বেলা বয়স্যদের সঙ্গে নাগরিকদের বাড়িতে গিয়ে নারীধর্ষণ করতেন । সেরকম করতে গিয়ে একদিন এক বাড়ির রক্ষীদের হাতে খুব মার খেলেন। অনন্ত ও সূর্যমতী পুত্রের বিপথগামিতার সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। কলসকে খবর দিয়ে আনালেন এবং রাজা তার মুখে চড় মেরে তাকে তিরস্কার করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না, কলস একই রকম কুকর্ম করতে থাকল, কারণ রানি কোনোভাবেই পুত্রকে শাস্তি দিতে চাইতেন না, উলটে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য রাজাকেই ভর্ৎসনা করতেন। শেষপর্যন্ত সস্ত্রীক অনন্তদেব রাজভাণ্ডারের ধন, ঘোড়া, অশ্বারোহী সৈনিক নিয়ে রাজধানী ছেড়ে নৌকোয় করে তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন। কয়েকজন অমাত্য, জ্ঞাতি ও ডামর অনুচর তাঁদের সঙ্গে গেল। তাঁরা বিজয়েশ্বরে পৌঁছে সেখানেই দিন কাটাতে লাগলেন। কলস দেখলেন ভাণ্ডার খালি, তখন রাজ্যশাসনে কিছু বাছাই লোক নিয়োগ করলেন, এবং ঋণ করে অর্থ ও সৈন্য সংগ্রহ করে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করলেন। ডামর সেনারা রাজা অনন্তের পক্ষে জড় হতে থাকল দেখে সূর্যমতী প্রমাদ গুণলেন। তিনি পুত্রের নিকটে দূত পাঠিয়ে তাকে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন বন্ধ করতে বললেন। রাজার শুভার্থী অনুচরেরা পিতা ও পুত্র দুজনকেই কটুকাটব্য করতেন, কারণ অনন্তদেবের রাজ্যত্যাগই কলসের দুর্বৃত্তির সাক্ষাৎ কারণ। পিতাপুত্র দুজনেই নিরস্ত হলেন বটে, কিন্তু রাজাকে রানির কর্কশবাক্য শুনতে হত।
ছেলে কলসকে রাজার উত্তরাধিকারী হিসেবে একেবারে পছন্দ ছিল না, তাই জ্ঞাতি নির্লোভ তন্বঙ্গের ছেলেকে রাজ্য দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। রানি নিজের বংশধরের অধিকার লুপ্ত হবে ভেবে রাজার সঙ্গে আলোচনা করে কলসের ছেলে হর্ষদেবকে ডেকে পাঠালেন। হর্ষদেব পিতামহের শিবিরে যুক্ত হলে কলস ভীত হয়ে পুত্রকে খবর পাঠালেন এবং পিতার সঙ্গে সন্ধিস্থাপনের প্রস্তাব করলেন। ব্রাহ্মণদের উদ্যোগে পিতামাতা রাজধানীতে ফিরে এলেন, কিন্তু কিছুদিন পর খবর পাওয়া গেল কলস মা-বাপকে কারাবন্দি করবার ফন্দি করছেন। তখন তাঁরা আবার বিজয়েশ্বরে চলে গেলেন। কলস পিতার ঘোড়ার ঘাস পুড়িয়ে দিলেন, তাঁর পদাতিক সৈন্যদের নানাভাবে হত্যা করালেন। অনন্তদেব চাইলেন পুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে, কিন্তু সূর্যমতী এখনো তাতে রাজি ছিলেন না। এবারে কলস পিতার বাড়িতে আগুন দিলেন, তাঁদের সবকিছুই পুড়ে গেল, এমন কী রক্ষীদের বাড়তি পরনের কাপড় অবধি। রানি দুঃখে আত্মহত্যা করতে উদ্যোগী হলেন, তন্বঙ্গের ছেলেরা তাঁকে বাঁচাল। সর্বহারা রাজদম্পতি কপর্দকশূন্য অবস্থায় পোড়া বাড়ি থেকে একটি রত্নখচিত সোনার শিবলিঙ্গ পেলেন, শিবলিঙ্গের বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহ করে সৈন্য ও ভৃত্যদের ভরণপোষণের অর্থ জোগাড় এবং বাসগৃহের সংস্কার করলেন। ভাল বাড়ি বানাতে গেলে রাজার অনুমতির দরকার হত, কলস তাঁদের সেই অনুমতি দিল না। তাদের কুটির মাটি, গাছের বাকল ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হল। কলস তাঁদের দেশ ছেড়ে পর্ণোত্সে চলে যেতে বলল। অনন্তদেব রাজি না হওয়ায় রানি তাঁকে আবার তিরস্কার করতে লাগলেন, রাজার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। কলস যে তাঁর ঔরসপুত্র নয়, রানির ছেলে গর্ভেই নষ্ট হলে তাঁর ইচ্ছেয় কলসকে দত্তকপুত্র নেওয়া হয়েছিল, সেই কথা সর্বসমক্ষে বলে ফেললেন। এই নিয়ে দুজনে বেশ ঝগড়া হল, হতাশ রাজা নিজহাতে নিজের গুহ্যদেশে ছুরিকাঘাত করে মারা গেলেন। রাজা মারা যাবার পর শোকার্তা হলেও রানি নিজের কর্তব্য বিস্মৃত হলেন না। তিনি ত্রিরাত্র উপবাস থেকে সমস্ত অনুচর, সৈন্য, সেবক এবং শ্মশানের চণ্ডাল সকলকে নিজেদের সেই শিবলিঙ্গ বিক্রয়ের বাকি টাকা থেকে বকেয়া বেতন দিয়ে স্বামীর ঋণ পরিশোধ করলেন, বাকি যা কিছু হর্ষকে দিলেন। তারপর পৌত্রের মঙ্গলের জন্য বিজয়েশের সামনে অনুচরদের কোশপান করিয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন যাতে তারা হর্ষের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, এবং পৌত্রকে উপদেশ দিলেন সে তার পিতাকে যেন কখনো বিশ্বাস না করে। রাজার মৃতদেহ শিবিকায় করে বিশ্বাসী সৈন্যদের দিয়ে সসম্মানে শ্মশানে পাঠালেন, সমস্ত কাজ শেষ করে চারদিকে উৎসুক নয়নে তাকালেন, হয়তো ভাবছিলেন পুত্র যদি একবার শেষবার দেখা করতে আসে। কিন্তু সে এল না। রানি আর অপেক্ষা করলেন না, সন্ধ্যায় প্রজ্জলিত চিতায় উঠে প্রাণত্যাগ করলেন।
পিতামাতার মৃত্যুর পর কলস পুত্রের সঙ্গে সন্ধি করলেন, প্রথমটায় অনিচ্ছুক হলেও পরে হর্ষ পিতার সঙ্গে শ্রীনগরে গেলেন। কলস হর্ষের ধনসম্পত্তি আলাদা ভাবে নিজের ছাপ দিয়ে কোষাগারে রাখলেন এবং তার জন্য মাসোহারা নির্দিষ্ট করে দিলেন। তিনি নিজেও রাজকার্য করতে শুরু করলেন, ফলে প্রজারা সন্তুষ্ট হল, রাজস্ব বৃদ্ধি পেল। এর মধ্যে জয্যক নামে এক ডামর নিজের জমির রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এবং দূরদেশে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসায়ে প্রচুর দিনার অর্জন করেছিল, সেই রাশি রাশি মুদ্রা ক্ষেতের মধ্যে মাটির তলায় পুঁতে উপরে ধান লাগিয়ে দিয়েছিল, এবং যে দু’চার জন এই ব্যাপার জেনেছিল, তাদের যতজনকে সম্ভব হত্যা করেছিল। তারপর সে অন্যত্র জমি দখল করতে গেলে তার অনুচরেরা পালিয়ে গেল, তার ঘোড়া দ্রাক্ষালতায় পা আটকে যাওয়ায় শত্রুরা তাকে হত্যা করল। রাজা তার অনুচরের মুখে তার ধনের খোঁজ পেয়ে সব তুলে নিলেন, তাঁর অর্থাভাব দূর হল। এদিকে কলসের শত্রুরা হর্ষের বন্ধু সেজে তাঁকে পিতার হত্যা করার জন্য কানে বারবার মন্ত্রণা দিতে থাকল। প্রথমটা অগ্রাহ্য করলেও একসময় হর্ষ তাদের বশীভূত হলেন, এবং তাদের দলে যোগ দিলেন। তবে ষড়যন্ত্র গোপন থাকল না। কলস হর্ষকে কারারুদ্ধ করলেন এবং অন্য পুত্র উৎকর্ষকে রাজ্য দিতে মনঃস্থ করলেন। তাঁকে বিষমিশ্রিত অন্ন দেওয়া হচ্ছে এই সন্দেহে হর্ষ খাওয়া ছেড়ে দিলেন। শুধুমাত্র তাঁর বিশ্বস্ত ভৃত্য প্রয়াগের আনা খাবার তিনি খেতেন। এদিকে কলস আগের মতই নীতিবিগর্হিত কাজ করতে থাকলেন, তিনি পুত্রের উপর শোধ তুলতে পুত্রবধূদের সতীত্ব নাশ করলেন। লাম্পট্যে তাঁর জুড়ি ছিল না, অপকর্মের অবধি ছিল না, তাঁর সময়েই প্রথম মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিক্রয়ের জন্য নারীদের কাশ্মীরে নিয়ে আসা হত, রাজা পছন্দমত নারী কিনতেন। তিনি বিহার ও মন্দির থেকে দেবমূর্তি চুরি করে গলিয়ে সোনারুপো নিজের ভাণ্ডারে নিয়ে এলেন, এদিকে আবার নিজের নামে মন্দির এবং দেবপ্রতিষ্ঠাও করেছিলেন।
কলস মারা যাবার পর উৎকর্ষ সিংহাসনে বসলেন এবং আরেক ভাই বিজয়মল্লকে হর্ষের সমান বৃত্তি দিয়ে নিজের পক্ষে টানলেন। তবে হর্ষের অনুগত অনুচরেরা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তারা এবং নগরের লোকেরা জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র হর্ষের পক্ষে ছিল। তাই শেষপর্যন্ত উৎকর্ষ রাজা হলেও হর্ষকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। হর্ষ কারাগারের বাইরে এসে নিজে রাজা হলেন, কিন্তু বাইশ দিনের রাজা উৎকর্ষ রাজ্যাধিকার ও সহায় হারিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
রাজা হর্ষ
হর্ষ বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন, অল্পবয়স থেকেই দানশীল ছিলেন। কিন্তু বিলাসী ও রাজকার্যে বিমুখ ছিলেন। দিনের বেলা দুপুর পর্যন্ত ঘুমোতেন আর রাতে আলোকোজ্জ্বল নাট্যশালায় নাচগান ও পণ্ডিতসমাজের আলাপ শুনে সময় কাটাতেন। অপাত্রে অনর্থক এবং অপরিমিত দান এবং ভোগের ফলে প্রায়ই অর্থের অভাব হত। এদিকে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করতে যত জ্ঞাতি রাজপুত্র ছিল সকলকে তিনি নানা ছলে হত্যা করালেন। কুমন্ত্রীদের পরামর্শে রাজপুরী দুর্গ আক্রমণ করতে বিশ্বস্ত সেনাপতি কন্দর্পকে পাঠালেন। বহু সৈন্যের বিনাশ হবার পর রাজপুরী, পরিহাসপুর প্রভৃতি স্থানের শাসকেরা বশীভূত হল--এরা এককালে কাশ্মীরের অধীন ছিল, কিন্তু বহুদিন অরাজকতার জন্য তারা রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করেছিল। যুদ্ধে সেনাপতি কন্দর্প বিজয়ী হয়ে যথেষ্ট ধন নিয়ে ফিরলেন, কিন্তু কুচক্রী মন্ত্রীরা রাজার কাছে তাঁর নামে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনল, এবং কানপাতলা রাজা সেকথা বিশ্বাস করলেন। দুঃখিত হয়ে কন্দর্প পরিবারবর্গ নিয়ে রাজ্য ছেড়ে বারাণসীতে চলে গেলেন। রাজার অনুচরবর্গ, অমাত্য সেনাপতি-- এঁরা সবাই পরস্পরকে ঈর্ষা করত, এবং ধনলোভে পরস্পরকে সরাবার, এমনকি হত্যার ষড়যন্ত্র করতেও ইতস্তত করত না। যে কেউ তার প্রতিপক্ষকে পরাভূত করার জন্য রাজার কানে কুমন্ত্রণা দিত, তারপর বন্দী করাত, বিষ খাইয়ে অথবা মুণ্ডচ্ছেদ করে হত্যা করাত। অর্থের অভাব হলে দেবমন্দির লুঠ বা দেববিগ্রহ ভেঙ্গে সোনাদানা গলিয়ে নেওয়া--রাজার ইচ্ছেতেই এখন সবরকম অপকর্ম শুরু হল। এই কাজের জন্য হর্ষ এক কর্মকর্তা পর্যন্ত নিয়োগ করলেন—দেবোৎপাটন নায়ক। কোনো বিধর্মীকে আনিয়ে তার দ্বারা দেবমূর্তিকে প্রথমটা অপবিত্র করিয়ে তারপর সেটা উপড়ে ফেলা হত। প্রাচীন ও বিখ্যাত মাত্র দুচারটি দেবমূর্তি ছাড়া হর্ষ সব মূর্তি তুলে সব সোনাদানা নিজের কোষে নিয়েছিলেন, এমনকি ললিতাদিত্যের স্থাপিত বিখ্যাত পরিহাসকেশবের রুপোর মূর্তিও উৎপাটিত হয়েছিল।
প্রজাপীড়নে এবং লাম্পট্যে রাজা হর্ষ পিতা কলসের সমকক্ষ, কিংবা তাঁকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। রাজার দোষের কথা ছড়িয়ে পড়ল, বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা কমে এল। হর্ষ নিজে অস্ত্রচালনায় পারদর্শী ছিলেন না, যুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পেতেন, সেনাপতিদের হাতেই যুদ্ধপরিচালনার ভার দিয়ে নিজে দূরে অবস্থান করতেন। এইসময় সহেল নামে রাজার এক বিশ্বাসভাজন তাঁকে প্রচুর ধনলাভের আশায় লহর প্রদেশের দুর্গঘাত নামক দুর্গ আক্রমণ করতে উৎসাহিত করল। প্রথমটা সেখানে আক্রমণ করতে যেতে কেউ রাজি হয়নি, পরে দ্বারপতি অর্থাৎ নগরের দ্বাররক্ষকদের অধিপতি চম্পক সৈন্যসামন্ত নিয়ে বের হলেন। তাঁর পিছন পিছন আরো বাহিনী যাবার কথা ছিল, কিন্তু দুর্গঘাত দুর্গের দুই রাজকুমার ভাই উচ্চল ও সুস্সলের পরাক্রম এবং প্রচণ্ড বৃষ্টিতে যুদ্ধ ঠিকভাবে শুরু করার আগেই রাজার বাহিনীর বহু সৈন্য ও রসদ জলে ভেসে গেল। সেনাপতি ও মন্ত্রীরা ঘরে ফিরবার ইচ্ছায় খাদ্য তাঁবু ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালাতে লাগলেন, বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। রাজা সেনাপতিদের সঙ্গে অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে রাজ্যে ফিরলেন, কিন্তু এই পরাজয়ে প্রজারা নিজেদের রাজার চাইতে রাজপুত্র উচ্চলের প্রশংসা করতে লাগল। সমর্থন পেয়েও উচ্চল শ্রীনগরে প্রবেশ না করেই তখনকার মত ফিরে গেলেন। এদিকে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল, এর মধ্যে ডামররা রাজস্ব দিতে রাজি না হওয়ায় হর্ষ তাদের আক্রমণ করলেন। রাজ্যে প্রচণ্ড বিশৃঙখলা দেখা দিল, রাজা সন্দেহের বশে রাজপুরুষদের হত্যা করতে লাগলেন।
উচ্চল ও সুস্সল এই দুই ভাই ও লোহর রাজবংশেরই অন্য শাখার ছিলেন, রানি দিদ্দার দুই ভাইয়ের দুই শাখা। উচ্চলের বীরত্বের খ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে তিনি রাজা হলেই ভাল হয় এরকম ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল। এঁরা লহর (লহর এবং লোহর দুটো আলাদা স্থান) রাজ্যে খশ রাজার সঙ্গে সুসম্পর্কে ছিলেন, সেখান থেকে সৈন্যসাহায্য পেতেন। হর্ষ আপন শাখার জ্ঞাতিদের শেষ করে ফেলায় সিংহাসনের লড়াইয়ে এঁরা শেষপর্যন্ত অবতীর্ণ হলেন। দুই ভাই সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, যদিও উচ্চল সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন না, অন্যদিকে সুস্সল রাজ্যলোলুপ ছিলেন। তাঁরা যখন রাজধানীতে প্রবেশ করলেন, তখন হর্ষের সৈন্যসামন্ত তাঁদের সামনে দাঁড়াতে পারল না, একসময় হর্ষ পালিয়ে এক মঠে আশ্রয় নিলে সঙ্গে শুধু বিশ্বস্ত প্রয়াগ রইলেন। সেখানে হর্ষপুত্র ভোজের মৃত্যুসংবাদও এল। মঠের লোকজন তাঁর পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে ধরিয়ে দিল। প্রয়াগ যথাসাধ্য আততায়ীদের প্রতিরোধ করে নিহত হলেন, তারা হতভাগ্য রাজাকে হত্যা করে তাঁর ছিন্নমুণ্ড নিয়ে যত্র তত্র ঘুরতে থাকল। রানিরা তাঁর পলায়নের সময়েই প্রাসাদশীর্ষে আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মৃত হর্ষের দেহের শেষকৃত্য তাই দুজায়গাতে কোনো রাজকীয় মর্যাদা ছাড়াই সম্পন্ন হল, এক জায়গায় মুণ্ডের, অন্য জায়গায় দেহের।
কাশ্মীর রাজবংশের চারিত্রিক অবনমন
হর্ষ রাজা হিসেবে অকর্মণ্য ছিলেন, সেই সময় কাশ্মীর রাজবংশের চারিত্রিক অবনমন অত্যন্ত লক্ষণীয়। খুব কাছের সম্পর্কের মধ্যেও অবিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা, ধনলোভ, নির্দয় ব্যবহার, লাম্পট্যের পর্যায়ে চলে যাওয়া ইন্দ্রিয়াসক্তি, বাইরের জগৎ সম্পর্কে উদাসীনতা-- এই সমস্ত কারণে কাশ্মীরে এক চূড়ান্ত অস্থিরতা ছিল। রাজবংশগুলোতে পাপ একেবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। এমন কী পরাজিত রাজার মৃতদেহের অবমাননার মত বীভৎস কাণ্ড এখন থেকে শুরু হল-- একইভাবে পরবর্তী দুই রাজা উচ্চল ও সুস্সলের মৃতদেহের একই দশা হয়েছিল।
রাজা উচ্চল
হর্ষের জীবিত অবস্থায়ই প্রজারা মল্লরাজপুত্র উচ্চলকে বরণ করে নিয়েছিল। উচ্চল ধনলোভী ও রাজ্যলোভী ছিলেন না। বুদ্ধিমান ছিলেন, প্রথম দিকের রাজ্যশাসনের কাজগুলি ভাল করেছিলেন। প্রথমত ভাই সুস্সল রাজ্যলোভী হওয়ায় তাকে লোহর দুর্গ ও তার আশেপাশের এলাকা শাসনের ভার দিয়ে সেখানে পাঠালেন, তার ইচ্ছেমত হস্তী অশ্ব অস্ত্রশস্ত্র পদাতিক এবং যথেষ্ট ধন নিয়ে যেতে দিলেন। হর্ষ ডামরদের দমন করার জন্য তাদের উপর অত্যাচার করেছিলেন, অনেককে হত্যাও করেছিলেন। উচ্চল তা করলেন না, তিনি কৌশলে তাদের দমন করলেন। তিনি তাদের মধ্যে একজনকে পদ দিলে অন্যরা ঈর্ষান্বিত হয়ে পরস্পর লড়াই করতে লাগল, যাকে পদ দেওয়া হয়েছিল সেই জনকচন্দ্র লড়াইতে নিহত হলে তার দল শক্তিহীন হয়ে পালিয়ে গেল। অন্যদল রাজার সঙ্গে থেকে গেল। রাজা তাদের প্রধান গগ্গকে অমাত্য করে লোহরে পাঠালেন এবং বাকিদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরতে আদেশ দিলেন। উচ্চল রাজ্যের অবস্থা দেখার জন্য রাতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের নিজের ভাণ্ডার হতে খুব কম দামে শস্য দিতেন। চুরির অপরাধ নিরসনের জন্য তস্করদেরই কোষ রক্ষণের ভার দিলেন, এর ফলে রাজ্যে চুরি কমে গেল। দণ্ডিত ব্যক্তির থেকে জরিমানা আদায় করে লোকহিতের কাজে লাগাতেন, সেই টাকা রাজকোষে জমা হত না। বিলাসের জন্য, ঘোড়া কিনতে বা অনর্থক প্রাসাদ তৈরি করতে অর্থব্যয় না করে তিনি প্রজার হিতার্থে খরচ করতেন। রাজ্যের খবর রাখতেন, উৎসবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, অভাবগ্রস্তদের দান করতেন। হর্ষের উৎপাটিত পরিহাসকেশবের মূর্তি পুনরায় মন্দিরে স্থাপিত হল, আরো অনেক মন্দির ভগ্নদশা থেকে পুনরুদ্ধার করা হল। তাঁর মহিষী জয়মতী একজন নর্তকীর কন্যা ছিলেন, নিচুবংশের মেয়ে হলেও উচ্চল তাঁকে বিয়ে করেন, তিনিও স্বামীর মতন নির্লোভ এবং দয়াশীল ছিলেন।
উচ্চলের ন্যায়বিচার ঃ বণিকদের চরিত্র
রাজা যশস্করের মত উচ্চলেরও সুবিচারক হিসেবে খ্যাতি ছিল। তাঁর একটি বুদ্ধিদীপ্ত বিচারের গল্প কলহন উল্লেখ করেছেন: একজন ধনী ব্যক্তি তার বন্ধু বণিকের নিকট এক লক্ষ মুদ্রা জমা রেখেছিল। প্রয়োজন অনুসারে সেই টাকা থেকে সে মাঝে মাঝে নিত। বিশ বছর পর সে বাকি টাকা ফেরত চাইল। বণিকের টাকা ফেরত দেবার মোটেই ইচ্ছা ছিল না। মহাজনের কাছে টাকা জমা রাখলে তা বাঘের মুখের গ্রাস আদায় থেকেও কঠিন--
তৈলস্নিগ্ধমুখঃ স্বল্পালাপো মৃদ্বাকৃতির্ভবন্।
ন্যাসগ্রাসবিবাদোগ্র বণিগ্ব্যাঘ্রাদ্বিশিষ্যতে।। ১২৯, অষ্টম তরঙ্গ
অর্থাৎ বণিকের মুখ তেল চুকচুকে, সে কম কথা বলে, তার চেহারা ভালমানুষের মত, কিন্তু জমা টাকা গ্রাস করতে উদ্যত বণিক বাঘের থেকেও ভয়ঙ্কর। উপস্থিত বণিকটি হিসেব করবার অজুহাতে কদিন ঘোরাল, মুক্তং মুক্তং জ্ঞায়মানং প্রাণান্তেঽপি ন মুচ্যতে( তরঙ্গ ৮, ১৩০), অর্থাৎ এই দিচ্ছে এই দিচ্ছে দেখাচ্ছে, কিন্তু প্রাণ গেলেও দেয় না। তারপরও একদিন জমাকারী ব্যক্তিটি আবার টাকা চাইলে সে চোখ নাক মুখের নানারকম ভঙ্গি করে চিন্তা করার অভিনয় করল, তারপর ভূর্জপত্রে লেখা হিসাবপত্রটি নিয়ে বলল, এখানে প্রথমে লেখা থাকে শ্রেয়স, মানে মঙ্গল। কিন্তু সেটা এখন অশ্রেয়সে দাঁড়িয়েছে। তুমি কোন কোন খাতে কত টাকা আমার থেকে নিয়েছ, সব লেখা আছে--বলে সে এক লম্বা-চওড়া হিসেব দিল। তারপর আবার খানিক চিন্তা করে বলল, এই যে টাকা তুমি বারবার আমার থেকে নিয়েছ, সেই টাকা ও তার সুদ আমার পাওনা হয়েছে। জমাকারী প্রথমটা বুঝতে পারেনি, তার মনে হয়েছিল বণিক ঠিকই বলছে। কিন্তু পরে বণিক যখন টাকার অঙ্ক মেলাল, সে দেখল, সেই টাকার যে সুদ তা যদি বণিকের প্রাপ্য হয়, তাহলে মূল টাকার সুদ একই হারে জমাকারীর প্রাপ্য, সেই সঙ্গে মূলধনের টাকাটাও -- বণিক সেটা উল্লেখ করছে না, ফলে বণিকের মতে তার প্রাপ্য মূল টাকা থেকে অনেক বেশি দাঁড়িয়েছে। জমাকারী বুঝল বণিক বন্ধু হয়েও তাকে ঠকাচ্ছে, আসল টাকাটা দিচ্ছে না। বিচারপতি মীমাংসা করতে না পারায় জমাকারী রাজা উচ্চলের কাছে গেল। উচ্চল বণিককে বললেন, জমা টাকার কিছু বাকি থাকলে এখানে নিয়ে এস। বণিক কয়েকটা মুদ্রা নিয়ে এল, যেগুলোতে উচ্চলের নাম লেখা রয়েছে। উচ্চল বললেন, এতো আমার নামের টাকা। জমাকারী যখন তোমার কাছে টাকা রেখেছিল, যখন রাজা ছিলেন কলস। তাহলে তাঁর নামের মুদ্রা কোথায়? তার মানে বণিক জমা টাকা খাটিয়েছে, এবং বাদী বণিকের কাছ থেকে সময় সময় টাকা নিয়েছে। তাই বাদী বণিকের টাকাও তার সুদ দেবে, এবং বণিক বাদীর টাকা, অর্থাৎ মূলধনও তার সুদ দেবে। বিচার করে উচ্চল বাদীকে প্রবঞ্চনার জন্য বণিককে রাজা যশস্করের বিধান, অর্থাৎ নির্বাসনদণ্ড দিলেন। কয়েক প্রজন্ম পূর্ববর্তী রাজা যশস্করের সময়ে যেমন ছিল, উচ্চলের সময়কার বণিকও একই চরিত্রের, এমনকি আধুনিক যুগেও বণিকের স্বভাব প্রায় একই রকম দেখা যায়।
উচ্চলের রাজত্বকালের প্রথম দিকটা এভাবে সুশাসনে কেটেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, তাঁর বাক্যে ও কর্মে নিষ্ঠুরতা প্রকট হয়ে উঠল। উৎসব উপলক্ষ্যে রঙ্গমঞ্চে রাজা সৈনিকদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে লড়াতেন, তারাও যুদ্ধপ্রিয় ছিল, হাসতে হাসতে আসত, কিন্তু দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর অনেকেই বিকলাঙ্গ হয়ে ফেরত যেত। তাদের বাড়িতে তখন কান্নার রোল উঠত। উচ্চল অনুজীবিদের কখনো ছোটখাট ভুলে কিংবা এমনিতেই কর্কশ বাক্য বলতেন, বিদ্রূপ করতেন, বংশ তুলে গালি দিতেন। এমনকি শারীরিক গঠন নিয়েও অপ্রিয়কথা বলতেন। এইসব কারণে তিনি ধীরে ধীরে অনুচর ও রাজপুরুষদের অপ্রিয় হয়ে পড়লেন। এর মধ্যে তাঁর ভাই সুস্সল আবার কাশ্মীর দখলের অভিলাষে লোহর থেকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন, তাঁর অশ্বারোহী সৈন্যদল বহু অশ্ব সংগ্রহের ফলে শক্তিশালী ছিল। এই সংবাদে রাজ্যের ভিতরে উচ্চলের শত্রুরা ধীরে ধীরে শক্তিসঞ্চয় করতে লাগল। একসময় সংগঠিত হয়ে এই শত্রুরা উচ্চলকে হত্যা করল।
তাঁর মৃত্যুর পর দুই রানি জয়মতী ও বিজ্জলা অনুমরণে যান। এই অনুমরণের ব্যাপারেও একটু মোচড় আছে। জয়মতী তাঁর সব টাকাপয়সা প্রধান অমাত্য গগ্গকে দিয়ে বললেন, ভাই, আমার ব্যবস্থা করো। জয়মতী ঠিক কী ব্যবস্থা চাইছিলেন, তা স্পষ্ট বলেননি। গগ্গ ভাবলেন তিনি চিতা সাজাতে বলেছেন, কারণ নৈরাজ্যের মধ্যে রাজার বিধবা পত্নীদের আত্মসম্মান নিয়ে থাকা দুঃসাধ্য ধরে নিয়ে অনেকেই সহমরণে বা অনুমরণে যেতেন। গগ্গ যথাস্থানে চিতা সাজিয়ে ফেললেন। জয়মতী সর্বাঙ্গে গয়না পরে পাল্কিতে রওয়ানা হলেন, কিন্তু রাস্তায় পালকি থামিয়ে দেরি করতে লাগলেন। তারপর দেখলেন, সপত্নী বিজ্জলা পিছন থেকে এসে আগে চলে যাচ্ছেন, দেখে জয়মতীও আবার চললেন। বিজ্জলা চিতায় উঠে গেলেন, আর ইতিমধ্যে ডাকাত পড়ে জয়মতীর গা থেকে সব গয়না লুটে নিল। নিরুপায় নিরাভরণ জয়মতী চিতায় উঠলেন।
উচ্চলের পর ক্ষমতাশালী অমাত্যেরা তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই সল্হনকে রাজা করলেন। ক্ষমতাবিবাদ চলতেই থাকল, সুস্সল উচ্চলের মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রচুর ঘোড়সওয়ার সৈন্য নিয়ে দ্রুত শ্রীনগরে পৌছোলেন এবং সল্হনকে কারাগারে পাঠিয়ে নিজে সিংহাসনে বসলেন।
সুস্সল
সুস্সল গুণের দিক থেকে উচ্চলের মতই ছিলেন, তবে তিনি ধনদৌলত জমা করতেন, এবং ঘোড়া কিনতেন। বিদ্রোহের আশঙ্কায় সব সময় খাপখোলা তরোয়াল নিয়ে চলতেন। তবে প্রজাদের মঙ্গলের জন্য উৎসবে দান-দক্ষিণা করতেন, বিশেষ করে বস্ত্র দান। তবে সুস্সলের রাজত্বের মাস দেড়েক যেতে না যেতেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হল। উচ্চলের অমাত্য ডামর গগ্গচন্দ্র রাজার আদেশ সত্ত্বেও তাঁর হাতে উচ্চলের শিশুপুত্রকে সমর্পণ করলেন না। রাজা গগ্গকে বন্দি করতে চাইলে গগ্গ যুদ্ধ শুরু করল, শেষপর্যন্ত পরাস্ত হয়ে ছেলেটিকে দিতে বাধ্য হল।
ভিক্ষাচর
এর মধ্যে নতুন বিপদ এল। উচ্চল তাঁর রানি জয়মতীকে শত্রু রাজা হর্ষের পরিবারের একমাত্র জীবিত দুবছর বয়সের উত্তরপুরুষকে পালন করতে দিয়েছিলেন। শিশুটি হর্ষের পুত্র ভোজের ছেলে, তার মায়ের পর পর তিনটি ছেলে নষ্ট হওয়ার পর এই ছেলেটি জন্ম নিলে তাকে অভব্য ভিক্ষাচর নাম দেওয়া হয়েছিল। হর্ষের পলায়নের সময় তাঁর ছেলে ভোজ যুদ্ধে মারা যান, তার পত্নী সহমরণে যান। তাই ছেলেটিকে লালনপালন করবার কেউ ছিল না। ডামর জনকচন্দ্র এই শিশুটিকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে রাজ্য শাসন করার ষড়যন্ত্র করছিলেন, সেই সময় উচ্চলের চালে ডামরেরা বিভক্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করে এবং জনকচন্দ্র নিহত হয়। তারপর উচ্চল ভাবলেন, ভিক্ষাচরকে বাঁচতে না দেওয়াই শ্রেয়। রাজার আদেশে ঘাতকেরা তাকে জয়মতীর ঘর থেকে নিয়ে গলায় শিলা বেঁধে নদীতে ফেলে দিল। কিন্তু একজন ব্রাহ্মণ দেখতে পেয়ে তাকে উঠিয়ে জীবিত দেখে শাহিবংশীয়৬ বিধবা রাজকুমারী বৃদ্ধা আসমতীর কাছে দিল, সেই বুদ্ধিমতী মহিলা তাকে নিয়ে কাশ্মীর থেকে বহু দূরে দক্ষিণাপথের মালবদেশের রাজার আশ্রয়ে রাখলেন। সেখানে ভিক্ষাচর যথোপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্রে শিক্ষা পেয়েছিল, এবং সেখানেই সে বড় হল। লোকের মধ্যে প্রচার ছিল যে জয়মতীই ছেলেটিকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। উচ্চলের কানেও কথাটা গিয়েছিল, তাই এরপর থেকে জয়মতীর উপর বিরক্ত হয়ে রাজা বিজ্জলা নামে অন্য নারীকে বিয়ে করেছিলেন।
এই ভিক্ষাচর কিছুটা বড় হলে এখন পালিকা মাতা আসমতীর আদেশে পিতৃভূমি কাশ্মীরের দিকে রওয়ানা হলেন। আসমতী তাঁর লালনপালন, শিক্ষা ও ফিরে আসার রাহাখরচের জন্য যথেষ্ট অর্থ দিয়েছিলেন। তাঁর খবর অনেকেই জানত। তাই পথে কুরুক্ষেত্রে সুস্সলের শত্রু সামন্তরাজারা ভিক্ষাচরের সঙ্গে দেখা করলেন, তাঁরা রাজা হর্ষের পৌত্র হিসেবে কাশ্মীরের সিংহাসনে ভিক্ষাচরের অধিকারকে সমর্থন করলেন। একাধিক সামন্ত রাজা ভিক্ষাচরকে কন্যা সম্প্রদান করে আত্মীয় করে নিলেন, এই রাজাদের সাহায্যে ভিক্ষাচরের কিছু সৈন্যসামন্তও সংগ্রহ হল।
সুস্সলের রাজ্যে সেই যে নানা পদাধিকারী রাজপুরুষদের মধ্যে পরস্পর বিবাদ চলছিল, তা থামেনি। আগের মতই রাজাকে পক্ষভুক্ত করার জন্য বিপক্ষের নামে রাজার কাছে নালিশ করা হত, রাজা কখনো উচিত বিচার করতেন, কখনো না ভেবে রায় দিতেন। রায় যার বিপক্ষে যেত সেই রাজার শত্রুতে পরিণত হত। সেরকম এক সামন্ত, রায় যার বিরুদ্ধে গিয়েছিল, সেই সোমপাল ভিক্ষাচরকে নিজ রাজ্যে আনাল।
সোমপাল ভিক্ষাচরকে নিয়ে আসায় সুস্সল ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে আক্রমণ করতে বেরোলেন, সোমপাল পালিয়ে গেল, অন্য এক সামন্ত বিজয় ভিক্ষাচরকে আশ্রয় দিল। রাজা তখন উন্মাদের ন্যায় দোষী-নির্দোষ নির্বিচারে হত্যা করতে লাগলেন। এমন কী সূর্যক নামে নিজের ছেলেকেও শূলে চড়ালেন। ডামরদের প্রতি অত্যাচার অত্যন্ত বৃদ্ধি পেল। অন্যায়ের প্রবল ঢেউতে জীবন হয়ে উঠল অনিশ্চিত, রাজ্যের অনেক ব্রাহ্মণ প্রতিবাদ করে অনশনে বসলেন, কেউ কেউ আগুনে ঝাঁপ দিলেন। রাজার এক সেনাপতি তিলক যুদ্ধে অনেক শত্রু নিধন করেছিল, কিন্তু অকৃতজ্ঞ রাজা তার কোনো প্রশংসা না করে উলটে কটুবাক্য বলতে থাকলেন। তিলক বিদ্রোহী হয়ে রাজার কাছ থেকে সরে গেল। আশ্রয়দাতা বিজয় রাজার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলে তিলক গোপন পথ দিয়ে ভিক্ষাচরকে নিজের কাছে নিয়ে এল। ইতিমধ্যে ধনী দরিদ্র আবালবৃদ্ধ প্রজাদের মধ্যে ভিক্ষাচর সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে পড়ল--ইনি এক শরে দশটি শিলা ভেদ করতে পারেন, ক্লান্ত না হয়ে শতযোজন যাতায়াত করতে পারেন, সবসময় অত্যন্ত ভদ্রভাবে কথা বলেন--ইত্যাদি। তা ছাড় হর্ষের নাতি হিসেবে ভিক্ষাচরের রাজসিংহাসনে অধিকার তো ছিলই। সুস্সলও তাই ভিক্ষাচরের আগমনে ভয় পেলেন। তিনি রাজত্বের প্রথমদিকেই নিজের সঞ্চিত ধনে বহু সোনার ইট বানিয়ে সেই সব নিজের পিতৃপিতামহগত বাসস্থান লোহর দুর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, এখন স্ত্রী, পুত্র ও অন্যান্য কুটুম্বদেরও সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের পিছন পিছন কিছু ব্রাহ্মণ ও ভৃত্য যাচ্ছিল, হঠাৎ সেতু ভেঙ্গে যাওয়াতে তারা বিতস্তা নদীতে তলিয়ে গেল।
এরই মধ্যে ডামরেরা সুস্সলের পুরোনো রাজ্য লহর দখল করে ভিক্ষাচরকে মিছিল করে সেখানে নিয়ে গেল। সেখানকার প্রধান ব্যক্তি মল্লকোষ্ট ভিক্ষাচরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। রাজা লহর আক্রমণ করবেন বুঝে সেখানকার সেনানায়কেরা ঘোড়াগুলোকে ব্যায়াম করাতে শুরু করল, কারিগর ও গাড়োয়ানরা পর্যন্ত অস্ত্রশিক্ষা করতে থাকল। রাজার বাহিনী আক্রমণ করে পরাজিত হল, সর্বত্র সুস্সলের প্রতি অসন্তুষ্ট এত লোক ছিল যে তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হলেন। সেখানেও ব্রাহ্মণেরা রাজার বিরোধিতা করায় দিশাহারা হয়ে তিনি রাজধানী ত্যাগ করে কিছুসংখ্যক অনুচর নিয়ে লোহর দুর্গের দিকে পালালেন। পথেও শত্রুর আক্রমণে অনুচরদের বেশিরভাগ এবং সমস্ত ধন নষ্ট হল, তিনি কোনোরকমে দুর্গে পৌঁছলেন। এদিকে ভিক্ষাচর রাজধানীতে প্রবেশ করে রাজা হলেন বটে, কিন্তু অরাজকতা কমবার বদলে বৃদ্ধি পেল। তাঁর সহায়ক সেনাপতি, অমাত্য ও সামন্ত রাজা ও তাদের সৈন্যেরা নগরী লুটপাট করতে লাগল, সুস্সলের সময়ে রাজকোষের যা বাকি সম্পদ ছিল সবই লুণ্ঠিত হল। হত্যা এবং ধর্ষণের অবধি ছিল না। এদিকে রাজাকে নিজেদের পক্ষে টানার জন্য ক্ষমতাশালী রাজপুরুষেরা ভিক্ষাচরের সঙ্গে নিজের মেয়েদের বিয়ে দেবার প্রতিযোগিতা করতে থাকলেন, যার মেয়ের সঙ্গে রাজার বিয়ে হত, তার বিপক্ষ ক্রুদ্ধ হত। এভাবে নতুন শত্রুতার শুরু হল। ভিক্ষাচরের আমলে পুরোনো দীনারের মূল্য পড়ে গেল, নতুন দীনার আশিটিতে পুরোনো একশ’টি পাওয়া যেত। ভিক্ষাচর রাজকাজে পটু ছিলেন না, সুখাদ্য আর লাম্পট্য এঁর জীবনেও মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াল।
অরাজকতায় ভুগে শেষপর্যন্ত মুখ্য ব্যক্তিরা আবার সুস্সলকে দেশে আসতে আহ্বান জানাল। লম্বা দাড়ি থাকার কারণে তাঁকে লোকে অবজ্ঞা করে ‘লম্বকূর্চ’ নাম দিয়েছিল, ভিক্ষাচরের অরাজকতায় অতিষ্ঠ হয়ে বলাবলি করছিল, লম্বকূর্চ ছাড়া আমাদের গতি নেই। সুস্সল সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে রাজধানীতে পৌঁছলেন। ভিক্ষাচরও নিজের সৈন্য এবং বিশ্বস্ত মিত্র পৃথ্বীচরের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন, কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ মিত্রই সুস্সলের পক্ষে চলে গিয়েছিল। তাই ছ’মাসের রাজত্বশেষে ভিক্ষাচর পালিয়ে সোমপালের রাজ্যের পুষ্পাণ্নাড় নামক গ্রামে পৌছলেন। আবারও সুস্সলের শত্রু সামন্তদের সাহায্যে কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করলেন, দুপক্ষের জয় পরাজয় চলতেই থাকল। একসময় ভিক্ষাচরের পক্ষভুক্ত ডামরেরা শহরে আগুন দিল। সমস্ত ঘরবাড়ি জ্বলে গিয়ে ছাই ও মাটির ভিটে অবশিষ্ট রইল, আর মন্দিরের ধংসস্তূপের মধ্যে আগুনের শিখায় কালো হয়ে যাওয়া একটি সুবৃহৎ বুদ্ধমূর্তি ‘দগ্ধদ্রুমোপম’, অর্থাৎ একটা পোড়া গাছের মত দাঁড়িয়ে রইল।
এই অবিরত যুদ্ধের ফলে কৃষির প্রভুত ক্ষতি হল, দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। রাজস্ব আদায় হল না, যুদ্ধের খরচ টানা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এই সময়ে সুস্সলের প্রিয়তমা রানি মেঘমঞ্জরী মারা গেলেন। সুস্সল মানসিক শক্তি হারালেন। রানি তাঁর পরিজনদের মধ্যে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে চার জন পরিচারিকা সহমরণে গেল, এমনকি একজন পাচকও হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করল। রাজা প্রিয় পুত্র জয়সিংহকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন ও তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।
জয়সিংহ কিশোর হলেও পিতার পক্ষে যুদ্ধে নেমে সাফল্য পেলেন, এমনকি রাজকার্যেও। যথারীতি কিছু লোক রাজাকে কুমারের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকল, কুমার শক্তিশালী হচ্ছেন, পিতার বিপদ আছে। মাথাগরম সুস্সল পুত্রকে বন্দী করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যাকে পাঠিয়েছিলেন সে বিচক্ষণ ছিল, নির্দোষ রাজপুত্রকে বন্দি না করে শুধু রক্ষা করবার বন্দোবস্ত করে সে চলে গেল। পিতাপুত্রের মধ্যে অবিশ্বাস তখনকার রাজাদের প্রত্যেক প্রজন্মেই ছিল। জয়সিংহ অনর্থক সন্দেহে দুঃখিত হয়ে বন্দির মতই রইলেন। কিন্তু রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের অসন্তোষ প্রবল হয়েছিল, তা ছাড়া নৈতিকতার দিক দিয়ে সারা রাজ্যেই অধঃপতন এসেছিল। টাকা পেলে বিশ্বাসঘাতকতা করতে অনেকেই দ্বিধা করত না। অর্থের প্রলোভনে রাজপুরুষেরা একই দিনে একাধিক পক্ষ বদল করত। চাহিদামত অর্থ না পেলে সাধারণ সৈন্যরাও রাজাকে কটাক্ষ করতে ছাড়ত না। বিশৃঙ্খলতার মধ্যে সুযোগ পেয়ে কিছু সুযোগসন্ধানী আততায়ী রাজাকে হত্যা করল। তারা সুস্সলের মাথা কেটে নিয়ে গেল, কবন্ধ পড়ে রইল।
রাজা জয়সিংহ
সুস্সলের পুত্র জয়সিংহ রাজতরঙ্গিণীর শেষ রাজা, এবং এই রাজত্বকাল কল্হনের নিজের কাল। জয়সিংহের রাজত্বকালের প্রথম দিকটা যুদ্ধেই কেটেছিল, কারণ যে অরাজকতার ধারা রাজা কলসের আমল থেকে শুরু হয়েছিল, তারপর হর্ষের সময় সেই ধারা চরম বেড়েছিল। জয়সিংহের পিতৃব্য উচ্চল কিছুটা সামাল দিয়েও শেষ অবধি পদস্খলন আটকাতে পারেননি, এবং তারপর একদিকে তাঁর পিতা সুস্সলের লোভ এবং অতি হঠকারিতার দোষে, অন্যদিকে একাধিক দাবিদারের রাজ্য, অর্থ ও সিংহাসনের লোভের কারণে খণ্ডযুদ্ধ পুরো ভূখণ্ডকে ছেয়ে গিয়েছিল, তার নিরসন সহজ ছিল না। জয়সিংহ পিতা এবং পিতৃব্যের রূঢ়তার দোষ পরিহার করে মৃদু বাক্য ও ভদ্র ব্যবহার দিয়ে ভাল ফল পেয়েছিলেন। এঁর সময়ে ভিক্ষাচর আবার বিদ্রোহী সামন্ত ও ডামরদের সহায়তা নিয়ে আক্রমণ করতে তৈরি হচ্ছিলেন। কিন্তু রাজার বাহিনী তাঁর আশ্রয়দুর্গ ঘিরে ফেলে আক্রমণ করল। মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ভিক্ষাচর তাঁর পিতামহ হর্ষের বিপরীতে শেষপর্যন্ত বীরোচিত লড়াই করতে করতে যুদ্ধে নিহত হন। একটা করুণ বিধিবিড়ম্বিত জীবন, কিন্তু তিনি কুলীন বীরগণের সঙ্গে, সমমর্যাদায় রণভূমিতে পতিত হলেন, ঠিক যেমন বজ্রাঘাতে পতিত পাহাড়চূড়া বা কোনো এক পুষ্পিত মহাবৃক্ষ ---কবির এই উপমা ভিক্ষাচরের প্রতি সসম্মান সহানুভূতির প্রকাশ।
আরো ক’জন সিংহাসনের দাবিদার ছিল, যেমন সুস্সলের বৈমাত্রেয় ভাই এবং তাঁর পূর্ববর্তী রাজা সল্হনের ছোট ভাই লোঠন, ও সুস্সলের আরেক পুত্র বিগ্রহরাজ। সল্হনের পুত্র তরুণ ভোজদেবও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। জয়সিংহ কৌশলে লোঠন ও বিগ্রহরাজকে বন্দি করে রাজধানীতে আনালেন, তারপর তাদের কিছুদিন বন্দিশালায় রেখে অত্যাচার না করে পর্যবেক্ষণে ছেড়ে দিলেন, এবং জ্ঞাতি হিসেবে তাদের যথাযোগ্য বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। ভোজ তখন পালিয়ে গিয়েছিল। তাকে আনতে জয়সিংহ নিজের অন্যতমা রানি বুদ্ধিমতী কল্হনিকাকে দূতরূপে পাঠিয়ে বিশ্বাস উৎপাদন করে তাকে নিয়ে এলেন। ভোজ রাজপরিবারে সসম্মানে পুত্রের মত আশ্রয় পেলেন। রাজপরিবারে বিবাদ থামলে বাইরের বিদ্রোহীরাও আর বাড়াবাড়ি করল না। এইভাবে শান্তি স্থাপিত হলে রাজ্যে সুশাসন প্রবর্তিত হল, সমৃদ্ধি এল।
শুধু যুদ্ধ নয়, কূটনীতি অবলম্বন করে কার্যসিদ্ধি করলে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়--এই বার্তা দিয়ে কলহন ইতিহাস-কাব্যটির পরিসমাপ্তি করেছেন।
পাদটীকা
১ কল্হনকে কবি বলা হয়, কারণ তাঁর রচনাটি ইতিহাস হলেও তার অবয়ব কাব্যের। সংস্কৃতভাষার সব রসরচনাকারই কবি, রসাত্মকং বাক্যং কাব্যম্। তাই নাট্যকার ভাস, কাহিনিকার বাণ, কাব্যকার ভারবি, কল্হন সবাই কবি।
২ গ্রন্থের উপাদান সম্পর্কে কল্হন বলছেন--
দৃগ্গোচর পূর্বসুরিগ্রন্থা রাজকথাশ্রয়াঃ।
মম ত্বেকাদশাগতা মতং নীলমুনেরপি।। ১৪
দৃষ্ট্বৈশ্চ পূর্বভূভর্তৃপ্রতিষ্ঠাবস্তুশাসনৈঃ।
প্রশস্তিপট্টৈঃ শাস্ত্রৈশ্চ শান্তোশেষভ্রমক্লম।। ১৫ রাজতরঙ্গিণী, প্রথম তরঙ্গ।
শ্লোকার্থ-- আমি পূর্বসুরীদের রচিত রাজাদের একাদশ কাহিনি এবং নীলমুনির মত(নীলপুরাণ) পড়েছি।
প্রাচীন রাজাদের মন্দির প্রতিষ্ঠার দানপত্র, প্রশস্তিপট্ট এবং এই বিষয়ক শাস্ত্র পড়ে নিজের ভ্রম নিরসন করেছি।
৩ কাশ্মীরের নাম সম্বন্ধে নীলমতপুরাণে উল্লেখ এরকম---
কঃ প্রজাপতিরুদ্দিষ্টঃ কশ্যপশ্চ প্রজাপতিঃ।
তেনাসৌ নির্মিত দেশঃ কশ্মীরাখ্যো ভবিষ্যতি।। নীলমতপুরাণ, ২২৩
কং বারি হরিনা যস্মাদ্দেশাদস্মাদপাকৃতম্।
কশ্মীরাখ্যং ততো পশ্য নাম লোকে ভবিষ্যতি।। নীল ২২৪
শ্লোকার্থ২২৩—প্রজাপতিকে ‘কঃ’ বলা হয়, কশ্যপ ও প্রজাপতি। তাঁর নির্মিত দেশ ‘কশ্মীর’ নামে বিখ্যাত হবে।
২২৪-- ‘কং’ অর্থে জল, যা হরির দ্বারা এ দেশ থেকে নিষ্কাশিত হয়েছিল। তাই দেখ, এদেশের নাম পৃথিবীতে ‘কশ্মীর’ নামে খ্যাত হবে।
রাজতরঙ্গিণীতে নামকরণের ইতিহাস নেই। কলহন, নিজের কথায়, তাঁর লেখায় (প্রথম তরঙ্গে) নীলমত পুরাণ কিছুটা অনুসরণ করেছেন। তবে দেশটির নাম আমরা কাশ্মীর বলে জানলেও আসলে নামটি হল ‘কশ্মীর’। নীলপুরাণের এই ব্যাখ্যাতে আমার একটু সন্দেহ আছে, এখানে ‘কঃ’ শব্দ ব্যাখ্যা করা হলেও ‘মীর’ শব্দ হয় নি। তাই নামকরণের ব্যাপারটা বর্তমান প্রবন্ধে আনা হয়নি।
৪ কাশ্মীরের প্রস্রবণ এবং নদী সম্পর্কে স্টাইনের অনুসন্ধান
Kashmir Chronicle ( Marc Aurel Stein);
Introduction, page 318, sec 18:
"Nature has, indeed, endowed the Valley and the neighbouring mountains with an abundance of fine springs. As each of these has its tutelary deity in the form of a NAGA, we can realize why popular tradition looks upon Kashmir as the favourite residence of these deities . Huen Tsang already had ascribed the superiority of Kashmir over other countries to the protection it received from a Naga. Kalhana, too, in the introductory passage already referred to, gives due prominence to the distinction which the land enjoys ss the dwelling-place of Nil, king of Nagas, and many others of his tribe."
কলহনের বর্ণনায় --
জ্যৈষ্ঠেব কৃষ্ণাদ্বাদশ্যাং যাত্রায়ৈ তক্ষকস্য তম্।
আগতং চূলয়া তোয়স্যন্দিন্যা জ্ঞায়সি ধ্রুবম।। রাজ প্রথম তরঙ্গ, ২২০
শ্লোকার্থ-- জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণাদ্বাদশীতে এখানে তক্ষকের (নাগ) উৎসব হবে। তাঁর জলস্রাবী চূড়া দেখে তাঁকে ঠিক চিনতে পারবে।
তক্ষক নাগকে চেনা যায় জলস্রাবী চূড়ায়। জলস্রাবী চূড়া প্রস্রবণ ছাড়া আর কী হতে পারে? বিতস্তার উৎপত্তিস্থলও একটি প্রস্রবণ ভেড়িনাগ। শারদা মন্দির ভেড়গিরিতে অবস্থিত, সেখানেও একটি প্রস্রবণ আছে।
৫ এক খারী= ১৭৭ পাউণ্ড (ওজন) source- M.A. Stein
৬ শাহি বংশ—উদ্ভাণ্ডপুরের রাজবংশ।
কাশ্মীর উপত্যকার উত্তরপশ্চিমে পীরপঞ্জল পর্বতের ঢালে লোহর দুর্গের অধিপতি সিংহরাজ উদ্ভাণ্ডপুরের (ঐতিহাসিকদের মতে কাবুল) রাজা ভীমাশাহির কন্যাকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির কন্যা দিদ্দা, যিনি পরবর্তীকালে রাজা ক্ষেমগুপ্তকে বিয়ে করে কাশ্মীরের রানি হন, এবং নিজেও সিংহাসনে আরোহন করে বেশ কয়েকবছর রাজত্ব করেন। ভীমাশাহীর পূর্বে উদ্ভাণ্ডপুর পারস্যের অধীনে ছিল। কল্হন-পরবর্তী ইতিহাসে ভীমাশাহির বংশ হিন্দুশাহি বলে পরিচিত।
ঋণস্বীকার
১ রাজতরঙ্গিণী (বাংলা অনুবাদ) হরিলাল চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক অমিত ভট্টাচার্য
২ নীলমতপুরাণম্
৩ রাজতরঙ্গিণী (মূল সংস্কৃত) পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ সম্পাদিত
৪ Kalhana's Rajatarangini-- A Chronicle of the Kings of Kashmir by Sir Marc Aurel Stein