তুই খুব ভাল বিষণ্ণ হতে পারিস, না?
আলিফ ওর দিকে দুটো কাগজের কাপে কফি ব্যালান্স করতে করতে এগিয়ে এল। বার্সেলোনার স্টেট অথরিটির বেঞ্চিগুলো সাদা, স্টিলের, চ্যাপ্টা, চৌকো। ওখানেই বসেছিল ওরা। অপেক্ষা ছিল পামপ্লোনার বাসের। ইতিমধ্যে মুখময় বিষাদের ছায়ায় নিজেকে চুবিয়ে দিয়ে হিনা চুপচাপ। যেন মুক্তো তৈরি হচ্ছে ওর ঝিনুকের মধ্যে। এতটাই আত্মগত, নিজের ছায়ায় নিজে থাকা গাছের মতন, নীরব আর শান্ত, কিন্তু একটু ভয় ভয় করে দেখলে আলিফের।
মুহূর্তটা ও ভাঙতে চায় না কিন্তু ভেঙে দেয়, কারণ এই নীরবতা ওর সহ্য হচ্ছে না, ও তাই কফির কাপ এগিয়ে দিতে দিতে, তেরছা চাহনি দিয়ে, একটু হেসে প্রশ্নটা করে ফেলে।
ইউরোপের আকাশ ঈগলের নখের মত তীক্ষ্ণ নীল, অনেকদিন আগে কে যেন বলেছিল কথাটা। আকাশ বেশি নীল, উচ্চ অক্ষাংশে তাই-ই হয়। রিফ্র্যাকশনের অংক। উত্তর গোলার্ধ, তিরিশ ডিগ্রি অক্ষাংশের বাইরে যত যাবে, কর্কটক্রান্তি থেকে অনেক দূরে, তাপমাত্রা যেমন কমবে, মেঘ বৃষ্টি ঝড়ের প্রকোপ কমবে, আকাশ অনেক স্বচ্ছ হবে, ভূগোল তাই বলে।
সামান্য দূরে বসে সীমা নিজের ব্যাকপ্যাক নামিয়ে রাখছিল। বোতল থেকে জল খেল ও একবার। ছোট বোতল, ব্যাকপ্যাকের পাশের পকেটে থাকে । ওই বোতল যে-কোন স্টেশনে, বাসস্টপে লাগোয়া টয়লেট কমপ্লেক্সে ঢুকে, কল থেকে ভরে নিলেই জল খাওয়া চলে এখানে, এত পরিচ্ছন্নতায় অস্বস্তি হয় সীমার, কিন্তু এটাই তো প্রথম বিশ্ব।
সীমা নিজেরটুকু ভাল করে গুছিয়ে রাখতে জানে, ও জানে লোকে ওকে আত্মকেন্দ্রিক ভাবে। আত্মকেন্দ্রের একটা ছোট বলয় এই গ্রুপের বেড়ানোর ভেতরেই, ঘুরতে ঘুরতেই বানিয়ে ফেলেছে, কিন্তু শুধুই নিজের চুন্নি দিয়ে মুখখানাকে রোদ্দুর থেকে ঢেকে ফেলার সময় মনোযোগ ওই চুন্নির দিকে ছিল না। তার ভেতরে ভেতরে ভাঁজ করে রাখা বিনোদনও ছিল। টানা আলিফ আর হিনার দিকে চেয়ে সীমা ওদের কেমিস্ট্রি আন্দাজ করতে ব্যস্ত ছিল। যদিও ওর কাছে, আলিফ হিনার সম্পর্কটা কৌতূহলের বিষয়মাত্র।
কিন্তু খুব চালাক হবার দরুন সীমা খুব ভাল কথা কাটতে পারত। এখন সুযোগ ছাড়ল না সীমা। হিনাকে টোকা দেবার। কে ওকে বলেছিল এমন সুন্দর হতে? স্পটলেস ওর স্কিন। একদম পুতুলের মত গড়নের মুখ। ছোট্ট শরীর, ছিপছিপে। হিনাকে দেখলে মনে হয় একটা নিখুঁত জিনিস বানাবে বলে ওপরওয়ালা অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল। হিনা সত্যি তাকিয়ে দেখার মতন মেয়ে। সীমার ভারি রাগ হয়, এমনিতেই নিজের ওপরে। কেননা ওর চামড়া ভাল নয়, মুখে দাগ আছে, এই ত্রিশ ছুঁই ছুঁই বয়সেই হালকা বলিরেখা ও আয়নায় দেখতে পায়।
ও বলল, না রে, হিনা খুব ভাল বিষণ্ণ বিষণ্ণ খেলতে পারে।
যাচ্চলে।
একটু কফি চলকে পড়ে গেল। একটা সুইপার ঝাড়ুমারা মেশিন নিয়ে ঘুরছিল, নীল পোশাকের। ওকে ডেকে আনল আলিফ। কথাটা চেপে গেল না আলিফ, নাকি লজ্জা পেয়ে চেপে দিল কে জানে। তবে সুইপারের যন্ত্রে শোঁ শোঁ করে শুষে নিল সব চলকে যাওয়া কফি। তারপর আবার সবদিক চুপচাপ হয়ে গেল।
পরাশর খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিল, কাঁধে রুকস্যাক। একটা দাঁত একটু উঁচু। সীমার ওকেই পছন্দ, একটু-আধটু ফ্লার্ট করার জন্য। ও ফিরে এসে বলল বাসের টাইমিং অনুযায়ী আর সাড়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে বাস আসছে। এতটা ডিটেলিং কী করে সম্ভব হয় এদের কে জানে। যাইহোক ভারত নয়।
স্বাদগন্ধহীন কফিতে চুমুক দিয়ে হিনা চনমনে হল কিছুটা। তারপর আলিফকে বলল, এখানে রেস্টরুম কোথায় রে? চুল আঁচড়াবে বলে হ্যান্ডব্যাগ থেকে চিরুনি বার করল। তারপর আলিফের সঙ্গে মিলিয়ে গেল পাবলিক ইউটিলিটির দিকটায়।
সীমা আর পরাশর চোখাচোখি করে হাসল, তারপর পরাশরের হাত থেকে ওর দামি মোবাইলটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে সীমা মেসেজ ইনবক্স খোলার চেষ্টা করতে লাগল, আর পরাশর সে ফোন ফেরত নেবে বলে সীমার সঙ্গে একটা ছদ্মযুদ্ধে নেমে পড়ল। এ যাবত পুরো ট্রিপে ক্রমাগত সীমাকে হান্ট করে গেছে পরাশর... ওর পেছন পেছন ঘুরছে সারাক্ষণ। সীমা ফ্লার্ট করছে ওর সাথে। একবার ওকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে তো পরের বার ওর ফোন, ওর জামা, ওর চুল, ওর গোঁফ ধরে টানাটানি করছে। সূক্ষ্ম কাঁচি বাগিয়ে ওর ভুরুর চুল কেটে দেবার মতলব করছে।
পরাশর গলে যাচ্ছে, ফ্রাস্ট্রেটেড হচ্ছে, আবার গলে যাচ্ছে, রেগে যাবার ভাণ করছে।
ওরা চারজন গিয়েছিল ইউরোপের একটা সার্কিটে, হিন্দি ছবি জিন্দেগি না মিলেগি দোবারার সার্কিটে। এভাবে বেড়ানো এখন ওদের সেক্টরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রায় বাধ্যতামূলক। ওরা সবাই টাকা জমায় শুধু একটা বেড়ানোর পরিকল্পনার জন্য, রীতিমত ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে দিয়ে, সেবিং এর গোল সেট করে করে। কোস্টা ব্রাভার ডিপ সি ডাইভিং, সেভিয়ের স্কাইডাইভিং, পামপ্লোনার বুল রেস, আর বুনুয়োলের টোমাটিনা ফেস্টিভাল। দক্ষিণ স্পেনের এই সার্কিট এখন রমরমিয়ে ভারতীয় আই টি সেক্টরের ছেলেমেয়েদের দখলে।
আলিফ আর হিনা ফিরে এল ইউটিলিটির দিক থেকে, মুখ দেখে মনে হল হিনার মনের মেঘ কেটে গেছে, আবার দুজনে হাসছে, গল্প করছে, আচরণ যেন বা বি এফ জি এফের। কোথাও কোন চিড় বা ফাটল চোখে পড়বে না।
ওহ দেখেছিস কী ভাব!
হ্যা! একদম মাখন!
ওদের কখন কী হয় কীভাবে বুঝব বল ? আপাতত এই হলায় গলায় হচ্ছে, তারপরই হিনা কেমন আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, জোন আউট করে যায়।
এইসব কথার পর, একটা সময় আসে যখন বাসের বড় বড় জানালা দিয়ে বাইরের ঢেউ তোলা সবুজ মাঠ, তৃণক্ষেত্র, গরুভেড়ার চরে বেড়ানো, ছোট ছোট শহর বা জনপদ দেখতে দেখতে ওদের চোখ লেগে আসে, খুব ভোর থেকে উঠে, হোটেলে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়ার ফলে রাতের ঘুম পুরো হয়নি।
হিনা মাথা রাখে আলিফের কাঁধে, সীমা জানালার কাচে মাথা হেলায়, পরাশর ছটফট করে সীমার দিকে তাকিয়ে, ঘুমাতে পারে না, কেবল ভাবে সীমার মনে কী আছে? জানতে হবে।
সীমার ঘুম একটা ঝাঁকুনির সঙ্গে ভেঙে যেতে সে নিজেকে আবার যেন সংযত করে নেয়, ঘুম আমাদের সবচেয়ে একান্ত করে, ভালনারেবল করে, নিরস্ত্র করে, আর সীমা তো তা হতে চাইবেই না, অন্তত পরাশরের পাশে বসে, অথচ আলিফ হিনার মত একটা কাপল হয়ে যেতে ওর বেদম আপত্তি হলেও, চার ছেলেমেয়ের অংকটা ভালই বোঝে সীমা, দুজনে কাপলিং করলে বাকি দুজন নিজেদের অজান্তেই দম্পতিতে পরিণত হচ্ছে আর এতেই বিকট রাগ হচ্ছে সীমার। সে ফিক করে হেসে, প্রচণ্ড ক্যাজুয়াল হবার মত করে গুছিয়ে নেয় পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ, তারপর পরাশরের দিকে ফিরে বলে, ট্রিপটা প্ল্যান করেছিস তুই, এবার ফ্লপ হলেই তোর দুর্নাম।
পরাশর বলে, আচ্ছা, তুইও তো বাড়িতে কিছু বলে আসিসনি, তাই না?
বাড়িতে না-বলে আসার কথাটা স্বীকার করা মানে নিজের বাবা মায়ের বোধ বুদ্ধির ওপরে কিছুটা অনাস্থা দেখানো তাই সহসা সত্যি কথাটা বলে না সীমা, ঘুরিয়ে বলে, হেলিকপ্টার থেকে জাম্পিং বললে হার্টফেল হবে তো, একটু রেখে বাঁচিয়ে বলতে হয় এসব।
হুঁ, পরাশর নিজের নখের দিকে দেখে, আমার মা তো সারাক্ষণ আমি কী খেলাম তাই নিয়ে বদারড থাকে।
স্নরকেল পরে জলের তলায় নামা শুনলেই ঘাবড়ে যাবে। হা হা হা।
২
মাইলের পর মাইল সবুজ মাঠ, ইংরেজিতে বলে মেডোজ। ঘাস যন্ত্রে কেটে মুড়ে গোল গোল কোলবালিশ বানিয়ে রাখা। বাসটা সরু আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে চলছে, অনেক ওপর থেকে দেখলে মনে হবে ছোট একটা পোকা। প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থান দেখতে দেখতে ওরা সবুজের মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে আবার হিনা নিজের জগতে হারিয়ে যাবে এখন। আলিফ বলল, তুই এখন মি টাইম নিবি? আমি তাহলে পেছনের সিটে গিয়ে বসি।
একেবারে পেছনের সিট ফাঁকা ছিল। আলিফ সামনে সবাইকে দেখতে পাচ্ছিল। গিটার হাতে দু তিনজন স্থানীয় ছেলেপিলে, তাদের চুলের কায়দা আলাদা, কালো হাতকাটা টাইট গেঞ্জি পরনে, সারাগায়ে বিচিত্র ট্যাটু। হয়ত তারা কোন জলসায় গান গাইতে চলেছে। মাথায় কালো টুপি দেওয়া অতিগম্ভীর কালো আলখাল্লা পরা ইহুদি র্যাবি রয়েছেন একটা সিটে। সবাই চুপ, গিটারের দল ফিসফিস করে গল্প করছে, হাসছে। অতি ভদ্র কুকুর-সহ এক মহিলা আছেন। সমুদ্রকে ডান পাশে রেখে বার্সেলোনা থেকে কোস্তা ব্রাভা। উচ্চাবচ আঁকাবাঁকা পথটুকু তীব্র সবুজনীল পান্নারঙা সমুদ্রতীর ধরে ধরে চলবে। বালিয়ারিক সাগর থেকে আসবে তাজা সামুদ্রিক বাতাস।
নতুন দেশ, নতুন পৃথিবী, নতুন জীবনের আনন্দে ওরা ভেসে যাচ্ছিল। হয়ত ওখানে গিয়ে, উঁচু উঁচু প্রাচীন দুর্গে চড়বে, হয়ত বালুময় সমুদ্রতীরে প্যারাগ্লাইডিং করবে। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসএর ধিকিধিকি অ্যাড্রিনালিন রাশ উপভোগ কবে।
পরাশরের গুগুল-ঘাঁটা জ্ঞান, নানা ভ্রমণের সাইট থেকে একেবারে নিখুঁত তুলে আনা সাজেশন, প্রতিটা ক্যাফে থেকে শুরু করে খাবার জায়গাগুলো, কোথায় গেলে পানিনি পাবে ভাল, কোথায় গেলে পিৎসা, সব নখদর্পণে। পানিনি মানে রুটি, কিন্তু বস্তুত স্যান্ডুইচ, সেই মোটা মোটা রুটিকে দুভাগ করে কেটে মধ্যেখানে ভরে দেওয়া চিজ ও মাংসের টুকরো, নানা রকম সব্জি আর সস। একটা খেলেই সারাদিন নিশ্চিন্ত।
এখনো পরাশর ফোন খুলে পড়াশুনো করে নিচ্ছিল। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাস থেমে গেল। এত মসৃণ চলা সুদৃশ্য বাস কেন বাংলার কোন মফস্বলের রাস্তায় হেঁচকি তুলে থামল। কেন বাস এভাবে থেমে যায়? উৎসুক চোখে তাকাল ওরা।
বাসের সামনে রাস্তায় একটা ছোটখাট ভিড় দেখতে পেল। মানুষের ভিড়, কোন কারণে হাত দেখিয়ে তারাই বাস থামিয়ে দিয়েছে হয়ত।
তারপরেই সবাইকে উচ্চকিত করে শুরু হল, বাসের গায়ে দুমদুম পিটুনির আওয়াজ। প্রচণ্ড জোরে অনেকগুলো মুষ্টিবদ্ধ হাত এসে আছড়ে পড়ছিল বাসটার ধাতব গায়ে।
বাসের হাট্টাকাট্টা ড্রাইভারের দিকে এবার চোখ গেল ওদের। স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে বলতে নেমে গেলেন তিনি। ড্রাইভারের সঙ্গে নিচের মানুষগুলোর বচসা শুরু হল যেন। পরাশর উঠে যাচ্ছিল দেখতে, সীমা ওর বাহু ধরে, আস্তিন খিমচে ওকে আটকাল। এই যাস না পরাশর। এটা তোর কলকাতা না, এখানের ভাষাও তুই জানিস না।
পরাশর শিশুর মত ঔৎসুক্যে শুধু ঘাড় তুলে দেখছিল। গিটার হাতে দলটাও উৎসুক। শুধু র্যাবির মুখে কোন বিকার নেই, বিকার নেই কুকুরসঙ্গী, গোলাপি ফুলেল ছাপ দেওয়া জামাপরা মহিলার মুখেও। বুদ্ধের অবতার রূপ নিয়ে যেন তাঁরা বসে আছেন, কোথাও কিছু ঘটেনি।
পরাশর কান পেতে ওদের কথা শুনছিল। ঠিক ঝগড়া নয়, কিন্তু বাদানুবাদ, মনে হয় ওরা বাসে উঠতে চাইছে। একটা দল, অন্তত দশ বারোজনের, তার ভেতরে মেয়েরাও আছে, মেয়েদের পোশাক দেখে পরাশর বুঝতে পারল, সম্ভবত এরা স্থানীয় নয়, মনে হচ্ছে এরা বহিরাগত। ওদের সিটের ফিরে এসে ফিসফিস করে বলল তা। সঙ্গে সঙ্গে আলিফ উঠে দাঁড়িয়েছিল, পরাশরের কাছে গিয়ে পরাশরকে ঈষৎ দূরে টেনে, কাঁধে হাত রেখে আলিফ বিড়বিড় করে কিছু বলছিল। সীমার দেখে খুব রাগ হল, একটা বিপদের সময়েই এদের ব্রো-গিরি চাগিয়ে ওঠে, মেয়েদের এরা দেখতে পায় না, সীমা চেঁচিয়ে বলল, অ্যাই আলিফ, পরাশর এখানে চলে আয়, ওস্তাদি মারতে ওখানে গেছিস কেন।
খানিকক্ষণ বাদে দশ-বারো জনের দলটা চেঁচামেচি থামিয়ে বাসে উঠে এল একে একে। ড্রাইভার নিজের দরজা খুলে নিজের সিটে বসল। ড্রাইভারের চোখেমুখে চাপা টেনশন ওদের চোখ এড়াল না, ঘামছেন ভদ্রলোক, সুবিশাল চেহারা, বেশ মোটাসোটা, অথচ সমস্ত মিলিয়ে খুব গোবেচারা লাগছিল তাকে দেখে এখন।
চেঁচামেচি নেই কিন্তু দলটার ভেতরে গুমগুমে একটা গুঞ্জন চলেছে, মাথায় রুমাল দুটি মেয়ে, সঙ্গে কোলের ছেলে রয়েছে, বাকিরা উত্তেজিত কিন্তু আপাতত একটা রফাসূত্রে আসা গেছে বলে খুশি। সকলের পিঠে ব্যাকপ্যাক রয়েছে, হাতে রয়েছে শপিং মলে যেসব পাতলা প্লাস্টিক ব্যাগ দেয় সেইরকম সাদা প্লাস্টিক। থলেগুলো উপচে উঠেছে জামাকাপড়ে, খাবারে। দলটার পরনের জামাকাপড় পরিচ্ছন্ন না হলেও একেবারে ছেঁড়াখোঁড়া নয়। এক ঝলক দেখলে এদের সবার সাথে নিজেদের একটা মিল চোখে পড়ে। এদের গায়ের রং শ্বেতাঙ্গদের মত নয়, ফর্সা হোক বা কালো, এরা ভারতীয়দেরই মতন, বাদামি চামড়ার। এই বিশাল পৃথিবীর যাবতীয় ভাল জিনিস, যাবতীয় সুন্দর জিনিস যাদের অধিকারে বলে পরাশর ভাবে, বা সীমা ভাবে সেই সাদাচামড়াদের দেশে এসে, একদল ময়লা চেহারার মানুষকে খুব কাছের খুব আপন বোধ হতেই পারত, কিন্তু এই মুহূর্তে ভয় আর সন্দেহে মনের মধ্যেটা শিঁটিয়ে গেছে।
চাপা গলায় পরাশর সীমাকে বলল, ক্রসবর্ডার রিফিউজি, সব এসেছে মিডল ইস্ট থেকে। পড়িস নি, যুদ্ধ চলছে লেবাননে, সিরিয়ায়?
সীমার বুক কাঁপছিল। মুখে কিছু দেখাচ্ছিল না। আলিফ বিড়বিড় করে এবার বাংলাভাষায়, বিশুদ্ধ শব্দে বোঝাচ্ছিল হিনাকে, যাতে আশেপাশে কেউ বুঝতে না পারে। শরণার্থী এরা, বোঝাই যাচ্ছে।
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতেই রেডিওর মাধ্যমে স্পেনীয় ভাষায় কিছু বলছিল। ড্রাইভারদের সবাই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে তাই রেডিও থেকে নানা রকমের নির্দেশিকা আসতেই থাকে। তাই সেটা কোন অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবু কান খাড়া করে পরাশর বোঝার চেষ্টা করছিল কোন ইংরেজি শব্দ কানে আসে কিনা। টানটোনের ভেতরে কোন লুকনো বার্তা খুঁজে বেড়াচ্ছিল আলিফ। কোন এস ও এস পাঠাচ্ছে ড্রাইভার? সম্ভবত তাইই।
পথের দিকে চোখ মেলে ওরা এবার যা দেখল তাতে ওদের চক্ষুস্থির হয়ে গেল। অজস্র এরকম ছোট দল, কুড়ি-তিরিশ জনের দল, সবার হাতে পিঠে ছোট ছোট ব্যাগ। পাতলা জ্যাকেট, শীতকালে এতে শীত মানাবে না। ছেলেদের মুখে চোখে বিরক্তি বিভ্রান্তি, মেয়েরা মাথায় রুমাল দিয়ে শান্ত, দশ বারো বছরের ছেলের হাত ধরা।
সীমার বুকের ভেতর ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে হচ্ছিল কেবল নিজেদের জন্য ভয়, আশংকা, এই চমৎকার বেড়ানোটার ভেতরে এসব কী উৎপাত।
পথে যাতে আর বাধা না পেতে হয়, ড্রাইভার তুমুল বেগে বাসটাকে চালিয়ে দিচ্ছিল। দূর নীল সবুজ সমুদ্রের তটরেখা, অনেক দূরে আকাশে চক্কর কাটছে সিগাল, এই অপূর্ব দৃশ্য দেখেও সীমা পরাশরের যেন কান্না পাচ্ছিল, ভবিষ্যতের উদ্বেগ আর অনিশ্চিতিবোধে। ঘরছাড়া, পথে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে দেখে রাগ হচ্ছিল, করুণা হচ্ছিল না আর সেইটে বুঝতে পেরে বুক ভরা অপরাধবোধও হচ্ছিল। ওরা বেড়িয়ে ফিরে যাবে নিজের ঘরের নিশ্চিন্ত নিরাপদ কোনায়, এদের ফেরার জায়গা নেই! হয়ত বাড়িই ভেঙে গেছে বম্বিং-এ।
অথচ এখন এরা যেন ওদের শত্রু, ওদের নিশ্চিন্ত বেড়ানোর পথের কাঁটা।
টানা আধ ঘন্টা বাস চলল। ড্রাইভার পড়ি-কি-মরি করে চালাচ্ছে বলেই আরো বেশি উদ্বেগ বোধ করছিল এরা। অনলাইনে টিকিট কেটে কত কাণ্ড করে এসব বাসে চাপার বরাত মিলেছে। অথচ এই দলটা বিনা টিকিটে ড্রাইভারকে শুধু ধমকি দিয়ে, বচসা করে, বাসের গায়ে দুমদুম পিটিয়ে উঠে পড়ল, একটা পয়সা কারুর পকেট থেকে বেরুল না। ব্যাপারটা এই নিয়মকানুন মানার দেশে কত অদ্ভুত ভাবলে গা শিরশির করছে ওদের সবার। এখানে বাসের টাইম ১০-৫৫ দেখানো থাকলে বাস ১০-৫৫তেই আসে, এগারোটায় নয়। এই প্রচণ্ড সময়ানুবর্তী শিডিউলের দেশে তাদের বাস ড্রাইভার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ব্যাপারে থমকে গেছে তো বটেই, নিজের চামড়া বাঁচিয়ে কীভাবে পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাবে তাই ভাবছে।
দম না ফেলে টানা তিরিশ মিনিট ছুটে, আপাতত ঘ্যাঁষ করে থেমে গেছে বাসটা। একটা বায়োলজিকাল ব্রেকের দরকার তো ছিলই, সবারই। কিন্তু এখন যেন সেসব মাথায় নেই, এবার একে একে ওরা নেমে যায়, বাস ছাউনির মুখের টয়লেটের সামনে লাইন পড়ে, স্যান্ডুইচ ও কফির দোকানের সামনে বিনবিন করে জমা হয় লোক। কুকুরসঙ্গী মহিলা নেমেই গেলেন বাস থেকে একেবারে বরাবরের জন্য। মুখে বিন্দুমাত্র কোন তাপ উত্তাপ না-দেখানো র্যাবি নেমে বাস ড্রাইভারের সাথে কথা বললেন।
টয়লেটের থেকে বেরিয়ে, মুখে চোখে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ হতে হতেই, পরবর্তী দৃশ্যটা খুলে গেল ওদের সামনে। যার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না ওরা কেউ।
৩
কোথা থেকে যেন কয়েকটা লাল নীল আলো জ্বলা, সাদা টয়োটা ভ্যান এসে হাজির হল প্যাঁ পোঁ করে হুটার বাজাতে বাজাতে। তারপর গাড়িগুলো থেকে লাফিয়ে নামল একদল পুলিশ। পুরুষ ও মেয়ে পুলিশের বিশাল দল। সীমা দেখল, সোনালিচুলো মেয়েপুলিশের চোখে কালো গগলস।
এদের সবাই সাদা চামড়ার। স্পেনের রোদ্দুরে ভাজা হয়ে লালচে হয়ে যায়নি ড্রাইভার বা গাইডদের মত। তাই যেন দূরত্ব আরো বেশি মনে হয়, যেন ঠান্ডা কামরার বদ্ধতায় এদের ঘরে রাখা ক্যাকটাস বা বাহারি ফুলের গাছের মত করে বাঁচিয়ে রাখা হয়, কোন আঘাত বা আঁচ লাগতে দেওয়া হয় না। ফলত, মার্জিত চেহারাগুলো আশ্চর্য ঝকঝকে। কালো ইউনিফরমে নানা রকম সোনালি হলুদ ব্যাজ আর কোমর থেকে ঝুলছে নানা দড়িদড়া, রুল। রুলের গুঁতো একবার খেলে আর দেখতে হবে না। সোনালি চুলো, কটাচোখ, শ্বেতাঙ্গ পুলিশের দল অসম্ভব রকমের ফিটফাট। প্রতিটি লোকের পকেটে নিদেনপক্ষে রিভলভার তো আছেই যদিও অদৃশ্য। সমস্ত শরীরে বিদ্যুত তরঙ্গের মত খেলা করছে ক্ষমতা।
এসেই এরা বাসের প্রতিটি যাত্রীর থেকে পাসপোর্ট বা নিদেন যে কোন আইডি দেখতে চায়। একের পর এক শরণার্থীর কাছে যায়, স্পেনীয় ভাষায় কথা বলে। ওরা সবাই উত্তর দেয় নিজের ভাষায়, শুধুমাত্র একজন ওদের মধ্যে, একটা যুবক, লিডার গোছের, ভাঙা ভাঙা স্পেনীয়ভাষায় কী যেন বলতে থাকে। নিজেদের এই বাস দখলের ব্যাখ্যা।
পুলিশের মুখে অবিশ্বাস, সন্দেহ, ভাষা না বোঝার বিরক্তি।
ছেলেটার কথায় নিরুপায়তা, আর্তি। ভাষা বোঝাতে না পারার বিভ্রান্তি।
ওদের কোন পাসপোর্ট নেই, ওরা এই পৃথিবীর সুস্থ, জানা-চেনা চৌহদ্দির বাইরে, নিজের দেশের বাইরে চলে এসেছে। ওরা সমস্ত নাগরিক পরিষেবার বাইরে চলে এসেছে।
এর পর যা হয় তা আরো ভয়ানক, হাতের রুল তুলে পুলিশেরা ওই শরণার্থীদের বাসছাউনির ভেতরেই বেশ খানিকটা দূরে আলাদা করে দেয়, একটা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করে, কী করুণভাবে পোঁটলাপুঁটলি সহ কেউ কেউ বসেও পড়ে রাস্তার ধুলোয়, বাচ্চাগুলো চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করে, তাদের মায়েরা ফ্যাকাশে নীরক্ত মুখে ব্যাগ থেকে বিস্কুট খুঁজে সন্তানকে দিতে থাকে।
পুলিসরা তারপর বাসের বাকি লোকেদের দিকে এগিয়ে আসে আইডি দেখবে বলে।
এই প্রথম পরাশর সীমা আর আলিফের বুকের মধ্যে যেন দড়াম দড়াম করে হাতুড়ি পড়তে থাকে। এই পুলিসদের চোখে পিঠে ব্যাকপ্যাক নেওয়া শরণার্থীদের সঙ্গে, এই চার ভারতীয়, ভেতো বাঙালির কোন তফাত নেই।
ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে পরাশরের। সীমা নিজের সমস্ত ডিফেন্স মেকানিজম ভুলে যায়। পরাশরের হাত জাপটে ধরে বলে, আমাদের সাথেও ওরকম করবে, রে?
পরাশর নিজের ভয় ভুলে হাসি হাসি মুখে বলে দূর বোকা, আমাদের ত বৈধ পাসপোর্ট আছে, শেনগেন ভিসা আছে, সব আছে। ধুর, ভয় পাচ্ছিস কেন!
এই প্রথম ও সীমার ঘাড় জড়িয়ে বুকের কাছে আগলে নেয়। সীমা কিছু বলে না, কোন বাধা দেয় না।
হিনা এতক্ষণ কিছুই বলেনি। এবার আলিফের দিকে তাকায়। থরথর করে কাঁপছে ওর ঠোঁট।
“আমার মা, কুড়ি বছর বয়সে, পালিয়ে এসেছিল এদিকে, একটা পোঁটলায় শুধু কটা জামা নিয়ে। একাত্তর সালে বাবাও চলে এসেছিল আমার খালার কাছে, পার্ক সার্কাসে…”
হিনা কাঁদতে পারে না, শুধু বিষণ্ণ থাকে সর্বদা। আলিফ ওর হাত বুকের কাছে নিয়ে আসে, দুহাত জড়ো করে চুমু খায় ওর হাতে।