• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৬ | অক্টোবর ২০২৪ | গল্প
    Share
  • ক্লর্ক্‌, ক্লর্কন্‌, আর একটা টেলিফুঙ্কেন রেডিও : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

    পর্ব ১             পর্ব ২


    (দিল্লী । সত্তর, আশি, বা নব্বইয়ের দশক)


    পুরোনো শহরের ছিল পুরোনো, অর্থহীন কোনো নাম। তার মাঝখান দিয়ে আরাবল্লীর যে শিরাটা দক্ষিণের উঁচু টিলায় গিয়ে ধাক্কা খেয়ে থামত সেটাকে বলত রিজ। মালচা, কুশক, মোতিবাগ, জোরবাগ, তালকটোরা ইত্যাদি একশোর উপর গ্রাম ছিল সেই টিলার আশেপাশে। গ্রাম নেই, তবু নামগুলো আজও শোনা যায়। টিলার চূড়াটা পড়ত রায়সীনা গ্রামে, যেখানে ডায়নামাইট দিয়ে জমি সমতল করার পর ভাইসরয়ের বাড়িটা তৈরি হয়। পরে সেই প্রকাণ্ড বাড়ির নাম হয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবন। তার দুদিকে, কৃত্রিম মালভূমির মেঝেতে দাবার দুটো রুকের মতো বসিয়ে দেওয়া নর্থ আর সাউথ ব্লক নামের সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং দুটোর পরিচয় পালটায়নি। সামনের সুবিশাল চত্বরটাকে ততদিনে বিজয় চওক নামে চিনেছে লোকে। সেখান থেকে শুরু করে ইণ্ডিয়া গেট পর্যন্ত একটা কালো অ্যাসফল্টের ফিতে তাড়াহুড়োতে সঙ্গে নিতে না পেরে রেখে গিয়েছিল ব্রিটিশরা। প্রথমে সেটার নাম ছিল কিংসওয়ে। পরে কিংসওয়ের আক্ষরিক অনুবাদ করে বলা হত রাজপথ। এই ফিতে ধরে ছাব্বিশে জানুয়ারির দিন একটা প্যারেড মার্চ করে উঠে যেত রায়সীনা পাহাড়ে, এবং ফিরে আসত তিনদিন পর, উনত্রিশ তারিখে, যখন তার নাম হয়ে যেত বীটিং দা রিট্রীট।

    রাজপথের দুধারে উৎখাত করা গ্রামবাসীদের ভাঙা খাটিয়া আর বাসন-কোসনগুলো চাপা দেবার জন্য যে খালের মতো গর্ত থেকে মাটি চুরি করা হয়, তাতে বৃষ্টির জল জমার পর পাওয়া যায় দুটো লেক বা পুকুর। হারিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর স্মৃতি ভুলবার জন্য বোটক্লাব নাম দিয়ে পরে সেখানে নৌকো ভাসানো চালু হয়েছিল।

    শীতকালে অবশ্য বোট বিশেষ চলত না। তখন সেখানে সাঁতার দিত সাইবেরিয়া থেকে পালানো লম্বা গলাওয়ালা রাজহাঁস আর ক্রেন, নভেম্বরের গোড়ায় চলে আসার পর যারা বীটিং দা রিট্রীট না দেখে ফেরার নাম নিত না। হাঁসেরা যখন ডানা গুটিয়ে নামত, তখন তাদের দেখাদেখি আকাশের একটা অংশ বিশ্রাম নেবার জন্য লেকের জলে নেমে আসতে শিখে যায়। এইভাবে একটা ঘটনার সূত্র ধরে ঘটে আরেকটা, এবং আকাশের অন্য অংশটা পৃথিবী থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেই একাকীত্ব ভুলবার জন্য নর্থ ব্লক আর সাউথ ব্লকের মাঝখানে সত্তর মিলিমিটার পর্দার সঙ্গে তুলনীয় অন্তরীক্ষের চৌকো ফালিটা বিকেল হলেই ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা বুকের রক্তে ভেজানো গাঢ় রঙের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী লাগিয়ে দিত। ইস্টম্যান কালারের বালতিতে চুবিয়ে তোলা এই ফিল্মগুলোর নাম বা মানে না থাকলেও, কিছু বাঁধা দর্শক ছিল।

    বোটক্লাবের দুদিকে রাজপথ থেকে রায়সীনা হিলের উপর নাম না জানা চলচ্চিত্রের পর্দার দিকে তাকালে অন্তত গোটা ষোলো বড়ো ও মাঝারি আকারের গম্বুজওয়ালা বাড়ি নজরে পড়ত। বাড়িগুলোর নতুন সব নাম হয়েছিল – কৃষি, শাস্ত্রী, উদ্যোগ, নির্মাণ, রেল ইত্যাদি। বিকেলবেলা তারা নিজেদের পেট থেকে এক ঝাঁক ডানাছাঁটা হাঁসের মতো ডোডো পাখি উগরে দিত বোট ক্লাবের সামনে। লেকের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটাকে তখন সবাই রফি আহমেদ কিদওয়াই মার্গ (বা সংক্ষেপে রফি মার্গ) বলে চিনলেও, শহরের পুরোনো বাসিন্দারা কেউ কেউ জানত যে জন্মের সময় তার বাবা-মা আদর করে নাম দিয়েছিল ওল্ড মিলস্‌ রোড।

    রফি মার্গে একসঙ্গে বেরিয়ে আসা এই ঝাঁকবাঁধা শহরের ডোডোদের বলা হত ক্লর্ক্‌ আর ক্লর্কন্‌। বোটক্লাবের ধারে কাঠের বেড়ায় হেলান দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় রায়সীনা হিলের উপরের সেই চৌকো আকাশটার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা ছিল ক্লর্ক্‌ আর ক্লর্কন্‌দের একটা প্রধান অবসর বিনোদন।

    বিনোদনের ফাঁকে ফাঁকে শীতের কোনো সাধারণ বিকেলে ক্লর্কন্‌দের ঝাঁকগুলোকে বোটক্লাবের কাছে দাঁড়ানো লংড়া চাটওয়ালার চাটের ঠেলার পাশেও জটলা করে কিচিরমিচির করতে দেখা যেত। সবাই জানত সেই কাঠের ঠেলার উপর পেয়ারা, কলা, শশা, কামরাঙা আর পোড়া রাঙালুর স্তূপের ধারে সবসময় একটা রেডিও বসানো থাকে। টেলিফুঙ্কেন কোম্পানির কুড়ি মেগাহার্ৎজ সিক্স ব্যাণ্ড শর্টওয়েভ রেডিওটার ছিল সবচেয়ে দারুণ একটা নাম। সে নামটা হল মল্‌হার।


    *****

    বীটিং দা রিট্রীটের রিহার্সাল চলাকালীন এরকম কোনো শীতের দিনে বিকেল চারটে কি সাড়ে চারটে নাগাদ, বোটক্লাবের ক্লর্কন্‌দের জটলা ছেড়ে একটা পাখি লাফাতে লাফাতে চলে এসেছিল লংড়া চাটওয়ালার ঠেলার কাছে। লেকের হাঁসগুলো তখন ডানা ফড়ফড় করে জলের উপর কোনো ভালো জায়গা খুঁজে প্যারেড দেখার জন্য তৈরি হচ্ছে। রফি মার্গের উপর দিয়ে তরতর করে চলেছিল বাস আর দুচাকার গাড়ির মিছিল। প্রাক্‌গোধূলির হলুদ পানীয়ের মতো উষ্ণ তরলতায় ডুবে সরকারি দফ্‌তরের জেল ভেঙে পালানো যুবকরা কথা বলছিল ক্রিকেটের বিষয়ে কিন্তু আসলে খুঁজছিল তাদের লাইফ-পার্টনার, যুবতীরা চাইছিল ঘড়ির কাঁটা থামিয়ে দিতে যাতে তাদের বাড়ি ফেরার সময়টা না ফুরোয়, আর প্রৌঢ়রা বাসস্টপ ছেড়ে হাঁটতে শুরু করেছিল আরো কিছুক্ষণ ফুটপাথের পাশের লাল সুরকি বা মোরামের জমিতে নিজের ক্ষয়ে যাওয়া চটির শব্দ শুনবে বলে।

    অর্থাৎ একটা সাধারণ শহরের সাধারণ ঘন্টা।

    নীল সালোয়ার কামিজের উপর সাদা কার্ডিগান পরা ক্লর্কন্‌ পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে বলছিল – কেমন আছ, লংড়াজী? আমাকে দুটো করমল চাট ফটাফট বানিয়ে দিতে পারবে?

    লংড়া টাকাটা ফটাফট ঠেলার উপরে পাতা ছালার আচ্ছাদনের নিচে চালান করে দিয়ে বলে – আপনার দোয়ায় সব ভালো, ম্যাডমজী। চাটও আপনার হাতে এসে গেছে ধরে নিন। শুধু দাঁড়াতে হবে একটু।

    - সেরকম বোলো না, লংড়াজী। দাঁড়াতে হবে কেন? দাঁড়াবার টাইম নেই বলেই তো ফটাফট চাইলাম।

    লংড়ার কাঁধের নিচে হাতের বদলে দুটো রেলগাড়ির ক্র্যাঙ্ক শ্যাফট লাগানো। সেই শ্যাফ্‌টদুটো দিয়ে সে শালপাতার দোনায় পেয়ারা এবং কামরাঙার টুকরোগুলোকে বন বন করে লাট্টুর মতো ঘোরায়। দোনা থেকে চোখ না তুলে সে বলেছিল – এই জ্যান্টলম্যানের অর্ডার শেষ করেই আপনারটা ধরব। ইনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছেন।

    নীল সালোয়ার কামিজ তখন একটু আহত গলায় বলে – লংড়াজী, আমি কি আগে কখনো লাইন ভেঙেছি? আজকে একটা স্পেশাল দিন সেটা বুঝতেই পারছ। ফাইটার প্লেনের ফ্লাই পাস্ট হবে এক্ষুনি। তার আগে হিলের উপর পৌঁছোতে চাই। দেখছ তো আমার দলটা বেরিয়ে যাচ্ছে?

    - কী করা যাবে, বাবুজীর অর্ডার যে আগে এসে গেছে।

    উফ্‌ফ্‌। কে বাবুজী? এবার একটু বিরক্ত হয়ে ক্লর্কনের কাজলহীন বাদামি চোখদুটো এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবুজীকে খুঁজছিল। ঠেলা থেকে দশ পা দূরে ক্লর্ক্‌দের একটা ছোট দল বোটক্লাবের বাঁশের বেড়ার উপর একটা করে পা তুলে দিয়েছে যেন সিঙ্ক্রোনাইজ করা তিনটে কুকুরের মতো তারা একসঙ্গে হিসি করে দেখাবে। দাঁড়ানো অবস্থাতেই তাদের হাতে তিন-পাত্তার খোলা তাশ। কেউ পরেছে মেশিনে বোনা সোয়েটার, কারো চোখে রোদ চশমা, কারো পায়ে এই শীতের বিকেলেও বুটের বদলে স্যাণ্ডেল আর মোজা। এর মধ্যে কে বাবুজী? কে জানে ক-ডজন চাটের অর্ডার তার?

    লংড়াকে আবার খোঁচাল ক্লর্কন্‌। - তোমার বাবুজীকে গিয়ে বলো একটু অপেক্ষা করতে আর আমারটা আগে করে দাও। পাঁচ মিনিট পরে পেলে কি তার রম্মির হাত খারাপ হয়ে যাবে?

    লংড়া এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল - এই ছোটু, যা গিয়ে বাবুজীকে খুব পেয়ার সে জিজ্ঞেস করে আয় এই ম্যাডমজীকে আগে দিয়ে দিলে কোনো অসুবিধে আছে?

    *****

    লংড়ার হাঁক শুনে বছর দশেকের ফুটফাট কাজ সারার ছেলেটা ছুটে গিয়ে যাকে ধরেছিল সে তিনপাত্তার দল থেকে একটু দূরে বাঁশের বেড়ার উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে। লোকটার পরনে গ্যাবার্ডিনের গ্রে স্যুট আর কালো চামড়ার জুতো। অন্যদের তুলনায় একটু বেশি শৌখীন, যেন কোনো নবাবের ছেলে বাড়িতে ঝগড়া করে ক্লর্ক্‌ হয়ে গেছে। ক্লর্কন্‌ আগেও লোকটাকে দূরে দাঁড়িয়ে একা ম্যাগাজিন বা পকেট বই পড়তে অনেকবার দেখেছে। ওদের চার্টার করা বাসটা আসবে সবার পরে। এত আগে এসে লোকটা কেন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে কে জানে। আন্দাজ করা যেতে পারে তার সংসারের দায়িত্ব নেই এবং হাতে অঢেল সময়। ছোটুর কথা শুনে সেই শৌখীন ক্লর্ক একবার চোখ তুলে তাকাল এবং নীল সালোয়ার পরা ক্লর্কন্‌কে তার দিকে অসন্তুষ্টভাবে চেয়ে থাকতে দেখল। ক্লর্ক্‌ ছোটুকে বলল – লংড়াকে তো বলিনি আমার এক্ষুনি চাই। যখন ইচ্ছে বানাতে পারে। হয়ে গেলে শুধু যেন একটা খবর পাঠিয়ে দেয়।

    ছোটুর কাছে এই খবরটা পাওয়ার পর নিশ্চিন্ত হয়ে ক্লর্কন্‌ বলেছিল – বাবুজীটাকে দেখতে যেমনই হোক, বুদ্ধি আছে। তুই যখন আবার তার কাছে যাবি তখন কী বলবি বল তো? এই বলে ক্লর্কন্‌ ছোটুর কানে ফিসফিস করে একটা কিছু বলে দেয়।

    শুনতে শুনতে ছোটুর চোখমুখ আনন্দে আর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিল। পরে এক গাল হেসে সে বলে – এটা বলবার জন্য তো আমি পয়সাও নেব না!

    তো এইভাবে লংড়া ক্লর্কনের অর্ডারে লেগে যায়, ক্লর্কন্‌ চুপ করে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখতে থাকে, আর ছোটুর হাতে কোনো কাজ ছিল না বলে সে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে গ্যাবার্ডিনের স্যুট পরা বাবুজীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, যে তখন হাতের ম্যাগাজিন বন্ধ করে আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ছোটু জানত প্লেনগুলো আসতে অনেক দেরি, সে বাবুজীর মতো আকাশের দিকে মুখ তুলে নর্থ আর সাউথ ব্লকের মাঝখানের নাম না জানা চলচ্চিত্রের পর্দাটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে, মানে নিজের সম্ভাব্য সুদূর ভবিষ্যতের একটা চেহারাকে দেখতে পেল। পর্দার উপর সেই চেহারাটা কখনো সৈনিকের বেশে আসে। কখনো মেকানিক। আজ সেটা ক্লর্কের রূপ ধরে এসেছিল। বাবুজীর মতো তার হাতেও ছিল একটা ফিল্মী ম্যাগাজিন।

    ছোটু জানত আকাশের এই টুকরোটার দিকে তাকানো নিষিদ্ধ। সে আড়চোখে একবার লংড়াকে দেখে নেয়। দূর থেকে লংড়া মাথা নাড়াচ্ছিল আর মনে মনে বলছিল – ছোটু, তোকে বাঁচানো গেল না। আকাশের বেকার শো-গুলো দেখা শিখে গেলি এই বয়সেই?

    তার মনিবের মনে কী আছে ছোটু বুঝেছিল, কারণ লংড়া চিরকাল দাঁড়াত রাইসীনা হিলের দিকে পিছন ফিরে। ছোটু শুনেছিল বহুদিন আগে আকাশের পর্দা থেকে একটা মর্তমান কলার মতো মোটা আঙুল এসে লংড়ার পিঠে টক টক করে টোকা দিয়ে বলে – এই লংড়া, তোর ভবিষ্যতের শো শেষ হয়ে যাচ্ছে, ফালতু কাজ ছেড়ে এবার উলটোদিকে ঘোর। লংড়া নেউলার চেয়ে চুস্তী সে ঘুরে তার কাস্তের মতো বাঁকানো সরু ছুরিটার এক কোপে আকাশ থেকে আসা সেই কলাগাছমার্কা হাতের পাঁচটা আঙুল এক কাঁদি কলার মতো গোড়া থেকে আলাদা করে দেয়। কেউ কোত্থাও ছিল না। শুধু রফি মার্গ ধরে স্কুটারে করে যাওয়া দুটো লোক লংড়াকে দেখে ফেলে। বোটক্লাবের অসম্ভব সুন্দর সন্ধ্যেবেলায় সেই অনৈসর্গিক দৃশ্য দেখার পর পুরোনো স্কুটারে ফুল স্পীড তুলে তারা বাছুরের মতো ডাক ছাড়তে ছাড়তে পালিয়েছিল।

    সেদিন কিন্তু ছোটু লংড়াকে উপেক্ষা করে এক ছুটে গ্যাবার্ডিনের স্যুট পরা বাবুজীর কাছে চলে আসে। বাবুজীকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাইছিল সে।

    *****
    *

    ছোটুর প্রশ্নটা প্রথমে গ্যাবার্ডিনের স্যুট ঠিক বুঝতে পারেনি। সে একটু অবাক হয়ে বলে – ছোটু তুই আমার মতো হবি? এইরকম স্যুট পরবি তুই?

    - হ্যাঁ বাবুজী। কী করতে হবে তার জন্য?

    - আমার মতো হতে চাইলে কী করতে হবে? হুম্‌ম্‌। চিন্তায় পড়ে যায় গ্যাবার্ডিনের স্যুট। - প্রথমত এই পত্রিকাটার মতো দেখতে সবকটা ফিলিমের পত্রিকা পড়তে হবে। দ্বিতীয়ত চুল-কে যে ক্রীমটা দিবি, সেটাই বুটকেও দিতে হবে। কারণ এর অন্যথা হলে তোর মাথা বা পা, কেউ তোর উপর খুশি থাকবে না, আর আমার মতো হবার আশা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু ছোটু, তুই আমার মতো হতে চাইছিস কেন? তার চেয়ে ওই দুর্দান্ত উর্দিওয়ালা ট্র্যাফিক পুলিশের মতো হবি না কেন? ওদের সরকারি দফ্‌তরের গুহায় ঢুকতে হয় না। আর সারাদিন চোখ বুজে ঘুমোতে ঘুমোতেই নিজের কাজ করে যেতে পারে।

    তখন ছোটু বলতে গিয়েছিল – যেই আমি বোটক্লাবের বেড়াতে হেলান দিয়ে…। বাকিটা তার বলা হয়নি। গ্যাবার্ডিনের স্যুট পরা ক্লর্ক্‌ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে – বুঝে গেছি, বুঝে গেছি, ছোটু। তুই নিজের ফিলম দেখে ফেলেছিস। একটা কথা মনে রাখিস। ওই ফিলমে যা দেখায় তা সবসময় সত্যি নয়। পরে ছোট ছোট করে লেখা আসে – চরিত্রগুলো কাল্পনিক। সবাই ক্ষুদে ক্ষুদে লেখাগুলো না পড়েই বাড়ি চলে যায় কিনা, তাই ভাবে সত্যি।

    কৃতজ্ঞতায় ছোটু তার কোমরে গোঁজা কাপড় দিয়ে বাবুজীর জুতো মুছে দিয়েছিল। জুতো মুছতে মুছতে তার মনে পড়ে কামিজ পরা ম্যাডমজীও গ্যাবার্ডিনের স্যুটকে কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! কানে কানে যে কথাটা ম্যাডমজী ছোটুকে বলেছিল, সেটা ম্যাডমজীর গায়ের গন্ধ থেকে দূরে যাওয়া মাত্র ছোটুর মাথা থেকে উবে গেছে। কিছুতেই আর মনে করতে পারল না ছোটু।

    *****

    - ম্যাডমজী আমাকে কিছু বলতে চেয়েছে? তুই ঠিক জানিস? বাবুজী ছোটুকে জিজ্ঞেস করেছিল।

    - ঠিক। বলে ছোটু।

    - কথাটা কী?

    – আমি কী করে জানব? আমি শুধু জানি একটা কিছু বলতে চায়। তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে নাও না?

    একটু পরে নীল সালোয়ার আর কামিজ পরা ক্লর্কন্‌ দেখতে পেল গ্যাবার্ডিনের স্যুট আর চামড়ার বুট পরা শৌখীন বাবুজী বেড়াতে বেড়াতে তাদের দিকেই আসছে।

    দুজনের চোখাচোখি হল কিন্তু তাদের ডোডোপাখির মতো নিষ্পাপ মনদুটো আকাশে ওড়েনি কারণ ডোডোরা আকাশে উড়তে পারে না। তারা মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশটাকে ভালোবেসে ফেলে। খুবই ঢিমে চালে গ্রে স্যুট এগোচ্ছিল। এতই সময় লেগেছিল তার ওইটুকু পথ অতিক্রম করতে যে ততক্ষণে উলটো দিকে দিয়ে আসা গোলাপি সোয়েটার পরা একটা ছোটখাটো লোক, আরেকটা ক্লর্ক্‌ই হবে, তার পথ আটকে দিয়েছে।

    - জে-কে!! জে-এ-এ-এ- কে-এ-এ-এ-এ!!! তুই এখানে! আমি তো ভাবতাম শহর ছেড়ে গায়েব হয়ে গেছিস! তোর বাড়ি কোথায়? চিনতে পেরেছিস তো আমাকে? উচ্চগ্রামে চিৎকার করতে করতে গোলাপি সোয়েটার অকস্মাৎ গ্যাবার্ডিনের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে পিছিয়ে দিতে থাকে।

    অ। শৌখীন বাবুজী, তোমার নাম হল জে-কে। মনে মনে ভাবছিল ক্লর্কন্‌। জে-কে ফর জসবিন্দর কুমার? জিতেন কপুর? না কি জাভেদ কিদওয়াই? জয়রামন কৃষ্ণন হতে পারে অবশ্য। জেকব কুরিয়েন কেন নয়? জিতেন্দ্র কানুনগো? যাই হোক না কেন, বাঁচা গেছে এই গোলাপি সোয়েটার এসে তোমাকে থামিয়ে দিয়েছে, নইলে নিশ্চয়ই ঝগড়া করে আমার আগে নিজের চাটটা ডেলিভারি নিতে।

    জে-কে নামের সেই স্যুটবাজ ক্লর্ক্‌ একটু লজ্জায় পড়ে গেছে। সে কথা বলছে নিচু গলায়, দূর থেকে শোনা যায় না। হাতের ফিল্মী ম্যাগাজিনটাও পাকিয়ে পিঠের পিছনে লুকোবার চেষ্টা করছিল। ক্লর্কনের দিকে একবার চট করে তাকিয়ে নিয়ে সে নিজের বন্ধুর দিকে ফিরে কিছু একটা বলল।

    - রাবিশ, রাবিশ, রাবিশ। জে-কে, আজ তোকে আমি ছাড়ব না।

    গোলাপি সোয়েটারের মাথার উপর দিয়ে ক্লর্ক্‌ আবার ক্লর্কনের দিকে অসহায়ভাবে তাকায়। ক্লর্কন্‌ সেদিকে চোখ রেখে লংড়াকে বলল – কতক্ষণ লাগবে লংড়াজী?

    - এই তো হয়ে গেছে।

    - তাড়াহুড়ো করে নষ্ট করে দিও না। ভালো করে বানাও।

    - তাড়াতাড়ি বানাব না?

    - না, না। তাড়াতাড়িই বানাও। কিন্তু বেশি তাড়াতাড়ি করতে যেও না।

    - ও, তাহলে রেডিওটা চালাই।

    *****

    এরকম একটা সময়ে মল্‌হার বলে সেই টেলিফুঙ্কেনের রেডিওতে একটা গানের প্রোগ্রাম চালু হয়। কড়ে আঙুলের ছোঁয়ায় লংড়া রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিয়েছিল। পুরোনো রেডিওতে একটা কিছু গণ্ডগোল আছে কারণ ধৈবত লাগলেই স্টীল আর ব্যাকেলাইটের বডি প্যাঁ প্যাঁ করে সানাইয়ের মতো বেজে উঠছে। রহস্যময় কারণে এই ফাটা রেডিওর আওয়াজ ক্লর্কন্‌কে অসম্ভব টানে। যেন সেই প্যাঁ প্যাঁ শব্দের মধ্যে দিয়ে রেডিওটা কথা বলতে চায়। ক্লর্কন্‌ সেদিনের প্রথম গানটা মন দিয়ে শুনবার চেষ্টা করেছিল –

       তুম্‌নে পুকারা অওর হম্‌ চলে আয়ে,
          দিল হথেলী পর লে আয়ে রে…

    জে-কেও কান খাড়া করে গান শুনছে নিশ্চয়ই! ক্লর্কন্‌ আরেকবার ওদিকে তাকিয়ে দেখল জে-কেকে গোলাপি সোয়েটার হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর জে-কে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করেও ভদ্রতার খাতিরে গায়ের জোর লাগাতে পারছে না।

    ক্লর্কনের চোখের সামনে গোলাপি সোয়েটারের ধাক্কায় জে-কে সরতে সরতে ফুটপাথের ধারে দাঁড়ানো একটা থ্রি হুইলারে উঠতে বাধ্য হয়েছিল। যে কাজটার জন্য বেচারা লংড়ার ঠেলার দিকে আসছিল তার আশা ছেড়ে দিয়ে সে শেষবারের মতো সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। যেন কোথাও থেকে বড়ো দাদা বা দিদি এসে তাকে বাঁচাবে। অতিষ্ঠ হয়ে ক্লর্কন্‌ লংড়াকে বলল – লংড়াজী, আপনার বাবুজী কিন্তু নিজের চাট খেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কেউ একটা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

    লংড়া দুটো বড়ো সাইজের দোনা ক্লর্কনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এরকম হয়। হাতের চাট ফসকে যায়। কিন্তু ভয় নেই, লংড়ার কাছে পয়সা মারা যাবে না। চাট উনি কাল পেয়ে যাবেন।

    ক্লর্কন্‌ দোনা দুটো তুলে নিয়ে যেতে যেতে লংড়াকে বলেছিল – লংড়াজী, কাল বলে কিছু হয় না। যা করার আজ। এই রেডিওটা তুমি হাথ-কে-হাথ আমায় বেচে দাও।

    - এটা একটা ভাঙা রেডিও। আপনি কেন কিনবেন?

    ক্লর্কন্‌ মনে মনে বলল কারণ এই রেডিও যখন প্যাঁ প্যাঁ করে বেজে ওঠে তখন সে আমাকে আকাশের পর্দায় দেখানো সিনেমাগুলোর ডায়লগ শুনিয়ে দেয়। কার মনে কী আছে কখনো কখনো সেটাও বলে ফেলে। আমার নাম ধরে কথা বলে রেডিওটা, যেন কতদিনকার চেনা। আর যে গানগুলো শোনায়, সেগুলোও পরিস্থিতি বুঝে নিজেই পছন্দ করে।

    - ভাঙা হলেও এর আওয়াজে একটা জাদু আছে। সবাই সেটা বুঝতে পারে না।

    - ম্যাডমজী, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রেডিও শুনুন তাহলে। অনেকে সেইজন্যই আসে। পাহাড়ের উপর উঠে কী হবে? ফাইটার জেট এখান থেকেই দেখা যায়।

    - আজ আমার সঙ্গে বন্ধুরা আছে। কাল বলে যদি কিছু থাকে তো রেডিও আবার শুনতে পাওয়া যাবে, তাই না?

    *****

    কয়েকটা মাস কেটে গিয়েছিল এর পর। এই শহরে বসন্ত আসতে দেরি লাগাত না। শীতের ঝরা পাতাগুলো রাস্তা থেকে ঝেঁটিয়ে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা হত রোজ। নতুন পাতা আসা শুরু হত তার অল্পদিনের মধ্যে। কুয়াশায় ভারী হয়ে জমে থাকা পোড়া পাতার গন্ধ জামাকাপড় থেকে মুছে ফেলে ক্লর্ক্‌ আর ক্লর্কন্‌রা যখন সকালবেলা বাস থেকে নামত তখন তাদের চলাফেরার মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা দিত। সোয়েটার ছেড়ে দিয়ে ক্লর্কন্‌রা পরত হলুদ কিম্বা গোলাপি রঙের সুতির পোষাক। ওড়নাগুলো টাইট করে পেঁচিয়ে নিত মাথায়। ক্লর্ক্‌রা শার্টের উপরের একটা বোতাম খুলে দিয়ে হাঁটত ফুরফুরে হাওয়ায়। কারো গলায় সোনার চেন থাকলে সেটা দেখা যেত এই মরসুমে।

    সবাই তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে পড়ছে। ক্লর্কন্‌ লংড়ার ঠেলার পাশে দাঁড়িয়ে নামহীন আকাশের টুকরোটায় কখন তার নিজস্ব শো শুরু হবে ভাবছিল। মল্‌হারে এই গানটা বাজছিল –

       চমন-ওয়ালোঁ সম্ভল্‌ যাও, কে আয়ে দিন বহার কে
       (ফুলের বাগান হও সাবধান, কারণ এসেছে বসন্তের দিন)

    দেখা গেল শৌখীন ক্লর্ক্‌ জে-কে, তার গ্যাবার্ডিনের স্যুট ছেড়ে সাদা শার্টের উপর সুতি আর স্যাটিনের ওয়েস্টকোট পরে ঢিলেঢালাভাবে আসছে। তার পিছনে ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে দুলকি চালে চলেছে একটা বাদামি রঙের দো-আঁশলা কুকুর। কুকুরের পিছনে ছোটুর মতো একটা ন-দশ বছরের ছেলে। একটু দূরে নিজের দুই সঙ্গীকে দাঁড় করিয়ে জে-কে লংড়ার দিকে এগিয়ে এল।

    কুকুরটা ক্লর্কনের পছন্দ না হওয়ায় তার চোখদুটো বেড়ালের মতো সরু হয়ে গিয়েছিল। সে আকাশের স্ক্রিনের দিকে মন দেবার চেষ্টা করছে। জে-কে লংড়ার কাছে এসে বলল – লংড়া, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাকে বাঁচাও।

    লংড়া খুব একটা বিচলিত না হয়ে কামরাঙা ফালি করতে করতে বলল – বউ পালিয়ে গেছে?

    - আমার বউ কোথায়? কার সাথে আমায় গুলিয়ে ফেলছ?

    - তো ছেলেটাকে দফ্‌তরে নিয়ে এসেছেন কেন?

    - সেটাই তো বলছি। ছেলেটা আমার এক আত্মীয়ের। বাবা-মা’র সঙ্গে গ্রাম থেকে এসেছিল শনিবার। কাল রাতে ওর বাবা-মা বলেছিল ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে যেতে চায়, আমি যেন স্কুলে ভর্তি করে দিই। হ্যাঁ না কিছু বলিনি। আজ সকালে উঠে দেখি দুটো পাখিই গায়েব। মালপত্রও নেই। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে, আর তার একটা স্যুটকেস পড়ে আছে।

    লংড়ার চাকু থেমে গিয়েছিল। - এ কী ধরনের মা-বাপ? সৎ ছেলে নাকি?

    - আমি তো ওদের নিজের ছেলে বলেই জানি।

    - ছেলেটা কী বলে? ও জানে ওর মা-বাপ কী করেছে ওর সাথে?

    - সে খুব একটা চিন্তিত নয়। বলছে বাবা-মা’র ভুলো মন। ওকে প্রায়ই এদিক ওদিক ফেলে চলে যায়। পরে মনে পড়লে নিতেও আসে।

    লংড়া এই শহরে এসে যা দেখছে, আগে জীবনে কোনোদিন দেখেনি। রোজই তাজ্জব হওয়ার মতো কিছু না কিছু হয়। মাথা চুলকে সে বলল – স্যরজী, ছেলেটা চালাক আছে মনে হচ্ছে। আরেকটা এরকম কেস দেখেছিলাম আগে। অবশ্য তার বয়স আরেকটু বেশি ছিল।

    - কী করেছিল তাকে নিয়ে?

    - কিছু টাকাকড়ি পকেটে ঢুকিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। নিজেই গ্রামে চলে যায়।

    - এটা তো দারুণ আইডিয়া! তাই করা যাক তাহলে। কিন্তু কুকুরটাকে নিয়ে কী করি? কাল সন্ধ্যেবেলা পাড়ায় কার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। এখন সেও ফিরে যাচ্ছে না।

    - তাহলে ওটাকেও সঙ্গে দিয়ে দিন। একা ছাড়ার চেয়ে ভালো। দুজনে দুজনকে দেখবে।

    জে-কে একটু বিবেচনা করে। - লংড়া, একটা প্রবলেম আছে। এর বাবা-মা নিজেদের বাড়িতে ফিরেছে কিনা সন্দেহ। কথা হচ্ছিল রাজস্থানে বেড়াতে যাবার। ছেলেটা যদি বাড়িতে ফিরে দেখে দরজায় তালা? তোমার চেনাজানা কেউ নেই যে একটা ছেলে চায়? কুকুরটাকে আমি রাখতে পারব, যদি পাড়ার কেউ ফেরত নিতে আসে।

    লংড়া এদিক ওদিক চাইল। ক্লর্কন্‌ কাছেই দাঁড়িয়ে আড়চোখে একটা বিষের দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল।

    লংড়া বলল – স্যরজী, তাহলে ছেলেটাকেও কয়েকদিন রাখুন। আমি খোঁজখবর নিই। এখন একটা চাট নিয়ে যান। মাথা ঠাণ্ডা করে ওকে খাওয়ান, নিজেও খান।

    - ওকেই করে দাও। সকাল থেকে আমার খিদে নেই।

    জে-কে আবার দূরে গিয়ে বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আজ তার হাতে কোনো বই বা ম্যাগাজিন দেখা যাচ্ছে না। দাড়িও কামায়নি। মলহার্‌ শোনাচ্ছিল – হমীঁ দুশমন না বন যায়েঁ, কহীঁ অপনে করার কে (নিজেই দুশমন হয়ে না যাই, নিজের মনের প্রশান্তির)। ক্লর্কন্‌ লংড়ার কাছে সরে এসে বলল – লংড়াজী, ছি-ছি। কাজটা একদম ঠিক করছ না তোমরা। এইভাবে একটা বাচ্চাকে কেউ ট্রেনে তুলে দেয়?

    - ঠিক বলেছেন। লংড়া অভিযোগটা মেনে নেয় অমনি। - আপনি কী বলেন, ম্যাডমজী। কী করা উচিত?

    - নিজের বাবা-মা’র কাছে রেখে আসে না কেন? কেউ তো আছে ফ্যামিলিতে।

    - তিন কুলে কেউ নেই। বাবা-মা তো ছিলই না। নানার কাছে বড়ো হয়েছে। ইলেক্ট্রিকের দোকান ছিল তাঁর, সেখান থেকেই এই পুরোনো রেডিওটা পেয়েছিলাম। তো সেই নানাও গুজরে গেছেন গত বছর। আচ্ছা, আপনি হলে কী করতেন?

    - প্রথমত যার বাচ্চা তার বাড়িতে নিজে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসতাম।

    - আর যদি গিয়ে দেখেন তাদের বাড়িতে তালা?

    - তাহলে ফিরিয়ে এনে আবার পরে যেতাম। ততদিন একটা চেনা পরিবারকে রাখতে দিতাম। অথবা নিজেই মানুষ করতাম। শরীফ লোকেরা এছাড়া আর কী করবে?

    - তাই বলব আমি বাবুজীকে। আপনি নিজে নিতে চাইলে নিয়ে নিন না? বাচ্চাটা ভালোই। বেশি কথা বলে না। কিছুদিন রাখুন। ভালো লাগলে রেখে দিন, নইলে বাবুজী ফেরত নিয়ে নেবেন।

    - বেশি কথা তুমি বোলো না, লংড়াজী। আমি তোমাকে বুঝদার মানুষ ভাবি। পারলে এই ক্লর্ক্‌টাকে বোঝাও, জল্লাদের মতো ব্যবহার না করতে। এরকম একটা সুন্দর দিনে কেউ ওরকম খারাপ কথা ভাবতে পারে? তুমিই বা কোন আক্কেলে এইসব জঘন্য প্ল্যান দাও? ফল কাটো, না বকরা? কসাই নাকি?

    *****

    দুচারদিন পরের কথা। বিকেল হলে এখন আর্মির রেজিমেন্টের বদলে মোঘল গার্ডেন্‌সের গোলাপ আর চামেলির গন্ধ রায়সীনা হিলের গা বেয়ে মার্চ করে আসে। ক্লর্কন্‌ দেখল জে-কে আবার ম্যাগাজিন হাতে একা এসে হাজির। লংড়াকে দেখে সে হন্‌হনিয়ে আসছিল। ক্লর্কন্‌ একটু সরে দাঁড়াল, কিন্তু বেশি দূরে যেতে পারল না, কারণ মল্‌হার প্যাঁ-প্যাঁ করে বেজে উঠে ক্লর্কন্‌কে বলেছিল – কাছেই থাকো, একটা ভালো গান আর কিছু মজার খবর শোনাব তোমায়। এবং সত্যিই ক্লর্কনের প্রিয় এই গানটা সে চালু করে দেয় - ইয়ারী হো গয়ী ইয়ার সে লক টুনুটুনু…।

    জে-কে এসে চাটের ঠেলার কাছে দাঁড়াল। লংড়াকে মৃদু গলায় সে যা বলছিল সবই রেডিওটা প্যাঁ প্যাঁ করে ক্লর্কনের কানে পৌঁছে দিচ্ছে। জে-কে বলল - লংড়া, আজ আমার মনে টুনটুন করে বাজনা বাজছে। লক্কি ডে আমার। লক্কি ডে।

    লংড়া শুধায় – এত লক্কি হলেন কী করে? ছেলেটা পালিয়েছে নাকি?

    - বাড়িতে এসে নিয়ে গেছে! ওই যে কুকুরটা দেখেছিলে? সেটা ছিল পাশের পাড়ার এক ডাক্তার আর ডাক্তারনীর। কোনো ছেলেপুলে নেই। কুকুরটাই সব। তো সে কুকুর আমাদের ছেলেটাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না। আমি বললাম – লগে হাথোঁ এই ছেলেটাকেও নিয়ে যান, নইলে আপনাদের কুকুর দুঃখের চোটে না খেয়ে মরে যাবে।

    - বলা মাত্র নিয়ে গেল?

    - ঠিক অত সোজা হয়নি। বলল – আসল বাবা-মা এসে যদি ছেলেটাকে ফেরত চায় তো আমরা কী করব? আমি বললাম – সেরকম কিছু যদি হয় তো আমি আপনাদের আরেকটা ছেলে এনে দেব।

    - এ আপনি কী বললেন, স্যরজী? ছেলে কোত্থেকে পাবেন? চুরি করবেন নাকি?

    - না, না। চুরি করব কেন? আমি ভেবেছিলাম তার বদলে তখন কিছু পয়সা দিয়ে মাফ চেয়ে নেব। কিন্তু ওরা কাগজে লিখিয়ে নিয়েছে আমার নিজের ছেলেপুলে কিছু হলে ওদের একটা দিতে হবে। এই বলে জে-কে হো হো করে হাসতে থাকে।

    লংড়া ফল কাটায় নজর দিল। - আর যদি এই ছোকরা পালিয়ে যায় আর ওরা আপনার ছেলে হবার অপেক্ষায় বসে থাকে?

    ক্লর্ক্‌ সেটা শুনে হাসতেই থাকল। - সারাজীবন কেটে যাবে অপেক্ষায়। আমার দুই দিদির কোনো অওলাদ-টওলাদ হয়নি। সবাই আমার কাছে বাচ্চা চেয়ে বসে আছে। আমার হবে কী করে?

    - আপনার হবে না কেন বাবুজী?

    - কারণ, আমার একটা ভাল্ভ খারাপ আছে ভাই। সেটা আজ নয় কাল উড়বে বলে তৈরি।

    লংড়া চাকু চালাতেই চালাতেই অবাক হয়ে তাকায়। - ভাল্ভ তো আমার পুরোনো রেডিওটার খারাপ। আপনি কি রেডিও? আচ্ছা-খাসা লম্বা-চওড়া জওয়ান আদমী।

    ক্লর্ক্‌ লংড়ার ঠেলা থেকে একটা পেয়ারা তুলে দুহাতে সেটাকে ক্রিকেটের বলের মতো পালিশ করছিল। কয়েকবার হাওয়ায় লুফে নেবার পর দাঁত বসিয়ে সেটাকে খেতেও শুরু করে। পেয়ারাটা চিবোতে চিবোতে সে বলল – তোমার রেডিওতে কোনো ভাল্ভ নেই, লংড়া। ছটা সলিড-স্টেট ট্রান্‌জিস্টার আছে। সেগুলো খারাপ হলে আমি পালটাতেও জানি। কিন্তু আমাদের দিলের চারটে টায়ারে চারটে ভাল্ভই থাকে। তার একটাও খারাপ হলে কেউ পালটাতে জানে না। আগে রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলতে যেতাম, ভাল্ভটার জন্য সব ছাড়তে হয়েছে। এখন শুধু বই পড়ি, আর গান শুনি। সবাই জেনে গেছে আমি দু-দিন কা মেহমান। অফিসে খটারা জে-কে বলে কি এমনি এমনি ডাকে? তোমার রেডিও আমার চেয়ে ঢের বেশিদিন চলবে, লংড়া-মাস্টর।

    মল্‌হার তার দীর্ঘু আয়ুর ভবিষ্যদ্‌বাণী শুনে নিশ্চয়ই বেশ খুশি হয়েছিল, কারণ দাঁড়ানো সবাইকে সে এই গানটা শুনিয়ে দেয়।

       সরে রাহ চলতে চলতে, মুঝে কোই মিল গয়া থা…
       যো কহী গঈ না মুঝসে, উয়ো জমানা কহ রহা হ্যায়
       কে ফসানা বন গঈ হ্যায় …
       মেরী বাত…
       চলতে চলতে…


    পর্ব ১             পর্ব ২


    অলংকরণ (Artwork) : পরবাস ডিজিটাল আর্ট
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments