পুরোনো শহরের ছিল পুরোনো, অর্থহীন কোনো নাম। তার মাঝখান দিয়ে আরাবল্লীর যে শিরাটা দক্ষিণের উঁচু টিলায় গিয়ে ধাক্কা খেয়ে থামত সেটাকে বলত রিজ। মালচা, কুশক, মোতিবাগ, জোরবাগ, তালকটোরা ইত্যাদি একশোর উপর গ্রাম ছিল সেই টিলার আশেপাশে। গ্রাম নেই, তবু নামগুলো আজও শোনা যায়। টিলার চূড়াটা পড়ত রায়সীনা গ্রামে, যেখানে ডায়নামাইট দিয়ে জমি সমতল করার পর ভাইসরয়ের বাড়িটা তৈরি হয়। পরে সেই প্রকাণ্ড বাড়ির নাম হয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবন। তার দুদিকে, কৃত্রিম মালভূমির মেঝেতে দাবার দুটো রুকের মতো বসিয়ে দেওয়া নর্থ আর সাউথ ব্লক নামের সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং দুটোর পরিচয় পালটায়নি। সামনের সুবিশাল চত্বরটাকে ততদিনে বিজয় চওক নামে চিনেছে লোকে। সেখান থেকে শুরু করে ইণ্ডিয়া গেট পর্যন্ত একটা কালো অ্যাসফল্টের ফিতে তাড়াহুড়োতে সঙ্গে নিতে না পেরে রেখে গিয়েছিল ব্রিটিশরা। প্রথমে সেটার নাম ছিল কিংসওয়ে। পরে কিংসওয়ের আক্ষরিক অনুবাদ করে বলা হত রাজপথ। এই ফিতে ধরে ছাব্বিশে জানুয়ারির দিন একটা প্যারেড মার্চ করে উঠে যেত রায়সীনা পাহাড়ে, এবং ফিরে আসত তিনদিন পর, উনত্রিশ তারিখে, যখন তার নাম হয়ে যেত বীটিং দা রিট্রীট।
রাজপথের দুধারে উৎখাত করা গ্রামবাসীদের ভাঙা খাটিয়া আর বাসন-কোসনগুলো চাপা দেবার জন্য যে খালের মতো গর্ত থেকে মাটি চুরি করা হয়, তাতে বৃষ্টির জল জমার পর পাওয়া যায় দুটো লেক বা পুকুর। হারিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর স্মৃতি ভুলবার জন্য বোটক্লাব নাম দিয়ে পরে সেখানে নৌকো ভাসানো চালু হয়েছিল।
শীতকালে অবশ্য বোট বিশেষ চলত না। তখন সেখানে সাঁতার দিত সাইবেরিয়া থেকে পালানো লম্বা গলাওয়ালা রাজহাঁস আর ক্রেন, নভেম্বরের গোড়ায় চলে আসার পর যারা বীটিং দা রিট্রীট না দেখে ফেরার নাম নিত না। হাঁসেরা যখন ডানা গুটিয়ে নামত, তখন তাদের দেখাদেখি আকাশের একটা অংশ বিশ্রাম নেবার জন্য লেকের জলে নেমে আসতে শিখে যায়। এইভাবে একটা ঘটনার সূত্র ধরে ঘটে আরেকটা, এবং আকাশের অন্য অংশটা পৃথিবী থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেই একাকীত্ব ভুলবার জন্য নর্থ ব্লক আর সাউথ ব্লকের মাঝখানে সত্তর মিলিমিটার পর্দার সঙ্গে তুলনীয় অন্তরীক্ষের চৌকো ফালিটা বিকেল হলেই ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা বুকের রক্তে ভেজানো গাঢ় রঙের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী লাগিয়ে দিত। ইস্টম্যান কালারের বালতিতে চুবিয়ে তোলা এই ফিল্মগুলোর নাম বা মানে না থাকলেও, কিছু বাঁধা দর্শক ছিল।
বোটক্লাবের দুদিকে রাজপথ থেকে রায়সীনা হিলের উপর নাম না জানা চলচ্চিত্রের পর্দার দিকে তাকালে অন্তত গোটা ষোলো বড়ো ও মাঝারি আকারের গম্বুজওয়ালা বাড়ি নজরে পড়ত। বাড়িগুলোর নতুন সব নাম হয়েছিল – কৃষি, শাস্ত্রী, উদ্যোগ, নির্মাণ, রেল ইত্যাদি। বিকেলবেলা তারা নিজেদের পেট থেকে এক ঝাঁক ডানাছাঁটা হাঁসের মতো ডোডো পাখি উগরে দিত বোট ক্লাবের সামনে। লেকের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটাকে তখন সবাই রফি আহমেদ কিদওয়াই মার্গ (বা সংক্ষেপে রফি মার্গ) বলে চিনলেও, শহরের পুরোনো বাসিন্দারা কেউ কেউ জানত যে জন্মের সময় তার বাবা-মা আদর করে নাম দিয়েছিল ওল্ড মিলস্ রোড।
রফি মার্গে একসঙ্গে বেরিয়ে আসা এই ঝাঁকবাঁধা শহরের ডোডোদের বলা হত ক্লর্ক্ আর ক্লর্কন্। বোটক্লাবের ধারে কাঠের বেড়ায় হেলান দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় রায়সীনা হিলের উপরের সেই চৌকো আকাশটার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা ছিল ক্লর্ক্ আর ক্লর্কন্দের একটা প্রধান অবসর বিনোদন।
বিনোদনের ফাঁকে ফাঁকে শীতের কোনো সাধারণ বিকেলে ক্লর্কন্দের ঝাঁকগুলোকে বোটক্লাবের কাছে দাঁড়ানো লংড়া চাটওয়ালার চাটের ঠেলার পাশেও জটলা করে কিচিরমিচির করতে দেখা যেত। সবাই জানত সেই কাঠের ঠেলার উপর পেয়ারা, কলা, শশা, কামরাঙা আর পোড়া রাঙালুর স্তূপের ধারে সবসময় একটা রেডিও বসানো থাকে। টেলিফুঙ্কেন কোম্পানির কুড়ি মেগাহার্ৎজ সিক্স ব্যাণ্ড শর্টওয়েভ রেডিওটার ছিল সবচেয়ে দারুণ একটা নাম। সে নামটা হল মল্হার।
বীটিং দা রিট্রীটের রিহার্সাল চলাকালীন এরকম কোনো শীতের দিনে বিকেল চারটে কি সাড়ে চারটে নাগাদ, বোটক্লাবের ক্লর্কন্দের জটলা ছেড়ে একটা পাখি লাফাতে লাফাতে চলে এসেছিল লংড়া চাটওয়ালার ঠেলার কাছে। লেকের হাঁসগুলো তখন ডানা ফড়ফড় করে জলের উপর কোনো ভালো জায়গা খুঁজে প্যারেড দেখার জন্য তৈরি হচ্ছে। রফি মার্গের উপর দিয়ে তরতর করে চলেছিল বাস আর দুচাকার গাড়ির মিছিল। প্রাক্গোধূলির হলুদ পানীয়ের মতো উষ্ণ তরলতায় ডুবে সরকারি দফ্তরের জেল ভেঙে পালানো যুবকরা কথা বলছিল ক্রিকেটের বিষয়ে কিন্তু আসলে খুঁজছিল তাদের লাইফ-পার্টনার, যুবতীরা চাইছিল ঘড়ির কাঁটা থামিয়ে দিতে যাতে তাদের বাড়ি ফেরার সময়টা না ফুরোয়, আর প্রৌঢ়রা বাসস্টপ ছেড়ে হাঁটতে শুরু করেছিল আরো কিছুক্ষণ ফুটপাথের পাশের লাল সুরকি বা মোরামের জমিতে নিজের ক্ষয়ে যাওয়া চটির শব্দ শুনবে বলে।
অর্থাৎ একটা সাধারণ শহরের সাধারণ ঘন্টা।
নীল সালোয়ার কামিজের উপর সাদা কার্ডিগান পরা ক্লর্কন্ পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে বলছিল – কেমন আছ, লংড়াজী? আমাকে দুটো করমল চাট ফটাফট বানিয়ে দিতে পারবে?
লংড়া টাকাটা ফটাফট ঠেলার উপরে পাতা ছালার আচ্ছাদনের নিচে চালান করে দিয়ে বলে – আপনার দোয়ায় সব ভালো, ম্যাডমজী। চাটও আপনার হাতে এসে গেছে ধরে নিন। শুধু দাঁড়াতে হবে একটু।
- সেরকম বোলো না, লংড়াজী। দাঁড়াতে হবে কেন? দাঁড়াবার টাইম নেই বলেই তো ফটাফট চাইলাম।
লংড়ার কাঁধের নিচে হাতের বদলে দুটো রেলগাড়ির ক্র্যাঙ্ক শ্যাফট লাগানো। সেই শ্যাফ্টদুটো দিয়ে সে শালপাতার দোনায় পেয়ারা এবং কামরাঙার টুকরোগুলোকে বন বন করে লাট্টুর মতো ঘোরায়। দোনা থেকে চোখ না তুলে সে বলেছিল – এই জ্যান্টলম্যানের অর্ডার শেষ করেই আপনারটা ধরব। ইনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছেন।
নীল সালোয়ার কামিজ তখন একটু আহত গলায় বলে – লংড়াজী, আমি কি আগে কখনো লাইন ভেঙেছি? আজকে একটা স্পেশাল দিন সেটা বুঝতেই পারছ। ফাইটার প্লেনের ফ্লাই পাস্ট হবে এক্ষুনি। তার আগে হিলের উপর পৌঁছোতে চাই। দেখছ তো আমার দলটা বেরিয়ে যাচ্ছে?
- কী করা যাবে, বাবুজীর অর্ডার যে আগে এসে গেছে।
উফ্ফ্। কে বাবুজী? এবার একটু বিরক্ত হয়ে ক্লর্কনের কাজলহীন বাদামি চোখদুটো এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবুজীকে খুঁজছিল। ঠেলা থেকে দশ পা দূরে ক্লর্ক্দের একটা ছোট দল বোটক্লাবের বাঁশের বেড়ার উপর একটা করে পা তুলে দিয়েছে যেন সিঙ্ক্রোনাইজ করা তিনটে কুকুরের মতো তারা একসঙ্গে হিসি করে দেখাবে। দাঁড়ানো অবস্থাতেই তাদের হাতে তিন-পাত্তার খোলা তাশ। কেউ পরেছে মেশিনে বোনা সোয়েটার, কারো চোখে রোদ চশমা, কারো পায়ে এই শীতের বিকেলেও বুটের বদলে স্যাণ্ডেল আর মোজা। এর মধ্যে কে বাবুজী? কে জানে ক-ডজন চাটের অর্ডার তার?
লংড়াকে আবার খোঁচাল ক্লর্কন্। - তোমার বাবুজীকে গিয়ে বলো একটু অপেক্ষা করতে আর আমারটা আগে করে দাও। পাঁচ মিনিট পরে পেলে কি তার রম্মির হাত খারাপ হয়ে যাবে?
লংড়া এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল - এই ছোটু, যা গিয়ে বাবুজীকে খুব পেয়ার সে জিজ্ঞেস করে আয় এই ম্যাডমজীকে আগে দিয়ে দিলে কোনো অসুবিধে আছে?
লংড়ার হাঁক শুনে বছর দশেকের ফুটফাট কাজ সারার ছেলেটা ছুটে গিয়ে যাকে ধরেছিল সে তিনপাত্তার দল থেকে একটু দূরে বাঁশের বেড়ার উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে। লোকটার পরনে গ্যাবার্ডিনের গ্রে স্যুট আর কালো চামড়ার জুতো। অন্যদের তুলনায় একটু বেশি শৌখীন, যেন কোনো নবাবের ছেলে বাড়িতে ঝগড়া করে ক্লর্ক্ হয়ে গেছে। ক্লর্কন্ আগেও লোকটাকে দূরে দাঁড়িয়ে একা ম্যাগাজিন বা পকেট বই পড়তে অনেকবার দেখেছে। ওদের চার্টার করা বাসটা আসবে সবার পরে। এত আগে এসে লোকটা কেন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে কে জানে। আন্দাজ করা যেতে পারে তার সংসারের দায়িত্ব নেই এবং হাতে অঢেল সময়। ছোটুর কথা শুনে সেই শৌখীন ক্লর্ক একবার চোখ তুলে তাকাল এবং নীল সালোয়ার পরা ক্লর্কন্কে তার দিকে অসন্তুষ্টভাবে চেয়ে থাকতে দেখল। ক্লর্ক্ ছোটুকে বলল – লংড়াকে তো বলিনি আমার এক্ষুনি চাই। যখন ইচ্ছে বানাতে পারে। হয়ে গেলে শুধু যেন একটা খবর পাঠিয়ে দেয়।
ছোটুর কাছে এই খবরটা পাওয়ার পর নিশ্চিন্ত হয়ে ক্লর্কন্ বলেছিল – বাবুজীটাকে দেখতে যেমনই হোক, বুদ্ধি আছে। তুই যখন আবার তার কাছে যাবি তখন কী বলবি বল তো? এই বলে ক্লর্কন্ ছোটুর কানে ফিসফিস করে একটা কিছু বলে দেয়।
শুনতে শুনতে ছোটুর চোখমুখ আনন্দে আর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিল। পরে এক গাল হেসে সে বলে – এটা বলবার জন্য তো আমি পয়সাও নেব না!
তো এইভাবে লংড়া ক্লর্কনের অর্ডারে লেগে যায়, ক্লর্কন্ চুপ করে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখতে থাকে, আর ছোটুর হাতে কোনো কাজ ছিল না বলে সে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে গ্যাবার্ডিনের স্যুট পরা বাবুজীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, যে তখন হাতের ম্যাগাজিন বন্ধ করে আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ছোটু জানত প্লেনগুলো আসতে অনেক দেরি, সে বাবুজীর মতো আকাশের দিকে মুখ তুলে নর্থ আর সাউথ ব্লকের মাঝখানের নাম না জানা চলচ্চিত্রের পর্দাটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে, মানে নিজের সম্ভাব্য সুদূর ভবিষ্যতের একটা চেহারাকে দেখতে পেল। পর্দার উপর সেই চেহারাটা কখনো সৈনিকের বেশে আসে। কখনো মেকানিক। আজ সেটা ক্লর্কের রূপ ধরে এসেছিল। বাবুজীর মতো তার হাতেও ছিল একটা ফিল্মী ম্যাগাজিন।
ছোটু জানত আকাশের এই টুকরোটার দিকে তাকানো নিষিদ্ধ। সে আড়চোখে একবার লংড়াকে দেখে নেয়। দূর থেকে লংড়া মাথা নাড়াচ্ছিল আর মনে মনে বলছিল – ছোটু, তোকে বাঁচানো গেল না। আকাশের বেকার শো-গুলো দেখা শিখে গেলি এই বয়সেই?
তার মনিবের মনে কী আছে ছোটু বুঝেছিল, কারণ লংড়া চিরকাল দাঁড়াত রাইসীনা হিলের দিকে পিছন ফিরে। ছোটু শুনেছিল বহুদিন আগে আকাশের পর্দা থেকে একটা মর্তমান কলার মতো মোটা আঙুল এসে লংড়ার পিঠে টক টক করে টোকা দিয়ে বলে – এই লংড়া, তোর ভবিষ্যতের শো শেষ হয়ে যাচ্ছে, ফালতু কাজ ছেড়ে এবার উলটোদিকে ঘোর। লংড়া নেউলার চেয়ে চুস্তী সে ঘুরে তার কাস্তের মতো বাঁকানো সরু ছুরিটার এক কোপে আকাশ থেকে আসা সেই কলাগাছমার্কা হাতের পাঁচটা আঙুল এক কাঁদি কলার মতো গোড়া থেকে আলাদা করে দেয়। কেউ কোত্থাও ছিল না। শুধু রফি মার্গ ধরে স্কুটারে করে যাওয়া দুটো লোক লংড়াকে দেখে ফেলে। বোটক্লাবের অসম্ভব সুন্দর সন্ধ্যেবেলায় সেই অনৈসর্গিক দৃশ্য দেখার পর পুরোনো স্কুটারে ফুল স্পীড তুলে তারা বাছুরের মতো ডাক ছাড়তে ছাড়তে পালিয়েছিল।
সেদিন কিন্তু ছোটু লংড়াকে উপেক্ষা করে এক ছুটে গ্যাবার্ডিনের স্যুট পরা বাবুজীর কাছে চলে আসে। বাবুজীকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাইছিল সে।
ছোটুর প্রশ্নটা প্রথমে গ্যাবার্ডিনের স্যুট ঠিক বুঝতে পারেনি। সে একটু অবাক হয়ে বলে – ছোটু তুই আমার মতো হবি? এইরকম স্যুট পরবি তুই?
- হ্যাঁ বাবুজী। কী করতে হবে তার জন্য?
- আমার মতো হতে চাইলে কী করতে হবে? হুম্ম্। চিন্তায় পড়ে যায় গ্যাবার্ডিনের স্যুট। - প্রথমত এই পত্রিকাটার মতো দেখতে সবকটা ফিলিমের পত্রিকা পড়তে হবে। দ্বিতীয়ত চুল-কে যে ক্রীমটা দিবি, সেটাই বুটকেও দিতে হবে। কারণ এর অন্যথা হলে তোর মাথা বা পা, কেউ তোর উপর খুশি থাকবে না, আর আমার মতো হবার আশা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু ছোটু, তুই আমার মতো হতে চাইছিস কেন? তার চেয়ে ওই দুর্দান্ত উর্দিওয়ালা ট্র্যাফিক পুলিশের মতো হবি না কেন? ওদের সরকারি দফ্তরের গুহায় ঢুকতে হয় না। আর সারাদিন চোখ বুজে ঘুমোতে ঘুমোতেই নিজের কাজ করে যেতে পারে।
তখন ছোটু বলতে গিয়েছিল – যেই আমি বোটক্লাবের বেড়াতে হেলান দিয়ে…। বাকিটা তার বলা হয়নি। গ্যাবার্ডিনের স্যুট পরা ক্লর্ক্ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে – বুঝে গেছি, বুঝে গেছি, ছোটু। তুই নিজের ফিলম দেখে ফেলেছিস। একটা কথা মনে রাখিস। ওই ফিলমে যা দেখায় তা সবসময় সত্যি নয়। পরে ছোট ছোট করে লেখা আসে – চরিত্রগুলো কাল্পনিক। সবাই ক্ষুদে ক্ষুদে লেখাগুলো না পড়েই বাড়ি চলে যায় কিনা, তাই ভাবে সত্যি।
কৃতজ্ঞতায় ছোটু তার কোমরে গোঁজা কাপড় দিয়ে বাবুজীর জুতো মুছে দিয়েছিল। জুতো মুছতে মুছতে তার মনে পড়ে কামিজ পরা ম্যাডমজীও গ্যাবার্ডিনের স্যুটকে কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! কানে কানে যে কথাটা ম্যাডমজী ছোটুকে বলেছিল, সেটা ম্যাডমজীর গায়ের গন্ধ থেকে দূরে যাওয়া মাত্র ছোটুর মাথা থেকে উবে গেছে। কিছুতেই আর মনে করতে পারল না ছোটু।
- ম্যাডমজী আমাকে কিছু বলতে চেয়েছে? তুই ঠিক জানিস? বাবুজী ছোটুকে জিজ্ঞেস করেছিল।
- ঠিক। বলে ছোটু।
- কথাটা কী?
– আমি কী করে জানব? আমি শুধু জানি একটা কিছু বলতে চায়। তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে নাও না?
একটু পরে নীল সালোয়ার আর কামিজ পরা ক্লর্কন্ দেখতে পেল গ্যাবার্ডিনের স্যুট আর চামড়ার বুট পরা শৌখীন বাবুজী বেড়াতে বেড়াতে তাদের দিকেই আসছে।
দুজনের চোখাচোখি হল কিন্তু তাদের ডোডোপাখির মতো নিষ্পাপ মনদুটো আকাশে ওড়েনি কারণ ডোডোরা আকাশে উড়তে পারে না। তারা মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশটাকে ভালোবেসে ফেলে। খুবই ঢিমে চালে গ্রে স্যুট এগোচ্ছিল। এতই সময় লেগেছিল তার ওইটুকু পথ অতিক্রম করতে যে ততক্ষণে উলটো দিকে দিয়ে আসা গোলাপি সোয়েটার পরা একটা ছোটখাটো লোক, আরেকটা ক্লর্ক্ই হবে, তার পথ আটকে দিয়েছে।
- জে-কে!! জে-এ-এ-এ- কে-এ-এ-এ-এ!!! তুই এখানে! আমি তো ভাবতাম শহর ছেড়ে গায়েব হয়ে গেছিস! তোর বাড়ি কোথায়? চিনতে পেরেছিস তো আমাকে? উচ্চগ্রামে চিৎকার করতে করতে গোলাপি সোয়েটার অকস্মাৎ গ্যাবার্ডিনের বুকে ধাক্কা দিয়ে তাকে পিছিয়ে দিতে থাকে।
অ। শৌখীন বাবুজী, তোমার নাম হল জে-কে। মনে মনে ভাবছিল ক্লর্কন্। জে-কে ফর জসবিন্দর কুমার? জিতেন কপুর? না কি জাভেদ কিদওয়াই? জয়রামন কৃষ্ণন হতে পারে অবশ্য। জেকব কুরিয়েন কেন নয়? জিতেন্দ্র কানুনগো? যাই হোক না কেন, বাঁচা গেছে এই গোলাপি সোয়েটার এসে তোমাকে থামিয়ে দিয়েছে, নইলে নিশ্চয়ই ঝগড়া করে আমার আগে নিজের চাটটা ডেলিভারি নিতে।
জে-কে নামের সেই স্যুটবাজ ক্লর্ক্ একটু লজ্জায় পড়ে গেছে। সে কথা বলছে নিচু গলায়, দূর থেকে শোনা যায় না। হাতের ফিল্মী ম্যাগাজিনটাও পাকিয়ে পিঠের পিছনে লুকোবার চেষ্টা করছিল। ক্লর্কনের দিকে একবার চট করে তাকিয়ে নিয়ে সে নিজের বন্ধুর দিকে ফিরে কিছু একটা বলল।
- রাবিশ, রাবিশ, রাবিশ। জে-কে, আজ তোকে আমি ছাড়ব না।
গোলাপি সোয়েটারের মাথার উপর দিয়ে ক্লর্ক্ আবার ক্লর্কনের দিকে অসহায়ভাবে তাকায়। ক্লর্কন্ সেদিকে চোখ রেখে লংড়াকে বলল – কতক্ষণ লাগবে লংড়াজী?
- এই তো হয়ে গেছে।
- তাড়াহুড়ো করে নষ্ট করে দিও না। ভালো করে বানাও।
- তাড়াতাড়ি বানাব না?
- না, না। তাড়াতাড়িই বানাও। কিন্তু বেশি তাড়াতাড়ি করতে যেও না।
- ও, তাহলে রেডিওটা চালাই।
এরকম একটা সময়ে মল্হার বলে সেই টেলিফুঙ্কেনের রেডিওতে একটা গানের প্রোগ্রাম চালু হয়। কড়ে আঙুলের ছোঁয়ায় লংড়া রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিয়েছিল। পুরোনো রেডিওতে একটা কিছু গণ্ডগোল আছে কারণ ধৈবত লাগলেই স্টীল আর ব্যাকেলাইটের বডি প্যাঁ প্যাঁ করে সানাইয়ের মতো বেজে উঠছে। রহস্যময় কারণে এই ফাটা রেডিওর আওয়াজ ক্লর্কন্কে অসম্ভব টানে। যেন সেই প্যাঁ প্যাঁ শব্দের মধ্যে দিয়ে রেডিওটা কথা বলতে চায়। ক্লর্কন্ সেদিনের প্রথম গানটা মন দিয়ে শুনবার চেষ্টা করেছিল –
তুম্নে পুকারা অওর হম্ চলে আয়ে,
দিল হথেলী পর লে আয়ে রে…
জে-কেও কান খাড়া করে গান শুনছে নিশ্চয়ই! ক্লর্কন্ আরেকবার ওদিকে তাকিয়ে দেখল জে-কেকে গোলাপি সোয়েটার হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর জে-কে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করেও ভদ্রতার খাতিরে গায়ের জোর লাগাতে পারছে না।
ক্লর্কনের চোখের সামনে গোলাপি সোয়েটারের ধাক্কায় জে-কে সরতে সরতে ফুটপাথের ধারে দাঁড়ানো একটা থ্রি হুইলারে উঠতে বাধ্য হয়েছিল। যে কাজটার জন্য বেচারা লংড়ার ঠেলার দিকে আসছিল তার আশা ছেড়ে দিয়ে সে শেষবারের মতো সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। যেন কোথাও থেকে বড়ো দাদা বা দিদি এসে তাকে বাঁচাবে। অতিষ্ঠ হয়ে ক্লর্কন্ লংড়াকে বলল – লংড়াজী, আপনার বাবুজী কিন্তু নিজের চাট খেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। কেউ একটা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
লংড়া দুটো বড়ো সাইজের দোনা ক্লর্কনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল – পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এরকম হয়। হাতের চাট ফসকে যায়। কিন্তু ভয় নেই, লংড়ার কাছে পয়সা মারা যাবে না। চাট উনি কাল পেয়ে যাবেন।
ক্লর্কন্ দোনা দুটো তুলে নিয়ে যেতে যেতে লংড়াকে বলেছিল – লংড়াজী, কাল বলে কিছু হয় না। যা করার আজ। এই রেডিওটা তুমি হাথ-কে-হাথ আমায় বেচে দাও।
- এটা একটা ভাঙা রেডিও। আপনি কেন কিনবেন?
ক্লর্কন্ মনে মনে বলল কারণ এই রেডিও যখন প্যাঁ প্যাঁ করে বেজে ওঠে তখন সে আমাকে আকাশের পর্দায় দেখানো সিনেমাগুলোর ডায়লগ শুনিয়ে দেয়। কার মনে কী আছে কখনো কখনো সেটাও বলে ফেলে। আমার নাম ধরে কথা বলে রেডিওটা, যেন কতদিনকার চেনা। আর যে গানগুলো শোনায়, সেগুলোও পরিস্থিতি বুঝে নিজেই পছন্দ করে।
- ভাঙা হলেও এর আওয়াজে একটা জাদু আছে। সবাই সেটা বুঝতে পারে না।
- ম্যাডমজী, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রেডিও শুনুন তাহলে। অনেকে সেইজন্যই আসে। পাহাড়ের উপর উঠে কী হবে? ফাইটার জেট এখান থেকেই দেখা যায়।
- আজ আমার সঙ্গে বন্ধুরা আছে। কাল বলে যদি কিছু থাকে তো রেডিও আবার শুনতে পাওয়া যাবে, তাই না?
কয়েকটা মাস কেটে গিয়েছিল এর পর। এই শহরে বসন্ত আসতে দেরি লাগাত না। শীতের ঝরা পাতাগুলো রাস্তা থেকে ঝেঁটিয়ে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা হত রোজ। নতুন পাতা আসা শুরু হত তার অল্পদিনের মধ্যে। কুয়াশায় ভারী হয়ে জমে থাকা পোড়া পাতার গন্ধ জামাকাপড় থেকে মুছে ফেলে ক্লর্ক্ আর ক্লর্কন্রা যখন সকালবেলা বাস থেকে নামত তখন তাদের চলাফেরার মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা দিত। সোয়েটার ছেড়ে দিয়ে ক্লর্কন্রা পরত হলুদ কিম্বা গোলাপি রঙের সুতির পোষাক। ওড়নাগুলো টাইট করে পেঁচিয়ে নিত মাথায়। ক্লর্ক্রা শার্টের উপরের একটা বোতাম খুলে দিয়ে হাঁটত ফুরফুরে হাওয়ায়। কারো গলায় সোনার চেন থাকলে সেটা দেখা যেত এই মরসুমে।
সবাই তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে পড়ছে। ক্লর্কন্ লংড়ার ঠেলার পাশে দাঁড়িয়ে নামহীন আকাশের টুকরোটায় কখন তার নিজস্ব শো শুরু হবে ভাবছিল। মল্হারে এই গানটা বাজছিল –
চমন-ওয়ালোঁ সম্ভল্ যাও, কে আয়ে দিন বহার কে
(ফুলের বাগান হও সাবধান, কারণ এসেছে বসন্তের দিন)
দেখা গেল শৌখীন ক্লর্ক্ জে-কে, তার গ্যাবার্ডিনের স্যুট ছেড়ে সাদা শার্টের উপর সুতি আর স্যাটিনের ওয়েস্টকোট পরে ঢিলেঢালাভাবে আসছে। তার পিছনে ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে দুলকি চালে চলেছে একটা বাদামি রঙের দো-আঁশলা কুকুর। কুকুরের পিছনে ছোটুর মতো একটা ন-দশ বছরের ছেলে। একটু দূরে নিজের দুই সঙ্গীকে দাঁড় করিয়ে জে-কে লংড়ার দিকে এগিয়ে এল।
কুকুরটা ক্লর্কনের পছন্দ না হওয়ায় তার চোখদুটো বেড়ালের মতো সরু হয়ে গিয়েছিল। সে আকাশের স্ক্রিনের দিকে মন দেবার চেষ্টা করছে। জে-কে লংড়ার কাছে এসে বলল – লংড়া, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাকে বাঁচাও।
লংড়া খুব একটা বিচলিত না হয়ে কামরাঙা ফালি করতে করতে বলল – বউ পালিয়ে গেছে?
- আমার বউ কোথায়? কার সাথে আমায় গুলিয়ে ফেলছ?
- তো ছেলেটাকে দফ্তরে নিয়ে এসেছেন কেন?
- সেটাই তো বলছি। ছেলেটা আমার এক আত্মীয়ের। বাবা-মা’র সঙ্গে গ্রাম থেকে এসেছিল শনিবার। কাল রাতে ওর বাবা-মা বলেছিল ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে যেতে চায়, আমি যেন স্কুলে ভর্তি করে দিই। হ্যাঁ না কিছু বলিনি। আজ সকালে উঠে দেখি দুটো পাখিই গায়েব। মালপত্রও নেই। ছেলেটা ঘুমোচ্ছে, আর তার একটা স্যুটকেস পড়ে আছে।
লংড়ার চাকু থেমে গিয়েছিল। - এ কী ধরনের মা-বাপ? সৎ ছেলে নাকি?
- আমি তো ওদের নিজের ছেলে বলেই জানি।
- ছেলেটা কী বলে? ও জানে ওর মা-বাপ কী করেছে ওর সাথে?
- সে খুব একটা চিন্তিত নয়। বলছে বাবা-মা’র ভুলো মন। ওকে প্রায়ই এদিক ওদিক ফেলে চলে যায়। পরে মনে পড়লে নিতেও আসে।
লংড়া এই শহরে এসে যা দেখছে, আগে জীবনে কোনোদিন দেখেনি। রোজই তাজ্জব হওয়ার মতো কিছু না কিছু হয়। মাথা চুলকে সে বলল – স্যরজী, ছেলেটা চালাক আছে মনে হচ্ছে। আরেকটা এরকম কেস দেখেছিলাম আগে। অবশ্য তার বয়স আরেকটু বেশি ছিল।
- কী করেছিল তাকে নিয়ে?
- কিছু টাকাকড়ি পকেটে ঢুকিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। নিজেই গ্রামে চলে যায়।
- এটা তো দারুণ আইডিয়া! তাই করা যাক তাহলে। কিন্তু কুকুরটাকে নিয়ে কী করি? কাল সন্ধ্যেবেলা পাড়ায় কার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। এখন সেও ফিরে যাচ্ছে না।
- তাহলে ওটাকেও সঙ্গে দিয়ে দিন। একা ছাড়ার চেয়ে ভালো। দুজনে দুজনকে দেখবে।
জে-কে একটু বিবেচনা করে। - লংড়া, একটা প্রবলেম আছে। এর বাবা-মা নিজেদের বাড়িতে ফিরেছে কিনা সন্দেহ। কথা হচ্ছিল রাজস্থানে বেড়াতে যাবার। ছেলেটা যদি বাড়িতে ফিরে দেখে দরজায় তালা? তোমার চেনাজানা কেউ নেই যে একটা ছেলে চায়? কুকুরটাকে আমি রাখতে পারব, যদি পাড়ার কেউ ফেরত নিতে আসে।
লংড়া এদিক ওদিক চাইল। ক্লর্কন্ কাছেই দাঁড়িয়ে আড়চোখে একটা বিষের দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল।
লংড়া বলল – স্যরজী, তাহলে ছেলেটাকেও কয়েকদিন রাখুন। আমি খোঁজখবর নিই। এখন একটা চাট নিয়ে যান। মাথা ঠাণ্ডা করে ওকে খাওয়ান, নিজেও খান।
- ওকেই করে দাও। সকাল থেকে আমার খিদে নেই।
জে-কে আবার দূরে গিয়ে বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আজ তার হাতে কোনো বই বা ম্যাগাজিন দেখা যাচ্ছে না। দাড়িও কামায়নি। মলহার্ শোনাচ্ছিল – হমীঁ দুশমন না বন যায়েঁ, কহীঁ অপনে করার কে (নিজেই দুশমন হয়ে না যাই, নিজের মনের প্রশান্তির)। ক্লর্কন্ লংড়ার কাছে সরে এসে বলল – লংড়াজী, ছি-ছি। কাজটা একদম ঠিক করছ না তোমরা। এইভাবে একটা বাচ্চাকে কেউ ট্রেনে তুলে দেয়?
- ঠিক বলেছেন। লংড়া অভিযোগটা মেনে নেয় অমনি। - আপনি কী বলেন, ম্যাডমজী। কী করা উচিত?
- নিজের বাবা-মা’র কাছে রেখে আসে না কেন? কেউ তো আছে ফ্যামিলিতে।
- তিন কুলে কেউ নেই। বাবা-মা তো ছিলই না। নানার কাছে বড়ো হয়েছে। ইলেক্ট্রিকের দোকান ছিল তাঁর, সেখান থেকেই এই পুরোনো রেডিওটা পেয়েছিলাম। তো সেই নানাও গুজরে গেছেন গত বছর। আচ্ছা, আপনি হলে কী করতেন?
- প্রথমত যার বাচ্চা তার বাড়িতে নিজে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসতাম।
- আর যদি গিয়ে দেখেন তাদের বাড়িতে তালা?
- তাহলে ফিরিয়ে এনে আবার পরে যেতাম। ততদিন একটা চেনা পরিবারকে রাখতে দিতাম। অথবা নিজেই মানুষ করতাম। শরীফ লোকেরা এছাড়া আর কী করবে?
- তাই বলব আমি বাবুজীকে। আপনি নিজে নিতে চাইলে নিয়ে নিন না? বাচ্চাটা ভালোই। বেশি কথা বলে না। কিছুদিন রাখুন। ভালো লাগলে রেখে দিন, নইলে বাবুজী ফেরত নিয়ে নেবেন।
- বেশি কথা তুমি বোলো না, লংড়াজী। আমি তোমাকে বুঝদার মানুষ ভাবি। পারলে এই ক্লর্ক্টাকে বোঝাও, জল্লাদের মতো ব্যবহার না করতে। এরকম একটা সুন্দর দিনে কেউ ওরকম খারাপ কথা ভাবতে পারে? তুমিই বা কোন আক্কেলে এইসব জঘন্য প্ল্যান দাও? ফল কাটো, না বকরা? কসাই নাকি?
দুচারদিন পরের কথা। বিকেল হলে এখন আর্মির রেজিমেন্টের বদলে মোঘল গার্ডেন্সের গোলাপ আর চামেলির গন্ধ রায়সীনা হিলের গা বেয়ে মার্চ করে আসে। ক্লর্কন্ দেখল জে-কে আবার ম্যাগাজিন হাতে একা এসে হাজির। লংড়াকে দেখে সে হন্হনিয়ে আসছিল। ক্লর্কন্ একটু সরে দাঁড়াল, কিন্তু বেশি দূরে যেতে পারল না, কারণ মল্হার প্যাঁ-প্যাঁ করে বেজে উঠে ক্লর্কন্কে বলেছিল – কাছেই থাকো, একটা ভালো গান আর কিছু মজার খবর শোনাব তোমায়। এবং সত্যিই ক্লর্কনের প্রিয় এই গানটা সে চালু করে দেয় - ইয়ারী হো গয়ী ইয়ার সে লক টুনুটুনু…।
জে-কে এসে চাটের ঠেলার কাছে দাঁড়াল। লংড়াকে মৃদু গলায় সে যা বলছিল সবই রেডিওটা প্যাঁ প্যাঁ করে ক্লর্কনের কানে পৌঁছে দিচ্ছে। জে-কে বলল - লংড়া, আজ আমার মনে টুনটুন করে বাজনা বাজছে। লক্কি ডে আমার। লক্কি ডে।
লংড়া শুধায় – এত লক্কি হলেন কী করে? ছেলেটা পালিয়েছে নাকি?
- বাড়িতে এসে নিয়ে গেছে! ওই যে কুকুরটা দেখেছিলে? সেটা ছিল পাশের পাড়ার এক ডাক্তার আর ডাক্তারনীর। কোনো ছেলেপুলে নেই। কুকুরটাই সব। তো সে কুকুর আমাদের ছেলেটাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না। আমি বললাম – লগে হাথোঁ এই ছেলেটাকেও নিয়ে যান, নইলে আপনাদের কুকুর দুঃখের চোটে না খেয়ে মরে যাবে।
- বলা মাত্র নিয়ে গেল?
- ঠিক অত সোজা হয়নি। বলল – আসল বাবা-মা এসে যদি ছেলেটাকে ফেরত চায় তো আমরা কী করব? আমি বললাম – সেরকম কিছু যদি হয় তো আমি আপনাদের আরেকটা ছেলে এনে দেব।
- এ আপনি কী বললেন, স্যরজী? ছেলে কোত্থেকে পাবেন? চুরি করবেন নাকি?
- না, না। চুরি করব কেন? আমি ভেবেছিলাম তার বদলে তখন কিছু পয়সা দিয়ে মাফ চেয়ে নেব। কিন্তু ওরা কাগজে লিখিয়ে নিয়েছে আমার নিজের ছেলেপুলে কিছু হলে ওদের একটা দিতে হবে। এই বলে জে-কে হো হো করে হাসতে থাকে।
লংড়া ফল কাটায় নজর দিল। - আর যদি এই ছোকরা পালিয়ে যায় আর ওরা আপনার ছেলে হবার অপেক্ষায় বসে থাকে?
ক্লর্ক্ সেটা শুনে হাসতেই থাকল। - সারাজীবন কেটে যাবে অপেক্ষায়। আমার দুই দিদির কোনো অওলাদ-টওলাদ হয়নি। সবাই আমার কাছে বাচ্চা চেয়ে বসে আছে। আমার হবে কী করে?
- আপনার হবে না কেন বাবুজী?
- কারণ, আমার একটা ভাল্ভ খারাপ আছে ভাই। সেটা আজ নয় কাল উড়বে বলে তৈরি।
লংড়া চাকু চালাতেই চালাতেই অবাক হয়ে তাকায়। - ভাল্ভ তো আমার পুরোনো রেডিওটার খারাপ। আপনি কি রেডিও? আচ্ছা-খাসা লম্বা-চওড়া জওয়ান আদমী।
ক্লর্ক্ লংড়ার ঠেলা থেকে একটা পেয়ারা তুলে দুহাতে সেটাকে ক্রিকেটের বলের মতো পালিশ করছিল। কয়েকবার হাওয়ায় লুফে নেবার পর দাঁত বসিয়ে সেটাকে খেতেও শুরু করে। পেয়ারাটা চিবোতে চিবোতে সে বলল – তোমার রেডিওতে কোনো ভাল্ভ নেই, লংড়া। ছটা সলিড-স্টেট ট্রান্জিস্টার আছে। সেগুলো খারাপ হলে আমি পালটাতেও জানি। কিন্তু আমাদের দিলের চারটে টায়ারে চারটে ভাল্ভই থাকে। তার একটাও খারাপ হলে কেউ পালটাতে জানে না। আগে রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলতে যেতাম, ভাল্ভটার জন্য সব ছাড়তে হয়েছে। এখন শুধু বই পড়ি, আর গান শুনি। সবাই জেনে গেছে আমি দু-দিন কা মেহমান। অফিসে খটারা জে-কে বলে কি এমনি এমনি ডাকে? তোমার রেডিও আমার চেয়ে ঢের বেশিদিন চলবে, লংড়া-মাস্টর।
মল্হার তার দীর্ঘু আয়ুর ভবিষ্যদ্বাণী শুনে নিশ্চয়ই বেশ খুশি হয়েছিল, কারণ দাঁড়ানো সবাইকে সে এই গানটা শুনিয়ে দেয়।
সরে রাহ চলতে চলতে, মুঝে কোই মিল গয়া থা…
যো কহী গঈ না মুঝসে, উয়ো জমানা কহ রহা হ্যায়
কে ফসানা বন গঈ হ্যায় …
মেরী বাত…
চলতে চলতে…
পরে ক্লর্কন্ বুঝতে পারে সেই দিনটা ছিল তুঙ্গ বসন্তের বেপরোয়া একটা তিথি। নিজের অজান্তে পুরো পৃথিবীটার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
এরকম দিনে নর্থ আর সাউথ ব্লকের মাঝখানের আকাশটা টকটকে লাল হয়ে থাকে। পার্লামেন্ট সার্কেলের কাছে যে কটা কৃষ্ণচূড়া বা গুলমোহরের গাছ ছিল সেগুলোর ডাল দিয়ে সেদিন বেরিয়ে আসছিল আগুনের হলকা। সত্তর মিলিমিটারের পর্দাটা অসভ্যের মতো ক্লর্কন্ আর ক্লর্ককে লক্ষ্য করে একের পর এক বলগাহীন দৈহিক ঘনিষ্ঠতার লাল লাভার মতো ছবি চালাতে শুরু করে। কামজ্বরের বিকারে উন্মাদ কোনো ফকিরের ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসা সেই চলচ্চিত্রগুলো উগ্র থেকে উগ্রতর লজ্জাহীন যথেচ্ছাচারের জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল একটি ঠাণ্ডা মাথার ক্লর্কন্ আর একটা ভাল্ভ উড়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত খটারা ক্লর্ক্কে, যারা সম্মোহিত দুটো ডোডো পাখির মতো সেই পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না, কারণ দুজনেই তখন ভাবছে সে ছাড়া তার প্রাইভেট শো দেখতে পাবে কে?
রফি আহমেদ কিদওয়াই নামের সেই চওড়া রাস্তা দিয়ে কার কটা বাস এল কি গেল তাদের খেয়াল নেই। গোধূলির লাল ধুলো পেট্রলের ধোঁয়ার সাথে মিশে আকাশে উঠে যাচ্ছে। ইস্পাত-কারখানার ফার্নেসের মতো মৃত্যুহীন কালো গোলাপের রং ধরেছিল পর্দাটায়। ক্লর্কন্ দেখল বিজয় চওক থেকে ক্রিমসন বর্ণের কার্পেট ধরে অগুনতি জ্বলন্ত কয়লার টুকরোর উপর ভর দিয়ে তার নিজেরই শরীরের চ্যাটালো-বর্তুল সমারোহে পূর্ণাঙ্গ একখানা থ্রি-ডি আলোকমূর্তি চিত হয়ে শুয়ে রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে পিছলে নেমে আসছে। প্রায় দু-তিনশো ফুট লম্বা এবং কোনো জামাকাপড়ের বালাই ছাড়া গভীর অশ্লীলতার প্রশান্ত ঘুমে ঘুমন্ত সেই দেহ। দীর্ঘতম এক একটা সুখের নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মাথাটা ইণ্ডিয়া গেটের দিকে ফেরানো। দুই পা তখনো রাষ্ট্রপতি ভবনের দুকাঁধের উপর দিয়ে পালকির দুটো মোটাসোটা ডাণ্ডার মতো সর সর করে নামছিল।
এটা আবার কী? ভাবতে ভাবতে আড়চোখে ক্লর্কন্ দেখল ক্লর্ক্ মুগ্ধ ক্যাবলরামের মতো তার নিজস্ব সিনেমাগুলো গিলছে একমনে। আশা করি সে আমার ছবিটা দেখতে পাচ্ছে না। ক্লর্কন্ ঘুরে নিজের মুখ আরেকটু আড়াল করে নেয়। তার হলুদ আলোর দেহটা তখন গড়গড় করে রাজপথ বেয়ে নেমে এসেছে খানিকদূর। সাইবেরিয়া থেকে আসা সারস আর কে জানে কোন বিদেশ থেকে আসা গোলাপি ফ্ল্যামিঙ্গো পাখিগুলো আকাশ থেকে টুপ টুপ করে নেমে পড়ছিল সেই অতিকায় শরীরের উপর। ক্লর্কন্ লক্ষ্য করল ক্লর্কেরও একটা সচল মূর্তি তার শরীরের পাশে মাটিতে হাঁটছে। সাধারণ ক্লর্কের মতো ছোটখাটো সাইজ সেটার। হাতে ঝুলছে টেলিফুঙ্কেন রেডিও। মাঝে মাঝে থেমে বুকে মালিশ করে দেখে নিচ্ছে ভাল্ভটা ঠিক জায়গায় আছে কিনা। বোটক্লাবের পাশে এসে মিছিলটা থামল।
চারদিকে প্রাগৈতিহাসিক পশুপাখিরা এসে ভিড় করেছিল। যেন ভাষণ দিতে উঠবে কেউ। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর ক্লর্কন্ বুঝল সবাই তার টান হয়ে শুয়ে থাকা শরীরের দিকেই চেয়ে অপেক্ষা করছে কিছু শোনার।
চারদিকে তাকিয়ে যখন সে বুঝল কোনো মানুষ নেই তখন ক্লর্কনের দেহটা কথা বলতে শুরু করল ফাটা মল্হারের প্যাঁ প্যাঁ শব্দটার ভিতর দিয়ে। হিন্দী বা ইংরেজি নয়। এই শহরে জন-মানুষ আসার আগের সময়ের একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ভাষা সেটা। রোল কলের মতো পশু পাখিদের পরিচয় নেবার পর সে একে একে প্রতিটি প্রাণীকে তার পছন্দমতো উপহার চেয়ে নিতে অনুরোধ করে। কোনো ফ্ল্যামিঙ্গো মাকে তার প্রার্থনা মতো ছ’টা ডিমের প্রতিশ্রুতি দেবার পর সে একটা হনুমানকে আশ্বাস দিল বংশধরের। এক বৃদ্ধ শেয়াল চেয়েছিল পাঁচটা বাড়তি বসন্ত, ক্লর্কন্ দিল আরো দশ বছরের আয়ু। এইভাবে নিজের ভিতর থেকে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহারগুলো বার করে বিতরণ করতে করতে সে লক্ষ্য করল ক্লর্ক্ তার পায়ের পাতার এক ধার দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরে সামনের সারিতে আসার চেষ্টা করছে। একমাত্র জামা কাপড় পরা হাস্যকর প্রাণী হিসেবে তাকে দেখে একটু সরে যাচ্ছিল অন্য সব পশুরা। ক্লর্কনের থ্রি-ডি দেহ উদাত্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল – কী রে ক্লর্ক্! তোর কী চাই?
- আমার… আমার… ভাল্ভ?
ক্লর্কনের প্রকাণ্ড দেহ তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ভীতু ক্লর্ক্টার বুকের মাঝখানে একটা মোচড় দিয়ে বলল – এই নে ফুল টাইট করে দিলাম। যতদিন ওই রেডিওর গান তুই শুনতে থাকবি ততদিন তার ট্রান্জিস্টারগুলোই তোর ভাল্ভের কাজ করে যাবে। রেডিও আর আমার কাছাকাছি থাকবি। তোর কিচ্ছু হবে না।
- থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যাডমজী…
আস্তে আস্তে দুটো পা ঘষতে ঘষতে ক্লর্ক্ ভিড়ের পিছনে অদৃশ্য হয়ে যায়। ক্লর্কন্ তাকে দৃষ্টির মধ্যে রাখতে চাইছিল। কিন্তু দ্রত অন্ধকার হয়ে আসছে এবং পাখিগুলো কলরব করতে করতে ক্লর্কনের দেহের উপর এসে সেটাকে ঢেকে দিচ্ছে। বোট ক্লাবের বাতাসটা হয়ে আসছিল ভিজে এবং শীতল। অসংখ্য ফ্ল্যামিঙ্গো আর হাঁসের নিচে হারিয়ে যেতে যেতে ক্লর্কন্ বুঝতে পারছিল আসলে সে ক্লর্কন্ নয়, এই টিলার নিচে শুয়ে থাকা কোনো আদিম জগতের বাসিন্দা, হয়তো আকাশের লাল পর্দার চেয়েও পুরোনো কালের কেউ। ক্লর্কনের রূপ ধরে কিছুকালের জন্য এই শহরের উপরে সে এসেছিল একটা মরসুমী ছুটি কাটাতে, কিম্বা সেই পৃথিবীটাকে উপভোগ করতে, যেটাকে সে একদিন নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবে টিলার নিচের লাভার সাগরে।
- ম্যাডমজী, আপনার আরেকটা বাস এসে গেছে, এটা মিস্ করবেন না। এবার আমিও চলে যাব।
লংড়ার কথায় চমক ভেঙেছিল ক্লর্কনের। সত্যি একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। জন-মানুষ প্রায় উধাও। লংড়া তার চাটের ঠেলা তুলে ফেলেছে। সাউথ ব্লকের দেয়াল থেকে দলে দলে নেমে এসে ফুটপাথ দখল করছিল বাঁদর আর হনুমানগুলো। আর দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন না। লংড়াকে টা-টা করে ক্লর্কন্ ছুটে তার বাসে উঠে পড়ার পর দেখল ক্লর্ক্ নিজের বেড়ার খুঁটি ছেড়ে গুটি গুটি এগিয়ে চলেছে পার্লামেন্ট সার্কেলের দিকে। সে কি আজ বাস নেবে না?
মল্হারে দিনের শেষ গানটা বাজছিল।
ইয়হী কহোগে তুম সদা, কি দিল অভী নহীঁ ভরা
যো খতম হো কিসী তরহ, ইয়ে অ্যায়সা সিলসিলা নহীঁ…
(এই তো বলবে সারাক্ষণ, এখনো যে ভরেনি মন
কোথাও গিয়ে যা শেষ হয়, মোটেও এমন গলি এ নয় ...)
অভী না যাও ছোড়কর, কে দিল অভী ভরা নহীঁ…
ক্লর্কন্ নিজেকে কোনোদিন পাষণ্ড বা পত্থর-দিল বলে ভাবেনি। তাও একটা ভাল্ভ খারাপ হয়ে যাওয়া এই ক্লর্কের জন্য তার মনে খুব একটা দুঃখ হচ্ছিল না। বরং এই অবাস্তব ধারণাটা তার মনে জন্ম নিচ্ছিল যে শহর আর সময়ের ভবিষ্যতের পুরোটা একদিন এসে জড়ো হবে একটা ক্লর্ক্ আর একটা ক্লর্কনের হাতের মুঠোয়।
তুঙ্গ বসন্তের পাগলামি ভর না করলে এরকম একটা হাস্যকর বিশ্বাস পায় কেউ?
এর পরের দিনগুলোতে যখন কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো হাওয়ায় পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাসাতে শুরু করেছে তখন প্রতিদিন বিকেলে ক্লর্ক্ আর ক্লর্কনকে মল্হারের আশেপাশে পাওয়া যেত। লংড়া দ্রুত হাতে কেটে চলত চিকু আর কামরাঙা। ছোটু একটা ফিল্মের ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেটা পড়ার চেষ্টা করত। রুটিনমাফিক চলা যৌথ পরিবারের মতো শান্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে চলেছিল শহরের চারটে ভিন্ন ধরনের চরিত্র। অবশেষে তাদের এই নিরুপদ্রব জীবনযাপনে যখন ছেদ এল তখন তা এসেছিল সাউথ ব্লকের দেয়াল বেয়ে। ঝড়ের মতো এই সুখী চারটে প্রাণীর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় বিপর্যয় ঘটাতে চলে আসে একটা বদতমীজ আর জাহিল জানোয়ার।
বসন্তের দিনগুলো সে বছর যেন শেষ হতে না চাইছিল না। তবু রৌদ্রের প্রখরতার একটু একটু করে তীব্র হয়ে ওঠা আটকানো যায় না। গরম বাড়লে সাউথ ব্লকের দেয়ালের বাঁদরগুলো ক্রমশ বেপরোয়া আর বদমেজাজী হয়ে ওঠে। সন্ধ্যে হবার আগেই তারা ফলের ঠেলায় ডাকাতি করার আশায় ঘুরঘুর করতে শুরু করছিল। লংড়ার হাতের চাকুটাকে সবাই যমের মতো ভয় পেত বলে রক্ষে। লংড়া বাতাসে সেটা সাঁই সাঁই করে ঘুরিয়ে তাদের মনে করিয়ে দিত কুচ করে যা দিয়ে সে শশা কেটে আধখানা করে, তাই দিয়েই একটা লেজ দুখণ্ড করতে তার একটুও বাধবে না। তো একদিন সেই চাকুকেও উপেক্ষা করে সাউথ ব্লকের দেয়াল বেয়ে নেমে আসা একটা ক্ষ্যাপা হনুমান দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লংড়ার ঠেলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দু-একজন খদ্দের যারা কাছাকাছি ছিল বাপ-বাপ বলে অমনি পগার পার। জানোয়ারটা ততক্ষণে এককাঁদি কলা হাতে তুলে ঠেলার অন্য এক কোণে গিয়ে বসেছে। লংড়া তার নাগাল না পেয়ে – ‘তেরী তো’ বলে হাতের একটা ভারী আনারস গায়ের জোরে হনুমানটার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। অচুক ব্রহ্মাস্ত্রের মতো সেটা গিয়ে আছড়ে পড়ে জন্তুটার বুকে এবং ধাক্কার চোটে কলার কাঁদি তার হাত থেকে খসে যায়। বাঁদরটা ডিগবাজি খেয়ে পড়েছিল বটে মাটিতে, কিন্তু পরমুহূর্তে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠেও পড়ে। তারপর যা ঘটে সেটা আগে অনুমান করতে পারলে লংড়া কিছুতেই আনারসটা ছুঁড়ত না। আক্রোশের মাথায় আর কিছু না পেয়ে হতচ্ছাড়া জানোয়ারটা মল্হারকে দুহাতে তুলে নিয়েছিল। তারপর সেই বোম্বেটে পশু ধ্বংসস্তূপ থেকে ইঁট সরাবার কায়দায় নির্দোষ রেডিওটাকে রফি আহমেদ কিদওয়াই মার্গের দিকে নির্মমভাবে ছুঁড়ে দেয়।
তখন বাসস্টপের দিকে তাক করে তিনটে বাস গোঁ গোঁ করে আসছে। বন্যার মতো চলেছে স্কুটার আর ট্যাক্সি। ‘গেল গেল’ রবের মধ্যে ক্লর্কন্ তার সুখের দাঁড় ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছিল রেডিওটাকে উদ্ধার করার জন্য। ওদিকে ক্লর্কও একটা ডাইভ দিয়ে রাস্তায় নেমে গিয়েছে বাসগুলোকে থামাবে বলে। তিনটে বাস ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক মেরে যখন থামে তখন তার প্রথমটা ক্লর্ক্ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই চলে এসেছে। জে-কে ঠিক এক মুহূর্ত আগে খটারা হৃদপিণ্ড সহ সরে না পড়লে তার হয়ে যেত। ক্লর্কন্ রাস্তায় নেমে মল্হারকে তুলতে যাবে এমন সময় অভাবনীয় দুর্ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল। শয়তান সেই হনুমান এক লাফে মাথার উপর দিয়ে এসে পড়ে ক্লর্কনের মুখের সামনে, এবং প্রকাশ্য দিবালোকে রেডিওটাকে ছোঁ মেরে তুলে নেবার পর সমস্ত ট্র্যাফিককে কলা দেখাতে দেখাতে একটা অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো রফি মার্গ ক্রস করে যায়।
মল্হার রাস্তায় ছিটকে পড়েও কিন্তু খুব একটা আহত হয়নি। সে মনের সুখে এমন একটা গান বাজিয়ে চলেছে যার সঙ্গে এ সবের একটা ক্ষীণ সম্পর্ক যদি থাকেও তো সেটা নিশ্চয়ই অনভিপ্রেত –
মুঝে দুনিয়া ওয়ালোঁ শরাবী না সমঝো,
ম্যাঁয় পীতা নহীঁ হুঁ পিলাঈ গঈ হ্যায়
যহাঁ বেখুদী মেঁ কদম লড়খড়ায়েঁ,
উয়োহী রাহ মুঝকো দিখাঈ গঈ হ্যায়…
ক্লর্কন্ চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল – আরে, নিয়ে গেল! নিয়ে গেল! হাঁ করে সবাই দেখছ কী? কেউ ধরো!
জে-কে সবে একটা লাফ মেরে নিজেকে বাসের টায়ারের নিচ থেকে বাঁচিয়েছে, সে ফুটপাথে ফিরে না এসে ‘ট্র্যাফিককে মার গুলি’ বলে লপকায় হনুমানটার পিছনে।
দেখা গেল বাঁদরটা উলটোদিকে রেলভবনের ধার ঘেঁষে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে সংসদের দিকে। কোনো মানুষকে সে পাত্তা দিচ্ছে না। জে-কে তার ছ-ফুটের মধ্যে এসে পড়লে সে এক লাফে দশ ফুট এগিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ বাদে দেখা গেল হনুমান বেপাত্তা, জে-কেকেও পাওয়া যাচ্ছে না, ট্র্যাফিক যেমন চলছিল তেমনই চলছে। শুধু লংড়া মাটিতে ছড়িয়ে যাওয়া ফলগুলোকে ঝেড়েঝুড়ে তুলছে আর ক্লর্কন্ মাথায় হাত দিয়ে ঠেলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
- হায়, হায়! কী হবে লংড়াজী?
- ম্যাডমজী, গরীবের জীবনে লস্ তো আসতেই থাকে। এই বাঁদরগুলোর একটা এবার আমার হাতে খুন হবে। নিজেদের রক্ত না দেখলে ওরা আমাদের রেহাই দেবে না।
- তারপর সবাই মিলে যদি আক্রমণ করে।
- কচুকাটা করব। কাউকে যদি রেয়াত করি তো আমি আমার মায়ের দুধ খাইনি। মরীয়া লংড়া নিজেকেই কথা দিয়ে ফেলল।
- বেচারা রেডিওটা তো গেল লংড়াজী। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল ক্লর্কন্। - ওর কী দোষ?
- হ্যাঁ, ওটা আপনাকে বেচে দেওয়া উচিত ছিল, তাহলে আজ বেঁচে যেত। কত দিন ধরে কত যে দারুণ দারুণ গান শুনিয়েছে আমাদের সবাইকে। বড় ভালো ছিল সে।
তারপর লংড়া আর ক্লর্কন্ মল্হারকে নিয়ে এমনভাবে কথা বলে গেল যেন সেটা একটা যন্ত্র নয়, রক্তমাংসের মানুষ, যার ভবিষ্যত আছে। কিছু স্বপ্নও থাকতে পারে।
পরের দিন জে-কে’র পাত্তা নেই। তার পরের দিনও তাকে দেখা গেল না। মল্হারের অভাবে দিনগুলো কেমন উদাস বিধুর হয়ে চলেছিল। ধুলো আর ধোঁয়া এসে আকাশটাকেও বোঝাই করতে শুরু করেছে। ক্লর্কন্ লংড়াকে জিজ্ঞেস করতে গেল জে-কে’র খবর জানে কিনা।
- ম্যাডমজী, মনে হয় বাঁদরের পিছনে দৌড়তে গিয়ে বাবুজীর ভাল্ভ উড়ে গেছে।
- ধ্যাৎ! কী করে জানলে? কেউ বলেছে নাকি তোমায়?
- পর পর দুদিন এই সিজিনে এলেন না, এরকম তো হয় না।
তারপর বিষন্ন ক্লর্কন্কে একটা মর্মান্তিক খবর শুনিয়েছিল লংড়া। সেও শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তাকে আর দেখতে পাওয়া যাবে না এখানে।
- কোথায় যাবে তুমি লংড়াজী? এত ভালো ব্যবসা তোমার? তুমি না থাকলে আমাদের ফল কে খাওয়াবে?
শোনা গেল শাদী ঠিক করে দেওয়া হয়েছে লংড়াজীর। এই সপ্তাহেই সে গাঁওয়ে ফিরে যাবে। ম্যাডমজী শুনলে খুশি হবেন, কিছু জমিজমা পাচ্ছে সে এই সৎকাজটার পুরস্কার হিসেবে। তাহলে চাষ কেন করবে না? জমির অভাবেই তো গাঁ ছেড়েছিল এককালে। বুড়ো বাপ-মাকেও দেখার সময় হয়েছে।
- তবে ফল আপনারা পেয়ে যাবেন। জানাল লংড়া। - ছোটুর মা আর ছোটু মিলে ঠেলাটাকে চালাবে। সব ভালো যার শেষ ভালো, বুঝলেন না। এই শহরে আমার মনে শান্তি আসছিল না। তাও একটা কীসের আশায় যেন পড়ে ছিলাম। রেডিওটা চলে যাবার পর আমার মোহ পুরোপুরি কেটে গিয়েছে। এখানে বন্দরের দাম মানুষের চেয়ে বেশি। সেই জন্যই বিয়েটাতে ‘হ্যাঁ’ করে দিলাম।
- মুবারক হো, লংড়াজী। বধাই হো! অভিনন্দন জানাবার পর ক্লর্কন্ চুপ করে যায়। তার নিজের বিয়েটা বিশ্রী ঝামেলা হয়ে আটকে গেছে। স্টাফ সিলেকশান কমিশনের পরীক্ষায় সফল হয়ে ক্লর্কনের চাকরি পাওয়ার সুখবর রটে যাওয়ার পর চমৎকার এক পাত্র নিজে থেকে হাতে এসে গিয়েছিল। নতুন বিজনেসম্যান, দুর্দান্ত করিৎকর্মা। এই বয়সেই ফ্যাক্টরি লাগিয়ে দিয়েছে। বাজার থেকে পুরোনো স্টিলের বাসন তুলে এনে একটা থালা গলিয়ে তা থেকে দুটো বানানোর ব্যবসা। ভালো লাভ থাকছিল, বাসনগুলো একটু পাতলা হত এই যা। সরকারি অফিসের ক্লর্কন্কে ভীষণ পছন্দও হয়েছিল তাদের। হবে নাই বা কেন? বাড়িতে অন্তত একজনের নিয়মিত মাসিক আয় থাকবে, একটা সরকারি কোয়ার্টারও পাওয়া যেতে পারে। পত্নীর আশ্রয়ে থেকে পাত্রটি মজাসে বিজনেসের রিস্কগুলো নিতে পারে। কথাবার্তা এতদূর এগিয়ে যাওয়ার পর কেলেঙ্কারি! কয়েকমাস আগে কী একটা সরকারি কন্ট্র্যাক্টে গড়বড় হয়ে যাওয়ায় ছেলেটার পাঁচ বছরের জেল হয়ে গেছে। অফিসে কাউকে লজ্জায় খবরটা জানাতে পারেনি ক্লর্কন্। বেচারা আবার জেল থেকে সনির্বন্ধ অনুরোধ পাঠিয়েছিল। পাঁচ বছর মামুলি ব্যাপার, গান্ধীজী, সুভাষজী এঁরা সব দস-পচ্চিস সাল গরাদের পিছনে ছিলেন। দেখতে দেখতে কেটে যায়। পাত্র স্বয়ং জেলে ঢুকলেও বিজনেস তো ডোবেনি। ছোট ভাই ফ্যাক্টরি চালাচ্ছে। ক্লর্কন্ যেন কটা দিন সবুর করে।
কী করা হবে সেটা অবশ্য এখনো ঠিক হয়নি। ক্লর্কনের দাদা চিঠিটা পড়ে প্রশ্ন তোলে – গান্ধীজী কেন জেলে যাওয়ার আগেই বিয়েটা সেরে নিয়েছিলেন? কারণ তিনি বোকা ছিলেন না। তিনি জানতেন জেল খাটাকে কেউ বিয়ে করে না। দাদার বউ, প্রাইমারি স্কুলে গণিত পড়ায় যে, সে বলল – সুভাষজী ক্যালকুলেশানে ভুল করে বিয়ের আগেই জেল খাটতে চলে যান। তারপর বেচারা স্বদেশে কোনো পাত্রী পেলেন না। মা কুন্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করেছিল – নেহরুজী? দাদা দাঁত বের করে বলে – গান্ধীজীর শিষ্য তো! সেরকমই চালাক। আগে বিয়ে, পরে জেল। ভাবীজী অবশ্য বলেছিল – নেহরুজী স্পেশাল। ওনার জেলের পরেও বিয়ে হয়ে যেত। একে তো রূপে-গুণে অতুলনীয় পুরুষ একজন। তার উপরে নিজেও জেল ফেরত মেয়ে পছন্দ করতেন। সে জন্য বিয়ের পর বউকে হাজত বাস করে আসতে হয়। এইরকম নানা ধরনের আজেবাজে আলোচনার পর শেষে সবাই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় যে জেল থেকে বেরোবার আগে ছেলেটার সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে গেলে বিরাদরীতে ছ্যা-ছ্যা পড়ে যাবে। একমাত্র ছোটি (মানে ক্লর্কন্) নিজে যদি কিছু করে জেলে চলে যেতে পারে তাহলে আত্মীয়রা কেউ এই রিশতা নিয়ে আপত্তি তুলবে না।
ক্লর্কনের আর সহ্য হয়নি। আলোচনাও এখানে থেমে যায়। তারপর বাড়ি থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে ব্যাপারটা। নিজের কপালের কথা ভাবলে বিরক্ত লাগে ক্লর্কনের। মল্হার চুরি হয়ে যাওয়া যেন একটা বিধাতার নির্দেশ। বোটক্লাবে দাঁড়িয়ে আকাশের গায়ে ভবিষ্যত দেখা এবার বন্ধ করতে হবে। সময়ের শ্রাদ্ধ।
- সেটাই ভালো। লংড়াকে বলল ক্লর্কন্। আমিও আর আসব না তাহলে কাল থেকে। শুধু মাঝে মাঝে ছোটুর ঠেলা থেকে চাট নিয়ে যাব।
তারপর সত্যিই যা এতদিন ভাবা যায়নি তাই হল। বোট ক্লাবের সামনে মল্হারকে কেন্দ্র করে যে সুন্দর যৌথ পরিবারটা গড়ে উঠেছিল সেটা তার চুরি হয়ে যাওয়ার পর রাতারাতি ভেঙে গিয়েছিল। ক্লর্কন্ ছুটির পর আর সেখানে আকাশ দেখতে আসত না। তাড়াহুড়ো করে একটা আগের বাস ধরে সে ফিরে যেত বাড়ি। ছোটু আর তার মা চাটের ঠেলা নিয়ে রোজ দাঁড়ালেও চাট কেনা হত কদাচিৎ।
দেখতে দেখতে এরপর গ্রীষ্মের দিনগুলো পেরিয়ে গিয়েছিল। ছোটুর কাছে ক্লর্কন্ খবর পেয়েছিল লংড়ার বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়ির জমিজমার দেখভাল তাকেই করতে হয় এখন।
তারপর? তারপর দিনগুলো ফোঁটা ফোঁটা করে কিছুদিন ঝরার পর স্রোতের মতো বইতে শুরু করে। দেখতে দেখতে সপ্তাহ, পক্ষ, মাস কেটে যায়। ঝরে যাওয়া ফুল আর পাতা যেমন বসন্ত আসার পরে দ্বিতীয়বার গাছে ফিরে যেতে পারে না, তেমনই ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলো আর জোড়া লাগেনি।
সারসগুলো বহু আগেই ফিরে গেছে সাইবেরিয়ায়। বোটক্লাবের জলের তলা থেকে সন্ধ্যেবেলা হারিয়ে যাওয়া গ্রামের মানুষদের দীর্ঘশ্বাস উঠত রোজকার মতো। তার দুদিকের সরকারি মন্ত্রালয়গুলোর উপর হাওয়ায় পতপত করে নড়তে নড়তে হঠাৎ থেমে যেত জাতীয় পতাকা। নর্থ আর সাউথ ব্লকের মাঝখানের বড় পর্দাটায় ছোটু তার ভবিষ্যতের চেহারাগুলো দেখবে না বলে লংড়ার মতো সেদিকে পিঠ করে দাঁড়াচ্ছিল বিকেলবেলা।
বর্ষার মরসুমের প্রথম দিন।
বছরের এই দিন আকাশের পর্দাটা সমস্ত টেকনিকালারের রং মুছে একটা ফ্যাকাশে জল রঙের ক্যানভাস খুলে বসে মেঘের নীল আর কালো ছবিগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য। সেদিন ক্লর্কন্ দুর্ভাগ্যবশত তার বাস ধরতে না পেরে আবার এসে দাঁড়িয়েছিল বোটক্লাবের পাশের বেড়াটার গায়ে। বৃষ্টি পড়ছিল বলে ছোটুর ঠেলাও উধাও। লোকজন অল্প। মাঝে মাঝে ফুটপাথের উপর রাস্তার জল ছিটিয়ে এক একটা বাস এসে চলে যাচ্ছে। মনমরা ক্লর্কন্ যখন আকাশের দিকে চেয়ে নিজের ছায়াছবিগুলো খুঁজে কোথাও পাচ্ছিল না তখন একটা বিশাল হুডখোলা ইম্পালা গাড়ি রফি মার্গের উপর এসে থামে। ক্লর্কন্ দেখেছিল সেটা চালাচ্ছে বছর ত্রিশের এক রোমশ যুবক। এই মেঘলা দিনেও তার শুঁয়োপোকার মতো ঘন ভুরুর নিচে কালো রোদচশমা। যুবকের হাতকাটা জামার বুকে একটা মোটা সোনার লকেট, মুখে চুরুট। পাশে একই রকম জামা আর সোনার চেন পরা উপযুক্ত এক স্যাঙাত, ফাউ হিসেবে যার মাথায় টাকের সঙ্গে কন্ট্রাস্ট করে ডাকাতদের মতো ছ ইঞ্চি লম্বা ঝোলানো গোঁফ। এই দ্বিতীয় নমুনাটার চোখেও রোদচশমা। গাড়ির পিছনের বিরাট সিটটাতে ক্লর্কনের চেনা আরো দুজন ক্লর্কন্ ডিমের উপর তা দিতে বসা দুটো ডোডো পাখির মতো জাঁকিয়ে বসে ছিল। তারা হাতছানি দিয়ে ক্লর্কন্কে ডাকছিল – চলে আয়, দৌড়ে আয়। বৃষ্টিতে রাস্তায় ভিজবি কেন? গাড়িতে উঠে পড় না?
- কিন্তু এটা তো একটা হুডখোলা গাড়ি! আমিই বরং একটা ছাতার নিচে শুকনো হয়ে আছি।
- আরে ম্যাডম, বৃষ্টিতে হুডখোলা গাড়ি চেপে যেতেই সবচেয়ে মজা। গাড়ির ড্রাইভার তার লোমশ বুক চুলকোতে চুলকোতে দাঁত বের করে বলে। - শুকনো হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আপনার কী লাভ হয়েছে?
অন্য সময়ে এরকম একটা মানুষকে দেখে ক্লর্কনের ভয় আর বিতৃষ্ণা হত। আজ বর্ষার প্রথম দিনে কিন্তু তার মাথা অন্যরকমভাবে কাজ করছিল। ক্লর্কন্ ভাবল আকাশের পর্দায় অর্থহীন ভবিষ্যত দেখার ফাঁদ থেকে পালাবার এই তার শেষ সুযোগ। লংড়া এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চিরকাল লড়েছিল। এমনকী জে-কেও সব বন্ধন কাটিয়ে বোট ক্লাবের পাড়া ছেড়ে গিয়েছে। তাহলে সে কেন একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী সেজে সময়ের স্রোত থেমে যাওয়ার অপেক্ষায় এখানে আটকা পড়ে থাকবে? বৃষ্টির দিনে একটা ছাদখোলা গাড়ির যুক্তিহীন উন্মত্ততাই তাকে এখান থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত বাহন।
হঠাৎ একটা গান কোথা থেকে ভেসে আসছিল তাকে সাবধান করার জন্য। হয়তো ক্লর্কনের মনের ভিতর থেকে তার অতীত তাকে ধরে রাখার জন্য গাইছিল –
রেশম কী ডোরী,
কহাঁ যই হ্যায় নীন্দিয়া চুরা কে চোরী চোরী …
রেশম কী ডোরী…
ক্লর্কন কানে আঙুল দিল। তারপর সে ছাতা বন্ধ করে এক ছুটে গিয়ে উঠেছিল সেই গাড়িটাতে।
সবারই যাওয়ার কথা উলটোদিকে। ক্লর্কন্কে তুলে নেবার পর ইম্পালা কিছুদূর এগিয়ে বিদেশ মন্ত্রালয়ের বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ায়। তারপর রাস্তায় আর কোনো গাড়ি নেই দেখে যখন ইউ-টার্ন করে সেটা আবার বোটক্লাবের দিকে ফিরছিল, তখন চুন্নি দিয়ে মুখ ঢেকে বৃষ্টির ছুরির মতো ফলাগুলো উপভোগ করতে করতে তিনটে ক্লর্কন্ একসঙ্গে সেই গান আবার শুনতে পায়। তাদের একজন বলল – আচ্ছা এই আওয়াজটা চেনা চেনা লাগছে না?
এতক্ষণ পরে ক্লর্কন্ বুঝতে পারে যে শব্দটা তার মন থেকে বা অতীত থেকে আসেনি। এটা আসছিল বোটক্লাবের ধারের বেড়ার গা থেকে। সে তাড়াতাড়ি দু হাত তুলে বলে – আরে রোককে, রোককে।
- কী হল?
- আমার একটা জিনিস রয়ে গেছে এখানে, সেটা আনতে যেতে হবে ভাই। ভীষণ দুঃখিত। কিছু মনে কোরো না কেউ। জিনিসটা আমার চাইই।
গাড়ি থামল এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্লর্কন্কে নামিয়ে দিল সবাই। কয়েকটা আপশোসসূচক শিষ্টাচারের কথা আদানপ্রদানের পরে সেটা হুস্ করে বেরিয়েও গেল নিজের পথে। ক্লর্কন্ আবার ছাতা খুলে যখন রফি আহমেদ কিদওয়াই মার্গ ক্রস করছিল তখন সে লোকটাকে দেখতে পায়।
শৌখীন বর্ষাতি আর হ্যাট পরে বোটক্লাবের গায়ে হেলান দিয়ে গান শুনছিল জে-কে। যেন বৃষ্টিতে তার কিছুই আসে যায় না। ভাল্ভও রয়েছে ফার্স্টক্লাস। কিন্তু যন্ত্রটা কোথায়? রাস্তা অতিক্রম করে ক্লর্কন্ তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল – রেডিওটা আছে?
- পাওয়া গেছে! এক গাল হেসে জানাল জে-কে। তার বর্ষাতির আড়ালে রাখা মল্হারের মুখ ক্লর্কন্কে একবার দর্শন করিয়ে দেয় সে। - ক’দিন ধরে এটার ফিকিরেই ছিলাম আর কি। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে। ব্যাটারি ফুরিয়ে গিয়েছিল। যাবে না? চব্বিশ ঘন্টা চালাচ্ছিল হনুমানটা। গান শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের দলের একটা মসীহা টাইপের হয়ে গিয়েছিল ব্যাটা। চেলা-চামুণ্ডারা চারদিক থেকে ঘিরে রাখত। রকাব গঞ্জের ধারে সবাই চিনে যায়। তো রেডিওর আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেচারার রোয়াব শেষ। শিষ্যরাই ল্যাজ ধরে দল থেকে বার করে দিয়েছে। তখন তালকটোরা রোডের মোড়ে বসে যে বুড়িটা ভিক্ষে-টিক্ষে করে, হনুমানজী তার শিষ্য হয়ে বসে যান। রেডিও পাশে পড়ে থাকত। আমি বুড়িকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেড়শো টাকায় কিনে নিয়েছি। একটু ড্যামেজ ছিল। সেটা কাল রাতে সারিয়ে নিলাম।
- শাবাস! স্বতস্ফুর্তভাবে ক্লর্কনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে শব্দটা। - ভিতরে কিছু ক্ষতি হয়নি তো। ভাল্ভ-টাল্ভ সব ঠিক আছে?
জে-কে ক্লর্কনের দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। - ভাল্ভ হয় না এই সব রেডিওতে। ট্রান্জিস্টার থাকে। সবকটাই ঠিক আছে।
- গুড, গুড! শাবাস! আরেকবার আলংকারিক অর্থে পিঠ চাপড়ে দেয় ক্লর্কন্। - আচ্ছা, লংড়া তো গ্রামে চলে গেছে। এবার রেডিওর কী হবে?
- লংড়ার সাথে কথা হয়ে গেছে বলেই না এটাকে বাজাচ্ছি। রেওয়াড়িতে তার বাড়ি অবধি গিয়েছিলাম। সে রেডিওটা আমাকে ন্যায্য দামে বেচে দেয়। টাকা তার হাতে দিয়ে এসেছি।
- দাঁড়ান, দাঁড়ান! আপনাকে বেচবে কী করে? ওটা তো আমি চেয়েছিলাম লংড়ার কাছে।
- কিন্তু বাঁদরের হাত থেকে তো আমিই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি না? জে-কে একটু গম্ভীর হয়ে জানায়। - লংড়া বোধহয় সে জন্য একটু কৃতজ্ঞ বোধ করছিল। কৃতজ্ঞতাবোধ বেশ ভালোই আছে কিনা ছেলেটার। ক্ষুন্ন হয়ে ক্লর্কন্কে শুনিয়ে দেয় জে-কে।
- অ। আচ্ছা, তাই হবে। একটু অধৈর্য হয়ে জানায় ক্লর্কন্। - যাহোক, এবার আমাকে এটা দরদাম না করে শরীফ আদমীর মতো বেচে দেবার কী নেবেন?
ক্লর্ক্ হাত দুটো জোড় করে ফেলে। - ম্যাডমজী, আমি এটা বেচতে চাই না। এই রেডিও না শুনলে আমার মন ভালো থাকে না। বুক ঢিপ ঢিপ করে। মনে হয় এটা হারিয়ে ফেললে আর বাঁচব না।
- ওরকম অনেকেরই মনে হয়। পরে সবাই মানিয়ে নেয়। আমারও এর রেডিওটা খুব দরকার। কীরকম দরকার সেটা কেউ বুঝবে না।
- আকাশের সিনেমা দেখার সময় কি এটা আপনাকে রানিং কমেন্ট্রি দেয়? আমাকে দেয়। তার চেয়েও বেশি দরকার আপনার?
ক্লর্কন্ কিছু না বলে চুপ করে যায়। কারণ রেডিওটা কথা বলতে শুরু করেছিল। সে বলছিল এক্ষুনি বৃষ্টি ধরে যাবে। আকাশ হয়ে যাবে পরিষ্কার। শো আবার শুরু হতে চলেছে। তোমরা কি ঝগড়াই করে যাবে না গানও শুনবে একটু?
তেরে নাম কর দুঁ জিয়া,
লে আ পট-ওয়ারী -
ক্যায়সা পটওয়ারী…
বেশ কিছুক্ষণ গানই চলে এর পর। মল্হারকে বেড়ার গায়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল জে-কে, যাতে সে আর ক্লর্কন্ সমান দূরত্ব থেকে তাকে নজরে রাখতে পারে। পরে জে-কে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল – চিন্তা নেই। আমার কিছু হলে যন্ত্রটা আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা হবে।
- কীভাবে?
- ছোটু নিয়ে আসবে। আমার প্রমিস।
- আর আপনার কিছু না হলে? বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকেন যদি?
- তাহলে তো এই বেড়ার ধারেই আসছি প্রত্যেকদিন। আকাশ দেখার সময় এটাকেও পেয়ে যাবেন পাশে।
- অন্য কাউকে বেচে দেবেন না তো?
- নেভর! বেচব না, খারাপও হতে দেব না। ছটা ট্রান্জিস্টারের স্পেয়ার আগেই যোগাড় করে রেখেছি। আরো যোগাড় করে নেব। নিজেই মেরামত করতে জানি। আমার নানাজী শর্টওয়েভ রেডিও বানাতে পারতেন।
- যাই করুন, খারাপ তো হবেই একদিন।
- এর মজাটা কী বলুন তো? আওয়াজের ডিফেক্ট আসছে বডির একটা ক্র্যাক থেকে। ভিতরের মালমশলা যতই পালটাই না কেন, বডি না পালটালে এটা আগের মতো কথা বলে যাবে। ফর এভার!
- চিরকাল? আরে দূর! হাসাবেন না। ফর এভার কিছু হয় নাকি?
- মানে আমাদের ভবিষ্যতের শো চলবে যতদিন, ততদিন পর্যন্ত। যথেষ্ট নয়? গ্যারান্টি দিচ্ছি আমি।
ওঃ, কত বড় পালোয়ান! গ্যারান্টি দিচ্ছেন দেখো! মনে মনে বলল ক্লর্কন্। আর বুকের ভাল্ভটার গ্যারান্টি দিচ্ছে কে? সেটা তো দিচ্ছি আমি!
তারপর? তারপর আর কী? যেমনটা চিরকাল হয়। আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবার পর অন্ধকার আসে। আবার আলো ফোটে তাতে। একটা দিন চলে যায়। আরেকটা আসে। এইভাবে কত যে দিন এল। কত রাত। বর্ষা গিয়ে এল শরৎ, শীত, বসন্ত। আবার বর্ষা। সূর্যকে ঘিরে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরে যেতে লাগল পৃথিবী আর অন্যান্য গ্রহগুলো। সাইবেরিয়া থেকে ডিম পাড়তে এল সারস, আফ্রিকা থেকে বেড়াতে এল ফ্ল্যামিঙ্গো। আকাশের পর্দায় অসংখ্য শো এল আর গেল।
রবিবার বাদে ক্লর্ক্ তার রেডিও নিয়ে হাজির হত প্রতিদিন। কখনো কখনো ক্লর্কন্ আগেই এসে অপেক্ষা করত তার নিজস্ব স্থানে। সত্তর মিলিমিটারের পর্দায় টেকনিকালারের শো শুরু হয়ে যেতে নির্দিষ্ট সময়ে। কখনো খালি চোখে আর কখনো রোদ চশমা পরে ক্লর্ক্ আর ক্লর্কন্ অবাক বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত তাদের ভবিষ্যতের ছবিগুলো দেখার জন্য। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে এক-আধটা বাক্যালাপ হত, যদিও বেশিরভাগ সময় কথা চলত রেডিওটার মাধ্যমে।
পরে ক্লর্কন্ বুঝেছিল তারা দুজন পাশাপাশি দাঁড়াবার পর থেকে একই চলচ্চিত্রও দেখতে শুরু করেছে। এমনকী তার প্রকাণ্ড চ্যাটালো-বর্তুল প্রাগৈতিহাসিক আলোর মূর্তিটা যখন প্রাচীন পৃথিবীর পশু পাখিদের মন রাখার জন্য বোট ক্লাবের ময়দানে উপঢৌকনের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হত তখন ভাল্ভ ঠিক করাতে আসা আলোর তৈরি ক্লর্কের মূর্তিটার চোখের ভিতর দিয়ে যে আসল জে-কে সেই দেহটাকে দেখতে পাচ্ছে এটাও জে-কে’র হাবভাব থেকে সে বুঝে গিয়েছিল। প্রতিবার তার থ্রি-ডি মূর্তির ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে টাইট করতে করতে জে-কে’র খটারা ভাল্ভটাকে সে প্রায় নতুনের মতো করে দেয়। সেই জন্য জে-কে নামের সেই শৌখীন ক্লর্কের শরীর প্রতি ঋতুতে আগের চেয়ে ঋজু হয়ে যেত। ক্লর্কনের পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাঁটাচলাতেও একটা ছন্দ এসে যাচ্ছিল তার।
ধীরে ধীরে এইভাবে মামলা আরো সঙ্গীন হতে থাকে, বদলে যেতে থাকে পুরোনো শহর। ভেঙে পড়ে কিছু বিল্ডিং। নতুন রাস্তাঘাট আর বাড়ি উঠে আসতে থাকে। একটা কিস্সার হাত ধরে আসে আরেকটা। একটা ভাঙনের সূত্র ধরে আরেক ভাঙন। কারো জীবনে সমস্যা বাড়ে, কেউ পায় সমাধান। জাতীয় পতাকার রং পালটে যায়, মানুষগুলোর পালটে যায় মুখ আর পরিচ্ছদ। ইতিহাসের একটা পরিচ্ছেদের পাতা উলটে আরেকটা এসে যায়। একটা জাতি, একটা প্রাণী, একটা সভ্যতা লুপ্ত হয়ে অন্য একটা দাপিয়ে রাজত্ব করতে থাকে। কখনো উত্থান, কখনো পতন, কখনো বিলয়, কখনো অভ্যুদয়, সময়ের রুটিন মাফিক যা কিছু হবার তা হয়ে যায় নিজস্ব বিধানে। এর মধ্যে কিছু কিছু খবরের হয়তো গুরুত্ব ছিল। বেশির ভাগেরই ছিল না। কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাও কিছু ছিল হয়তো।
মোটকথা এইভাবে যুগের পর যুগ ধরে রায়সীনা টিলার উপত্যকায় অপেক্ষা করে থাকা কয়েকটা চরিত্রের প্রিয় আকাশটাকে এক সময় বড় হতে হতে গ্রাস করে ফেলে নিভে যাওয়ার মুখে শেষবার জ্বলে ওঠা সৌর মণ্ডলের একটামাত্র সূর্য।
টিলাটাও ছিল না আর তারপর। আকাশে কোনো আলো বা বায়ুমণ্ডল না থাকায় বহুদূর পর্যন্ত অবারিত দৃষ্টির নাগালে চলে এসেছিল ভবিষ্যতের নীহারিকাগুলো। ধ্বনিহীন মহাশূন্যের সম্মুখে ছড়ানো নিরুত্তর ব্যবধানে কোনো ইতিহাস বা প্রাণের স্পন্দন ছিল না আর। অতীতের সমস্ত গল্প কালের গর্ভে বিলুপ্ত। শুধু অগুনতি তারা আর ছায়াপথের পর্দায় ভবিষ্যতের শো তখনো চলছিল।
কিন্তু এরকম একটা শো চালাতে গেলে তার কিছু মুগ্ধ দর্শক তো চাই। কোথায় তাহলে তারা?
এক আকাশ জ্যোতিষ্ক-ভরা পর্দার সামনে অবাক বিস্ময়ে একটা ক্লর্ক্, একটা ক্লর্কন্, আর একটা লাইফটাইম গ্যারান্টি পাওয়া টেলিফুঙ্কেন রেডিও।
(শেষ)
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ এই লেখায় ব্যবহৃত গানের পদগুলো বিভিন্ন কবির রচনা থেকে নেওয়া হয়েছে। নিচে তাঁদের নাম দেওয়া হল:
হস্রত জয়পুরী (তুম্নে পুকারা অওর হম্ চলে আয়ে)
আনন্দ্ বক্শী (চমন-ওয়ালোঁ সম্ভল্ যাও)
মজরূহ সুলতানপুরী (ইয়ারী হো গয়ী ইয়ার সে)
ক্যায়ফী আজমী (সরে রাহ চলতে চলতে)
সাহির লুধিয়ানভী (অভী না যাও ছোড়কর)
নওশাদ (মুঝে দুনিয়া ওয়ালোঁ শরাবী না সমঝো)
আনন্দ্ বক্শী (রেশম কী ডোরী / তেরে নাম কর দুঁ জিয়া)