চিলি সম্পর্কে আমারই কি আগ্রহ হত, যদি না আমার ছেলে পুলস্ত্য পারেখ চিলির ভালডিভিয়া শহরে আসত পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার কাজে? ভালডিভিয়া শহরের CECS অর্থাৎ Centre de Estudios Cientificos (যা ইংরেজিতে অনুবাদ করলে হবে, Center for Studies in Science)- এ পদার্থবিদ্যার ‘স্ট্রিং থিওরি’ নিয়ে কাজ করছে সে।
কলকাতা থেকে দীর্ঘ যাত্রা চিলি। আমরা এলাম কলকাতা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে আবু ধাবি হয়ে আমেরিকার মায়ামি। সেখান থেকে কলম্বিয়ার বোগোটা হয়ে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো, অবশেষে সান্তিয়াগো থেকে ভালডিভিয়া। একনাগাড়ে আসি নি, মুম্বাইতে আর মায়ামিতে থেমে থেমে এসেছি।
আতাকামা মরুভূমি দেখতে যাওয়ার আগে ভালডিভিয়া শহর এবং তার আশেপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখেছি। ভালডিভিয়া শহরটি ছবির মতো সুন্দর। ভালডিভিয়ার যে অংশে আমরা ছিলাম সেটা নদী দিয়ে ঘেরা একটা দ্বীপ। কায়ে কায়ে (Calle-calle), কাউ কাউ (Cau-cau) আর ক্রুশেস (Cruces)— এই তিনটে নদী মিশে হয়েছে ভালডিভিয়া নদী। তিনটি নদীর জল বুকে নিয়ে ভালডিভিয়া নদী মিলিত হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। আতাকামা মরুভূমি দেখার আগেই চিলির দক্ষিণ অংশের যে জায়গাটায় বেড়াতে গিয়েছিলাম তাকে বলে Lake District। সবুজে মোড়া জায়গাটায় রয়েছে বেশ কিছু পাহাড়, আগ্নেয়গিরি ও হ্রদ। সেখানে প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ওদিকে দেশের উত্তর দিকে আতাকামা একেবারে শুষ্ক মরু অঞ্চল, কিন্তু সেটাও চিলির বিখ্যাত আকর্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম। পর্যটকদের কাছে চিলির মুখ্য আকর্ষণ দুটি— দক্ষিণের প্যাটাগোনিয়া এবং উত্তরে আতাকামা। প্যাটাগোনিয়া বেড়াতে যাওয়ার আদর্শ সময় হল গ্রীষ্মকাল, অর্থাৎ ডিসেম্বর-জানুয়ারি। দক্ষিণ গোলার্ধের এসব জায়গায় মার্চ মাসের শেষ থেকে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে, অল্পবয়স্ক ও অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় কেউ কেউ সে সময়ে সেখানে গেলেও আমার মতন বয়স্ক ও শীত-কাতুরে মানুষের পক্ষে সে সব করা মুশকিল। নানা কারণে আমাদের চিলি যাওয়াটা ঘটেছিল ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে, সুতরাং প্যাটাগোনিয়া দেখার পরিকল্পনা করাই হয়নি। এখানে বলে রাখা ভালো, মার্কিন ভিসা থাকলে ভারতীয়দের জন্য চিলি যেতে আলাদা ভিসা দরকার হয় না।
আতাকামায় প্রথম দিন
মঙ্গলবার (১২ মার্চ ২০২৪) আমাদের যাত্রা শুরু। সোমবার রাত থেকে খুব বৃষ্টি। যাই হোক, সকাল নটায় এয়ারপোর্ট নিয়ে যাওয়ার বাস এসে গেল। ভালডিভিয়া থেকে বের হয়ে কোথাও প্লেনে করে যেতে হলে প্রথমে সান্টিয়াগো যেতে হবে। সান্টিয়াগো থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার উড়ান আছে অনেক।
ছোটকুর (পুলস্ত্য) সঙ্গে ভ্রমণের মজা অন্য রকম, বিশেষ করে প্লেনে। প্লেনে উঠে ও ওর যন্ত্রপাতি সেট করে বসে। উড়ানের যাত্রাপথ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, উচ্চতা সব দেখা দরকার। আমি তো প্লেনে বসে মেঘ দেখা ছাড়া আর কিছুই বুঝি না। মেঘ ভেদ করে নীচের পৃথিবীতে কোথায় কী আছে অত ভেবে দেখি না। কিন্তু ছোটকুর সঙ্গে প্লেনে উঠলে নীচের পৃথিবীর নদী, পাহাড়, স্থলভূমির সঙ্গে পরিচিতি হয়। স্ক্রিন-এর ম্যাপ আর প্লেনের জানলা দিয়ে দেখা বাস্তব চেহারা মিলে যায়, জানার আগ্রহ বাড়ে। ‘ও তাইতো, আন্দিজ পর্বতমালা, তার ডানদিকে আর্জেন্টিনা; হ্যাঁ হ্যাঁ, বাঁদিকে সমুদ্র’। প্লেন থেকে আতাকামার বিস্তৃত মরুভূমি দেখা গেল। দেখা গেল ধূ ধূ বাদামি, গেরুয়া, এবড়ো-খেবড়ো, উচুঁ-নিচু ভূমির মাঝে সরু লাইন। ছোটকু জানাল ওটা রাস্তা, ঐ পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে। দেখেই শিহরিত হলাম। ছোটকু আগে একবার আতাকামা এসেছে, ওর গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। নিশুতি রাতে একা নির্জন দীর্ঘ পথে গাড়ি চালিয়ে আতাকামার সান পেড্রোতে এসেছিল, সে গল্প শুনেছি। আকাশ পথে দেখাল সেই সব জায়গা। পরে তো সত্যিই সেইরকম পথের কিছুটা অভিজ্ঞতা আমাদেরও হল।
সান্টিয়াগো থেকে অন্য একটা বিমানে করে যখন কালামা বিমানবন্দরে নামলাম, তখন সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। কালামার রানওয়ে আতাকামা মরুভূমির মধ্যে। প্রচণ্ড গরম। এখানে ছোটকু গাড়ি ভাড়া করল। কালামা থেকে সান পেড্রো ডে আতাকামা দেড় ঘন্টার পথ। রওনা হলাম আকাঙ্ক্ষিত পথে। পথ যত এগোচ্ছে, ততই বিস্মিত হচ্ছি। এ কী রে বাবা! এ তো মনে হচ্ছে পৃথিবীকে পিছনে ফেলে মঙ্গল গ্রহের দিকে চলেছে। গাছপালা নাই, পাথরের রঙ বিচিত্র। ঠোঁট ক্রমশ শুষ্ক হতে শুরু করেছে। এই শুষ্ক বিচিত্র আবহাওয়ায় কোন প্রাণীই থাকতে পারবে না, তায় আবার ট্যুরিস্টরা চলেছে! ট্যুরিস্টদের থাকা, খাওয়া, দর্শনীয় স্থান দেখানো কীভাবে সম্ভব বাপু, তা জানি না।
কালামা শহরটি হল আতাকামা মরুভূমি প্রবেশ-দ্বার। এই অসহনীয় গরমে লোকজনদের কাজকর্ম করতে হচ্ছে। সুসজ্জিত মেয়েদের এয়ারপোর্টে কাজ করতে দেখেছি। আতাকামার এই অঞ্চলে তামার খনি আছে, তার জন্য লোকজনের বাস। এক রীতিমতো কর্মচঞ্চল শহর কালামা। এখানে প্রচণ্ড হাওয়া। রাস্তার পাশে পাশে দেখলাম অনেক wind mill, প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া হাওয়াকে কাজে লাগানো হচ্ছে। দু-একবার গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের বৈরাগী রূপ দর্শন করা গেল। তবে হাওয়ার ধাক্কায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
বাড়ির ব্যবস্থাদি চমৎকার। প্রথমেই কফি বানিয়ে খাওয়া হল। বাবা ছেলে বের হল কিছু খাদ্যের সন্ধানে। আগেই বলেছি, জায়গাটার উচ্চতা প্রায় আট হাজার ফুট। আমার আবার high altitude-এ সমস্যা আছে, তাই বিশ্রামের জন্য বাড়ি থাকলাম। ঘুম নয়, একটু আচ্ছন্নের মতো ছিলাম। মনে হল অনেকক্ষণ সময় কেটে গেছে। বাইরে ওদের কণ্ঠস্বর শুনছি, কিন্তু উঠতে পারছি না, মাথা টলছে, চোখে ভালো দেখছি না। দরজা খুললাম। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাও করলাম, কিন্তু একটা অস্বস্তি হচ্ছে ভিতরে, কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। হঠাৎ খুব গরম লাগল, মাথায় যন্ত্রণা, চোখে কম দেখা। ভাবছিলাম ঘরের আলো বড্ড নিষ্প্রভ। সঙ্গে থাকা ইলেকট্রাল খাওয়ার পর একটু সুস্থির বোধ করলাম। ডি-হাইড্রেশন হয়ে গিয়েছিল। এখানে বাতাস অত্যন্ত শুকনো, আর্দ্রতা ১০%-এর কম। ছোটকুর মন খারাপ হল, দুশ্চিন্তাও হল। মা-র যদি সান পেড্রোতেই এই অবস্থা হয় তাহলে ১২ হাজার ফুট উচ্চতার Puritama আর ১৬ হাজার ফুটের El Tatio দেখবে কী করে? আটাকামার নানা জায়গায় বেড়ানোর প্ল্যান করেছে বাবা ও ছেলে মিলে।
আতাকামায় দ্বিতীয় দিন (১৩ মার্চ ২০২৪)
সারা রাত যদিও ঠিকঠাক ঘুম হল না, তবু সকালে শরীর তাজাই লাগল। High altitude sickness এর ওষুধ কিনে আনলে ভালো হত। আর কফি খাওয়াটাও ঠিক হল না। গুগ্ল-এ পড়েছিলাম হালকা খাওয়া, প্রচুর জল খাওয়া এবং coca tea খাওয়া ভালো। এখানে পৌঁছে পুরো একটা দিন বিশ্রাম নেওয়া উচিত।
সান পেড্রোতে যা গরম! ঘরে বসাই যাচ্ছে না। যথেষ্ট জল আর বিস্কুট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আজ যাব Termas de Puritama (Puritama Hot Spring)। ‘Puri’ মানে জল আর ‘tama’ হল গরম। এই জলে প্রচুর খনিজ পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, বোরন আছে। এই জলে অবগাহন করলে শরীর ও মন তরতাজা হয়। স্থানীয় মানুষেরা বহুকাল ধরে এই উষ্ণ প্রস্রবণের উপকারী জলের কথা জানেন, নানা ধরনের বাতের জন্য এই জলে স্নান উপকারী তো বটেই, সাধারণভাবে শারীরিক ক্লান্তিও নাকি দূর হয়ে যায়। এখানে ট্যুরিস্টদের ভিড় হয় খুব। টিকিট কেটে ঢোকার ব্যবস্থা। নেট-এর কল্যাণে আমার সঙ্গীরা আগে থেকেই প্ল্যান করে আজ এখানে আসার জন্য টিকিট কেটে রেখেছিল।
গাড়িতে করে পাহাড়ে উঠছি তো উঠছি, সঙ্গে থাকা যন্ত্রে বাবা আর ছেলে দেখছে কত উচ্চতায় উঠলাম। কিন্তু সেটা আর আলোচনা করছে না, পাছে আমি ঘাবড়ে যাই। ছোটকু কিছুক্ষণ অন্তর জিজ্ঞেস করছে জল খাচ্ছি কিনা। গাড়ির এসি-তে গরম লাগছে না। পথে কয়েকটা উঁচু উঁচু ক্যাকটাস দেখলাম। অবাক কাণ্ড, গুল্মলতাহীন রুক্ষ পাহাড়ের ফাঁকে ফোঁকরে অল্প অল্প নীলচে জলের ঝিলিক দেখা গেল। ছোটকু বলল, ‘ওখানেই আমরা যাব’। দৈত্যের মতো পাহাড়ের আনাচে-কানাচে শান্তির জল! এটাই Puritama, সমুদ্রতল থেকে সাড়ে এগারো হাজার ফুট উঁচুতে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথটা বারো হাজার ফুট উঁচু। আতাকামা মরুভূমির মধ্যে কিছু কিছু অংশ সবুজ, সেখানে আবার লেকও আছে। অনেক লেকই গরম জলের আধার কিংবা নুনের আধার। বলিভিয়া থেকে আসা মেঘ ভূমিতে ঝরে পড়ার সুযোগ পায়না। তার আগেই সূর্যের তেজ তাকে শুষে নেয়। তবে ঝরনার জল কোথা থেকে এল? এই ভূগর্ভস্থ জল মাটির তলায় থাকা গরম ম্যাগমার পাশ দিয়ে এসেছে, তাতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে এসে পাহাড়ের খাঁজের ভিতর দিয়ে উষ্ণ প্রস্রবণ রূপে বয়ে যাচ্ছে ঝরনার মতো। মাটির তলায় থাকা সেই ম্যাগমা-ই উচ্চ চাপে আগ্নেয়গিরির ভিতর দিয়ে বেরিয়ে লাভা হয়ে বেরিয়ে আসে। ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছিল।
ঝরনার কাছে যেতে হলে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে অনেকটা নীচে নামতে হবে, প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট। এই দুর্ধর্ষ দৈত্যাকার পাহাড়ের ওপরে কি মমতাময়ী জল থাকতে পারে? মানবসন্তানদের জন্য তাকে তো আড়ালেই থাকতে হবে। কষ্ট করে নেমে গিয়ে তপ্ত শরীরকে শীতল করো। ঝরনার জল জমে জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট ডোবা বা ‘pool’ তৈরি হয়েছে। সেই জল উষ্ণ ও আরামদায়ক (তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে)। তার ‘পুরিতামা’ নাম সার্থক।
পাহাড় থেকে হেঁটে নেমে তবু আসা যায়, তবে ওঠাটা বেশ কষ্টের, বিশেষত এই প্রখর রোদে। এদের ভালো ব্যবস্থা, আমাদের মতো লোকেদের ওপরে নিয়ে যাবার জন্য নিখরচায় গাড়ির বন্দোবস্ত আছে। এইরকম শাট্ল গাড়িতে চেপে আমরা ওপরে উঠে এলাম। এবার যাব বাড়ির পথে। পথের দৃশ্য দেখছি আর ভাবছি যারা এখানকার অধিবাসী তারা দিনের পর দিন থাকে কীভাবে? অবশ্যই প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বসবাস করে। স্কুলে বাচ্চারা যায়, মা-বাবারা নানা ধরনের কাজ করে। পর্যটন একটা বড় আয়ের পথ, তাছাড়া খনি আছে। শুনেছিলাম, আতাকামায় রয়েছে অনেকগুলো বড় বড় টেলিস্কোপ আর মানমন্দির। এই স্থান জ্যোতির্বিদদের গবেষণার জন্যও খুবই উপযুক্ত এবং কাঙ্ক্ষিত। সারা পৃথিবীর জ্যোতির্বিদেরা এখানে কাজ করতে আসেন। বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি থেকে দূরে পাহাড়ের চূড়ো দেখিয়ে ছোটকু বলল, ওখানে ALMA observatory আছে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে পথ করা দেখতে পেলাম। ALMA অর্থাৎ Atacama Large Millimeter Array। এটি আতাকামার Chajnantor Plateau-তে ১৬,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। যেহেতু এই অঞ্চলে বছরে ৩০০দিনই মেঘমুক্ত আকাশ, উচ্চতা বেশি, জায়গাটা জনবিরল ও আলোর দূষণ থেকে মুক্ত, তাই মহাকাশের গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, dust cloud এমন সব জ্যোতির্বিদদের আগ্রহের বস্তু এখানে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। গত বছর ব্ল্যাক হোল-এর প্রথম ছবি প্রকাশ হল, তখন খুব হইহই হয়েছিল। এই ছবি তোলার জন্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ৯-১০টা ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে দুটো রয়েছে এই আতাকামাতেই। তাই বিজ্ঞানীদের কাছে বিশেষ করে জ্যোতির্বিদদের কাছে আতাকামা মরুভূমি এক বিশেষ তীর্থক্ষেত্র।
ফেরার সময়ে বাড়িতে ঢোকার আগে সান পেড্রোর বাজারে নেমে চাল, আলু, আপেল, দুধ চিজ় এসব কেনা হল। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল কাউন্টারে দোকানির পেছনে বিক্রির জন্য টাঙানো জিনিসপত্রের মধ্যে ‘coca’ লেখা টফির প্যাকেট। দোকানিকে স্প্যানিশ ভাষায় জিজ্ঞাসা করে ছোটকুকে জানতে পারল, high altitude sickness-এর জন্য এটা খুব ভালো। আগে অরুণাচল যাবার সময়ে শুনেছিলাম, অতি-উচ্চতার সমস্যা সামলাতে অনেকে Coca 6 নামের একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খায়। তাই এখানে ‘কোকা’ লেখা দেখেই আমি উৎসাহিত হয়েছিলাম। সত্যিই খুব দরকারি জিনিস। কেনা হল দু প্যাকেট, এক একটাতে ৬টা কি ৮টা টফি। আতাকামার বাকি দিনগুলোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমি কোকা টফি খেয়ে ভালোই উপভোগ করতে পেরেছি । এমনকি সেখানে আরও বেশি উচ্চতার El Tatio Geyser দেখতে যাওয়ার সময় দুজন বিদেশিকে দিয়েছি। উপকৃত হয়েছে ওরাও।
গরমের মধ্যে আর ঘরে বসে না থেকে আমরা আবার গেলাম আগের দিনের সেই জায়গাটায় (Piedro del Coyote) সূর্যাস্ত দেখতে। Piedro মানে হল পাথর। যতক্ষণ পারি দেখেই গেলাম। গতকাল ওখানে পৌঁছতে একটু দেরি হয়েছিল, সূর্যের অস্ত যাবার ঠিক মুহূর্তটা দেখতে পাইনি। আজ আগে ভাগে পৌঁছে, বেশ অনেক দূর গিয়ে ভালো করে দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণ প্রাণ ভরে দর্শন করলাম। এই মুহূর্তটা সত্যিই দুর্লভ।
আজ রাতে ছোটকুর পরিকল্পনা, মাঝরাতে লোকালয় থেকে দূরে যেখানে আলো ব্যাঘাত করবে না, সেইরকম ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গায় গিয়ে তারা আর গ্যালাক্সি দেখবে। আগে যখন একবার ও একা একা আতাকামা এসেছিল, তখন আসার উদ্দেশ্যই ছিল খালি চোখে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি নিরীক্ষণ করা। এটা একমাত্র আতাকামার মতন জায়গাতেই সম্ভব, কারণ সেখানে বাধাবন্ধহীন দিগন্ত দেখা যায়, আর আকাশও মানুষের সৃষ্টি আলো থেকে মুক্ত। সেবারে ছোটকুর উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। গুগ্ল-এ দেখেছিলাম, অ্যান্টোফাগাস্টা শহর আর সান পেড্রো দা আতাকামা-র মাঝে কোনও একটা জায়গায় অন্ধকার আকাশে নক্ষত্রাদি পরিষ্কার দেখা যায়। আমরা এয়ার বিএনবি-র যে বাড়িতে আছি, সেই বাড়ির উঠোন থেকেই আকাশের তারা যেন মাথার ওপর নেমে আসছে। সূর্যাস্ত দেখে ফিরে আসার পর ছোটকু উঠোন থেকেই খালি চোখে আর দূরবীনে দেখাল, Southern cross, কালপুরুষ, ছায়াপথ (milky way), কালপুরুষের belt, লুব্ধক জ্বলজ্বল করছে। ছোটকু কতদূর যাবে জানি না। ও টেলিস্কোপ, দূরবীন, মাথায় লাগানো আলো ইত্যাদি নিয়ে রাত দুটোয় বেরিয়ে গেল। আমাদের আবার আগামীকাল ভোর পাঁচটায় বেরোতে হবে এল তাতিও উষ্ণ প্রস্রবণ দেখার সফরে। একটা ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে টাকা দিয়ে বুক করা। বছর আগে যখন ছোটকু আতাকামা এসেছিল, তখন এটা দেখেছে। এবারে আর যাবে না। রাতে আকাশ দেখে এসে সকালটা ঘুমোবে।
আতাকামায় তৃতীয় দিন (১৪ মার্চ ২০২৪)
ফেরার পথে সকাল আটটা নাগাদ একটা জায়গায় বাস থামিয়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট দিল। কী করিৎকর্মা আমাদের গাইডদাদা। ড্রাইভার আর আলবার্তো ঝটপট ফোল্ডিং টেবিল বার করে বাইরে সাজিয়ে ফেলল। তারপর পাঁউরুটি, অ্যাভোকাডো দিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিল, সঙ্গে কফি আর কুকি। এই সময়টা সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা পাথরের ওপর বসে খেতে খেতে পরস্পরের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করছিল। ইংরেজি জানা মানুষের সঙ্গেই বিশেষ পরিচয় হল। একজন চিলির মেয়ে ছিল, সান্তিয়াগোতে থাকে। ইংরেজি জানে। জানাল, চিলির মধ্যে সব থেকে ভালো জায়গা ভালডিভিয়া। প্রকৃতি সবুজ। সান্তিয়াগো আর পাঁচটা বড় শহরের বৈশিষ্ট্যে ভরা। ক্রাইম, বড় বড় বিল্ডিং ইত্যাদি, যা চিলির চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। আরেকটি ছেলে স্পেন থেকে এসেছে। তার বান্ধবী থাকে আমেরিকায়। দুজনে একসাথে চিলি বেড়াতে এসেছে। এখানেই যা ওদের একসঙ্গে থাকা। তবু বেচারারা বাসে পাশাপাশি বসার সীট পায় নি। যখনই বাসের বাইরে থাকছে, দুজনে একটু দূরে চলে যাচ্ছে। গাইড আবার তাদের ডেকে আনছে। গিজারের কাছে লাফাতে পারে নি, তাই বাসের কাছে এসে স্পেনের ছেলেটি বেশ খানিকটা লাফিয়ে নিল। বান্ধবী আবার তার ছবি তুলল। এই যুগলদের সঙ্গে বাসে গল্প করেছিলাম, এদের আমি কোকা টফি দিয়েছিলাম।
ব্রেকফাস্ট হয়ে যাবার পর আমাদের আরও কয়েকটি জায়গায় নিয়ে গেল। যত নীচে নামছি আর সূর্য যত উঠছে, বাসের ভিতরে লোকজন স্তরে স্তরে পোশাক কমাচ্ছে। ব্যাগের ভিতর ঢুকছে জ্যাকেট, টুপি, মাফলার, গ্লাভস, সোয়েটার ইত্যাদি। স্পেনের ছেলেটি বাস থেকে ভিকুনিয়া নামের জন্তুটিকে দেখতে পেল। আমরা ‘কই কই’ করে জানালায় মুখ বাড়ালাম, সে ততক্ষণে অদৃশ্য। মরুভূমি, পাথর পেরিয়ে যেখানে এলাম সেখানে সবুজ প্রান্তর, নীল জলাশয়। পথে দেখলাম পাথরের ওপর পাথর দিয়ে সাজানো, যেরকম অরুণাচলে অনেক জায়গায় দেখেছি। এটা বোধহয় পাহাড়ের মানুষের কিছু লৌকিক আচার বা বিশ্বাস। ততক্ষণে সূর্যের আলো এত তীব্র যে কী ছবি তুলছি বুঝতেই পারছি না। পথে চলতে চলতে আবার মরুভূমির মধ্যে দূরে ধূসর, কালচে পর্বতের ওপর বরফের প্রলেপ দেখা যাচ্ছে। এই আতাকামায় দেখছি প্রকৃতির সব রূপই আছে। এবার এসে পড়লাম বিশাল একটা লেকের সামনে। ভাবা যায়, বিশ্বের শুষ্কতম মরুভূমির মধ্যে এরকম টলটলে জলের লেক। প্রকৃতির কী যে খেলা! বিচিত্র জায়গা এই আতাকামা, যত দেখছি তত চোখে ঘোর লাগছে। এই লেকের জলে আবার ফ্লেমিংগোদের জটলা। বেশ খানিকটা দূর থেকে দেখছি আমরা। গাইড আলবার্তো লেকের জলে ফ্লেমিংগোদের দেখিয়ে বলল, দুই ধরনের ফ্লেমিংগো আছে একসঙ্গে। উজ্জ্বল গোলাপি রঙের চিলিয়ান ফ্লেমিংগো যাদের কালো ঠ্যাং, আর হলুদ পা ওলা আন্দিয়ান ফ্লেমিংগো। ওরা একসঙ্গে থাকলেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। চিলিয়ান ফ্লেমিংগো আন্দিয়ান ফ্লেমিংগোর সঙ্গে মিলিত হয় না। তাছাড়াও আরেক ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির ফ্লেমিংগোও আছে। চিলির চরম পরিবেশ তার সমস্ত বাসিন্দাদের কাছে এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ। তবুও আতাকামা মরুভূমির ফ্লেমিংগো এমন একটি প্রাণী যে তারা কঠিনতম পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। গাইডবাবুর কাছ থেকে অনেক জ্ঞান আহরণ হল। ভোর রাতের অন্ধকারে যে পথের দৃশ্য দেখতে পাই নি, ফেরার পথে সে সব দৃষ্টিগোচর হল। অ্যারিজ়োনার টুশন শহরের কাছে Saguaro National Park-এ বড় বড় ক্যাকটাস দেখেছিলাম, এখানে অত বড় না হলেও কয়েকটা লম্বা লম্বা ক্যাকটাস দেখা গেল। বারোটার আগেই আমরা সান পেড্রো পৌঁছে গেলাম। বাজার অঞ্চলে ওদের ট্যুরিস্ট অফিসের সামনে নামিয়ে দিল আমাদের, সেখান থেকে আমাদের থাকার জায়গাটা মিনিট দশেকের পথ। চাঁদিফাটা রোদে হাঁটা কষ্টের। তবু জায়গাটা দেখব বলে হাঁটতে লাগলাম। গ্রামের পথ। মনে হচ্ছে মহেঞ্জোদরো যুগের রাস্তায় এসে পড়েছি। পাথরের বাড়ি। অনেকটা রাজস্থানের গ্রামের মতো। সান পেড্রোর বাড়ি বা বাজার অঞ্চলের ছবি তোলা হয়নি। অবশ্য গুগল থেকে পাওয়া যাবে।
বেশিদূর হাঁটতে হয়নি। ফোনে খবর পেয়ে ছোটকু গাড়ি নিয়ে চলে এল। আজ রাত নটায় আমাদের তারা দেখতে যাওয়ার ট্রিপ। বিকেলের দিকে দেখা গেল আকাশে সামান্য মেঘ। ছোটকুর সন্দেহ হল যে আমাদের তারা দেখার প্রোগ্রাম আজ বাতিল হয়ে যাবে। ঠিক তাই হল। মনটা একটু খারাপ হল অভিজ্ঞ লোকেদের সঙ্গে তারা চেনার অভিজ্ঞতা হতে পারল না বলে। কিন্তু খানিক পরে এবং রাতে এমন অভিজ্ঞতা হল যার জন্য কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। সন্ধ্যেবেলায় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ মেঘ কেটে গেল। উঠোনে দাঁড়িয়ে চমৎকার চাঁদ দেখা গেল। ছোটকু দূরবীন দিয়ে দেখল, আমিও পাশে বসে দেখলাম। দূরবীন মোবাইলের সঙ্গে যুক্ত করে চাঁদের বড় ছবি তোলা হল। দেখতে দেখতে ক্রমশ আমার আগ্রহ বাড়তে থাকল। ঠাণ্ডা ভুলে ছোটকুর সঙ্গে তারা দেখায় মগ্ন হলাম। একে একে কত তারা যে চিনলাম! দক্ষিণ গোলার্ধের Southern Cross পরিষ্কার দেখলাম। চারটি বড় তারা, ঘুড়ির আকারে। এদের এই দক্ষিণ গোলার্ধেই দেখতে পাওয়া যায়। ভারতে বা উত্তর গোলার্ধের কোথাও এদের দেখা মিলবে না। তেমনি ধ্রুবতারা এই অঞ্চলে দেখা যাবে না। কালপুরুষ, বৃশ্চিক, কন্যা ইত্যাদি রাশির তারারা তাদের অবয়ব নিয়ে দেখা দিচ্ছিল। খালি চোখেই চমৎকার দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। তবে গভীর রাতের যে অভিজ্ঞতা হল তা অবিস্মরণীয়, চিরদিন মনে রাখার মতো।
আতাকামা মরুভূমির অভিজ্ঞতা: ১৪ মার্চের রাত এবং ১৫ মার্চ সারাদিন
এই সন্ধ্যে রাতেই যদি আকাশের তারা এত স্পষ্ট দেখা যায়, তাহলে মাঝরাতে ঘন অন্ধকারে লোকালয়ের বাইরে, শহুরে আলোর বাইরে, খোলা জায়গায় টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহ নক্ষত্র কী রূপ নিয়ে দেখা দেবে, তা ভেবেই রোমাঞ্চ বোধ করলাম। রাত দুটোয় ছোটকু বের হবে ওর টেলিস্কোপ বাইনাকুলার নিয়ে। সেই আগের দিনের জায়গায়। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা। ছোটকু যেই রওনা দেবে বলল, আমরাও তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে ছোটকুর সঙ্গে যাবার জন্য তৈরি হলাম। ঠাণ্ডার জন্য ধড়াচূড়ো পরলাম, জ্যাকেট-টুপি-মাফলার-উলের মোজা-গ্লাভসে সুসজ্জিত হলাম। যেন অভিযানে যাচ্ছি। সত্যিই এক অভিযান বটে। ২০ মিনিট মতো গাড়ি চালিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছলাম আমরা। মোক্ষম জায়গা বার করেছে বটে গুণধর পুত্রটি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু বিশাল আকাশ জুড়ে অসংখ্য তারাদের জগৎ। ওপর থেকে চোখ সরালে সামনের কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, ধারে কাছে কী আছে কিছুই বুঝছি না। অনন্ত বিশ্বে নির্জন, নিঃঝুম অন্ধকারে শুধু আমরা তিনজন।
ছোটকু ওর কাজ শুরু করে দিল। গাড়ি থেকে টেলিস্কোপ, বাইনাকুলার, স্ট্যান্ড বের করে সেট করল। খনিতে যারা মাথায় আলো লাগিয়ে কাজ করে, তাদের মতো মাথায় আলো লাগিয়ে সেট করল। তারপর আবার ঘন অন্ধকার। এ তো সাধারণ কাজ নয়। বড় বিস্ময় লাগে। টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাকাশের বিস্ময় অনুভব করলাম। সন্ধ্যেবেলায় চেনা গ্রহ-নক্ষত্র-ছায়াপথ যেন আরও পরিষ্কার, আরও বড়, আরও কাছে চলে এল। ছায়াপথের মধ্যে নক্ষত্রগুলো পরিষ্কার দেখা গেল। ম্যাগেলান ক্লাউড চিনতে পারলাম। সাদার্ন ক্রস চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগল। ভাগ্যিস আজ রাতে অ্যাস্ট্রোনমার দলের সঙ্গে তারা দেখতে যাওয়াটা বাতিল হল! তাই তো ছোটকুর সঙ্গে বিস্ময়কর জায়গায় অতিপ্রাকৃত পরিবেশে এমন মহাজাগতিক দৃশ্য দেখবার সুযোগ হল। দেখলাম, চিনলাম, জানলাম। শাপে বর হল এই কারণে যে ওরা, মানে পেশাদার অ্যাস্ট্রোনমার দল সবকিছু দেখাবার আগেই আমি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান বুঝে গেলাম আর ছোটকু এত ভালো করে বোঝাল আমার পড়া তো তৈরিই হয়ে গেল। পরের দিন রাতে যখন অ্যাস্ট্রোনমার গ্রুপের সঙ্গে তারা দেখতে যাওয়া হল, তখন পুরোটা সময় আরো ভালো উপভোগ করেছিলাম। ওদের কাছে আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ ছিল, শক্তিশালী লেজার টর্চ ছিল কিন্তু সময় ছিল সীমিত আর দর্শক ছিল অনেক। এখানে এই জনবিরল স্থানে, অন্ধকারে গা ছমছম অনুভূতি নিয়ে আমাদের তিনজনের তারা দেখা, আকাশ চেনা একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা।
গায়ে অনেক কিছু পরে আছি, তাও ঠাণ্ডা লাগছিল। তাই মাঝে মধ্যেই গাড়িতে গিয়ে বসছি আবার কত কিছু miss হয়ে যাচ্ছে ভেবে বাইরে এসে দেখছি। সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি থেকে দেখা তারাগুলোর অবস্থান এখন পালটে গেছে। চাঁদও আর আকাশে দেখা যাচ্ছে না। ছোটকু বিশেষ একটা গ্যালাক্সির খোঁজে ব্যস্ত ছিল। তার অবস্থান জানা আছে কিন্তু টেলিস্কোপের মাধ্যমে ওর চোখে ধরা পড়ছে না। ইতিমধ্যে ও টেলিস্কোপে মোবাইল লাগিয়ে ছায়াপথ, ম্যাগেলান ক্লাউডের ছবি তুলেছে। আমি সঙ্গে টর্চ রেখেছিলাম। আর কোন একটা তারা চিনব বলে যেই টর্চের আলো ওপরের দিকে তাক করেছি অমনি ছোটকু ‘রে রে’ করে উঠল। ও তখন timer adjust করে ছবি তুলছিল। “দিলে তো সব ভেস্তে!”। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সত্যিই ভারি বোকামির কাজ করা হল। আসলে চরম সত্য বলে কিছু নেই। পরিস্থিতির প্রয়োজনে বস্তুর মূল্য। এখানে টর্চ বেমানান। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারই প্রয়োজন তারা দেখার জন্য— যে কারণে আতাকামা মরুভূমি বিখ্যাত এবং জ্যোতির্বিদদের কাছে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত স্থান। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও ছোটকুর তারা দেখায় এবং ছবি তোলায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল সুদূর কালামা শহরের ক্ষীণ আলো, কাছাকাছি অঞ্চলের খনির আলো আর দূর আকাশে উড়ে যাওয়া প্লেনের আলো। সেখানে আমি কিনা বোকার মতো টর্চের আলো জ্বালিয়ে ফেললাম! তবে এর ফলে যে ছবিটা উঠেছে তা দুর্ধর্ষ। আলো ফেলার ফলে যে অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছি তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে। এক্কেবারে যেন চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবা যায়! মনে হচ্ছে ওর কাজ শেষ হতে আরও দেরি কিংবা যা চাইছে তা আদৌ পাবে কিনা, অর্থাৎ কিনা ভোর হওয়া পর্যন্ত হয়তো থাকতে হবে। ছোটকু একবার বলল আমাদের বেশি ঠাণ্ডা লাগলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। পাগল নাকি? আবার যাবে আবার আসবে! অবশেষে অনেক ধৈর্য ধরে, অনেক সময় ধরে, মনোযোগ দিয়ে দেখে ঈপ্সিত বস্তুর সন্ধান পেল, ছবি তুলল। আমাদেরও শান্তি। সবকিছু গুটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে পাঁচটা বেজে গেল। পরের দিন আমাদের সারাদিন-সারারাত নানা জিনিস দেখার কথা, যাকে বলে একেবারে ‘packed program’। কাজেই ঘুমিয়ে নেওয়াটা ভীষণ জরুরি।
আতাকামায় চতুর্থ দিন: ১৫ মার্চ
সকাল নটায় ঘুম থেকে উঠেই ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ বানিয়ে ফেললাম। বাবা আর ছেলে ঘুম থেকে দশটায় উঠলে ব্রেকফাস্ট করে সবাই বেরিয়ে পড়লাম সেদিনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে। এখানে বাঁকে বাঁকে চমক। আজ ছেলের বিশ্রাম, বাবা ড্রাইভারের আসনে। প্রায় এক ঘন্টা ড্রাইভিং করে একটা লেকের কাছে এলাম। এলাম বলতে গাড়ি থেকে নামলাম আর লেকের ধারে পৌঁছালাম তা নয়। ছোটকু টিকিট কেটে আনার পর হাঁটছি তো হাঁটছি। লেক কোথায় রে বাবা! এখানেও লক্ষ্মণের গণ্ডি। নির্দিষ্ট পথ দিয়ে হাঁটা। মাথার ওপর সূর্যের প্রচণ্ড তাপ। বিশাল বড় এলাকা, ভাগ ভাগ করা। প্রথমে যেখানে পৌঁছালাম সেখানটা লবণ হ্রদ। বরফের মতো সাদা হয়ে আছে। আরও হেঁটে টলটলে নীল হ্রদ। এখানেও জলে নুন আছে। তবে এখানে সাঁতার কাটা যায়। সাঁতার কাটা বললে ভুল হবে, বলা ভালো ভেসে থাকা যায়। ডেড সীর মতো। জলের ঘনত্ব এত বেশি যে ভাসাবার জন্য সাঁতার কাটার দরকার নেই, বরং ডুবে যাওয়াটাই অসম্ভব। পিতা-পুত্র অনেকক্ষণ হ্রদের ভাসমান হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াল। জল থেকে উঠল যখন, রোদের বেশ তেজ আর দেখি দুজনেরই গায়ে-মাথায় শুকিয়ে যাওয়া লবণ। এই হ্রদে এক ভারতীয় পরিবার দেখলাম। আমেরিকার বাসিন্দা ভারতীয় দম্পতি দুই বাচ্চাকে নিয়ে চিলি বেড়াতে এসেছেন। হ্রদের শেষ অংশটিতেও হেঁটে গেলাম। তবে এই অংশে জলে নামা বারণ। সিকিউরিটির লোকও কড়া চোখে নজর রাখছে। ডেড সীর মতো ভেসে থাকা যায় যে হ্রদে সেটার নাম ‘Laguna Cejar’। এই লেকটা সান পেড্রো ডে আতাকামা থেকে ১৮ কিমি দূরে । আর এটি আছে Salar de Atacama Mountain Range-এর মধ্যেই। এই লেকের জলে লবণের ঘনত্ব ৫% থেকে ২৮% পর্যন্ত থাকে।
আরও দুটো হ্রদে যাওয়া হল। একটি দেখে মনে হল বড় সবুজ ডোবা। তাতে পাহাড়ের ছায়া পড়ে খুব সুন্দর রূপ তৈরি করেছে। সেই ডোবার ধারে এক চাইনিজ পর্যটক খানিক লাফালাফি করল আর তার সঙ্গিনী পটাপট ছবি তুলে নিল। চাইনিজ ভদ্রলোক খুব আমুদে। আমাদের সঙ্গেও হেসে হেসে কথা বলল। দ্বিতীয় হ্রদটিও লবণ হ্রদ। পাথর রেখে রেখে পথ করা। হ্রদের ধারে ধারে হেঁটে যাও, কিন্তু ছুঁয়ো না। জল প্রায় নেই, শুকিয়ে গিয়ে বিরাট বড় লবণের ভাণ্ডার তৈরি হয়েছে। এটাকেই বলে ‘সল্ট ফ্ল্যাট’।
রোদ্দুরে প্রায় ভাজা ভাজা হয়ে গেলাম। হাতে সময় কম। চারটের সময় যাব Valley of moon। এটা আতাকামা মরুভূমির বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান। বাড়ি ফিরে লাঞ্চ খেয়েই আবার বেরোনো। তবে গরমে আর এত দৌড়ঝাঁপে শরীর ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। এখানে রয়ে-সয়ে ভ্রমণ করা ভালো। Valley of moon বিশাল এলাকা নিয়ে এবং চড়াই-উতরাই আছে। জায়গাটা পুরোটা ঘুরে দেখতে হলে শরীরের তাকত চাই। সঙ্গে জল আর টুপি অবশ্যই জরুরি। আর প্রয়োজন sun screen lotion ও sun-glass। দুপুরের খাবার খেয়ে উঠেই এসেছি। টিকিট কেটে ভিতরে ঢোকা হল। ঢুকেই মনে হল যেন মিশরে এলাম। টুপি, কালো চশমা পরিহিত ট্যুরিস্টদের ভিড়। মুহুর্মুহু ট্যুরিস্ট ভর্তি সাদা ছোট বাস আসছে, নামছে নানা বর্ণের, নানা ভাষার, নানা দেশের মানুষ; চাঁদের মাটিতে ভ্রমণের স্বাদ পেতে। দলে দলে সব উঠছে মরু পর্বতের বালি ঠেঙিয়ে। ১৪-১৫ দলের সঙ্গে এক-একজন গাইড। সর্বনাশ, এই ঠা-ঠা রোদ্দুরে বালির পাহাড় ডিঙোতে হবে? এই কারণে গুগলমামা বলেছিল কম খেতে, বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে, ধীরে সুস্থে আতাকামার অতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কিছুদূর উঠতে না উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম। গলা শুষ্ক হতে থাকল। এখানে কঠোরভাবে পথ চলার নিয়ম মানতে হবে। তা না হলে প্রকৃতির এক বিশেষ শৃঙ্খলিত রূপ অবিন্যস্ত হয়ে যাবে। এক একটা অংশে যাবার নির্দিষ্ট পথ তৈরি করা আছে। সেই নিয়ম ভাঙা বে-আইন। কিন্তু বাধ্য হয়ে নিয়ম ভাঙতে হল। অতি কষ্টে থেমে থেমে কিছু দূর গিয়ে উঠতে পারছি না। এটা one-way, সরু পথ। পর্যটকরা দল বেঁধে উঠছে, গাইডের ভাষণ শুনছে। আমরা পিছন ঘুরে ফিরে যেতে চাইলাম। বুঝলাম এই পথ ফেরার নয়, চলার। তবু একজন গাইড বললেন শারীরিক অসুবিধে থাকলে ফিরে যেতে পারেন। আবার গাড়ির কাছে ফিরে আসতে মহিলা সিকিউরিটি কিছু বলল আর আঙুল দিয়ে কিছু নির্দেশ দিল। ও দেখাতে চাইল ফেরার পথ। অত সুন্দর sand dune এর বাকি অংশ দেখতে পারলাম না। ছোটকু ততক্ষণে ঘুরে চলে এসেছে। ছবি তুলেছে। আরও দু জায়গায় আমি গেলাম না। গাড়িতে বসলাম, ওরা ঘুরে এল। চাঁদের মাটির সঙ্গে বিস্তর মিল। শুধু তাই নয় নাসার বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছে যে, এখানকার মাটির বৈশিষ্ট্য মঙ্গল গ্রহেরও আছে।
আতাকামায় শেষ রাত: ১৫ মার্চের রাত ও ১৬ মার্চের ভোর
সন্ধ্যে ছটার আগেই আমরা ঘরে ফিরে এলাম। আজ রাত নটায় বাস আসবে। আমরা তিনজনেই আতাকামার আরেকটি বিখ্যাত দর্শনীয় ব্যাপার, তারা দেখতে যাব ‘Llama Stargazing’ সংস্থার সঙ্গে। এটাতেই আমাদের যাওয়ার কথা ছিল গতকাল রাত্রে, যেটা ওরা মেঘলা আকাশের জন্য বাতিল করেছিল। ইতিমধ্যে স্যুটকেস গুছিয়ে নিতে হবে। তারা দেখে ফিরে এসে রাত থাকতেই বেরিয়ে পড়তে হবে কালামা বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে। রাতের খাওয়ার আর সময় হল না। উঠোনে দাঁড়িয়ে আবার আকাশের তারা, চাঁদ দেখলাম।
বহু প্রাচীনকালে পণ্ডিত ব্যক্তিরা, মুনি-ঋষিরা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে খালি চোখেই তো গ্রহ নক্ষত্র দেখতেন, নক্ষত্রপুঞ্জের এক একটা চেহারা কল্পনা করে নাম দিয়েছেন কন্যা, মিথুন, সিংহ, বৃশ্চিক ইত্যাদি। প্রকৃতির নানা রূপে মুগ্ধ হয়ে, ভয় পেয়ে পুজো করেছেন। বেদে তাই দেখি আকাশ, জল, বাতাস-এর উদ্দেশে মন্ত্র। প্রাচীন কাল থেকে বর্তমানে মানুষ আরও জানার আকাঙ্ক্ষায় আরও কত আধুনিক যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যাতে মহাকাশের রহস্য, প্রকৃতির রহস্য ধরা দেয়।
রাত পৌনে নটায় বাড়ির কাছে হেঁটে গিয়ে বাসে উঠলাম। বাসের চালক অল্পবয়সী মেয়ে। বিভিন্ন হোটেল থেকে ট্যুরিস্টদের নিয়ে প্রায় আধঘণ্টা পরে এক জায়গায় বাস দাঁড়াল। কোথায় এলাম বুঝলাম না। তারা দেখাবার সরঞ্জাম নিয়ে দুজন আগেই পৌঁছে গিয়েছে। অন্ধকারে দুটো বড় বড় টেলিস্কোপ রাখা দেখলাম। আমাদের সঙ্গীদের বাসেই যা মুখ দেখলাম, অন্ধকারে কাউকে আর বোঝা যাচ্ছে না। যিনি তারা চেনাবেন তিনি Astrophysics-এর লোক, নাম Albarto Nardin। তিনি প্রথমে চাঁদ দেখালেন। বড় ও শক্তিশালী টেলিস্কোপে চাঁদের উপরিভাগ স্পষ্ট হল। তৃতীয়া কি চতুর্থীর চাঁদ ছিল। পূর্ণিমার চাঁদ হলে দারুণ হত। একে একে শুকতারা, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, মিথুন, Southern Cross, milkyway সব দেখালেন, Magellan cloudও দেখালেন। মজাই লাগল। লেজার দিয়ে তারা চেনালেন। দুদিন ধরে দেখে এখন বড় টেলিস্কোপে আরও ভালো দেখা গেল তবে অল্প সময়ের জন্য। পনেরো-ষোলো জনের দল। সবাই দেখবে। চাঁদ দেখানোর পর drinks দেওয়া হল আর কে কোথা থেকে এসেছে তার পরিচয় নেওয়া হল। সবই অন্ধকারে, তাই নাম আর ব্যক্তির সমন্বয় ঘটল না। ওরা তো শেষে আবার snacks দিল। এই অন্ধকারে সবার বসার জায়গার ব্যবস্থা, খাওয়ার ব্যবস্থা কী করে যে করল! নিঃশব্দে অথচ শৃংখলার সঙ্গে। রোজই করতে হয়। ঠাণ্ডাও বেশ ভালোই। ছোটকু ওদের দুজনের সঙ্গে ভালোই interact করল। ও হ্যাঁ, বড় টেলিস্কোপে সপ্তর্ষি মণ্ডল দেখলাম, অবশ্য ছোটকুও আগের দিন দেখিয়েছিল; সপ্তর্ষি মণ্ডলের ‘পুলস্ত্য’-কেও দেখলাম। শেষে মহাকাশের ছায়াপথের সঙ্গে পৃথিবীর মানুষদেরও ছবি তোলার ব্যবস্থা ছিল। এককভাবে কিংবা যৌথভাবে। দম্পতিরা বা যুগলরা স্বাভাবিকভাবে যৌথ ছবিই তুলেছে। একজন চাইনিজ ভদ্রলোক নানাভাবে, নানা ঢঙে ছবি তোলালেন। এখানে ট্যুরিস্টদের মধ্যে ভারতীয় যুবক-যুবতী ছিল, তারা শিকাগোতে পড়াশুনা করে। চিলি ভ্রমণে এসেছে। ফিরতি পথে মহিলা বাস চালিয়ে নিয়ে আসছিলেন। পথ ছিল খারাপ। বাসটা গর্তে পড়ে গিয়েছিল। ড্রাইভার মহিলা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কেউ কেউ নেমে যেতে চাইলেন, তাহলে বাসকে নাড়ানো সম্ভব হবে। সব থেকে ভালো হয় সবাই নেমে গেলে। শেষ পর্যন্ত সবাই নামল। ছোটকুর মতো অনেকে মিলে ঠেলে বাসকে চালু করল। ড্রাইভার মেয়েটিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। রোজ এই কাজ করতে হয় তাকে। রাতেই তো লোকালয় থেকে দূরে, ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে আকাশের তারা দেখাতে নিয়ে যায়। কঠিন জীবন।
ঘরে ফিরতে রাত একটা বেজে গেল। দুঘন্টা মতো ঘুমালাম। ঠিক রাত চারটেয় তৈরি হয়ে বের হলাম। আতাকামায় দিনের তাপমাত্রা যেমন পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ ডিগ্রির ওপরে, তেমনি রাতের তাপমাত্রা কমে দশ-এগারো ডিগ্রির নীচে। প্লেন ছাড়বে নটায়, সান পেড্রো থেকে যেতে সময় লাগবে দুঘন্টা। তাহলে এত তাড়াতাড়ি করে বেরোনো কেন? ছোটকুর সব হিসাব করা। আসার সময় যেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম (Piedra de Coyote), সেখানে গাড়ি দাঁড় করাল ছোটকু। লিখতে গিয়ে সেই মুহূর্তটা আবার অনুভব করলাম। বাপরে বাপ, কী সে অনুভূতি! সূর্যাস্তের সময় লোকজনের ভিড় ছিল। চোখের সামনে বাদামি পাথুরে পাহাড় দেখতে পারছিলাম আর এখন এই রাতে রাস্তার ধারে কেমন যেন ভুতুড়ে ভাব। ওপরে তারাগুলোর ঔজ্জ্বল্য চোখ ধাঁধায়। তার ওপর কনকনে ঠাণ্ডা। এবার তো ছেলে আবার ক্যামেরা, স্ট্যান্ড বের করে ছবি তুলবে। আকাশের ছবি তুলবে। একটা গাড়ি চলে গেল। চার মিনিট ধরে ছবি ওঠার কথা। গাড়ির হেড লাইটের আলোয় ছবির বারোটা বেজে গেল। আবার ছবি আবার চার মিনিট অপেক্ষা। হে ভগবান, এখন যেন গাড়ি না আসে। না, আরেকটা গাড়ি গেল। আবার চার মিনিট। মনে মনে দুর্গা নাম জপ করছি। অবশেষে মনের মতো ছবি তোলা হল। চলো তাহলে। এত রাত্রিতে এরকম রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়াটাও যথেষ্ট সাহসের দরকার। তার ওপর সে রকম ঘুমও হয় নি। ছোটকু তো বলতে গেলে তিন রাতই জাগা। ঠিক পাঁচটা নাগাদ আরেক জায়গায় থামবে, সেটাই আসল উদ্দেশ্য। ঐ সময়ে zodiacal light স্পষ্ট দেখা যাবে। এইটা আবার ছোটকু বুঝিয়ে বলল। গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে অনেক ধূলিকণা ঘুরে বেড়ায়, তাতে সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করে, যেমন নাকি ঘরের ধুলোতে যদি ঠিক angle এ সূর্যের আলো পড়ে তখন হাওয়ার মধ্যে ধূলিকণা দেখা যায়, সেরকমই ঠিক সময়ে ঠিক angle এ সূর্যের আলো পড়লে ভোরের আগে সেই ধূলিকণা মেশানো আবছা আলো দেখা যায়, যেটা অনেক সময় ভোর বলে ভ্রান্ত ধারণা হয়। কিন্তু সেই সময় ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকতে হবে, এমনকি চাঁদের আলো থাকলেও হবে না। স্থান, কাল, পরিবেশ অনুকূল হলে সত্যিই সেই আবছা আলো দেখা যায়। আমরাও দেখতে পেলাম। ছোটকুর জন্য কত অভাবনীয় দৃশ্য দেখার সুযোগ পেলাম। এখানেও ছবি তোলার বিঘ্ন হচ্ছিল। তখন গাড়িও ঘন ঘন যাচ্ছিল। নির্বিঘ্নে ছবি তুলতে সময় লাগছিল। বেশি সময় লাগলে প্লেন miss হয়ে যাবে। যাইহোক সময় মতো ছবি তুলে, স্ট্যান্ড ট্যান্ড গুছিয়ে আবার চলা শুরু। উল্টো দিকের রাস্তা থেকেও গাড়ি আসছে। তীব্র হেড লাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যেতে এবার খিদে টের পাওয়া গেল। সঙ্গে আনা স্যান্ডউইচ আর ফল খাওয়া হল। এয়ারপোর্টে গাড়ি জমা দেওয়ার আগে গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করে দিতে হবে। হাতে সত্যিই সময় কম। এয়ারপোর্টের কাছে পেট্রল পাম্প, ম্যাপে দেখে নিয়েছিল ছোটকু। অবশেষে গাড়ি জমা দিয়ে, সিকিউরিটি চেক করে গেটের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর প্লেনে ওঠার সময় হয়ে গেল। প্লেনে উঠেও তো ওর কাজ থাকে। এবার প্লেনের জানলা দিয়ে পরিচিত আতাকামার পথ দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হলাম। চাঁদের পাহাড়, মঙ্গল গ্রহের মাটির দেশে আমিও গিয়েছিলাম, ভাবা যায়? বাবা কাকুদের জানাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তারা তো আর নেই। অনেকেই এখন নেই যারা আমার লেখা পড়তে ভালবাসত, বিশেষ করে জলিজীজী, কাবেরীর দিদি, মেসোমশাই অধ্যাপক দেবজ্যোতি দাশ, আমার কাকিমা।
এ প্রসঙ্গে বলি আমাদের ঠাকুরদা রমেশ ভট্টাচার্য শিলচরের নর্মাল স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। গরমের ছুটিতে যখন স্কুল বন্ধ, তখন স্কুলের ঘরের দরজা বন্ধ করে তিনি ঘরের সিলিং-এ আকাশের তারা এঁকে রেখেছিলেন। স্কুল খোলার পর ছাত্রদের জন্য অপেক্ষা করছিল এক দারুণ বিস্ময়। আতাকামা মরুভূমিতে আকাশ ভরা তারা দেখে আমার না-দেখা ঠাকুরদার কথাও খুব মনে পড়ল।