তারাশঙ্কর জন্মেছিলেন ঔপনিবেশিক ভারতে। তাঁর সাহিত্যরচনার পটভূমি রাঢ়বাংলা, আর বিষয় রাঢ়বাংলার মানুষ ও তাঁদের জীবন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে গ্রামবাংলার অবস্থা ছিল জমিদারি প্রথার নিয়ন্ত্রণাধীন। সুতরাং জমিদার আর প্রজা এই বিন্যাসই ছিল বাংলার চরিত্রগত রূপ। জমিদার ও প্রজা এই দুই শ্রেণির মধ্যে সম্পর্ক স্বভাবতই ছিল বিরোধের, আর এই বিরোধ অর্থনৈতিক। নায়েব, গোমস্তা, লেঠেলবাহিনী দিয়ে শোষণ জমিদারকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে আর্থিক শোষণের শিকার চাষিরা ভাগ্যের হাতে নিজেদের সমর্পণ করেছে। জমিদার মধ্যস্বত্বভোগী এবং ইংরেজের আজ্ঞাবহ—তাঁদের কাজই ছিল ইংরেজদের শক্তিবৃদ্ধি এবং নিয়মিত রাজস্ব সরকারের হাতে তুলে দেওয়া। এই কর্তব্য পালনের জন্য শারীরিক বলপ্রয়োগেও পিছপা হতেন না জমিদাররা। এইভাবে একদিকে রাষ্ট্রশক্তির প্রতিনিধি জমিদার অন্যদিকে শোষিত চাষি ও সাধারণ মানুষ। তারাশঙ্কর যখন এই গ্রামজীবনকে দেখলেন তখন ইতিমধ্যেই সমাজে শুরু হয়েছে পড়ন্ত সামন্ততন্ত্র ও নব্য ধনিকশ্রেণির দ্বৈরথ। এই দেশ মূলত কৃষিনির্ভর থাকলেও ব্রিটিশ শাসকেরা রেলপথ নির্মাণ করে শুধু যাতায়াতের সুযোগই করেননি, ব্যবসাবাণিজ্যের পথ সহজ করেছেন। শুরু হয়েছে নীল, চা ও কফির চাষ। বেড়েছে তুলো ও পাটশিল্প। গড়ে উঠেছে নতুন ধনিকশ্রেণি। এদিকে ব্রিটিশ শাসকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে জমি থেকে পাওয়া রাজস্ব বেশিরভাগটাই তুলে দিতে হয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের হাতে এবং তাঁদের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। একদিকে আভিজাত্যের অহঙ্কার অন্যদিকে আর্থিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে দোলাচল।
তারাশঙ্কর নিজেও ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের মধ্যে বড়ো হয়েছেন। তিনি বলেছেন—“সামন্ততন্ত্র ও জমিদারতন্ত্রের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্ব আমি দুচোখ ভরে দেখেছি। সে দ্বন্দ্বে ধাক্কা খেয়েছি। আমরাও ছিলাম ক্ষুদ্র জমিদার। সে দ্বন্দ্বে আমাদেরও অংশ ছিল” (আমার কালের কথা)। তিনি আরো বলেছেন, “আমি ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি ব্যবস্থার মধ্যে মানুষ। বিত্ত ছিল না, অহঙ্কার আর আভিজাত্যটাই পেয়েছি। অন্যদিকে আমার স্ত্রী ধনী পরিবারের সন্তান, পুরনো আভিজাত্যের সম্পর্কে সম্পর্কহীন। এই দ্বন্দ্ব আমার সারাটা জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত—প্রায় সারাটা জীবন উপলব্ধি করে এসেছি” (আমার কালের কথা)। এই দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। পরাধীন দেশে এই সংগ্রাম মুক্তির দ্যোতনা নিয়ে এসেছে। ব্যক্তিগতভাবে তারাশঙ্কর স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও তাঁর উপন্যাসে মুক্তিচেতনা সম্মিলিত মানুষের স্বাধীনতাচেতনায় তাঁর কল্পনাকে উদ্দীপিত করতে পারেনি। সংবেদনশীল ও সহানুভূতিসম্পন্ন একজন দর্শক হয়েই তিনি এই আন্দোলন, বিরোধ ও পরিবর্তনকে দেখেছেন। অতীতের গ্রামীণ সংস্কৃতির অধোগতিতে ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি একাকী। একে যদি তারাশঙ্করের সীমাবদ্ধতা বলি, তবে এও বলা প্রয়োজন যে সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু ব্যক্তিমানুষ এবং ব্যক্তিমানুষই সাহিত্যের বিষয়। উপন্যাসের সমষ্টির জীবন ও ছবি প্রতিফলিত হলেও সে ছবি ব্যক্তিমানুষের সম্মিলিত জীবনের ছবি। জমিদারি শাসন ঘিরে যে গ্রামজীবন তা ব্যক্তিরই সুখদুঃখের জীবন।
‘চৈতালী ঘূর্ণি’ (১৯৩১) উপন্যাসের তারাশঙ্কর দেখিয়েছেন গোষ্ঠ-দামিনীর গ্রামত্যাগ করার প্রধান কারণ জমিদারের অত্যাচার। এর সঙ্গে ছিল কাবুলিওয়ালা রসক মহাজন, দালাল সতীশ সরকার, এমনকি, জমিদারের চাপরাশির অত্যাচার। জমির মালিক চাষি নয়, মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার। জমির ওপর তার অধিকার ণেই, অধিকার নেই গাছপালার ওপর। এমনকি, চলার পথও তার নয়। ঔপনিবেশিক শাসনে প্রজা শুধু পরাধীন। সে শোষিত। গোষ্ঠের স্বগতোক্তি—“সেই ভাল, কিসের তরে থাকব, জমি গেল, ছেলে গেল, পেট দুটো, যেখানে খাটবো সেখানেই ভাত, এখানেও খাটা বাইরেও খাটা। ঘর? গাছপালা তো আছে।” বাইরে ঝড়ের প্রবল শব্দ শুনেও সে ভগবানকে ডাকতে চায় না, কেননা “ভগবান নাই, নইলে একজন অট্টালিকায় ঘুমায় আর দশজন রোদে পোড়ে, ঝড়ে বাদলে মরে?” তাঁদের শহরে আশ্রয় সন্ধানের পিছনে সামন্ততান্ত্রিক শোষণের যে চিত্র ঔপন্যাসিক এঁকেছেন, তাতে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। নিরীশ্বরবাদিতার সঙ্গে গোষ্ঠের কথায় প্রকাশ পেয়েছে হিংসা ও বিপ্লবের কথা। গ্রামে থাকার সময় জমির সঙ্গে ছিল তার আত্মীয়তার সম্পর্ক। কিন্তু শহরে শ্রমিক হয়ে শ্রমের সঙ্গে এমন সম্পর্ক তৈরি হয় না। তার কাজ যান্ত্রিক এবং শ্রম অনুযায়ী টাকা রোজগার হয় না। কারখানার মালিক তার চোখে পুঁজিবাদী শোষণের প্রতিভূ। বিরোধ তৈরি হয় মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের। এই বিরোধে মালিক পক্ষই জিতে যায় কারণ শ্রমিকশ্রেণি এক হতে পারে না। মালিকের বিরুদ্ধে তারা চিৎকার করে কিন্তু যৌথভাবে লড়তে পারে না। এই উপন্যাসে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব তারাশঙ্কর অস্বীকার করছেন না। শ্রমিক আন্দোলন হচ্ছে কিন্তু তার নেতৃত্বে আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা গান্ধীর অনুরাগী। বিদ্রোহ ও শ্রেণিসংঘর্ষের চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেও দলবদ্ধতার অভাবে তা স্থায়ী হয় না।
তারাশঙ্করের জীবন শুরু একজন রাজনীতিসচেতন মানুষ হিসেবেই। কল্লোল পত্রিকায় তাঁর 'রসকলি’ গল্প যখন প্রকাশিত হয়, তখন তিনি রাজনৈতিক কর্মী। কীভাবে রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন সে সম্পর্কে নিজেই লিখেছেন ‘আমার সাহিত্যজীবন’ গ্রন্থে—
“একসময় কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে রামপুরহাট অঞ্চলে আলাপ হয়েছিল বিপ্লবী বীর নলিনী বাগচির সঙ্গে। তিনিই আমার জীবনক্ষেত্রে এই দেশপ্রেমের বহ্নিকণা আমার মনে লাগিয়েছিলেন। পরাধীন দেশকে বৈদেশিক শাসনমুক্ত করার সংকল্প ছিল তার যজ্ঞাগ্নির মতো লেলিহান... ১৯২১ সালে মহাত্মাজীর অহিংস অসহযোগিতার আদর্শগত রোমান্টিসিজম আমার কল্পনাপ্রবণ মনকে আকর্ষণ করেছিল প্রবলভাবে।”অন্যত্র তিনি লিখেছেন –
“কংগ্রেসের কাজ করি, কলেরা ম্যালেরিয়া প্রভৃতিতে গ্রামে গ্রামে সেবকদল নিয়ে ফিরি। বাংলা দেশের মেলায় ঘুরে বেড়াই, ভলান্টিয়ারি করি। সাহিত্য তখন শখের সামগ্রী আমার। উনত্রিশ সাল শেষ হতেই তিরিশ সাল এল। ডাক এল গান্ধীজীর। আমি কলম রেখে ঝান্ডা হাতে বের হয়ে পথ থেকে লোহার ফটক ঠেলে জেলে ঢুকলাম। এই জেলেই য়ামার মনে একটা অবসাদ বা বিতৃষ্ণা এল রাজনৈতিক দলবাদের ওপর। জেলের মধ্যে দল, উপদল, অহিংসা ও সশস্ত্র বিপ্লবপন্থীদের কলহ দেখে মন দমে গেল। সংকল্প করলাম রাজনীতি করব না, সাহিত্যের মধ্যে দিয়েই নবজীবনের কথা লিখব।” (‘লেখার কথা’/ সাহিত্যের সত্য)
একই কথার প্রতিধ্বনি পাই ‘আমার সাহিত্যজীবন’ গ্রন্থে। নিজের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে তিনি বলেছেন—
“১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে যেদিন জেলখানা থেকে বের হলাম সেইদিনই মনে মনে সংকল্প করেছিলাম। জেলখানাতেই তখন ‘চৈতালী ঘূর্ণী’ এবং ‘পাষাণপুরী’ উপন্যাস দুখানি পত্তন করেছি, এবং তখন জেলখানায় রাজনীতিসর্বস্ব মানুষের চেহারা দেখে ভবিষ্যৎ ভাবনায় শঙ্কিত হয়েছি, চিত্ত ভারাক্রান্ত হয়ে রাজনীতির দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে বিমুখ হয়েছে। ভারতবর্ষের মানুষ, হিন্দু সংস্কৃতির পথে জীবনযাত্রা শুরু করেছি। কোনোমতেই মিথ্যাচারণের আশ্রয় নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই পথে অগ্রসর হতে মন রাজী হল না। আত্মাই যদি কলুষিত হয় তবে স্বাধীনতার মধ্যে কী পাব আমি?” (পৃষ্ঠা ১১)‘সাহিত্যের পথে দেশসেবা’ এই ব্রত গ্রহণ করে তিনি সর্বক্ষণের সাহিত্যজীবন শুরু করেছেন কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার দিক থেকে কখনই তাঁকে বিযুক্ত থাকতে দেখি না। সাহিত্যরচনার পাশাপাশি গঠনমূলক দেশসেবার কাজেও জড়িয়ে থেকেছেন এবং তাঁর রাজনৈতিক চেতনা সম্প্রসারিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যেও। তিনি সরাসরি কংগ্রেস দলের কাজ নয়, সামাজিক ও গ্রামীণ উন্নয়নমূলক কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—
ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হলাম। কিছু কাজ আমার চাই। চরকা কাটি বটে, কিন্তু ওতে সমস্ত দিন কাটে না। আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের অবস্থা তখন বিশৃঙ্খল। তাই ওই কাজ ঘাড়ে তুলে নিলাম। ... ভাঙা পথঘাট মেরামত করাই, আঁকাবাঁকা নালাকে সোজা করে কাটাই, ওখানকার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সঙ্গে পরিচয় করি।” (আমার সাহিত্যজীবন, পৃষ্ঠা ২৫)‘ধাত্রীদেবতা’র শিবনাথ এবং ‘গণদেবতা’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে দেবু ঘোষের আদর্শ এইসব কথার মধ্যেই নিহিত দেখতে পাই।
রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তারাশঙ্কর গান্ধীজিকে অনুসরণ করেছেন, বিশেষ করে গ্রাম-স্বরাজ ও গ্রামীণ অর্থনীতির চিন্তায় তিনি গান্ধীজির কথাকেই উদ্দীপ্ত ভাষায় বিস্তৃত করেছেন তাঁর উপন্যাসে। দেশের মুক্তির অর্থ আত্মার মুক্তি, তার জন্যই সত্যাগ্রহ, আইন অমান্য আন্দোলন। স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সবচেয়ে কাম্য ছিল তাঁর পরম। স্বদেশপ্রীতি একসময় বিশ্বপ্রীতির জন্ম দেয় এবং এক বৃহত্তর সত্যের সন্ধান চলে। এখানে তারাশঙ্করের সঙ্গে যত না গান্ধীর যোগ, তার চেয়ে বেশি যোগ রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের গ্রাম ও স্বদেশভাবনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তারাশঙ্কর এ কথা আমরা জেনেছি। রবীন্দ্রনাথই গান্ধীর আগে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে রাষ্ট্র ও সরকারকে বাদ দিয়ে গ্রামকে ভেবেছেন। স্বয়ংসম্পূর্ণতা, আত্মশক্তি ও সকলের মধ্যে ঐক্য এবং মনুষ্যত্ববোধই ছিল তাঁর স্বদেশী সমাজের মূল ভাবনা। আমাদের সমাজ গ্রামীণ, কারণ নগরসভ্যতা ভারতের নয়। প্রত্যেক সমাজ ছিল সম্পূর্ণতা এবং এই কারণে রাজশক্তির অদলবদলে সমাজের জীবনধারা থমকে পড়েনি। কিন্তু ব্রিটিশ শক্তির শোষণ ভারতের গ্রামকে রেহাই দেয়নি। তাই গ্রাম হারিয়েছে তার আত্মশক্তি ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এর ফলে কৃষিমুখী সভ্যতা যন্ত্র ও ধনিকশ্রেণির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু এর ফলাফল যে গ্রামীণ জীবনে ভালো হয়নি এই বিশ্বাস তারাশঙ্করের ছিল। এর উদাহরণ মেলে ‘চৈতালী ঘূর্ণি’, ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’ ও ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে। ‘চৈতালী ঘূর্ণি’তে লেখক আমাদের জানাচ্ছেন—
“জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধ নাই, আছে শুধু উত্তাপ অগ্নি, অঙ্গার, কঙ্কাল, শব।”নির্মম এই জীবনের কী গভীর পর্যবেক্ষণ লেখকের! এই বর্ণনার মধ্য দিয়ে শুধু গ্রামীণ সমাজের মৃত্যুবার্তাই দিচ্ছেন না, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা তথা ভারতের বাস্তব রূপটিকেও প্রকাশ করছেন।“কঠিন রসলেশহীন, মাটির বুকে শীর্ণ পাংশুটে গাছগুলি তবু অতিকষ্টে বাঁচিয়া থাকে, যেন শুষ্কবক্ষ কঙ্কালবিশেষা নারীর সন্তান সব মরণের শোষণে রসময়ী ধরণী মা সেও বুঝি বন্ধ্যার মতো শুষ্ক হইয়া উঠিল।...
বাহিরের ওই মরণের ছায়ায় গ্রামখানাও ঠিক যেন মৃতের রাজ্য।”
‘চৈতালী ঘূর্ণি’তে যদি থাকে মার্কসীয় প্রভাবান্বিত শ্রেণিচেতনার কথা, ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯) উপন্যাসে দেখি গান্ধী-প্রবর্তিত রীতির অনুসরণ।
এর সম্ভাব্য কারণ এই হতে পারে যে ১৯৩০ সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ফলে জেলে থাকার সময় তিনি মার্কসীয় ধারণার পরিচয় লাভ করেছিলেন, কিন্তু ১৯৩৯ সালে সেসবের কোনো প্রভাবই তাঁর মধ্যে দেখা যায় না। এখন তিনি পুরোপুরি গান্ধীবাদী। উপন্যাসে শিবনাথ প্রথম দিকে কলেজজীবনের প্রভাবে বিপ্লবীদের সঙ্গে কাজ করছে কিন্তু পরে গান্ধীজির আদর্শকেই সে বেছে নিচ্ছে। বিপ্লববাদ সন্ত্রাসের পথ। এই পথ হত্যার পথ। শিবনাথ এই পথকে ভুল ভেবে সরে আসছে। বিপ্লববাদী দাদা একসময় সন্ত্রাসের পথ থেকে সরে গিয়ে দূরে আশ্রমজীবন যাপন করছে কারণ তার মনে হয়েছে এই পথ অসার। ফলে সন্ত্রাসবাদী দলের যুবক তাকে হত্যা করছে। এই পুরনো বিপ্লবীর সন্ত্রাসবাদ ও বিপ্লবের পথ বর্জনের সাহসিকতা দেখে শিবনাথের মন বিচলিত হয়, সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি তারও আস্থা টলে যায়। শিবনাথ তাঁর কাছে শুনেছে—
“আমার ধারণা, ইংরেজ তাড়ানোর নামই স্বাধীনতা নয়, বৈদেশিক শাসন উচ্ছেদ করে সম্প্রদায়ের শাসন প্রবর্তনের নাম রাজ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি। দেশের সত্যকার স্বাধীনতা ও থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বস্তু। ...স্বাধীনতা বলতে আমি কী বুঝি জানিস? এস্ট্যাবলিশমেন্ট অব এ গভর্নমেন্ট অব দি পিপল বাই দি পিপল, নট ফর দি সেক অফ দি পিপল। অনুগ্রহ নয়, দান নয়, তেত্রিশ কোটির দাবির বিষয়বস্তু গ্রহণ করতে কোটি কোটি হাত আপনা হতে এগিয়ে আসা চাই।”ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লব ও অহিংস সংগ্রামের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলেছিল, সেই দ্বন্দ্বের প্রতিফলন শিবনাথ চরিত্রের মধ্যে লক্ষ করা যায়। কিন্তু একসময় সে এই দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী বন্ধু সুশীলকে সে বলে—“অহিংসায় আমি বিশ্বাস করি, গণআন্দোলন আমি প্রত্যাশা করি, বিশ্বাস করি আমি মানুষকে।” প্রশ্ন করে--”স্বাধীনতা লাভ করলেই কি সব পেয়ে যাবে তুমি, সুশীলদা? ... ওতে তুমি চরম প্রাপ্তি পাবে, পরম নয়। ...পরম হল অফুরন্ত, অক্ষয়, চিরন্তন।” তারাশঙ্করের কাছে এই পরমই ছিল আকাঙ্ক্ষার বিষয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে তারাশঙ্কর যেমন জেল খেটেছেন, ক্ষয়িষ্ণু জমিদার শিবনাথও তেমনি জেলে গেছেন। শিবনাথ যেন এই উপন্যাসে তারাশঙ্করেরই আত্মপ্রতিকৃতি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে নব্য ধনিকশ্রেণির দ্বারা পুঁজির বিকাশ ঘটতে থাকে। এর ফলে কৃষিব্যবস্থা চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে। জমির হাতবদল হতে শুরু করে। এই অর্থ হল, জমিদারি শাসনে চাষি ভূমি হারাচ্ছে আর নব্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়েই প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে শুরু করেছে। ‘গণদেবতা’ (১৯৪২) উপন্যাসে অনিরুদ্ধ কাহার গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে উৎখাত হয়ে আধুনিক শিল্পব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়, কারণ সে জানায়—“আমার চোখের সামনে ১১টি ঘরের হাল উঠে গিয়েছে। জমি গিয়ে ঢুকেছে কঙ্কনার ভদ্রলোকদের ঘরে।” এই অবস্থায় দেবু পণ্ডিত গান্ধীবাদকে অনুসরণ করে গ্রামীণ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদী যতীনকে উপেক্ষা করতে পারছে না। এই প্রীতি লেখক তারাশঙ্করেরও হয়তো। এদিকে শিবকালী গ্রামে টাকার জোরে ছিরু পাল জমির মালিক হয়ে জমিদারের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠছে। সে যেন নিজেই রাষ্ট্রশক্তি হয়ে উঠতে চায়। ধনের জোরে সে পাল থেকে ঘোষ হয়েছে। লেখক তার বর্ণনা করেছেন এইভাবে—
“লোকটার চেহারা প্রকাণ্ড, প্রকৃতিতে ইতর এবং দুর্ধর্ষ ব্যক্তি। সম্পদের যে প্রতিষ্ঠা সমাজ মানুষকে দেয়, সে প্রতিষ্ঠা ঠিক ওই কারণেই ছিরুর নাই। ধনী ছিরু পালকে ভয় করিলেও সম্পদোচিত সম্মান কেহ দেয় না।”সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি ব্যবস্থা তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা হারিয়ে ফেলার জন্যই ছিরি ঘোষের উত্থান। ধনগর্বে চণ্ডীমণ্ডপের বিচারসভায় প্রবীণ জমিদারবংশীয় মাতব্বর চৌধুরীর কথা অগ্রাহ্য করতে তার বাধে না। বস্তুত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই পরিবর্তন দেখেছে গ্রামীণ জীবন। শুরু হয়েছে স্বদেশী আন্দোলন, শোনা যাচ্ছে রুশ বিপ্লবের কথা, সাম্যবাদী স্বপ্নের কথা। বিপ্লববাদী বিশ্বনাথ দেবুকে বলে, “এ যুগে চণ্ডীমণ্ডপ আর চলবে না। কো-ওপারেটিভ ব্যাঙ্ক করতে পার?” ক্রমশ রাজনীতি এই পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠেছে, এ কথা তারাশঙ্কর খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করেছেন।
‘পঞ্চগ্রামে’ও গান্ধীপ্রবর্তিত সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের আদর্শ প্রাধান্য পেয়েছে। দেবুর চরিত্রের মধ্যে এই আদর্শ প্রকট। অস্পৃশ্যতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিধবা ও অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে গান্ধীর মতই ব্যক্ত করেছে দেবুচরিত্র। জেল থেকে ফিরে এসে তিনি বালবিধবা শিক্ষিত ও সুন্দরী তরুণী স্বর্ণকে বলছেন তার আদর্শের কথা।
“দেবু স্বর্ণকে বলিয়া চলিয়াছে—তার যে কথা বলিবার ছিল। তাহার নিজের কথা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। সেই পুরনো কথা। সত্যযুগের আমন্ত্রণ নূতন ভঙ্গিতে, নূতন ভাষায়, নূতন আশায়, নূতন পরিবেশে সুখস্বাচ্ছন্দ্য-ভরা ধর্মের সংসার। দেবু বলিল, তোমার আমার সে ঘরে সমান অধিকার, পুরুষ স্বামী নয়, স্ত্রী দাসী নয়—কর্মের পথে হাত-ধরাধরি করে চলব আমরা। তুমি পড়াবে এখানকার মেয়েদের, শিশুদের, আমি পড়াব ছেলেদের—যুবকদের। তোমার আমার দুজনের উপার্জনে চলবে ধর্মের সংসার।”কর্মই দেবুর জগৎ। এর দ্বারাই গ্রামের দীনতা হীনতা কদর্যতা দূর করবে সে, অশিক্ষা থাকবে না, গ্রামীণ অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। এটাই সত্যযুগের আমন্ত্রণ যা গান্ধীর কাছে রামরাজ্য ও গ্রামীণ সমাজ। স্বরাজচিন্তায় সেবা নয়, দান নয়, কর্ম ও বিনিময়ই প্রধান। জেল থেকে ফিরে এই শিক্ষাই প্রকাশ করেছে দেবু। সে জেল খেটেছে দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয়তার জন্য। গ্রামীণ স্বরাজের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা জড়িত। কারণ পরাধীন ভারতে দেশের মানুষের মুক্তি নেই। কিন্তু এই মুক্তি সশস্ত্র সংগ্রামে আসবে না, আসবে না যতীনের হিংসার পথে, কিংবা বিশ্বনাথের কমিউনিস্ট বিপ্লববাদের পথেও আসবে না। মুক্তি শুধুই গান্ধীজি প্রদর্শিত অহিংস আন্দোলনের পথে। এই পথের সন্ধান দিতে চায় দেবু। গান্ধীজির আদর্শে উজ্জীবিত হয়েই সে মৃতপ্রায় পল্লিজীবনের পুনরুজ্জীবন চায়। ‘ধাত্রীদেবতা’য় তারাশঙ্কর জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রের স্বাধীনতা চেয়েছেন, আর ‘গণদেবতা’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’-এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে গ্রামীণ স্বরাজ প্রতিষ্ঠার বাসনাও প্রকাশ করেছেন।
'মন্বন্তর' (১৯৪৪) রচিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর ও প্রত্যক্ষ রাজনীতির আবহে। নানা অভিঘাতে বিপর্যস্ত কলকাতার নগরজীবন। গণদেবতা ও পঞ্চগ্রামে যেমনভাবে তারাশঙ্কর পল্লিজীবনের মহাকাব্য রচনা করেছেন, ‘মন্বন্তর’এ তিনি নগরজীবনের মহাকাব্য রচনা করতে যাননি। অনুজ্জ্বল একটি চতুর্ভুজ প্রেমের কাহিনি বলেছেন কেউ কেউ। তবু পারিবারিক সমস্যার পথ ধরে এই উপন্যাস মন্বন্তর নামক সমস্যার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে। উপন্যাসে শুরুতেই কানাইয়ের উপলব্ধি—
“বিশ বছরে ধনী যে ধন উপার্জন করত, এক বছরে সেই ধন সে সঞ্চয় করেছে। সঙ্গে সঙ্গে এক বৎসরে বিশ বছরের বঞ্চনায় বঞ্চিত হচ্ছে দরিদ্রের দল। বিশ বৎসরের অভাব—অন্নের বস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে পরমায়ুরও অকস্মাৎ নিষ্ঠুরতম হিংস্র মূর্তিতে এসে আক্রমণ করেছে পৃথিবীর মানুষকে। বিশেষ করে এই হতভাগ্য দেশের হতভাগ্য মানুষগুলিকে।”কানাইয়ের আদর্শবাদ লক্ষণীয়ভাবে স্পষ্ট হয়েছে উপন্যাসে। দুর্যোগের ছবি তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তার বংশের সম্পদ সংগ্রহের ইতিহাস, লালসা ও বিলাস তাকে ক্লিষ্ট করেছে। এমনকি, নীলাকে জীবনের প্রতিপক্ষে দাঁড় করাতে সাহসে কুলোচ্ছে না তার। আদর্শবাদী কানাইকেও আমরা দেখি দারিদ্রের জন্য নানাভাবে সমঝোতা করতে। সবমিলিয়ে, তারাশঙ্করের মন্বন্তর-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহর কলকাতার মানুষের কলঙ্কময় সমাজব্যবস্থার যে নিপুণ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও মানবিক অবক্ষয়ের এক দলিল হয়ে উঠেছে। তবে এ উপন্যাসের আবেদন আর এক জায়গায়। লেখক তাঁর এতদিনের রাজনৈতিক দর্শনকে এখানে স্থাপিত করেছেন বিতর্কিত এক বিশ্বাসে। জাতীয়্তাবাদী তারাশঙ্কর এই উপন্যাসে সাম্যবাদীদের প্রধান চরিত্র করে দুর্যোগকালের প্রেক্ষাপটে ত্রাণকর্তা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। সমাজের পীড়িত মানুষের আর্ত চিৎকার বিচলিত করেছে তারাশঙ্করকে। তিনি সাম্যবাদের প্রতি হৃদ্যতা জ্ঞাপন করেছেন, এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাঁর কমিউনিস্ট চরিত্রেরা তাত্ত্বিক অর্থে যথার্থ শ্রেণিচ্যুত সাম্যবাদী নয়। একটি চরিত্রও সেই অর্থে প্রকৃত কমিউনিস্ট চরিত্র হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ কালোবাজারির চিত্র উন্মোচন করে লেখক যথেষ্ট রাজনীতি সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
এই উপন্যাস যখন শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৯৪৩) প্রকাশিত হয়, তারাশঙ্কর তখন ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সভাপতি। কমিউনিস্ট নেতা বিজয়দার চরিত্রের মধ্যে যেন লেখকের নিজের দোলাচল ও পরস্পরবিরোধিতা প্রস্ফুটিত। এ কারণেই তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে গান্ধীবাদীদের আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্য ভুলে যান। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কমিউনিস্টরা গান্ধীজিকে সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী হিসেবে দেখেছে। অথচ বিজয়দা গান্ধী সম্পর্কে দুর্বল। গান্ধীর কর্মে তিনি আবিষ্কার করেন ‘বশিষ্ঠের পুণ্যফল’ ও ‘সত্যধর্মে’ প্রতিষ্ঠা। মার্কসবাদের বদলে তিনি অন্বেষণ করছেন গীতার বাণীর সার্থকতায়। ফলে তিনি আর যথাযথ কমিউনিস্ট থাকেন না। এখানেই চরিত্রটির ওপর লেখকের ব্যক্তিভাবনার আরোপ। তারাশঙ্কর নিজেই লিখেছেন—“আমার অহিংসার প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস ও গান্ধীজির প্রতি অনুরক্তিই তার ওপর আরোপিত হয়েছে।”
তারাশঙ্করের স্বদেশভাবনায় নিহিত আছে দেশকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখে চলে দেবু, আর নতুন স্বপ্নের শুরু ‘সন্দীপন পাঠশালা’(১৯৪৬)-য় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্য দিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে চাষির সন্তান সীতারাম যেদিন থেকে পড়াশুনা শুরু করে সেদিন থেকেই তার বাবা রমানাথের মনে হয়েছে এবার বুঝি পূর্বপুরুষের চাষবাসের ধারার অবসান হয়েছে। কিন্তু পাঠশালা গড়ে তোলার মানসিকতাকেই বিদ্রুপ করতে ছাড়ে না ভদ্রলোকেরা। তাঁদের ভাষায়—‘চাষা পণ্ডিত আর শৌণ্ডিক ছাত্র’। উচ্চবর্ণের কিছু মানুষ পাঠশালার উদ্বোধনের দিন গৃহকে বিষ্ঠায় লিপ্ত করেছে। ধীরানন্দ যিনি পরে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হবেন, তিনি এগিয়ে আসেন গৃহ পরিষ্কার করতে। গান্ধী দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্রকে সীতারাম প্রণাম জানায় কেননা তাঁদের স্বদেশী আন্দোলনের ফলে সমাজে তুমুল আলোড়ন লক্ষ করা গেছে। প্রাচীন সংস্কারের অন্ধকারের ভিতর প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে সীতারাম একধরনের সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও কোনো বৈপ্লবিক সমাজপরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা যায়নি। সীতারামের শ্রেণিসচেতনতা আছে কিন্তু তা তার শ্রেণিকে বাবুদের সমগোত্রীয় করে তোলার কাজে ব্যয়িত হয়েছে। মধ্যবিত্তের জীবনাকাঙ্ক্ষা, যেমন ইংরেজি শিখে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওঠাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই কারণে আধুনিক অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হলে সামন্ত সহায়তা-নির্ভর সন্দীপন পাঠশালা উঠে যায়।
তারাশঙ্কর নিজের রাজনৈতিক ভাবনা সম্বন্ধে লিখেছেন—
“অনেকে আমাকে মার্কসবাদে প্রভাবান্বিত বলে ঠাউরেছেন। কিন্তু মার্কসের ক্যাপিটাল বা তাঁর লেখা কোনো বই আমি পড়িনি। আমার সম্বল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, তা থেকেই আমার উপলব্ধিজাত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম।”‘আমার সাহিত্য জীবন’-এর আর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন—
“হাজার হাজার বৎসর ধরে মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তের কাল একদিন আসবেই। এই আমি বুঝেছিলাম। ১৯১৬/১৭ সাল থেকে ১৯৩০/৩১ সাল পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে মানুষের মধ্যে ঘুরে এইটুকু বুঝেছিলাম যে সেদিন আসতে আর দেরি হবে না। রুশ বিপ্লব সেইদিনের উষাকাল তাতে সন্দেহ নেই। বাতাসটা উঠেছিল সেখানেই প্রথম, সেখান থেকেই বাতাস উঠে এখানকার গুমোটের মধ্যে চাঞ্চল্য তুলেছে। এর জন্য মার্কসবাদ পড়তে হয়নি আমাকে।” (পৃষ্ঠা ৯৩)স্পষ্টতই মানবতাবাদী তারাশঙ্করের মনে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষের সাম্য। তাঁর স্বদেশপ্রীতির মূল ভিত্তি হল এই। কিন্তু এই সাম্য একটি স্থির লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দু নয়। স্বদেশকে অতিক্রম করে যে পরমের সন্ধান তাঁর সেখানে এক বৃহত্তর সত্যের সন্ধান তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তাঁর পরম সত্যকেই তিনি দেশের ক্ষেত্রে রূপায়িত দেখতে চেয়েছেন তারাশঙ্কর। এখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যোগ আমরা লক্ষ করেছি।
‘সুতপার তপস্যা’ (১৯৭১) শেষবারের মতো তারাশঙ্করের রাজনীতি চেতনা প্রকাশ করেছে। ‘মন্বন্তর’এ একটা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন লেখক। এই আদর্শ সাম্যবাদী আদর্শ। কিন্তু এখানে জাতীয়তাবাদী আদর্শ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, গ্রামীণ স্বরাজের আদর্শ, সত্যাগ্রহ সব এখন পুরনো ইতিহাস। গান্ধীজির অহিংসার নীতি পরিত্যক্ত। আর কমিউনিস্টদের প্রতি তারাশঙ্করের বিরূপ ধারণা এখানের প্রেক্ষিতে পেয়েছে নতুন রূপ। দেশের জন্য রাজনীতি নয়, পার্টির জন্যই রাজনীতি। বুদ্ধিজীবীরাও এখন রাজনীতিক, আর তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই সাধারণ মানুষের। দলের বৃদ্ধির জন্য অনাচারও গ্রহণ করতে দ্বিধা নেই। এইসময় খুনোখুনির রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গ যখন রক্তাক্ত হচ্ছে, তখন তারাশঙ্কর খুঁজতে চেষ্টা করেছেন এর মধ্যে জীবনের কোনো সত্য লুকিয়ে আছে কি না। উপন্যাসে সুব্রতর যে পরিবর্তন তা সম্ভবত ওই সত্যসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সে এমন এক পার্টি করে যারা দ্বান্দ্বিক জড়বাদে বিশ্বাস করে না, আবার কংগ্রেস দলও নয়। জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যে তার বিশ্বাস। সে জানায়—“ন্যাশানালিটিতে আমি ইন্ডিয়ান, জাতিতে আমি ভারতীয়, এটা ভুলব কী করে? হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান—এ জাত আমিও ঠিক মানি না, এ জাতের থাক উঠিয়ে দেবার আন্দোলন করলে আমাকে ভলান্টিয়ার পাবে—কিন্তু ভারতীয় জাতিত্বকে ওঠাতে গেলে যে স্বাধীনতাকে আবারও জলে ডোবাতে হয়। ন্যাশানাল থেকে ইন্টারন্যাশানাল হওয়া আমার ধাতে ঠিক সয় না।” এই কণ্ঠস্বর লেখক তারাশঙ্করের না হয়ে যায় না। সুব্রতের মধ্য দিয়ে কথা বলছেন একদা স্বাধীনতা-সংগ্রামী তারাশঙ্কর।
কিন্তু সেই সুব্রতকে সত্যানুসন্ধানের কাজে লাগালেন লেখক। বদলে গেছে সুব্রত। অহিংসা ছেড়ে সে এখন হিংসায় বিশ্বাসী। ব্যক্তিগত জীবনে সে ব্রাহ্মণ হলেও বৈদ্যকন্যাকে বিয়ে করেছে ভালোবেসে। তাঁদের মধ্যে প্রেম থাকলেও রাজনৈতিক মতবাদ তাঁদের বিবাদের কারণ হয়ে ওঠে। সুতপা সুব্রতর গৃহ ছেড়ে চলে যায়। সুব্রত নিঃসঙ্গ, একাকী, রাজনীতিই তার একমাত্র অবলম্বন। ব্যক্তিগত জীবনের হতাশাই তাকে হিংসার রাজনীতিতে টেনে নিয়ে যায়। তার মৃত্যুর খবর রটে। সুতপা পুত্রকে নিয়ে তপস্বিনীর মতো রাজনীতির সংস্রবহীন জীবন কাটাচ্ছে। এইসময় ফিরে আসে সুব্রত। এখন সে নতুন মানুষ; ঈশ্বর, ধর্মশাস্ত্র সব মিথ্যা তার কাছে; অর্থ, যৌবন ও রাজনীতি তার আকর্ষণের বিষয়। বহু লোককে হত্যা করে এখন তার কাছে হিংসাই সত্য। অনৈতিক উপায়ে অর্থ রোজগার করতে সে পিছপা নয়। “সেকাল হলে আমি কালাপাহাড় হয়ে সর্বপ্রথম আমার বাড়ির ওই শালগ্রাম শিলা আর গোপালমূর্তি দুটোকে জলে ফেলে দিতাম। আমি নতুন করে পলিটিকাল পার্টি তৈরি করব। নূতন পৃথিবী। নগ্ন সত্য হবে ভিত্তি। একটা ব্লাডবাথের মধ্য দিয়ে হবে নতুন দিনের সানরাইজ”, সে বলে। রক্তাক্ত রাজনীতি মেনে নিতে পারে না সুতপা। সুব্রতর জীবন থেকে সে অনেক দূরে চলে যায় পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। সুতপার চলে যাওয়া যেন লেখকেরও। কোনো সত্যানুসন্ধানের দৃষ্টিতেই হিংসাকে তিনি মেনে নিতে পারেন না। সাময়িক বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি ঘটে তাঁর। কিন্তু কোনোকিছুকেই সত্য বলে গ্রহণ করতে পারছেন না।
আর একদিক থেকে ঘটেছে মোহমুক্তি তাঁর। দেশের রাজনৈতিক চিন্তার অবনমন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ব্যর্থতা, বেকারি বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, নিরক্ষরতা তাঁকে হতাশ করেছে। রাজনীতিতেও আর আস্থা রাখতে পারেন না। গ্রামীণ শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ভাঙাগড়ার যে চিত্র তিনি তাঁর উপন্যাসে এঁকেছেন তার গভীরতা অসীম। কিন্তু ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব সম্পর্ক একটি পর্যায়ের পর তাঁকে আর আকর্ষণ করে না। বাস্তববাদী হয়েও আর তিনি বাস্তববাদী থাকেন না। স্বাধীনতা-উত্তর কালের বাস্তব তাঁর আকাঙ্ক্ষিত পথে চলেনি বলেই বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি চলে গেছেন ইতিহাসে, ধর্মীয় গূঢ় সাধনায়, অধ্যাত্মবাদী আদর্শের আশ্রয়ে। তিনি আস্থা রাখেন প্রিয় অধ্যাত্মবাদী ভঙ্গিতে রোম্যান্টিক স্বপ্নাবিষ্টতায়। রাজনীতির ঊর্ধ্বে মানুষ ও তার ধর্ম স্থান পায়। মানবিকতাবাদী ও আস্তিক্যবাদী পরিচয়ই শেষ হিসেবে তারাশঙ্করের পরম পরিচয় হয়ে ওঠে।