"আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি... অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে... পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো... "। সূর্য ডোবার অপেক্ষায় থাকে এক অভিমানী কন্যা। দিগন্ত জুড়ে আঁধার নামে। আকাশের তারা হয়ে মিটিমিটি আলোর প্রদীপ নিয়ে লক্ষ যোজন দূর থেকে সে তাকিয়ে দেখে প্রচন্ড কোলাহলের মঝেও তার ছেড়ে যাওয়া পৃথিবী কেমন নিরুচ্চার, পৃথিবী যেন তারই মতো একলা, তারই মতো সর্বংসহা। তার হেঁটে চলা পথ ঢেকেছে বুনো ঘাস। তার যাওয়া আসা লক্ষ্য করে নি যেন কেউ। সে বঙ্গকন্যার নাম বিভা। তাঁরই নামে আকাশের এক তারা। আমাদের সৌরজগতের বাইরে, সূর্যের থেকে ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরে হলদেটে সাদা, ছোট সে তারা। সেক্সট্যান নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে তার বাস। সংখ্যার হিসেবে তার পরিচয় এইচ ডি-৮৬০৮১। খালি চোখে আমাদের চোখে সে ধরা দেয় না। সে তারা নতুন পরিচয় পেল ২০১৯ সালে। প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন-এর শতবর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন দেশের কাছে সুযোগ আসে একটি করে নক্ষত্র এবং তার এক্সোপ্লানেটের নামকরণের। ভারতের ভাগে পড়ে এইচ ডি-৮৬০৮১ তারাটি । আয়োজিত হয় নামকরণের প্রতিযোগিতা। আরো অনেক প্রস্তাবিত নামের মধ্যে থেকে এন আই টি, সুরাটের ২০ বছরের ছাত্র অনন্য ভট্টাচার্যের প্রস্তাবিত 'বিভা' নামটি নির্বাচিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন তারাটির নাম দিলেন 'বিভা'। ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী বিভা চৌধুরীর স্মৃতিতে এই নামকরণ। 'বিভা'র চারপাশে ঘোরা এক্সোপ্ল্যানেটটির নাম সান্তমাসা, যার অর্থ 'মেঘলা'। অস্বীকৃতির মেঘ যাঁর সমস্ত কর্মজীবন ঢেকে রেখেছিল, সেই বিভার সহচরী গ্রহের নাম যে 'মেঘলা' হবে, এ আর নতুন কথা কি! বিভা চৌধুরীই প্রথম ভারতীয় মহিলা কণা-পদার্থবিজ্ঞানী বা পার্টিকল্ ফিজিসিস্ট। যাঁর কৃতিত্বের বিভা ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল বিজ্ঞানী মহল থেকে সাধারণের মধ্যে, যাঁর কাজের স্বীকৃতি উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকার কথা ছিল ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে, যাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে গর্বিত হতে পারত তাঁর স্বদেশ, তাঁর কথা জানলই না কেউ। গুটিকয় পদার্থ বিজ্ঞানীর বাইরে বিভা চৌধুরী প্রায়-অশ্রুত নাম। এই উপেক্ষা কি তিনি মহিলা বলেই! তাইবা বলি কেমন করে! ২০০৮ সালে রোহিনী গোড়বলে এবং রাম রামস্বামী সম্পাদিত এবং ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস থেকে প্রকাশিত "লীলাবতী'স ডটার্স: দ্য উইমেন সায়েন্টিস্টস অফ ইন্ডিয়া" বইটিতে আটানব্বই জন ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানীর কথা থাকলেও, ছিল না বিভা চৌধুরীর নাম। ২০২৪ এর পরিমার্জিত সংস্করণে এখন তা সংযোজিত হয়েছে। জীবনভর এই বিচ্যুতি এবং বিস্মৃতির পাহাড়ের আড়ালবাসিনী বিভা নিমগ্ন থেকেছেন তাঁর গবেষণায়। তাঁর ধ্যানজ্ঞান পদার্থ বিজ্ঞান, যে পথে হাঁটার সাহস দেখাননি তখনো বিশেষ কোন মেয়ে। তবু কোনো প্রচারের আলো খুঁজে নেয়নি তাঁকে। তিনি কেবলই থেকে গেলেন এক দূরের তারার ক্ষীণ আলোয়, মেঘলা সময়ের ঝাপসা স্মৃতি হয়ে।
বিভার জন্ম ১৯১৩ সালে, কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত ও প্রগতিশীল পরিবারে। বাবা বঙ্কুবিহারী চৌধুরী ছিলেন পেশায় ডাক্তার। মা ঊর্মিলা দেবী ব্রাহ্মসমাজের সদস্য। বিয়ের পর বঙ্কুবিহারী ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। পরিবারের আবহ শুধু পুরুষ নয়, মেয়েদেরও উচ্চশিক্ষায় সমান ভাবে এগিয়ে যেতে সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছিল। যে সময়ে মেয়েদের পড়াশোনা প্রায় অপরাধের মতো ছিল, বিভা সে সময়ে বেথুন স্কুল পেরিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি এস সি পাশ করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন। সেবছর চব্বিশ জনের ক্লাসে একমাত্র ছাত্রী বিভা। একলা চলার পথ হয়তো তখনই তাঁর জীবনের যাপন মন্ত্র হয়ে গিয়েছিল। তাঁর আগে মাত্র দুজন ছাত্রী, চামেলী বসু এবং চামেলী দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছিলেন। তাঁরা দুজনে শিক্ষকতা ও সরকারি চাকরিতে যোগ দিলেও বিভা সম্পূর্ণভাবে গবেষণার কাজে ডুবে গেলেন। ১৯৩৬ সালে বোস ইনস্টিটিউটে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোসের ভাগ্নে, ড. দেবেন্দ্র মোহন বোসের অধীনে গবেষণায় যোগ দেন বিভা। শুরুটা যদিও বিভার জন্যে খুব সহজ ছিল না, কারণ ড. বোস তাঁর গবেষণাকে 'মেয়েদের জন্যে অনুপযুক্ত' বলে বিভাকে নিতে অস্বীকার করেন। যেমন করে একদিন সি ভি রমন ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এ কমলা সোহনী-কে রিসার্চ স্কলার হিসেবে নিতে অস্বীকার করেন শুধু মেয়ে বলে। যাইহোক, নিজেকে উপযুক্ত প্রমাণ করে বিভা ড. বোস-এর অধীনে গবেষণা শুরু করেন। তাঁদের গবেষণার বিষয় মহাজাগতিক রশ্মি। গবেষণার প্রয়োজনে তাঁরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে হিমালয়ের ১৪০০০ ফুট উচ্চতা অবধি পৌঁছন। দার্জিলিং, সান্দাকফু এবং ভূটান সীমান্তের ফারিজং-এর মতো দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে হাফটোন ফোটোগ্রাফিক প্লেটের সাহায্যে দীর্ঘ সময় ধরে মহাজাগতিক রশ্মির প্রকৃতি ও গঠন পর্যবেক্ষণ করেন তাঁরা। 'মেসোট্রন' কণার সন্ধান মেলে তাঁদের ফোটোপ্লেটে। বিভাই প্রথম মেসোট্রনের ভর নির্ধারণ করেন। 'নেচার' পত্রিকায় তড়িঘড়ি চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তাঁরা। ফোটোপ্লেটের সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁদের ফলাফলে কিছু ত্রুটি ছিল। এই বিষয়ে আরো নিবিড় গবেষণার জন্যে তাঁরা প্রস্তুত হতে থাকেন। কিন্তু বিধি বাম। শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইংল্যান্ড থেকে ফোটোগ্রাফিক প্লেট আনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। থমকে যায় বিভা এবং ড. বোসের গবেষণা। অথচ যুদ্ধ শেষে এই একই বিষয়ে আরো উন্নত ফুলটোন ফোটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে ইংল্যান্ডের সি.এফ. পাওয়েল আবিষ্কার করলেন নতুন কণা 'পাই-মেসন'। ১৯৫০ সালে সেই গবেষণার জন্যে পাওয়েল পেলেন নোবেল পুরস্কার। যা হয়তো প্রাপ্য ছিল বিভা এবং ড. বোসের। কিংবা অস্ট্রিয়ার পদার্থ বিজ্ঞানী ম্যারিয়েটা ব্লাউ-এর। তিনিও বিভার মতো আর এক উপেক্ষিতা বিজ্ঞানী, যাঁর দেখানো পদ্ধতি অবলম্বন করে পাওয়েল সাফল্য পেলেন। পাওয়েল তাঁর গবেষণায় বার বার স্বীকৃতি জানিয়েছেন এই দুই ভারতীয় পথ প্রদর্শককে। কিন্তু ইতিহাস পাওয়েলকেই মনে রেখেছে, পথপ্রদর্শকদের নয়।
দমবার পাত্রী নন বিভা। এর পর ১৯৪৫ সালে তিনি ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারে পি. এম. ব্ল্যাকেট-এর অধীনে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে পি এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন বিভা, আর তার মাস তিনেক আগে ওই একই বিষয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল প্রাইজ পেলেন ব্ল্যাকেট। ব্ল্যাকেটের কাজে বিভার অবদান আলাদা করে জানা না গেলেও তাঁর থিসিসের পরীক্ষকরা টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ অধ্যাপনার জন্যে ড. হোমি ভাবার কাছে তাঁর নাম সুপারিশ করেন। তবে অধ্যাপক হিসেবে নয়, ১৯৪৯ সালে বিভা টি আই এফ আর-এ প্রথম মহিলা ফেলো হিসেবে যোগ দেন। লিঙ্গবৈষম্যের চোরা স্রোত বয়ে চলেছিল সবখানেই। বিভাকে লেখা চিঠিপত্রে তাঁকে 'শি' না বলে 'হি' বলে উল্লেখ করা হতো। এ কি নেহাতই কলমের দোষ!
ফরাসী ভাষায় দক্ষতা তাঁর আগেই হয়ে গিয়েছিল। টি আই এফ আর ছেড়ে ১৯৫৪ সালে বিভা চলে যান প্যারিসে। সেখানে অধ্যাপনার পাশাপাশি আল্পস পর্বতে তাঁর গবেষণার কাজ চালান। তার কিছুদিন পর চলে যান আমেরিকায়; মিশিগান ইউনিভার্সিটি এবং এম আই টি-তে প্রফেসর ব্রুনো রসির সাথে একযোগে তাঁর গবেষণার কাজ করেন। দেশে ফিরে ১৯৫৭ সালে তিনি বিক্রম সারাভাই-এর অধীনে আমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন। এই সময় তিনি কোলার গোল্ড ফিল্ডে তাঁর গবেষণা শুরু করেন। বাতাসে নিউট্রিনোর উপস্থিতি নথিবদ্ধ করা এবং পার্টিকল ডিটেক্টর নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। অথচ তাঁর সহকর্মীরা তাঁদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় পুরস্কার পেলেও কোন স্বীকৃতি পেলেন না বিভা। তাঁর জন্য বরাদ্দ কেবল 'বিশেষ ধন্যবাদ'। এর পর মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে মাউন্ট আবুতে বিক্রম সারাভাইয়ের সঙ্গে আরো বিস্তৃত গবেষণার পরিকল্পনা করেন বিভা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সারাভাই অকালে চলে গেলেন। আবার থমকে গেল বিভার পরিকল্পনা। কর্তৃপক্ষ কোন এক অজ্ঞাত কারণে বিভার রিসার্চ গ্র্যান্ট মঞ্জুর করলেন না।
এবার তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়, তাঁর আপন শহরে, ১৯৮১ সালে। কিন্তু তাঁর গবেষণায় ভাটা পড়ল না। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সেস-এ তিনি তাঁর নিরলস গবেষণা চালিয়ে গেছেন। ১৯৯০ সালে 'নেচার' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর শেষ গবেষণাপত্র। ১৯৯১-এর জুনে বাংলার এই বিদূষী কন্যা পাড়ি দিলেন তারাদের দেশে। এক আকাশ অস্বীকৃতি আর উপেক্ষার ছায়াপথ পেরিয়ে।
ভাবতে অবাক লাগে, বিজ্ঞানের যে শাখায় আজও মেয়েদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম, সেই কণা-পদার্থ বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ে এত অবদান রাখার পরেও কেন উপেক্ষার অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন বিভা চৌধুরী। খনির অতল গভীরতা থেকে হিমালয়ের দুর্গম উচ্চতা অবধি বিস্তৃত ছিল বিভার গবেষণার ক্ষেত্র। কিন্তু তাঁর পরিচিতির বিস্তার বিন্দুসম। রাজিন্দর সিং এবং সুপ্রকাশ রায়-এর লেখা "আ জ্যুয়েল আনআর্থড: বিভা চৌধুরী, দ্য স্টোরি অফ অ্যান ইন্ডিয়ান ওম্যান সায়েন্টিস্ট" বইখানি হয়তো নতুন প্রজন্মের সাথে পরিচয় করাবে এই 'হারিয়ে' যাওয়া 'আমি'র। কোনো এক 'তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতে' হয়তো দেখা হবে সেই অভিমানী কন্যার সঙ্গে। মুগ্ধ হবে কোনো জিজ্ঞাসু চোখ । ২০২০ সালে ভারত সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরীর নামে একটি চেয়ার প্রফেসরশিপ ঘোষণা করে। টি আই এফ আর কিংবা ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে। ব্যস। ওইটুকুই। ভারতের কোনো সায়েন্স অ্যাকাডেমি তাঁকে ফেলো নির্বাচিত করে সম্মান জানায়নি কোনদিন। কোনো পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম কখনো বিবেচিত হয়নি। না জাতীয় স্তরে, না তাঁর নিজের বঙ্গদেশে। তাঁর চলে যাওয়ার খবরটুকুও কোনো দৈনিকে ঠাঁই পায়নি। সংস্কারদীর্ণ সমাজের চোখ রাঙানির তোয়াক্কা না করে, সংসারের জালে নিজেকে না জড়িয়ে, আজীবন যে মানুষ গবেষণায় ডুবে থাকলেন, লিখে গেলেন যুগান্তকারী সব গবেষণাপত্র, বিজ্ঞান সাধনায় উৎসাহিত করে গেলেন অনুজদের, তাঁর কি আরো অনেক স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল না! শুধুমাত্র একটা দূরের তারার নামে বেঁচে থাকবেন বিভা! এ উপহাস তোমায় মানায় না বিজ্ঞান জগৎ! ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরের 'বিভা' নক্ষত্র নাকি প্রতি সেকেন্ডে ৩১ কিলোমিটার বেগে দূরে সরে যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়মে। হয়তো অভিমানেও। সরে যায় আমাদের স্মৃতি থেকেও, একই বেগে। এক উজ্জ্বল মেধার রূপকথার গল্প ফুরিয়ে যায় বিস্মৃতির তেপান্তরে। "তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে…তারও দূরে...তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে..."।