• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮ | অক্টোবর ১৯৯৮ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • নিবিড় পাঠঃ ক্লিনটন সিলি-র জীবনানন্দ : অংকুর সাহা

    A Poet Apart—A Literary Biography of the Bengali Poet Jibanananda Das (1899-1954)-—Clinton B. Seely; Univ. of Delaware Press, USA; 1990; Pp. 341; ISBN: 0-87413-356-4

    || ১ ||

    ক্লিনটন সিলির কথা আমি প্রথম জানতে পারি প্রায় আড়াই দশকেরও বেশি আগে। মেদিনীপুর জেলে শহর ছেড়ে বেরিয়ে দক্ষিণ পানে এগুলে এবং কাঁসাই নদীর সেতু পেরিয়ে কয়েক মাইল গেলেই ইন্দা নামক জনপদ—সেখানে খড়গপুর কলেজ। জীবনানন্দ ঐ অখ্যাত কলেজে ইংরেজির অধ্যাপনা করেছিলেন কয়েকমাস ১৯৫০-৫১ সাল নাগাদ। সেখানে তথ্যসন্ধানে এসেছেন একজন আমেরিকান জীবনানন্দ-গবেষক, এইরকম খবর পেয়েছিলাম লোকমুখে। এর কয়েক বছর পরে তিনি একটি জনপ্রিয় ও বহু-বিতর্কিত বাংলা উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করেন। বুদ্ধদেব বসু রচিত “রাত ভরে বৃষ্টি” উপন্যাসটির ক্লিনটনকৃত অনুবাদ “রেন থ্রু দ্য নাইট” প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।

    একেবারে গোড়ার থেকেই শুরু করা যাক। ক্লিনটন সিলি ১৯৬৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার পরে জন কেনেডি প্রতিষ্ঠিত শান্তি বাহিনীর (পিস কোর) কর্মী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। সেখানে দুবছর ধরে তাঁর কাজ ছিলো বরিশাল জেলা স্কুলে হাতে কলমে প্রাণীবিদ্যা শেখানোয় বিজ্ঞান শিক্ষকদের সাহায্য করা। তারই ফাঁকে ফাঁকে সাগরদির ওরিয়েন্টাল মিশনারি স্কুলে বাংলা শিখতে যেতেন সপ্তাহে কয়েক দিন। এখান থেকেই তাঁর বাংলাভাষার চর্চা শুরু—বাংলা বলেনও শুদ্ধ বরিশালি টানে। দু বছরের স্বেচ্ছাসেবক জীবন শেষ হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরে স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের “দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সভ্যতা” বিভাগে যোগ দেন। শিক্ষার বিষয়—“বাংলা ভাষা ও সাহিত্য”। শিক্ষক—বাংলা ভাষার ডাকসাইটে অধ্যাপক এডোয়ার্ড সি ডিমক। এইভাবেই শুরু হল তাঁর বাংলা সাহিত্যে নিমজ্জন।

    ১৯৬৭-৬৮ সনে আয়ওয়ার একটি রাইটার্স ওয়ার্কশপে তাঁর সংগে পরিচয় ঘটে কবি, প্রাবন্ধিক এবং “কলকাতা পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্তের। শোনা যায় যে জ্যোতির্ময় তাঁকে প্রাণিত করেন গবেষণার বিষয়বস্তু নির্বাচনে। সেই বিষয়বস্তু—“জীবনানন্দ”। গবেষণার সূত্রে ক্লিনটন দ্বিতীয়বার বাংলায় এলেন ১৯৬৯-এ—এবার জীবনানন্দ-এর কর্মস্থল কলকাতায়। শুরু হ’ল তন্নতন্ন করে খোঁজা—তথ্যসন্ধান—ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি থেকে আরম্ভ করে রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে চুনীলালের চায়ের দোকান। আতিথ্য ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন জ্যোতির্ময়ের সুত্রে বসু পরিবার—বুদ্ধদেব-প্রতিভা। ১৯৭১ সালে শিকাগোয় ফেরেন এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপনা শুরু করেন। জীবনানন্দ গবেষণা শেষ করেন ১৯৭৬ সালে। পরবর্তী গবেষণার বিষয়—মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ১৯৮১-৮২তে ছ মাসের জন্য বাংলাদেশে যান, ঢাকা ও চট্টগ্রামে—বাংলা ভাষাটিও ঝালিয়ে নেন সেই ফাঁকে।

    ৮০ র দশকে আমেরিকান কবি লেনার্ড নেথানের সংগে মিলে তিনি শ্যামাসংগীতের অনুবাদ করেন। ১৯৮২তে প্রকাশিত হয় একগুচ্ছ অনূদিত রামপ্রসাদী গানের সংকলন—“গ্রেস অ্যান্ড মার্সি ইন হার ওয়াইল্ড হেয়ার: সিলেকটেড পোয়েমস টু মাদার গডেস”। জীবনানন্দ বিষয়ক বর্তমান গ্রন্থটি পাণ্ডুলিপি অবস্থায় পড়েছিল দীর্ঘদিন আগ্রহী প্রকাশকের অভাবে। শেষ পর্যন্ত ডেলাওয়্যার ইউনিভার্সিটি প্রেস ১৯৯০ সালে প্রকাশ করেন এই প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ—“অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট”। ঘাইহরিণী নামটি ভীষণ মনে ধরেছিল ক্লিনটনের—তাই বইটির প্রথম নামকরণ “ডো ইন হিট”। শেষ পর্যন্ত এই নামটি বাদ পড়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, অনুবাদ ও গবেষণা চলছে তার পরের থেকেই। অনুবাদ করেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ শামসুল হকের গল্প; মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘানাদবধকাব্য (এখন অব্দি অপ্রকাশিত)। প্রবন্ধও লিখেছেন অনেকগুলি, বিশেষভাবে উল্লেখাযোগ্য—“দ্য রাজা’স নিউ ক্লোদ্‌স: রিড্রেসিং রাবণ ইন মেঘনাদবধ কাব্য” (১৯৯১) এবং “সিরিয়াস সাহিত্য: দ্য প্রোজ ফিক্‌সন অফ্‌ বাংলাদেশ’স রিজিয়া রহমান” (১৯৯০)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইকেল বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন দুবার—১৯৮২ ও ১৯৯০ তে। এ ছাড়াও ১৯৯০ সালে আলোচ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার ঠিক পরেই ক্লিনটন কলকাতায় আসেন—শহরটির তিনশো বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সেমিনারে যোগ দিতে এবং সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে বাংলা ব্যকরণ বিষয়ে বক্তৃতা দিতে। সেই সময় কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ-আলোচনা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর লেখা জীবনানন্দের এই সাহিত্য-জীবনীটি দুই বাংলার কোথায়ও বিশেষ জনপ্রিয় হয়নি—বইটি ভীষণ দামী এববং দুষ্প্রাপ্য হওয়ার জন্যেই হয়তো।

    ১৯৯৩ সালে “অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট” গ্রন্থটির জন্য ক্লিনটন বি সিলি আনন্দবাজার সংবাদপত্রগোষ্ঠীর প্রদত্ত “অশোক কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার”-এর জন্য নির্বাচিত হন। “সাহিত্য সমাবেশ—১৪০০” অনুষ্ঠানে কলকাতার ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুমে তাঁর হাতে পুরস্কারটি তুলে দেন অনুষ্ঠানপ্রধান শ্রী অশোক মিত্র, শনিবার ১৮-ই বৈশাখ, ১৪০০ সালে; ইংরেজি ১লা মে, ১৯৯৩। তাঁর সম্মানপত্রের ভাষ্যটি ছিল—“সুদূর আমেরিকা থেকে আপনি এক সময়ে সেবাব্রত নিয়ে এসেছিলেন পূর্ব বাংলায়, শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন এক গ্রাম্য স্কুলে। আপনি অধ্যয়ন করেছেন জীববিজ্ঞান, এখানে এসে ভালবেসে ফেললেন বাংলা ভাষা এবং সেই সূত্রেই আকৃষ্ট হলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের দাশের প্রতি। যাঁকে বলা হয় নির্জনতম কবি, সেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও খ্যাতি এখনও বাংলার বাইরে বিশেষ পৌঁছয়নি, অন্য ভাষার পাঠকেরা তাঁর কাব্যের মর্ম গ্রহণ করতে পারেনি। আপনি বরিশাল ও কলকাতায় দীর্ঘ সময় বসবাস করে অকালপ্রয়াত এই কবির জীবন-পথ অনুসরণ করেছেন, তাঁর কবিতার বিশেষত্ব ও পটভূমিকার বিশ্লেষণ করেছেন, সমসাময়িক সাহিত্য আন্দোলনের ছবিও ফুটিয়ে তুলেছেন যথার্থভাবে। একজন মহৎ কবির সমগ্র রচনার মর্মসন্ধান ও জীবনী-সংবলিত এমন গ্রন্থ যে কোন ভাষাতেই দুর্লভ। এ ছাড়াও আপনি অন্যান্য বাংলা গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সভ্যতা বিভাগের সংগে যুক্ত থেকে বাংলাভাষা প্রসারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনলসভাবে। আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। আপনার “অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট” গ্রন্থটিকে সম্মান জানাবার জন্য আপনাকে এ বৎসর অশোক কুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার প্রদত্ত হল।” এই সভায় পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত ক্লিনটনের ছবিটি তখন বিভিন্ন সংবাদপত্রে এবং দেশ পাক্ষিকে প্রকাশিত হয়েছিল।

    ১৯৯৬-এর পুজোর সময় কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশন সংস্থার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এই মর্মে যে তাঁরা “অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট” গ্রন্থটির প্রামাণ্য ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে চলেছেন। কিন্তু তার পরে অনেক খোঁজ খবর করেও না পেরেছি বইটির প্রকাশ বিষয়ে আর কোন খবর পেতে, না পেয়েছি দোকানে খোঁজ করে ভারতীয় সংস্করণটি কিনতে। খুবই দুঃখের বিষয়। আর কয়েকমাস পরেই জীবনানন্দের জন্মশতবার্ষিকী। আশা করবো রবীন্দ্রভারতী তৎপর হবেন গ্রন্থটির ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশে—বাংলা ভাষা না-জানা মানুষজনের কাছে জীবনানন্দকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।


    || ২ ||

    ৩৪১ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত নয়; প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অল্পে অল্পে থেমে থেমে বইটি উপভোগ করেছি আমি—শয্যাপ্রান্তে নিশীথস্তম্ভের ওপরে বাতিদানের পাশাপাশি “অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট” পাকাপাকি স্থান পেয়েছিল সেই কয়েক সপ্তাহ। আর সেই সংগে ক্লিন্টবাবুর অনবদ্য জীবনানন্দ অনুবাদ—সেগুলি কখনো মূল কবিতার সংগে মিলিয়ে পাঠ করেছি, আর অন্য সময়ে বিশুদ্ধ কবিতা হিসেবে পাঠ। কখনোই হতাশ হইনি। উৎসর্গে কিঞ্চিৎ অতিকথন রয়েছে—“To Gwendolyn Layne, who though she neither speaks nor reads Bengali, understands Jibanananda’s poetry as well as anyone I have met, Bengali or not.”

    ভূমিকায় ক্লিনটন লিখেছেন ১৯৭০ সালে চুনীলাল দে-র সংগে তাঁর দেখা করতে যাওয়ার কথা। চুনীলালের চায়ের দোকান ছিল রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ওপর। ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর পদচারণা ফেরত জীবনানন্দ যখন দুর্ঘটনার কবলে পড়েন, তখন তাঁর চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিলেন চুনীলাল, এবং ট্রামের তলা থেকে টেনে বার করেছিলেন তাঁর রক্তাক্ত শরীর। লেখকের তথ্য সংগ্রহের উৎসাহ ও নিবিড়তার একটা আভাস পাওয়া যায় প্রথম থেকেই—কীভাবে ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর-গ্রামের কোণে কোণে তিনি হাজির হয়েছেন সম্ভাব্য তথ্যের সন্ধানে। টুকরো টুকরো তথ্য-স্মৃতি-দলিল-দস্তাবেজকে যুক্তি ও কল্পনায় গেঁথে গড়তে চেয়েছেন গোটা মানুষের ছবি। যে মানুষটি মিশতেন কম, কথা বলতেন কম, থাকতেন আপনমনে; তাঁকে তাড়া করে বেড়াতো অর্থাভাব, অস্বাচ্ছল্য, বেকারত্ব। লেখক এই বইটির ওপর কাজ করেছেন কমবেশি দু দশক ধরে—কবির সংগে পরিচয়ের সৌভাগ্য না হ’লেও, তাঁর পরিবারের প্রায় সবার সংগেই দেখা করেছেন লেখক—কবিপত্নী লাবণ্য, পুত্র সমরানন্দ, কন্যা মঞ্জুশ্রী, ভ্রাতা অশোকানন্দ, ভগিনী সুচরিতা—অল্প বিস্তর সাহায্য যুগিয়েছেন সকলেই। ভূমিকার শেষদিকে জীবনানন্দের খুব সম্ভবত জনপ্রিয়তম কবিতাটির কয়েক পঙ্‌ক্তি তুলে দিয়েছেন—

    “At day’s end, like hush of dew
    Comes evening. A hawk wipes the scent of sunlight from its wings.
    When earth’s colors fade and some pale design is sketched,
    Then glimmering fireflies paint in the story.

    এবং লিখেছেন—over three decades after the loss of this original and gentle man, it is surely time for those who cannot read Berngali to “see” the poetry he painted. খুব খাঁটি কথা। আমরা যারা বাংলা পড়তে পারি তাদেরও সুযোগ হয় নতুন চোখ মেলে দেখে নেয়ার।

    গ্রন্থের ২৭০ পৃষ্ঠার মূল অংশটি ৭-টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত—শেষে বিস্তৃত টীকা, নির্বাচিত পুস্তক ও পত্রপত্রিকার তালিকা এবং নির্ঘন্ট। প্রথম অধ্যায়ে (Roots) বাংলাদেশের ভূগোল ও ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং বাখরগঞ্জ জেলার প্রধান শহর বরিশালের দাশগুপ্ত পরিবারের বৃত্তান্ত, সেই সংগে স্থানীয় ব্রাহ্মণ সমাজের কথা। লেখক আলোচনা করেছেন কীভাবে এই পরিবেশের কথা পরবর্তী জীবনে বার বার ফিরে এসেছে জীবনানন্দের কবিতায়। ২০ পৃষ্ঠায় একটি সনেটের প্রথম দুলাইনের অনুবাদ—

    “Carelessly, the Kirtinasa crumbled Rajaballabh’s glory;
    Yet the Padma’s beauty outshines the twenty one jewels—”

    মূল কবিতায়:

    “তবু তাহা ভুল জানি… রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা
    তবুও পদ্মার রূপ একুশ রত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ়—”

    “Carelessly” শব্দটি অনুবাদ কবিতায় চমৎকার মানিয়েছে কিন্তু মূল কবিতায় তার ভাব অনুপস্থিত।

    প্রসংগত এসেছে জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশের কথা যিনি নিজগুণে প্রতিভাময়ী কবি। তাঁর ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটির (“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?”) একটি চমৎকার ইংরেজি অনুবাদ (“The Exemplary Boy”) করেছেন লেখক--

    “When within our country will that boy be born
    Who not by words but by deeds grows big, and strong!
    Smiling face, expansive chest, a mind that’s full of fire;
    “I must indeed become a man”—this his firm desire.

    ১৯১৫ সালে জীবনানন্দ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন বরিশাল ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশান থেকে। ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই এ। আই এ পরীক্ষায় জীবনানন্দ পঠিত তিনটি বষয় ছিল ইংরেজি, বাংলা এবং রসায়ণশাস্ত্র। কেমিস্ট্রির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশ করছেন জীবনানন্দ, ভাবতেও মজা লাগলো খুব। এর পর জীবনানন্দ কলকাতায় আসেন এবং ইংরেজিতে সাম্মানিক সহ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে এম এ—আবার দ্বিতীয় শ্রেণী। লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো লিস্টি খুঁজে দেখেছেন যে জীবনানন্দ আইন কলেজেও পাঠ করেছিলেন তিন বছর, কিন্তু পরীক্ষা দেননি। এইরকম সময়েই তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখেন এবং খুব সম্ভবত কিছু কবিতা পাঠান। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত চিঠিটি—“তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্‌টো। (রবীন্দ্রনাথ। চিঠিপত্র-১৬, পৃষ্ঠা-১)। যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের সংগে জীবনানন্দের কোনদিন সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি, যদিও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অসংখ্য এবং ‘রবীন্দ্রনাথ” নামেই অন্তত ৬টি কবিতা লিখেছেন তিনি।

    এর পরের অধ্যায়গুলির নাম, “The Kallol Era”, “Back to Barishal”, “The War Years: Prelude and Aftermath”, “Another Fling of Fiction”, “The Poetry of Politics” এবং “Posthumous Jibanananda”. দ্বিতীয় অধ্যায়ে কলকাতায় জীবনানন্দের কর্মজীবন শুরু এবং সেই সংগে নিয়মিত কাব্যচর্চারও। কল্লোল, কালিকলম ও প্রগতিতে তাঁর লেখার কথা; সজনীকান্ত ও শনিবারের চিঠির অবিশ্রান্ত আক্রমণ ও জীবনানন্দ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মহতী আলোচনা; লাবণ্যর সংগে তাঁর বিবাহ ও বরিশালে প্রত্যাবর্তন; এবং বলাই বাহুল্য ১৯২৭ সালে “ঝরা পালক” প্রকাশ। প্রচলিত ধারণা—একটি কবিতা লেখার জন্য সিটি কলেজে তাঁর চাকরিতে জবাব হয়ে যায়—লেখকের প্রদত্ত তথ্যাদি থেকে মনে হয় তা ঠিক নয়। অর্থাভাবের জন্য কলেজ ১১ জন অধ্যাপককে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়, এবং ইংরেজি বিভাগের কনিষ্ঠ অধ্যাপক হিসেবে জীবনানন্দও। তাঁর ব্রাহ্মধর্ম অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও এর জন্য কিছুটা দায়ী।

    পরবর্তী ৫টি অধ্যায়ে লেখক গড়ে তুলেছেন জীবনানন্দের বাকি জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি। তার জন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত, হাসপাতাল, কর্পোরেশান—তথ্য সংগ্রহের জন্য সম্ভাব্য সব জায়গাতেই গিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা “জীবনানন্দ” গ্রন্থটি পড়ে জানলাম যে ১৯৬৮ সালে তাঁর সংগে ক্লিনটনের পরিচয় হয় কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে। গোপালবাবুকে জীবনানন্দকে বেশ ভালোভাবেই চিনতেন শুনেই—“সাহেব তাঁর খাতা কলম নিয়ে প্রস্তুত।” লেখকের নিবিড় তথ্যসংগ্রহের প্রমাণ এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়।

    জীবনানন্দের পাঠানো “ক্যাম্পে” কবিতাটি পরিচয়ের তৎকালীন সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রথমে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিষ্ণু দে যেহেতু নিজে জীবনানন্দকে অনুরোধ করে কবিতাটি আনিয়েছিলেন, তাঁর পীড়াপীড়িতে কবিতাটি শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় পরিচয়ের জানুয়ারি ১৯৩২ সংখ্যায়। লেখকের অনুবাদটি চমৎকার। জীবনানন্দ নিজে কোনদিন শিকার করতে যাননি—তবে তাঁর শিকার বিষয়ক বেশ কয়েকটি কবিতা আছে। এক অর্থে ‘ক্যাম্পে’ শিকার বিষয়ক কবিতা নয়ও—এর বিষয় মানুষ, মানুষের আন্তঃসম্পর্ক, তার জীবন ও মৃত্যু—যা ফিরে ফিরে আসতো আজীবন জীবনানন্দের কবিতায়।

    সঞ্জয় ভট্টাচার্য চেয়েছিলেন কবিতায় কম্যুনিস্ট চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশকে বন্ধ করতে। ভাবতে অবাক লাগে যে তাঁর চোখে বুদ্ধদেব বসু এবং কবিতাগোষ্ঠীর অন্যান্য কবিরাও ছিলেন কম্যুনিস্ট মনোভাবাপন্ন। সঞ্জয়ের এই মতামতের বিবরণ প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর (জুন ১৯৬৯) কিছুদিন পরে—তখন বুদ্ধদেব বসু খুব অবাক হয়েছিলেন তাঁর সতীর্থ কবির এই ধরনের চিন্তাভাবনায়। সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা (The East) পত্রিকার পক্ষ থেকে জীবনানন্দের “মহাপৃথিবী” কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করা হয় ১৯৪৪ সালে—শোনা যায় তার একটি প্রধান কারণ বাংলা সাহিত্যে কম্যুনিস্ট ভাবধারার অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং ক্ষয়ে আসা রোমান্টিকতাকে জাগিয়ে তোলা।

    “বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা পত্রিকার “এক পয়সায় একটি” গ্রন্থমালায়। বেশ কয়েকজন কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল এই গ্রন্থমালায়—চার আনা দামের বইতে ১৬টি কবিতার প্রতিশ্রুতি থাকলেও জীবনানন্দের গ্রন্থটিতে কবিতা ছিল মোটে ১২টি—হয়তো তাঁর কবিতার বাড়তি দৈর্ঘ্য-ই এর কারণ। ১৯৫২ সালে সিগনেট প্রেস “বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থের নতুন ও পরিবর্ধিত সংস্করণ বের করে। এর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদটি এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা জীবনানন্দের একেবারেই পছন্দ হয়নি প্রচ্ছদটি।

    জানা গেল যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে জীবনানন্দের ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৭ সালে জীবনানন্দ যখন “স্বরাজ” সংবাদপত্রে চাকরি করতেন, তখন তাঁর অনুরোধে নারায়ণ তাঁর “বৈতালিক” (লেখকের অনুবাদ The Flattering Bird) উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন স্বরাজের পুজো সংখ্যার জন্য।

    শেষ অধ্যায়ে, মৃত্যুর পর কীভাবে জীবনানন্দের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কীভাবে তিনি প্রভাবিত করেছেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের, তার কিছুটা আভাস দেওয়া হয়েছে। এমন কি তীব্র সমালোচক সজনীকান্তও তাঁর ভুল স্বীকার করেছেন। অ্যালেন গিন্‌সবার্গের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যায়টি শুরু—তিনি শুধুমাত্র যে জীবানানন্দের নামের বানানটিই গুলিয়েছেন তা নয়, তিনি জীবনানন্দকে কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন তাতেও সন্দেহ রয়েছে। এবং শেষ অনুচ্ছেদে: “Energetic manipulation of language, intensely sensual images, daring displays of personal revelations, analytically unwieldy doubts and insecurities—this is the stuff of Jibananda’s poetry and of his greatness” এবং শেষ বাক্যে: “The barrier of language not withstanding, Jibananda’s poetry has the capability to speak volumes to all of us about the finely tuned, passionately involved imagination of an ordinary man who has also happened to be a poet apart.”

    সাহিত্য অকাদেমির “মেকারস অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচার” গ্রন্থমালায় চিদানন্দ দাশগুপ্তের একটি কৃশকায় পুস্তিকা ছাড়া ইংরেজি ভাষায় জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থের ভীষণ অভাব ছিল। লেখক সেই অভাব পূর্ণ করে জীবনানন্দ অনুরাগীদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার ভাগী হলেন। অবশ্যই, যে কোন ভাষায় প্রকাশিত জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে “অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট” প্রথম সারিতে স্থান পাবার যোগ্য। ভবিষ্যতের জীবনানন্দ পাঠক ও গবেষকদের কাছে এটি একটি মহামূল্যবান আকরগ্রন্থ।


    || ৩ ||

    অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট গ্রন্থটির আর একটি অমূল্য সম্পদ হ’ল লেখক কৃত জীবনানন্দের কবিতার অনবদ্য অনুবাদগুলি। ৬৫টির মতো কবিতার পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ, আরো কিছু কিছু কবিতার অংশবিশেষ—এ ছাড়াও জীবনানন্দের গল্প ও উপন্যাসের উদ্ধৃত অংশগুলিও অনুবাদ করেছেন তিনি। কিছু অনুবাদ কবিতা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বলে লেখক ভূমিকায় জানিয়েছেন। মার্চ ১৯৩৮-এ কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত “আট বছর আগের একদিন” কবিতার সেই বহু-উদ্ধৃত অংশটি তাঁর অনুবাদে—

    “Not wealth nor fame nor creature comforts
    There is some other perilous wonder
    That frolics
    In our very blood
    It exhausts us—
    Exhausts, exhausts us”

    (পৃষ্ঠা—১৩৬-৩৭) আসলে বইটি দুটি খণ্ডে ভাগ হলে ভীষণ ভালো হত—একখণ্ডে জীবনী এবং অন্য খণ্ডে তাঁর সাহিত্য সম্ভারের অনুবাদ। এমনিতেই জীবনানন্দকে অনুবাদ করা মুশকিল, কিন্তু লেখক অধিকাংশ সময়ে মূলানুগ থেকেও অনুবাদগুলিকে কবিতে হিসেবে টেনে দাঁড় করিয়েছেন। ১৯৪২ সালে রচিত অনুভব (Feeling) কবিতাটির এই কয়েকটি পঙ্‌ক্তি—

    “বাংলার মাঠের শিয়রে বড়ো চাঁদ
    ধীরে এসে থেমে দাঁড়াতেই—
    প্রকৃতি নিজের মনে যা দেয় তা ছাড়া
    কোথাও বাড়ন্ত জ্যোৎস্না নেই”।

    তাঁর অনুবাদে হয়েছে—(পৃষ্ঠা ১৭২)

    “As a huge moon slowly comes to rest
    Standing at the head of Bengal’s fields
    Besides what nature gives of her own heart
    There is no other moonlight anywhere.”

    অসম্ভব আক্ষরিক, তবু নিজগুণেই বিশুদ্ধ কবিতা।

    ১৯৫১ সালে রচিত “সুদর্শনা” কবিতার প্রথম কয়েক পঙ্‌ক্তি ও তার লেখককৃত অনুবাদ (পৃষ্ঠা ২৬৩-৬৪):

    “একদিন ম্লান হেসে আমি
    তোমার মতন এক মহিলার কাছে
    যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
    অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
    শুনেছি কিন্নরকন্ঠে দেবদারু গাছে,
    দেখেছি অমৃতসূর্য আছে”

    “One day beside a woman such as you
    Wanly smiling I,
    About to be absorbed in the collected merit of age,
    Pausing suddenly inside a ring of fire,
    Heard some heavenly voice in a devadaru tree,
    Saw the immortal Sun there.”

    মহাপৃথিবী (The World at large) গ্রন্থের “বিভিন্ন কোরাস” কবিতাটি অনুবাদ করতে গিয়ে তৃতীয় স্তবকের “বাচক্‌ণবী” শব্দটির সম্বন্ধে লিখেছেন—এখনো পর্যন্ত কোন বাঙালি তাঁকে এই শব্দটির অর্থ বুঝিয়ে বলতে পারেননি। ক্লিনটনের অনুবাদে শব্দটি হয়েছে “something”—

    “নগরীর পিতামহদের ছবি দেয়ালে টাঙায়ে
    টাঙায়েছি নগরীর পিতাদের ছবি;
    পরিক্রমণে গিয়ে সর্বদাই আমাদের বড়ো নগরীতে
    যাহাতে অমৃত হয় সে-রকম অর্থ, বাচক্‌ণবী,
    প্রকাশে পয়াস পেয়ে গেছি মনে হয়;”

    “We have hung pictures of the city’s grandfathers—
    Pictures of the city fathers from the walls
    We circumambulate this big city of ours
    Trying hard, it seems
    That meaning is that something by which we shall be immortal.”

    সেই সঙ্গে জানা গেল যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি সংকলনে শব্দটি “বাচক্লবী” ছাপা হয়েছে। (জীবনানন্দের দাশের কাব্যসম্ভার—সম্পাদক: রণেশ দাশগুপ্ত; প্রকাশক: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং, ঢাকা; ১৯৭০ সাল। )

    জীবনানন্দ হয়তো তাঁর নিজের অজান্তেই “introvert” শব্দটির একটি উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ আমাদের দিয়েছেন। ১৯৪৩ সালের মে মাসে দেশ পত্রিকায় জীবনানন্দের প্রথম প্রকাশিত কবিত “নিরীহ, ক্লান্ত, মর্মান্বেষীদের গান”, লেখকের অনুবাদে হয়েছে “Song of the Meek, Tired, and Introverted”. এখন “মর্মান্বেষী” শব্দটি “introvert”-এর বাংলা হিসেবে চালু করলে মন্দ হয় না।


    || ৪ ||

    বইটিতে তথ্যের ভুল প্রায় নেই বললেই চলে। ক্লিন্টবাবুর নিবিড় তথ্যানুসন্ধান এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার জন্যই তা সম্ভব হয়েছে। যেখানে তথ্যের যথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহ রয়েছে, দীর্ঘ পাদটীকায় তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি। তবে দুয়েকটি ছোটখাটো গন্ডগোল আমার চোখে পড়েছে— ১) ৩৪ পৃষ্ঠায় “Ksetakadasa’s Manasa Mangal”। মনসামঙ্গলের রচয়িতার নাম কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। অন্তনাম ক্ষেমানন্দের “ক্ষ” হয়তো প্রভাবিত করেছে পূর্বনামের ভুল করে ঢুকে যাওয়া বাড়তি “s” টিকে—ফলে “ক্ষেতকাদাস” হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    ২) ৩৬ পৃষ্ঠায় “Ram Mohan Ray”। রামমোহন রায়ের নাম অন্যত্র সব জায়গায় জীবনী-আলোচনা-বইপত্রে “Ram Mohan Roy” বলেই লেখা হতে দেখেছি। লেখক অবশ্য “রায়” নামধারী সবাইকেই “রে” নামে ডেকেছেন পুরো বইতেই।

    ৩) ৩৯ পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি বিষয়ে লেখক জানিয়েছেন—“The first of three Calcutta residents so honoured”. সম্প্রতি নোবেল পুরস্কার পাওয়া অমর্ত্য সেনের কথা না ধরলেও, আলোচ্য বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চারজন কলকাতা-বাসী নোবেল বিজয়ীর মধ্যে দ্বিতীয়। প্রথম হলেন ডাক্তার রোনাল্ড রস সাহেব (১৮৫৭-১৯৩২)। যিনি কলকাতায় বসে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু বিষয়ে গবেষণা করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয় করেছিলেন ১৯০২ সালে। এর পরেও তিনি অনেক বছর বাস করেছেন কলকাতায়। তথ্যটি অনেকদিনই কলকাতার মানুষের কাছে সাধারণভাবে অজ্ঞাত ছিল—কিন্তু গত কয়েক বছরে কলকাতায় নব নব রূপে ম্যালেরিয়ার প্রত্যাবর্তন এবং অমিতাভ ঘোষের “Calcutta Chromosome” উপন্যাসটির প্রকাশ এই বিষয়ে নতুন আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে।

    এ ছাড়া কোন কোন স্থানে তাঁর ইংরেজি অনুবাদের শব্দচয়ন একটু খটোমটো। ৫০ পৃষ্ঠায় “আনন্দমঠ”-এর অনুবাদ “Abbey of Bliss”; ৪৪ পৃষ্ঠায় “পথের দাবী” হয়েছে “The Path’s Demand”; ৮০ পৃষ্ঠায় “বৌভাত” কে ইংরেজি করেছেন “Bride Rice”. “সজনে”-কে “Indian Horseradish” বলাটাও কেমন যেন—সজনের তো কোন ব্রহ্মতালু জ্বলে যাওয়া ঝাঁঝ নেই। মনে পড়ে সেই কবে ছেলেবেলায় ওয়ার্ডবুকে পড়েছিলাম—সজিনা গাছ: The Morunda Tree. “দয়েল পাখি” অনুবাদে “Magpie” ঠিক আছে; কিন্তু হিজল গাছে কি কাজুবাদাম ফলে? ৩৫ পৃষ্ঠায় ক্লিনটন “হিজল” এর অনুবাদ করেছেন “Cashew”. অবশ্য ছোটবেলায় আমাদের প্রত্যন্ত শহরতলীতে কাজুবাদামকে “দীঘার বাদাম” বা “হিজলী বাদাম” বলতে শুনেছি বটে, তবু মনের খুঁতখুঁতুনি কাটে না। হিজলের খানিক পরেই আছে “শটিবনে” ও “ভাঁটফুল”-এই দুটি শব্দবন্ধের ক্ষেত্রে লেখক সঙ্গতকারণেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ২৬৮ পৃষ্ঠায় অমৃতবাজার পত্রিকা সংবাদপত্রের উল্লেখ রয়েছে এবং পাদটীকায় তার বিবরণ—“This esteemed paper whose name glosses as ‘Journal of the Elixir Marketpalce’….”!

    গ্রন্থটিতে জীবনানন্দ ও তাঁর পরিবারের কিছু আলোকচিত্র থাকলে বেশ হ’ত। অথবা তাঁর গ্রন্থগুলির প্রচ্ছদ না নামপত্রের ছবি। পশ্চিমে প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থে এগুলি দেখতে পাই অধিকাংশ সময়েই। এ ছাড়া জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপির কিছু ফোটোকপিও গ্রন্থটির পক্ষে উপযোগী হ’ত—আমাদের চির পরিচিত সেই হস্তাক্ষরের আরো কয়েকটি নমুনা। জীবনানন্দের নিজের অবশ্য একটি আলোকচিত্রই দেখা যায়—খুব সম্ভবত তুলুম দাম্পত্য কলহের পরই ছবিটি তোলা। ক্লিনটন তো জীবনানন্দের পরিবারের প্রায় সকলের সঙ্গেই আলাপ করেছেন এবং সেই সঙ্গে তাঁর অসংখ্য পরিচিত ব্যক্তিদের—কারুরই কি পারিবারিক অ্যালবাম খুঁজেপেতে কোন নতুন ছবি পাওয়া যেত না? জানতে ইচ্ছে করে।

    আমাদের পরম সৌভাগ্য যে বরিশালে পুনর্জন্ম নেওয়া এই বাঙালি অসীম পরিশ্রমে ও নিষ্ঠায় এই অসামান্য জীবনীগ্রন্থটি রচনা করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু বা অমিয় চক্রবর্তী বিষয়ে কি এই ধরনের কাজ হওয়া সম্ভব? আশা করতে ইচ্ছে করে ভীষণ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments