|| ১ ||
গ্রামের নাম সামতা, আর শরৎচন্দ্রের বাড়িটি ছিল রূপনারায়ণ নদীর ধারে একেবারে বাড়-এর ওপর। সেইজন্যেই তিনি চিঠিপত্রে লিখতে শুরু করেন “সামতাবেড়”। তাঁর দিদি অনিলা দেবীর শ্বশুরবাড়ি ছিল পাশের গ্রাম গোবিন্দপুরে- সেখানে কৈশোর থেকেই তাঁর আসা যাওয়া- এ ছাড়া রূপনারায়ণ নদীটিও ছিল শরৎচন্দ্রের খুব প্রিয়। বাড়ি তৈরি শেষ হতে হতে ১৯২৬ সালের ফেব্রুআরি- তখন “পথের দাবী” লেখা চলছে। অনেকখানি প্রশস্ত জমি নিয়ে বাড়ি, সংগে বাগান ও পুকুর। খরচ হয়েছিল তখনকার দিনের প্রায় সতেরো হাজার টাকা।
নানান কারণে তিনি অনেকগুলি মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। প্রথমে তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় পোষা কুকুর ভেলুর মৃত্যু। ভেলু ছিল শরৎচন্দ্রের দিনরাত্তিরের সংগী ও সখা- ১৯২৫-এর এপ্রিলে ভেলু মারা গেলে তিনি শিশুর মতো কেঁদেছিলেন। আর একটি দুঃখের কারণ হ’ল তাঁর পরম সুহৃদ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণ, ১৬ই জুন ১৯২৫- দার্জিলিং-এ। এর পরে শরীর ও মনের শান্তি এবং স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে সিদ্ধান্ত করেন, মাঝে মাঝেই গ্রামে গিয়ে থাকবেন।
তখন রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে করে গিয়ে দেউলটি স্টেশনে নামতে হ’ত। সেখান থেকে পালকি চড়ে সামতাবেড়। বর্ষাকালে রাস্তাঘাটে জল জমে আসা-যাওয়ার প্রচণ্ড অসুবিধে হত। পথে নালাও ছিলো কয়েকটি- বাঁশের তৈরি সাঁকো ধরে পার হতে হ’ত। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল অপূর্ব- যেমন বিশাল রূপনারায়ণ নদী- তেমনি তীব্র তার স্রোত। এই প্রকৃতির অমোঘ টানেই শরৎচন্দ্রের এখানে আসা।
কিন্তু দুঃখ, শোক ও মানসিক আঘাত আসছিল তাঁর পিছু পিছু। মেজ ভাই প্রভাসচন্দ্র ১৫ বছর পূর্বেই সন্ন্যাসধর্ম নিয়েছিলেন এবং স্বামী বেদানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন। কয়েক বছর মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে এবং বৃন্দাবনের রামকৃষ্ণ মঠে কাটিয়ে প্রভাসচন্দ্র বর্মা চলে যান রামকৃষ্ণ মিশনের কাজে। বর্মা থেকে ফিরে তিনি পূর্বাশ্রমের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শরৎচন্দ্রের কাছে সামতাবেড়ে আসেন কিছুদিন থাকবেন বলে। এখানে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯২৬-এর ২৭শে অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। ভাইকে শরৎচন্দ্র ভীষণ ভালোবাসতেন এবং নিজের বাড়ির পাশেই ভাই-এর সমাধি নির্মাণ করেন। এই ঘটনায় রামকৃষ্ণ মিশনের সংগে শরৎচন্দ্রের প্রবল মনোমালিন্য ঘটে।
গ্রামে বাস করা শুরু করার পরে শরৎচন্দ্রের জীবন যাপন খুব পাল্টে যায়। এই মন্থরগতি জীবনের কথা তিনি বন্ধুবান্ধবদের লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন। কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “রূপনারায়ণের তীরে ঘর বাঁধিয়াছি, একটা ইজিচেয়ারে দিনরাত পড়ে থাকি।” আড়াই মাস পরে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি, “. . . তার পরে আমি কলকাতা যাইনি। এখানকার ছোট্ট পরিবেশে যাহোক করে দিন কেটে যাচ্ছে। তবে একবার শহরের মুখ দেখলে তা সামলাতে পাঁচ-সাত-দিন কেটে যায়।”
বর্মা ছেড়ে বাংলাদেশ ফিরে আসার পরে শরৎচন্দ্র প্রায় দশ-এগারো বছর হাওড়ার বাজেশিবপুর অঞ্চলে বসবাস করছিলেন। তারপরে সামতাবেড়ে গাঁয়ের এই দোতলা মাটির বাড়িটি ছিল তাঁর প্রধান বাসস্থান। এখান থেকেই কলকাতা আসা-যাওয়া করতেন। শেষ জীবনে কলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলে ২৪ অশ্বিনী দত্ত রোডের নতুন দোতলা বাড়িটিতে উঠে আসেন স্ত্রী হিরণময়ী দেবী, ছোটভাই প্রকাশ্চন্দ্র ও তাঁর পরিবারবর্গকে নিয়ে। সেটা ১৯৩৫ সালের জানুআরি মাস। অর্থাৎ দীর্ঘ ন বছর ধরে সামতাবেড় ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চা এবং জীবন যাপনের কেন্দ্রস্থল। কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসার পরেও গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন সময় পেলেই।
|| ২ ||
সামতাবেড় সম্পর্কে আমার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। মেদিনীপুর-হাওড়া লাইনে অসংখ্যবার ট্রেনযাত্রার সময় চোখে পড়েছে দেউলটি স্টেশনের প্রস্তর ফলকটি- শরৎচন্দ্রের বসতবাটী সামতাবেড় যাওয়ার পথের ঘোষণা। কিন্তু এত বছরের মধ্যে কোনদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। গত বছরের (১৯৯৭) ডিসেম্বরে তাই ঠিক করলাম- দেখে আসতেই হবে।
কোলাঘাটের দিক থেকে রূপনারায়ণ নদী পেরিয়ে দেউলটির দিকে রওনা দিলাম গাড়ির জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে- কোন পথচিহ্ন চোখে পড়ে কিনা। ৬ নং জাতীয় সড়কের অবস্থা বেশ শোচনীয়, বিরাট বিরাট সব খানাখন্দে ভরা। যাওয়া-আসার পথে ট্রাকের দুর্ঘটনায় ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তা বন্ধ থাকতেও দেখেছি। সে যাই হোক, দেউলটির মোড়ের মাথায় গাড়ি থামিয়ে চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই বললো- ওঃ, শরৎবাবুর বাড়ি? বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে চলে যান- তিন কিলোমিটার মতো দূর। অর্থাৎ ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে কলকাতার দিক থেকে এলে, ডান দিকে বাঁক নিতে হবে। এই গ্রামের পথটি সরু হলেও সমতল এবং খানাখন্দ নেই। সোয়া দু কিমি যাওয়ার পর রাস্তটি দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে- ডান দিকের পথটি ভালো মনে হওয়ায় সেটি নেওয়া হ’ল। কয়েক মিনিট পরেই এলো বাঁ-দিকে বেঁকে যাওয়ার পথনির্দেশ- রাস্তাটি আরো সরু- একটি গাড়ি কোনমতে যেতে পারে। একটু এগিয়েই ডান দিকে বাড়ির ফটক এবং বাঁ-দিকে বাঁধানো পুকুরের ঘাট। গাড়ি থামতেই স্থানীয় কচিকাঁচাদের ভিড় জমে উঠলো।
ফটক খুলে ঢোকার আগে কিছুক্ষণ বাড়ির চারদিক ঘুরেফিরে দেখলাম। দোতলা বাড়ি- টালির ছাদ। একতলা এবং দোতলা দু জায়গাতেই বাড়ির চারদিক জুড়ে চওড়া বারান্দা। বাড়ির চারপাশে মানুষপ্রমাণ ইঁটের প্রাচীর। বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে স্বামী বেদানন্দের ছোট্ট, সুন্দর সমাধি। ফটকের দুপাশে দুটি ফলকে শরৎচন্দ্রের রচনা থেকে উদ্ধৃতি।
ফটক খুলে ভেতরে ঢুকে ইঁট-বিছানো পথ এবং গাছপালায় ভরা বাগান। তিন-চার ধাপ সিঁড়ি উঠে লাল সিমেন্টের বারান্দা- জুতো খুলে রেখে বারান্দায় ওঠার নির্দেশ লেখা রয়েছে। বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে এবং বাড়ির কয়েকটি ছবি তোলার পর জুতো খুলে বারান্দায় উঠে বসলাম। ভাবছিলাম এর পরে কী করা উচিত? প্রত্যেকটি ঘরের দরজায় তালা চাবি লাগানো এবং আপিশ ঘরের মতোও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এমন সময় লুংগি ও সোয়েটার পরিহিত এক ভদ্রলোক এসে সামনে দাঁড়ালেন- জিজ্ঞেস করলেন- আপনারা কোত্থেকে আসছেন? আরো বললেন যে আমরা চাইলে উনি ঘুরিয়ে দেখাতে পারেন ভেতরটা। ভদ্রলোক নাম বলেছিলেন, এখন ঠিক মনে পড়ছে না, খুব সম্ভবত দুলালচন্দ্র মান্না। উনি কাছেই থাকেন এবং বাড়িটার দেখাশোনা করেন- ট্যুরিস্ট এলে ঘুরিয়ে দেখানোও ওনার দায়িত্ব। এই জন্য সরকার থেকে মাসে একশো টাকা করে পান। ওনার কাছ থেকেই জানতে পারা গেল যে বাড়িটি এখনো ব্যক্তিগত মালিকানাতেই রয়েছে- যদিও দীর্ঘকাল মামলা চলছিল শরৎচন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। শোনাও যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করতে পারেন এর ঐতিহাসিক মূল্যের জন্য। ১৯৭৮ সালের ভয়ংকর বন্যায় বাড়িটির অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল- তখন অবশ্য বামফ্রন্ট সরকারের পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী নিজে এসেছিলেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখতে এবং সরকার থেকে অনুদান দেওয়া হয়েছিলো মেরামতির জন্য।
|| ৩ ||
বারান্দার বাঁ-দিকের ঘরটি ছোট- শরৎচন্দ্রের লেখার কক্ষ ছিল এটি। লেখার টেবিলটি এখনো রয়েছে ঘরের মধ্যে- জানালা দিয়ে আগে রূপনারায়ণ দেখতে পাওয়া যেত- সেই দৃশ্যের জন্যই এই কক্ষটি ছিল শরৎচন্দ্রের প্রিয়। এখন নদীটি পশ্চিম দিকে আরো দু-আড়াই কিলোমিটার সরে গিয়েছে। লেখার টেবিল-চেয়ার ছাড়াও ঘরের মধ্যে রয়েছে শরৎচন্দ্রের ব্যবহৃত আরাম কেদারা, চকচকে কাঠের হাতল ও কাঠামো, মাঝখানে বেতের বোনা- তার মাথার থেকে ঝুলছে লেখকের হাঁটার সংগী লাঠি। পাশে আর একটি ছোট টেবিল। লেখার টেবিলের মাঝখানের অংশটি কোনাকুনিভাবে তোলা এবং নামানো যায়- ভীষণই আধুনিক ব্যবস্থা। হয়তো বিদেশ থেকে আনানো। টেবিলটি ছুঁতে চাইলাম- ভদ্রলোক সায় দিলেন। বললাম ছবি তুলতে চাই- তাতেও কোনো আপত্তি নেই।
পাশের বৈঠকখানা ঘরই শরৎচন্দ্রের বিশ্রামের স্থান- কাঁচের আলমারি ভরা বই, ঢাকা দেওয়া রয়েছে আরাম চেয়ার আর চমৎকার একটি ঘোরানো বুককেস- একেবারে হাল ফ্যাশানের। কীরকম আধুনিক মন এবং আধুনিক আসবাব ছিল ভেবে অবাক হতে হয়। সংগের প্রদর্শক বললেন- শেষ জীবনে শরৎবাবু ফ্রয়েড পড়তেন খুব- এছাড়া অনেকগুলি বিদেশী অভিধান ও হোমিওপ্যাথির বই রয়েছে। পাশের কক্ষটিতে আছেন গৃহদেবতা- রাধাকৃষ্ণ। এখনো পুজো হয়।
শোবার ঘরগুলি দোতলায়- সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার বারান্দার কিছু অংশে যাওয়া যায়- তার পরে রেলিং দেওয়া দরজায় তালা লাগানো। শয়নকক্ষটি জানলা দিয়ে উঁকি মেরেই দেখে নিতে হ’ল। নীচে নেমে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম বারান্দায়- খুব ভাল লাগছিলো ভদ্রলোকের সংগে কথা বলতে। অনেক নামকরা লেখক, প্রকাশক, পত্রিকা সম্পাদকেরা দেখা করতে এসেছেন এই বাড়িতে। স্বদেশী ও বিপ্লবীদের সংগেই যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। শরৎচন্দ্র তাঁর জমির সীমানায় কোন প্রাচীর দেননি- বর্তমান প্রাচীরটি দেওয়া হয়েছে তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে। যেহেতু বাড়ির চারদিক খোলা- পুলিশের চরের পক্ষে নজর রাখা মুশকিল কার কখন কোনদিক দিয়ে আসাযাওয়া করা সম্ভব ছিল। “পথের দাবীর”র লেখকের ওপর যে লালটুপিদের নেকনজর থাকবে এতে আর বিস্মিত হওয়ার কী আছে।
একদিকে যখন আসতেন দেশ-বিদেশ থেকে মানী ও নামী লোকেরা, অন্যদিকে ছিল তাঁর সর্বহারা পাড়াপড়শীরা- কেউ আসতো ওষুধ নিতে, কেউ চাইতো পরামর্শ আর অনেকে আসতো কেবল মনের কথা আর নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা দাদাঠাকুরকে জানাতে। ক্ষেতের ফসলের কথা, ঘর-গেরস্থালির কথা, সন্তান-সন্ততির কথা। আসতো নারী ও পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত।
আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে স্কুলের ছাত্রদের একটি দল এসে পড়েছে। তাদের ঘুরিয়ে দেখার জন্য ভদ্রলোককে বিদায় নিতে হ’ল। যাবার আগে উনি সামনের পুকুরটি দেখিয়ে বললেন এর ধারে বসে শরৎবাবু অনেক সময় কাটিয়েছেন এবং এখানেই দুটি মাছকে দেখে “রামের সুমতি”-র কার্তিক-গণেশের চিন্তা তাঁর মাথায় আসে।
আরও কয়েক মিনিট বাড়ির চারপাশে কাটিয়ে তারপরে এলো ফেরার পালা। যদিও এখন বড়দিনের ছুটি, আপিশযাত্রীদের ভিড় শুরু হওয়ার আগে কলকাতায় ঢুকে পড়তে পারলে ভালো।
|| ৪ ||
ফেরার পথে আপনমনে ভাবছিলাম শরৎচন্দ্রের কথা। বাংলো সাহিত্যের অনেকগুলি উজ্জ্বল মণিমুক্তোর সৃষ্টি হয়েছে গ্রামের ওই বাড়িটিতে। এর আগে ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টারে (Monterey) শহরে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের বসতবাটিতে গিয়েছি; দেখেছি জন স্টাইনবেক-এর স্মৃতিবিজড়িত ক্যানারি রো (Cannery Row); মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরে এডগার আলান পো’র সমাধিতে গিয়ে তাঁর কবিতা পাঠ করেছি মধ্যরাতে, ঘুরে বেড়িয়েছি সবান্ধব আলেন গিন্স্বার্গের লীলাভূমি সান ফ্রানসিসকোর হেইট- আশবেরি (Haight-Ashbury) অঞ্চলে। কিন্তু কখনো এরকম আপ্লুত লাগেনি নিজেকে। গেঁয়ো যোগী ভিক্ষে পান না কথাটা হয়তো সত্যি। তা না হ’লে যেখানে আমার জন্ম তার ৫০ মাইলের মধ্যে অবস্থিত এই পুণ্য তীর্থে আসতে গিয়ে অর্ধেকের বেশি জীবন পার করে দিলাম কেন?
সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ছিল রবার্ট লুই স্টিভেনসনের কথা। স্টিভেনসন তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি কাটিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের অন্তর্গত সামোয়ান দ্বীপপুঞ্জে (Samoan Islands)। সেখানকার বিভিন্ন দ্বীপের অধিবাসীদের সংগে তাঁর অসম্ভব হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। স্থানীয় রাজা থেকে শুরু করে দরিদ্রতম প্রজা পর্যন্ত সকলেই ছিল স্টিভেনসনের গুণগ্রাহী। প্রাণ খুলে তিনি কথা বলতেন এঁদের সংগে- ওঁরাও নিজেদের দুঃখকষ্টের কথা উজাড় করে দিতেন তাঁর কাছে। স্থানীয় ভাষায় তাঁর নাম ছিল “টুসি-টালা” বা গল্প-বলা মানুষ।
বাংলাদেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গল্প-বলা মানুষকেও আপন করে নিয়েছিলেন সামতাবেড় ও তার আশেপাশের গ্রামের নিঃস্ব সাধারণ মানুষগুলি।
তথ্যসূত্রঃ
১) “আওয়ারা মসীহা”- বিষ্ণু প্রভাকর (হিন্দী); দেবলীনা ব্যানার্জী কেজরিওয়াল-এর বাংলা অনুবাদ- “ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ”।
২) সুকুমার সেন সম্পাদিত শরৎ সাহিত্য সমগ্রের (আনন্দ) ভূমিকা, গ্রন্থ পরিচিতি ও জীবনপঞ্জী।
৩) “যাঁদের দেখেছি”- হেমেন্দ্রকুমার রায়।
অনুষঙ্গঃ
১) নিবন্ধটি লেখার সময় বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্যকণাগুলি ছেঁকে নেবার সময় একটি প্রবল অভাব অনুভব করেছি। শরৎ রচনাবলীর বেশ কয়েকটি সুসম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন প্রকাশক। কিন্তু শরৎচন্দ্রের লেখা চিঠিপত্রের কোন সংগ্রহ এখনো অব্দি ছাপা হয়নি। এটি ভীষণ লজ্জার বিষয়- বাংলা ভাষায় সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত লেখক শরৎচন্দ্র। তিনি নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং খুব সম্ভবত অসংখ্য চিঠি লিখেছেন। আমার মতে একজন লেখকের সাহিত্যসৃষ্টির সংগে তাঁর লেখা পত্রাবলী অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কোন প্রকাশক শরৎচন্দ্রের পত্রাবলীর একটি সুসম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশের কাজে এগিয়ে আসবেন কি? কেবল ঐতিহাসিক এবং নান্দনিক কারণেই নয়- ভালো লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
২) আমি হিরণময়ী দেবীকে শরৎচন্দ্রের স্ত্রী বলে উল্লেখ করেছি। যদিও আমার মনে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই– বিষয়টি অনেকেই বিতর্কমূলক বলে মনে করেন- সন্দেহ করেন সত্যি সত্যি ওঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিনা। লিখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে “significant other” শব্দবন্ধটির যদি কোন শোভন বাংলা প্রতিশব্দ থাকতো তাহ’লে এখানে গর্বের সংগে ব্যবহার করতে পারতাম। কিন্তু অনেকক্ষণ হাতড়েও কোন পছন্দসই বাংলা পাওয়া যায়নি। পাঠক-পাঠিকারা যদি এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়ান, তাহ’লে কৃতজ্ঞ থাকবো।