আজ লক্ষ্মীপূর্ণিমা। একবার বাজের যাওয়া বাদে সারাদিনই ঘরে শুয়ে বসে কাটালাম। সন্ধ্যার পর একবার লোডশেডিং হলো। বারান্দায় গিয়ে বসলাম। চারিদিকে চাঁদের আলো। এখনও generator-এর আলো আসেনি। একবার ইচ্ছে হলো ছাদে যাই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত না গিয়ে বারান্দার একদম ধারে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে দেখতে ছেলেবেলার লক্ষ্মীপুজোর রাতের কথা মনে হলো। শম্পা ছেলেবেলার কথা লিখতে বলেছে।
কয়েকমিনিটের মধ্যেই আলো এলো। একটা বই পড়ছিলাম, তাতে ছিলো দক্ষিণ মেরুতে রাতের আকাশে মায়াবী সূর্যের আলোর কথা।
আমাদের ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের সব বাড়িতেই লক্ষ্মীপুজো হতো। সকাল থেকেই লেগে পড়তে হতো পুজোর যোগাড়যন্ত্রে। দূর্গাপুজোর আগে থেকেই মা-পিসি-কাকিমারা যে তিলের, নারকোলের, দুধের নাড়ু তৈরী করতে শুরু করতেন তা তখনো পর্যন্ত চলছে। সকালে উঠে ওঁরা ওঁদের কাজের লেগে গেছেন। আমাদের ছোটদের কাজ হলো- ফুল তোলা, কলার খোলা, কলাপাতা, বেলপাতা, দুটো আমের পল্লব- এগুলো যোগাড় করা। আর তারই মাঝে মাঝে এসে নাড়ূ মোয়া খেয়ে যাওয়া। ততক্ষণে প্রায় দুপুর। দল বেঁধে পুকুরে যাওয়া হতো স্নান করতে। সাঁতার কেটে পুকুর তোলপাড় করে তুলতাম, উঠবার নাম নেই। শেষ পর্যন্ত মা-মাসি-পিসিদের কেউ একজন ডাকতে আসতেন খাবার জন্য, ততক্ষণে দেড়-দুই ঘন্টা কেটে গিয়েছে জলে। চটপট পুকুর থেকে উঠে খেতে বসে যেতাম নিজেরাই পিঁড়ি পেতে আর কলার পাতা নিয়ে। এদিন নিরামিষ। খিচুড়ি আর পাঁচমিশেলী তরকারীর লাবড়া। লাবড়া জিনিসটা নিরামিষ তরকারী হলেও ওর একটা অন্যরকম স্বাদ ছিলো- কেন তা বলতে পারবো না। হয়তো বিশেষ কোন তরকারী বা মশলা বা অন্য কোন কিছুর রাসায়নিক বিক্রিয়া। তবু একথা ঠিক যে আমার এক বিধবা পিসিমার মত লাবড়া আর কেউই রাঁধতে পারতেন না। এরকম বিশেষ দিনগুলিতে লাবড়া পিসিমাই রাঁধতেন। সাথে কখনো কখনো ভাজাভুজিও থাকতো। তবে তা আমাদের পাতে কদাচিৎ আসতো- ওটা বাবা, কাকা ও অন্যান্য অভ্যাগতদের জন্য। ঐ সময়ে বাড়িতে অনেক আত্মীয় আসতেন সপরিবারে, সেটাই নিয়ম ছিলো। আসলে ঐ সময়টায় সবারই একটু অবসর হতো কাজকর্ম থেকে, তাই তাঁরা বেরিয়ে পড়তেন। আজকের দিনে যেমন সবাই নানা বিখ্যাত জায়গায় ভ্রমণ করতে যায়।
আমাদের আসল ব্যাপার ছিলো ঐ খাওয়াদাওয়ার পরে। আমাদের সমবয়সীদের একটা দল ছিলো। আমাদের চেয়ে যারা দুচার বছর বড় তাদের দল ছিলো আলাদা। যাই হোক, দুপুরে খাওয়ার পর আমাদের দলের সব ছেলেরা মিলে এক জায়গায় গোল হয়ে বসতাম। বসতাম শুধু আড্ডা মারা বা মজা করার জন্য নয়। আরো গভীর ব্যাপার ছিলো। এটা নষ্টচন্দ্রের রাত। এই উপলক্ষ্যে প্রতিবেশীর ‘কিচেন গার্ডেন’-এ চুরি করা মহা পুণ্যের কাজ। এই জমায়েতের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সে সম্বন্ধে আলোচনা ও চুরির কৌশল ঠিক করা।
প্রথমেই আমরা প্রত্যেকে কার বাড়িতে কী আছে সেটা আলোচনা করে নিতাম। গত পনেরো দিন ধরে কার বাড়ি থেকে কী চুরি করা যাবে তার শুলুকসন্ধান আমরা সবাই করেছি। এই মিটিঙে তা বলতাম। কী চুরি হবে তা ঠিক হবার পর কে কী চুরি করবে সেটা ঠিক করা হতো। নিয়ম ছিলো যে, যে বাড়িতে চুরি হবে, সে বাড়ির লোক যেন বিন্দুবিসর্গও জানতে না পারে। তারা জানবে পরদিন সকালে। আরেকটা নিয়ম ছিলো, যে বাড়িতে চুরি হবে সে বাড়ির ছেলে ঐ চুরিতে জড়িত থাকবে না, যদিও সে ব্যাপারটা জানবে। এছাড়া নিয়ম ছিলো যে এই মিটিঙের কথা বাইরে কাউকে বলা চলবে না। চুরি করা জিনিসপত্র পরদিন এক জায়গায় জড়ো করতে হবে। পরের দিন ঐসব জিনিস দেখেও কেউ কিছু বলতে পারবে না, কারণ সেটা ঐ বাড়ির লোকেদের লজ্জা-- তারা তাদের নিজেদের জিনিস রক্ষা করতে জানে না।
মিটিং গুলতানি সারতে সারতে প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। যে যার বাড়িতে ফেরার আগে ঠিক হয়ে যায় পরে কোথায় আবার আমরা অনেক রাতে একসাথে হবো। আমরা সাধারণত আমাদের এক পাড়াতুতো ভাইপোর বাড়িতে জড়ো হতাম। বাড়িতে ও ছাড়া আর ছিলেন ওর বিধবা মা আর তিন-চার বছরের ছোট বোন; কাজেই সব ব্যাপারেই ওটা ছিলো আমাদের ঘাঁটি।
ওখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি গিয়ে--না, যা এখনকার ছেলেমেয়েরা করে, তা নয়, পোশাক পাল্টানো বা সাজগোজ করা নয়-- দেখতাম পুজোর কদ্দুর কী হলো। এই সাজগোজের কথায় মনে পড়লো, আমরা সাধারণত পড়তাম ডোরা দেওয়া একরকমের প্যান্ট আর শীত না পড়লে গায়ে কিছুই থাকতো না- একেবারে উদোম গা। তাতে কেউ কিছু ভাবতো না। আমাদের গাঁয়ের ধনীর ছেলেরও ঐ পোশাক, আবার সবচেয়ে গরীব যে, তারও তাই। এরপর বেরোতাম পাড়ার অন্যান্য বাড়ির পুজো সার্ভে করতে। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতেই দলের সবাই একত্রিত হয়ে যেতাম। এর মধ্যে হয়তো কোন বাড়ির পুজো হয়ে গেছে, কোথাও শেষ হতে চলেছে। আমাদের কাজ যেখানে যেখানে পুজো শেষ হয়েছে, সেখানে সেখানে হানা দিয়ে প্রসাদ খাওয়া, আলপনা দেখা ইত্যাদি। এইভাবে পাড়ার সব বাড়ির প্রসাদ খেয়ে পেট ভরে যেতো, বাড়িতে রাতে আর খাওয়ার ব্যাপার থাকতো না। বাড়ির সবাই সেটা জানতেন, তাই কোন ছেলে না খেলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হতো না কারোর। এভাবে প্রসাদ খেতে খেতে চাঁদ প্রায় মাথার উপরে চলে আসতো। সবাই সবার বাড়িতে প্রসাদ খাচ্ছে, কাজেই রাস্তায় লোক চলাচল কম। ফলে আমাদের কাজ শুরু হতে দেরী হতো। ঐ সময়টা ঐ ভাইপো, যার নাম ছিলো পরাশর, তার বাড়িতে গল্পগুজব হতো। একবার আমার এক দূর সম্পর্কের ভাই সুবোধ বাথরুমে যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েই হাউমাউ করে উঠলো। আমরা সবাই বেরিয়ে এসে জিগেস করলাম, কী ব্যাপার। সবাইকে দেখে একটু ধাতস্থ হয়ে সুবোধ বললো--ভূত!
আমরা বললাম--কোথায়?
ও একটা কলার ঝোপের দিকে দেখিয়ে বললো--ঐখানে।
বলতে বলতে আবার চেঁচিয়ে উঠলো--ঐ তো, তোমরা দেখতে পাচ্ছো না? একটা সাদা শাড়ী পরা মেয়ে--
আমরা বললাম--না তো।
শুনেই ও ঘরের ভেতর চলে গেলো। আর আমরা কলা গাছের ঝোপটার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম সত্যিই কিছু আছে কি না।
ইতিমধ্যে হৈ-হট্টগোল শুনে বৌদি ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সব শুনে আবার ভেতরের ঘরে গিয়ে একটা টর্চ নিয়ে এলেন। ঐ কলাগাছের দিকে টর্চের আলো ফেলে একটু দেখেই সুবোধকে ঘর থেকে টেনে বের করে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড় করিয়ে বললেন--এখনো দেখতে পাচ্ছিস?
ও বললো--হ্যাঁ, ঐ তো দেখা যাচ্ছে।
ওর কথা শেষ হতে না হতেই বৌদি টর্চের আলো ফেললেন কলা ঝোপের ওপর--এখনো?
সুবোধ বললো--না তো!
ঐ রাতে যদি বৌদি ভয় ভাঙিয়ে না দিতেন তাহলে আমাদের রাতের অ্যাডভেঞ্চারটাই বরবাদ হয়ে যেত।
আসলে হয়েছিলো কি, ঐ কলা ঝোপের পাশেই ছিলো একটা বিরাট বেলগাছ। ঐ বেলগাছের শাখাপ্রশাখার ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল চাঁদের আলো কলা গাছের পাতায় পড়েছিলো এবং গাছটা বাতাসে অল্প অল্প দুলছিলো। তাতেই সুবোধের দৃষ্টিভ্রম হয় যে একজন সাদা শাড়ী পরা ঘোমটা দেওয়া মেয়ে যেন দাঁড়িয়ে আর তার কাপড়টা একটু একটু নড়ছে।
এরপর সারা রাত চৌর্যবৃত্তিতে আমাদের যা যোগাড় হতো তাই দিয়ে পরদিন হতো মহাভোজ। সেই ভোজের উদ্যোক্তা ছিলেন ঐ বৌদি। চুরি করে পাওয়া যেতো কলা, মানকচু, কুমড়ো, শশা, নারকেল। তবে নারকেল আমরা মাত্র একবারই পেয়েছিলাম কারণ নারকেলের ঘন পাতার জন্য তলাটা খুব অন্ধকার থাকে আর তার মধ্যে নারকেল গাছে ওঠবার হিম্মৎ আট-দশ বছরে আমাদের ছিলো না। আমি দেশ ছাড়ার আগের লক্ষ্মীপুজোয় আমার চেয়ে বছরখানেকের বড় আমার এক দাদা, যে আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতো, আমাদের দলের মধ্যে প্রথম নারকেল চুরি করে আমাদের নায়ক হয়ে গেলো রাতারাতি।
ঐ নারকেলের কথায় আরেকটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেলো। সুবোধদের বাড়িতে শোবার ঘরের ওপরেই একটা নারকেল গাছ ছিলো। একবার লক্ষ্মীপুজোর আগে আমার আরেক কাকা সুবোধের বাবাকে বললেন, দাদা, আপনার গাছে তো বেশ বড়ো বড়ো নারকেল হয়েছে অনেকগুলো। সুবোধের বাবা, যাঁকে আমরা নন্দীকাকু বলে ডাকতাম, বললেন, ওদিকে নজর কেন হে? লক্ষ্মীপুজোয় চুরির মতলব নাকি?
কাকু বললেন--না না, সেরকম কোনো মতলব নিয়ে বলিনি, এমনি বলছিলাম।
নন্দীকাকু--তা বেশ। তবে এখানে চুরি করতে এলেও সুবিধা হবে না। আজ পর্যন্ত কেউই এ গাছ থেকে নারকেল চুরি করতে পারেনি।
কাকুর কানে কথাটা একটু চ্যালেঞ্জের মতো ঠেকলো। বলে বসলেন--ঠিক আছে, আমি এবার ঐ নারকেল গাছ থেকেই নারকেল চুরি করবো।
নন্দীকাকুও বললেন, ঠিক আছে, চেষ্টা করে দেখো পারো কিনা।
কাকু প্ল্যানমাফিক নারকেল চুরি করেছিলেন এবং খুব সামান্যর জন্যই ধরা পড়েন নি। হঠাৎ একটা নারকেল হাত ফসকে নন্দীকাকুর টিনের চালের উপরে পড়ে গিয়ে হুলুস্থুলু ব্যাপার। টর্চফর্চ নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে নন্দীকাকুর যেটুকু সময় লাগলো তারই মধ্যে দাঁতে একটা নারকেল কামড়ে ধরে নারকেল গাছ থেকে পাশের সুপারী বাগানের একটা সুপারী পাতা টেনে শূন্যেই ঐ সুপারী গাছ এবং একই পদ্ধতিতে বারো-চোদ্দটা সুপারী গাছের সাহায্যে শূন্যেই প্রায় তিরিশ-চল্লিশ হাত দূরে গিয়ে সুপারীগাছ বেয়ে নিচে নেমে টুক করে পাশের পুকুরে নেমে নিঃশব্দে ডুবসাঁতার কেটে পুকুর পেরিয়ে নিজের দলের কাছে ফিরে এলেন। পরদিন কাকুর মুখেই ঐ গল্প শুনেছিলাম। নন্দীকাকু হেরে গিয়ে কাকুদের পুরো দলকে একদিন নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিলেন মনে আছে।
কী দিন ছিলো তখন ভাবতে এখনো রোমাঞ্চ লাগে। এযুগের ছেলেমেয়েরা সে আনন্দ পেলো না আর কোনিদন পাবে না সে ভরসাও নেই। কারণ মানুষের জীবনের pivot point এখন অর্থ, আনন্দ নয়।