নীল সম্বলপুরীর আঁচলে সেফটিপিন লাগিয়ে একবার নিজের দিকে তাকিয়ে নিল শ্রীময়ী। কুড়ি বছর আগের ছিপছিপে চেহারার, লম্বাটে মুখের মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সেই মায়াবী চোখদুটিও। এখন সদ্য-চল্লিশের মুখখানিতে ভারিক্কি ভাব এসেছে খানিক, চোখের কোনায় কাল-বায়সের পায়ের দাগ, চুলেও একটা-দুটো রুপোর তারের ঝিলিক।
সুখের কথা, যা বিশেষ বদলায়নি তা হল গলার জোওয়ারী। ভরা আসরে গলা ছেড়ে যখন মুদারার পঞ্চম থেকে সুরের চিতান দেয় তারার পঞ্চম অবধি, শ্রোতারা নড়েচড়ে বসে। ঝিমিয়ে পড়া আসর মুহূর্তে টানটান, সজাগ। আবার যখন মাথুরের পদ গায়, শ্রোতারা সেই বিচ্ছেদ-বেদনার অভিঘাতে একসঙ্গে কাঁদে। এ তো আর একদিনে হয়নি, এত দাগ-ছোপের বিনিময়ে, এতদিন পরেই না গ্রামে-গঞ্জের কীর্তনের আসর ছাড়াও তার ডাক আসছে শহুরে বাবুদের সভা থেকে।
তবে এই সোশাল মিডিয়ার জমানায় কলকাতা-কৃষ্ণনগরে শ্রোতার মধ্যে বেশি এধার-ওধার নেই। শহর আর গঞ্জ মফস্বলেরও না। একই গান কয়েক সেকেন্ডে লক্ষ-লক্ষ লোকে শুনে ফেলছে মুঠোর যন্তরে। ভাল তো বটেই, খারাপ লাগলেও বলতে ছাড়ছে না! শুধু কতদিন ধরে শুনবে তা বোঝার কোনো হাওয়া-মোরগ নেই...আজ যাকে ভাইরাল করে মাথায় তুলে নাচছে, কাল তাকেই ফেলে চলে যাচ্ছে অন্য কোনো রিলের সন্ধানে। হালে তার গাওয়া কীর্তন নেড়ে-চেড়ে দেখছে অনেক লোকে, ডাকতে ভরসা পাচ্ছে। বিশ বচ্ছর তো হয়ে গেল এই লাইনে, এতদিন পরে এখন বিশু পর্যন্ত বলেছে, হাওয়া চলছে, কামিয়ে নাও।
আজকে রূপানুরাগ আর অভিসার গাইবে ঠিক হয়েছে, তাই বিশুই বলল, "নীল শাড়ি পরো শ্রী।" সঙ্গের ম্যাচিং রুপোর গয়না অবশ্য শ্রী-র নিজের পছন্দে। "নীল বসন, রতন-ভূষণ, জলদে দামিনী সাজে"। আয়নায় নিজের ছায়া দেখে নিজেই গুনগুন করে।
সকালে আঁকা রসকলি একটু মুছে গিয়েছে বৃষ্টিহীন শ্রাবণের সারাদিনের গুমোটে। দুই ভুরুর মাঝখানে দুটি সমান্তরাল রেখার সামান্যই অবশিষ্ট আছে। মোবাইলে একবার সময় দেখে নিল শ্রী। একটাই তো কাজ বাকি, তার আগে আর একবার এঁকে নেবে নাকি? সময় তো আছে। তারপর নিজেই ভাবল, নাঃ থাক। যাওয়া এসি গাড়িতে, গিয়ে গ্রীনরুম, স্টেজ, সবই ঠান্ডায় হিম হয়ে থাকবে। যেটুকু আছে, থেকে গেলেই হল, এ তো আর কেতুগ্রামের কি রঘুনাথপুরের কোনো নাটমণ্ডপ নয়। তাছাড়া বিশু নিচে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে। বড় ব্যস্তবাগীশ খুঁতখুঁতে মানুষ, সব কিছু তার প্ল্যান মত, সময়মত না হলেই বকাবকি। তবু কী যেন ভেবে তিলকমাটির ডেলাটি ব্যাগে ভরে নিল শ্রী। যদি লাগে।
আলমারি বন্ধ করার আগে আরেকবার নিচের তাকটা হাঁটকালো। কোথায় যে গেল জিনিষটা! বিয়ের বেনারসির নিচেই তো রাখা ছিল, যা মনে পড়ে! এমনভাবে, যাতে কারণে অকারণে হাত না পড়ে...অথচ চাইলেই ছোঁওয়া-পরা যায়। গত স্নান-পূর্ণিমায় কালাচাঁদ মন্দিরের আসরের আগেও তো তাই করেছে। যে কোনও বড় আসরে যাওয়ার আগে দু-দণ্ড করজোড়ে, দু-চোখ বন্ধ করে দাঁড়ানো, সেই দিব্য অভিজ্ঞানটির সামনে। যুগল সরকার, পঞ্চতত্ত্বের পটে মাথা ঠেকানোর পর। কিন্তু এখন নেই...বিয়ের বেনারসি, বড়মামীর দেওয়া সাধের বোমকাই, বিশুর কেনা কাঞ্জিভরম ...বাকি সব আছে।
শ্রীর ইচ্ছা হল টান মেরে সব কটা তাকের শাড়ি নামিয়ে ফেলে। বিশুকে বলে দেয় আজ আর যাবে না, ফিরিয়ে দিক বায়নার টাকা। বিশু চেঁচামেচি করবে খুব। যেমন চেঁচিয়েছিল জগৎবল্লভপুরের সেই আসর থেকে ফেরার সময়—"তোর আক্কেল কবে হবে শ্রী? রূপাভিসারের, রূপানুরাগের বড় তালের দাগী গান ধরলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে খোলে কাটান তুলতাম, আসর জমে যেত! তা না, মিনমিন করে রবি ঠাকুরের গান ধরলি? কিশোর, কিছু বলছিস না যে, তোর যদি সুরটা জানা না থাকতো?"
তখন সবে সকাল হচ্ছে। তিনজনে তেঁতুলপাতায় সুজনের মত ভ্যান-রিকশায় বসে ফিরছিল আসর থেকে। সঙ্গের সঙ্গী বিশুর শ্রীখোল আর বাসুর হারমোনিয়াম। কিশোরের বাঁশির ব্যাগ তার কাঁধে, তূণীরের মত। শ্রী তখন একুশ, বিশু কিশোর দুজনেই তেইশ, গানের জগতে সদ্য পা রেখেছে সবাই একসাথে। টগবগে তরুণ সব। সেদিন তিন ঘন্টা ধরে অভিসার গেয়েছে শ্রী, কর্মকর্তারা চাইলে কুঞ্জভঙ্গও গেয়ে দিত। কিন্তু প্রথা ভাঙলে বিশুর মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে বেরিয়ে পড়তে চাইল। ভ্যানওয়ালাকে বলাই ছিল, গায়ে শাল জড়িয়ে আসর থেকে অগত্যা বেরিয়ে এল শ্রী। বাসু পরে আসবে, জগৎবল্লভপুর তার শ্বশুরঘর।
তখনও বিশুর ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল শ্রী। একটা কথা ঠিক, পালা কীর্তনের ওই পর্যায়ে কীর্তনিয়ারা বড় তালের গান ধরেন, খোলবাদকেরা হাত খুলে বাজায়, মাঝরাতের ঝিমিয়ে পড়া আসর চেতে ওঠে...যেমন সেদিন বিশু বলেছিল, শশিশেখর তালের "মরি মরি শ্যামের বদন-ছটা" গাইতে, রূপানুরাগের পদ। কিন্তু তখন একটু অন্যরকম করতে ইচ্ছে হয়েছিল তার, সেই সন্ধ্যায় গৌরচন্দ্রিকা থেকেই ভারি ভারি গান গেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল, সে ধরেছিল ইস্কুলের প্রভা দিদিমণির কাছে শেখা রবীন্দ্র-গান, এখনো তারে চোখে দেখিনি, শুধু বাঁশি শুনেছি।
বিশু রেগেমেগে একবার তাকিয়েছিল, তারপর অবশ্য বাজানোয় মন দিল। কিশোর কিন্তু আগাগোড়া তাকে ফলো করে গেল সহজেই। তখন সে কৃষ্ণনগরের পরাণ হালদারের কাছে কালোয়াতি বাজনা শেখে, এটুকু তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। শ্রোতাদের দেখেও মনে হয়নি কোনো ছন্দপতন ঘটেছে। শ্রী-র মনে হয় রবি ঠাকুরের এই গান যেন বৈষ্ণবতত্ত্ব ছেনে রচিত, পূর্বরাগ পর্যায়ে এর তুল্য গান খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধু এই গান কেন, রবি ঠাকুরের অনেক গানই লীলাকীর্তনেও স্বচ্ছন্দে জুড়ে যায় ভাবের দিক থেকে, তুকের দিক থেকে। তার কেবল মনে হয় বৈষ্ণব পদাবলীও তো কত কত বছর ধরে নানা মহাজনের পদ জুড়ে জুড়ে আজকের পদাবলী, তাতে রবি ঠাকুরের গান জুড়ে দিলে ঐশ্বর্য বাড়বে বই কমবে না। কিন্তু সে চুপ করে থাকল। কারো সাড়া না পেয়ে বিশু রাগত দৃষ্টিতে কিশোরকে দেখল, কিন্ত কিশোর অন্যমনস্ক। সে দেখছিল সরষের মাঠের শেষে বিশাল তামার টাটের মত সূর্য উঠছে।
মনসাতলার মোড়ে বিশু নেমে গেল। খোল কাঁধে তাদের গলিতে ঢুকে পড়ল হনহন করে। শ্রীকে ওর বাড়ির সামনে ছেড়ে দেবার সময় কিশোর বলল, ভাবিস না, পরশুর প্রোগ্রামের আগে বিশুর মেজাজ আবার ঠিক হয়ে যাবে। তারপর গলা নামিয়ে যেন ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমনভাবে বলল, হ্যাঁরে, আমাকে ওই গানটার স্বরলিপিটা একটু দিবি?
নিচ থেকে বিশুর হাঁকডাকের আওয়াজ আসছে। শ্রীখোল, হারমোনিয়াম গাড়িতে রাখছে মনে হয়। এই কাজটাও সবসময় নিজেই করে বিশু।
কখন যে তাকের সব শাড়ি নামিয়ে খাটে জড়ো করেছে শ্রী, নিজেরই মনে নেই। নেই, কোথাওই নেই। এবার তার অস্থির লাগছিল। কোথায় গেল তবে? কারো হাত পড়েছে আলমারিতে? কাজের মেয়ে বেলা? নাঃ, অনেক দিনের বিশ্বস্ত লোক, তা ছাড়া, দামি শাড়ি, পারফিউম সবই যেমনকার তেমনি আছে। বিশু? তার সম্মানবোধ নাসাগ্রে। হলই বা স্ত্রী, না বলে শ্রী-র আলমারি হাঁটকানো বিশুর পক্ষে সম্ভব না।
শ্রী ঠিক করতে পারছিল না কী করবে, এবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কী বোর্ড নিয়ে বাসুদেব এসে গেছে অনেকক্ষণ। মেসেজ করেছে। বিশু তো কল টাইমের এক-আধঘন্টা আগে পৌঁছনোর পক্ষপাতি। বকাবকি করবে।
বাসু আজকাল হারমোনিয়াম ছেড়ে কী-বোর্ড ধরেছে। আজকাল আসরে নাকি নানা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শুনতে চায় লোকে। সেতার, ভায়োলিন, বাঁশি। তাছাড়া হরবোলার মত পাখপাখালির ডাক। লোকে চায় সেটা বড় কথা নয়, অবাক লাগে বিশুর ভোল পাল্টানো দেখে। সে বেশ মেনেও নিয়েছে এই বন্দোবস্ত।
অথচ তখন? কিশোর স্বরলিপি দেখে দেখে কত রবি ঠাকুরের গান তুলেছিল! ভানুসিংহের পদাবলীর প্রায় সব গান, কীর্তনাঙ্গের আখরযুক্ত অন্য গান... তখন তো মোবাইলের রিল ছিল না, ছাপা স্বরলিপিই একমাত্র ভরসা ছিল। কিশোর বলে-বলে সেইসব সুর থেকে ধুন বাজাতো, আর বিশু রেগে যেত। তার কাছে নাম সংকীর্তন আর মহাজন পদ ছাড়া সব "কাওলাতি"। কিশোর একবার বলেই ফেলেছিল, "তা তুমিও তো খোলে কাওলাতিই করো, এইযে বাজাও হাতুটি, উঠান, কাটান, লহর... এসব কাওলাতি না?"
"উঁহু, শ্রীখোলের বোলেও মহাপ্রভুর প্রেম রয়েছে, শুনবি?"
বলেই মুখে বোল তুলে বাজিয়েছিল—"দুটি দুটি দুটি ভাই, চৈতন্য-নিতাই
রাধা ধ্যায়াও, রাধা ধ্যায়াও মন,
কৃষ্ণ ধ্যায়াও, সীতানাথ অদ্বৈত ধ্যায়াও
তাকে ধ্যায়াও...."
কিশোর হেসে ফেলে, বলে, "আর ওইটা! ধিক তাম্, ধিক তাম্ ধিক্?"
"হ্যাঁ, ওটাও। ...মানাক্রান্তাবলোকয়তি দোষম্, ধিক্তাং ধিক্তাং ধিক্," বিশুর হাতে খোল কথা বলে ওঠে যেন।
কিন্তু সব তর্কই এরকম হাসি-ঠাট্টায় শেষ হচ্ছিল না। আড়ংঘাটায় এক কীর্তনের আসরে এমন খটামটি লাগল বিশু আর কিশোরের মধ্যে যে কিশোর আসর ছেড়ে বেরিয়ে এল মাঝপথে।
তাদের সঙ্গে বাজানো ছেড়েও দিল।
বাসু পকেটের থেকে পান-মশলা বের করে মুখে দিল। কেন দেরি হচ্ছে জানা নেই তার। সে দেখল বিশ্বনাথদা রেগে যাবার বদলে স্মিতমুখে গুনগুন করে কী যেন সুর ভাঁজছে। কেমনধারা যেন মানুষটা!
কিশোর চলে গেছিল। বেনারস। ওস্তাদ পরাণ হালদার তাঁর ঘরানার খলিফার কাছে তালিম নিতে পাঠালেন ছাত্রকে। অন্তত সবাই তাই জানে। বিশু আরো খানিকটা জানে। ভাগনিকে রাসচক্র দেখাতে নিয়ে গেছিল, সেখানে আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনা যেটুকু।
অবশ্য কতটুকুই বা উচ্চারিত হয়? বিশেষত একপক্ষই যদি কেবল কথা বলে যায়, আর অন্যপক্ষ গুমরিয়ে গুমরিয়ে কাঁদে? জনতার কোলাহলে যদি কিছু চূর্ণকথা গুঁড়িয়ে যায়?
"আমাকে যেতেই হবে রে। শিখতে হবে আরো ভালো করে। এমনি কীর্তনে সঙ্গত করে কোনো লাভ নেই।"
অপর পক্ষ কী বললো ভালো শোনা গেল না। নাক-টানার আওয়াজ।
"বিশুকে সামলে রাখিস। আর...দেখবি, তোর খুব নাম হবে একদিন।"
আবার নীরবতা।
"আচ্ছা চলি।"
"আর ওইটা?"
"কী আবার? আচ্ছা, মার কাছে রেখে যাবো। নিয়ে নিস মনে করে।"
কুড়ি বছরে শ্রীর গোপনীয় আর প্রায় কিছুই নেই। কিন্তু এইটুকু গোপন রেখে দিয়েছে। সযত্নে। সামনে ফেলে রাখলে হয় তো বিশু জানতো না। জানতে চাইতোও না।
বিশুর বদমেজাজ স্তিমিত হয়ে এসেছে অনেক। রাগ, অভিমান, ঈর্ষা...কিছুই না, বরং আশ্চর্য এক শান্তিতে তার মন ভরে ছিল...মন বলছিল, আরেকটু খোঁজো শ্রী। হলুদ বালুচরী শাড়ির ভাঁজে আছে সেইটা। বেনারসীতে নয়।
কিশোরের একটা হাই পিচের বাঁশি। ছোট্ট জিনিষ।
আজও খুব ভাল গান হবে। তবে শ্রী আজ মাথুর গাইলে বড় ভাল হয়।