“তুই নিশ্চয় ক্যাবলার মত কিছু করেছিস। যে রকম সাধারণত ক’রে থাকিস।”
কি জানি! হয়তো তাই।
খুব চাপের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু কি ভুল করলাম বুঝতে পারছি না।
আচ্ছা, মনে করুন আপনি খুব চাপের মধ্যে আছেন। ইয়োরোপের কোনো দেশের দূতাবাস থেকে বিশেষ একটা ভিসা করাতে হবে। শেষ মুহূর্তে এক গাদা দাম দিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লিতে যাবার প্লেনের টিকিট কিনেছেন, কারণ সময় নেই। সন্ধেবেলা দিল্লি পৌঁছোলেন। রাতটা হোটেলে কাটালেন।
সকালে স্নান ক’রে, দূতাবাসের অ্যাপয়েন্টমেন্টে গেলেন। বিভিন্ন প্রকার ফর্ম, পাসপোর্ট, বিশেষ মাপের বিশেষ ধরনের ফোটো, অন্যান্য অনেক কাগজপত্র, টাকাপয়সা ইত্যাদি ইত্যাদি। চোখে চমৎকার নতুন চশমা, ফুলঝুরি পাখির পালকের চেয়েও হালকা, তিন মাসের মাইনে দিয়ে কেনা।
লক করা লোহার গেট দিয়ে ঢুকে, নাম লিখিয়ে, টাকা জমা দিয়ে, ছাউনির নিচে ব’সে সাত-পাঁচ ভাবছেন। ভিসা হবে তো? নিশ্চয় হবে! কতদিন লাগবে কে জানে! পাসপোর্ট তো নিয়ে নেবে। কুরিয়ার দিয়ে পাঠাতে কত দিন লাগবে কে জানে! যাবার দিনের তো বেশি বাকি নেই! তার মধ্যে পৌঁছবে তো? না পৌঁছলে সর্বনাশ! সব কাগজপত্র ফর্ম ঠিকমত এনেছি তো? এই ফোটোটাতে হবে তো? ইত্যাদি।
অশেষ অপেক্ষার শেষে আপনার নাম ডাকলো।
আপনি গুটি গুটি হেঁটে দ্বিতীয় একটা লক করা গেট পেরিয়ে ভেতরে গেলেন। কি জানি কি হয়!
নাঃ। সব কাগজপত্র ফর্মই ঠিক এনেছেন। সব ঠিকঠাক। ফোটোটাতেও কাজ চলবে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। শুধু পূর্বে উল্লেখিত হয়নি এমন আর একটা কাগজ লাগবে। সেটা কালকের মধ্যে ইমেল-এ পাঠালেই হবে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ওরা ভিসার ছাপ মেরে পাসপোর্ট আপনাকে পাঠিয়ে দেবে। আপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আর কোনো চিন্তা নেই।
দূতাবাস থেকে বেরিয়ে ভাবছেন এবার কি করবেন। সবে বারোটা বেজেছে। চশমাটা খুলে ঝোলানোর জন্য বুকের কাছে জামাতে গুঁজলেন। ফেরার ফ্লাইট সেই সন্ধেবেলা। একবার তাহলে “জনপথ” যাই? বাজারে হাঁটাহাঁটি করা যাবে, কেনাকাটি করা যাবে। তারপর নাহয় “কনট প্লেসে” কোথাও ব’সে একটু খাওয়াদাওয়া সেরে এয়ারপোর্ট যাওয়া যাবে। অনেক সময় আছে হাতে।
আপনি রাস্তায় চট ক’রে একটা অটোরিক্সা পেয়ে গেলেন। দর রফা ক’রে ফট্ ক’রে উঠে পড়লেন। কাজ ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে। বেশ ফুরফুরে লাগছে।
বড় রাস্তায় প’ড়ে অটোরিক্সা বাঁ দিকে ঘুরলো। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। ড্রাইভার জোরে চালাচ্ছে। আপনি ব’সে আছেন বাঁ-দিক ঘেঁষে। ডান দিকের সীট খালি। মুখে এসে লাগছে মুক্ত হাওয়া। মাঝে মাঝে এক একটা জোর দমকা দিচ্ছে। নিশ্বাস নিচ্ছেন টেনে টেনে। আঃ!
এই চিত্তাকর্ষক শান্তির মধ্যে হঠাৎ ঘটে গেল অঘটন।
ভালো ক’রে বোঝার আগেই দেখলেন ডানদিকের জানলা দিয়ে একটা চশমা চ’লে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে হাওয়ায়। নিচের দিকে প’ড়ে যাচ্ছে অমোঘ মাধ্যাকর্ষণে।
আপনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অবোধ্য কিছু শব্দ। শব্দ নয়, আওয়াজ। হয়তো বলতে চাইছিলেন, “এ কি! এ কি!” কিম্বা “ধর্! ধর্!” অথবা “হায়! হায়!” — কিন্তু ড্রাইভার শুনলো একটা অস্ফুট আর্তনাদ, “গ্যাঁৎ শংকর ধরাশায়ী” -গোছের কিছু প্রলাপ।
দেড় সেকেন্ড পরে লক্ষ্য করলেন বুকের কাছে জামা থেকে ঝুলন্ত চশমাটা গায়েব হয়েছে। হাওয়ায় দমকায় উধাও হয়ে হারিয়ে গেছে সেটা। অবাক বিস্ফারিত চোখদুটো আপনি নিজের জামা থেকে ধীরে ধীরে ডানদিকের জানলা অবধি বোলালেন। চশমাটা আর হাওয়ায় ভাসমান নেই। চশমা হাপিশ।
“রোখ্ কে, রোখ্ কে,” চেঁচিয়ে উঠলেন একটা অযৌক্তিক আশায়। ড্রাইভার ঘ্যাঁশ্ ক’রে ব্রেক কশলো, ঘ্যাঁ-অ্যাঁ-শ্-শ্ খ্যাঁক্ ঘ্যাঁশ্।
আপনি তাড়াতাড়ি নামলেন অটোরিক্সা থেকে। পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। সকরুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে রাস্তায় খুঁজতে লাগলেন। কোথায় চশমা? কোথায়? ওই তো! ওই যে!
একটা উল্লাস জাগল আপনার বুকে। কিন্তু সেটা পরমুহূর্তেই চুপসে গেল।
একটা দ্রুত ধাবমান গাড়ি নিখুঁত পারদর্শিতায় আপনার চশমার উপর দিয়ে চাকা চালিয়ে হুশ ক’রে চ’লে গেল। হ্যাঁ। আপনার চোখের সামনে আপনার প্রিয় ও প্রয়োজনীয় প্রাণসঙ্গী অপ্রত্যাশিত ভাবে এক পলকে প্রাক্তন হয়ে গেল।
শেষ আশায় আপনি দৌড়ে গেলেন। না, বাঁচেনি। লাশ প’ড়ে আছে ছিন্নভিন্ন হয়ে। আপনার চশমাহীন চোখে জল।
এর পর আপনি আর কি করতে পারেন?
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে।
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে॥
ক্ষতবিক্ষত শবদেহ দুহাতে কুড়িয়ে এনে আপনি অটোরিক্সায় বসবেন। গাড়ি চলবে আবার। আপনি আপনার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুকে ফোন করবেন একটু সহানুভূতির খোঁজে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলবেন, “চশমা প’ড়ে ভেঙে গেল রে! তার উপর দিয়ে গাড়ি চ’লে গেল!”
প্রাণের বন্ধু নুন ছিটোবে।
“তুই নিশ্চয় ক্যাবলার মত কিছু করেছিস। যে রকম সাধারণত ক’রে থাকিস।”