“আমরা কিন্তু অসুখী নই।”
রজত তার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। কে জানে কেন তারা সবাই ওকে এই কথাটা বলে। হয়তো ভাবে, এটা না বললে রজত তাদের থেকে বেয়াড়া কিছু একটা চেয়ে বসবে। রজতের বিয়ে হয়নি, তাই সে জানে না 'সুখী দাম্পত্যের' পরিভাষাটা ঠিক কি। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যসুখের ওপরেই যে তার রুজিরুটি নির্ভর করছে, এটা সে খুব ভালোই বোঝে। তারা কথাটা বুঝেও বুঝতে চায় না। হয়ত তাদের সম্মানে আঘাত লাগে।
রজত এটাও লক্ষ্য করেছে, যে কথাটা বলার সময়ে তাদের চোখে একটা ধূসর ছায়া নেমে আসে। বৃষ্টি নামার ঠিক আগে যেমন কালো মেঘ এসে দিগন্ত ঢেকে দেয়, সেরকম একটা অস্বচ্ছ ধূসরতা। আর আছে অস্থিরতা। সব সময়ে তারা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে আছে – যেন নিজের জীবন থেকে নিজেই সময় চুরি করে ফেলেছে। বর বাড়ি ফেরার সময়, ছেলের স্কুল ছুটি হওয়ার সময়, কাজের লোক আসার সময়। অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোও সেই একই ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। এতটুকু বেনিয়মের জায়গা নেই। টিক টিক টিক টিক...
কথাটা যেদিন সে বলেছিল, সেদিন তারা পার্কে বসেছিল। বর্ষার মনমরা আকাশে সবে শরতের নীল হাসি ফুটেছে। নরম সবুজ ঘাসের ওপর সারি সারি পাম গাছের ছায়া পড়েছে। আর পড়েছে তার নরম ফর্সা গালের ওপর চোখের লম্বা পাতার ছায়া। দুটোই নকল।
“আমার বর খারাপ লোক নয়, জানিস? কিন্তু মাঝে মাঝে মানুষ সংসারে থেকেও একা হয়ে যায়। মনের কথা বলার জন্যে একজন সাথী খোঁজে।”
রজত আবার চুপ করে থাকে। ব্যাখ্যাটা সে রজতকে দিচ্ছে না নিজেকেই দিচ্ছে বোঝা যায় না। পাশ দিয়ে এক তরুণ-তরুণী হাত ধরে হেঁটে গেল। দূরে একজন বাচ্চা আইসক্রিম না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল। চোখের কোণা দিয়ে রজত সব লক্ষ্য করছিল।
“তুই আমার সব কথা কত মন দিয়ে শুনিস, তুই থেরাপিস্ট হলি না কেন?” বলতে বলতে সে হেসে ওঠে। তাকে হাসতে দেখে রজত স্বস্তি পায়। সুখী দাম্পত্যের কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই 'তারা' কান্নাকাটি জুড়ে দেয় ।
“সত্যি বলছি, তুই আর সবার থেকে পুরো আলাদা। তোর মতো ছেলে এই লাইনে এল কি করে রে?”
রজত ঈষৎ হাসল।
“সে অনেক লম্বা গল্প। তোমাকে পরে একদিন বলব।”
আবেগের বশে জিজ্ঞেস করে ফেললেও রজতের ক্লায়েন্টরা ওর কথা শোনার জন্যে টাকা দেয় না। নিজেদের গল্প শোনাতে চায়। অবশ্য রজতেরও যে বলার মতো তেমন কোন নাটকীয় গল্প আছে তা নয়। খুবই সাদামাটা কাহিনী তার।
কলেজ থেকে পাশ করে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিল রজত। এক সময়ে দুম করে চাকরিটা চলে গেল। ক'দিন বাড়ি বসে নিজের জমানো টাকা আর বাবার পেনশন খরচ করে ফুর্তি করল। তারপর যখন চাকরি খোঁজার পালা এল, আর পুরনো কাজে ফেরত যেতে ইচ্ছে করল না। স্কুলজীবন থেকেই রজতের শরীরচর্চার দিকে আগ্রহ ছিল। সেই অভ্যেস পরবর্তীকালেও যায়নি। অফিস থেকে ফেরার পথেও রোজ দু’ঘন্টা জিম করে তবে বাড়ি ঢুকত।
রজত ঠিক করল নিজের জিম খুলবে। ওটাই ওর সত্যিকারের প্যাশন। এদিক ওদিক খোঁজ নিয়ে জানতে পারল ঠিকঠাক একটা জিম খুলতে প্রায় লাখ দশেক টাকা লেগে যাবে। এইবারে রজতের মহা ফ্যাসাদ হল। ব্যাংকে গিয়ে লোন নেওয়ার সামর্থ্য নেই; বন্ধুবান্ধবরা কেউ ধার দিতে চায় না; বাবা সোজা বলে দিয়েছে জমা টাকা থেকে এক পয়সাও দেবে না, রজত যেন পত্রপাঠ চাকরি খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু রজত আর মাসে পঁচিশ হাজার টাকার জন্য সপ্তাহে ছ'দিন দশ ঘন্টা ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে রাজি নয়। বাঘ ততদিনে রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে।
একদিন ভুজুমদা আর বিল্টুর সঙ্গে বসে মদ খেতে খেতে সেই নিয়েই রজত দুঃখ করছিল। ভুজুমদা আর বিল্টু রজতের পাড়ার বন্ধু। এখন বিল্টু একটা বড় কোম্পানির ব্যাক অফিসে কাজ করে। ভুজুমদা যে কি করে পৃথিবীর কেউ তা জানে না। বলতে গেলে, ভিখিরি থেকে প্রধানমন্ত্রী অবধি সবাই ভুজুমদার চেনা, সকলের সঙ্গেই ওর ওঠাবসা, সবাই নাকি ওর এক গেলাসের বন্ধু।
রজতের সমস্যা শুনে ভুজুমদা কিছুক্ষণ বুকের মধ্যে থুতনি গুঁজে বসে রইল। যেন সামনে রাখা উইস্কির গ্লাসেই সব সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে আধবোজা চোখে জিজ্ঞেস করল,
“ব্লু ফিল্ম করবি? একটা প্রজেক্ট আছে। ঘণ্টা তিনেকের কাজ, পনের হাজার টাকা দেবে।”
ভুজুমদার কথা শুনে রজত তো থ।
“ব-ব্লু ফিল্ম?”
“জানিস তো কাকে বলে?”
“জ-জ-জানব না কেন? কিন্তু এসব কেউ করে নাকি? কি যা-তা বকছ!”
“কেন? এসব ফিল্মে এমন কি করা হয় যা আর পাঁচজনে করে না? খুন ডাকাতি তো আর করে না। হ্যাঁ, বাকিরা যেটা দরজার আড়ালে করছে তুই সেটা ক্যামেরার সামনে করবি। এটাই তফাৎ।”
“কিন্তু ভুজুমদা...” রজতের ভেতর থেকে প্রতিবাদ উঠে এসেছিল, “একজনকে চিনি না, জানি না...মনের দিক থেকে কোন টান নেই, সম্পর্ক নেই সেরকম কারুর সঙ্গে...”
ভুজুমদা খ্যাকখ্যাক করে বিশ্রী হাসি হাসতে হাসতে বলেছিল,
“ন্যাকা ষষ্ঠী আমার! মনের টান, ভালোবাসা ছাড়া এসব হয় না বুঝি? ঘরে ঘরে হচ্ছে, তবে লোকজন সেই জন্য তাদের মন্দ বলে না।”
“অ্যামস্টারডামে তো এসব লিগাল, প্রকাশ্যে চলছে,” পাশ থেকে বিল্টু ফুট কেটেছিল।
রজত মুখের ওপর হাত বুলিয়ে নিয়েছিল।
“কিন্তু...বাবা মা যদি দেখতে পেয়ে যায়?”
“তোর বাবা মা ওইসব সাইট দেখে কেন?”
“বন্ধুবান্ধবরা তো দেখবে।”
বিরক্ত হয়ে ভুজুমদা ওর গ্লাসটায় একটা মৃদু ধাক্কা দিয়েছিল। যেন গ্লাসটা রজত স্বয়ং।
“ছাড়, তোর দ্বারা কিস্যু হবে না! তোর বডি-ফডি ভালো দেখে বলেছিলাম, কিন্তু তোর বুকের পাটা নেই। ছেড়ে দে, আমি অন্য কাউকে বলব! ওই পার্ট করার জন্যে ছেলেদের লাইন লেগে আছে।”
সেদিন ভয়ের চোটে রজত কোন উত্তর দিতে পারেনি। বাড়ি ফিরে সারা রাত ছটফট করেছিল। একবার মনে হয়েছিল – মন্দ কি? কাজ বলতে তো তেমন কিছু না। ফোকটে পনেরটা হাজার টাকা পকেটে আসবে। ভালোভাবে উতরে দিতে পারলে হয়তো আরো প্রজেক্ট হাতে আসবে। সানি লিওনি তো এই করে সেলিব্রিটি হয়ে গেল।
পরক্ষণেই মনে হয়েছে নাঃ, মধ্যবিত্ত বাড়ির ভদ্রলোক এসব করে নাকি? লোক জানাজানি হলে পাড়ায় ঢি-ঢি পড়ে যাবে। ভুজুমদাকে সবাই লস্ট কজ বলে ধরেই নিয়েছে কিন্তু রজতদের তো একটা মানসম্মান আছে। তাছাড়া, এসব করতে গিয়ে যদি সে একটা বাজে অসুখ বাধিয়ে ফেলে? কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করবে না।
আবার ভেবেছিল, উপার্জন না থাকলেই বা কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করবে? এসব করে বড়লোক হয়ে বাড়ি-গাড়ি করতে পারলে গার্লফ্রেন্ডের অভাব হবে না। সারাটা রাত চোখের সামনে সানি লিওনির মুখটা নৃত্য করেছিল।
সকাল হতেই রজত ভুজুমদাকে ফোন লাগিয়েছিল।
“পার্টটা এখনো আছে?”
ফিসফিসে গলা, যদিও ঘরের মধ্যে আর কেউ নেই। রজতের ভয় ছিল, পাছে ওর নিজের কানই ওর বলা কথাগুলো শুনে ফেলে। পাছে, জানতে পারলে ও নিজেই নিজেকে একঘরে করে দেয়।
“শেষ অবধি কেউ জানতে পেরেছিল?”
এই প্রশ্নটা রজতকে কে করেছিল তা আজ আর ওর মনে নেই। মনে রাখাও মুশকিল। সবারই প্রায় সমান বয়স, পার্লারে গিয়ে ঘসামাজা চেহারা, দামী পোশাক, দামী পারফিউম। একজনের থেকে আরেকজনকে তফাৎ করা মুশকিল।
তাদের কর্তারা বরং অনেক ধরনের মানুষ। কর্তাদের ব্যাপারে রজত অনেক কিছু জানতে পারে। কর্তাদের অজান্তেই। একজনের গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করার শখ ছিল। আরেকজনের ছিল বইয়ের নেশা। কত বই...দেওয়াল থেকে সিলিং অবধি শুধু বই আর বই। একখানাও রজতকে ছুঁতে দেওয়া হয়নি। আরেকজন ছিল ক্রিকেটপ্রেমী। কারুর দামী মদের নেশা। কেউ পোশাক আশাকের ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক, আবার কারুর বাড়ির কোন ব্যাপারেই হুঁশ নেই। চোখের সামনে দিয়ে টেবিল চেয়ার হাপিস হয়ে গেলেও জানতে পারবে না। রজতের ক্লায়েন্টরা তাদের জীবনের ওই দিকটা রজতের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। তবুও শোয়ার ঘরের দেওয়াল দরজা, অসাবধান মুহূর্তে বলা বেফাঁস মন্তব্য, অবহেলায় পড়ে থাকা দামী টাইপিনেরা ফিসফিস করে গোপন কথা প্রকাশ করে দেয়।
যাই হোক, কেউ একজন রজতকে প্রশ্ন করেছিল রজতের সেই ব্লু ফিল্মের কথা কেউ জানতে পেরেছিল কি না। উত্তরটা ছিল হ্যাঁ, ওর এক বন্ধু জেনে ফেলেছিল। এবং দায়িত্ব নিয়ে বাকি সবাইকে জানিয়েছিল। মুখে কেউ কিছু বলে না আজকাল। সকলকেই উদারমনস্ক হওয়ার ভান করতে হয়। তাই রজতের মুখে কেউ কালি মাখাতে আসেনি। মাথায়ও ঘোল ঢালেনি। দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেছিল খুব গোপনে। আশ্চর্যের কথা, যারা বন্ধ করেছিল তাদেরই মধ্যে তিনজন থাইল্যান্ড থেকে ঘুরে এসে ম্যাসাজের পরে হ্যাপি এন্ডিং নেওয়ার কথা জাহির করেছিল। কীর্তি আরো অনেকের আছে, কিন্তু সবই বন্ধ দরজার ওপারে। তাই তারা আজ ভদ্রতার চাদরের আড়ালে গা ঢাকা দিতে পেরেছে।
যাই হোক, কথায় বলে একটা দরজা বন্ধ হলে আরেকটা খুলে যায়। ওই ফিল্মটা করে রজত যেমন কুখ্যাত হল, সেরকম কিছু সুফলও পেল। ওই থেকেই সে ধীরে ধীরে ক্লায়েন্ট পেতে থাকল। আবার সেই ভুজুমদা-ই ক্যাটালিস্ট।
“আরে তুই তো স্টার হয়ে গেলি রে!” অকস্মাৎ এক দুপুরে ভুজুমদার ফোন এল। “সকাল থেকে তোর প্রোডিউসারের ফোন থামছে না! সবাই তোকে চাইছে। ইন্টারেস্টেড?”
এবার আর রজত ইতস্তত করেনি। মানসম্মানের যখন বারোটা বেজেই গেছে, বস্ত্রহীনের আর বাটপাড়ির ভয় কি?
***
রজত খেয়াল করেনি কখন সে সরে এসে রজতের পাশ ঘেঁষে বসেছে। তার চুলের ডগাগুলো রজতের বুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
“আজকেও অটো করে এলি?” সে হাল্কা করে রজতের চিবুক নেড়ে দিল।
“হ্যাঁ, অটোয় এলে তাড়াতাড়ি হয়।”
“কেন রে, উবার নিতে পারিস না? আমি তো কত টাকা দিই, লাগলে আরো দেব। তবু অটো চড়িস কেন?”
টাকা সে একলা দেয় না, কিন্তু রজত সেকথা বলে না। ওরা সবাই ভাবে ওরা একাই বুঝি রজতের ক্লায়েন্ট, রজতের জীবনে একাই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ভ্রমটা বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।
“এবার পুজোয় বর কি দিচ্ছে?” রজত কথা ঘোরানোর জন্যে জিজ্ঞেস করল।
তার চোখে কৌতুকের ঝিলিক খেলে গেল। “বলব না, সারপ্রাইজ। একেবারে অষ্টমীর দিন গলায় পরে ছবি তুলে পাঠাব।”
“সেই হীরের নেকলেস?” রজত হেসে ফেলল। “যেটা সেদিন দেখালে?”
দু'জনে পি সি চন্দ্রের শোরুমের সামনে দিয়ে হাঁটছিল। সে-ই রজতকে ভেতরে টেনে নিয়ে গেছিল। “আয়, তোকে একটা জিনিস দেখাব!”
সেদিন দেখা হীরের ঝলক শেষ বিকেলের রোদে তার চোখে চিকচিক করে ওঠে।
“তা নয় তো কি? বললাম, এত বড় বিজনেসম্যানের বউ আমি, গায়ে গয়না না থাকলে লোকে কি বলবে? তোমার ক্লায়েন্টরা দেখলে ভাববে বিজনেস লাটে উঠেছে। ব্যাস, সুড়সুড় করে গিয়ে কিনে দিল।”
রজত মনে মনে হাসে। কেনাবেচার মাঝখানে আরেকটা অধ্যায় আছে, যা ঘটে বন্ধ দরজার আড়ালে। যখন রজত ফোন করলে তারা ধরতে পারে না। কিন্তু সেই লেনদেন সম্মানজনক। তাই তারা ঘরে ঢুকলে কেউ আড়চোখে তাকায় না, কথা থামিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে না।
“তাহলে এবছর তুমি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে লাঞ্চে যাবে?”
“ধুর! জানিস তো ওটা করতে আমার একদম ভালো লাগে না। ক্লায়েন্টদের সামনে ও কেমন অচেনা হয়ে যায়। তেল মেরে কথা বলে, ওদের বোকা বোকা কথায় দুলে দুলে হাসে।”
“তোমার ভালো লাগে না সে কথা তুমি বলনি?”
“বলেছি রে। কি বলল জানিস? বলল আমার প্রডাক্ট যদি বিক্রি করতে হয় আমার পার্সোনালিটিকেও খানিকটা বিক্রি করতে হবে। বিজনেস না করে যদি চাকরি করতাম, প্রমোশনের জন্যে বসের কাছে নিজেকে বিক্রি করতে হত। এটা বিপণনের যুগ। আরো অনেক কিছু বলল, সব আমার মাথায় ঢোকেনি। সিরিয়াসলি বলল না বোকা পেয়ে আমাকে টুপি পরাল তাও বুঝতে পারলাম না।”
“না না টুপি পরাবে কেন? কথা তো ঠিকই। কড়ি না ফেললে তেল মাখবে কি করে?”
“কড়ি তো তোরও আছে, তবু তো তেল মাখিস না। বড্ড কষ্ট হয় না তোর, অটো করে আসতে?” সে আড়মোড়া ভাঙে। “বিয়ের আগে আমাকেও বাসে, অটোয় ঝুলে ঝুলে ঘুরে বেড়াতে হত। এখন গাড়ির এমন অভ্যেস হয়ে গেছে না, পাশের বাড়ি যেতে হলেও থাপা-দাকে বলি গাড়ি বার করতে।”
“আরে, আমি বললাম তো, আমার অটো চড়তে অসুবিধা হয় না। তুমি আমাকে নিয়ে এত ভেব না তো।”
“তোকে নিয়েই তো যত ভাবনা রে আমার। সারারাত ভেবে ভেবে দু'চোখের পাতা এক করতে পারি না।”
বলতে বলতে সে ঘড়ির দিকে তাকাল। আর্মানির ঘড়ি। এবার জন্মদিনে উপহার পেয়েছে।
“এ বাবা, কথায় কথায় কত বেলা হয়ে গেল! তুই থাকলে সময় কিভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারি না। নির্ঘাত রুমেলার নাচের ক্লাস ছুটি হয়ে গেছে।”
তার মানে এবার ওঠার পালা। রুমেলা বাড়ি ফেরার আগে তার মাকে ফিরতে হবে। জলখাবারের তদারকি করতে হবে। চুরি করা সময়ের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে।
“ওঃ, ভুলেই গেছি। তোর জন্যে একটা গিফট আছে,” সে ব্যাগে হাত ঢোকাল। একটা চকচকে ফোন বেরিয়ে এল।
“আমার আগের আইফোনটা। জাস্ট তিন মাস আগের, ব্র্যান্ড নিউ। কিন্তু এখন আর আমার কি কাজে লাগবে? এ মাসে তো নতুন ফোন কিনে দিল। তুই বরং এটা ইউজ কর।”
“থ্যাংক ইউ,” নিঃসংকোচে হাত পেতে ফোনটা নিয়ে পকেটে ভরে ফেলল রজত। এসবই তার চাকরির অঙ্গ। এর জন্য আজ দুপুরেই সে দাম চুকিয়ে এসেছে।
“তোকে বাস স্ট্যান্ডে ড্রপ করে দিই?”
“হ্যাঁ তাই কর।”
***
পরে যতবার রজত সেই বিকেলটার কথা ভেবেছে, একটা কথাই তার বারবার মনে হয়েছে। পাশাপাশি হেঁটে গিয়ে গাড়িতে ওঠার সময়ে পড়ন্ত রোদের আলোয় তাদের দু'জনের ছায়া মিলে এক হয়ে গেছিল।