• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | রম্যরচনা
    Share
  • ছন্দের বন্দি : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


    দুপুর বেলা খাওয়ার পর ভাতঘুম দেবার তাল করছি, এমন সময় পচার ফোন, “সিধু, মহা কেলেংকারি হয়েছে।”

    পচাকে এত টেনসান খেতে কখনও দেখিনি, জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে রে?”

    পচা বলল, “মেসেঞ্জারে সদ্য বন্ধু হওয়া এক বঙ্গললনা, নাম প্রীতি… মেসেজ করেছে, ‘একটু ভালবাসা পাই কোথায় বলতে পারেন?’।”

    আমি আঁতকে উঠলাম, “সে কী রে? তা কেসটা কী? তুই রিকু দিয়েছিলি না নিয়েছিলি?”

    পচা বলল, “নিয়েছিলুম। দেখলুম, টাইমলাইনে ভালমন্দ খাবারের ছবি পোস্টিয়েছে…”

    আমি বললাম, “পেটুক আর কাকে বলে! অমনি টপ করে রিকু একসেপ্ট করে নিলি! এখন ভালবাসা একসেপ্ট কর।”

    পচা কাতর গলায় বলল, “কী করি বল তো?”

    এসব জটিল প্রশ্ন উঠলে আমি সাধারণত নার্ভাস হয়ে যাই। এ সব ক্ষেত্রে বঙ্কুদাই ভরসা। বললাম, “দাঁড়া, বঙ্কুদাকে ডাকি।”

    সৌভাগ্যক্রমে বঙ্কুদাকে কনফারেন্স কলে পাওয়া গেল। সব শুনেটুনে বঙ্কুদা বলল, “আর একবার দেখো তো, ‘ভাল’ আর ‘বাসার’ মধ্যে কোনও গ্যাপ আছে কি না।”

    পচা দেখে বলল, “তা আছে।”

    বঙ্কুদা বলল, “তা হলে চিন্তা নেই, এ সেই অবাক জলপান কেস।”

    আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “যাক, তবে তো মিটেই গেল। কোনও ভাল ব্রোকার চেনা থাকলে তার মোবাইল নাম্বার পাঠিয়ে দে।”

    পচা বলল, “আচ্ছা, দেখি…”

    ফোন ধরেই খুটখাট করে মেসেজ পাঠাল পচা।

    বঙ্কুদা বলল, “পচা, নতুন কোনও কবিতা-টবিতা লিখলে নাকি?”

    পচা সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, “বোঝো কাণ্ড!”

    আমি বললাম, “কী হল আবার?”

    পচা বলল, “মেয়েটা জবাব দিয়েছে, ব্রোকার দিয়ে কী হবে? ঢং! বাড়ি খুঁজছি নাকি? সঙ্গে একটা রাগী-রাগী লালমুখো ইমোজি।”

    বঙ্কুদা বলল,

    “জলপাই নয় ভাই, ইনি সেই জল
    খুঁজছেন, যাকে ছাড়া জীবন অচল।”

    পচা ভয়ার্ত গলায় বলল,

    “বল কী হে বঙ্কুদা, জলপাই নয়
    আদতে এ গল্পটা ছল-জলময়?”

    আমি বললাম, “বেড়ালের 'বে', ঘটকের 'ঘ' আর রুমালের 'র'... এই তিন মিলে বেঘোরে মরবি পচা, খামোখা আগ বাড়িয়ে জল-ফল দিতে যাস না।”

    পচা বলল, “জল দিলে কী ফল হবে জানি না। সেসব দিকে যাচ্ছি না। কিন্তু ব্যাপারটার তো একটা বিহিত করা দরকার।”

    আমি বললাম, “তা ঠিক।”

    বঙ্কুদা চুপ করে ছিল। হঠাৎ বলল, “বলছিলে না মেয়েটি রাঁধতে ভালবাসে। রকমারি রান্নার ছবি সাঁটায়? আমার মনে হচ্ছে, তোমার ছল-জল-ছন্দ সেই রন্ধন-পটীয়সীর জন্য নয়। অন্য কিছু না, সে ভেটকির ভাইপো বাসা মাছের খোঁজ করছে। আজকাল ভেটকি মহার্ঘ, সবাই বাসা দিয়েই কাজ চালায়। হোটেল রেস্তোরাঁ যেখানেই যাও ফিস-এন-চিপ্সের অর্ডার দিলে আলু ভাজার সঙ্গে বাসা মাছ ভেজে দেয়। তুমি বরং কোনো অনলাইন মার্কেটিং, যারা মাছ-মাংস বিক্রি করে তাদের ঠিকানা পাঠিয়ে দাও।”

    আমি বললাম, “এটাও একটা সম্ভাবনা বটে। রুই-কাতলা খেয়ে মুখ পচে গেছে। বাজারে ইলিশ দুষ্প্রাপ্য। মানুষ এখন বাসা-ফাসাই খাচ্ছে। পচা তুই চেক করে দেখ বাসা ভাজাভাজিতে চিঁড়ে ভেজে কি না।”

    পচা আবার খানিকক্ষন খুটখাট করে উল্লসিত হয়ে বলল, “বঙ্কুদা, তুসি গ্রেট হো, সাধে কি তোমায় গুরু মানি!"

    আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “বাঁচালি। এই জন্যেই রবি ঠাকুর লিখে গিয়েছিলেন, ‘জেনো, বাসনার সেরা বাসা... রসনায়’।”



    আবার সেই হারুর চায়ের দোকান। আমাদের চিরাচরিত প্রভাতী ঠেক। বঙ্কুদা আজ বৌদিকে ম্যানেজ করে উপস্থিত।

    পচা বলল, “বঙ্কুদা, কবিতা-টবিতা আজকাল আর কেউ পড়ে না, ভাবছি গল্প লিখব।”

    বঙ্কুদা বলল, “টবিতা পড়ে না মানছি, কিন্তু কবিতাও কি পড়ে না?”

    পচা বলল, “হেঁয়ালি রাখো। গল্প লেখার ফান্ডা দাও দেখি। এমন গল্প যা পত্র-পত্রিকায় পাঠালেই ছাপা হবে।”

    বঙ্কুদা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “শোনো তবে, আধুনিক বাংলা গল্প লেখার সহজ উপায়।

    গল্প মানেই থাকতে হবে শ্মশানচারী তান্ত্রিক
    জায়গা হবে গঞ্জ-গাঁয়ে নদীর ধারে প্রান্তিক।

    অন্ধকারে স্কন্ধকাটা ধরবে চেপে কন্ঠ
    মন্দ হাওয়ায় জ্বলবে দাওয়ায় টিমটিমিয়ে লন্ঠন।

    নায়ক কিন্তু আসবে ট্রেনে শহর থেকে ডাইরেক্ট
    ভাঙতে হবে ক্রনোলজি, মাথায় রেখো ভাইরে।”

    পচা মাথা চুলকে বলল, “সময়-টময় ভাঙা পরিশ্রমের কাজ। হামানদিস্তে লাগে। আমার দ্বারা কি হবে? অন্য ব্যবস্থা নেই, ঝট করে একটা গল্প নামানোর?”

    বঙ্কুদা বলল, “কেন থাকবে না? তবে...

    বছর খানেক লাগবে সময় করতে গেলে মস্কো
    তার চে' অনেক সহজ ভায়া পারলে হতে তস্কর।

    বদলে দেবে নাম ঠিকানা, হেয়ার স্টাইল, জেন্ডার
    প্লটের ঠেলায় নিয়ম ভেঙে ক্লায়েন্ট হবে ভেন্ডার।

    পড়লে ধরা নিন্দে হবে, নইলে মহাবিদ্যা
    ধন্য ধন্য করবে সবাই, লেখায় হবে ফিদ্দা।”

    পচা ভুরু কুঁচকে বলল, “ফিদ্দা আবার কী?”

    বঙ্কুদা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, “অন্ত্যমিলের চাপে দ দ'য়ে পড়েছে। ওই নিয়ে ভেবো না।”

    পচা বলল, “বঙ্কুদা, তুমি ছন্দ অন্ত্যমিল নিয়ে থাকো। তোমার মেথডে হবে না। আমি বরং চ্যাটজিপিটি করে দেখি একখানা ঝিনচ্যাক গল্প নামানো যায় কি না।”

    বঙ্কুদা বলল, “বুলস আই। গত বছরের অধিকাংশ শারদীয় সংখ্যার গল্পগুলো ওই ভাবেই লেখা। তবে চ্যাটজিপিটির বাংলা ভার্সন বাজারে বোধহয় এখনও আসেনি। ইংরাজিতে লিখে গুগল ট্রান্সলেট করে নিও। প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা সবাই তাই করেছে।”

    বঙ্কুদা যে এত হাই-টেক জানা ছিল না।



    আমি বললাম, “বঙ্কুদা, গল্প থাক। তুমি অন্ত্যমিলের ব্যাপারে আর একটু খোলসা করে বলো।”

    বঙ্কুদা বলল, “দেখো বাপা, অন্ত্যমিল-যুক্ত কবিতা লিখতে হলে ছন্দে কবিতা লিখতে হয়। আমি ছান্দসিক হতে বলছি না। তবে যারা কবিতা লিখতে আসছে তাদের বলি, বাংলা ছন্দের বেসিকগুলো জেনে রাখা আবশ্যক। অন্ত্যমিলের কবিতায় ছন্দচ্যুতি হলে খামোখা কান কটকট করে।”

    পচা হেসে বলল, “সামাজিক মাধ্যমের কবিতা পড়লে তো তুমি তাহলে কালা হয়ে যাবে।”

    বঙ্কুদা যথারীতি পচাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, “কালা হব কী গোরা হব জানি না। তবে অন্ত্যমিলেরও বিভিন্ন স্কীম আছে। পরপর দুটি লাইনের শেষে, অল্টারনেট লাইনের শেষে ইত্যাদি প্রভৃতি। তাই বলে এখুনি দড়াম করে সনেট লিখতে বসে যেও না। অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।”

    পচা অসন্তুষ্ট গলায় বলল, “আমায় খোঁটা না দিলে কি তোমার ভাত হজম হয় না? যারা ছন্দে লেখে তাদের আমার খোঁটায় বাঁধা ছাগল মনে হয়।”

    আমি ঘাড় নাড়লাম, “পচা, খোঁটা উপড়ে যারা ঘাস খেতে যায় তাদের অনেক সময় বাঘে ধরে। সেটা তো মানবি?”

    বঙ্কুদা লেকচার থামাল না। বলল, “অন্ত্যমিলের নিয়ম হল শেষ বর্ণের আগের বর্ণটির গায়ে যে স্বরটি লাগে সেটি এক হওয়া জরুরি। মানে, ছাগল বা মেষ যতই ঘাস খেতে পছন্দ করুক শব্দ হিসেবে মেষের সঙ্গে ঘাসের অন্ত্যমিল নেই। তেমনি মেঘ ডাকলে যতই ব্যাঘ্র-গর্জনের মত শুনতে লাগুক না কেন, মেঘের সঙ্গে ঘুণাক্ষরেও বাঘের মিল দিতে যেও না। পচা, তোমার বাহ্যে পেলে সহ্য না হলেও ওই দুটো শব্দ আগে পিছে ওপর নিচে বসবে না।”

    পচা হাত উলটে বলল, “বঙ্কুদা আমি ছন্দের বন্দি হয়ে থাকতে চাই না।”

    বঙ্কুদা উদাস গলায় বলল, “ছন্দমুক্তি, অন্ত্যমিলের থেকে নিষ্কৃতি বহু জন্মের সাধনার ফসল। সেসব তোমার জন্য নয়।”



    পচার এক বন্ধু... ভাল নাম অনন্ত, ডাক নাম নন্তু, মুম্বাইতে থাকে, সেখানেই চাকরি-বাকরি করে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। কবিতা লেখায় ভয়ানক উৎসাহ। আমরা কবিতা-টবিতা নিয়ে কথা বলি শুনে আমাদের চায়ের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। পচা চায়ে সুরুত করে চুমুক দিয়ে বলল, বাঙালির মাথা থেকে কবিতা বার করে নিলে মহাশূন্য ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকে না।

    আমি বললাম, “তা আর বলতে!

    কবিতাবিহীন বাঙালি... অনেকটা যেন
    ঘরে ছাদ নেই, তবুও মশারি টাঙালি?”

    বঙ্কুদা বলল, “বাপা, তুমি কি মধ্যমিল দেওয়ার চেষ্টা করলে?”

    আমি বললাম, “মধ্যবিত্ত বাঙালি, যেখানে সুযোগ পাই সেখানেই টেনেটুনে মেলাবার চেষ্টা করি, এই আর কী?”

    বহু বছর মুম্বাইতে থাকার ফলে নন্তুর কথায় মাঝেমধ্যে হিন্দি ঢুকে পড়ে। সে অর্ধেক বুঝে বলল, “এতে পরেশান হবার কী আছে? এই আমাকেই ধরো না, এতদিন কলকাতা ছাড়া, তবু কবিতা আমার জীবনে অনেক মাইনে রাখে।”

    বঙ্কুদা আঁতকে উঠে বলল, “অ্যাঁ, আজকাল কবিতা লিখে লোকে মাইনেও পাচ্ছে নাকি?”

    পচা বলল, “আঃ! বঙ্কুদা! কী আন শুনতে ধান শুনছ! কথা হচ্ছে বাঙালির কবিতা-প্রীতি নিয়ে।”

    আমি বললাম, “অথবা প্রীতির কবিতা নিয়ে।”

    ক’দিন আগে মেসেঞ্জারে প্রীতি নামের একটি বঙ্গ-ললনার সঙ্গে পচার বন্ধুত্ব হয়েছিল, আগেই বলেছি। বাসা এপিসোডের পরে দু’-চারটে সুললিত বাক্য বিনিময়ও হয়েছিল। সে একদিন একখানা স্বরচিত কবিতা পাঠিয়ে পচার মতামত জানতে চায়। বঙ্কুদার সাহচর্যে থেকে পচার আজকাল ছন্দজ্ঞান বেড়েছে। দোষের মধ্যে পচা প্রীতির কবিতার ছন্দে সামান্য কিছু ত্রুটির হদিশ দিয়ে ফেলে। ফলত ব্যাপারটা সেখানেই ঘেঁটে যায়। খবরটা বঙ্কুদার অজানা ছিল। জিজ্ঞেস করল, “প্রীতি কে?”

    আমি কিছু বলার আগেই পচা আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “ওসব অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ থাক না।”

    বঙ্কুদা বলল, “তা থাক। কিন্তু একটু আগে কবিতা-প্রিয় বাঙালিদের নিয়ে কী যেন বলছিলে?”

    পচা মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছিল। মুখ তুলে বলল, “শুনবে? শোনো তাহলে।

    রুশ-ইউক্রেনে যুদ্ধ বাঁধলে আমি লিখে ফেলি কবিতা
    বৌ আধা ভাত সিদ্ধ রাঁধলে আমি লিখে ফেলি কবিতা
    নদীতীর ধরে মুগ্ধ হাঁটলে আমি লিখে ফেলি কবিতা
    চোনা পড়ে হায় দুগ্ধ ফাটলে আমি লিখে ফেলি কবিতা
    দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়লে আমি লিখে ফেলি কবিতা
    ভারতের কাছে লঙ্কা হারলে আমি লিখে ফেলি কবিতা
    নীল আসমানে পাখিরা উড়লে আমি লিখে ফেলি কবিতা
    বন্ধ ঘরেতে মানুষ পুড়লে আমি লিখে ফেলি কবিতা,”

    একটু থেমে যোগ করল,

    “বাঙালি যখন, কবিতা লেখায় জন্মসিদ্ধ অধিকার
    আটকাবে কোন শ্যালকের ব্যাটা?
    বন থেকে বেঁধে এনেছি স্বর্ণ গোধিকা।”

    বঙ্কুদা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “এ তো লিস্টি কবিতা। যদি অবশ্য একে কবিতা বলা যায়! মধ্যমিলের কিছু অক্ষম প্রয়োগও যেন দেখতে পেলাম। কার লেখা?”

    পচা মুচকি হেসে বলল, “আজকাল সব কবিতা একজন কবিই লেখে – সংগৃহীত।”

    নন্তু একটু দোনামনা করে বলল, “শেষ লাইনদুটোর মিলটা যেন কেমন খাপছাড়া। তাছাড়া শেষ শব্দটার মানেও ঠিক বুঝলাম না। কী যেন বললে, গদি কার... না কী? ইজ ইট রাজনৈতিক?”

    বঙ্কুদা বলল, “রাজনৈতিক কি না জানি না। তবে বাপা এসব বুঝতে গেলে তোমায় মঙ্গল কাব্য পড়তে হবে। বিষয়টা জটিল। তোমার বোধগম্য হবে বলে মনে হচ্ছে না। আর যে মিলের কথাটা বললে সেটা সাদামাটা অনন্ত-মিল নয় বলে তুমি চট করে ধরতে পারলে না। আজ সময় কম। অন্ত্যমিল না অনন্ত্যমিল, খাপছাড়া না খাপখোলা, পরের বার যখন আসবে বুঝিয়ে দেব।”

    আমি বললাম, “বঙ্কুদা, যতই পরিহাস করো, বাঙালি হিসেবে বাঙালির কাব্যচর্চা নিয়ে আমি গর্বিত।”

    বঙ্কুদা উঠে পড়ল, মনে হল রাগ হয়েছে, বলল, “তবে আর কী! ওই গর্ব নিয়ে গার্গল করো গিয়ে। গলা সাফ হবে।”


    নন্তু মুম্বাই ফিরে গেছে। আমাদের তিনজনের আড্ডা হচ্ছিল বঙ্কুদার বাড়িতে। আকাশ কালো করে মেঘ জমেছিল। বৌদি পিঁয়াজি ভেজে এনে দিয়েছিল, সঙ্গে সবুজ চা। বঙ্কুদা ল্যাপটপ খুলে লো ভল্যুমে গান চালিয়েছিল। আমরা ‘ইয়াদ পিয়া কি’র সঙ্গে পিঁয়াজিতে কামড় দিচ্ছিলাম। চুকচুক করে স্বাস্থ্যকর চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। পচা উঠে গেল জানলা বন্ধ করার জন্য। পাল্লায় হাত রেখে বলল, “আরে বাঃ!”

    আমি বললাম, “কী রে, কী হল?”

    “শিল প-পড়ছে, দ‌-দেখে যা,” বেশি উত্তেজিত হলে পচা একটু তুতলিয়ে ফেলে। বঙ্কুদা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “শিল্প? কার মাথায় পড়ল?”

    “আরে না না। শিল পতিত হচ্ছে,” পচা সাধ্য মত সাধু ভাষায় ব্যাখ্যান করার চেষ্টা করল। বঙ্কুদা বিরক্ত হল, “পচা, শিল্প কি খাদ্যবস্তু? শিল্পের আবার তিতো মিষ্টি কী?”

    আমি পচার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম সাদা-সাদা নুড়ি পাথরে সামনের চত্বরটা ঢেকে গেছে। পচা বলল, “আরে বাবা, শিল্প নয়, শিল। যাকে বলে শিলা। জল ঠান্ডায় পাথর হয়ে টুপটাপ খসে পড়ছে।”

    বঙ্কুদা বলল, “ও পাথর, তাই বল। ভাগ্যিস... মাথায় শিল্প পড়লে সে ভারী সাংঘাতিক কাণ্ড হত।”

    পচা বলল, “বঙ্কুদা, তুমি কিন্তু দিনদিন সিনিক্যাল হয়ে যাচ্ছ।”

    আমি ধুয়ো ধরলাম, “এমন করলে শিল্পোদ্যোক্তারা তোমায় ‘ছিঃ, নিকাল’ বলে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেবে।”

    বঙ্কুদা বলল, “তোমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা দোক্তা দিয়ে পান খাক। আমি মঞ্চে উঠলে তো নামাবে!”

    আমি বললাম, “বঙ্কুদা, তুমি কি শিল্প-সংস্কৃতির মঞ্চ চাও না?”

    পচা বলল, “বঙ্কুদার ধারণা সংস্কৃতি মানেই কৃতী সংদের নাম সংকীর্তন।

    মঞ্চ তো নয় মালঞ্চ

    সেখানে সবাই পালং চোর।”

    পচার কথায় আমি একটু আঁশটে গন্ধ পেলাম, বললাম, “এর মধ্যে আবার খাট-পালঙ্ক কোথা থেকে এসে পড়ল?”

    পচা রহস্যময় হাসল। বলল, “সে তুই বুঝবি না।”

    বঙ্কুদা বলল, “না বাপা, মঞ্চ চাই না, শুধু মন চাই।”

    পচা বিমর্ষ গলায় বলল, “সে তো আমিও চাই, কিন্তু দিচ্ছে কে?” তার গলা শুনে মনে হল সেই রন্ধন-পটীয়সী বঙ্গ-ললনা প্রীতিলতাকে সে এখনও ভুলতে পারেনি।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments