[মূল উর্দু গল্পটি পাওয়া গেল দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত জ়কিয়া মশহদির গল্প সংকলন ‘মুনতখব আফসানে’ (পৃ ৮৯–১০১)-তে। এই গল্পের অনুবাদ প্রকাশের অনুমতি দেওয়ার জন্য আমি লেখিকার কাছে কৃতজ্ঞ। - অনুবাদক]
‘এই হারামজাদি, ভিখিরির বেটি! বাচ্চার বাহানা দিয়ে আর কতকাল ওখানে বসে থাকবি? বাটি-বাসন কি তোর বাপ মাজবে?’
বাচ্চাকে আলতো চাপড় মারতে মারতে সরোজা হড়বড়িয়ে ভেতরে চলে গেল। তিন মাসের মহেশটা সবে ঘুমিয়েছে। পেট কামড়াচ্ছিল কি না কে জানে. দুপুর থেকেই অস্থির করছিল। তাকে কোলে নিয়েই সব কাজ করতে হচ্ছিল। শাশুড়ি তো মজায় হুঁকো গড়গড় করতে করতে সরোজার বাপের বাড়ির লোকদের স্তুতিবাক্যে ভরিয়ে দিচ্ছে – কেন তারা এত অলস মুখরা একটা কামচোরকে তাদের ঘরে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়েছে!
ভেতরে যেতে যেতে সরোজা একবার চোখ তুলে বাচ্চাটার দিকে চাইল। সে এখন একদম শান্ত। সন্ধে গাঢ় হয়েছে। ঘরে বাতি জ্বললেও বাইরে অন্ধকার নিঃশব্দতার রাজত্ব। বারান্দায় সরোজার খাটিয়াটা রাখা, তারই একদিকে গরু-মোষও বাঁধা থাকে। সামনে টাটির দরজা।
সদ্য মাটি-লেপা রান্নাঘরে পৌঁছে সরোজা বাঁশের টুকরিটা ওঠাল। ক্ষেতের আল থেকে তোলা বেথুয়া শাকে ভরে আছে। শাক বাছতে অনেক সময় লাগে। তারপরে ভালোভাবে যদি না ধোও তো বালিমাটি কড়কড় করবে। একদিন অল্প কাঁকড় দাঁতে পড়ায় শ্বশুর থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। উনুনে শাক চড়িয়ে রুটি পাকাতে হবে। কম সে কম পঁচিশটা রুটি আর লাল লঙ্কার চাটনি হবে। বাচ্চাটা শান্ত হয়ে ঘুমোলে নিশ্চিন্তে কাজ করা যায়। দুপুরে তো খুব মুস্কিল হয়ে গিয়েছিল – মোষের দানাপানি, ক্ষেতে কাজে ব্যস্ত মরদদের জন্য রুটি পাঠানো। শাক বেছে বাইরে হ্যান্ড পাম্পের কাছে যাওয়ার সময় সরোজা আবার এক নজরে বাচ্চাটাকে দেখল। এখনও ঘুমিয়ে আছে। হাত দুটো মুঠো করে – ছোট্ট পা দুটো ভাঁজ করে যেমন বাচ্চারা ঘুমোয়।
হা ভগবান, বাচ্চা যেন কিছু সময় এমনই শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকে! শাক ধুয়ে ফেরার পথে সরোজা মনে মনে এই প্রার্থনাই জানাল। তারপরে এগিয়ে গেল। উনুনের কাছে সবে পৌঁছেছে। হ্যান্ড পাম্পের পাশ থেকে ছায়ার মত কিছু একটা যেন লাফাল। গাঢ় হতে থাকা সন্ধের আঁধারের সঙ্গে তার গায়ের রঙ এমন মিলে গেছে যে অস্পষ্ট একটা নড়াচড়া ছাড়া আর কিছুই টের পাওয়া গেল না। অন্ধকারে কে যে চলে গেল! জাবর কাটতে থাকা মোষটা হঠাৎই মুখ বন্ধ করল। লেজ নাড়াও থেমে গেল – লেজটা যেন পাথরই হয়ে গেল। টপ টপ করে জল ঝরতে থাকা শাকের টুকরিটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে সরোজা ঘুরে দাঁড়াল। তার মায়ের মন তখন কু ডাকছে। আর ততক্ষণে সেই ছায়াটা বিজলির ঝলকানির মত দ্রুততায় বাচ্চাকে তার মজবুত চোয়ালের মধ্যে চেপে ধরে এক লাফে আঁধারে মিলিয়ে গেছে।
সরোজার প্রথম প্রতিক্রিয়াও যেন হল মোষের মত। কোনও ম্যাজিকে যেন সে চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই কানফাটা চিৎকার জুড়ে নড়তে থাকা ছায়াটা যেদিকে গেছে সেদিকে ছুট লাগাল – ‘বচোয়া কে বাবু – হামার বচোয়া – হায় রে দাইয়া – হামার বচোয়া......’
পাঁচুর প্রথম বাচ্চাটাকে পেত্নী পিছল পেরি উঠিয়ে নিয়ে গেছে। সকাল হতে না হতেই সারা গাঁয়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল।
হাড়গোড় সুদ্ধু মালাইয়ের লাড্ডুর মত চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে নিশ্চয়ই। গ্রামবাসী খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হলেও শিশুর লাশ মিলল না। শুধু এক জায়গায় যেমন তাবিজ বাচ্চাটার গলায় ছিল তেমন একটা তাবিজ পাওয়া গেল। তবে স্বয়ং পাঁচুও নিশ্চিত হতে পারল না সেটা তার বাচ্চার কি না। কারণ বোধহয় এই যে অমন তাবিজ গ্রামের অনেকেই পরত, কখনও মৌলবি সাহেব, কখনওবা রাম সনেহি ওঝার কাছ থেকে এনে। দুজনের দেওয়া তাবিজই দেখতে প্রায় একই রকম। কিছু তফাত থাকলেও কাদামাটি লেগে, জীবজন্তুর ক্ষুরে সে সব চিহ্ন তো মুছে গেছে।
তারপরে, চার মাসের মধ্যে একটার পর একটা আরও তিনটে বাচ্চাকে গ্রাম থেকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেল। ঘটনাচক্রে তিনটেই খোকা। লোকে বলতে শুরু করল পিছল পেরির নজর লেড়কাদের ওপর। সে গ্রামে তাদের বাঁচতে দেবে না।
হাঁ জি, খুকিদের কবে কে ক্ষতি করেছে? তারা তো সব বুকের ওপর উঠে নাচছে! এটা তো আমার তিন নম্বর। দুধ পুরো না মিললেও দিনরাত তো বেড়েই চলেছে। সাজপুরি চাচি বলতেন ‘নিউমোনিয়া হলেও তেমন ভোগায় না, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে।’ চাচির নামটা অমন কারণ তাঁর বাপের বাড়ি ছিল শাহজাহানপুরে। তিনি ছিলেন গ্রামের ভি.এল.ডব্লু। আর কড়া নির্দেশ ছিল গ্রামবাসী ছেলে আর মেয়ের মধ্যে যেন কোনও তফাত না করে।
সাজাপুরওয়ালি যেহেতু এই গ্রামের মানুষ ছিলেন না, তাই বোধহয় গ্রামবাসীরা তাঁর চরিত্রের নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গুজুর গুজুর করত। কেউ কেউ বলত তাঁর জিভটা কালো, তাঁর উল্টোপাল্টা কথার জন্যই মানুষের এই দুর্দশা। কিন্তু এদিকে এঁরা যখন বেটিদের শাপশাপান্ত করছেন, তখন ওপাশে বংশী কামারের ছ-বছরের মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেল।
কুমোরটুলিতে বাটি-ঘড়া পুড়িয়ে শক্ত করার জন্য বড় বড় ভাঁটি জ্বালানো হত। ভাঁটিগুলো রাতে যাতে না নেভে সে খেয়াল রাখতে বংশী বাইরে খাট পেতে শুত। তার মেয়েটা পরিবারে একটু বেশিই আদর পেত। প্রথম ছটি সন্তান পোলা কি না! খুকি বাপের সঙ্গে লেগে লেগে থাকত। মাঝরাতে উঠে বাপুর কাছে যাওয়ার জেদ ধরেছিল। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটনির পরে খুকির মা তখন ক্লান্তি আর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেয়ের পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘বাইরে গিয়ে মরগে যা, তোর বাপু ওখানেই শুয়ে আছে ভাঁটির পাশে।’ দুবলা-পাতলা মেয়েটা, ছবছর যে বয়েস বোঝাই যায় না। মনে হয় তিন কী চার। পাকা গমের সোনালি শিষের মত গায়ের রঙ। ঘুমে চোখ ডলতে ডলতে বাইরে খোলা জায়গায় এসেছিল। ঘন অন্ধকার হলেও ভাঁটির আগুন দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল। ভাঁটির বেশ কিছুটা আগে ছাউনির নিচে কতগুলো বড় বড় কাঁচা মটকা। পরদিন ভাঁটির আগুনে পোড়ানো হবে। কিন্তু মটকার পেছনে দুটো চোখও যে তখন জ্বলন্ত কয়লার মতই জ্বলছিল। প্রথম ভাঁটিটার কাছে এসেই খুকি কেঁপে উঠে ‘বা-আ-আ-পু’ বলে চিৎকার করতে চাইলেও মুখ থেকে ‘বা-’ বেরোনোর পরেই তার গলাটা যেন কিছুতে জোরে চেপে ধরল। তারপরে, নিঃশব্দে বিজলির বেগে জ্বলতে থাকা চোখদুটো অন্ধকারে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। মজার কথা হল খুকির মা বাকি রাতটা এই ভেবে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রইল যে বাচ্চি তো বাপের গলা জড়িয়ে বাইরে ভাঁটির পাশেই শুয়ে আছে।
খুকির অর্ধেক খাওয়া লাশটা বাঁশঝাড়ের পাশে পাওয়া গেল। সেই যে বাঁশঝাড়ে চুরেল ভূতের বাস বলে গাঁয়ের লোকে বলত।
বছর সাতেক আগে গ্রামের আহির রামবাবুর জোয়ান হাড্ডাগাড্ডা বউ ফুলমতীকে রামবাবুর শরিকরা মেরে বাঁশঝাড়ে পুঁতে দিয়েছিল। আহিরের ছিল পাঁচ বিঘে উর্বর জমি, তিনটে ভালো জাতের গাই। গরুগুলো নিয়মিত বাছুর বিয়োলে কী হবে, বিয়ের পরে বারো বছর কাটলেও ফুলমতী একটা ইঁদুরের বাচ্চাও গর্ভে ধারণ করেনি। রামবাবুর অবশ্য তা নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। সে সব কিছু ভগবানের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে নিজের ক্ষেত, গরু আর সুন্দরী বউকে নিয়ে দিব্যি ছিল। ওদিকে সম্পত্তির শরিকরাও তার সন্তান না হওয়ায় খুশি। শরিকদের ধান্দা আর নিজের খামতি আন্দাজ করে নিয়ে ফুলমতী জোর করে তারই ছোট বোনের সঙ্গে রামবাবুর বিয়ে দিয়েছিল। এই পাপের জরিমানা হিসেবে ফুলমতীকে ডাইনি বানিয়ে শরিকরা গ্রামের ওঝার সঙ্গে যোগসাজশে তাকে মেরে ফেলে। লাশটা বাঁশঝাড়ে পুঁতে দেয়। তারপরেই শরিকরা তো বটেই, পুরো গ্রামই ফুলমতীর ডাইনি হয়ে যাওয়ার আরেকটা প্রমাণ পেল। ফুলমতীর বোন গর্ভবতী হল – লোকে ধরে নিল ফুলমতীই তার বোনের পেটে এসেছে।
রামবাবুটা তো নপুংসক। গ্রামের বৈদ্য তো সে বিধান দিয়েই দিয়েছি। ওঝাও তাই বলেছে। প্রথম বউটা বারো বছর তার সঙ্গে শুলেও কিছু হয়নি। এখন সে মরার সঙ্গে সঙ্গেই তার ছোট বোন, যাকে ফুলমতীই সতীন করে এনেছিল, পোয়াতি হল কী করে? এক হতে পারে বাচ্চাটা রামবাবুর নয়। আর না হলে ফুলমতীই শরিকদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার জন্য বোনের কোলে এসে বসেছে। একদিন কোনও এক শরিকের বউয়ের মাথার মধ্যে ঢুকে ফুলমতীর পেত্নী বলে গেছে যে রামবাবু এতটাই বে-মরদ যে তার বীজ থেকে নাকি ঘাসও ফুটবে না, বাচ্চা তো দূরের কথা। আসলে ফুলমতীই তো বোনের পেটে এসে ঢুকেছে। এবারে মানুষ দেখুক! সে আবার জন্ম নিয়ে এক এক করে সকলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেবে!
গাঁয়ের লোক ষড়যন্ত্র করল। পরিকল্পনামাফিক পার্বতীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাঁশঝাড়ের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে একটা মোটা বাঁশকে মাঝখান থেকে চিরে ফাঁদের মত বানানো হয়েছিল। কাটা বাঁশের দুটি ফালির মধ্যে আঠারো বছরের রোগা পাতলা পোয়াতি মেয়ের গলাটা ভরে দিয়ে ফাঁদের দুদিক ধরে এত জোরে ঠেলা হল যে মেয়েটার চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে এল। সে তখন ত্রাস আর আতঙ্কের প্রতিমূর্তি যেন! আর চোখদুটো তার যেন এই প্রশ্ন করে চলেছে…কেন? …কেন?
চেরা বাঁশের সঙ্গে সেই বাঁশঝাড়ে একটা বড় গর্তও খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। ফুলমতীর পাশেই পার্বতীকেও গোর দেওয়া হল। রামবাবু আধপাগলের মত হয়ে গেল। দুধভর্তি গরু দোয়ানোর বদলে বাঁশঝাড়ের আশপাশে সে তখন ঘুরে বেড়ায়। সেখানে বাঁশির সুরে গান আর কোনও শিশুর আধো আধো স্বরের কলকল শুনতে পায়। শিশুটিও মাঝে মাঝে বলে…কেন?…কেন?….কেন?
আর কেউ কখনও তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সাহস করেনি। সম্পত্তির শরিকরা আশপাশের গাঁয়ের মানুষদের এত্তেলা দিয়েছিল কেউ রামবাবুর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে হয় পেত্নী এসে তাকে মেরে ফেলবে অথবা তার কোল আলো করে কোনও পেত্নীর জন্ম হবে। এখন তো দুই ভূতে মিলেছে – রামবাবুকে তো তারাই পাগল বানিয়েছে!
বাঁশের মধ্যে দিয়ে হাওয়া বইলে মনে হত যেন কেউ কাঁদছে। এখন তো আরও কেউ কেউ নাকি সেখানে বিলাপের গীত শুনতে পাচ্ছে – মহরমের সময় যেমন শোকের গান শোনা যায়। ফুলমতী গান শুরু করলে কিছুক্ষণ পরে পার্বতী খেই ধরে – ঠিক যেন শোকগাথা গাওয়া বিলাপকারীর দল। ঠিক তখনই কোনও কোকিল 'পিউ কাঁহা' বলে ডেকে ওঠে আর বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষের কান খাড়া হয়ে যায়। ধীরে ধীরে গাঁয়ের মানুষ বাঁশঝাড়টাকে এড়িয়ে তার দশ হাত দূর দিয়ে চলা শুরু করল। মেয়েরা তো সন্ধে নামলেই আর ওমুখো হত না। আর এবারে তো সেই বাঁশঝাড়েই বংশী কুম্ভকারের শীর্ণ ছোট্ট মেয়েটার আধ খাওয়া লাশটা মিলল।
শাঁকচুন্নিরা যেন বেশ উঠেপড়ে লেগেছে!
ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের চিন্তাভাবনা কিছুটা অন্যরকম ছিল। এত বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছিল যে খবরের কাগজ আর টিভি-তে হৈচৈ শুরু হতে সরকারি টিম গাঁয়ে চলে এল। দুজন শিকারিও সে দলে ছিল। তারা নেকড়ে চেনে। কিন্তু গরু খোঁজা করেও গ্রামে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কোনও নেকড়ে দেখা গেছে এমন রিপোর্ট পাওয়া গেল না।
গ্রামে বুড়োর বুড়ো তস্য বুড়ো আল্লাদিয়া জানাল সে যখন ছোট, তখন গাঁয়ে নেকড়ে আসত। এত ভেড়া, ছাগল আর মুরগি লোপাট হত যে কিষানরা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। নেকড়েগুলো অবশ্য তখনও মানুষের রক্তের স্বাদ পায়নি, কিন্তু পোষা জন্তুজানোয়ারের এমন লোকসান হয়েছিল যে নেকড়ে মারতে পারলে চল্লিশ টাকা পাওয়া যাবে বলে অফিসার কথা দিয়েছিল। সেকালে সেটা অনেক টাকা। আল্লাদিয়ার বড় চাচা আল্লারাখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে ছিল। সাপ্লাই লাইনে কাজ করলেও তার বন্দুক চালানোর ট্রেনিং ছিল। রিটায়ার হলে কী হবে স্বাস্থ্যও মজবুত। সাহসও ছিল। চারটে নেকড়ে মেরে তিনি রেকর্ড করেছিল।
‘একসঙ্গে চারটে?’ কেউ খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘না, না, একটা একটা করে, মাঝে মাঝে এক-দুমাসের তফাত ছিল।’ প্রত্যেক বার পুরস্কার মিলেছিল। তখন আশি টাকায় এক তোলা সোনা পাওয়া যেত। তিনি ইনামের টাকায় বুড়ো বয়েসে চাচির জন্য কানের বড় বড় ঝুমকো দুল গড়িয়ে দিয়েছিলেন। নেকড়ের গায়ে পা রেখে ছবিও তুলেছিলেন।
চার নম্বর নেকড়েটাকে মারার পর তো ডেপুটি কমিশনার সাহেব তার সঙ্গে হ্যান্ডশেকও করেছিলেন।
‘সে ছবি কি আছে আপনার কাছে?’ এক শিকারি প্রশ্ন করেছিল।
টিমের নেতা তাকে থামিয়ে বলল, ‘ইয়ার কাম কি বাতেঁ করো!’ নেতা আবার ক্লাস-টু সরকারি অফিসার!
‘সে ছবি তো চাচি একদিন রেগে গিয়ে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।’ বয়স্ক চাচির রাগের কারণের ওপর আল্লাদিয়া সবিস্তারে আলোকপাত করতে যাবে, এমন সময় তাকে হাতের ইশারায় থামানো হল।
‘এটা বলুন এর পরে আবার কবে নেকড়ে দেখা গিয়েছিল!’
‘সন সাতচল্লিশে দাঙ্গাহাঙ্গামা কিছু লেগেছে। সে সময় পরিবেশটা তো তেমনই ছিল। পরে মালুম হল যে নেকড়ে ঢুকেছিল। তারপরে আর কোনও খবর নেই।’
ততক্ষণে গ্রামবাসীরাও এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেছে। তার ভেতরে মাঝবয়সী কেউ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তারপরে আমাদের সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়ে গেল। রাতে হল্লা শুনে অনেকেই ভেবেছিল আবার বোধহয় নেকড়ে ঢুকেছে। হামলাকারীরা এসে আরাম সে পঁচিশ-তিরিশ জনের গলা কেটে পগার পার। আমাদের এক চাচি তখন সদ্য বিয়ে হয়ে আসা কনে। সে কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছিল।’ বক্তার গলার স্বর বুজে এল, সে শান্ত হয়ে গেল।
‘মনে হচ্ছে আপনারা আমাদের কাজ করতে দেবেন না। হটে যান সব এখান থেকে। ভিড় হঠান!’ সরকারি অফিসার এত রেগে কথাটা বললেন যে লোকেরা ভয় পেয়ে গেল। যেন একটা নেকড়ে এসে তাদের মাঝখানে গর গর করছে।
‘হ্যাঁ, আপনি বলুন দেখি,’ অফিসার গলা নামিয়ে বয়স্ক একজনকে জিজ্ঞেস করলেন। ‘এর পরে আর কখনও কি জনবসতির ভেতরে নেকড়ে দেখা গিয়েছিল?’
‘না, সাহেব! সে অনেক যুগ হয়ে গেল…ওই সন সাতচল্লিশ আর পঞ্চাশের মধ্যে চল্লিশ টাকা ইনামের জন্য লোকেরা অনেক নেকড়ে মেরেছিল। জঙ্গলও সাফা হয়েছিল। দু-চারটে নেকড়ে যদি তারপরেও থেকে থাকে, তা হলে তারা দম বন্ধ করে হয় পালিয়েছে, অথবা গভীর জঙ্গলের ভেতরে হয়ত কোথাও গিয়ে আছে।’
‘দু-একটা কখনও সখনও হয়ত জঙ্গলের মধ্যে কাঠুরেদের চোখে পড়েছে। কিন্তু তারা বস্তির ভেতরে আসেনি।’
‘যদি থাকেও তো এখন আর আসবে কেন?’ আরেক জন কথা বলার ইচ্ছে চাপতে না পেরে বলে উঠল। শক্তপোক্ত কৃষ্ণবর্ণের লোকটির পরনে শুধু একটা খাটো ধুতি আর বেনিয়ান। স্থানীয় পূর্বী ভাষায় কথা বলছে। মানুষটার মুখে একটা কঠোর ভাব, গলার স্বরও রুক্ষ। দেরি না করে সে বলে চলল: ‘একটা কথা বুঝতে পারছি না চাচা আল্লাদিয়া। এই যে খোকাদের তুলে নিয়ে গেল, তা সে কুমোরটোলার হোক বা জেলেবস্তিরই হোক, মিয়াঁটোলার কোনও লেড়কাকে তো কখনও নেকড়ে মুখে করে নিয়ে যায়নি! ছাগল যে গেছে তাও তো গরীব বামুনি বুড়ির। তা এর কোনও জবাব কি আপনার কাছে আছে?’
‘বেটা, আমি তো এটা কখনও ভাবিনি যে নেকড়েরাও…’
‘আপনি কি কখনও নেকড়ে দেখেছেন চাচা?’ সে কথার ওপর কথা বলে।
‘দেখা তো নহিঁ বটোয়া ভগীরথ, কিন্তু দেখে তো সাফ মনে হচ্ছে এসব নেকড়েরই কাজ, তাই না?’
‘উঁহু, আমার কথাটার জবাব দিন। নেকড়ে মেরেছে না আর কেউ সে সিদ্ধান্ত তো এখনও হয়নি।’
‘তোমার কথার কী জবাব দেব? এসব চিন্তা তো তোমার মাথাতেই এসেছে!’
‘আপনি আর কেন ভাবতে যাবেন,' এই বলে ভগীরথ এমন বাঁকা হাসি হাসল আর তেরছা নজরে চাইল যে বুড়ো আল্লাদিয়া প্রথমে তো মাথা চুলকোতে রইল। তারপরে ভগীরথ টিমের উদ্দেশে বলল, ‘আপনারা সব ধরনের ছানবিন চালিয়েছেন। জঙ্গল থেকে তিন ক্রোশ পথ পেরিয়ে কেউ ধর্মেন্দ্র মিশিরের বকরিটাকে খোঁটা উপড়ে তুলে নিয়ে গেছে। তা হলে দেখুন, জানোয়ার যে নিয়ে যাচ্ছে সেগুলোও তো আমাদেরই সম্প্রদায়ের মানুষের। শুনছি সেই ঘটনার পরদিন নাকি মনজুর মিয়াঁর ওখানে কাদের জন্য ভোজের আয়োজন হয়েছিল। পোলাও রান্না হয়েছিল। হাণ্ডিতে মাংসের ঝোলও হয়েছিল।’
‘দেখুন, আপনি তো অন্য কথা বলতে শুরু করলেন।' সরকারি টিমের কোনও একজন বলল। ‘এই গাঁয়ে নিজেদের মধ্যে শত্রুতা বা চুরিচামারি, বা খোঁটায় বাঁধা জানোয়ার খুলে নিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা আমাদের তদন্তের বিষয় নয়। আমরা তার চেয়ে বড় একটা সমস্যার সমাধানের জন্য এসেছি। এ গাঁয়ে লাগাতার বাচ্চা মারা পড়ছে।'
‘কিন্তু এখানে যে নেকড়ে নেই এটা সত্যি,' আরেক জন কেউ জোরের সঙ্গে বলল।
‘নেকড়ে না হলেও চিতা, প্যান্থার, হায়না…কিছু তো হবেই। আপনারা সাহায্য করলেই কিন্তু আমরা কাজ করতে পারব।'
‘চিতা, প্যান্থার এসব এখানকার জানোয়ার না। নেকড়ে বললে তাও মানা যায়। তবে গত পঞ্চাশ বছরে নেকড়ে গ্রামে ঢোকেনি।'
গাঁয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষাকেন্দ্র চালায় যে আশা, মিডওয়াইফের ট্রেনিং ছিল বলে গাঁয়ের মানুষ তাকে নার্স দিদি নামেই চেনে। প্রসবের সময় কেউ সাহায্য চাইলে সে চটজলদি হাজির হয়ে যায়। সেই আশা এর মাঝে বলে উঠল, ‘জঙ্গল কেটে সাফ হয়ে যাচ্ছে। বসতি গড়ে উঠছে। আগে এত পতিত জমিই বা কোথায় ছিল?'
ভগীরথ তার দিকে কটমট করে চেয়ে বিড়বিড় করল, ‘দু-চারটে অক্ষর কোনও মতে পড়তে পারলেই হয়ে ওঠেন পণ্ডিতাইন!' ভগীরথের কথাগুলো অবশ্য আশার কানে গিয়ে পৌঁছোল না।
আশা ভগীরথকে বড়ই ভয় পেত। সত্যি কথা বলতে কী যেখানে গ্রামের প্রবীণ মানুষরাও ভগীরথকে সমঝে চলে, সেখানে এই দরিদ্র মহিলার আর কতটুকু সামর্থ্য! সে নিঃশব্দে ঘোমটায় মাথা ঢেকে সেন্টারের দিকে সটকে পড়ল।
তিন-চারদিনের চেষ্টাতেও কোনও ফল মিলল না। শিকারিরা বন্দুক নিয়ে জঙ্গল ঢুঁড়ে বেড়াল। গাঁয়ের বাসিন্দাদের মধ্যে তল্লাশি চলল, দুর্ঘটনাস্থলের পরিদর্শনও হল। কিন্তু ভগীরথের সেই সহজ কথাটা – আল্লাদিয়া চাচার জাতের কোনও বাচ্চাকে কেন উঠিয়ে নিয়ে গেল না – সেটা গাঁয়ে ঢুকে পড়া নেকড়ের মতই তার হিংস্র দাঁত বার করে রইল – ফেনা বেরোনো মুখ নিয়েই যেন সে টহল দিচ্ছে। লোকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে এই নতুন বিষয়টা নিয়ে গুনগুন শুরু করল।
এক মহিলা জানাল সে অন্ধকারের মধ্যে মাঠে যাওয়ার জন্য নলখাগড়ার জঙ্গলের কাছে পৌঁছোতেই ঝোপের আড়াল থেকে একটা দীর্ঘ ছায়া লাফ দিয়ে বেরিয়েছিল। আওরত দিব্যি দিয়ে বলেছিল যে ছায়াটা দু-পায়ে লাফায় আর তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছিল কালো কাপড় জড়ানো।
‘লাজবন্তী বহিনের কথা ঠিক হলে তো এটা একদম পরিষ্কার যে সে কোনও বোরখা পরা মেয়েছেলেই দেখেছে।’
এবারে বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে এমন বোরখা পরা মহিলার গল্পও দিকে দিকে রটে গেল। কুমোরটুলি থেকে বেরিয়ে মুচিদের বস্তি হয়ে সে কাহিনি কায়স্থদের গ্রামে কিছুক্ষণ জিরিয়ে ঠাকুরদের বাগানের মধ্যে দিয়ে ব্রাহ্মণদের আমবাগানে ঢুকে আরামে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল!
ভোলা সিং বলল প্রথমে বাচ্চাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বোরখা পরা মহিলার কোনও সম্পর্ক বোঝা যায়নি। কিন্তু এখন এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে যে সে ভাবনাও মনে আসছে। সেদিন পঞ্চায়েতে মামলার শুনানি শেষে কবরস্থানের চার দেওয়ালের পাশ দিয়ে আসার সময় অন্ধকার হয়ে এসেছিল। নালা পেরিয়ে আসতে আসতে তো প্রায় রাতই হয়ে এল। নালার ওপারে মিয়াঁটোলা। সেখানে অনেক দূর থেকে যেন কারও হাসির আওয়াজ আসছিল। এতই ভয়ানক অমঙ্গলের হাসি যেন হায়না হাসছে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ে যে পাগলা মজিদও তো এভাবেই হাসে। সেই হবে। যখন এই ভাবছে এমন সময় এক বোরখা পরা মেয়েছেলে লাফাতে লাফাতে গলি থেকে বেরিয়ে পেছন দিকে যেখানে একটা পাকদণ্ডী ঠাকুরদের বাগানের দিকে নেমে গেছে, সেদিকে চলে গেল। বোরখার টুপিতে ঢাকা মাথাটা এদিক-ওদিক দুলছিল। মনে হচ্ছিল যে তার তাড়া থাকলেও আশপাশটা দেখতে দেখতে চলেছে। সে রাতেই ঠাকুরদের ক্ষেতে খড়ের ছাউনির নিচে খাটিয়ায় ঘুমিয়ে থাকা বলভদ্র পাহারাদারের ছেলেটাকে কেউ তুলে নিয়ে যায়। তার বাপ তখন একটু দূরেই পেচ্ছাপ করতে গিয়েছিল। বলভদ্র সাহস করে পেছনে দৌড়তেই কালো ছায়াটা আঁধারে অদৃশ্য হয়ে যায়। কুড়ুল আর লোহার রড নিয়ে যুবকেরা এদিক-ওদিক দৌড়লেও পোলাটার কোনও খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।
তখন থেকে লোকেরা মিয়াঁটোলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ মেরে ইশারা করত অথবা সেখানে দুদণ্ড থেমে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলত। টোলার পড়শিরা দুশ্চিন্তায় পড়ল। কিছুদিন আগেই কবরস্থানের চার দেওয়াল নিয়ে ঝঞ্ঝাট শুরু হয়েছিল। অনেক কষ্টে বড় কোনও অঘটন এড়ানো গেছে।
ঠাকুরবাগানের বড় ঠাকরুন গুরুত্ব দিয়ে ভাবছিলেন যে তরকারি কোটা আর ওই ধরনের অন্যান্য ফাইফরমাশ খাটতে আসা ইসা বো-কে এবার ছাড়িয়ে দেবেন। তার আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন এসেছিল, যদিও ইসা বো-র ঘরে কেউ বোরখা পড়ত না। এরা সব রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে জমি নিড়ানো আর হাঁসুয়া নিয়ে অন্যের জমিতে কাজ করার মেয়ে। বোরখা তো বড় ঘরের আওরতের আয়েশের জিনিস। বোরখায় ঢাকা কোনও মেয়ের গল্প ইসা বো-ও শুনেছিল, শুনে আর সবার মত ভীষণ ভয়ও পেয়েছিল। সে নিজে বারান্দায় শোওয়া শুরু করেছিল, বউমা আর ছোট দুই নাতিপুতিকে ভেতরের একটি মাত্র ঘরে শুতে পাঠিয়ে। বউয়ের ওপর কড়া নির্দেশ যাতে ঘরের খিল লাগিয়ে শোয়। বেটা কানপুরের কাপড়ের মিলে কাজ করত। ইসা মিয়াঁ মরে গেছে তাও তো বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। ইসা বো কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে মিষ্টি কথার আর সময়ে অসময়ে তার বাচ্চাদের জন্য ফলফলাদি দেওয়া সেই ঠাকুরাইন হঠাৎই কেন এমন হয়ে গেল!
যে শিকারিরা বন্দুক নিয়ে শালের জঙ্গলে ঘোরে তারা সেই সময় একটা নেকড়ে মেরেছিল। গাঢ় বাদামি রঙের মোটাসোটা মাদী নেকড়ে। ডেরা থেকে নেকড়ের বাচ্চাদেরও পাওয়া গেল। তারাও তখন বেশ বড়সড়। নেকড়ের আস্তানায় যেসব হাড়গোড় ছিল সেগুলো এমনই ফুটিফাটা যে এক নজর দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। তবে আন্দাজ হচ্ছিল সেগুলো মানুষের বাচ্চারই অস্থি। হাড়গুলোকে থলেতে ভরে তদন্তের জন্য রাখা হল। নেকড়ের বাচ্চাদের চিড়িয়াখানায় পাঠানোর জন্য খাঁচায় কয়েদ করে রাখা হল। আর মাদী নেকড়ের শবটাকে গাঁয়ে ঘোরানো হল। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যে টিম পাঠিয়েছিল তারা তাদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে বিদায় নিলেও এই প্রশ্ন তখনও অনেকের মনেই ঘুরছিল যে কেন মিয়াঁটোলার একটাও বাচ্চাকে কেউ তুলে নিয়ে গেল না। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে। কে জানে এই মাদী নেকড়েটাই বাচ্চাদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কি না – আর তার ডেরা থেকে যে হাড়গোড় পাওয়া গেছে, সেগুলো মানুষের বাচ্চারই তো, নাকি খরগোশ, হরিণ বা সম্বরের বাচ্চার! সরকারি লোকদের আর কী যায় আসে – ফাইল বন্ধ করতে তারা যা খুশি তাই বলে দিতে পারে।
কয়েক হপ্তা পরে মনসা মালী এসে ঠাকরাইনকে জানাল অড়হরের ক্ষেতে গতকাল সন্ধে গাঢ় হতেই সে একটা কালো ছায়াকে লাফিয়ে যেতে দেখেছে। ভীষণ ভয় পেয়েছিল বলেই আর ফিরে তাকায়নি। সোজা নাক বরাবর তখনই ছুটে পালিয়ে বাগানের কুয়োর পাশে আসার পরই প্রথম দম ছাড়ার সুযোগ পায়।
ইসা বো তখন মাথা ঝুঁকিয়ে পাথরের চাকিতে মাষকলাইয়ের ডাল পিষছিল। তার আশা আজ নিশ্চয়ই ঠাকুরাইন পেষা ডাল কিছুটা তাকে দেবে। পেষা ডালের রুটির বেশ স্বাদ। পেটে অনেকক্ষণ থাকেও। কিন্তু ঠাকুরাইন তো পাষাণ হৃদয় বেপরোয়া মানুষের মত পেষা ডাল মটকায় ঢেলে রেখে ইসা বো-কে বলল, ‘কাল খোল আর মাড় মিশিয়ে গরুকে খাওয়ানোর সময় ডালটা ওর মধ্যে দিয়ে দিস।'
আরও মাস দুয়েক কাটল। এর মধ্যে কোনও বাচ্চা মরল না, কারও ছাগল-ভেড়াও কেউ তুলে নিয়ে গেল না। লোকে নেকড়ে নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা আর বলে না। কেউ কেউ তো নিশ্চিত ছিল যে তার বাচ্চাদের পেট ভরানোর জন্যই বাদামি রঙের মাদী নেকড়েটা মানুষের বাচ্চা মারছিল। তাও তো সে একটা জানোয়ার। মানুষও কী কখনও নিজের উদ্দেশ্য সাধনে তারই মত অন্য মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করে? রামবাবুর পাট্টাদারেরা তো তার দুই বউ, এমনকী বউয়ের পেটের বাচ্চাটাকেও মেরে ফেলেছিল, তাই না? কেউ কিছু বলুক বা নাই বলুক, পুলিশ কিছু করুক আর নাই করুক, ঘটনাটা কী সে তো সারা গাঁয়ের মানুষই জানত। আর অমন সুন্দরী যুবতীদের যদি অকালে মেরে ফেলা হয়, তা হলে তো তারা হয় ডাইনি নয় শাঁকচুন্নি হয়ে জন্মাবেই। এও গাঁয়ের সকলেই জানে।
অথচ সেই বাদামি মাদী নেকড়েটাকে মারার তিন মাস পরে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল।
গাঁয়ে পায়খানা খুব কম ঘরেই ছিল। মেয়েরা সাধারণত গাঢ় অন্ধকারে মাঠে ময়দানে প্রাতঃকৃত্য সারতে যেত। অনেকে তো মাঝরাতের পরে তারকাখচিত আকাশের নিচে কাজ সেরে আসত। সুখরাম পণ্ডিতের নতুন বউয়ের পেট খারাপ হওয়ায় সন্ধে নামতেই তাকে মাঠে যেতে হয়েছিল। রাত বারোটায় আবার পেটে ব্যথা শুরু হলে সে লজ্জায় পাশেই শুয়ে থাকা স্বামীকে ঘুম থেকে তোলেনি। সে তো আর বাচ্চা নয়। চাষীর ঘরের শক্তপোক্ত উনিশ বছরের মেয়ে। নিঃশব্দে যাওয়ার জন্য পায়েল আর চুড়িগুলো খুলে রেখে শাড়ি সামলে, নাকের নথটাকে ঠিক করে নিয়ে বউটা নলখাগড়ার ঝোপের পেছন দিকে চলে যায়। গা ছমছমে নিস্তব্ধতা, অথচ পূর্ণিমার রাত, মোহিনী জ্যোৎস্নায় নলখাগড়ার ঝোপ ঢেকে আছে। আসলে সেই চাঁদনিই মেয়েটার মনে কোনও ভয় ঢুকতে দেয়নি। অভ্যেসমত পাখির কলতানে যুবকের ঘুম ভাঙল। বউকে পাশে না পেয়ে ভাবল যে সে নিশ্চয়ই অন্ধকারেই ‘বাহ্যে ময়দানের’ উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু বউয়ের পায়েল আর চুড়ির গোছা বিছানার ওপর রাখা দেখে একটু আশ্চর্য তো হয়েছিল বৈকি। সূর্য পুরো ওঠার পরেও যখন বউ ঘরে ফিরল না, তখন লোকে দৌড়োদৌড়ি শুরু করল। নলখাগড়ার ঝোপের মধ্যে গাড়ুটা উল্টে পড়ে ছিল। একটু দূরে পাওয়া গেল বউটার লাশ – তার ঊরুর একটা বড় অংশ কেউ খুবলে নিয়েছে।
চাঁদনি রাতে কোনও প্রাপ্তবয়স্কের হত্যা এই প্রথম ঘটল।
‘নেকড়েটাকে তো মেরে ফেলা হয়েছে। তা হলে এটা কে?’
‘অন্য নেকড়েও তো হতে পারে।’
‘এদিকে তো নেকড়ের আস্তানা নেই,’ কেউ খুব রেগে বলল…‘সন সাতচল্লিশ-আটচল্লিশের পরে কখনও এ গ্রামে নেকড়ে ঢোকেনি।’
‘এবারেও নেকড়েরা সেই “আমাদেরই” ক্ষতি করল।’
‘হ্যাঁ, এটা ভাববার কথা বটে। আর কতদিন আমরা চোখ বন্ধ করে থাকব?’
‘হিংসার জবাব হিংসার মাধ্যমে দেওয়া উচিত। আমাদের, অর্থাৎ হিন্দুদের একটা বড় দুর্বলতা হল আমরা অন্যায় আর হিংসাকে অমৃতের মত গিলে নিই, একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেলি না।'
‘না জি, এবার তো জল মাথার ওপর দিয়ে বইছে। এই সরকারি লোকেরা কিছুই করবে না। নির্দোষ মাদী নেকড়েটাকে মেরে ফেলল। বেচারির ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে তুলে চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দিল। তারা সারা জীবন কয়েদি হয়ে কাটাবে। কী ঘোর অন্যায়! রাম, রাম, রাম!'
জোয়ান লেড়কিটার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে সারা গ্রাম একজোট হয়ে গেল। ইসা বো আশপাশেই কোথাও ছিল। মাথার ওপর উড়ানিটাকে সমান করতে করতে সে দার্শনিকের মত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘আমাদের আম্মা বলতেন খেলেও নেকড়ের দোষ, না খেলেও নেকড়েরই দোষ!'
‘এই বুড়িটার গলা তো প্রথম দিনই কেটে সমান করে দেওয়া উচিত ছিল। গত বছর রাম নবমীর শোভাযাত্রায় এর বেটা গুড়ের শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে রাম নাম, বগলে ছুরি। গ্রামের বৈঠকখানায় আমরা রোজ সন্ধেয় কাগজ পড়তে যাই। আমাদের গাঁয়ের বিষয়ে খবর বেরিয়েছে যে এখানে নাকি প্রতিবেশী দেশের গুপ্তচর এজেন্সির লোকেরা ঘোরাফেরা করছে। এই সব লোকেদের সাহায্যেই তো তারা গ্রামের ভেতরে ঢুকতে পারছে। না হলে তারা গ্রামে ঢুকবেই বা কীভাবে?'
ইসা বো এসব মালুম করতে পারে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা ডিটেকটিভ এজেন্সির সে কিছুই বোঝে না। বুদ্ধি যে কম ছিল তাই নয়, সে একটু কালাও তো বটে। কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরে নড়বড় করতে করতে নিজের কাজে চলে গেলেও মনের কোথাও অশান্তি রয়ে গেল। লোকেদের কথা সব না বুঝলেও তাতে এমন কিছু ছিল যা ইসা বো-র ভালো লাগল না।
তবে ইসা বো-র গলা কাটার পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণের আগেই আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আরও দুটো বাচ্চা নিখোঁজ হয়ে গেল – কিন্তু এবারে দুজনেই মিয়াঁটোলার।
আব্দুল গরমকালে মহুয়া তুলে আর শীতের মরসুমে পুকুরের কচুরিপানা সাফ করে চালাত। তার সাত-আট বছরের মেয়েটা মা আর তার দলবলের সঙ্গে ঘাস কেটে ফিরছিল। সেদিন মেয়েটার হালকা জ্বর। সন্ধে হতে জ্বর আরও বাড়ল। সে আস্তে চলছিল, আর বারবার ধীরে চলার জন্য মায়ের বকুনি খাচ্ছিল। অন্ধকার হয়ে আসছে, বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ। আম বাগানের কাছে আসতে হঠাৎই মেয়েটাকে কেউ পেছন দিকে টেনে ধরে। মেয়েরা সব পেছন ঘুরে সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার শুরু করলে জানোয়ারটা মেয়েটাকে ছেড়ে পালালেও গলা চেপে ধরায় আর ঘটনার আকস্মিকতায় প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সে মারা যায়।
পরদিনই মুখতারন বিবির ওপর হামলা হল, তাও সবাইকে আশ্চর্য করে দিনের বেলায়।
মুখতারন বিবি কোলে বাচ্চা আর মাথায় টুকরি নিয়ে পথ চলছিল। গাঁয়ে ভয়ের পরিবেশ রইলেও জীবন তো থেমে থাকে না। (ভয়ের কিছু নেই এমন জায়গাই বা এখন কোথায়?) তবে সেটা দিনের বেলা। জ্বালানির জন্য পাকদণ্ডী থেকে বেরোনো জানোয়ারদের গোবর তুলতে তুলতে মুখতারন বাঁশঝাড়ের কাছে চলে এসেছিল। হঠাৎ বাঁশঝোপ থেকে একটা মোটাসোটা জোয়ান নেকড়ে তার দিয়ে ঝাঁপায়। আর পলক পড়তে না পড়তেই কোলের বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। মুখতারন বিবির বাহু আর পাঁজরে গভীর ক্ষত হয়। সন্ধেবেলায় বাচ্চার শরীরের অংশবিশেষও পাওয়া যায় বাঁশঝাড়ের মধ্যে কয়েক ক্রোশ এগিয়ে একফালি পোড়ো জমিতে। এই প্রথম কেউ দিনের আলোয় হামলাকারীকে নিজের চোখে দেখল! তার পরিচয়ও জানা গেল। সে ছিল নেকড়ে, মাদী না মদ্দা তা তো এক মুহূর্তে বোঝা যায়নি। তবে এটা বলাই যায় যে বাস্তবিকই এক দারুণ সেকুলার নেকড়ে!
শুধু সেই বা কেন? নেকড়েরা তো সবাই সেকুলার। তারা কখনও শিকারের ধর্ম জিজ্ঞেস করে তুলে নিয়ে যায় না।