• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | গল্প
    Share
  • মুট্‌ঠি মালিশ مٹھی مالش : ইসমত চুঘতাই
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়

    [দূরদর্শনে ভয়ঙ্কর কোনও দৃশ্যের অবতারণার আগে যে ‘বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’ থাকে, ইসমত চুঘতাইয়ের এই গল্পটি পাঠকের সামনে উপস্থিত করার আগে তেমন কিছুর প্রয়োজন কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারলাম না। তবে আগেভাগেই সতর্ক করলাম।

    যার বাংলা করা হয়েছে, সেই মূল উর্দু গল্পটি পড়তে পেলাম আবদুল্লাহ্‌ অ্যাকাডেমি, আল-করিম মার্কেট, উর্দু বাজার, লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘ইসমত চুঘতাই কে আনমোল আফসানে’ (পৃ ৪১৫ – ৪২২) বইটি থেকে।]

    পোলিং বুথে খুব ভিড়, যেন কোনও ফিল্মের প্রিমিয়ার শো হচ্ছে। কিউ খুব লম্বা। পাঁচ সাল আগেও আমরা এমনই লম্বা লাইন লাগিয়ে ছিলাম – কে বলবে ভোট দেওয়ার লাইন না সস্তায় চাল-গম কেনার লাইন! মানুষের মুখে আশার আভাস, কিউ লম্বা হলেই বা কী, কখনও তো আমারও ডাক আসবে! আরেকটা কথা কী, টাকাপয়সাও পাওয়া যাবে ভালো। আমরা ভরসা রাখতে পারি এমন লোক। সৌভাগ্যের লাগামটা আমাদেরই কারও হাতে থাকলে সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে।

    ‘বাই, ও বাই, ভালো আছ তো?’ ময়লা রেশমি শাড়ি জড়ানো এক আওরত হলদেটে দাঁত বার করে আমার হাতটা ধরল।

    ‘ওহো, গঙ্গা বাই…?’

    ‘রতি বাই। সে গঙ্গা বাই আরেক জন। মরে গেছে বেচারি।’

    ‘আরে…বে…বেচারি…’ আমার মনটা যেন ডিগবাজি খেয়ে পাঁচ বছর পেছিয়ে গেল।

    ‘মালিশ না মুঠি?’ আমি শুধোলাম।

    ‘মালিশ,’ রতি বাই চোখ মারল। ‘শালিটাকে কত বারণ করলাম। শুনল না। তুমি কাকে ভোট দেবে বাই?’

    ‘তুমিই বা দিচ্ছ কাকে?’ আমরা একে অপরকে জিজ্ঞেস করি।

    ‘আমাদের জাতের লোককে – আমাদের গ্রামেরই আছে।’

    ‘পাঁচ সাল আগেও তুমি নিজের জাতের লোককেই দিয়েছিলে ভোট।’

    ‘হাঁই বাই, সে শালা তো কনডেম ছিল, কোনও কাজই করেনি।’

    রতি বাইয়ের মুখ ভার।

    ‘আর এও তোমারই জাতের।’

    ‘হ্যাঁ, তবে এ ফার্স্ট ক্লাস – হ্যাঁ – বাই দেখো, এ আমাদের জমিজায়গা ফিরিয়ে দেবে।’

    ‘তা হলে তো তুমি গ্রামে ফিরে গিয়ে ধান ঝাড়াই-বাছাই করবে?’

    ‘হাঁ, বাই,’ রতি বাই তার ঘোলাটে চোখগুলো পিট পিট করতে করতে বলল।

    **************

    পাঁচ বছর আগে হাসপাতালে আমার মুন্নিটা জন্মানোর সময় রতি বাই বলেছিল সে নিজের জাতের লোককে ভোট দিতে যাচ্ছে। চৌপাটিতে হাজার লোকের সামনে তার জাতভাই কথা দিয়েছিল সে এলেই সব পালটে দেবে। দুধের নদী বয়ে যাবে, জীবন থেকে মধু ঝরে পড়বে। আজ পাঁচ সাল পরেও রতি বাইয়ের শাড়ি তেমনই ছেঁড়াখোঁড়া, চুল আরও পেকেছে। চোখে আরও বিহ্বল ভাব। আজ আবার চৌপাটিতে দাঁড়িয়ে দেওয়া বক্তৃতা শুনে সে নিজের ভোটটা দিতে এসেছে।

    **************

    ‘বাই, তুমি ওই ছেনালটার সঙ্গে কেন কথা বল?’ বেডপ্যানটা সরাতে সরাতে রতি বাই তার পরামর্শ দেওয়ার দফতর খুলত।

    ‘কেন? ক্ষতিটা কী?’ যেন কিছু জানি না এমন ভাব দেখিয়ে প্রশ্ন করতাম।

    ‘বলেছি না ওই ছুকরিটা একদম খারাপ? শালি পাকা বদমাশ!’ রতি বাইয়ের ডিউটি শুরু হওয়ার আগে গঙ্গা বাইও তার ডিউটির মধ্যে আমাকে একই রায় শুনিয়েছিল। সেও বলেছিল রতি বাই একটা লোফার। হাসপাতালের এই দুই আয়ার মধ্যে সব সময় কচর-কচর লড়াই লেগেই থাকত। সে লড়াই কখনও সখনও মারপিটেও পর্যবসিত হত। তাদের সঙ্গে কথা বলে মজা পাওয়া যেত।

    ‘কী? ওই শালা শঙ্কর ওর ভাই নাকি? ও তো ওর ইয়ার! একসঙ্গে শোয়!’ গঙ্গা বাই বলেছিল। রতি বাইয়ের মিয়াঁ শোলাপুরের কাছে কোনও গ্রামে থাকত। অল্প জমিজমা, তবু তার জন্যই সেখানে থেকে গিয়েছিল। ফসল থেকে যা পাওয়া যেত তার সবটাই ধার শোধ করতে উবে যেত। সামান্য টাকাই আর আছে, তাও এবার গেল বলে! তারপরে সে নিজের বালবাচ্চার কাছে চলে যাবে, আর সেখানে মজায় বাকি জীবনটা ধান ঝেড়ে-বেছে কাটিয়ে দেবে। দুজনে গ্রামে ফিরে গিয়ে ধান কোটার স্বপ্নে বাই এমন বিভোর হল যেন প্যারিসে যাওয়ার খোয়াব দেখছে!

    ‘তা হলে রতি বাই, তুমি বোম্বেতে পয়সা কামানোর জন্য এলে কেন? যদি তোমার মিয়াঁ আসত তাও বুঝতাম।’

    ‘আরে বাই, ও কী করে আসবে? সেই তো চাষবাস করে। আমি কি আর ওসব সামলাতে পারি?’

    ‘আর বাচ্চাদের দেখাশোনা কে করে?’

    ‘সে একটা রাঁড় আছে আমার!’ রতি বাই দু-চারটে গালিও দিয়ে দিল।

    ‘তোমার মিয়াঁ আরেকটা বিয়ে করে নেয়নি তো আবার?’

    ‘আরে না! শালার দুটো করার হিম্মত আছে নাকি? এমনিই রেখে নিয়েছে।’

    ‘আর সে যদি তোমাকে আড়ালে রেখে আসল মালকিন বনে যায় তো?’

    ‘কীভাবে বনবে? মেরে তক্তা বানিয়ে দেব না? ভুসি ঠুসে দেব! ধারটা শোধ হলেই আমি সেখানে চলে যাব।’

    বুঝলাম যে রতি বাই নিজেই কোনও লাওয়ারিস মেয়েছেলেকে তার মিয়াঁ আর বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য রেখে এসেছে। ধার শোধ করে জমি ছাড়িয়ে নিতে পারলেই আবার গৃহিণী হয়ে ধান কোটার কাজ করতে ফিরে যাবে। আর সেই রক্ষিতার কী হবে? সে এমন আর কোনও মিয়াঁকে পেয়ে যাবে যার বিবি পয়সা কামানোর জন্য বোম্বাই এসেছে। যার ছেলেমেয়েকে দেখার কেউ নেই।

    ‘তার নিজের মিয়াঁ নেই?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    ‘তা আবার নেই!’

    ‘তা হলে সে স্বামীর কাছে থাকে না?’

    ‘ওর মিয়াঁর খেতজমি সব গেছে। জমিতে মজুর খাটে। আর বছরে আট মাস চুরি-চামারি করে চালায় বা বড় শহরে এসে ভিক্ষে করে চালায়।’

    ‘আর বাচ্চারা?’

    ‘তা আবার নেই! চারটা বাচ্চা তো আছে বা ছিল। একটা তো বোম্বেতেই হারিয়ে গেল। কেউ জানে না কোথায় গেল। ছুকরিগুলো ভেগে গেল। শুধু ছোটটাই সঙ্গে থাকে।’

    ‘তুমি গাঁয়ে কত টাকা পাঠাও, রতি বাই?’

    ‘এক আর চল্লিশ।’

    ‘তা হলে তোমার চলে কীভাবে?’

    ‘আমার ভাই সামলে নেয়। সেই ভাই যাকে নিয়ে গঙ্গা বাই বলেছিল যে ওর ফ্রেন্ড আছে!’

    ‘তোমার ভাইয়ের বালবাচ্চা?’

    ‘তা আবার নেই!’

    ‘তারা কোথায়? গ্রামে?’

    ‘হাঁ, পুনার পাশে একটা জায়গা আছে। ওর বড় ভাই সেখানে খেতি সামলায়।‘

    ‘অর্থাৎ তোমার বড় ভাই?’ আমি পেছনে লাগার জন্য শুধোলাম।

    ‘ধ্যাত! ওহ্‌ হামারা ভাই কাহে কো হোতা? কী বাই, তুমি কি আমাকে ছেনাল ভাবো? এ কী গঙ্গা বাই পেয়েছ নাকি? মালুম আছে চারটে দিনও সে পিটুনি না খেয়ে থাকে না। বাই, কোনও ফাটা পুরোনো কাপড়ও ওই বদমাশটাকে যেন দিও না! আমাকে দেবে, ঠিক আছে?’

    ‘রতি বাই!’

    ‘হাঁ বাই?’

    ‘তোমার ভাই তোমাকে মারে?’

    ‘শালা ওই গঙ্গা বাইটা তোমাকে বলেছে, তাই না? না বাই, বেশি মারে না। কখনও খুব খেয়ে নিল, তো হয়ত দু-এক ঘা দিল। তাতে কী, ভাই আদরও তো করে।’

    ‘ওহ্‌, ভালোও বাসে?’

    ‘বাসে না আবার!’

    ‘কিন্তু রতি বাই, তুমি ওই কমবখতটাকে ভাই বল কেন?’

    রতি বাই হাসতে লাগল। ‘বাই, আমাদের মধ্যে আমরা ওভাবেই কথা বলি।’

    ‘তা হলে রতি বাই, চল্লিশ টাকা যখন রোজগার কর, তখন আবার ধান্দা কেন কর?’

    ‘না হলে চালাব কী করে? যে ইঁদুরের গর্তটাতে থাকি তার ভাড়া পাঁচ রুপিয়া। তিন টাকা লালা নেয়।’

    ‘লালাকে কেন দাও?’

    ‘বস্তির সব মেয়েদেরই দিতে হয়, না হলে তাড়িয়ে দেবে।’

    ‘যে ধান্দা কর তার জন্য?’

    ‘হাঁ বাই।’ রতি বাই যেন লজ্জা পেল।

    ‘আর তোমার ভাই কী করে?’

    ‘বাই, সত্যিই এটা বলার কথা নয়। আসলে দারুর ধান্দা খুব নোংরা ধান্দা। যে পুলিশের পকেটে পয়সা ভরবে না, তাকে শহর ছেড়ে পালাতে হবে।’

    ‘তাই নাকি?’

    ‘হাঁ বাই!’

    এই সময় নার্স এসে রতি বাইকে খুব ঝাড়ল। ‘এখানে বসে বসে খুব তো মিঠে গল্প হচ্ছে! চল্‌, যা, ১০ নম্বরে বেডপ্যান পড়ে আছে।’

    রতন বাই ময়লা দাঁতগুলো বার করে হাসতে হাসতে পালাল।

    ‘আপনি এই লোফার আওরতদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যান? আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। না হলে কিন্তু আবার ব্লিডিং শুরু হয়ে যাবে।’

    নার্স বাচ্চাকে দোলনা থেকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

    সন্ধ্যেয় গঙ্গা বাইয়ের ডিউটি ছিল। ঘণ্টি না বাজিয়েই আমার ঘরে ঢুকে পড়ল।

    ‘বেডপ্যানটা নিতে এলাম বাই।’

    ‘না, না, গঙ্গা বাই, বোসো।’

    ‘বসলে রাঁড় শিশটারটা বোম মারবে না! তোমাকে বলছিলটা কী?’

    ‘কোন সিস্টার? ও, বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলছিল।’

    ‘শিশটার না, ওই আওরতি বাই!’

    ‘বলছিল যে পোপট লাল গঙ্গা বাইকে খুব মারে।’ আমি গঙ্গা বাইয়ের পেছনে লাগার জন্য বললাম।

    ‘আরে ও শালা আমাদের কী মারবে?’ গঙ্গা বাই হাত দুটো দিয়ে আমার পায়ে আস্তে আস্তে চাপড় মারতে লাগল।

    ‘বাই, তুমি আমাকে জুতো চপ্পল দেবে বলেছিলে, দাও না গো?’

    ‘নিয়ে যাও। কিন্তু এটুকু তো বলো যে তোমার মিয়াঁর চিঠি এল কি?’

    ‘আসেনি আবার?’ গঙ্গা বাই লাফ দিয়ে চপ্পল দুটো তুলে নিল।

    ‘শালা শিশটারটা দেখে ফেললে তো বোম মারবে। বড় খিটখিট করে।’

    ‘গঙ্গা বাই?’

    ‘হ্যাঁ বাই!’

    ‘তুমি নিজের গ্রামে কবে ফিরে যাবে?’

    গঙ্গার উজ্জ্বল চোখ দুটো যেন দূরের খেতের শ্যামলিমার মধ্যে হারিয়ে গেল। গভীর শ্বাস নিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘রামের কৃপায় এবারের ফসলটা যেন ভালো হয়, তা হলে বাই আমি নিজের ঘরে ফিরে যাব। গেল বার তো বন্যায় সব ধান পচে গেছিল।’

    ‘গঙ্গা বাই, মিয়াঁ তোমার এই সব দোস্তদের ব্যাপারে জানে?’

    আমি খোঁচানোর চেষ্টা করলাম।

    ‘কী যে বল বাই!’ গঙ্গা বাই একদম চুপ মেরে গেল। মনে হল যেন লজ্জা পেয়েছে। সে তাড়াতাড়ি কথা অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল। ‘বাই, তোমার তো পর পর দুটো ছুকরি হল। শেঠ খুব খেপে যাবে, না?’

    ‘কোন শেঠ?’ আমি অবাক হয়ে বললাম।

    ‘তোমার বর। যদি আবার শাদি করে নেয়?’

    ‘দ্বিতীয় বিয়ে করলে আমিও আবার বিয়ে করে নেব।’

    ‘তোমাদের মধ্যে এমন হয়? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি উঁচু জাতের!’

    মনে হল গঙ্গা বাই উঁচু জাতের লোকদের নিয়ে মজা করছে। আমি তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল দ্বিতীয় বারও মেয়ের জন্ম দেওয়ার জন্য আমাকে নিশ্চয়ই শাস্তি পেতে হবে। শেঠ যদি আমাকে উত্তম-মধ্যম না দেয়, তা হলে বুঝতে হবে সে থার্ড ক্লাস শেঠ।

    হাসপাতালে পড়ে থাকা নির্জন কারাবাসের চেয়ে কম নয়। সন্ধে বেলা দুঘণ্টার জন্য লোকে দেখা করতে আসে। বাকি সময় গঙ্গা বাই আর রতি বাইয়ের সঙ্গে গল্পসল্পে কেটে যায়। এই দুজন না থাকলে তো একঘেয়েমিতে দম ফেটে যেত। এদের সামান্য ঘুস দিলেই একে অপরের নামে নানা রকম উল্টা-সিধা কথা বলে যেত। একদিন রতি বাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রতি বাই, তুমি তো মিলে কাজ করতে, ছেড়ে দিলে কেন?’

    ‘আরে বাই, শালা মিলে তো বড়সড় ঝামেলা ছিল।’

    ‘ঝামেলা কেন?’

    ‘আরে বাই, এক তো কাজ খুব ভারি ছিল। তাও চলত, কিন্তু বাই দুমাস পর পর ছাড়িয়ে দিত।’

    ‘কেন?’

    ‘অন্য বাইদের রাখত।’

    ‘ভাই সেটা কেন?’

    ‘কারণ এই যে যদি পাক্কা ছমাস হয়ে যায়, তা হলে ফ্যাক্টরি ল লাগু হয়ে যাবে!’

    ‘ওহ্‌ হো, এবার বুঝেছি।’ অর্থাৎ দু-তিন মাস অন্তর অন্তর স্টাফদের বদলে দিত। যদি স্থায়ী হয়ে যায়, তা হলে কারিগরের ফ্যাক্টরি আইন মোতাবেক অসুস্থতার ছুটি, প্রসবকালীন ছুটি নেওয়ার অধিকার জন্মে যাবে। তাই দু-মাস পর পর অদল-বদল করে দেওয়া হয়। একজন মজুর বছরে খুব বেশি হলে চার মাস কাজ পায়। বাকি সময় গাঁয়ে ফিরে যায়। যাদের সে ক্ষমতা নেই, তারা অন্য মিলে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। কেউ হয়ত পচাধসা তরকারি নিয়ে বিক্রি করতে ফুটপাতের ওপর বসে গেল। ফুটপাতের ওপর জায়গার দখল নিয়ে তাদের মধ্যে খুব গালিগালাজও চলে।

    এরা সব লাইসেন্স ছাড়াই জিনিস বেচে বলে কোণে বসে থাকা সেপাইটাকে কিছু খাওয়াতে হয়। তা সত্ত্বেও কখনও হয়ত কোনও অচেনা অফিসার চলে এল। তখন ভাগদৌড় শুরু হয়ে যায়! যারা ধরা পড়ে গেল, তারা তো চিৎকার করে কান্না জুড়ল। পুলিশ তখন তাদের থানায় নিয়ে যায়। ফুটপাত সব সাফ হয়ে গেলে তারা কিন্তু ধীরে ধীরে ফিরে আসে। ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় পেতে আবার দোকান সাজিয়ে নেয়। কেউ কেউ আবার আরও চালাক। তারা ঝোলায় করে চার-ছটা লেবু, দু-চারটে ভুট্টা নিয়ে বাজারে এমনভাবে ঘুরে বেড়ায় যেন নিজেরাই খদ্দের! কিন্তু তাদের পাশ দিয়ে গেলেই ফিস ফিস আওয়াজ শোনা যায়: ‘লো ভাইয়া, ভুট্টা লিও, এক এক আনা!’ আর সে সব বিক্রিও হয়ে যায়।

    এদের কাছ থেকে তরকারি কেনার অর্থ হল কলেরাকে আমন্ত্রণ জানানো। যাদের ভাগ্য আরও খারাপ তারা ভিখ মাগতে শুরু করে। মাঝে মাঝে ছুটে-দৌড়ে অন্য ধান্দাও করে নেয়। অন্তত তাদের মত ষোলো শৃঙ্গারে পরিপাটি করে সেজেগুজে, মুখে পান নিয়ে স্টেশনের আশপাশের আবছা অন্ধকার জায়গাগুলোতে টহল দিতে থাকে। পার্টি এলে ইশারা ইঙ্গিত শুরু হয়! সওদা হয়ে যায়। এই খদ্দেরদের অধিকাংশই উত্তর প্রদেশের ঘর ছেড়ে আসা গয়লা, বউ গ্রামে আছে এমন ঘরছাড়া মজদুর অথবা এমন চিরকালের আইবুড়ো যাদের ঘরবার হল এই নোংরা গলি আর ফুটপাত।

    একদিন সকালে বারান্দায় রতি বাই আর গঙ্গা বাইয়ের মধ্যে ফ্রিস্টাইল কুস্তি শুরু হয়ে গেল। রতি বাই গঙ্গা বাইয়ের চুড়ো করে বাঁধা ঝুঁটিটা ধরে টান মারল। জবাবে গঙ্গা বাই রতি বাইয়ের মঙ্গলসূত্রটা টেনে ছিঁড়ে দিল। …মঙ্গলসূত্র…কালো পুঁতি দিয়ে তৈরি কণ্ঠহার – রতি বাই যে সধবা তার নিশানা। রতি বাই এমন ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল যেন কেউ তাকে বিধবা করে দিয়েছে। লড়াইয়ের কারণ ছিল সেই তুলোর টুকরোগুলো যা দিয়ে রোগীদের কাটাছেঁড়া মুছে অথবা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। মিউনিসিপ্যালিটির হুকুম আছে এই তুলো সাবধানে পুড়িয়ে ফেলার। কিন্তু মালুম হল যে রতি বাই আর গঙ্গা বাই গোপনে এই তুলো পাত্র থেকে তুলে ধুয়ে, পুঁটলি বেঁধে নিয়ে যায়। যেহেতু ইদানীং তাদের মধ্যে সম্পর্ক একটু বেশি খারাপ হয়েছে, গঙ্গা বাই হেডের কাছে নালিশ করে দিয়েছে। আর তা জানতে পেরে রতি বাই তাকে গালি দিলে দুজনের মধ্যে কিল-চড়ের লড়াই শুরু হয়ে গেছে। দুজনকেই বার করে দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দুজনেই হাত জোড় করে অনেক অনুনয়-বিনয় করায় হেড ব্যাপারটা চেপে গেলেন।

    রতি বাই ছিল বয়েসে বড় আর মোটাসোটা। গঙ্গা বাই তাকে বেশ উত্তম-মধ্যম দিল। দুপুরে রতি বাই জখম নাক নিয়ে বেডপ্যান রাখতে এলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘রতি বাই, ওই নোংরা তুলোগুলো নিয়ে কী কর?’

    ‘ধুয়ে শুকিয়ে নিই। এক্কেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়।’

    ‘তারপর?’

    ‘তারপর তুলোওলাদের কাছে বেচে দিই!’

    ‘এই সব জীবাণুতে ভর্তি তুলো কারা কেনে?’

    ‘ম্যাট্রেসওলারা নেয় – ওই যারা সাহেবদের ফার্নিচারের জন্য গদি বানায়।’

    ওফ্‌! আমার শরীরের রোম খাড়া হয়ে উঠল। একবার আমি যখন বেতের সোফার গদিগুলো ধোনার জন্য বার করিয়েছি, তখন সেগুলো একদম কালো হয়ে গেছিল। তা হলে সেও এই ক্ষত পরিষ্কার করা তুলোই নিশ্চয়ই ছিল! আল্লাহ্‌!! আমার মেয়ের তোষকটাও ওই তুলো দিয়ে তৈরি নাকি? আমার ফুলের মত বাচ্চাটা আর ওই জীবাণুর স্তূপ! হায়, গঙ্গা বাই, রতি বাই, খোদা যেন তোমাদের আচ্ছা করে অভিশাপ দেয়।

    আজ জুতোজুতির পর থেকে রতি বাই ভেতরে ভেতরে ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। গঙ্গা বাই যেহেতু তুলনায় জোয়ান, তাই রতি বাই তাকে নিজের থেকে বেশি পাপী মনে করত। কিছুদিন আগে গঙ্গা বাই রতি বাইয়ের বাঁধা খদ্দেরকেও ছিনিয়ে নিয়েছিল। অনেক দিন ধরে গঙ্গা বাই নানা গর্ভপাত ঘটিয়েছিল – একবার কোনও জীবন্ত বাচ্চার মুখের মধ্যে নাড়ি ঠুসে দিয়ে তাকে নর্দমায় ফেলে দেওয়ার পরেও নিশ্বাস বন্ধ হয়নি। সকালে নর্দমার ধারে লোক জমে গেল। রতি বাই তখন চাইলে গঙ্গা বাইকে সোজা ধরিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সে গোপন কথাটা নিজের বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিল। আর গঙ্গা বাইয়ের কী সাহস দেখো! ফুটপাতে বসে কাঁচা কুল আর পেয়ারা বেচছে!

    'রতি বাই, বন্ধুত্ব করতে গিয়ে কোনও গড়বড় হয়ে গেলে তোমরা হাসপাতালে যাও না কেন?'

    'কী করতে যাব হাসপাতালে? আমাদের মধ্যে কত বাই আছে যারা ডাক্তারের মত, একদম ফার্স্ট ক্লাস!'

    'ওষুধ-টষুধ দেয় কেউ?'

    'না তো কী! ফার্স্ট ক্লাস দাওয়াই দেয়। মুট্‌ঠিও চলে, তবে মালিশ সবচেয়ে ভালো।'

    'এই মুট্‌ঠি আর মালিশে কী হয়?'

    'বাই, তুমি বুঝবে না।' রতি বাই একটু লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলে।

    আমার ডাস্টিং পাউডারের কৌটোটার দিকে সে বেশ কিছুদিন ধরে নজর রাখছে। যখন আমাকে পাউডার মাখায়, হাতের তালুতে একটু নিয়ে নিজের গালেও মেখে নেয়। আমি ভাবলাম ওর মুখ থেকে কথা বার করার জন্য এই পাউডারের কৌটোটাই যথেষ্ট। কিন্তু তাকে কৌটাটা দিতেই ভয় পেয়ে গেল।

    'না বাই, শিশটার মারবে!'

    'না, না, মারবে না। আমি না হয় বলে দেব যে পাউডারের গন্ধ পছন্দ হয়নি।'

    'যাঃ, আরে কী বলছ! একদম ফার্স্ট ক্লাস গন্ধ বেরোচ্ছে। আরে ভাই, তোমার তো মাথা খারাপ আছে!'

    অনেক খোঁচানোর পরে রতি বাই আমাকে মালিশ আর মুট্‌ঠি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল।

    গর্ভধারণের প্রথম দিকে মালিশ খুব ভালো কাজ করে। একদম ফার্স্ট ক্লাস ডাক্তারের মত। বাই রোগীকে মাটিতে শুইয়ে ছাদ থেকে ঝোলানো রশি বা কোনও লাঠিতে ভর করে তার পেটের ওপর খাড়া দাঁড়িয়ে পা দিয়ে খুব মাড়াতে থাকে। এতটাই যে তাতেই অপারেশন হয়ে যায়। অথবা মেয়েটাকে দেওয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বাই প্রথমে নিজের মাথায় খুব ভালো করে চিরুনি চালিয়ে চুলটা চুড়ো করে বেঁধে নেয়। তারপরে মাথায় কড়া সর্ষের তেল মেখে মদ্দা ভেড়ার মত মেয়েটার দু-পায়ে প্রচণ্ড জোরে গুঁতো দিতে থাকে। মেয়েটা যদি কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত গতর-খাটানো যুবতী হয়, তা হলে এসব দাওয়াই সব সময় কাজ করে না। তখন মুট্‌ঠির দরকার পড়ে। নোংরা নখভর্তি অপরিষ্কার হাতটাকে তেলে ডুবিয়ে গর্ভবতীর শরীরের ভেতর থেকে কাঁপতে থাকা প্রাণটাকে ছিঁড়ে বার করে আনা হয়।

    অধিকাংশ সময় এই অপারেশন কাজ করে। বাই যদি আনাড়ি হয়, তা হলে হয়ত কখনও বাচ্চার একটা হাতই ভেঙে বেরিয়ে এল। কখনও হয়ত গলাটা খুলে ঝুলতে থাকল। আবার কখনও মায়ের শরীরের এমন অংশ বাইরে চলে এল যা ভেতরে থাকা উচিত ছিল!

    মালিশের দাওয়াতে খুব বেশি রোগী মারা না গেলেও অন্য নানা রোগের শিকার হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ওঠে। স্থায়ী ঘা হয়ে যায় যা কখনও সারে না। জ্বর থেকেই যায়। আর শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র দেওয়া মৃত্যুও যার হওয়ার তার হয়েই যায়। মুট্‌ঠি খুব কঠিন পরিস্থিতিতেই ব্যবহার করা হয়.....এতো প্রাণ নিয়ে খেলা। আর অধিকাংশ বাই এই খেলা খেলে। শেষ পর্যন্ত যারা বেঁচে থাকে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ চলাফেরা করতে পারে না। কেউ কেউ কয়েক বছর ঘসতে ঘসতে শেষমেশ পটল তোলে।

    রতি বাই আরও বলল যে ওই অসভ্য মেয়েছেলেগুলোর নাকি ওটাই শাস্তি। তাদের নাকি মরাই উচিত।

    আমার ভীষণ বমি পেল। বমি দেখে যে রতি বাই এতক্ষণ খুব রসিয়ে রসিয়ে কাহিনি শোনাচ্ছিল, ভয় পেয়ে ভেগে পড়ল। সুনসান, নিস্তব্ধ হাসপাতালে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। হায় খুদা, পৃথিবীতে মানুষের জন্ম দিতে চাওয়ার এমন ভয়ানক সাজা! আমি অস্পষ্টতার মধ্যে ভাসতে ভাসতে ভাবছিলাম।

    ভয়ে আমার গলায় যেন কাঁটা বিঁধছে। রতি বাইয়ের আঁকা ছবিতে আমার কল্পনা রঙ মেশাতে শুরু করল। তারপরে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল। জানলার পর্দার ছায়া দেওয়ালে নড়ছে। দেখতে দেখতে সেই ছায়া গঙ্গা বাইয়ের মালিশ করা রক্তমাখা লাশের মত এলোমেলোভাবে দুলতে লাগল। আমার মনের মধ্যে হাতের মুঠোটা যেন লোহার একটা ভয়ঙ্কর সাঁড়াশির মত চেপে বসেছে। ছোট ছোট আঙুল, ঝুলতে থাকা গলা যেন রক্তের সাগরে ভাসছে। আমার শরীর আর মন নিয়ে আমিও যেন কোথায় ডুবে যাচ্ছি! চিৎকার করতে চাইলাম, চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতে চাইলাম – কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বেরোলো না। ঘণ্টির সুইচ টেপার জন্য হাত বাড়ালেও হাত সরল না।

    হাসপাতালের নিঝুম নিস্তব্ধতায় যেন খুনের শিকার হয়েছে এমন কোনও মানুষের চিৎকার অনুরণিত হচ্ছে। আওয়াজটা আমার ঘর থেকে এলেও আমি সে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না। আমার অজান্তেই মুখ থেকে যে আওয়াজ বেরোচ্ছে, আমি তাও শুনতে পাচ্ছি না।

    'খুব মারাত্মক কোনও স্বপ্ন দেখেছেন নিশ্চয়ই?' নার্স আমাকে মরফিন ইঞ্জেকশন দিচ্ছে। আমি খুব বলতে চাইলাম, ‘নার্স, আমায় মরফিন দিও না। ওই দেখো সামনে গঙ্গা বাইয়ের মালিশ করা রক্তে স্নান করা লাশ ক্রুশের ওপর দুলছে। তার চিৎকার যেন স্ক্রু ড্রাইভারের মত আমার হৃদয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। দূরে কোথাও নর্দমার মধ্যে মুমূর্ষু বাচ্চার মৃদু ফোঁসফোঁসানি হাতুড়ির আঘাতের মত আমার মাথার ভেতরে বাজছে। আমার অনুভূতিকে মরফিনে ডুবিয়ে দিও না। রতি বাইকে পোলিং বুথে যেতে হবে। নতুন মন্ত্রী ওর স্বজাতি। এবার ওর ধার শোধ হয়ে যাবে। মজায় ধান ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজে লেগে যাবে। আমার মনের ওপর থেকে ঘুমের এই চাদরটা টেনে সরিয়ে দাও। আমাকে জাগতে দাও। গঙ্গা বাইয়ের হাতের ফোঁটা ফোঁটা রক্ত আমার সাদা চাদরের ওপর ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে জেগে থাকতে দাও।'

    ***************

    আমি জেগে উঠলাম যখন টেবিলের সামনে বসা ক্লার্কের মত দেখতে লোকটা আমার বাঁহাতের আঙুলে নীল রঙের ছাপ লাগিয়ে দিল।

    'আমাদের জাতের লোকের বাক্সে ফেলা চাই!' রতি বাই আমাকে ধমক দিল।

    রতি বাইয়ের স্বজাতির ডিবে। …সেটা যেন একটা বিশাল মুঠির মত ওপরে উঠেই আমার হৃদয়ে ভীষণ জোরে এসে ধাক্কা দিল। আমি আমার পরচাটা ওই বাক্সে ফেলতে পারলাম না!



    অলংকরণ (Artwork) : শুভময় রায়
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments