লক্কি নীডল্
জ্বরের মধ্যে ভোররাতের দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা অফিসে যাবার আগে একটা আলুর পরোটা বানিয়ে দিয়েছে। আমায় জাগিয়ে মাথায় হাতটাত বুলিয়ে বলেছিল – যাব আর আসব। রেজিস্টারে হাজিরি লাগিয়েই বেরিয়ে আসব দেখিস। খাবারটা খেয়ে নিয়ে তারপর ঘুমো। উঠে দেখবি আমি ফিরে এসেছি।
মায়ের অফিসে যাওয়ার শাড়িগুলো থেকে একটা পারফিউমের গন্ধ বেরোয়, সেটা ভালো করে নাকে ঢুকে যাবার পর সত্যি আমার আবার ভীষণ ঘুম পেয়ে যায়। কোনোমতে পরোটা শেষ করে আরো দুটো ক্রোসিন গিলেছি। পরে যখন সেই ঘুম ভাঙে তখন মা নয়, কানে স্টেথোস্কোপ লাগানো একটা বুড়ো গরিলা আমার মুখের উপর ঝুঁকে গোদা গোদা আঙুল দিয়ে চোখের নিচের চামড়া টেনে পরীক্ষা করার ভান করছিল, যদিও মোটা কাঁচের চশমার ভিতরে তার নিজের চোখই বন্ধ।
ডক্টর গুলজারীলাল বাজাজের অতিকায় শুঁয়োপোকার মতো সাদা ভুরুদুটো একবার উঠে নেমেছিল, যেন কিছু একটা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। অথচ গণ্ডারের চামড়ায় তৈরি চোখের ঢাকনাদুটো একবারও খোলেনি।
- আমার কি জণ্ডিস হয়েছে? ভদ্রতাবশত জিজ্ঞেস করলাম গুলজারীলালকে।
***
কাল বিকেলে মা কীভাবে যেন টের পেয়েছিল আমার কিছু হয়েছে। আমি মানতে চাইনি। পরে মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙেছিল আমার। চোখ খুলেই বুঝতে পারি সারা গায়ে ধুম জ্বর। হাতে পায়ে ব্যথার চোটে বিছানা থেকে নামতে পারছি না। হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে সন্তর্পণে দেরাজ খুলি। মনে আছে একটা নেংটি ইঁদুর পায়ের উপর দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। হাতড়ে হাতড়ে ক্রোসিনের স্ট্রিপ খুঁজে বার করে জল দিয়ে দুটো গিলে ফেলেছিলাম। তারপর বাকি স্ট্রিপটা সঙ্গে নিয়ে বিছানায় ফিরে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়েছি।
আজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমার কপালে হাত দিয়ে দেখেছে মা। এবং সঙ্গে সঙ্গে চিৎকারে বাড়ি মাথায়। - বৌদি, আমি কইছিলাম অর গায়ে জ্বর। এখন নিজেই আইস্যা দেইখ্যা যাও।
মামিমা ডায়াগনোসিসে ফেল করে অপরাধীর মতো এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি ঘুমঘোরে বলি – কাল মোটেও ছিল না। রাত্রে এসেছে। দুদিন দয়া করে আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আপনা থেকেই ঠিক হবে।
মায়ের চিৎকার শুনে মামা বেজায় চিন্তিত মুখে ঘরে ঢোকে। মা বলে ওঠে – মেজদা, জণ্ডিস নয় তো? সবার হইতে আছে। একটা ভালো ডাক্তার লাগব। বাড়িতেই ডাক। এত জ্বরে ছেলেটারে বাইরে করণের দরকার নাই।
সারা গায়ে বেদনা, তাও মামার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বলেছিলাম - প্রবুদ্ধর ঠাকুরদা ডাক্তার। আমি সেখানে গিয়ে দেখিয়ে আসব।
মামা বলল – পাগলামি করিস না। সেটা একটা ঘোড়ার ডাক্তার। আর্মিতে থাকার সময় ভুল-ভাল চিকিৎসা করে এত জওয়ান মেরেছে, নিজেই বলে বেড়ায় যে কোনো দিন নিশান-এ-পাকিস্তান খেতাব পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না দুল, তুই চলে যা। আমি একটু দেরিতে অফিসে বেরোব। ভালো ডাক্তারকে কল দিচ্ছি। দশটা, সাড়ে দশটা নাগাদ এসে পড়বে।
আমি ধরে নিয়েছিলাম শিমলিপুরের নাপিতদের কাউকে টেনে আনা হবে। ছোটবেলা থেকে মধ্যম মাতুলের মুখে শুনে এসেছি যে নিউরো-সার্জারিতে একদম পয়সা নেই। তবে খুলি ফাঁক করার আগে নিউরো-সার্জেনদের চুল ছাঁটা শিখতে হয়, সেই বিদ্যেটা কাজে লেগে যাচ্ছে। ডাক্তাররা ডিগ্রী লুকিয়ে ফেলে সেরা সেলুনগুলো খুলছে আজকাল। সব নাপিতই আসলে বাঘা সার্জেন।
মা হাজির থাকতে মামাকে জিজ্ঞেস করি - কে তোমার ভালো ডাক্তার?
মামা বলল - কেন? বাজাজ। তোর পেটটা কয়েকবার টিপে সে বুঝে যায় কী হয়েছে। আজ পর্যন্ত কখনো ভুল হয়নি।
মাতুল যা বলে তা সবসময় করে না। আজ করে দেখিয়েছে।
***
মামার পছন্দ করা সেই শ্রেষ্ঠ ডাক্তার আমার পেটের ডানদিক হাতের চেটো দিয়ে চেপে রেখেছিলেন। আমাকে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নির্দেশ দিয়ে তিনি বললেন - তোর শরীরটা পাতলা বলে সব অরগ্যান প্যালপেট করা যায়। লিভার আগের চেয়েও ছোট হয়ে গেছে, কিন্তু ভয় পাস না, আবার বাড়বে। স্প্লীন ইজ হিউজ, লাইক এ ভালিবাল। তার মানে গলায় একটা ইনফেকশান হয়েছে। তবে জ্বরের সাথে তার সম্পর্ক খুঁজতে যাস না। জ্বরটা হল বুধ-বুখার। বুধবার শুরু হয়েছে, কোনো একটা বুধবার নিজের থেকেই সরে পড়বে। ও নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই।
কী বুলশিট! তাও আমি যতটা সম্ভব সৌজন্য দেখিয়ে বললাম - ডাক্টর সাব, আপনি গলা না দেখেই এসব কী করে বলছেন? টনসিল কি ফুলেছে? আমার তো সেখানে কোনো ব্যথা হচ্ছে না।
বাজাজ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন – কতবার বলব তোর টনসিল গুড়্দার কাজ করে বলে সবসময় তাদের সাইজ কিডনির সমান? তো টনসিলের কাজ কে করবে? সে কাজটা হয় স্প্লীনে। ভয়ের কিছু নেই। তোর মতো মানুষ আরো আছে পৃথিবীতে।
- এটা মেডিকালি সম্ভব নয়। আমার মা আর মামা প্রতিবাদ করে না বলে আমার বিষয়ে যা ইচ্ছে তাই বলবেন না।
- তুই ডাক্তার না আমি ডাক্তার?
- ও.কে ডাক্টর-সাব, ফর ইওর কাইণ্ড ইনফর্মেশন, আমার জ্বরটা বুধবার সকালে না হয়ে মঙ্গলবার রাতেও শুরু হয়ে থাকতে পারে। তাহলে আপনার ডায়গনসিসের কী হবে?
- সারি মাই বায়, তুই বুঝতে পারিসনি। বুধ-বুখার যে শুধু বুধবারই স্টার্ট হবে তা নয়। বুধের একদিন, দুদিন, বা তিনদিন আগেও শুরু হতে পারে। সেক্ষেত্রে বুধের একদিন, দুদিন, বা তিনদিন আগেই শেষ হবে। সাইকেলটা বুধ টু বুধ চলে।
চমৎকার! বুধের সঙ্গে বুধ-বুখারের কোনো সম্পর্কই নেই। অম্লানবদনে স্বীকার করছে এই শিমলিপুরের পিশাচ, যার হাতে আমার আরোগ্যের ভার সমর্পিত।
ফুকরে উঠে বললাম - দিস ইজ ইনসেন! মীনিংলেস। বাই দা ওয়ে, আপনি এখন পর্যন্ত একবারও চোখ খোলেননি। একটা রেসপনসিবল্ ডাক্তার কীভাবে সারাক্ষণ চোখ বুজে রুগীকে একজামিন করে?
- বিকাজ আই ক্যান সী উইথ মাই ফিংগর্স্। বাজাজ তাঁর মোটা মোটা আঙুল দিয়ে আমার পেট তিন জায়গায় ফুটো করার চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। আমি অ্যাবডোমেনের সমস্ত পেশী একত্র করে এই বর্বরের আক্রমণ ঠেকাচ্ছি। রুগী সতর্ক হয়ে গেছে দেখে বাজাজ শেষ পর্যন্ত পিছোলেন। - আমি তোর পেটের তিনটে জায়গায় আঙুল ঠেকিয়ে পুরো বাডিটা দেখতে পাই। নইলে লাহোরের স্যাকিণ্ড ব্যাস্ট আটপ্সি সর্জন বলত না আমায়।
- বেস্ট কে ছিল? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি। বাজাজ এ খবরটা আগেও দেননি।
- একটা ইরানী বুড়ো। হি ওয়জ কাম্প্লীটলি ব্লাইণ্ড। দুচোখে হণ্ড্রেড পর্সেন্ট ছানি। সে বলত পুরু ছানি না হওয়া পর্যন্ত একটা ডাক্তার ফুল রিয়ালটি দেখতে পায় না। পার্শিয়ল ট্রুথ দেখে।
আমি দেয়ালের দিকে আরেকটু সরবার আগে বললাম – যা ইচ্ছে বলে যান। আপনার একটা কথাও বিশ্বাস করছি না। আই ডাউট ইউ ইভন হ্যাভ এ মেডিকাল ডিগ্রী। সার্টিফিকেট দেখতে চাইলে হাজারটা অজুহাত পাওয়া যাবে কিন্তু একটা পর্চিও বেরোবে না।
- ফাল্স্! দ্যাট ইজ ফাল্স্! গর্জে ওঠার পর পিছনে হেলান দিতে গিয়ে বাজাজ টের পেলেন বেতের মোড়ায় হেলান দেবার জায়গা থাকে না। আমাদের বাড়িতে কোনো চেয়ার টেয়ার নেই। মামার ঘরে একটা সোফা সেট আছে, এই যা। আর সব কাজ মোড়ায় বসে হয়।
- পার্টিশানের সময়ে প্রাণ আর ইজ্জত বাঁচানো যাচ্ছিল না। সেই জন্য একশো মাইল পথ আমরা এক এক করে নিজেদের সমস্ত অমূল্য সম্পত্তি ত্যাগ করে আসতে পেরেছিলাম। একটা কাগজের টুকড়া তার কাছে কী? তাও আমার আণ্ডারওয়্যারের ভিতর হেড অফ দি ডিপার্টেমেন্টের হাতে লেখা চিঠি ছিল। স্বঘোষিত লাহোরের সার্জেন গুলজারীলাল বাজাজ ব্যাগ থেকে ব্লাড প্রেশারের যন্ত্র, প্যাড, এবং কলম বার করতে করতে বললেন।
- কোন ভাষায় লেখা? ফারসি না উর্দু? কেউ পড়তে পেরেছিল সেটা? খোঁচা দিয়ে বাজাজকে জিজ্ঞেস করি আমি।
বাজাজের একটা চোখ খুলে আবার বুজে গেল। - আমি পড়ে শুনিয়ে দিয়েছিলাম। তার উপর বেস করে হাসপাতালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাই। লাশের পর লাশ যমুনায় ভেসে বা গোরুর গাড়িতে ভরতি হয়ে আসত। আমি আর দিল্লীর প্রধান আটপ্সি সর্জন চিল্কট সাহেব ধড়াদ্ধড় পোস্ট-মার্টেম করে দিতাম। তোর মতো কত ফড়িং-কে টেবিলে ফেলে কেটে ফেলেছি! আমাদের মতো ডাক্তার না থাকলে ইন্ডিয়া মধ্যযুগে ফিরে যেত।
- আমি লাশ নই। একটা জ্যান্ত পেশেন্ট।
- এক্ষুনি বোঝা যাবে। বাজু আগে কর্। বাজাজ আমার বাহুতে কাপড়ের পট্টি জড়িয়ে তাতে হাওয়া ভরতে লাগলেন। ইচ্ছে করে চাপ বাড়াতে বাড়াতে হাতটাকে রক্তশূন্য অবস্থায় আধমিনিট রাখার পর পাষণ্ড গুলজারীলাল যখন বুঝলেন শরীরের একটা অঙ্গ খসে গেলেও আমি তাঁর সামনে কোনো দুর্বলতা দেখাব না, তখন হতাশ হয়ে সেটা ছাড়ার পর তিনি বললেন – তোর উপর নিচ দুটোই ষাট। তার মানে হার্ট শুধু ততটুকু প্রেশার দিচ্ছে যতটা না হলে ব্লাড বাডিতে চলবেই না।
- তাহলে আপনি পারাটাকে তিনশো অবধি তুলে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন কেন?
- কারণ তার উপরে আর যাওয়ার জায়গা নেই। আর্মি হাস্পিটলের প্রসিজর্ হল সিলিং টচ্ করে ফেরা, যাতে একবারের বেশি সময় না দিতে হয়। অ্যানিওয়ে, তোর খুব লেগেছে তো বললি না কেন?
হাত অবশ হয়ে গেছে। যেন আমার শরীরের অঙ্গ নয় সেটা। মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বাজাজকে বললাম – আমার সিস্টলিকের ভ্যালু নব্বই থেকে একশোর মধ্যে থাকে। স্টেথোস্কোপটা মালার মতো গলায় ঝুলিয়ে না রেখে যদি কানে ঢোকাতেন তাহলে আপনিও সেটা টের পেতেন। সো মাচ্ ফর প্রসিজর্।
- ফিকর্ নাট, ওয়াইজ বায়। মাই গোল্ডন ফিঙ্গর্ ওয়জ্ আন ইয়োর পল্স্।
***
- জ্যান্ত পেশেন্ট আর লাশের মধ্যে বেশি তফাত নেই। একটা একটু তাড়াতাড়ি পচে। ব্রিটিশ আমলের স্ফিগমোম্যানোমিটারকে মোঘল যুগের পোর্টম্যান্টো ব্যাগে ভরতে ভরতে পরে বললেন বাজাজ। - লাশ হল একটা এমন বডি যার দুটো হার্ট বীটের মধ্যে ব্যবধান কিছুটা বেড়ে গেছে। তখন একজামিন করা সোজা। সেইজন্য আমি তোর হাতের সব ব্লাড হার্টে ফেরত পাঠিয়ে কিছুক্ষণের জন্য সেটাকে থামানো যায় কিনা দেখছিলাম। এবার তোর গায়ে ছোট্ট একটা হুল ফোটাব। তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
দশ ইঞ্চি লম্বা গোরু-মোষের উপযোগী ভয়াবহ সিরিঞ্জটা ব্যাগ থেকে বেরোল, যার জন্য বাজাজের ম্যানিক উন্মাদ বলে এত সুনাম। গুলজারীলাল তাতে একটা ছ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এবং পেন্সিলের মতো মোটা ছুঁচ ফিট করার চেষ্টা করছিলেন। কোনো কারণে ছুঁচটা ফিট করছে না। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম – আমি জানি আপনি লাহোরে মোষের চিকিৎসা করতেন, সম্বলপুরায় ষাঁড়ের স্পার্ম সংগ্রহ করতেও খুব কাজে লাগে এই ছুঁচ আর সিরিঞ্জ। কিন্তু শিমলিপুরে আর সবাই ভাবে হয় পাগল, নয় চোখে দেখেন না, সেইজন্য এত বড়ো ইকুইপমেন্ট দরকার। এই কাজটা নার্স মিস মুস্কানকে দিয়ে করাতে পারেন না, যাতে আপনার বদনাম কম হয়?
- গারবেজ! ক্ষেপে গিয়ে বললেন বাজাজ। - পীপল্ টাক্ গারবেজ! এটা আমার লক্কি নীডল্, সেইজন্য এই ছুঁচটা ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করি না। একটু বড়ো সিরিঞ্জ লাগে এটার জন্য। কিন্তু জীবনে কোনোদিন কোনো অ্যাানিমলের উপর ব্যবহার করা হয়নি। যদি না তুই খান অব্দুল গফ্ফার খানকে লায়ন হিসেবে ধরিস।
- এই মোষের সিরিঞ্জ ফুঁড়লে পেশেন্টরা তাড়াতাড়ি ভালো হয়?
- অ্যাবসলিউটলি নাট্! বজাজ ইজ্ এ ডাক্টর, নাট্ এ মিরকল্ ম্যান! এটা দিনের গোড়ার দিকে কয়েকবার ব্যবহার করলে আমার নিজের রোজগার ভালো হয় ঘোঁচু। আজ কাউকে দেওয়া হয়নি, তাই তোকে দিয়েই শুরু করতে হবে।
গুড গড! ছিটকে সরে গিয়ে বললাম - আপনার কি এই সেন্স্টুকুও নেই? অন্যের রোজগার ভালো করার জন্য কেউ নিজের বডিকে গোরু-মোষের মতো ব্যবহার করতে দেবে কেন?
বাজাজ যেন আমার নিষ্ঠুরতায় হতবাক হয়ে গেলেন। এবার সত্যিই চোখ খুলেছে বুড়োর। আমার দিকে খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন – আমি তোদের ফ্যামিলির ওল্ডেস্ট ফ্র্যাণ্ড। তোকে আমার ব্যাস্ট সম্পদটা দিয়ে দিইনি?
ব্রেকফাস্টের পরে দুটো ক্রোসিনের গুলি খেয়েছি। তারপর থেকে আমার জ্বর কম ছিল। বাজাজের এই শেষ কথাটায় রাগে সারা শরীর এবং অন্তরাত্মা দুইই দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে। আমার উপর এতদিন ধরে যে অত্যাচার চালিয়েছে এই বুড়ো তার স্মৃতি হাতুড়ির মতো দুম-দাম করে বুকে আঘাত করছিল। তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে বললাম – সেই সম্পদ হল একটা গ্রেনেড! সাইকোপ্যাথ না হলে কেউ একটা স্কুলের ছেলেকে গ্রেনেড উপহার দেয়?
- আমি তোকে সেটা মাটিতে পুঁততে সাহায্য করিনি?
- সে তো আমি জিনিসটা বাড়িতে নিয়ে আসতে অস্বীকার করায়। আপনি জানতেন আমি ওটাকে যমুনায় ফেলে দেব। আমার জায়গায় অক্কি হলে মজাসে বাড়ি নিয়ে যেত। আরো ছোট ছেলেমেয়েরা আসে ওদের বাড়িতে। কেউ পিন খুলে দিতে পারত।
- সেই জন্যই ওদের কাউকে দিইনি বেওকুফ!
- আপনার কথার কোনো মানে হয় না। ইট্স্ অল বক্ওয়াস।
- লিস্সন্ ছছুন্দর্, তোর নিজেরই ব্রাহ্মিন মেয়ে বন্ধুটা তোর সামনে আমায় বলেছে তুই টোন-ডেফ। কার কাছে কী বলতে হয় জানিস না। আমি তোকে মানুষ ভেবেছিলাম, তোর বন্ধুগুলোর মতো জানোয়ার নয়। কোথায় সে সব যম্নাপাড়ের গোরুঠোক চাষা, আর কোথায় তোর মতো একটা ব্রিটিশ মাস্টারের পা-চাটা অ্যাংলো-ওয়রশিপিং ঘরে পালা লাওয়ারিস বাচ্চা…
- মেজমা! মেজমা! কোথায় তোমরা? আমি চিৎকার করে মামিমাকে ডাকতে লাগলাম। বাজাজ টুক করে উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসে বললেন – সারি বায়, শুনতে পাচ্ছে না। মামা অফিসে চলে গেছে, বাসন মাজার মহিলা আজ আসেনি বলে তোর মামিমা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে পাশের কোনো বাড়ি থেকে কাজের লোক বেরোলে তাকে ধরবে।
***
খাট থেকে নামতে গেলাম। বাজাজ আমার পথ আটকে দিয়েছেন। ঘরের যেহেতু একটাই দরজা, গরিলার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখান থেকে বেরোনো সহজ না। আলনার পিছনে রাখা টোটোদার হকিস্টিকটা ঘুরিয়ে মাথায় মারা যায়। কিন্তু মাথা গরম করলে আমাদেরই ক্ষতি। তারপর নাবালক বলে আমি পার পেয়ে গেলেও মা আর মামা কোর্ট-কাছারি করে নাজেহাল হবে। তাছাড়া লোকটার হাতের লক্কি সিরিঞ্জ আমি ভাঙতে চাইছিলাম না। সত্যি যদি রুজি-রুটির ব্যাপার হয়।
- শান্ত হয়ে বোস। গুলজারীলাল গরগর করে বললেন আমায়। - একটা ছুঁচ দেখে তালপাতার মতো কাঁপিস না। আমরা তলোয়ার আর ছোরার সামনে বুক চিতিয়ে এগোতাম। যাক গে, তার বদলে আজ একটা কারমিনেটিং মিক্সচার নিয়ে নে। আমার নিজের হাতে তৈরি, বিলায়তি মেশানো আছে। গ্যাসটা বেরিয়ে আসবে, মেজাজও ভালো হয়ে যাবে। আর একটা কাশির ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি, ইচ্ছে হলে খাস।
বিছানায় ফিরে গিয়ে যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম – গলায় কিছু হয়নি আমার। জণ্ডিস বা ম্যালেরিয়া রুল আউট করলে বাকি থাকে একটা ভাইরাল কিছু। রাত থেকে গায়ে হাত পায়ে ব্যথা। এর জন্য শুধু জ্বরের ওষুধই যথেষ্ট। কেন যে মামারা আপনাকে ভালো ডাক্তার বলে সেটা আমার কাছে একটা মহাবিস্ময়।
বাজাজ খসখস করে প্যাডে উর্দুতে কিছু লিখতে লিখতে বললেন – বয়স কম বলে লাহোরে স্যাকিণ্ড ব্যাস্ট ছিলাম। এখন আমি ওল্ড দিল্লীতে ব্যাস্ট। সেটা জানে বলেই লোকেরা ভালো বলে। তুই আমার দেওয়া যে কোনো একটা ওষুধ খেতে শুরু কর, দেখিস গলা আপনে-আপ খারাপ হয়ে যাবে। তখন বাকিটা খেয়ে আরাম পাবি। খামোখা আমার উপর রেগে থাকিস না। আমি আজকের সিম্পটম দেখে ওষুধ দিই না। আগামী কালের সিম্পটম দেখে দিই। আমার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আর পাওয়ার আছে তোর। সেদিন যে এনফীল্ড পিস্তলটা দেখালাম সেটা কেমন লেগেছিল? পুরোনো মাল, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ফেভারিট।
- আপনার পিস্তলে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমার দাদুর কাছ থেকে আপনি কী এবং কেন পেয়েছিলেন সেটা যদি আমাদের মধ্যে একজন এস্কপায়ার করে যাবার আগে জানিয়ে দেন তাহলে ভালো হয়।
- সমস্ত জানাবার জন্যই তো অপেক্ষা করে আছি। পালিয়ে বেড়াচ্ছিস বলে একসাথে বসা হয় না। তোর পালোয়ানের মতো টন্সিলগুলো ছুঁয়ে প্রমিস কর, আমার জন্য দুটো ছোট কাজ করে দিবি।
- কী কাজ?
- এক, আগামী বছর ছ’ মাসের জন্য আমার ছেলের কাছে ক্যানাডায় যাব। তুই ওই সময়ে আমার বাংলোটার দেখাশোনা করে দে। কুছ নহীঁ, ব্যাস সপ্তাহে দু-তিন দিন গিয়ে ঝাড়পোঁছ। জল আর ইলেক্ট্রিকের বিল জমা করা। পিছনের বাগানে ঘাসের ব্যবস্থা চাষারাই করবে, তুই বেড়াফেড়াগুলো মেনটেন করবি। হায়েনা ঢুকতে দিবি না। ল্যাট্রিনটা ব্যবহার না করলেও পনেরো দিনে একবার ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করে দিস, নইলে মিথেন গ্যাস উঠে আসে।
- আমি এসব কাজ কোনোদিন করিনি। আপনি এই ভার সিপ্পিকে দিচ্ছেন না কেন? ও আপনার বিশ্বাসী লোক।
- সিপ্পি ছুটিতে দেশে চলে যাবে। খারাপ কী, আমার একটু পয়সা বাঁচে। আসল প্রবলেম হচ্ছে ইডিয়টটা সাপের ভয়ে বাংলোতে একা যেতে চায় না। আগে ও একবার বাড়ি থেকে একটা কিছু সরাচ্ছিল, তখন সাপেরা ইন্ট্রুডর ভেবে কামড়ে দিয়েছে। তার পর থেকে বেচারা চোখে একটু কম দেখে। আমি ছাড়া আর কেউ ওকে গাড়ি চালাতে দেবে না। কিন্তু তোর ভয় নেই, তুই তো চুরি করিস না। সাপগুলো তোকে ঘরের লোক ভাববে আর আমি অ্যান্টিডোটও দিয়ে যাব।
- আরো তো লোক আছে আপনার। চেম্বারে কাজ করে। সেকেণ্ড মার্কেটের পাড়ায়…। সবাইকে ছেড়ে আপনি আমার ঘাড়ে এটা চাপাতে চাইছেন কেন বলুন তো? একটা কিছু লোচা আছে এর মধ্যে যেটা আমাকে জানানো হচ্ছে না।
- আরে দূর! খালি বাংলো পেলে এরা হিজড়া নিয়ে ফুর্তি করতে যাবে। মদ খাবে। তারপর ভাঙচুর, ক্রাইম, সব হতে পারে। এসে দেখব লাশ পচে পড়ে আছে। বিশ্বাস কর কোনো লোচা নেই। চতুরানন গ্রাম থেকে শহরে এলে বাংলোটাতে লুকিয়ে থাকেন। সিক্র্যাসির জন্য তিনি ভারটা তোকে দিতে জোর করছেন। আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু চতুরাননের তোর উপর অগাধ বিশ্বাস। গুরুজীর মতে গোরু ঠোকেনি এমন ছেলে একটাই পড়ে আছে শিমলিপুরে। আমিও ভেবে দেখলাম ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এতগুলো বান্ধবী থাকতে তুই গোরু ঠুকতে যাবি কেন?
ডিজগাস্টিং ম্যান। মনে মনে বাজাজকে গাল পাড়লাম আমি। লাহোর থেকে এরকম বে-অদব একটা মানুষ কী করে বেরোল? যদি না সেটা একটা জিন হয়। পম্পা বলেছিল জিনদের মুখ থেকে কৃমির মতো বকওয়াস্ বেরোয়।
- আমি তো আর সারাদিন থাকব না। দরজা ভেঙে ঢুকে কেউ যদি জিনিসপত্র নিয়ে যায়?
- আছেটা কী? কিছু পুরোনো ফার্নিচার। সেগুলোতে কারো ইন্টারেস্ট নেই। পুরোনো ল্যাবরেটরিটা আছে। সেটা তোর জিম্মা। সবাই জানে ওখানে মড়া কাটা হত, তার জন্যই কেউ ধারে কাছে আসবে না। তোকে তোর দাদুর গল্প খানিকটা আজ শুনিয়ে যাব ভাবছিলাম। বোধহয় আর সময় হবে না।
- রুকিয়ে, রুকিয়ে। সেকেণ্ড কাজটা কী?
- সেটা করলে আজই করতে হবে। লক্কি নীডল্টা একবার চট করে ব্যবহার করতে দে। তোর মামিমা ফিরে আসার আগে।
***
আবার দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুলাম। বাজাজ আমার চোখের উপর একটা কাপড় ফেলে দিলেন যাতে ভয় না পাই। তারপর বাজুতে ফুটল সেই বিরাট ছুঁচ যা দিয়ে ষাঁড়ের অণ্ডকোষ থেকে বীর্য বার করা হত। চামড়ায় জ্বালা নয়, তার অনেক ভিতরে টনটনে ব্যথা করে উঠল। যেন হাড় ফুটো করা মজ্জা ভরা হচ্ছে। চাদরটা দাঁতের মধ্যে নিয়ে চিবোতে চিবোতে আমি জিজ্ঞেস করলাম – কী ভরেছেন আপনি? ডিস্টিল ওয়াটার?
- এইট্টি পর্সেন্ট হুইস্কি। বাকিটা অ্যানেস্থেসিয়া। নো ওয়াটার।
- অ্যানেস্থেসিয়া কেন?
- যাতে তোর চুঁ চুঁ করা থেমে যায়, আর যা বলছি সেটা চুপ করে শুনিস।
সেই মুহূর্তেই আমার সমস্ত ব্যথা দূর হয়ে প্রচণ্ড ঘুমে দুটো চোখ আরামে বুজে আসে। আমি হয়তো বিড়বিড় করে বাজাজকে ধন্যবাদও বলে থাকতে পারি। ব্ল্যাক আউট হয়ে যাচ্ছিল। গরিলার গরগরে গলাটা পেয়ে আমি চেষ্টা করে নিজেকে জাগিয়ে রাখলাম।
- ঘুমিয়ে পড়িস না মেম্নে, একটুখানি জেগে থাক। তুই আমার গলা শুনতে পাচ্ছিস?
- হুঁ।
- আর বেশিক্ষণ হয়তো পাবি না। কিন্তু তার আগে আমি আমার প্রমিস রাখার জন্য তোকে একটা শার্ট স্টোরি শুনিয়ে যাব। আ স্টোরি দ্যাট স্টার্টড ম্যানি ম্যানি ইয়র্স্ অগো আন আ স্টার্মি নাইট …
আবার ব্ল্যাক আউট। আবার আমি নিজেকে ঝাঁকিয়ে জাগাবার চেষ্টা করলাম। একটা অন্ধকার বৃষ্টির রাতে বাজাজের গলা দূর থেকে কোনো জংলী জানোয়ারের মতো আমার দিকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছিল। এটাকে আমি হারাতে চাইছিলাম না।
… শুনছিস মেম্নে? ওয়ন্স্ আপন আ টাইম, ম্যানি ম্যানি ইয়র্স্ অগো, দেয়র ওয়্যার থ্রি আন-ইকোয়ল ফ্র্যাণ্ড্স। তাদের একজনের নাম ছিল বাজাজ, একজনকে বলত চিল্কট, আর থর্ডজন ছিল সেন, তোর গ্র্যাণ্ডফাদর। আমার বয়স তখন থর্টি টু। চিল্কট ওয়জ স্যাভন্টি টু। অ্যাণ্ড সেন ফিফ্টি টু। ফার্টি এইটের সেই বছর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে, চারদিকের গ্রামগুলো যখন আর রক্তে নয় জলে ভাসছে, চিল্কটের বাংলোতে আমরা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে ছিলাম। তখন আমাদের তিনজনের মাঝখানে আরেকজন চলে আসে। কোনো চতুর্থ মানুষ…।
পরে আমি এই ঘটনাগুলো ইচ্ছেস্বপ্নের জগতে কোনো নিরিবিলি অরণ্যের বালি আর ঝরা পাতায় আচ্ছাদিত জমি মাড়াতে মাড়াতে আবার দেখেছিলাম, এবং আমার মনে এই বিশ্বাসটা দানা বাঁধতে থাকে যে ইউক্যালিপ্টাসের পাতার ফাঁক গলে নক্ষত্র থেকে আসা এই আকাশবাহিত গলার স্বর গুলজারীলাল নামের লাশকাটা সার্জেনের নয়, আমার এক পূর্বপুরুষের।
…একটা ফোর্থ হিউমন…। বলছিল সেই স্বরটা।
- এটা সেই ফোর্থ হিউমনের স্টোরি…।
কুড়িয়ে পাওয়াদের বংশ
আমার যখন ঘুম ভেঙেছিল তখন বেশ রাত। আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিছানা থেকে নেমে আমি জল খাচ্ছিলাম। মা নিজের খাট থেকে উঠে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে বলল – যাক, উঠে পড়েছিস। সেই সকালের পর সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। নে এবার বসে ভালো করে খেয়ে নে।
দেখলাম বাইরের টেবিলে আমার জন্য দুটো কলা, গোটা ছয়েক মাখনে ভাজা টোস্ট, আর এক ফ্লাস্ক গরম চা রাখা আছে। আস্তে আস্তে গিয়ে চা দিয়ে টোস্টগুলো খেতে শুরু করি।
- এতক্ষণ জাগাওনি কেন? পুরো দিন কেটে গেছে।
- বাজাজ বৌদিকে বলে গিয়েছিলেন ঘুম না ভাঙাতে। ব্রেন ঠাণ্ডা হতে সময় লাগে।
- ব্রেনে আবার কী হয়েছে আমার?
- কিছু হয়নি। জ্বর মাথায় উঠে গেলে মানুষের মাথা গরম হয়ে যায়। সেই জন্য।
হাতের পাঁউরুটিটা থালার মাঝখানে এত জোরে ছুঁড়ে মারলাম যে সেটা বাউন্স করে আবার হাতে ফিরে এল। খিঁচিয়ে উঠে বলি – আমার মাথা গরম হয়নি, তোমাদেরই মাথা খারাপ হয়েছে তাই এই বনমানুষটাকে ডাক্তার বলো। তার কোনো ডিগ্রী আছে কিনা চেক করে দেখেছ কেউ?
মা তাড়াতাড়ি গিয়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল নিয়ে এল। - ঠিকই বলেছিস। কিন্তু মানুষটা খারাপ না। অনেক দিনের চেনা, তোর দাদুর সময়কার লোক। কাজের দরকারে তো এই ধরনের বিশ্বাসী লোকের কাছেই যায় সবাই। তাছাড়া হাতে হাতে টাকাও দিতে হয় না। বছরে একবার কি দুবার যা পারি দিয়ে আসলেই চলে।
- তোমাদের এই বিশ্বাসী লোক আজকে আমাকে কী বলেছেন জানো? লাওয়ারিস! রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। এবার নিজেই বলে দাও সেটা মিথ্যে না সত্যি।
মা হাসি হাসি মুখ করে বলল – যে যা বলে সব সত্যি বলে মেনে নিতে হয় নাকি? তুই আমার নিজের ছেলে। তোকে দেখাইনি পেটের দুটো সিজারের দাগ? একটা তোর জন্য আর একটা দিদির জন্য? ডক্টর লাহিড়ীর করা। কলকাতার শ্রেষ্ঠ সার্জেন একজন, তাও তোর বেলা ইনফেকশান হয়ে মরতে বসেছিলাম।
- কী তোমাদের শ্রেষ্ঠ সার্জেন? ভার্টিকালি সবকটা মাস্ল্ কেটে দুফাঁক করে দিয়েছেন। কোর বডিতে স্ট্রেংথ আসবে কোথা থেকে? আজকাল কাউকে দেখেছ ওরকমভাবে কাটতে? ছোট্ট একটা হরিজন্টাল ইন্সিশান করে।
- হ্যাঁ, রেণুরও তো তাই দেখলাম। মনে হয় তখনকার সার্জারি আলাদা ছিল। জয়, তুই যে এত জানিস, কেন ডাক্তার হচ্ছিস না? তোর ঠাকুরদা বড়ো ডাক্তার ছিলেন। আমাদের তো ওটাই লাইন। ভালো ডাক্তার প্রয়োজন হলে ফ্যামিলির বাইরে যেতে হয় কেন?
- তোমরা কেউ তো হতে পারতে।
- আমাকে স্কুলেই পাঠায়নি। বাড়িতে পড়িয়েছে। বাড়িতে ল্যাবরেটারি নেই, সায়েন্স পড়া যায় না। তাই আর্ট্স্ পড়তে হল। সায়েন্স পড়তে দিলে আমি ডাক্তার হতাম না কেন? তুই তো সায়েন্স পড়ছিস।
- ঠিক আছে, বুঝেছি। আমার বন্ধু প্রবুদ্ধ ডাক্তারি পাশ করে বেরোক, যা চাও সব পেয়ে যাবে। আচ্ছা, আমার জন্ম যদি হাসপাতালে হয়ে থাকে তো বার্থ সার্টিফিকেট নেই কেন?
- সে তো তোর দিদিরও নেই! দিদি কি তার জন্য দাপাদাপি করছে? কলকাতা থেকে আসার সময় কত কী হারিয়ে যায়। দামি গয়না অবধি হারিয়ে গেছে আমার।
- মা, আমি বাজাজের কথায় কান দিতাম না। ঘটনা হল এই যে তোমরাও ছোটবেলায় আমাকে অনেকবার কুড়িয়ে পাওয়া বলেছ। সেগুলো আমি ভুলিনি, ভুলতেও পারব না। মনে চিরদিন একটা সন্দেহ ছিল। বাজাজ আজ তাতে আরেকটু পেট্রল ঢেলে দিয়েছেন শুধু। কিন্তু ওটা যে আমার উইক স্পট সেটা এই বনমানুষ জানল কী করে?
মা আমাকে ঘরে নিয়ে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলল – ইস, এটা তোর উইক স্পট? ছি, ছি, ছি! তাহলে সেটা পুরোপুরি আমাদের দোষ। আমরা বাঙালরা বাচ্চাদের ‘কুড়িয়ে পাওয়া’, ‘বানের জলে পাওয়া’, ‘ছাই ঘেঁটে পাওয়া’, ‘উকুন বাছতে গিয়ে পাওয়া’ এই সব যা ইচ্ছে বলে বেড়াই। আমরা ভাবতাম বাচ্চারা শুনে খুশি হবে যে তাদের আমরা পছন্দ করে ঘরে এনেছি। তোর দিদিকে বলা হত না যে ধোপার কাপড়ের সঙ্গে ধবধবে রং নিয়েই এসেছিল? সবাই বলতাম কার বাড়ির মেয়ে কে জানে কিন্তু আমরা এরকম জিনিস একবার পেয়ে গেলে ছাড়ি না। তুই তখন হোসনি, ও পূরণ ধোপাকে দেখলে লুকিয়ে পড়ত, পাছে ওকে ফেরত চাওয়া হয়।
- গুড গড! দিদিকেও এইভাবে জ্বালিয়েছ?
মা কাঁচুমাচু হয়ে ঘাড় নাড়াল। তারপর নতুন উদ্দীপনা নিয়ে বলল – আমাকে কী বলত জানিস না? আমি ছোটবেলা একটু মোটাসোটা ছিলাম। দাদা বলত একদিন সন্ধ্যেবেলা ফুটবল খেলার পর মাঠ থেকে ফিরে দেখে বলের বদলে একটা বাচ্চা মেয়েকে পা দিয়ে গড়াতে গড়াতে নিয়ে এসেছে। তখন সে পরের দিন ফেরত দিয়ে আসবে বলে খাটের নিচে রেখে দেয়। কিন্তু পরদিন পরীক্ষার পড়া এসে যাওয়ায় তার একদম মনে ছিল না। এদিকে মা আমাকে ঘর ঝাঁট দেবার সময় পেয়ে গিয়ে ভেবেছে আগের ভাড়াটেরা ফেলে গেছে। তখন বাবা আর মা ঠিক করে - এরকম ভালো একটা বাচ্চা তো কোনোদিনও আমাদের হবে না, তাহলে একেই কেন না রেখে নেওয়া যাক? বাড়ির কাজ বেশি করাব না, এটাকে ঠেসে পড়াশোনা করাও যাতে এ সবাইকে একদিন খাওয়াতে পারে। এই গল্পটা বলার পর দাদা আমাকে বইয়ের সামনে বসিয়ে দিত আর আমিও ভাবতাম সেটাই আমার কর্তব্য।
আমাদের লজ্জাকর ইতিহাসের এই বিচিত্র উপাখ্যান শোনার পর আমি আর মা পাশাপাশি খাটিয়ার উপর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। এমন কি হতে পারে যে মায়েদের বংশে কারোই কোনোদিন নিজের ছেলে বা মেয়ে হয় না? যারা এই পরিবারে ঢুকেছে সবই ছাইয়ের গাদা হাতড়ে পাওয়া কাঠকয়লার টুকরো?
***
- মা, তোমার ছোটবেলা এ নিয়ে কখনো দুঃখ বা চিন্তা হয়নি? পরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।
মা চশমাটা খুলে আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল – আমাদের ছেঁড়া ফ্রক, পায়ে জুতো থাকত না, মাথার বিনুনির জন্য একটা রিবন অবধি ছিল না। যা খাওয়ানো হত তা-ই সঙ্গে সঙ্গে হজম হয়ে যেত, তারপর পেটে ক্ষিদে নিয়ে টো-টো করে সারাদিন ঘুরপাক খেতাম। বাড়িতে এতগুলো ভাইবোন, কেউ খোঁজ রাখত না। তখন সব পরিবারে অনেক ছেলেমেয়ে হত। কয়েকটা মরত, কয়েকটা বাঁচত। বইটই বেশি ছিল না কারো কাছে। তোরা যে এত পড়িস, আমরা তো দুটো লেখকের নাম বলতে বললে পারতাম না। ভবিষ্যত জিনিসটা কী সেটাই আমরা ভালো করে বুঝতাম না। সব কিছু আমাদের কাছে ছিল একটা বিরাট প্রেজেন্ট টেন্স। মা হয়তো কখনো আমাকে জাপটে নিজের বুকে টেনে নিয়ে মাথার চুলটা যত্ন করে বেঁধে দিত। তখন একটু একটু টের পেতাম ‘মা’ মানে কী। নইলে কে কী ধরনের আত্মীয় তাই বা কে বুঝত? দাদা আর বাবা দুজনেই আমাদের কাছে সমান গুরুত্বের অভিভাবক ছিল। দাদা শুধু একটু বেশি প্রিয়। মানে তোদের মতো এতটা চিন্তা করারই ক্ষমতা ছিল না আমাদের। একটা বেড়াল মরে গেলে বা পোষা ছাগলের ছানা হারিয়ে গেলে আমরা দুঃখ পেতাম, আবার ভুলেও যেতাম। এছাড়া আর দুঃখ কী? এখন অফিসের নতুন মেয়েগুলো অভিযোগ করে বলে – দিদি-ই-ই, বচ্চোঁ কো অ্যায়সা নহীঁ কহতে। ছেলেমেয়েদের ‘কুড়িয়ে পাওয়া’ বলতে নেই। তাহলে তাদের মন গভীরভাবে ভেঙে যায়। আমরা ভাবি এই কথাগুলো কেউ আমাদের আগে বুঝিয়ে দেয়নি কেন?
এই রে! মা আবার আমার কথা ভেবে দুঃখ না পায়। তাড়াতাড়ি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম – চিন্তার কিছু নেই, আমার মন একটুও ভেঙে যায়নি। তোমাদের চেয়ে আমাদের ছেলেবেলা অনেক ভালো কেটেছে। শুধু বাজাজ আমার পাস্ট টেন্সের কী জেনে বসে আছেন যা আমি নিজেই জানি না ভেবে আমার রাগ হচ্ছিল।
- আরে ডাক্তার বাজাজ তো তোর পাস্ট প্রেজেন্ট সবই জানেন। আমাদের পাস্টে লুকোবার মতো কিছু নেই। তিনি নিশ্চয়ই মজা করে বলেছেন, যেমন এককালে আমরা বলতাম। আমাকে তো অফিসের নতুন মেয়েগুলো বকে বকে শুধরে দিয়েছে। ওনার মতো বুড়ো আর রাগী মানুষকে কে শোধরাবে বল?
মা পানের ডিবে বের করে জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটতে বসেছিল। আমি একটা হৃতযৌবন কলা বিটনুন লাগিয়ে খাবার জন্য উঠেছি। দ্বিতীয়টা আর খাওয়া গেল না। তার বদলে দুটো ক্রোসিন মুখে ফেলে ফ্লাস্ক থেকে আরো খানিকটা চা আর একটা কুড়মুড়ে রাস্কের সদ্গতি করলাম। মায়ের সুপুরি কাটা শেষ হয়েছে। আমি মায়ের গায়ের সঙ্গে মাথাটা লাগিয়ে খাটিয়ায় শুয়ে পড়েছিলাম। মা আমার তালুর কাছে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল – তোর মুখে তো আমার বাবার মুখ কেটে বসানো।
- মা, তুমি নিজেই বলেছ আমার চোখের মতো সুন্দর চোখ, আর আমার চামড়ার মতো পালিশ করা চামড়া নাকি পরিবারের কারো নেই। সেটা সত্যি না এটা সত্যি?
- সে তো একশোবার। তোর চোখ বাবার চোখের চেয়ে অনেকগুণ সুন্দর আর বাবার চামড়া ছিল খরখরে খদ্দরের কাপড়ের মতো। তোরটা গরদ। কিন্তু বাবার চোখের ভিতরের গভীর কোনো জায়গা থেকে একটা ভরসার আলো বেরোত। তোর চোখের ভিতর থেকে ঠিক সেই জিনিসটা বেরোয়।
- কলকাতার হাসপাতাল থেকে আমার জন্মের কোনো রেকর্ড পাওয়া যাবে? তাহলে বাজাজের মুখে একটা কপি ছুঁড়ে মারি।
- এক কাজ কর না? স্কুল পাশ করে চলে যা। একটু ধরাধরি করতে হতে পারে। নিজেই বার করে আনতে পারবি। পেলে দিদিরটাও নিয়ে আসিস। তোর বেলা সার্জারিটা লাহিড়ী নিজে করেছিলেন কিনা সেটা জানার খুব ইচ্ছে আমার। তিনি যতবার বলতেন ‘চিন্তা নেই, আমি করেছি’, তাঁর পাশে দাঁড়ানো লম্বা আর সুন্দর দেখতে এক ছাত্র হাসতে হাসতে বলত, ‘না, আমি করেছি’। নাম ছিল ডক্টর দেব।
- বহুবার শুনেছি। আমি এখনই বলে দিতে পারি তোমার পেট কে কেটেছিলেন।
মায়ের শেষ প্রশ্নটা ছিল – কে? কিন্তু আমার ব্রহ্মতালুর এমন মোক্ষম জায়গায় বিলি কাটা হচ্ছিল যে তার উত্তর দেবার আগেই একটা ইচ্ছেপূরণ স্বপ্নের গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই।
পরে আমি বুঝি এই বুধ-বুখারটা আমাকে মারবে বলে কবরখানা থেকে উঠে আসেনি। এটা আমারই পূর্বপুরুষদের কেউ, হয় আমার গুড়্দা, অথবা যকৃতের ভিতর কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল, যাতে একদিন আমি নিজের ইচ্ছেস্বপ্নগুলো দেখতে শিখে যাই। গুলজারীলাল বাজাজের উদ্ভট ও বিরাট ছুঁচটাও এসেছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমল থেকে। বুধ-বুখারের সহোদের ভাইয়ের মতো সেটা এতদিন ধরে শিমলিপুরের ডাক্তারদের পোর্টম্যান্টো ব্যাগে যাত্রা করেছে এক ডোজ চেতনানাশক কার্তুজ নিয়ে। সেই ডোজের উপরে পঁয়ত্রিশ বছর ধরে একটা নাম লেখা ছিল।
আমার সেই নিরুপায় ও গ্যায়র-মর্জির ঘুমের ভিতর গুলজারীলাল এসে বলেছিলেন – ঝড় জলের এক রাত্রে আমি তোর দাদুর সঙ্গে চিল্কটের বাংলোতে আশ্রয় নিতে এসে দেখি টেবিলের উপর তোয়ালে জড়ানো একটা মাস তিনেকের বাচ্চা ট্যাঁ ট্যাঁ করছে আর বুড়ো চিল্কট ড্রপার দিয়ে তাকে জল খাওয়াবার চেষ্টা করছেন।
ঘুমিয়ে থেকেও আমি বুঝতে পারছিলাম যে এটা সেই ইচ্ছে-স্বপ্ন যার মধ্যে আমি নিজের সমস্ত প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে গুলজারীলাল সব জিজ্ঞাসার গোড়া যেখানে, সেই চিল্কটের বাংলোতে আমাকে ডেকে তারপর এক ফুঁয়ে ঘরের সব ইলেক্ট্রিক আলোগুলো নিভিয়ে দেন। সন্ধ্যে হতে যাচ্ছিল। রাস্তার উলটোদিকের টিলার উপর দিয়ে অস্তগত সূর্যের ক্ষীন আভা আসছে। আমি জানতাম একটা ফোর্থ হিউম্যানের গল্প শুনব বলে জ্বরের মধ্যে বহুদূর থেকে বাদামী পাতা ঝরা বনের পথ অতিক্রম করে এসেছি। সেরকম বন কুমায়ুঁতে অনেক দেখলেও, শিমলিপুরে তার আগমন ছিল অতি বিরল। বুধ-বুখারের স্বপ্নে ঢুকে নিজের সঙ্গে তর্কে গেলাম না। আমার মন ছিল বাজাজের দিকে যিনি ভাবুক হয়ে স্মৃতিচারণ করলেন - হামফ্রি চিল্কট প্রথম যে কথাটা বলেছিলেন সেটা হল – তোমাদের মধ্যে কে যাওয়ার সময় বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নাও।
তখন বাজাজ আর আমি টেবিলে বসে বোর্নভিটা খাচ্ছি। যে গল্পটা শুনছিলাম তা আসলে আমার আগেই জানা কারণ একটা গরিলা সেদিনই সকালে আমাকে ঘুমের ওষুধ দেবার পর সেটা শুনিয়ে গিয়েছিল। পরে বুঝি যে আমি আশা করেছিলাম স্বপ্নের ভিতরে কোনো জাদুবলে এই দুঃখের গল্পটা আশা আর আনন্দের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
বাজাজকে এখন অনেক বেশি সতর্ক আর স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল, এবং আমাকে আর তিনি কথায় কথায় অপমান করছিলেন না। সকালে যেখানে থেমেছিল সেখান থেকেই আবার গল্পের খেই ধরেন গুলজারীলাল। তিনি বললেন - বুঝতেই পারছিস, তোর দাদু আর আমি আকাশ থেকে পড়েছি। পার্টিশানের সময় কত বাচ্চা হারিয়ে গেছে, কত বাবা-মার বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। সে সব আমার চোখের সামনে হয়। তবু এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি যখন কেউ আমার ঘাড়ে একটা তিনমাসের বাচ্চা চাপাতে চাইছে। তোর দাদুর ততদিনে সবকটা ছেলেপুলে হয়ে গিয়েছে, অনেকে বড়োও হয়ে গেছে। আমার নতুন বিয়ে, কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। স্যানদাদা আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে দিল। বুড়ো হামফ্রি বলল – গুলজারীলাল, চিন্তা করিস না। এটা একটা ট্যাম্প্ররি অরেঞ্জমেন্ট। পর্মন্যান্ট প্ল্যাসমেন্ট করছি শীগ্গীরই।
প্রশ্ন ওঠে, চিল্কট কোত্থেকে তুলে আনল শিশুটা? তার চুল, চোখ সব লাইট ব্রাউন। গা ফরসা। মোঘল মিনিয়েচার লুক্স্। আমি আর স্যান-দাদা দুজনেই ভাবছি বুড়োর নিজের অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান বাচ্চা নাকি। চিল্কটের স্টোরি অনুযায়ী, দুপুরবেলা তাঁর দরজার বাইরে একটা আর্মির ক্যানভাস ব্যাগ ফেলে কেউ চলে গেছে। ব্যাগের ভিতর ছিল একটা আর্মির লোকের জামাকাপড়। মোজা, টুপি, ব্ল্যাঙ্কেট। সব কিছুর মাঝখানে খবরের কাগজে জড়ানো একটা মোড়কও রাখা। পেঁপে জাতীয় ফলটল হবে ভেবে চিল্কট খোশমেজাজে র্যাপার খুলে পেলেন একটা বাচ্চা। বুঢ্ঢা সাহিব চোখের সামনে ক্যানভাস ব্যাগটা এনে না দেখালে আমরা কেউ এরকম একটা গল্প বিশ্বাস করতাম না। তার মধ্যে যে জামাকাপড়গুলো ছিল, সেগুলো নিঃসন্দেহে অন্য একটা লোকের। কোথায় তাহলে সেই লোকটা? আর কোথায় বাচ্চার মা?
বোর্নভিটার কাপে চুমুক দিয়ে আমি মাথা নাড়িয়েছিলাম। আশ্চর্য, কোথায় এর মা? মা ছাড়া তো বাচ্চা হয় না।
যৎসামান্য ঘাড় নেড়ে আমার সম্মতি অনুমোদন করার পর বাজাজ বলে চলেন - বাচ্চাটাকে তোয়ালে সমেত বর্ষাতির ভিতর পুরে বাড়ি নিয়ে এলাম। তারপর থেকে অ্যাভরি ডে অ্যাট মিডনাইট একটা ড্রামা রিপীট হতে থাকে। দিস চাইল্ড উড টর্ন ব্লু, অ্যাণ্ড ইট্স্ হার্ট উড কফ্, স্পটর্, অ্যাণ্ড ডাই। প্রত্যেক দিন রাত বারোটার সময় বাচ্চাটা নীল হয়ে গিয়ে কাশতে শুরু করত। এবং মিনিট তিনেক পর দেখতাম দিল কী ধড়কন বন্দ্ হয়ে গেছে। তখন আমার বউ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে – হে রব্বা, বলে একটা ভয়ংকর চিল্লানা চিল্লাত। সেই আওয়াজে বাচ্চার হার্ট আবার চালু হয়ে যাচ্ছিল। আর কোনো ডাক্তারি করতে হত না, এবং সত্যি বলতে কি, আমার বউ হার্টটা চালু না করে দিলে আমার করারও কিছু ছিল না। চিল্কট আর আমি ভালোভাবে ক্লিনিকল এগ্জামিনেশন করি। প্রত্যেকটা ইন্টরনল অরগ্যান সাধারণ বাচ্চার তুলনায় দুগুন সাইজের। কোনোমতে চামড়া দিয়ে বিরাট পেটটা যেন র্যাপ করা। এমনটা আমরা কোনোদিন দেখিনি। ওরকম বেঢপ একটা বডি নিয়ে শিশুটার জন্মের আগেই মরে যাওয়ার কথা। অথচ প্রত্যেক রাতে বাচ্চাটা একবার করে মরে আবার বেঁচে উঠত। চিল্কট আর আমার সন্দেহ ছিল না যে মায়ের পেট থেকে বেরোনো মাত্র এই সিলসিলা শুরু হয়। আমাদের হাতে আসার আগেও তিন সপ্তাহ ধরে কেউ রাত্রিবেলা ওকে রিস্টার্ট করে গেছে। কিন্তু সেটা কে?
ব্রিটিশ যুগের ভেঙে পড়া কোয়ার্টারের মতো পরিত্যক্ত লাহোরী সার্জেন বাজাজ একটু থেমে নিজের মোটা মোটা আঙুলের গাঁট টেনে নিচ্ছিলেন। যেন আরেকটু অপেক্ষা করলেই আমি তাঁর জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে দেব। পরে আমার কাছ থেকে কোনো মন্তব্য না পেয়ে নিরাশ হয়ে তিনি বললেন - বোকার মতো মাথা নাড়াচ্ছিস কেন? আমি কোনো জবাব দিইনি, কারণ কোনো খানা বা পীনা ভালো লাগলে আমার মাথা সত্যি বোকার মতো নড়তে থাকে, এটা আগেও জানতাম।
বাজাজ বললেন - বাচ্চাটার কী নাম দিয়েছিলাম শুনতে চাইছিস? ছিল একটা ভুলে যাওয়ার মতো নাম। সেটা এখন বলে কোনো লাভ আছে?
- নো। মাথা নাড়ানো বন্ধ করে আমি গুলজারীলালকে সংক্ষেপে জানালাম।
- ভ্যারি ওয়েল। তো এই বার বার থেমে যাওয়া ইঞ্জিন আর কতদিন চলবে, সেটাই আমাদের প্রধান উদ্বেগ তখন। আমার বউ বিশ্বাস করত যে হার্ট চালু করে দেবার পর ওর ট্যাম্পর্ম্যান্টটা প্রত্যেকদিন বদলে যায়। আজ হ্যাপ্পি, তো কাল স্যাড। কাল খুব চুপচাপ তো পরশু সারাদিন হাসি। হোয়াই? যেন অ্যাভরি ডে তার মধ্যে একটা নতুন পর্স্নালটি চলে আসে, এবং রাতের বেলা ঘড়ি ধরে বারোটার সময় যখন তার হৃদয়ের গতি স্তব্ধ হয়ে যায় তখন সেটা বিদায় নেয়। একমাস পরে আমার ওয়াইফের মনে একটা অন্ন্যাচুরাল বিলীফ আসতে থাকে। একটা অপ্রাকৃত বিশ্বাস – যে আসলে রোজ এই শিশুর শরীরে একটা নতুন আত্মা জন্ম নেয়, এবং দিনের শেষে তার লাইফটাইম ওভর হয়ে যায়।
গল্পটার মধ্যে থেকে বিপদ আর বিকৃতির গন্ধ আসা সত্ত্বেও সব কিছু বড্ড বেশি ভালো লাগছিল। বললাম - মাই গড! আপনার বোর্নভিটাতে কি কিছু মেশানো থাকে?
গুলজারীলাল আমাকে ধমকে বললেন - বোর্নভিটা আমার নয়, তোর। তুই বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিস।
- কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো শুধু চা খাওয়ায়।
- ফিজুল না বকে শোন। আমি স্যানদাদা আর হামফ্রি চিল্কটের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি। চিল্কট সারাজীবন সাধুবাবা আর ফকিরদের বুজরুকির ফাঁদে পা দিয়ে এসেছেন। সবরকম সুপর-ন্যাচুরল ঘটনায় বিশ্বাস করতেন। স্যানদাদাও ভূতপ্রেত মানতে রাজি, কিন্তু তাঁর মতে ভূতেরা অনেকটা শেয়াল গোত্রের জীব। ভয়ের চোটে মানুষদের ধারে কাছে আসে না। একবার বডি ছেড়ে খোলা হাওয়ায় মুক্ত হয়ে যাবার পর তারা আবার শরীরের খাঁচায় ফিরে আসতে চাইবে কেন? তো আমি বললাম – আর যারা বডি ছেড়ে বেরোতে চায়নি? যাদের জোর করে বডি থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল তারা?
বাজাজের এই প্রশ্নটার উত্তর আমার আগে জানা ছিল, কারণ সকালে ঘুমপাড়ানি ইঞ্জেকশান দেবার পর একটা গরিলা আমার শরীরটাকে এপাশ ওপাশ করে কিছু পরীক্ষা করার সুযোগে সেটা আমায় বলে দেয়। আমি স্বপ্নের বাজাজকে তাঁর নিজের বলা উত্তরটা শুনিয়ে দিই – তারা তো মানব দেহেই ফিরতে চাইবে, তাই না?
বাজাজ বললেন – দ্যাট্স্ আবভিয়স। যাহোক, আমার মুখে এটা শুনে সবাই চুপ্প। দ্য মেম্রি আফ পার্টিশন ওয়জ ফ্র্যাশ ইন আওয়র মাইণ্ড্স্। আমরা সকলে ভাবছিলাম, পার্টিশনের ভায়লেন্সের শিকার যারা হয়েছিল তাদের বডিগুলো তো এখনো যমুনা দিয়ে ভেসে আসে। সেই সমস্ত আত্মাগুলো যদি লাইন দিয়ে এই বাচ্চাটার মধ্যে ঢুকবে বলে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে এটাই কি স্বাভাবিক নয় যে চব্বিশ ঘন্টা পুরো হয়ে গেলে পরের জন ঠেলা দিয়ে আগের জনকে বাডি থেকে বার করে দেবে? হাত জোড় করে আমি চিল্কটকে বললাম – একটা কিছু ব্যবস্থা করুন কারণ আমার ওয়াইফ নিজেই এই ভূতুড়ে বাচ্চাটাকে ভয় পেতে শুরু করেছে। চিল্কট বললেন - এক সপ্তাহ টাইম দে। তোদের দুজনকে খুশি করে দেব।
- গুড! গুড! চিল্কটের আশ্বাস পেয়ে খুশি হয়ে বললাম আমি।
- খাক্ গুড! কীসের গুড? খেঁকিয়ে ওঠেন তমীজদার লাহোরের অওলাদ। - এক হফ্তা পরে বুড়ো হামফ্রি ঠিকই একটা গজব কাণ্ড করে দেখান। কিন্তু আমরা যা চেয়েছিলাম তা নয়। আরেকটা বাচ্চা এনে হাজির করলেন কোথা থেকে! এবারেরটা নাকি এসেছিল প্যাকিং বাক্সে। আমার বউ তো খুশিতে পাগল হয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছে। এই বাচ্চাটা অবশ্য রোজ মরত না। তিন চার দিনে একবার এটা নীল হয়ে যেত। হার্টটাও আধ মিনিট পরে নিজের থেকে চালু হয়ে যাচ্ছিল। চিল্কট ভীষণ অনুতপ্ত ভাব দেখিয়ে বললেন – আর একটা হফ্তা দে ভাই, সব ঠিক করে দিচ্ছি। তখন আমি আর স্যানদাদা বললাম যথেষ্ট হয়েছে, আপনাকে কিছুদিনের জন্য শিমলা চলে যেতে হবে, নইলে এই বাচ্চার ট্রেন বন্ধ হবে না। বুড়ো নিজেও ঘাবড়ে ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই নিজের বাংলো ছাড়তে রাজি হলেন না…
এইখানে এসে অকস্মাৎ শুরু হওয়া কিস্সাটা তেমনই হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। আলোর অভাবে বোঝা যাচ্ছিল না আমি ছাড়া ঘরে আর কেউ আছে কিনা। তাহলে কি আমি এতক্ষণ একাই বাংলোটাতে ঢুকে বসে ছিলাম? টেবিলের উলটোদিকে কেউ আছে কিনা সেটা ঠাহর করার চেষ্টা করি। মনে হল বাজাজ কিছু একটা খুঁজবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন। অন্ধকারে আমি তাঁর মুখ দেখতে পেলাম না।
***
- তো সে রাতে আমি আর স্যানদাদা চিল্কটের বাংলোর রাস্তায় একটা গাছের পিছনে লুকিয়ে ছিলাম।
কিছুক্ষণ গায়েব থাকার পর নিজের যকৃত কিংবা হৃদয় থেকে ছেঁড়া টাটকা মাংসের টুকরোর মতো লাল কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে ফিরে এসে বলছিলেন বাজাজ। মোমবাতিটা টেবিলের উপর ব্যালান্স করে দিয়ে তিনি বললেন - সন্ধ্যে হতেই দেখি বুড়ো সার্জেন চিল্কট এক ছালা ভর্তি কাগজের ঠোঙা আর একটা টুপি এনে দরজার সামনে রেখে গেছেন। তারপর অন্ধকার ফুঁড়ে প্রেতের মতো কখনো একজন মেয়েছেলে, কখনো একটা আট বছরের ছোকরা এসে সেই ঠোঙার মধ্যে থেকে একটা বা দুটো তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। কেউ কেউ টুপিতে হাত ঢুকিয়ে কিছু রেখে যাচ্ছে। পুরো ছালাটা খালি হয়ে যাবার পরেও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম আমরা। পরে চুপি চুপি দরজার কাছে গিয়ে দেখি টুপির ভিতর আধডজন পুরোনো সোনা আর রূপোর সিক্কা। আমি কিছু বলার আগেই স্যানদাদা সেগুলো কুড়িয়ে নিজের পকেটে ভরতি করে নেন।
- দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমার দাদু পরের জিনিস না বলে নিতেন? প্রমাণ ছাড়া এটা আমি মানতে পারছি না। এবং ঘটনাটা সত্যি ঘটে থাকলে সেই মোহর আমরা পেলাম না কেন? কোথায় গেল সে সব?
- সবুর কর। সব জানবি। পরের দিন সায়েব হাসপাতাল থেকে ফিরবার আগেই আমরা তাঁর জন্য বাংলোর বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। একসঙ্গে তিনজন ঘরে ঢুকি। বেশ মনে আছে আমি কিচেন থেকে চা বানিয়ে আনলাম। সেটা নিয়ে তিনজনে ডাইনিং টেবিলটাতে বসেছি। স্যানদাদা তখন এক এক করে পকেট থেকে সোনা আর রূপোর মোহরগুলো বার করে টেবিলে রাখতে আরম্ভ করলেন। এক মিনিট মৌন থাকার পর হামফ্রি সায়েব উঠে ভিতরের ঘর থেকে একটা স্যুটকেস টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসেন। সেটা খোলার পর আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। সোনা-রূপোর কয়েন ছাড়াও, পুরোনো খঞ্জর, তমঞ্চা, জুতো, বাজুবন্ধ, জং ধরা তলোয়ার, কোমরবন্ধ সব মিলিয়ে একটা গোটা থিয়েটারের সরঞ্জাম দিয়ে সেটা ভরতি। একবার দেখেই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম যে দেড়শো-দুশো বছর পুরোনো হলেও তার একটা মালও নকল নয়। - খাবারের দাম হিসেবে এগুলো দিয়ে যায় ওরা। চিল্কট জানালেন আমাদের।
- ওরা মানে কারা? ভুরু নাচিয়ে শুধিয়েছিলাম আমি।
- আরে ঘন্চক্কির ঘোঞ্চু, আমরাও কি সেটাই জিজ্ঞেস করিনি? চিল্কট বললেন – কে বলতে পারে? নিজেরাই তো জানে না। যারা সন্ধ্যেবেলা আমার কাছে আসে তাদের ধারণা তারা মাটির ভিতর থেকে সবে জেগেছে। কে কবে ঘুম পাড়িয়ে চলে গিয়েছিল। এখন উঠে দেখে ওদের পৃথিবীটা আর নেই। দু-বছর ধরে এদের যমুনার আশে পাশে ঘুরে বেড়াতে দেখছি। প্রায় সবই মহিলা আর বাচ্চা। পুরুষ লোকগুলো মিসিং। আমি এদের ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে বানিয়ে খাওয়াতাম। এখন যেন সবাই সেটার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ মনে হয় না সত্যি কারো নিউট্রিশানের প্রয়োজন আছে। আমরা বললাম – বেঁচে থাকতে গেলে কিছু তো খেতে হবে। সারাদিনে কয়েকটা ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেয়ে বাঁচা যায়? চিল্কট বললেন – স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছে কিনা সেটাও কি নিশ্চিত? আমার মনে হয় ওদের হার্ট খুব ধীরে চলে। বাচ্চাদুটোকে ওরাই রেখে গিয়েছিল আসলে, ক্যানভাস ব্যাগের গল্পটা বানানো। প্রথম বেবিটা আসে কাঁসার থালায়। বোধহয় তার মা এতদিনের হাইবরনেশন সরভাইভ করলেও চাইল্ড বর্থ সরভাইভ করেনি।
- শুধুই মহিলা আর শিশু? আর ইউ শিওর? গল্পের ফাঁক ধরাবার জন্য বাজাজকে জিজ্ঞেস করি।
- ট্রস্ট্ মী। শুধু মহিলা আর শিশু। আমাদেরও পর্মন্যান্ট খটকা লেগে গিয়েছিল। স্যানদাদা বললেন – এর কি কোনো মানে হচ্ছে? সঙ্গে একটাও পুরুষ লোক না থাকলে নিউবর্ন বেবিরা এল কোত্থেকে? আশা করি ইউ নো হোয়াট দ্যাট মীন্স্। তো এত কাণ্ডের পর নির্লজ্জ চিল্কট আমার বউকে তার সাহায্যের পুরস্কার হিসেবে কয়েকটা মোহর দিতে চেয়েছিলেন। স্যানদাদা আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন – গুলজারীলাল, লোভ করিস না। তুই ফ্যামিলিদার লোক। এই মোহরগুলোতে অভিশাপ আছে। স্যানদাদার কথামতো আমি মোহরগুলো ফিরিয়ে দিই। চিল্কট সেগুলো কাকে দিলেন আমরা শেষ পর্যন্ত জানতে পারিনি। ভদ্রলোকের নিজের তো তিনকুলে কেউ ছিল না। থাকতেনও সাধারণ মানুষের মতো। তবে একটা খঞ্জর উনি পরে আমাকে দিয়ে যান। বাঁকানো মোগলদের ছুরি। উপরে চামড়ার খাপ। ব্লেডটা ভোঁতা কিন্তু স্টিলের হ্যাণ্ডেলে নিখুঁত বাজপাখির নকশা। সেটা আমার কাছে এখনো আছে।
- আমাকে আপনি সেটা না দিয়ে একটা গ্রেনেড দিতে গেলেন কেন? আমার নিজস্ব ইচ্ছেস্বপ্নে গুলজারীলালের কাছে অনুযোগ করলাম আমি। - দিতেই যদি হয় তো একটা নিরাপদ জিনিস দেওয়া উচিত নয় কি? ভোঁতা খঞ্জর আর ফিউজ উড়ে যাওয়া বাল্বের চেয়ে ভালো গিফ্ট কটা আছে পৃথিবীতে?
বাজাজ বোর্নভিটার কাপ সরিয়ে রেখে হঠাৎ হাসতে শুরু করেন। – আগে হুইস্কি ছাড়া আর কোনো ড্রিঙ্ক খেতাম না। আজ তোর জন্য বোর্নভিটা খাচ্ছি। কারণ এই উল্লু-কী-দুম স্বপ্নটা তোর। কিন্তু স্টোরিটা যে এখনো আমার তা ভুলে যাস না। এক এক করে সব জিনিস বলতে হয়। নইলে না থাকে মানে, না থাকে মূল্য।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমার স্বপ্ন এবার শেষ হতে চলেছে এবং চাইলেও গায়ের জোরে গুলজারীলালের গল্পে এক ফোঁটা আনন্দ বা প্রফুল্লতা মেশাতে পারব না। বললাম - ঠিক হ্যায়, আপ আগে বঢ়িয়ে।
গুলজারীলাল বললেন - পরে চিল্কট সেই অন্ধকারের মহিলাদের বিষয়ে একটা অবাক করা তথ্য দিয়েছিলেন। ম্যানি আফ দ্যাম ওয়্যার স্টিল প্র্যাগন্যান্ট। চিল্কট মানতেন কারো কারো পেটে এখনো বাচ্চা আছে। সেগুলো এই বছরেই পয়দা হবে। কে ওদের পেটে বাচ্চা দিয়েছে সেটা অবশ্য কারো মনে নেই। তারা শুধু জানে সদ্য একটা লম্বা ঘুম থেকে এক এক করে উঠছে সবাই। প্র্যাগন্যান্ট হয়েই কি তবে ঘুমোতে গিয়েছিল? সেটা কবেকার ঘটনা? ব্রিটিশ পিরিয়ডের, না মোঘল? চিল্কট বিশ্বাস করতেন বাচ্চাগুলো একটা অন্য যুগের আনবর্ন বেবি। যে শিশুগুলো জন্মাতে পারেনি, মায়ের পেটে শুয়েই যাদের কবর হয়েছিল তারা মায়ের ঘুম ভাঙার পর একটা অন্য যুগে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। এদের ইন্টর্নল আরগনগুলো মাটি আর সময়ের চাপে তেড়ে-বেঁকে গিয়েছিল। তাই যখন তখন হৃদয়ের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়।
- গুলজারীলালজী, এগুলো কি সব ভূত?
- ভূত নয় ঘোঞ্চু, অ্যাকচুয়াল হিউম্যান্স্। যারা বাঁচতে চাইছিল। বাংলোর সামনে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে এরা আমাদের পাগলা সাহেবের কাছে দয়া ভিক্ষা করত। চিল্কটের পুরো মাইনে চলে যাচ্ছিল এদের খাওয়াতে। ভূতেদের কেউ খাওয়ায়?
- ঘুরে ফিরে আপনার গল্পে সেই এক জিনিস - হয় যমুনায় ভেসে আসা জিন্দা লাশ, অথবা মাটির কবর ছেড়ে উঠে পড়া অসহিষ্ণু দেহ। তারা সবাই, অফ অল পীপ্ল্, একজন লাশকাটা অটপ্সি সার্জেনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে যাবে কেন?
- দ্য সায়ল্ ইজ ফুল আফ লাইফ। এই মট্টিটা জ্যান্ত খোত্তে। তোর পায়ের নিচে কী আছে তুই জানিস না। ইট হ্যাজ অ্যাভ্রিথিং।
- আচ্ছা, যে বাচ্চাদুটো আপনাদের কাছে ছিল তাদের কী হল?
- সত্যি বলতে, আমি হাত ঝেড়ে ফেলেছিলাম। স্যানদাদা আর চিল্কট মিলে বিলি করে দেন। আন্দাজ করি শেষ পর্যন্ত আর কাউকে এই অশৈলি শিশু গছাতে না পেরে বুড়ো হামফ্রি তাদের আবার নিজের দরজার বাইরে রেখে দিয়েছিলেন। পরের দিন আর পাওয়া যায়নি। অন্ধকারের মহিলাদের কেউ এসে তাদের ফেরত নিয়ে যায়।
আর সেই গুনাহের বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে না পেরে তারপর আমাদের ডর্টি সাহিব কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে আস্তে আস্তে পাগল হতে থাকেন। যমুনার ধারে বালি আর টিলার উপর সারাদিন তিনি কিছু খুঁজে বেড়াতেন। স্যানদাদা আর আমি একবার লুকিয়ে ফলো করি। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে জঙ্গলের ধারে চলে গিয়েছিলাম। ফকিরের মতো ছেঁড়াখোঁড়া জামা পরা চিল্কটেরই সমান এক বুড়ো বসে ছিল সেখানে। চিল্কট তার পাশে মাটিতে আসন নেন। তারপর আমরা তাঁকে ঝোলা থেকে দুটো কাগজের ঠোঙা বার করে ফকিরের দিকে এগিয়ে দিতে দেখি। সেদিন চিল্কটের সঙ্গে সেই লোকটা অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেয়ে গিয়েছিল।
এইভাবে প্রায় বছর দেড়েক সেই উদ্ভট ভুঁইফোঁড় মানুষগুলোর মধ্যে কিছু খুঁজতে খুঁজতে চিল্কট একদিন বোধহয় যা খুঁজছিলেন সেটা পেয়ে যান। আর তাঁকে আমরা দেখিনি। এইখানে ডর্টি সাহিবের কিস্সা খতম, এবং আমারও এর বেশি কিছু বলার এক্তিয়ার নেই।
বাজাজের গল্পে ছেদ পড়ার পর আমরা দুজন যে কতক্ষণ ধরে চুপচাপ বোর্নভিটা খেয়ে চলেছিলাম তা আমি মনে রাখতে পারিনি। এক একটা চুমুকের পর চোখ বুজে তরলটাকে গলা দিয়ে নামতে দেবার সময় বুঝতে পারি বাজাজও আমার দেখাদেখি সেই কায়দাটা রপ্ত করার চেষ্টা করছেন। - জীবনে কোনোদিন এটা খাইনি ঘোঞ্চু। কিন্তু আজ কোনো উপায় নেই আমার। আমাকে বললেন গুলজারীলাল।
- ভালো লাগছে? কোমলভাবে জিজ্ঞেস করি শিমলিপুরের বদরাগী বুড়োকে। - আমরাও পাই না বেশি। এটা খেলে মনের সব ক্ষোভ, সব নালিশ দূর হয়ে যায়।
- ইট ইজ ট্যারিবল্! একটা কাদা আর চিনির নালায় চুমুক দিচ্ছি যেন। বাট দিস ইজ ইয়োর ড্রীম। আমার আর কিছু কনফ্যাস করার নেই। তাই আমরা মুখোমুখি চেয়ারে অনেকক্ষণ ধরে এটাতে চুমুক দিয়ে পরস্পরের বিশ্বাস অর্জন করব।
পরে অবশ্য শিমলিপুরের কংসরাজ আমায় আরো একটু বলেছিলেন। বড়মামার কাছে শুনে এসেছি পার্টিশানের সেই তিন চারটে বছর এই এলাকাটায় লাশের রেলগাড়ি লেগে যায়। কাতারে কাতারে ভেসে আসত নদীতে। আমি সেই সব দিনের কথা ভাবছিলাম। বাজাজ আমার মনের কথা শুনে ফেলে বললেন – শুধু কি নদী? বৃষ্টির সঙ্গে আকাশ থেকে ধড়াধ্ধড় পড়ত লাশ। আটপ্সির পরে সব কটাতে মাটিতে ফেরত পাঠাতাম আমরা। কিন্তু যতগুলো দেহ মাটিতে ঢুকত প্রায় ততগুলোই বেরিয়ে আসছিল সেখান থেকে রোজ। ভিজে ক্ষেত থেকে বাষ্পের মতো উঠে পড়ত অচ্ছুত শরীর।
- অচ্ছুত? আপনি না সার্জেন?
- তারা মানুষের স্পর্শ এড়াত। যাতে অন্তত আমরা সুস্থ হয়ে বাঁচি। তকদীরের সামনে কেউ কিছু না। লকীর কা ফকীর। আমাদের কোনো ক্ষমতা ছিল না প্রকৃতিকে আটকাবার। শুধু ট্যাকনিক ফালো করতাম। কেন তোকে আটপ্সি রুমে প্রসিজর্ ইজ কিং বলেছিলাম জানিস? যখন সার্জেনের কোনো পাওয়ার থাকে না তখনও তার হাতে একটা তাস থাকে। সেটা হল প্রসিজর্। বস্তির বাড়িতে ঢুকে টার্চের আলোয় অ্যাপেন্ডিক্স বার করার সময় কখনো সেই তাসটাকে বলে লাইগেশন, কখনো বলে পর্স্ স্ট্রিংগিং। বুঝলি কিছু?
শব ব্যবচ্ছেদ ঘরে গুলজারীলাল আমাকে হাতে কলমে একটা মানুষের শরীর অংকের মতো ভেঙে ফেলার পদ্ধতিগুলো দেখিয়েছিলেন। আমি তাঁর মন রাখার জন্য বললাম - একটু একটু।
বাজাজ টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ছিলেন। যেন প্রকৃতির কাছে হার মানা দিনগুলোর স্মৃতি তাঁর সাদা চুল ভর্তি মাথাটাকে ভারাতুর করে দিয়েছে। - তুই দয়া করে বোর্নভিটার কাপ দুটো ধুয়ে আমার ল্যাট্রিনটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবি তো?
***
আমি কাপদুটো তুলতে তুলতে বাজাজকে বলেছিলাম – গুলজারীলালজী, এখনো কিন্তু গ্রেনেডটা কী করে আপনার হাতে এল সেটা জানাননি। আমার দাদুরই বা কী ভূমিকা ছিল তাতে?
বাজাজ আস্তে আস্তে উঠলেন। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে ভিতরের ঘর থেকে একটা ধারালো খঞ্জর নিয়ে এসে মোমবাতির আলোয় আমার বাঁ হাতে এক ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিয়ে বলেন – এটা তোর চাই?
আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠে বললাম - হোয়াট অন আর্থ আর ইউ ডুইয়িং? ক্ষেপে গেলেন নাকি? খামোখা আমাকে ছুরি দিয়ে মারছেন কেন?
- তোকে বোঝাবার জন্য যে ফার্টি স্যাভিনে যে জিনিসটা ভোঁতা ছিল সেটা এইটি থ্রিতে ভোঁতা নাও থাকতে পারে। চিল্কট এটা আমাকে তাঁর উইলে দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রচণ্ড কাজের জিনিস। এটা তোকে দেব কেন? এটা আমার উত্তরাধিকারীরা পাবে।
গায়ের জোরে খঞ্জরটাকে বডি থেকে বার করে দিয়ে বললাম – পাগলামি করবেন না। আই ওয়জ জোকিং। আপনার কোনো জিনিস আমি চাই না। ল্যাট্রিনও পরিষ্কার করব না। আমি চললাম।
- তে-এ-রী-ই তো অ্যায়সী কী ত্যায়সী!
বাজাজ আমার কাঁধ দুটো গরিলার মতো থাবা দিয়ে ধরে আমাকে আবার চেয়ারে গেঁথে ফেলেন। মোমবাতির শিখা তাঁকে সাহায্য করার জন্য সাপের জিভের মতো লকলকিয়ে আমার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে পুড়িয়ে দেবে ভয় দেখাচ্ছিল। – চিল্কট উইলে লিখেছিলেন তাঁকে খুঁজে পাওয়া না গেলে এই বাংলো আর ল্যাবরেটরিটা আমি পাব। বাঘের মতো গম্ভীর গলায় বলছিলেন বাজাজ। - কিন্তু এই বাংলোর ভিতরে আর যা কিছু আছে সব যেন তোর দাদুকে দিয়ে দেওয়া হয়। স্যানদাদা আর আমি এসে দরজা খুলে দেখি বুড়োর বাড়ি বিলকুল সাফ। চেয়ার টেবিল আসবাব সব উধাও। মোহর-টোহর কিচ্ছু নেই। মোঘল আমলের একটা চুল কি দাড়িও পড়ে নেই কোথাও। চিল্কটের নিজস্ব জিনিস গায়েব। একটা চিনির গুঁড়ো অবধি পড়ে নেই যে পিঁপড়েরা খাবে। শুধু বসার ঘরের মেঝের উপর আমাদের হ্যালো বলার জন্য সেই হাঁ করা ক্যানভাসের ব্যাগটা পড়ে ছিল যেটা চিল্কট তার ভিতরের সমস্ত মাল সমেত এক মার্কিন সোলজারের কাছ থেকে কিনেছিলেন বলে জানতাম আমরা।
- মার্কিন সোলজার! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যারা এসেছিল? তারা শিমলিপুরেও পা দিয়েছিল নাকি? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
- আসবে না কেন? ক্যান্টনমেন্ট এখানে। যমুনা এখানে। দিল্লীতে যতবার আর্মি ঢুকেছে ততবার লায়লিটিলা থেকে মচ মচ করে জুতোর শব্দ শোনা গেছে রাত্রিবেলা। তবে এই দামি ব্যাগটা কোনো নেশায় চূর বাচ্চা ছেলের কাছ থেকে কনট প্লেসের রাস্তায় হাতানো। বেচারার ফুর্তি করার পয়সা ফুরিয়েছিল। তো সেই ক্যানভাসের খোলের মধ্যে এবার আগের জিনিসগুলো ছাড়াও দুটো গ্রেনেড পাওয়া যায়। দিনকাল ভালো ছিল না, তাই গ্রেনেড পেয়ে আমরা কেউ বিন্দুমাত্র ভয় পাইনি। উলটে খুশি হয়েছিলাম। স্যানদাদা আমাকে একটা রাখতে দিয়ে অন্যটা নিজের সঙ্গে নিয়ে যান।
খানিকক্ষণ বিরতি দিয়ে বাজাজ আমার কাঁধ ছেড়ে দিলেন। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো তাঁর মল্লবীরের মতো চওড়া দেহ একটা সীমিত মোমবাতির আলোয় সবটা ধরা পড়ছিল না। অন্ধকারের সার্জেনরা নিপুণ হাতে সেই ক্যাডাভারের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সরিয়ে ফেলছে। গুলজারীলালের ছায়াদেহ মিলিয়ে যাওয়ার আগে বলল - এই হচ্ছে সেই স্টোরি যেটা শুনতে তুই পাক্কা দুমাস ধরে বেতাব ছিলিস আর আমি তোকে বলব বলে মাত্র ষোলো বছর অপেক্ষা করে ছিলাম।
- গুড গড! মার্কিন সোলজার তার ব্যাগের ভিতরকার পার্সোনাল জিনিসগুলো রেখে নিল না কেন? সে সব নিজের ছাড়া আর কার কাজে লাগে?
- কারণ সেগুলো রাখার জন্য তার কাছে কোনো ব্যাগ ছিল না! গুলজারীলাল আমার মূর্খতায় হতাশ হয়ে বললেন। - যাহোক, যে হাথ-গোলাটা আমার জিম্মায় এতদিন ছিল সেটা আসলে তোর দাদু আমাকে সেফটির জন্য ধার দিয়েছিলেন। দেশ ছেড়ে যাবার আগে তোর কাছে জমা করে দিয়েছি। আমার অকাউন্ট ক্লোজ্ড্। কে বলতে পারে, যদি না ফিরি? ওটা নিয়ে প্লেনে ওঠাও যায় না। আমার উপহার নয়, তোর দাদুর স্মৃতি ভেবে যা করার করিস।
- আর যেটা দাদুর কাছে ছিল? সেটা?
- আঃ। এর আগে একটা গ্রেনেড যার হজম হচ্ছিল না, এখন তার দুটো চাই? শাবাস বেটা। টাইট আণ্ডারওয়্যারের ভিতর দু-দুটো গ্রেনেড প্যাক করে রাখতে চাস তুই। গুলজারীলালের বাপ হতে চাস। তাহলে তো এই দ্বিতীয় গ্রেনেডটার যে নিজস্ব কাহিনী আছে সেটাও জানতে হয়। কিন্তু অফসোস্ খোত্তে, আই রিগ্র্যাট টু ইনফার্ম দ্যাট আওয়র টাইম ইজ অপ্। ইউ মাস্ট গো নাও।
ল্যাট্রিনে সাপ-খোপ উঠে আসে। মোমবাতিটা সঙ্গে নিয়ে যাস।
বাজাজ তাঁর অবিশ্বাস্য শিমলিপুরানের পুরোটা কেন শোনাচ্ছেন না তা আমি একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছিলাম। সেই ইন্দ্রিয়টার নাম সন্দেহ। কারণ যা বলা হয়েছিল তার মধ্যে অন্য একটা লুকোনো ইতিহাসও আছে। সেই উপাখ্যান চিল্কট নামের কোনো ময়লা সাহেব বা আমার দাদুকে নিয়ে নয়। সন্দেহের একটা পোকা আমাকে খুঁচিয়ে বলছিল শিমলিপুরের সাইকোপ্যাথ নিজেই গল্পের একটা অধ্যায় জানতেন না। তিনি চাইছিলেন আমি সেটাকে খুঁজে বার করি। বাচ্চাদুটো মেল না ফিমেল তাও সেই কারণেই ইচ্ছে করে বলা হয়নি।
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার পিছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমি সেটা টের পেয়েও ভুলে গিয়েছি। স্মৃতির ভিতরে ব্যথার মতো শুধু পড়ে আছে প্রতিশোধের ইচ্ছে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগে আমি বেশ কয়েকবার বাদামী পাতার মাদুর বিছানো জঙ্গলের পথটা উর্ধশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে পেরিয়ে বাংলোতে ঢুকি এবং সিনেমার রিলের মতো আমার ইচ্ছে-স্বপ্নটাকে এগিয়ে এবং পিছিয়ে একজন লাশ-কাটা সার্জেনের না বলা সংকেতগুলো অন্বেষণ করি।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ব্যথার অব্যক্ত মোড়কটা আমি খুলতে পারিনি। আটচল্লিশের না জন্মাতে পারা শিশুদের মধ্যে নিজের ইতিহাসও আমি খুঁজে পেলাম না। আমার চেনাজানাদের কারো জন্ম সেই বছরগুলোতে হয়নি।
পরে আমার অপদার্থতায় নিরাশ হয়ে টেবিলের উপর দাঁড়ানো একটা মোমের সিপাহী রক্তের মোটা মোটা ফোঁটা ঝরাতে শুরু করেছিল, এবং তার নিভে আসা আলোর উত্তাপে আমার স্বপ্নের দেয়ালগুলো পুড়ে কার্বন পেপারের মতো কালো হতে থাকে। গুলজারীলাল তখন ঘরে ছিলেন না।
ডক্টর বাজাজের ফাটা বুকের ভাঙা খাঁচা থেকে বার করে আনা ইন্টার্নাল অরগ্যানের মতো লাল টকটকে মোমবাতির সময় সত্যিই ফুরিয়েছে আশঙ্কায় আমি তাঁর অনুরুদ্ধ কাজটা করে যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম।