এক একটা দিন বেশ মসৃণ কাটলেও আবার কোন কোনদিন বন্ধুর হয়ে ওঠে। এইরকমটাই মনে হয় ঋতবানের। এখন যেমন, অর্ডারটা ডেলিভারি করতেই কত দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর হাতে তো আর সব কিছু নেই! রাসবিহারীর মোড়ে যে এই সময়ে এইরকম বিশ্রী জ্যাম হবে, কে জানত? সকাল থেকে আকাশটা মুখ ভার করে ছিল ঠিকই, তবে হঠাৎ করে এই সন্ধ্যে বেলায় হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামবে, এটা বোঝা যায় নি কোনমতেই। আর বৃষ্টি হল কি না হল, সাথে সাথেই বড় রাস্তায় সরীসৃপের মত লম্বা লাইন পড়ে যাবে গাড়ির, এর কোন মানে হয়? তাও তো ঋতবানের টু হুইলার, যত জ্যামই থাকুক, কোনভাবে একটু সরু জায়গা পেলেও ঠেলেঠুলে গাড়ি বের করে নেবে। সেই সুবিধেটুকু থাকা সত্ত্বেও আজ যেন একেবারে জগদ্দল পাথরের মত দুর্ভেদ্য গাড়ির সমারোহ, যা ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার মত এতটুকু ফাঁকফোঁকর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টি থেমে গিয়ে এখন একটা ভ্যাপসা গরম লাগছে। বাইকে বসে ঘামতে থাকে ঋতবান। এই ডেলিভারিটা পৌঁছতেই অনেক লেট হবে। জানে না কপালে কি আছে! কত গালমন্দ শুনতে হবে, রেটিং খারাপ হবে! এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সবুজ সংকেত পেয়ে গেল সিগন্যাল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ঋতবান! যেটুকু লেট হয়েছে, পক্ষীরাজের মত গাড়ি ছুটিয়ে ওটা ও অনেকটাই মেকাপ করে নিতে পারবে মনে হয়, যদি পথে আর কোন বিভ্রাট না ঘটে।
দুরন্ত গতিতে বাইক চালিয়ে ও যখন নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছল, তখন অন্তত আধ ঘন্টা দেরি তো হয়েই গেছে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে খাবারের পার্সেলটা হাতে নিয়ে চটপট সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো ঋতবান। কলিং বেলে হাত ছোঁয়াতেই দরজাটা আস্তে করে খুলে গেল। ভেতরে তাকালে তেমন কিছু দেখা যায় না। একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ। একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। রোগা মতন। একটু ভালো করে তাকালে বোঝা যায় একসময় চেহারা ভালোই ছিল। এখন বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ। ঋতবান সলজ্জ কন্ঠে বলল –
“সরি! কিছুটা দেরি হয়ে গেল। রাস্তায় এমন জ্যামে ফেঁসে গেলাম না!”
“খুব চিন্তায় ছিলাম। আরেকটু দেরি হলেই মুশকিল হয়ে যেত।” ফ্যাসফেসে গলায় উত্তর দিলেন বৃদ্ধ।
“হ্যাঁ, রাত হয়েছে তো! আপনাদের পক্ষে রাত্রি করে খাওয়া ...”
ঋতবান কে থামিয়ে বৃদ্ধ বলে উঠলেন –
“আরে না না, ওটা কোন ব্যাপার না। খাওয়াটা সেরে ফেলতে হবে ওরা এসে পড়ার আগে!” এবার প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন কথা গুলো। ঋতবানের অদ্ভুত মনে হলেও কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করাটা সমীচীন নয় ভেবে চুপ করে থেকে নিচে নেমে এলো। কিন্তু খটকাটা মনের মধ্যে রয়েই গেল।
সেন্টারে ফিরে ওর নেক্সট ডেলিভারির অ্যাড্রেসটা দেখেই মনটা নেচে উঠল। এফ টু নাইন জিরো ফাইভ! পাঁচ মিনিটের মধ্যেই গরমাগরম প্যাকেট রেডি হয়ে হাতে চলে এলো। আর ও বাইকে স্টার্ট দিলো। রাস্তার দু পাশে সবুজের শ্যামলিমা মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এখন যদিও সন্ধে নেমে গেছে, তাই চারপাশের গাছগাছালিতে পাখিদের কলতান, বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ! বৃহত্তর কলকাতার এই নতুন করে বেড়ে ওঠা অঞ্চলে এখনও শহুরে দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কম। শান্ত, স্নিগ্ধ, জনকোলাহল বর্জিত এই আবাসনটি প্রথম দর্শনেই মন টেনেছিল ঋতবানের। তার ওপর ওই নাইন জিরো ফাইভের অমোঘ আকর্ষণ! গত সপ্তাহেই ডেলিভারি দিতে গিয়ে প্রথম দেখেছিল ঋতবান। আর তাতেই একদম ফিদা! ঘরের এলোমেলো পোষাকের ওপর একটা ওড়না জড়িয়ে কোনমতে হাত বাড়িয়ে প্যকেটটা নিয়েছিল ওর হাত থেকে। এত সুন্দর মুখ সহজে নজরে পড়ে না। তাও আবার কোন মেকাপ ছাড়া। আজকাল তো মেকাপের দৌলতে কোনটা মেকি, কোনটা আসল বোঝাই মুশকিল! ঋতবান শুধু বলতে পেরেছিল –
“ম্যাডাম, একটু রেটিংটা দিয়ে দেবেন কাইন্ডলি!”
ও প্রান্তে একটু মৃদু সৌজন্যের হাসি ফুটেছিল ঠোঁটে, আর তাতেই ধন্য হয়েছিল ঋতবান। পরে অনেকবারই ওই মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠেছে যখন একলা হয়েছে। তবে একটা ব্যাপার মনে হয়েছে ঋতবানের। ওই সুন্দর মুখের মধ্যেও কোথায় যেন বিষাদের ছোঁয়া রয়েছে! এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখল পৌঁছে গেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। লিফট বেয়ে থার্ড ফ্লোরে উঠেই ভেতরে ভেতরে একরকম উত্তেজনা অনুভব করছিল ঋতবান। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছে নিল। কলিং বেলে আঙুল ছোঁয়াতেই পাখির ডাকের কিচিরমিচিরের সাথেই একটা চাপা গর্জন আর ধ্বস্তাধস্তির আওয়াজ শোনা গেল। বেশ অবাক হয়ে গেল ও। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিল না। আর একবার বেল বাজাবে কি? একটু পরে দরজাটা আধ খোলা অবস্থায় একটা ফর্সা সুডোল হাত বেরিয়ে এলো, সাথে মুখমণ্ডলের অর্ধেক দেখা গেল। প্যাকেটটা দেওয়ার সময় দরজাটা আরও একটু ফাঁক হতেই চকিতে ঋতবানের নজর চলে গেল তরুণীর মুখের দিকে, কপালের বাঁ-দিকে একটা গভীর ক্ষত, একদম টাটকা! রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে! কয়েক মুহূর্ত! ঋতবানের বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টির সামনেই ফ্ল্যাটের দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
নিচে নেমে এসে বাইকে স্টার্ট দিতে গিয়েও পারল না ঋতবান। চোখের সামনে ওই মুখ ভেসে উঠছে! কী হয়েছে? কে মেরেছে ওকে এভাবে? ওর স্বামী নিশ্চয়ই! কিন্তু কেন? আর তার পরেও ও চুপ করে আছে কেন? এইসব এলোমেলো চিন্তার মাঝেই সেল ফোন বেজে উঠল। দু চারটে দরকারি কথা বলেই ঋতবান বাইকে স্টার্ট দিলো। মনটা যদিও ভার হয়ে রইল।
নেক্সট ডেলিভারি যে বাড়িতে সেখানে ডোরবেল বাজাতে না বাজাতেই দরজা খুলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কচিকাঁচার দল। ওর হাত থেকে প্যাকেট প্রায় কেড়ে নিল একটা বাচ্চা মেয়ে, সাথে সাথে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর থেকে ছোট একটা বাচ্চা ছেলে।
“বিট্টু, এরকম করবি না! প্যাকেট ছিঁড়ে খাবার পড়ে যাবে!” দিদির চিৎকারে কোন পাত্তা না দিয়ে ভাই সমান তালে কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত। দরজা কিন্তু হাট করে খোলা! এবার ভেতর থেকে মায়ের আবির্ভাব।
“কী হয়েছে কি? আমার হাতে দাও ওটা!” কড়া সুরে ধমকের সাথে সাথে এগিয়ে এসে দরজা বন্ধ করলেন ভদ্রমহিলা।
বেশ লাগে ঋতবানের এই টুকরো ছবিগুলো। মনে হয় শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত এই যে ছুটে যাচ্ছে, কিছু লোকের মুখে হাসি তো ফোটাতে পারছে! এই বা কম কি! কাজটা তাই বেশ খুশি হয়েই করে ও। এই শহরের আনাচে কানাচে কত ঘর, কত পরিবার, কত রকমের দুঃখ, সুখ – কত বৈচিত্র্যে ভরা! তার ছিটেফোঁটা স্বাদ পেলেও ও চেটেপুটে নেয়। গ্র্যাজুএশনের পর চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়েও যখন কিছু হল না, তখন মধ্যবিত্ত পরিবারের আর পাঁচটা ছেলের মত ঋতবানও সংসার চালানোর জন্য এই কাজ বেছে নিয়েছিল। একটা সেকেন্ড হ্যান্ড বাইক কিনেছিল যাতে যাতায়াতের সুবিধা হয়। বাবা মায়ের পছন্দ নয় এই কাজ। বাইক নিয়ে নিয়ে শহরের রাস্তায় ঘোরা, কখন কী হয়ে যায়! ঝিনুকও রাগ করেছিল।
“এই কাজটাই করতে হবে তোকে? কত রিস্ক জানিস?”
ঋতবান অবশ্য সেসব কথায় কান দেয় নি। ও বুঝিয়েছে ওদের, ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকলে কী হবে? মাস গেলে বাবার ওই কটা টাকার পেনশন ভরসা করে ভাই, বোন নিয়ে ওদের পাঁচজনের পেট কি চলবে? তাছাড়া ভাই-বোনের পড়াশুনাও তো রয়েছে, না কি? এই অকাট্য যুক্তির কাছে শেষপর্যন্ত হার মেনেছে সবাই। তবে ঋতবান এখনও অনেক জায়গায় অ্যাপ্লাই করে চাকরির সন্ধানে। মনে মনে আশা আছে একদিন কিছু একটা পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই। ঝিনুক একটা বিউটি পার্লারে কাজ করে। অন্য সবার মত, ওরাও একটা সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখে! শুধু কটা দিনের অপেক্ষা!
প্রতিদিনের কাজের মাঝে এই টুকরো টুকরো ঘটনা, যা ওর মনকে স্পর্শ করে, ও ভাগ করে নেয় সপ্তাহের একটা দিন ঝিনুকের সাথে। ঋতবান আসলে খুবই আবেগপ্রবণ। তাই উত্তেজিত হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। ঝিনুক ওকে বোঝায় সবার সব সমস্যা তো আর ও সমাধান করতে পারবে না! তাই নিজেকে অত জড়িয়ে কী হবে?
সেদিন সন্ধেয় ফুড প্যাকেট নিয়ে আবার সেই বৃদ্ধের ফ্ল্যাটের কাছে পৌঁছে যায় ঋতবান। ভদ্রলোক প্রায় রোজই একই সময়ে খাবারের অর্ডার দেন। ওপরে উঠে দেখে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, বেশ কিছু লোক জমা হয়েছে দরজায়। অবাক হয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখতে যায়। ভেতরে উঁকি দিতেই--একি! ওই বৃদ্ধকে কয়েকজন মিলে পাঁজাকোলা করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়বিমূঢ় ঋতবান বাইরে এসে দাঁড়ায়। একজন ভদ্রলোককে সামনে দেখে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে – “কী হয়েছে?”
“মিস্টার সান্যাল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন! ওনার স্ত্রী তো বহুদিন ধরেই বেড রিডেন। স্ট্রোক হয়ে পারালাইসড হয়ে গেছেন। আয়াই সারাদিন দেখাশোনা করে আর কি। খুব স্যাড!”
“আচ্ছা, ওনাদের ছেলে-মেয়ে ?”
“আছে। ছেলে, বৌমা দুজনেই চাকরি করে তো! খবর দেওয়া হয়েছে। অন দ্য ওয়ে। কিন্তু আপনি? কিছু ডেলিভারি দিতে এসেছিলেন মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, ওনারাই অর্ডার করেছিলেন!”
“তাহলে মিস্টার সান্যালই অর্ডার করেছিলেন হয়ত! আর তার পরেই ওনার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। আয়ার বয়ানমত উনি বিছানায় শুয়ে পড়ে আয়াকে ডেকে বলেন ওনার শরীর খারাপ লাগছে। আয়াই পাশের ফ্ল্যাটে খবর দেয়। তাতেই আমরা সবাই জানতে পারি। অ্যাম্বুলেন্স কল করা হয়েছে, এসেও গেছে বোধহয়।”
“আচ্ছা! উনি প্রায়ই সন্ধেতে খাবার অর্ডার করতেন। আর ডেলিভারি দিতে এলেই তাড়াহুড়ো করে প্যাকেট নিতেন। বলতেন ‘খাওয়াটা সেরে ফেলতে হবে ওরা এসে পড়ার আগেই।‘ আমার অদ্ভুত লাগত জানেন, ওনার কথাগুলো!”
“হ্যাঁ, আসলে,” চাপা গলায় বলে চললেন ভদ্রলোক, “ছেলে বৌমা ফেরার আগে ভালোমন্দ কিছু খেতে চাইতেন। ওরা সামনে থাকলে তো ওইসব অ্যালাউ করবে না! সামান্য চিঁড়ে দুধ এইরকম খাবার দিত ডিনারে। তাই তড়িঘড়ি সুস্বাদু খাবার আনিয়ে নিজেও খেয়ে নিতেন, স্ত্রীকেও যতটা পারতেন খাইয়ে দিতেন।”
“ও! তাই এত তাড়া ছিল!” খাবারের প্যাকেট নিয়ে নিচে নেমে গেল ঋতবান। গোধূলির রং তখন মলিন হয়ে গেছে। অন্ধকার নেমে আসছে চারপাশে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল ঋতবানের। নিজের বাবার কথা মনে এলো। ওদের সংসারে অভাব আছে ঠিকই, কিন্তু বয়সজনিত কারণে কাউকে অবহেলা বা উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না! বরং বাবা যা খেতে ভালোবাসেন, মাইনে পেয়ে সেদিনই কিনে নিয়ে যায় ও। ভাবতে ভাবতেই বাইক চালাচ্ছিল ও। একটা মেসেজ ঢুকল। সেন্টার থেকে কল করেছে, তাড়াতাড়ি যেতে বলছে। আজ কম ছেলে এসেছে কাজে। তাই চাপ বেশি। দুটো জায়গায় ডেলিভারি দিয়ে এসে পরবর্তী ডেস্টিনেশন এফ টু নাইন জিরো ফাইভ দেখেই বুকটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠল। প্যাকেট নিয়ে ঝড়ের গতিতে বাইক চালিয়ে পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট জায়গায়। আগের দিনের মতোই ডোর বেলে হাত রাখতেই ভেতর থেকে মহিলা কন্ঠে একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো। তারপরই শোনা গেল পুরুষ কন্ঠে গর্জন –
“বেশ করেছি। আরও করব। তুই কি করতে পারবি? বেশি কথা বললে একেবারে শেষ করে দেবো।”
গলার স্বর বেশ জড়ানো, অর্থাৎ নেশাগ্রস্ত। খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেল ঋতবান। কী করবে ও এখন? আরেকবার বেল বাজাবে, নাকি ফিরে যাবে? কিন্তু ফিরে যাওয়ার কোন রাস্তা তো খোলা নেই! অর্ডার তো ওকে ডেলিভারি করতেই হবে! কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বেল বাজালো ও। একটু পরে দরজা ফাঁক হল, সেই তরুণী সামনে দাঁড়িয়ে। নাইটির ওপরে ওড়না জড়িয়ে এলেও, প্যাকেট নেওয়ার সময় হাত বাড়াতেই ওড়না সরে গিয়ে গলায় একটা জায়গা বেশ লাল হয়ে গেছে দেখা গেল। দেখে মনে হয় গলায় কোন কিছুর চাপ পড়েছিল। কেউ কি গলা টিপে ধরেছিল! ইতিমধ্যে ভেতর থেকে আবার গর্জন ভেসে এলো –
“কী হল? খাবারটা নিয়ে আসতে কতক্ষণ লাগে, অ্যাঁ?”
তরুণী কেঁপে উঠে ওর হাত থেকে প্যাকেটটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ঋতবান মুহ্যমান হয়ে লিফটের দরজার দিকে এগোল। ফেরার পথে একটাই কথা ওর মাথায় ঘুরছিল। ওই তরুণী, কী নাম ওর? মিসেস এস বাসু। ফ্ল্যাটের দরজার নেমপ্লেটে সেইরকমই লেখা দেখেছে। এস দিয়ে তো অনেক নামই হতে পারে, তবু ঋতবানের মনে একটা নাম ওর জন্য রাখা আছে, সুনন্দিনী! ও কেন এভাবে পড়ে থেকে অত্যাচারিত হচ্ছে দিনের পর দিন! ও কি বেরিয়ে আসতে পারে না ওই নারকীয় পরিবেশ থেকে? বাইক চালাতে চালাতে এই কথাটাই ভাবছিল ঋতবান। ওই চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিল যে রাস্তাঘাটে কিছুই খেয়াল করতে পারেনি। হঠাৎ অন্যমনস্ক ঋতবানের চোখে তীব্র আলোর ঝলকানি। নজর করতেই দেখল ওর মুখোমুখি একটা বিশাল ট্রাক ছুটে আসছে!
হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে উড়ে চলেছে ঋতবান। ওর শরীরটা একদম হালকা এখন। আকাশে কি তারা ফুটেছে অনেক? ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না ও। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে ওকে। ওই বৃদ্ধ, কী যেন নাম? হ্যাঁ মনে পড়েছে, মিস্টার সান্যাল, উনি অপেক্ষা করছেন তো ওর জন্য! খাবারটা ডেলিভারি না দিলে উনি আর ওনার স্ত্রী খাবেন কী করে? দেরি হলে ধরা পড়ে যাবেন যে! যে করে হোক ওকে প্যাকেট নিয়ে পৌঁছতেই হবে ওনার ছেলে, বৌমা অফিস থেকে ফেরার আগে! কলিং বেলে হাত ছুঁইয়ে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। দরজা খুলে গেল। এক মহিলা ওর হাত থেকে প্যাকেটটা নিলো। কিন্তু এ কী দেখছে ও! একজন পুরুষ ও সেই মহিলা ওই বৃদ্ধ আর এক বৃদ্ধাকে যত্ন করে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে!
মনে এক অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে বেরিয়ে এলো ঋতবান। কেমন ধোঁয়াশা মতন ওর চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে! এফ টু নাইন জিরো ফাইভে খাবার নিয়ে যেতে হবে যে! ধোঁয়াশা একটু কাটতে ঋতবান দেখল ও সেই ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে। ডোর বেলে হাত ছোঁয়াবে কি না ভাবতে ভাবতে বোতাম টিপল। দরজা খুলে গেল। কিন্তু ও কই? সুনন্দিনী! হ্যাঁ, ঋতবানের একান্ত সুনন্দিনী! ঘরে ঢুকে পড়ল ঋতবান। ড্রয়িং রুমের সোফাতে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা লোক। সামনে টেবিলে মদের বোতল, গ্লাস। কাছে গিয়ে দেখল লোকটার বুকে একটা বড় ছুরি বিঁধে আছে। আর সেই ক্ষতস্থান দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে! উফফ, কী ভয়ানক দৃশ্য! কোনমতে বেরিয়ে আসে ঋতবান টলতে টলতে। নিচে নেমে বাইকে স্টার্ট দিতে যাবে, কে যেন এসে বাইকের পিলিওনে বসে ওর পিঠে হাত রাখল। ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল –“কি, দেখলে তো, আমি পারি কি না!” চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে। ক্রমশ চেতনা বিলুপ্ত হতে থাকে ঋতবানের। কোন অতলে যেন তলিয়ে যেতে থাকে ও!
খুব ফিকে আলোর রেখা ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। অনেকদিন আগে বাবার হাত ধরে ছোট্ট ঋতবান একবার এইরকম আলো ফুটে উঠতে দেখেছিল দীঘার সমুদ্রতীরে। একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছিল চরাচর। ঠিক সেইরকম ভাবেই এখনও অল্প অল্প করে আলো দেখা যাচ্ছে। চেতনায় ধরা দিচ্ছে অনেকদূর থেকে ভেসে আসা কিছু শব্দ। কারা যেন চেঁচামেচি করছে না! হ্যাঁ, ওই তো, ওই বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো! ওরা কী বলছে ঋতবানকে? খাবারের প্যাকেটটা নিতে চাইছে? তাই ওর হাত ধরে টানাটানি করছে? “আরে, টানাটানি করিস না তোরা, খাবারটা পড়ে যাবে যে!” বলতে চাইছে ঋতবান, কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না!
“এই যে! এই যে ঋতবান! শুনতে পাচ্ছেন? চোখ খুলুন! হ্যাঁ হ্যাঁ, পারবেন আপনি। এই তো! দ্যাটস লাইক আ গুড বয়! কেমন ফিল করছেন এখন?”
কে যেন ওর হাত ধরে নাড়া দিচ্ছে! আধবোজা অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে চোখটা পুরো খুলতে পারল ঋতবান। ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছেন একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক।
“আমি কোথায়?”
“আপনি হাসপাতালে আছেন। সেইফ আছেন। কোন টেনশন করবেন না, ঠিক আছে?” ঘোরটা এখনও পুরোপুরি কাটেনি ঋতবানের। তবে এটা বুঝতে পারছে যে ও একটা বেডে শুয়ে আছে। আর এই ঘরে ডক্টর, নার্স এরা রয়েছেন। ও এখানে কী করে এলো, সেটা অবশ্য মনে করতে পারছে না। ঘুম পাচ্ছে ঋতবানের, গভীর ঘুম!
“ডাক্তারবাবু, আমার ছেলেটা?” উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন ভেসে আসে স্বনামধন্য নিউরোসার্জন ডক্টর চৌধুরীর উদ্দেশ্যে। যিনি এইমাত্র ওটি থেকে বেরোলেন। গ্লাভস খুলতে খুলতে এক অসহায় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু মৃদুস্বরে জানালেন –
“ডোন্ট ওয়ারি, হি ইস আউট অফ ডেঞ্জার!”