স্টেশনের আধো-অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে শৈলেন ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ডে কি লেখা আছে পড়ল। ঠিক প্ল্যাটফর্মেই এসেছে। হাতে ঘড়ি নেই। ফোনে সময় দেখল। রাত সাড়ে নটায় ট্রেন। দশ মিনিট বাকি আছে। শহরের নাম কুফষ্টাইন, দেশের নাম অস্ট্রিয়া।
এইমাত্র শৈলেনের ছোটবেলাকার বন্ধু রমেন তাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে চ’লে গেছে। শৈলেনের সাথে আছে ওর অদৃশ্য বন্ধু, মন্থরা।
শৈলেন অ্যামস্টারডাম যাবে। সারারাত ধ’রে নাইটজেট ট্রেন চলবে। অস্ট্রিয়া ছাড়িয়ে, জার্মানি পেরিয়ে। সকাল দশটার একটু পরে পৌঁছবে নেদারল্যান্ডস-এর রাজধানী অ্যামস্টারডামে। সাথে রয়েছে একটা ছোট স্যুটকেস, পিঠে ব্যাকপ্যাক, গায়ে সোয়েটার ও জ্যাকেট, মাথায় টুপি। এপ্রিলের মাঝামাঝি। তাও বেজায় ঠান্ডা। মাঠে ঘাটে রাস্তায় বরফ প’ড়ে রয়েছে।
শৈলেনের কাছে তিনজন যাত্রীর টিকিট। কিন্তু বিশু আর কান্তি নেই, আসবেও না। নানা কারণে তাদের সফর বাতিল হয়েছে। অনেক পরিকল্পনা ক’রে চার জনের কুপ-এর টিকিট কেটেছিল। ভেবেছিল তিনজন থাকবে একটা কুপ-এ। আর হয়তো চতুর্থ কোনো অপরিচিত ব্যক্তি। আড্ডা মারতে মারতে, শুয়ে শুয়ে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাবে – তাই ভেবেছিল। আর এখন চলেছে একা। শুধমাত্র মন্থরা সঙ্গে রয়েছে। কুপ-এ আর কে থাকবে কে জানে।
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মের ঠিক কোথায় থামবে জানে না। হয়তো মিনিট দুয়েক দাঁড়াবে। তার মধ্যেই ছুটোছুটি ক’রে ঠিক কামরাটা খুঁজে বার ক’রে উঠতে হবে। একটু উদ্বেগ হচ্ছে। পকেটে রয়েছে একটা কাগজ – তিনজন যাত্রির টিকিট। শৈলেনের বয়স মধ্যযুগ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু শরীরে মেদ, শিথিলতা বা ব্যাধি কিছুই প্রায় নেই। এখনো পরিশ্রমের শক্তি আছে। মালও শুধু ওই ছোট স্যুটকেস। অনুপস্থিত দুই সহযাত্রীদের প্রতি বিরক্তি আর আসন্ন ট্রেনে ওঠার উত্তেজনা নিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো শৈলেন।
ট্রেন সময়মতোই এলো। সব কামরার গায়ে ইলেক্ট্রনিক সাইনবোর্ডে সীট নম্বর ইত্যাদি লেখা। তাই দেখে দেখে কামরা খুঁজে বার ক’রে উঠে পড়ল শৈলেন। ছোট স্যুটকেসটা টেনে টেনে নির্ধারিত কুপটা খুঁজে বার করল। দরজা খোলা। ভেতরে একজন মধ্যবয়স্ক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক ব’সে আছেন। শৈলেন ঢুকতে ঢুকতে হ্যালো জানাল। উনিও তাকিয়ে হাসিমুখে পালটা হ্যালো বললেন। ট্রেন ছেড়ে দিল।
শৈলেন মনে মনে ভাবছিল ভদ্রলোক ইংরিজি জানেন কিনা। শৈলেন জার্মান জানে না।
কুপের দরজা দিয়ে ঢুকে, ভদ্রলোক ব’সে আছেন ডানদিকের বার্থে। শৈলেন বাঁ দিকের বার্থ্-এর উপর ব্যাকপ্যাকটা রেখে, স্যুটকেসটা বার্থের নিচে ঢোকানোর চেষ্টা করল। আঁটছে না। ভদ্রলোককে পেরিয়ে, কুপের মধ্যে পুরোটা ঢুকে গিয়ে, শেষ প্রান্তে বাঁ বার্থের নিচে কোনো মতে স্যুটকেস ঢুকলো।
ভদ্রলোক উৎসাহ দিলেন ও কথা ব’লে সাহায্য করার চেষ্টা করলেন। যাক্! ইংরিজি চলবে।
স্যুটকেসের ব্যবস্থা ক’রে শৈলেন বাঁ বার্থে বসল। ব্যাকপ্যাকটা পাশেই রইল। পরে চেষ্টা করবে নিচে ঢোকানোর, বা কুপের ওপরের বার্থে রাখার। জ্যাকেটটা খুলে পাশে খুঁটিতে ঝুলিয়ে দিল।
ভদ্রলোককে শৈলেনের নিজের থেকে কয়েক বছরের ছোট মনে হল। রোগা কিন্তু স্বাস্থ্যবান। গোঁফ-দাড়ি পরিষ্কার ক’রে কামানো। কাঁচা-পাকা অল্প চুল। চোখে স্বচ্ছ ফ্রেমের চশমা।
খুব সহজেই আলাপ হয়ে গেল। ভদ্রলোক জার্মান, নাম পল। চাকরির সূত্রে অস্ট্রিয়ার কোথাও গিয়েছিলেন। এখন বাড়ি ফিরছেন। রাত আড়াইটা নাগাদ ট্রেনটা ইয়ুর্জবর্গ নামক শহরে থামবে। সেখানে নেমে যাবেন। ওনার বাড়ি সেখান থেকে অদূরবর্তী গ্রামে।
কথা বলতে বলতে, আড্ডা বেশ জ’মে উঠল। পল-এর স্ত্রী ভিয়েতনামীয়। ওঁদের আলাপ হয়েছিল ভিয়েতনামে। তারপর বিয়ে ক’রে ভদ্রমহিলা পল-এর সাথে জার্মানি চ’লে এসেছেন। সঙ্গে এসেছে আগের পক্ষের দুই সন্তান। এখন তাঁর আর পল-এরও একটি মেয়ে হয়েছে, সে খুবই ছোট।
পল বলছিলেন কত ভাবে তিনি তাঁর স্ত্রীর আগের পক্ষের সন্তানদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন। এবং ক’রে যাচ্ছেন। একজন এখন কলেজে পড়ে, আর অন্যজন পড়াশুনো শেষ ক’রে কিছু একটা কাজ করছে। পলের উপর অনেক দায়িত্ব। অনেক খরচার চাপ। কথাবার্তা শুনে শৈলেনের মনে হ’ল ছোট কন্যাটির প্রতি পলের একটু পক্ষপাতিত্ব আছে। তার সম্বন্ধে পল একাধারে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত এবং সবচেয়ে বেশি আনন্দিত। সেটাই হয়তো স্বাভাবিক।
এক সময় ওদের আড্ডায় বাধা দিয়ে টিকিট চেকার এসে টিকিট এবং পরিচয়পত্র চাইলেন। শৈলেন ওর আমেরিকান পাসপোর্ট দেখাল। পল দেখালেন তাঁর জার্মান আইডি কার্ড। দুজনেই টিকিট দেখাল। শৈলেন বুঝিয়ে বলল যে টিকিট থাকা সত্বেও ওর দুই সহযাত্রী আসেনি।
টিকিট চেকার চ’লে গেলেন।
আড্ডা চলতে লাগল। পল শৈলেন সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। গত তিরিশ বছর ধ’রে শৈলেন অ্যামেরিকায় সফ্টওয়ারের চাকরি করেছে। তারপর দুয়েক বছর আগে নিজের কোম্পানি খুলেছে, যার বেশিরভাগ কর্মচারীই ভারতবর্ষে। ইয়োরোপে এসেছে বেড়াতে। আপাতত অ্যামস্টারডামে যাচ্ছে সে।
’কোভিডে আপনার কাজের ক্ষতি হয়নি?’ পল জানতে চাইলেন।
’না, আমাদের কোম্পানির উপর সে রকম কোনো প্রভাব পড়ে নি। কারণ সব কর্মচারীই রিমোট, যে যার বাড়ি থেকে কম্পিউটারের কাজ করে। আর কোম্পানির যারা খদ্দের তারা সব বড় বড় কোম্পানি। কোভিডে প্রায় কিছুই এসে যায়নি। এখনো অবধি।’
পল-কে বেশ ভালো লাগছে শৈলেনের। সাধারণ মধ্যবিত্ত জার্মান। স্ত্রী, সন্তান এবং চাকরি নিয়ে আর যে-কোনো দেশের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেদের মত জীবন কাটাচ্ছেন।
কোভিড চলাকালীন খুব কষ্ট পেয়েছেন। পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের মতই। চাকরিটা যায়নি, কিন্তু কাজ ক’মে সপ্তাহে দু’দিন হয়ে গেছিল। তাঁর দেশ সেই সময়ে তাঁকে ক্ষতিপূরণ-স্বরূপ বেকারভাতা দিয়ে অনেক সাহায্য করেছে। উপার্জন একদম অটুট না থাকলেও পর্যাপ্ত ছিল। জার্মানির এই সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা শুনে শৈলেন মুগ্ধ হ’ল।
তবুও কোভিডের সময়ে পল ও তাঁর পরিবার অপেক্ষাকৃত খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। এক সময়ে অফিস যাবার দৈনন্দিন ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কয়েক মাসের জন্য। তখন অফিসের কাছেই কোথাও একটা ঘর ভাড়া ক’রে থাকতে হয়েছিল। অনেকটা দূরত্ব গাড়ি চালিয়ে যাতায়াত করতে হ’ত। সপ্তাহে দু’দিন বাড়ি ফিরতে পারতেন না।
শৈলেনও কিছু কিছু নিজের জীবনের কথা বললো। কোভিডে পুরো জীবনটাই ঘর-ঘেঁষা হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য আর্থিক কোনো কষ্ট হয়নি। ক্ষতি তো হয়ইনি, বরং কোম্পানি এখন ভালোই চলছে। ভবিষ্যতটা মন্দ মনে হচ্ছে না। শৈলেন স্বাভাবিকভাবেই আশাবাদী এবং ভাগ্যবান।
আড্ডা মারতে মারতে কত সময় কেটে গেছে শৈলেন খেয়াল করেনি। পল-ও না। হঠাৎ ফোনে সময় দেখলো শৈলেন। প্রায় সাড়ে এগারোটা! দু ঘন্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল?
পল বললেন, ’এবার তাহলে শোওয়ার বন্দোবস্ত করা যাক।’
’হ্যাঁ! আপনাকে তো আবার দু-তিন ঘন্টা পরেই উঠে পড়তে হবে। আড়াইটেতে আপনার স্টেশন আসবে বললেন না?’
’হ্যাঁ।’
চারজনের কুপ। তাই চার সেট্ বালিশ, চাদর আর কম্বল দেওয়া আছে। চার বোতল জল।
পল ডান দিকের ওপরের বার্থে নিজের জন্য বিছানা বানালেন।
শৈলেন নিজের বিছানা বানাল বাঁ দিকের ওপরের বার্থে। স্যুটকেসটা তো আগেই নিচের বার্থের তলায়, কোণে কোনোমতে ঢুকিয়ে ছিল। কিন্তু ব্যাকপ্যাকটা জিনিসপত্রে এমন ফুলে ফেঁপে আছে যে কিছুতেই সেটা বার্থের নিচে ঢুকলো না। ওটা নিচের বার্থের ওপরেই রেখে দিলো শৈলেন। ভারী জুতোটা খুলে মেঝেতে রেখে, ওপরে উঠে শুয়ে পড়ল। আলো নিবিয়ে দিল।
ট্রেন চলছে নিজের ছন্দে। কুপের মধ্যে মোটামুটি অন্ধকার। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে আলো আসছে। খুব দ্রুত এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত ছায়ার দল ছুটে যাচ্ছে তখন। তারপর এক নিমেষে মিলিয়ে যাচ্ছে।
পল-এর নিশ্বাসের শব্দ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এল।
কিন্তু শৈলেনের কিছুতেই ঘুম আসছে না। শুধু তাই নয়, ওপরের বার্থটা কামরার ছাদের এতই কাছে, কি রকম যেন দম বন্ধ মনে হচ্ছিল। অনেক বছর পরে রাত জুড়ে ট্রেন যাত্রা। ছোটবেলায় ভারতবর্ষে ট্রেনে কি ভালো ঘুম হ’ত! ইয়োরোপের কামরাগুলো কি বেশি ছোট? বা ওপরের বার্থগুলো কি ছাদের বেশি কাছে?
একবার এ পাশ ফিরলো শৈলেন। একবার ও পাশ। চোখ বন্ধ ক’রে ট্রেনের অবিরাম শব্দ শুনলো। চোখ খুলে আলো-ছায়ার দৌড়াদৌড়ি দেখলো। হাত বাড়িয়ে ছাদটা ছুঁলো।
বেশ কিছুক্ষণ ছটফট ক’রে শৈলেন নিচের বার্থে নেমে এল। নিশ্বাসের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে পল ঘুমোচ্ছেন। নিশ্চয় ঘড়িতে বা ফোনে অ্যালার্ম দিয়েছেন।
শৈলেন আর চাদরটাদর পাতার চেষ্টা করল না। ব্যাকপ্যাকটা পায়ের দিকে জুতোর পাশে মেঝেতে নামিয়ে রাখলো। বার্থে বালিশ পেতে শুয়ে পড়ল। পাতলা চাদরটা গায়ে টেনে নিল। কম্বলটা ওপরের বার্থ থেকে নামাল না।
শুয়ে শুয়ে ছোটবেলাকার ট্রেনযাত্রার আনন্দ মনে করার চেষ্টা করল। ঘুম কোথায়? কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। ঘুম আসছে না। আরাম নেই।
শৈলেনের ঘুম ভাঙল হঠাৎ। চোখ খুলেই শৈলেনের মনে হ’ল – ঘুম কেন ভাঙল?
দেখলো মাথার কাছে কুপ-এর স্লাইডিং দরজাটা খোলা। পল বেরিয়ে যাচ্ছেন। শৈলেনের মনে পড়লো সব। তার মানে পল-এর স্টেশন এসে গেছে। শৈলেন উপলব্ধি করলো ট্রেনটা চলছে না, দাঁড়িয়ে আছে।
ওর দিকে হাত বাড়ালেন পল। শৈলেন শুয়ে শুয়েই হেসে হান্ডশেক করল।
পল বললেন, ’গুডবাই!’ শৈলেনও প্রত্যুত্তর দিল।
পল চ’লে গেলেন। শৈলেন চোখ বন্ধ করল।
কয়েক মুহূর্ত।
কি জানি কি মনে হ’ল শৈলেনের। হয়তো মন্থরা ফিসফিস ক’রে বলল, ’সব ঠিক তো?’
উঠে বসলো শৈলেন। সোয়েটারের নিচে বুক পকেটটা চাপড়ে দেখল। টাকাকড়ি আর ক্রেডিট কার্ড জায়গায় আছে।
ব্যাকপ্যাকটা ঠিক আছে তো? ওর মধ্যে পাসপোর্ট। পায়ের কাছে মেঝের দিকে হাত বাড়ালো। ব্যাকপ্যাক নেই!
বার্থ থেকে নেমে মেঝেতে বসলো শৈলেন। ব্যাকপ্যাক কোথায়?
উঠে দাঁড়িয়ে কুপের আলো জ্বাললো। ব্যাকপ্যাক নেই।
মেঝেতে হাঁটু গেড়ে ব’সে ভালো ক’রে খুঁজলো।
হ্যাঁ, বার্থের নিচে স্যুটকেসটা রয়েছে, জুতোটা তার পাশে। শৈলেন কি ব্যাকপ্যাকটা স্যুটকেসের পেছনে ঢুকিয়েছিল? স্যুটকেসটা টেনে বার করলো শৈলেন। পেছনে কিছু নেই। মরিয়া হয়ে বার্থের নিচের আধো-অন্ধকারে হাত ঘোরালো শৈলেন। কিচ্ছু নেই। তাহলে ব্যাকপ্যাকটা কোথায় গেল? পাসপোর্ট? বুকপকেটটা আরেকবার চাপড়ালো। হ্যাঁ, টাকাকড়ি ঠিক আছে। কিন্তু পাসপোর্ট ছাড়া এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কি ক’রে চলবে?
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল শৈলেন।
পল!
পল কি চ’লে গেছেন? খালি পায়ে ছুট লাগালো শৈলেন। কামরার যেই দিকে দরজাটা কাছে মনে হ’ল সেই দিকে ছুটল। কেউ কোথাও নেই।
একছুটে পৌঁছে গেল দরজায়। ওই তো পল! প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে আছেন। দরজার কাছেই।
কামরা থেকে না নেমে, খালি পায়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, শৈলেন পল-কে ডাকল।
’আমার ব্যাকপ্যাকটা নেই!’
’সে কি? ভালো ক’রে দেখেছেন?’
’হ্যাঁ, কোথাও নেই, কামরায় কোথাও নেই।’
’সে কি ক’রে সম্ভব? নিশ্চয়ই আছে।’
শৈলেন জোরে জোরে মাথা নাড়লো।
’না না, নেই, কোথাও নেই।’
ট্রেনের উইসল শোনা গেল। এবার ছাড়বে।
পল জিগ্যেস করলেন, ’আমি যাবার পর অন্য কেউ কুপের ভেতরে ঢুকেছিল?’
’না…’, বললো শৈলেন, ’আমি জানি না।’
’ট্রেন তো এবার ছাড়বে, আপনি কোনো গার্ডকে খুঁজে বার করুন।’
চট্ ক’রে একটা ছোট নোটবুক বার ক’রে পল তাতে কিছু লিখলেন। তারপর লেখা-পাতাটা ছিঁড়ে শৈলেনকে দিলেন।
’এই আমার ফোন নাম্বার। আমাকে ফোন করবেন। যদি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি…’
ট্রেন চলতে শুরু করলো।
পল বললেন, ’আমি খুবই দুঃখিত।’
পল-এর মূর্তি ধীরে ধীরে দূরে চ’লে যেতে লাগলো।
চলমান ট্রেনে, ডানহাতে পলের ফোন নাম্বার লেখা কাগজ ধ’রে, খালি পায়ে শৈলেন তাড়াতাড়ি ফিরে এলো কুপে। পাগলের মত আবার আদ্যন্ত খুঁজলো। ওপরের দুই বার্থে। নিচের দুই বার্থে। বার্থের নিচে।
বালিশ, কম্বল, চাদর, জলের বোতল। ঝুলন্ত জ্যাকেট, শোয়ানো স্যুটকেস আর পরিত্যক্ত জুতো ছাড়া কিছু নেই। সব ভোঁ-ভাঁ।
হাতের কাগজটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে আবার ছুটলো গার্ডের খোঁজে। আগের বার যে দিকে গিয়েছিল, এবার গেল তার উলটো দিকে। কামরার শেষে পৌঁছে দেখলো দরজা বন্ধ। ট্রেন এখন জোরে চলছে। বাথরুমে ‘অকেজো’ সাইন লাগানো। কেউ কোথাও নেই।
শৈলেন ফিরে গেল কামরার অন্যদিকে। নিজের কুপটা পেরোনোর সময়ে আরেকবার কুপের ভেতরে তাকালো – না, কোনো জাদুর খেলায় ব্যাকপ্যাকটা প্রত্যাগমন করেনি।
আরো এগিয়ে গেল। যে দিকের দরজায় পল-এর সাথে দেখা হয়েছিল একটু আগে, সেই দিকে। উলটো দিক থেকে আসছে একজন গার্ড।
’হেল্প্! হেল্প্!’ ব’লে চেঁচিয়ে উঠলো শৈলেন।
গার্ড বললো, ’কি হয়েছে?’
’আমার ব্যাকপ্যাকটা খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ চুরি করেছে।’
ঠান্ডা গলায় কৃষ্ণকায় গার্ড বললো, ’শান্ত হোন। নিজেকে শান্ত করুন।’
গার্ডকে সাথে ক’রে শৈলেন কুপে ফিরে এলো। সব দেখালো। সব বললো। জুতো জোড়া মেঝেতে প’ড়ে আছে। বাঁ দিকের বার্থের নিচে থেকে উঁকি মারছে স্যুটকেস। খুঁটি থেকে ঝুলছে জ্যাকেট। আরেক জন যাত্রী ছিলেন কুপে। তিনি শেষ স্টেশনে নেমে গেছেন।
গার্ড জিগ্যেস করলো, ’যখন শুয়েছিলেন, কুপের এই স্লাইডিং দরজাটা লক্ করেছিলেন?’
’না তো!’
’খুব ভুল করেছেন। এই সব স্পেশাল প্রাইভেট কামরা। এখানেই চোররা বেশি আসে। অন্য কামরায়, যেখানে কুপের দরজা নেই, সব যাত্রীরা ব’সে ব’সে রাত পোহায়, সেখানে চুরি হয় না।’
‘তাহলে আমি কি করব? প্লিজ. আমাকে সাহায্য করুন!’
শীতল করুণাহীন কন্ঠস্বরে গার্ড বললো, ’আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না।’
শৈলেনের কথা ফুরিয়ে গেছে। কোথাও আর কোনো আশা খুঁজে পাচ্ছে না সে। মাথা নিচু ক’রে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবার চেষ্টা করলো আর কোথায় বা কীভাবে ব্যাকপ্যাকটা পাওয়া যেতে পারে। এমন কিছু সম্ভাবনা কি আছে যা শৈলেন এখনো ভাবেনি?
গার্ড মুখ ফিরিয়ে চ’লে যেতে উদ্যত হ’ল। তারপর কি মনে ক’রে আবার শৈলেনের দিকে তাকালো।
’আপনি বাথরুমে দেখেছেন?’
শৈলেন বললো, ’না তো!’
’দু’দিকের দুই বাথরুমই দেখুন একবার।’
গার্ড চ’লে গেল।
শৈলেন মনে মনে ভাবলো, ’যদি চোরই নিয়ে থাকে, সে বাথরুমে রেখে যাবে কেন?’
তবু একবার দেখলে তো ক্ষতি নেই। যে দিকের দরজায় পল-এর সাথে দেখা হয়েছিল, সে দিকেই চললো শৈলেন, কারণ মনে প’ড়ে গেল যে অন্য দিকের বাথরুমে ’অকেজো’ সাইন লাগানো আছে।
বাথরুমের দরজা লক্ করা নেই। দরজা খুলে ভেতরে উঁকি মারলো শৈলেন। না, বাথরুম খালি। কেউ নেই, কিছু নেই।
ট্রেন চলছে জোর কদমে। যাত্রীরা সবাই ঘুমোচ্ছে। গার্ড কোথাও চ’লে গেছে। শৈলেন ভাবলো এবার অন্য বাথরুমটাও দেখবে। নিজের কুপের পাশ দিয়ে, কুপ পেরিয়ে, চললো কামরার অন্য প্রান্তে। এই বাথরুমের গায়ে এখনো ’অকেজো’ চিহ্ন লাগানো।
দরজার হাতল ঘুরিয়ে ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। তাকিয়ে দেখলো মেঝেতে ওর ব্যাকপ্যাক। মুখ-ধোওয়ার সিঙ্কের কাছে মাটিতে পরিত্যক্ত হ’য়ে প’ড়ে আছে। ব্যাকপ্যাক খোলা।
হৃৎপিণ্ডটা যেন বুকের মধ্যে একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেলো। শৈলেন ভেতরে ঢুকে, বাথরুমের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে ব’সে, চট্ ক’রে দেখে নিল - হ্যাঁ, পাসপোর্ট আছে।
তাড়াতাড়ি ক’রে ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে, দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে, কুপের দিকে পা বাড়ালো শৈলেন। পথে আবার সেই গার্ডের সাথে দেখা।
’পেয়েছি! বাথরুমে পেয়েছি!’ ব’লে শৈলেন গার্ডকে প্রভূত পরিমাণে ধন্যবাদ জানালো।
কুপে ঢুকে, ভালো ক’রে ব্যাকপ্যাকের সব পকেট আর খাঁজ আর ভাঁজ দেখলো। না, মনে হচ্ছে সবই আছে, কিছুই খোয়া যায় নি। ক’দিন পরে হয়তো বোঝা যাবে কিছু নিখোঁজ হয়েছে কিনা। আপাতত মনে হচ্ছে -- না।
কুপের স্লাইডিং দরজাটা বন্ধ ক’রে, এইবার কুলুপ আঁটতে ভুললো না শৈলেন।
বেশ খানিকটা জল খেলো শৈলেন। ব্যাকপ্যাকটা ডানদিকের বার্থে রেখে, আলো নিবিয়ে, বাঁ দিকের বার্থে শুয়ে পড়লো।
কি হ’ল তাহলে? ব্যাকপ্যাকটা বাথরুমে নিয়ে গেল কে? কিছু তো চুরি হয়নি মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
কিছুতেই ঘুম আসছে না। খানিকক্ষণ চোখ খুলে জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকার আকাশ দেখলো শৈলেন। মাঝেমাঝে কোথাও থেকে এক ঝলকের জন্য আলো এসে প’ড়ে তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে যাচ্ছে।
ট্রেন চলেছে তার নিজের মনে, নির্ধারিত বেগে, পুনরাবৃত্তির তালে। যেন একটা সাংঘাতিক অবিনশ্বর উদাসীনতায়।
কে নিয়েছিল ব্যাকপ্যাক? ওই গার্ডটা? অন্য কোনো গার্ড?
সত্যিই কোনো চোর এসেছিলো? অন্ধকারে কুপে ঢুকে এসে ব্যাকপ্যাকটা উঠিয়ে নিয়েছিল? এত সাহস চোরের? তখন যদি শৈলেনের ঘুম ভেঙে যেত? এত বড় ঝুঁকি চোর নেবে? বিশেষ ক’রে গার্ডই যদি চোর হয়, তার এত সাহস হবে? ধরা পড়লে পুলিশ তো আছেই, সরকারী চাকরিটাও তাহলে যাবে।
বিশু আর কান্তির কথা একবার মনে হ’ল। হতভাগারা বেপাত্তা না হ’য়ে আজ যদি থাকতো, কি জানি ঘটনার স্রোত কোন্ দিকে মোড় নিত।
ঘুমোনোর কথা ভাবছিলোই না শৈলেন।
ট্রেন চলার অবিরাম শব্দের মধ্যেই হয়তো মন্থরা ফিসফিস ক’রে কখনো বললো, ’ঘুমোও এবার।’
শৈলেন মন্থরার হাতটা শক্ত ক’রে ধ’রে ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘুম ভাঙলো কয়েক ঘন্টা পরে। ভোর হয়েছে। সাতটার সময় গার্ড এসে দরজায় ধাক্কা মারলো। তাড়াতাড়ি উঠে প’ড়ে শৈলেন দরজা খুলে দিল। কফি এসেছে, সাথে বাসি পাঁউরুটি। গার্ড চ’লে গেল। গত রাতের ব্যাপারে কোনো কথা হ’ল না। শৈলেন আবার দরজায় কুলুপ দিলো। কফিতে একটা চুমুক দিয়ে টের পেলো যে খিদে পেয়েছে। পাঁউরুটিটাতে কামড় লাগালো। বাসি, তবু খাওয়া যায়। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।
ক্লান্ত লাগছে। কফিটা শেষ ক’রে আবার বার্থে গা এলিয়ে দিল শৈলেন। ব্যাগ চুরির কথা ভাবতে অবাক লাগছে। শেষ পর্যন্ত যে কিছুই খোয়া যায়নি, সেটা ভেবে হালকা লাগছে। উফ্! সত্যি সত্যি চুরি হ’লে কি কেলেঙ্কারিটাই না হ’ত। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কে? কেন?
আস্তে আস্তে একটা ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করলো শৈলেন। ঘুম আর জাগরণের মাঝে একটা গোধূলিতে। চেতনা আর অবচেতনের মধ্যবর্তী একটা কুয়াশায়।
মন্থরা কি কিছু জিগ্যেস করছে? শৈলেন যেন একটা বিভ্রান্তিতে বিহ্বল হ’য়ে রইল। মনে হ’ল কয়েকটা বিকল্প অনুকল্প আছে। তার থেকে একটা বেছে নিতে হবে।
’কিন্তু কী?’
প্যান্টের পকেটে একটা ফোন নাম্বার আছে না?
’হ্যাঁ, পল-এর নাম্বার।’
সেইটাতে ফোন করতে পারে শৈলেন।
’ফোন ক’রে কি বলবো? ওঁকে জিগ্যেস করবো উনি চোর কিনা? আমি জানি উনি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। চোর হ’তে পারেন না।’
শৈলেন চুপ করলো। মন্থরা আবার কিছু বললো ফিসফিস ক’রে? আজ থেকে সাতদিন পর হয়তো শৈলেনকে জার্মান পুলিশ থেকে ফোন করবে। ক’রে বলবে, চোর ধরা পড়েছে।
’কে ধরা পড়েছে? গার্ডটা?’
কিম্বা হয়তো কেউ কোনো দিনও ধরা পড়বে না। জীবনের অসীম রহস্যের মধ্যে এই ঘটনাটাও অমীমাংসিত র’য়ে যাবে।
’কিন্তু যেই চুরি ক’রে থাকুক, কিছু না নিয়ে ব্যাকপ্যাকটা বাথরুমে রেখে গেল কেন?’
হয়তো টাকা খুঁজছিল। কিন্তু ব্যাগে তো টাকা ছিল না। ছিল শৈলেনের বুক পকেটে। আর ব্যাগে ছিল পাসপোর্ট। কিন্তু পাসপোর্ট নিয়ে চোর কি করবে? অগত্যা নিরাশ চোর ব্যাকপ্যাকটা বাথরুমে পরিত্যাগ ক’রে পালিয়েছে।
ঘন্টা খানেক একটা অপার্থিব ঘোরের মধ্যে রইল শৈলেন।
তারপর এক সময় উঠে ব’সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো বাইরের ল্যান্ডস্কেপ পালটে গেছে। সবই সমতল। মাঝে মাঝে যে গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে, সেখানে বাড়িগুলোর ধাঁচ পালটে গেছে। খানিক পর পর গাছের সারি দেখা যাচ্ছে দূরে। সারিগুলো একেবারে নিখুঁত। সবকটা গাছের সমান উচ্চতা আর প্রত্যেক দু’টি গাছের মধ্যে সমান ব্যবধান।
শৈলেন বুঝতে পারলো যে প্রাকৃত জার্মানি ছাড়িয়ে পরিশীলিত নেদারলান্ডসে ঢুকে গেছে ট্রেন। অ্যামস্টারডাম আর বেশি দূর নেই।
প্যান্টের পকেট থেকে কাগজটা বার ক’রে দেখলো শৈলেন।
হাতের লেখা পরিষ্কার। তাড়াতাড়ি লেখা হ’লেও অক্ষরগুলো স্পষ্ট। পড়তে কোনও অসুবিধা নেই। সংখ্যাগুলো চিনতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না।
কাগজের টুকরোটা হাতে ধ’রে, জানলার দিকে তাকিয়ে, অনেকক্ষণ চুপ ক’রে ব’সে থাকলো শৈলেন। মাথার ভেতরটা সম্পূর্ণ খালি। সব চিন্তা, আবেগ, যুক্তি যেন আচমকা ছুটি নিয়ে শৈলেনের ক্লান্ত মস্তিষ্ক ছেড়ে চ’লে গেছে অন্য কোনো দেশে।
আরেকবার কাগজটা দেখলো শৈলেন। তারপর পাশ থেকে ফোন নিয়ে নাম্বারটা ডায়াল করলো।
রিং করার কোনো শব্দ হ’লো না। তার পরিবর্তে শৈলেন শুনতে পেলো একটা নির্লিপ্ত রেকর্ডিং – ’আপনি যে নাম্বারে ডায়াল করেছেন, সেই নাম্বারটি বৈধ নয়। অনুগ্রহ ক’রে ইত্যাদি ইত্যাদি।’
অবাক হ’য়ে ফোনটা অফ্ ক’রে পাশে রাখলো শৈলেন।
ওর মনে প্রশ্ন এলো, ’তবে কি পল নিজের নাম্বারটা নিজেই লিখতে ভুল করলেন?’
নিরুত্তর মন্থরার হাত ধ’রে সে ব’সে রইল অ্যামস্টারডাম পৌঁছনো অবধি।