• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || দিনবদলের সফরনামা; বা রংবদলের ||

    নকশালবাড়িনামা-- অসীম চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ৯; জুলাই ২০২২; ISBN 978-93-5425-383-6

    এটি যে আত্মজীবনী নয় সেটা তো গোড়াতেই লিখে দিয়েছেন বিখ্যাত লেখক-মহাশয়, আর আসলে এটা যে একটা ভ্রমণকাহিনি সেটা বললেন এই সেদিন, আনন্দ-পুরস্কারবিতরণী অনুষ্ঠানে।

    তাই ‘সফরনামা’ !

    কিসের সফর? কোথা থেকে কোথাকার সফর? এইচ জি ওয়েলস সাহেব টাইম-ট্রাভেল নিয়ে লিখে জগৎবিখ্যাত হয়েছিলেন—কাল থেকে কালে; আর এটি হলো মত থেকে মতে। তাই, মত বদলের সফরনামা—এ’মত থেকে সে’মত— শুরু যার নামী কলেজের পোর্টিকোতে, আর গণসংগঠন হয়ে শেষ যার খতমের রাজনীতিতে।

    বালাই ষাট, সেখান থেকে আবার ফিরে আসা নেই?

    জীবনের সাপলুডো খেলার এ’হেন অনন্য আত্মজীবনী আরও একটা লেখা হয়েছে কিনা সন্দেহ।

    ***

    নিজ পরিবারকে যতটা দরিদ্র করে এঁকেছেন আসলে ততটা না হলেও বীরভূমির এক গরীব-কিন্তু-মেধাবী কিশোর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার রেজাল্টের বলে ভারতশ্রেষ্ঠ কলেজের শ্রেষ্ঠ ডিপার্টমেন্টে পড়তে এলো সন ১৯৬০-এ। তিন বছর ফিজিক্স পড়েও ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে ফের অর্থনীতি অনার্সের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে অসীম অস্থিরমতিত্ব প্রকাশ পায় সেটা তাঁর সারাজীবন ধরেই বজায় ছিল, কারণ পার্লামেন্টকে শুয়োরের খোঁয়াড় বলা দলাধিনায়ক পরে আইনসভায় ঢোকবার জন্যই ভোটে লড়বেন, এবং সেই পার্টির সমর্থনে, সংশোধনবাদিত্বের অভিযোগে যাকে তিনি ও তাঁর গুরুবর সেই কবেই আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন [চারুবাবুর ‘আট দলিল’ মূলতঃ সংশোধনবাদেরই বিরুদ্ধে, না?]।

    এতেই শেষ নয়, অতঃপর আরও এক আপাদমস্তক দক্ষিণী (rightist) পার্টির ছত্রছায়ায় আবার তাঁকে সংসদীয় ভোটে দাঁড়িয়ে হারতে হবে না?

    বইটির ভূমিকায় লিখেছেনও, অবিশ্যি, ইনি যে কোন্‌ কোন্‌ পরিস্থিতিতে ওঁকে কী কী অবস্থান নিতে হয়েছিল সেটা পাঠককে জানানোর তাগিদটা ওঁর আজকের কলম ধরার অন্যতম কারণ।

    তাই না এ এক ‘সফরনামা’; (আত্মজীবনী নয়)?!

    ***

    আর কত কতই না উল্লেখ্য মোড়ের সন্ধান পাওয়া গেল এ’ কেতাব পাঠে, কতই না ‘সোনার পাথরবাটি’!

    যেমন, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’-র বিরহে হাপুসনয়ন হচ্ছে এক আপাদমস্তক স্তালিনীয় পার্টি—কেন্দ্রিকতা হলো, কিন্তু গণতন্ত্র এলো না !

    বা, ‘নকশালপন্থা’ আর ‘নকশালবাড়ির পথ’ যা আসলে আলাদা—এটাও কি আর আগে জানতেন, সুধী পাঠক?

    নামী পাবলিশারের দামি এই কেতাব পড়লে জানতে পারবেন।

    বা, ১৯৯৬তে ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিতে জ্যোতি বসুকে যে এই লেখকমশাই পই পই করে বলেছিলেন সেটাও তো জানতে পারতাম না এ’ কেতাব না পড়লে। এটাও জানতাম না যে এই উপদেশের জন্যে জ্যোতিবাবু ওঁর উপরে এতটা নির্ভর করতেন।

    ***

    কিন্তু এতেও তো জীবন থেমে থাকেনি, বয়ে চলেছে আনন্দধারায়—দুইটি বিবাহ ও পুরীতে সপ্তাহব্যাপী হনিমুন!

    ও সমুদ্রস্নান!

    পুলিশের পাকড় এড়াতে সুবর্ণরেখা-নদীতে মিহির সেন-সম সন্তরণ। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিশোরপাঠ্য কাহিনির মতো থ্রিল জাগায়! ‘আমি’ ‘আমি’ ‘আমি’ ‘আমি’—সারা বই জুড়ে, যেখানে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রাথমিকতম শিক্ষা যে ‘আমরা’ ‘আমরা’ [এইসব ভুলে যেতে হবে এ’গ্রন্থের রসগ্রহণ করতে চাইলে]।

    প্রভু চীনের হুকুম মেনে একাত্তরের বাংলাদেশ মুক্তি-আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন—আগ্রাসনকারী ভারতের নিন্দা করে। মূর্তিভাঙা বা খতমের রাজনীতির দায় হেলায় চাপিয়ে দিয়েছেন সরোজ দত্ত ও চারু মজুমদারের উপরে।

    ***

    কিন্তু এত হাবিজাবির মধ্যে তাঁর আসল লক্ষ্যের কথা ভুলে গেলে চলবে কি?

    কী সেই লক্ষ্য?

    চীনের চেয়ারম্যান-প্রদর্শিত পথে ভারতেও বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থার সমূল উৎপাটন করে কৃষকশ্রমিকের সরকার গড়ে তুলতে হবে না (সে তুমি দেশ ভারতবর্ষের ০.০০০০০১% জানলেও বা দেখে থাকলেও)? কিন্তু, শেষমেশ চীনদেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে ও ধমক খেয়ে ফিরে এসে এই উপলব্ধি যে ‘নেতা বা পার্টি নয়, জনগণই ইতিহাসের আসল নির্ধারক’! ভাবা যায়?

    চণ্ডীদাস ও নজরুলের গান মন দিয়ে শুনলে যে ‘পিপল-সেন্ট্রিক’ জ্ঞান হয়ে যেত, সে সোজা পথে না গিয়ে বিরাশি বছরের এক প্রাক্তন বিপ্লবী এখন বলছেন ‘মানুষ’-এর কাছে ফিরে আসতে হবে !

    ভাবো, ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো।

    এর মাঝে ঝরে গেছে কত প্রাণ, খালি হয়ে গেছে কত মায়ের কোল। সে সবই তোমাদের ঐ “বন্দুকের নল-ই ক্ষমতার আসল উৎস” শ্লোগানের জন্য, না?

    সত্যি, প্রকৃত বোধ আসতে যে কত সময় লাগে!

    ***

    এই সন ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে বইখানি পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে মনে সেকালে ওঁদের কেউ ‘মনুবাদী’ বলে দাগড়ে দেয়নি কেন?

    বাংলায় চাটুজ্জ্যে-মজুমদার-সান্যাল দিয়ে শুরু করে ও’পাশে রেড্ডি-পট্টনায়ক-সিংহের মতো উচ্চবর্ণীয় যে যে অতিবামপন্থী নেতৃবৃন্দ নকশাল আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, কৃষক-কৃষক করে মাতলেও গ্রাম-ও-কৃষিব্যবস্থা সম্বন্ধে তাঁদের জ্ঞানগম্যি ‘ধানচারা-ও-কাশফুলের মতই দুরপনেয়’ ছিল। ভাগ্যিস ওঁদের হাতে পড়েনি, নৈলে ভারতে ‘সবুজ-বিপ্লব’-এর মতো বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঘটতে আরও অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে যেত।

    বইটি পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে মনে লেখক নিজেকে অতি সৌভাগ্যবান বলে মনে করেন কিনা, যাঁর সারাজীবনের এচিভমেন্ট জিরো (আসলে, নেগেটিভ) হওয়া সত্ত্বেও আজও রোমান্টিক বাঙালি কাকা-চাটুজ্যেকে নিয়ে মাতামাতি করে এবং তা ভাঙ্গিয়ে এক উল্লেখ্য সাহিত্য পুরস্কার পান।

    ওঁর প্রথমা পত্নী সেই কবেই সার-টা বুঝে গিয়ে সংসার প্রতিপালনের জন্যে অসীমকে ইলেক্ট্রিক ফ্যানের ব্যবসা ধরতে বলেছিলেন। উনি রেগে আগুন! (পৃ ৩১২)

    ***

    বইটির কোনো এডিটর (নিদেন, প্রুফরিডার) আদৌ ছিলেন বলে মনে হয় না, কারণ এডিটিঙের বিন্দুমাত্র পরিচয় এতে পাওয়া যায়নি, ‘আনন্দ’-র বইতে যেটা অকল্পনীয়। বানান-সমতা নেই, একই ঘটনার উপর্যুপরি লিখন, তথ্যের বিচ্যুতি—এ’গুলি হয়ে পড়েছে বইটির আভরণ। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকালেই এ’সব চোখে পড়লেও গ্রন্থাকারে আসবার সময়ে এই সকল বিচ্যুতির মেরামতির দরকার ছিল।

    অনেক অনেক আশা নিয়ে শুরু করলেও তাই বইটিকে পাঁচে ডেড়ের বেশি দেওয়া যাচ্ছে না।

    || প্রথম ভারতীয় সাই-ফি ও স্বদেশিকতা ||

    A Journal of Forty-eight hours of the year 1945—-first published narrative (1835) by an Indian English author—-Kylas Chunder Dutt (Ed. Somdatta Mondal); Sambhabi, The Third Eye Imprint, Calcutta 700110; ISBN: 978-93-83888-15-3

    Science Fiction কে আদর করে Sci-Fi ডাকার চল আছে।

    ফিকশন মানেই কল্পনা, বাস্তবের রিপোর্টিং নয় তা; এবং উপন্যাস থেকে ছোটগল্প থেকে নাটক—এমন এমন নানান ফর্মে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। কঠিন বাস্তব বা সত্যের সঙ্গে ফিকশনের যদিও কোনো বিরোধিতা নেই, তবু শুধু তারই মধ্যে আটকে থাকে না ফিকশন— এটাই তার লক্ষণ, এখানেই তার মুক্তি। আবার ফিকশনে যদি ‘বৈজ্ঞানিকতা’-র ছোঁয়া এসে মেশে তাকে ‘কল্পবিজ্ঞান’ [মানে, ঐ Sci-Fi] বলি। যেমন, মেরী শেলীর নায়ক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যখন মৃতে প্রাণসঞ্চার করতে ল্যাবে গবেষণা করে এক বীভৎস অতিমানব সৃষ্টি করে ফেলে, প্রথম আধুনিক সাই-ফি উপন্যাস (১৮১৮) লেখা হয়ে যায় তখনই।

    আরেকটি কথা এখানে বলা থাক্‌: ‘কাল-ভ্রমণ’ [Time Travel] হলো সাই-ফি কাহিনীর এক অতি প্রিয় থীম, যেটি বারে বারে ঘুরে ফিরে নানান দেশে নানান লেখকের কলমে উঠে এসেছে। এইচ জি ওয়েলস সাহেবের যুগান্তকারী ‘দ্য টাইম মেশিন’ উপন্যাসিকা (১৮৯৫) এই নিরিখে শ্রেষ্ঠ।

    —এ’সব জ্ঞাত তথ্য।

    ***

    পলাশি ও বক্সার যুদ্ধের পর থেকে ‘ইংরেজ-কোম্পানির শহর’ কলিকাতার বোলবোলাও বাড়তে থাকায় আশেপাশের জেলাগুলি থেকে নানান পেশার লোকজন এসে জোড়াসাঁকো-সিমলে-কুমোরটুলি প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে।

    তেমনই একজন ছিলেন বর্ধমানের কায়েত নীলমণি দত্ত, যিনি ১৭৭১ খৃ. ওত্তর কলকেতার রামবাগানে থিতু হন, ও কালক্রমে এই দত্তবংশ শহরের এক প্রধান ঘর বলে স্বীকৃতি পায়। সোজা কথা নয়, রবিঠাকুরের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের পরে দ্বিতীয় আই সি এস মিঃ রমেশচন্দ্র এই দত্ত বংশেরই সন্তান ছিলেন, যাঁর ভাইঝি-দ্বয় স্বল্পজীবী তরু দত্ত অরু দত্ত বিলেতটিলেত গিয়ে ইংরিজি ও ফ্রেঞ্চে কবিতা লিখে টিখে… ইত্যাদি ইত্যাদি! নমস্যা মানুষ!! প্রখ্যাত বৃটিশ কম্যুনিস্ট রজনী পালমে দত্ত-ও এই বংশজাত।

    নীলমণির বড় ছেলে রসময় ছিলেন হিন্দু স্কুল/কালেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ও সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক—কলেজটি চালানো নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে যাঁর বিবাদ বহুখ্যাত (বা, অখ্যাত)।

    রসময়ের চারি পুত্র কৈলাস-গোবিন্দ-হর-ও-গিরীশ ইংরিজিতে নামের বানান লিখতেন Kylas-Govin-Hur-&-Greece(!), স্বয়ং রসময় লিখতেন Russomoy. পরে, সন ১৮৫৪ থেকে ১৮৬২-র মধ্যে রসময়ের ফ্যামিলি কেশ্চান হয়ে যায়, যদিও ওঁর দুই ভাই হরিশ ও পীতাম্বর হননি। মোটকথা, অতীব রাজভক্ত ইঙ্গ-নবীশ পরিবার ছিল এই রামবাগানের দত্ত-রা।

    পীতাম্বরের দুই ছেলে শশী ও ঈশান —শশীর কথায় পরে আসছি— ঈশান ছিলেন আই সি এস রমেশচন্দ্রের বাবা—- বাংলা উপন্যাস ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’ ও ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ লিখে বিখ্যাত হন রমেশচন্দ্র, যে দুটি উপন্যাসের নাম ঋষি বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ও ‘কপালকুণ্ডলা’-র সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়।

    একটা বংশ সম্বন্ধে এত কথা লিখছি কেন?

    কারণ, সেকালের মুক্তচিন্তার দিশারী হিন্দু কালেজের এক Creative Writing competition-র ডাকে এই বংশেরই কৈলাসচন্দ্র [নামের বানান লিখতেনঃ Kylas Chunder Dutt!] যে সাড়ে-পাঁচহাজার শব্দের রচনাটি লিখে পাঠিয়েছিলেন সেটিকে কোনো ভারতীয়ের লেখা প্রথম ফিকশন-তথা-কল্পবিজ্ঞানকাহিনী ব’লে মেনে নেন পণ্ডিতজনে [বঙ্কিমের ইঙ্গরাজী উপন্যাস ‘Rajmohan’s Wife’ তার প্রায় ত্রিশ বছর পরে প্রকাশিত হবে (1864); তাঁর যুগবিভাজক ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস তারও এক বছর পরে, সন ১৮৬৫তে]!

    বাবু কৈলাসচন্দ্রের ‘A Journal of Forty-eight Hours of the year 1945’ [এর পর থেকে—‘Journal’ লিখব] —সন ১৮৩৫-এ’ বসে লেখা ১১০-বছরের এক ‘আগামী-ইতিহাস’!!

    ভাবা যায়?

    না , প্রিয় পাঠক, আমি কোনো আর্থার ক্লার্কের ‘ভবিষ্যকালের সাই-ফি’ নিয়ে লিখতে বসিনি, না ঐ সন জুন-১৮৩৫তেই আমেরিকা থেকে প্রকাশিত এডগার এলেন পো-সাহেবের চন্দ্রাভিযান-কাহিনী "Hans Phaall -- A Tale", নিয়ে। নিশ্চিত, আমাদের কৈলাসবাবু সেটি পড়েননি (দুটিই সন ১৮৩৫-এর জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছিল)।

    আমার আজকের এই গ্র.স. কৈলাসচন্দ্রের সেই ১১০-বছরের ভবিষ্যকাহিনীটি নিয়েই !

    ঠিকাচে?

    কী ছিল সন-১৮৩৫-এ লিখিত কৈলাসের সেই যুগান্তকারী ছোটগল্পে?

    গত পঞ্চাশ বছর ধরে বর্বর ইংরেজের রাজত্বে উত্তক্ত দেশভক্ত-ভারতীয়গণ নবীনযুবক ভুবন মোহনের নেতৃত্বে অস্ত্র ধরলো হাতে, কারণ আবেদন-নিবেদনে কাজ হয় না যে কিছুই!

    অনেকানেক বাবু-রাজা-নবাবও সামিল হলেন এই যুদ্ধে—যাঁদের লক্ষ্য ছিল নগর কলিকাতার ফোর্ট উইলিয়ম দখল করা।

    তুখোড় ভাষণ দিয়ে যুবক নবীন উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁর বাহিনীকে, কিন্তু মূলতঃ অনভিজ্ঞতার কারণেই ভাইসরয় লর্ড ফেল বুচারের সৈন্যদলের কাছে পরাজয় হলো এংলো-ইণ্ডিয়ান কলেজের প্রাক্তনী যুবনেতা ভুবনমোহন ও তাঁর দেশীয় বাহিনীর ।

    ভাইসরয়ের আদেশে ভুবনের শিরশ্ছেদ করল সরকারী জলহাদ!

    [সারসংক্ষেপিত]

    কিন্তু কোনো সাই-ফি নিদর্শন কৈ এই দেশাত্মবোধক গল্পটির মধ্যে?

    কিচ্ছু নেই!

    [নমস্যা মা-বেগমরোকেয়ার ‘Sultana’s Dream’ (১৯০৫ খৃ.) সাই-ফি গল্পটিতে তবু না হয় সৌরশক্তি ও উড়ুক্কুযানের কথা বলা ছিল, যেগুলি সাই-ফি নিদর্শন বটে!]

    যদিও সাহিত্যমানে অনন্য-অসাধারণ কৈলাসচন্দ্রের বর্তমান গল্পটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বর্তমান গ্রন্থটির লেখিকা করেছেন এই বইটিতে যার পাঠ যে কোনো সাহিত্যপ্রেমীর কাছে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা !

    Sub-altern শব্দটির ব্যবহার এখানে উল্লেখযোগ্য, প্রো. রণজিৎ গুহ মহাশয়ের (১৯৯৭) প্রায় এক শত বৎসর আগে ইয়ং-বেঙ্গলি শ্রীমান কৈলাসচন্দ্র মশাই করেছিলেন এই শব্দটির ব্যবহার, বাঙালি ভুলে গেছে কি?

    লক্ষণীয়, এক রাজভক্ত বংশের সন্তানের কলমে এ’হেন রাষ্ট্রবিরোধী লিখন যে বৃটিশ-সরকারের কোপানলে পড়তে পারে, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি হিন্দু কালেজের তৎকালীন প্রবাদপ্রতিম প্রিন্সিপ্যাল ক্যাপ্টেন রিচার্ড লেস্টার ডেভিডসনের (যিনি কিনা ছিলেন মাইকেল মধুসূদনেরও মন্ত্রগুরু!)—-অনেকেরই (যথার্থ) অনুমান যে গল্পটির এই শিরোনামটি অধ্যক্ষ-সাহেবেরই দেওয়া, নিজের প্রিয় ছাত্র কৈলাসচন্দ্রকে রাজরোষানল থেকে বাঁচাতে—যাতে গল্পটিকে নিছক এক কল্পকাহিনী (Sci-fi. Science Fiction) বলেই উৎরে দেওয়া যায়।

    এর দশ বছর পরে লেখা কৈলাসচন্দ্রের ভাইপো শশীচন্দ্রের ‘The Republic of Orissa: Annals from the pages of Twentieth Century’ (1845) গল্পটিকেও অধ্যক্ষ রিচার্ডসন সাহেব এই ভবিষ্যবাদী মোড়কেই বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে নায়কের পরাজয় নয়, রীতিমত বিজয় দেখিয়েছিলেন শশী দত্ত মশাই।

    ***

    এত দীর্ঘ প্রাক্‌কথন লিখে বিশ্বভারতীর বর্ষীয়ান অধ্যাপিকা সোমদত্তা মণ্ডল দিদিমণির এই অনন্য গ্রন্থটির কাছে ফিরে আসতে হলো—অসাধারণ এই বিষয়ের উপরে লিখিত বর্তমান গল্প/গ্রন্থটিকে পাঠকের সামনে পেশ করার জন্যে!

    এই কাজের কোনো জুড়ি নেই—কেবলমাত্র ভবিষ্যৎ যার বিচার করবে, মূল্যায়ন করবে।

    প্রত্যেক সাহিত্যপ্রেমী ভারতবাসীর উচিত এই অনন্য গ্রন্থটি পাঠ করা—-সামান্য যে নিবেদনটুকু জানিয়ে এই অকিঞ্চিৎকর গ্র.স.-তে ইতি টানি—-অনবদ্য এই বইটি সম্বন্ধে এর চাইতে বেশি ভ্যাজানো অনুচিত।

    বাকি বিচার পাঠকের হাতে—যিনিই জনার্দন!!

    দশে বারো দিই বইটিকে!!!

    || রাতের সে নীরবতা… শুনেছ কি রাত্রির কান্না? ||

    পতিতাবৃত্তির উৎস সন্ধানেঃ উনিশ শতকের বাংলা—বিদিশা চক্রবর্তী; বুকপোষ্ট পাবলিকেশন, কলকাতা-৯; অগাস্ট ২০২৩; ISBN: 978-81-94321-5-6-9

    সুকুমারী ভট্টাচার্যের অসামান্য নিবন্ধ ‘প্রাচীন ভারতে গণিকা’ হয়ত তখনও পড়িনি, —-সে আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে্কার কথা হবে, ইংরিজিতে লেখা একটা বই পড়েছিলাম—এই বিষয়ের উপরে সেটিই ছিল প্রথম, এখন বর্তমান বইটি পড়তে পড়তে সেই বইটির কথা মনে আসছিল। নেট ঘেঁটে দেখি, দুই লেখিকা— তিনি-আর-ইনি প্রায় সমবয়সী, এবং একই ক্ষেত্রের গবেষণায় উৎসাহী।

    ইয়েল-অক্সফোর্ডে শিক্ষিতা সেই গ্রীক অধ্যাপিকা রুথ মাজো কারাসের অসামান্য বইটি আজ সহজেই ই-বুক রূপে পাওয়া যায় [কিনলাম], নামঃ ‘Common Women: Prostitution and Sexuality in Medieval England’.

    না, এই মানের নন-ফিকশন খুব বেশি সংখ্যায় পড়িনি অদ্যাবধি।

    ***

    আর আমাদের এই ইনি?

    প্রেসিডেন্সির কৃতি-প্রাক্তনী বিদিশা চক্রবর্তী দীর্ঘকাল ছিলেন পঃবঙ্গ অভিলেখাগারে, যাঁর আরও তিনটি কেতাব আগেই পড়েছি ও মুগ্ধ হয়েছি। যে নিবেদিতপ্রাণতা নিয়ে ও নিখাদ যুক্তি-ও-উদাহরণ দিয়ে উনি নির্মাণ করেছেন বর্তমান গ্রন্থটিকে, অনায়াসে সেটি রুথ-দিদিমণির বিশ্বমানের বইটির (OUP) সাথে তুলনীয় হয়, বা ছাপিয়ে চলে যায়। আর কিছু না হোক্‌, গণিকাবৃত্তির সমস্যা বা বেদনাটি তো মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে বা কলোনিয়াল কলকাতায় মূলতঃ একই ছিল, আজও হয়ত আছে।

    বিদিশা, সম্ভবতঃ, রুথ-কে পড়েননি; কারণ ওঁর দীর্ঘ গ্রন্থ-তালিকায় রুথ ঠাঁই পাননি। [এই গ্রন্থ-তালিকাটি/গুলি নিজগুণেই এক অনবদ্য প্রাপ্তি]!

    ***

    রুথের বইটিতে একটি অধ্যায় রয়েছে, ‘Becoming a Prostitute’; সেটি যেন বিদিশার দ্বিতীয় অধ্যায়টির প্রতিরূপ (‘উনিশ শতকের বাংলায় বাল্যবৈধব্য ও পতিতাবৃত্তি’)। পড়তে পড়তে ক্ষিপ্ত হতে হয়, বেদনাহত হতে হয়,—সেই একই দারিদ্র্য-অশিক্ষা-অনাচার-ও-প্রতারণার পৌনঃপৌনিকতা দেশ-কাল ভেদে একই! একই! আর আর্থিকভাবে ও শারীরিকভাবে বেশি অসুবিধাজনক অবস্থিতির কারণে নারীর উপরেই প্রত্যাঘাতটি বেশি আসে, এসেছে, এসে চলেছে।

    ***

    কত কী-ই যে জানতাম না!

    কলোনিয়াল কলকেতার পতিতাদেরও আয়কর দিতে হতো!

    সন ১৮৬২-র রেভিন্যু রেকর্ড দেখিয়ে লেখিকা লিখছেন, ১৮৬০-এর আগে অবধি দু’শো টাকা পর্যন্ত ইনকাম করমুক্ত ছিল, পরে ঐ লিমিট বাড়িয়ে পাঁচশ’ করা হলে পটলডাঙা নিবাসী জনৈক শেখ সোনাউল্লা লাটসাহেবকে চিঠি লিখে গণিকাদিগকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করে তদনুযায়ী ট্যাক্সো চাপানোর সুপারিশ করেন।

    ***

    পতিতাবৃত্তির রমরমার কারণ খুঁজেছেন লেখিকা পণপ্রথা, বহুবিবাহ, কুলীনপ্রথা, ও বালবৈধব্যের মধ্যে; এবং এর খোঁজে বঙ্গদেশ ছেড়ে উত্তরপশ্চিম ভারতে পর্যন্ত ‘গেছেন’ (কারণ, আমরা বাঙালিরা কিনা সমাজসংস্কারের প্রশ্নে কেবল রামমোহন-বিদ্যাসাগরকে নিয়েই অগাধ গর্ব করতে ভালোবাসি)! পেশোয়ারবাসী কায়স্থসন্তান মুন্সী পিয়ারীলালের আন্দোলনের কথা আগে পড়িনি, যিনি ডাকবিভাগে কর্মসূত্রে বিহারের আরায় এসে ক্রমে পণবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সরকারী চাকুরিটিই ছেড়ে দেন। পতিতাবৃত্তির মতো পরিহার্য পেশার বাড়বাড়ন্ত রুখতে যে এ’হেন সমাজ-সংস্কার অতি জরুরি, সেটা অনুধাবন করা তখনই তেমন কঠিন ছিল না বটে।

    ***

    প্রাসঙ্গিক আলোচনায় কলোনিয়াল কলকাতার শ্বেতাঙ্গা গণিকাদের কথা সাধারণত অনুল্লেখিত থেকে যায়। ওঁর অন্য একটি অসাধারণ গ্রন্থে [শর্মিষ্ঠা দে-র সঙ্গে সহ-লিখিত] বিদিশা এই বিষয়ে বিস্তৃত লিখেছেন। পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বর্তমান গ্রন্থটিতে বিষয়টি সামান্য ছুঁয়ে গেছেন। পাক্কা ইংরেজতনয়া হয়ত সংখ্যায় নগণ্য ছিলেন, কিন্তু রুশ-রুমানিয়ান থেকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান শ্বেতাঙ্গিনী গণিকারা সেকালের কলকাতার কলিঙ্গা, ব্ল্যাকবার্ণ লেন, কারলেন প্রভৃতি অঞ্চলে চুটিয়ে ব্যবসায় করে গিয়েছেন—নৈর্ব্যক্তিক গবেষণার স্বার্থে এই তথ্যও ধরা থাকুক।

    ***

    অতি প্রয়োজনীয় ‘পরিশিষ্টে’ ‘সেল ডীড’ ও রেজিস্টারের পৃষ্ঠার ফটোকপি তুলে এনে শহর কলিকাতায় গণিকা কেনাবেচার রেকর্ড দাখিল করা হয়েছে। এ’ ১৮৫০-এর দশকের আগেপিছে সময়ের কথা। পড়ে শিউরে উঠতে হয়, সামান্য ১৩-২৫-৪৫ টাকার বিনিময়ে ১৬-১৮-২০-২৫ বছরের নারীদের বিক্রি করে দিয়ে গেছে তাদের পতি বা অন্য আত্মীয়রা। ত্রুটিযুক্ত ছাপা বা ব্যাখ্যার অভাবে আর কয়েকটি পরিশিষ্ট অবশ্য মার খেয়ে গেছে; পড়া যাচ্ছে না।

    ব্রাহ্মণ্যপ্রথা বা বহুবিবাহের মতো যে সব সামাজিক সমস্যার বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি তো সবই বর্ণহিন্দু সমাজের বিষয়। তাহলে পরিশিষ্টের লিস্টিতে অত অত মুসলিম ও নিম্নবর্গীয় নারীর নাম আসে কী করে? তাদের পতনের কারণ/যুক্তি তবে কী? সে ব্যাখ্যা নেই। এই বেশি হিন্দুকেন্দ্রিকতা বইটির একটি খামতি বটে।

    এতদসত্ত্বেও বর্তমান বিষয়ের উপরে এ’খানি সংগ্রহযোগ্য একখানি কেতাব—এ’ সত্য ধরা থাক এখানে।

    || তেনাদের কথা! চুপ্‌….শ্‌ শ্‌ শ্‌ শ্‌ ||

    কলকাতার ভূত—দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়; ঋত প্রকাশন, কলকাতা-৯; অক্টোবর ২০২৩; ISBN 978-93-94181-72-4

    আউট্রাম ঘাট থেকে বেশি দূরে নয়। ফুরুফুরে গাঙ্গেয় হাওয়া আসে বেশ।

    তা বলে গঙ্গার হাওয়ায় পিয়ানোর রীড উঠবে পড়বে উঠবে পড়বে এমনটা তো আর হতে পারে না। কিন্তু সেটাই নাকি হতো। অনেকেই শুনেছে নিজকানে। এবং তাঁরা সব ছিলেন সেকালের বাংলার শিল্পসঙ্গীতজগতের মাথা!

    হচ্ছে রাজভবনের কাছেই গার্স্টিন প্লেসের কথা; সেখানেই তখন কলকাতা বেতারকেন্দ্র অবস্থিত ছিল কিনা। তেঢেঙ্গে এক গোরাসাহেবের দেখা মিলত—আবছায়া-আবছায়ায়—যিনি কিনা নোটেশন ভুল হলে বেজায় চটে যেতেন, নড়ে উঠত কাঠের আলমারীটা। আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মশাই বুঝিয়ে বললে বা ধমক দিলে সমঝে যেত সেই গ্যারীসাহেবের ভূত! এ’গল্প প্রেমাঙ্কুর আতর্থী থেকে বেলা দে থেকে ইন্দিরা দেবী অনেকেই শুনিয়ে গিয়েছেন।

    বা, ১৯৪৮-এর ৩০শে জানুয়ারি সন্ধ্যায় মফস্বলে বসে প্ল্যানচেট করতে করতে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যেন দেখতে/জানতে পারলেন চারজন দেবদূত এক দিব্যরথে চড়িয়ে মহাত্মা গান্ধীজির জ্যোতির্ময় শরীর নিয়ে চলে গেল স্বর্গলোকে! ইত্যাদি ইত্যাদি। রেডিওর সান্ধ্যনিউজে সে খবর পেলেন তার বেশ কিছু পরে!

    ***

    ভূত আছে কি নেই, ভূত বলে সত্যি সত্যিই কিছু হয় কি না—এ’সব হল গিয়ে ছেঁদো প্রশ্ন। ভূত ইজ্‌ ভূত—আদি ও অকৃত্রিম ভূত—তার আবার সত্যিমিথ্যে কী? ভূতের নিবাস কথাসাহিত্যে, লেখক-পাঠকের (বা, বক্তা-শ্রোতার) মনোজগতের আঙিনায়। পাঠক যেমন প্রেমের গল্প পড়তে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন রোমাঞ্চকর বা করুণ বা হাস্যরসের গল্প, তেমনই ভয়ালরসও সাহিত্যের এক প্রধান রস, যাতে (বাংলায়) ‘সম্পত্তি-সমর্পণ’ বা ‘কামিনী’ বা ‘ফ্রিৎ স’-এর মতো রসোত্তীর্ণ সাহিত্যসৃষ্টি হয়েছে, এবং যেগুলি আজও পাঠককে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ভৌতিকরসের গল্প মানেই যে সেখানে একটা ভূত বা ভৌতিক চরিত্র থাকতেই হবে সেটা জরুরি নয়, জরুরি হলো ভৌতিক-অনুভূতিটা। ‘খগম’-এর চাইতে ভয়াল গল্প বেশি লেখা হয়নি আর, কিন্তু তাতে ভৌতিক চরিত্র কৈ? তবু, আজও রাতে গল্পটা পড়লে সহজে ঘুম আসতে চায় না, না?

    না, বর্তমান বইটিতে যে এ’হেন ভূততত্ত্বের কথাই শোনানো হয়েছে কেবল, তা নয়। তবু, ‘Table Turning’, ‘Ouija Board’ ও ‘Automatic Pencil’-এর মতো প্রেতচর্চার নানান প্রকরণের কথা আলোচিত হয়েছে বিস্তৃত রূপে। এসেছে নগর-কলিকাতার আদিতম প্ল্যানচেটকারী ‘ডিরোজিয়ান’ প্যারীচাঁদ মিত্রের উল্লেখ। ঠাকুরবাড়ি ও রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই বিদ্যায় উৎসাহী ছিলেন সেটা জানা তথ্য, তবু তাঁর থেকেও তিন দশক আগে এই ‘আলাল’ টেকচাঁদ ঠাকুর প্ল্যানচেটে দিগগজ হয়ে উঠেছিলেন সেটা জানা ছিল না।

    আর এ’ বইয়ের সর্বাঙ্গ জুড়ে রয়েছে ছুট্‌কাহানীর পর ছুট্‌কাহানী! অতি উপাদেয় ও রসসমৃদ্ধ পাঠ বটে!

    যেমন, রাইটার্স বিল্ডিঙের যে অলিন্দে অসীমসাহসী যুদ্ধ লড়ার পর শহীদ হন বিনয়-বাদল-দীনেশ, বিশ বছর পরে এক সন্ধ্যায় সেখানে স্যুট-টাই পরা এক সাহেবকে কাতরাতে কাতরাতে বুক চেপে ধরে শুনশান সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখেন বিল্ডিঙের কেয়ারটেকার স্বয়ং। বুলেট-ফোঁড়া বুক থেকে রক্তের ধারা নেমে এসেছে তাঁর। এবং একবার নয়, একাধিকবার সেই সাহেবকে দেখেছিলেন ফণী রায়।

    আরও আছে।

    সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অতি আদরের নাতবৌ অমিতা ঠাকুরের লেখা থেকে জোড়াসাঁকোর ছাদে তাঁর এক শ্বশুর ঁনীতীন্দ্রনাথের ভারী পদধ্বনির শব্দ পাঠকও (যেন) শুনতে পান। আরেক পুত্রবধূ হেমলতাদেবীকে অনেকবার দর্শন দিয়েছিলেন প্রয়াত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মেজাজী ঢঙে কী যে বলতে চাইতেন উনি, বোধগম্য হয়নি তা হেমলতার।

    শান্তিনিকেতনের আর্কাইভে গুরুদেবের ‘প্ল্যানচেট-পেপার্স’ সযত্নে রক্ষিত আছে। যে কোন উৎসাহীজন (অনুমতিসাপেক্ষে) দেখে আসতে পারেন সে সব।

    তন্বী গ্রন্থটির শেষ প্যারাগ্রাফখানি অতি মনোজ্ঞ!

    প্ল্যানচেটে অত্যুৎসাহী ঠাকুরবাড়ির অমন এক আসরে তাঁদের পুরনো এক ঁ কর্মচারীকে ডেকে পরলোকের অবস্থা জানতে চাইলে সে বলে ওঠে, ‘বাবুমশায়রা, আমি মরে যা জানতে পারলাম, আপনেরা জ্যান্ত থাকতেই সে স-ব জেনে নিতে চান?’

    হালকা চালে বললেও, পরলোকচর্চার এর চাইতে বেটার লাস্ট লাইন আর কিছু হতে পারে না।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments