রঙ্গমঞ্চের কুশীলবদের দর্শক দেখেন দূর থেকে। আলোর কেন্দ্রে। মঞ্চে শিল্পী মিশে থাকেন অন্য চরিত্রের আলখাল্লায়। কিন্তু মঞ্চের বাইরে শিল্পী তো আমার আপনার মতোই সাধারন এক মানুষ। তবে শিল্পীদের বোধ হয় অত সাধারণ হওয়ার জো নেই। তার পেশা-ই বাধ সাধে। চরিত্রের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে মামুলীযাপন হয়ত তাকে সহজলভ্য করে দেবে। তাই তাদের টিকিয়ে রাখতে হয় 'এ আমির আবরণ'। অনেক কাল আগের কথা। তখন থিয়েটারের মেয়েদের, মানে অভিনেত্রীদের, ঘোড়ার গাড়িতে করে আনা হত। সহিস কোচ্ ম্যানদের উপর হুকুম ছিল গাড়ির জানলা দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে মেয়েদের আনতে হবে। গরমে বন্ধ গাড়িতে হাঁসফাস অবস্থা মেয়েদের। একদিন স্টার থিয়েটারের মেয়েরা গাড়ির জানলা খুলে এলে সেই বেয়াদপি নজরে পড়ে থিয়েটারের মালিক ও দিকপাল অভিনেতা অমর দত্তের। তিনি ধমকি দিয়ে বলেন "রাস্তার লোক হামেশাই যদি তোমাদের দেখতে পায়, তাহলে তোমাদের দেখার জন্যে তারা পয়সা খরচ করে থিয়েটারে আসবে কেন?" তাই তো! অধরা বলেই না তারা 'তারকা'! সাধারণের থেকে দূরত্বে থাকে বলেই কলাকুশলীদের জীবন নিয়ে আপনার আমার এত কৌতুহল।
বিশ শতকের নাট্যমঞ্চের এক নেপথ্য কারিগর দেবনারায়ন গুপ্ত (১৯১০-২০০০), যিনি বহু কলাকুশলীর সান্নিধ্যে এসেছেন। তাদের সাথে মিশেছেন অন্তরঙ্গ ভাবে। মঞ্চের বাইরে তাদের আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতা, অনুরাগ কিংবা অনটনের ইতিহাস তাঁর কাছে অনায়াসে ধরা দিয়েছে।১৯৫৩ সালে দেবনারায়নবাবু যোগ দেন স্টার থিয়েটারে। নাটক রচনা, নির্দেশনা ও নাট্যরূপ নির্মাণের পাশাপাশি তিনি একজন সাংবাদিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিকও। তিনি এক সময় 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সম্মানিত হয়েছেন বহু পুরস্কারে।দেবনারায়নবাবু তাঁর স্মৃতির ঝুলি থেকে রঙ্গমঞ্চের হরেক অজানা আখ্যান আমাদের উপহার দিয়েছেন। সে যুগের কলাকুশলী, থিয়েটার কর্মী ও যাঁদের আর্থিক আনুকূল্য ও সহৃদয়তায় স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী থিয়েটার ও রঙ্গমঞ্চ তার যাত্রাপথ সুগম করেছিল, সেই সব জানা-অজানা ব্যাক্তি ও ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে 'উইংস-এর আড়ালে' বইটিতে। থিয়েটারের সংকট-মুহূর্তে নিজেদের হাজার দৈন্য সত্ত্বেও যাঁরা থিয়েটারকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন তাঁদের কথাও স্মরণ করেছেন লেখক। আবার রয়েছে এমন অনেক প্রতিভাবান অথচ বেসামাল অভিনেতা-অভিনেত্রীর জীবনকথা, শ্রী গুপ্ত কলম না ধরলে যা গুপ্তই থেকে যেত। এই মনিমানিকের হদিশ বড় সুলভ নয়। এ যে ইতিহাসের গন্ধমাখা!
রাশিয়ান সাহেব গেরাসিম লেবেদেফের হাত ধরে বাংলা রঙ্গমঞ্চের যাত্রা শুরু। ১৭৯৫ সাল। পর্যটক লেবেদেফ দুটি ইংরাজী নাটকের বাংলা রূপান্তর করেন। বাংলার সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালবাসা তাঁর। সেই দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয় এই বাংলার বুকেই। শোনা যায় দর্শকরা নাকি টিকিট কেটে সেই অভিনয় দেখেন। সেই নাট্যশালার ঠিকানা ছিল ২৫ নং ডোমতলা, আজ যার নাম এজরা স্ত্রীট। কোন এক গোলোক নাথ দাস তাঁর এই ইতিহাস সৃষ্টির নেপথ্য সহযোগী ছিলেন। ভাবা যায়! বাঙালীর নাটকের পথচলা শুরু এক সাহেবের হাত ধরে! লেবেদেফ-এর পর কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। তাঁর দেখানো পথে বাংলা নাটক অভিনীত হয়েছে বটে, তবে তা ধনীর দালানে, জলসাঘরে বা বাগানবাড়িতে। দর্শক ছিলেন আমন্ত্রিত অভিজাতরাই। এই বড়লোকি বিনোদনকে সাধারনের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পোকা যাদের মাথায় ঢুকলো তাদের মধ্যে অন্যতম গিরিশ চন্দ্র ঘোষ। ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রলাল বসু, রাধামাধব কর, মতিলাল সুর, এবং ক্ষেত্রমোহন গাঙ্গুলীরা। সামান্য চাঁদার টাকায় শ্যামবাজারে রাজেন্দ্রলাল পাল-এর বাড়ির উঠোনে মঞ্চস্থ হল 'লীলাবতী'। উৎসাহের জোয়ারে ভেসে চলেছে নাট্যমোদী তরুণের দল। আর চেয়েচিন্তে নয়। এবার টিকিট বেচেই থিয়েটার হবে। টিকিট বেচেই হবে স্থায়ী নাট্যশালা। কিছুদিন পরেই জন্ম নেবে ন্যাশনাল থিয়েটার। বাংলার প্রথম পেশাদার মঞ্চ। সেটা ১৮৭২ সাল। দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পন'-এর প্রথম মঞ্চায়ন দিয়েই উদ্বোধন হল ন্যাশনাল থিয়েটারের। পর পর গড়ে উঠল বেশ ক'টি পেশাদার মঞ্চ। বেঙ্গল থিয়েটার, স্টার থিয়েটার, এমারেল্ড থিয়েটার, মিনার্ভা, রঙমহল, বিশ্বরূপা। আশির দশকের শেষ দিকে বা নব্বই এর দশকের গোড়া পর্যন্ত এইসব পেশাদার মঞ্চে প্রায় নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। মঞ্চ তৈরি করেছে বহু দিকপাল অভিনেতা অভিনেত্রীকে। তবে অনটন এই শিল্পমাধ্যমের নিত্যসঙ্গী হয়ে থেকেছে। কখনো যে রমররমা ছিলনা তা নয়, তবে সেটা প্রাচুর্যের দিন ছিলনা। অভাব অনটনের মাঝেও ছিল অনাবিল আনন্দের ধারা। 'উইংস-এর আড়ালে' শুরু হয়েছে এসব গোড়ার কথা পেরিয়ে। মোটামুটি বিশ শতকের মাঝের ছ'সাত দশক জুড়ে তার বিস্তার।
আজকের ওটিটি প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাদ দিলে অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে চেনেন না এমন মানুষ পাওয়া ভার। তাঁর অভিনয় জীবন শুরু মঞ্চেই। স্টার থিয়েটারে। তিনি ছিলেন জাত-শিল্পী। কি হাস্যরস, কি করুণরস, এক কথায় সবরকম রসসৃষ্টির ক্ষমতা ছিল তাঁর। তিনি নাচতে পারতেন, গাইতে পারতেন, বাজাতে পারতেন। তিনি যে থিয়েটারে কাজ করেছেন সেই থিয়েটারের পরিচালকেরা নিশ্চিন্ত থাকতেন, যদি কোন দায়-অদায় ঘটে তো, তুলসীবাবু সামলে দেবেন। এত ভরসা যার ওপর, সেই তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় জীবনের গোড়ার দিকের কথা শুনলে থিয়েটারের হালচালের কিছু আভাস পাওয়া যায়। তুলসীবাবুর কথায়, "আমি যখন থিয়েটারে ঢুকেছি ভাই, তখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। কত দিন আমরা মোজা এঁকে নিয়ে স্টেজে নেমেছি।" "মোজা এঁকে নিয়েছেন? সে কি!" তুলসীবাবু খোলসা করেন, "তখন ফতুয়া বা গেঞ্জি যে যা পরে আসতো, তার-ই ওপরে সাজ-পোশাক চাপানো হতো। যাঁরা বড় অভিনেতা ছিলেন,তাঁরা অবশ্য গেঞ্জি বা মোজা পেতেন। আর আমাদের মতো যারা, অর্থাৎ গ্রামবাসী কি সৈনিক সাজি বা কোরাসে গান গাই, তাদের সকলকেই মোজা এঁকে নিতে হোত। একদিন থিয়েটারে এসে দেখি একজন মাঝারি রকমের শিল্পী আসেননি। তার পার্টটা আমাকে করতে হবে। কতদিন পরে একটা চান্স এসেছে। মহা উৎসাহ। হেড-ড্রেসারের কাছে গিয়ে জানালাম। অমুক লোক আজ আসেনি, তার জায়গায় আমায় সাজতে হবে। আমায় জুতো মোজা সাজ পোশাক দাও। জুতো মোজার কথা শুনে তিনি তো গর্জে উঠলেন। বললেন, এগারো টাকার এ্যাপ্রেন্টিস, চল্লিশ টাকা মাইনের আর্টিস্ট-এর সাজ পোশাক, জুতো, মোজা পরতে এসেছিস? যা যা, মোজা এঁকে নিগে যা। মনে বড় কষ্ট হল। চান্স যদিও বা পেলাম, কিন্তু ভাল সাজ-পোশাক পেলাম না। নিজেদের সাজঘরে যা পোশাক পেলাম তাই পরে, পুরু করে সবেদা গুলে হাঁটু থেকে পায়ের চেটো পর্যন্ত লাগালাম। তারপর পায়ের ডিমের ওপর লাল আলতা দিয়ে বর্ডার এঁকে নিলাম। ব্যস্। মোজা হয়ে গেল।"
এই তুলসী চক্রবর্তীরই আরেক মজার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন লেখক। তবে তা উইংস-এর আড়ালে না। মঞ্চের অঘটন। "সেদিন ছিল 'দুর্গেশনন্দিনী'র অভিনয়। আমার বিশেষ কোন পার্ট ছিল না। দু একটা জায়গায় সৈন্য সেজে বেরুই। সেদিন এসে শুনি, যিনি হাকিমের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি আসেননি। হুকুম হোল আমায় হাকিম সাজতে হবে। মহা উৎসাহে হাকিমের যা কিছু সামান্য সংলাপ ছিল, তা বার বার পড়ে মুখস্ত করে ফেললাম। তারপর হাকিমের সাজ পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। সেদিন আয়েষা করছিলেন তারাসুন্দরী আর জগৎ সিংহ তারক পালিত। সকলে তাঁকে 'পালিত সাহেব' বলত। মেজাজটাও সেইরকম। পান থেকে চুন খসবার উপায় ছিল না। যথাসময়ে আমার সিন এলো। অসুস্থ জগৎ সিংহ শুয়ে আছেন। আয়েষা অদূরে। আমি হাকিম সেজে মঞ্চে প্রবেশ করলাম। তারপর জগৎ সিংহকে পরীক্ষা করে বলব -- আর চিন্তা নাই বেগম সাহেবা, কুমার এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু ঐ দুই নামকরা অভিনেতা অভিনেত্রীর মাঝে পড়ে, আমি যেন কি রকম নার্ভাস হয়ে গেলাম। ফস্ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল - আর রক্ষা নাই বেগম সাহেবা, কুমার এ যাত্রায় চিন্তা পেয়েছেন।" দর্শকরা হো হো করে হেসে উঠলেন। মঞ্চ থেকে বেরিয়ে পালিত সাহেবের হুঙ্কার- "কোথায় গেল সে?" "পালিত সাহেবের মারের হাত থেকে রেহাই পেতে হাকিমের পোশাকেই পাঁচিল টপকে স্টার লেন দিয়ে ছুটে পালালাম।" সেদিনের পাঁচিল টপকে পালানো তুলসীবাবু-ই আমাদের দেখা অন্যতম সেরা অভিনেতা, যার অভিনয়কে কখনো অভিনয় বলে মনেই হয়নি।
এমন সব অনেক মজাদার অভিজ্ঞতার কথা ছড়িয়ে আছে উইংসের আড়ালে আবডালে। আছে নিষ্ঠার কথা, দায়িত্ব বোধের গল্পও। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে প্রভা দেবী এক স্মরণীয় নাম। একদিন নাটকের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রভা দেবী বলেছিলেন, অভিনেতাকে নিষ্ঠাবান হতে হবে, একাগ্র হতে হবে। তাঁর সেই নিষ্ঠার বাস্তব প্রমাণ পেয়েছিলেন লেখক। "রঙমহলে 'নিষ্কৃতি''র অভিনয় চলছে। গিরিশ - জহর গাঙ্গুলী আর সিদ্ধেশ্বরী - প্রভা দেবী। প্রায় প্রতিটি শো হাউস ফুল। দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা পড়ার সাথে সাথে আমাদের কেউ একজন এসে খবর দিল শিগগিরি আসুন, প্রভা দেবী অজ্ঞান হয়ে গেছেন।... প্রভা দেবী তখন স্টেজের ওপর অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন। একটা কাঠের চোকলা পায়ের ভেতর ঢুকে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে। ডাক্তারকে ডাকতে পাঠানো হোল। তিনি এসে দেখে বললেন অপারেশন করে বের করতে হবে। জহরবাবু বললেন এ্যাকসিডেন্টের কথা দর্শকদের জানিয়ে দিন। দর্শকরা যদি টিকিটের দাম ফেরত চান দিয়ে দিন।.... আমি স্টেজে গিয়ে দুর্ঘটনার কথা দর্শকদের কাছে নিবেদন করলাম এবং জানালাম আজ বোধ হয় আর প্রভা দেবীর পক্ষে অভিনয় করা সম্ভব হবে না। আপনারা ইচ্ছে করলে অপেক্ষা করতে পারেন অথবা টিকিটের দাম ফেরৎ নিতে পারেন। কিন্তু একথা বলার পরেও দর্শকেরা বসেই রইলেন। কেউ-ই টিকিটের দাম ফেরৎ নিলেন না। সকলেই যেন মুষড়ে পড়লেন। আমাদের বিপদে আজ দর্শকেরাও যেন বিপদগ্রস্ত।" এর পর শল্যচিকিৎসার সাহায্যে কতকটা সুস্থ হলেন প্রভা দেবী। জ্ঞান ফিরতেই খোঁজ নিলেন নাটকের। যখন শুনলেন দর্শকেরা উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করছেন, তিনি বললেন, 'কি লজ্জা! ড্রপ তোলার ব্যাবস্থা করুন। আমি ঠিক হয়ে গেছি'। প্রায় দেড় ঘন্টা পরে ড্রপ উঠল, পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে আবার অভিনয় শুরু করলেন প্রভাদেবী।
থিয়েটারের অনেক মেয়েকেই উইংস-এর আড়ালে খুঁজে পাই এ বইতে। পেশাদারী মঞ্চের গোড়ার যুগে অভিনেত্রী তিনকড়ি তাঁর অসামান্য অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সে যুগে একাধিক দুরূহ চরিত্রে তিনি রূপদান করে যশস্বিনী হয়েছিলেন। যেমন গিরিশচন্দ্রের 'জনা' নাটকে তার অভিনয় এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। তিনকড়ি ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীনা। কিন্তু নটগুরু গিরিশচন্দ্রের শিক্ষাধীনে, তিনি 'ম্যাকবেথ' নাটকে, লেডি ম্যাকবেথের মতো কঠিন চরিত্রে অভিনয় করে বিস্মিত করেছেন দর্শকদের। পতিতাপল্লীতে বড় হওয়া তিনকড়ি পরিবারের শত লাঞ্ছনা সয়েও মঞ্চকেই তাঁর জীবনের একমাত্র আশ্রয় করে নিয়েছিলেন। কতকটা এভাবেই এসেছেন গোলাপসুন্দরী, নীহারবালা, হরিসুন্দরী, এসেছেন রানীবালা, বিনোদিনী। মঞ্চই তাদের জীবনের চলার পথ বেঁধে দিয়েছিল।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রবল বন্যায় দেশ যখন আন্দোলিত, সেই সময় বাংলার সাধারণ রঙ্গালয়ও তাতে সক্রিয় অংশগ্রহন করে। এই সময় গিরিশ্চন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল পর পর কয়েকখানি দেশাত্মবোধক নাটক রচনা করেন। ১৯০৫ সাল। মিনার্ভা রঙ্গমঞ্চে গিরিশচন্দ্রের 'সিরাজদ্দৌলা' মঞ্চস্থ হয়। সিরাজ- দানীবাবু, ক্লাইভ - ক্ষেত্রবাবু, দানশা ফকির - অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। দানীবাবু স্বয়ং গিরিশচন্দ্রের ছেলে। লেখাপড়া বিশেষ না শিখলেও অভিনয়বিদ্যাটি তিনি সহজেই আয়ত্ত্ব করেছিলেন। সিরাজদ্দৌলার অভিনয় দর্শকদের অকুন্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। দানশা ফকিরের চরিত্রটি দর্শকদের কাছে মোটেই সহানুভুতি পাবার চরিত্র নয়। দানশা ফকির সিরাজকে ধরিয়ে দিতে কোম্পানীর লোকদের পথের সন্ধান দিচ্ছে। এই দৃশ্যে অর্ধেন্দুশেখর একদিন অভিনয় করছেন। এমন সময় এক মুসলমান দর্শক আসন থেকে উঠে অর্ধেন্দুশেখরকে মারতে উদ্যত হন। অন্য দর্শকরা তাকে ধরে ফেলেন। সেযাত্রা মারের হাত থেকে বেঁচে যান অর্ধেন্দুশেখর। এ যে নিছকই অভিনয়, দর্শক সেটা ভুলে গেছেন। একজন অভিনেতার জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ অনেক প্রতিভাধর শিল্পীকে অকালে হারিয়েছে শুধু নেশার কারণে। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সেযুগের একজন দিকপাল অভিনেতা। শুধু মদের নেশা কেড়ে নিয়েছিল তার জীবন। একবার ডা: বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে যাওয়া হয় অসুস্থ দুর্গাদাসকে দেখানোর জন্যে। তিনি পরামর্শ দেন, "মদ আপনাকে ছাড়তে হবে"। একথায় বিরক্ত দুর্গাদাসবাবু বললেন, "উপদেশ চাই না, চাই প্রেসক্রিপশন। জীবনে বহু উপদেশ শুনেছি। বাবা কাকার উপদেশও কোনদিন কানে তুলিনি। আজও তুলব না।" গভীর বেদনায় ব্যথিত হয়ে ডা: রায় বলে গেলেন "একটা প্রতিভার অপমৃত্যু দেখে গেলাম"। তার কয়েকদিন পরেই চলে গেলেন দুর্গাদাসবাবু। নৈহাটির সিধু গাঙ্গুলীও এমনই এক প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন। লেখক বলছেন, 'মদ যদি তাকে না খেতো, তাহলে তার সমকক্ষ অভিনেতা পাওয়া দুরূহ হতো'। এমন আরো মাতালিয়া আখ্যান খুঁজে পাবেন উইংস-এর আড়ালে।
১৯৫২ সালে স্টার থিয়েটারে 'শ্যামলী' মঞ্চস্থ হয়। বোবা মেয়ের গল্প। শ্যামলী'র বাবার ভুমিকায় অভিনয় করছেন রবি রায়। নায়কের ভূমিকায় উত্তমকুমার। চারশ চুরাশি রাত্রি অভিনয়ের পর 'শ্যামলী' বন্ধ হয় উত্তমকুমারের অসুস্থতার কারণে। এতগুলো দিন অভিনয়ের পর পুরো টিম এক পরিবার হয়ে ওঠে। 'শ্যামলী'র শেষ দিনের আবেগঘন মুহূর্তের কথা শুনিয়েছেন শ্রী গুপ্ত। "তৃতীর অঙ্কের যবনিকা উত্তোলনের সাঙ্কেতিক ঘন্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রবিদা পাশের ঘর থেকে এলেন। স্টেজে যাবার আগে আমার ঘরের পর্দাটা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে বললেন, 'এসো, দেখে নাও। আর তো শ্যামলী কে দেখতে পাবে না'। কথাকটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। মনে হোল শ্যামলীর বাপের ভূমিকায় দীর্ঘদিন অভিনয় করে, সত্যিই যেন তিনি কন্যার বিয়োগ ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছেন"।
এই বইটিতে ছড়িয়ে আছে বহু চেনা-অচেনা মানুষের কথা, বহু না-জানা ইতিহাস। রাশভারি অভিনেতা কমল মিত্রও যে মঞ্চে উঠে ঘাবড়ে যেতে পারেন, সে কথা কি কেউ কল্পনা করতে পারতাম! মিনার্ভায় 'কর্ণার্জুন' নাটকের ঘটনা সেটি। খুঁতখুঁতে ছবি বিশ্বাস যে ভুল করে গোঁফ হাতে নিয়ে মঞ্চে অভিনয় করে নেমে আসবেন সে-ও আজ কারোর জানার কথা না। সে ছিল স্টার থিয়েটারে মনোজ বসুর 'ডাকবাংলো' নাটকের এক দৃশ্য । এই প্রসঙ্গে দেবনারায়নবাবু ভারি সুন্দর একটি মন্তব্য করেছিলেন। "অডিয়েন্স যখন গোঁফহীন বিশ্বেশ্বর কে দেখে গুঞ্জন করে নি, তখন বুঝতে হবে তারা ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ই দেখতে এসেছেন, মেক-আপ দেখতে আসেননি"।
এ বই শোনায়, কেমন করে থিয়েটার মালিকরা একজনের থেকে টাকা ধার করে অন্য পাওনাদারের দেনা শোধ করতেন। শুধু মাত্র নাটককে ভালবেসে তাদের এই উঞ্ছবৃত্তি। মঞ্চ বোধ হয় আজও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি। পেশাদার মঞ্চের জায়গা নিয়েছে আজ গ্রুপ থিয়েটার। শিল্পের এমন সজীব মাধ্যম আর দুটি নেই। অভিনয়কে ভালবেসেই অভিনয়। এক্ষেত্রে বোধ হয় অনটনের সঙ্গে বিরোধ করার চাইতে তাকে ভবিতব্য বলে মেনে নেওয়াই ভাল। পুরনো হল গুলো আজ মল হয়ে যাচ্ছে। এ বড় বেদনার। রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে যুদ্ধ করা কি শিল্পীর সাধ্য, না শিল্পের! তবু টিকে আছে গুটিকয়। তবে আজকের মঞ্চের সবচেয়ে বড় অন্তরায় 'সব পেয়েছির দেশ'-এর মানুষের আলসেমি। তার হাতের মুঠোয় তো সমগ্র বিনোদন জগৎ ঘাপটি মেরে বসে আছে। তাকে হলমুখো করে কার সাধ্যি! তবু হল ভরে। ভরবে। এ বিশ্বাস নিয়েই তো নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ে মঞ্চকে ভালবাসছে। তাদের সামনে মঞ্চের গৌরবময় অতীতকে তুলে ধরার জন্যে সাধুবাদ শ্রী সৌমিত্র বসুকে, বইখানির সম্পাদনা করে এক সুখপাঠ্য ইতিহাস উপহার দেওয়ার জন্য। তবে আর একটু বেশি সময়কালের উল্লেখ থাকলে
নাট্যগবেষকদের কাছে বইটি আরো সমাদর পেত। ব্যাবসায়িক লাভের তোয়াক্কা না করে শহরতলীর 'খসড়া খাতা' প্রকাশন এমন এক ভিন্ন স্বাদের বই ছাপিয়েছে ভাবতেই ভাল লাগে। ঝকঝকে উপস্থাপনা। প্রচ্ছদটিও ভারি মানানসই। ওদের দেখে সত্যিই মনে হয়, বাংলার রঙ্গমঞ্চ টিকে থাকবে। থিয়েটারের আঙ্গিক বদলাবে। সময়ের সাথে সাথে পাল্টাবে দৃষ্টিকোণ। তবু থিয়েটার থাকবে। গিরিশ ঘোষ-শিশির ভাদুড়িদের স্বপ্নের মৃত্যু হয় না, হতে পারে না। স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা মঞ্চে ফিরে আসবেই। দ্য শো মাস্ট গো অন।