পাশের ক্লাসরুম থেকে মাঝের কাঠের পার্টিশনের উপরে নানা ধরনের ধুপধাপ আওয়াজ আর মাঝে মাঝে শিসের মতো শব্দ ভেসে আসছে। বোঝা যাচ্ছে শিবব্রত স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। সংস্কৃতের অনুস্বর, বিসর্গ এবং অন্যান্য অলংকার বোর্ডে অবিরত বর্ষিত হচ্ছে। আর চকের সঙ্গে ব্ল্যাকবোর্ডের প্রবল ঘষটানিতে শিসের মত শব্দ উত্থিত হচ্ছে। আমাদের এই ক্লাসে শিক্ষক না থাকাতে বেশ গন্ডগোল হচ্ছিল। শশাঙ্ক বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে পাশের ক্লাসের শিবব্রত স্যারকে নকল করছিল। ঠিক এমন সময় শিবব্রত স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। মুহূর্তে সবাই গোলমাল থামিয়ে যে যার বেঞ্চে বসে পড়ল। কিন্তু শশাঙ্ক পেছন ফিরে থাকাতে দাঁড়িয়েই রইল। স্যার ঢুকেই দেখলেন শশাঙ্ক বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু স্যারকে দেখেও বেঞ্চ থেকে নামার আর সময় পেল না সে। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। স্যার এসে ওকে কান ধরে নামালেন । শশাঙ্ক একটু জেদি ছাত্র। কান ধরায় একটা অপমান ভাব ওর চোখে ফুটে উঠলো।
‘বেঞ্চের ওপর কি করছিলি তুই?’ শিব স্যার হুঙ্কার ছাড়লেন।
শশাঙ্ক শুধু বলল ‘আমার কানটা ছাড়ুন স্যার।’
স্যার রাগের বশে আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে এক বিরাশি শিক্কার চড় কষালেন ওর গালে। ওরকম দশাসই শিব-স্যারের হাতে থাপ্পড় খেয়ে যে কেউ ভিরমি খেত। শক্তিমান শশাঙ্ক কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল দাঁতে দাঁত চেপে। বলতে লাগল ‘আমার কানটা ছাড়ুন স্যার।’ এতে শিববাবু আরও রেগে গেলেন। ওনার ফর্সা বিশাল চেহারা রাগে লাল হয়ে উঠলো। যিনি সংস্কৃতের সুন্দর অলংকার অত জোরে বোর্ডের ওপর বর্ষান, তাঁর শরীরের ভীষণ শক্তি সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকে না। তিনি বললেন ‘কান ছাড়বো? দাঁড়া দেখাচ্ছি তোকে, বদমাইশি করার জায়গা পাস না?’ বলে সপাটে আরো দুটো চড় কষিয়ে পরের চড়ের জন্য হাত তুললেন। শশাঙ্ক কিন্তু তখনও দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে, আর কঠিন স্বরে বলে যাচ্ছে ‘আমার কানটা ছেড়ে দিন স্যার।’ সমস্ত ক্লাস নিঃশব্দ। মনে হচ্ছে এখনই কিছু একটা ঘটে যাবে।
স্যার পরের চড়টা মারতে যাবেন এমন সময় পেছন থেকে ‘ওকে ছেড়ে দিন স্যার, মারবেন না’ বলে কেউ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। শিব-স্যার তোলা হাতটা নামিয়ে পেছনে ঘুরলেন। দেখলেন ফার্স্ট বেঞ্চে শশী দাঁড়িয়ে আছে। ওর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। দুচোখে জলের ধারা। ‘স্যার ছেড়ে দিন। ওকে আর মারবেন না’ বলতে বলতে দুহাতে মুখ ঢেকে বেঞ্চে রাখা নিজের ব্যাগে মুখ গুঁজলো সে। স্যার খানিকটা অবাক হয়ে ‘আজ ছেড়ে দিলাম তোকে। আর কোনদিন বাঁদরামি দেখলে পিঠের চামড়া গুটিয়ে নেব’ বলে আমাদের ক্লাস ছেড়ে নিজের ক্লাসে চলে গেলেন। সেদিন ওই পিরিয়ডে আমাদের ক্লাসে কোন শিক্ষক না আসলেও গণ্ডগোল হয় নি আর। শশী ব্যাগের উপর থেকে মুখ তোলেনি একবারও। কেবল ফুলে ফুলে কেঁদেছিল। শশাঙ্ক অবশ্যই ক্লাস শেষের ঘন্টার জন্য অপেক্ষা করেনি। আগেই ক্লাস ছেড়ে নিজের প্রিয় সাইকেলটা নিয়ে মাঠের দিকে চলে গিয়েছিল। ক্লাস এইটে পড়া একটি কিশোর কেন এরকম কাঁদবে? আমরা শশীকে জিজ্ঞেস করছিলাম বারে বারে। কিন্তু শশী মুখ তোলেনি। শুধু টিফিনের ঘন্টা পড়ার পর টয়লেটে চলে গেল। কে যেন বলেছিল ‘ওর মনটা বড্ড নরম। এইসব মারপিট ও একদম সহ্য করতে পারে না।’
আরো একদিন পেয়েছিলাম শশীর নরম মনের পরিচয়। চলছিল স্কুল টুর্নামেন্টের ফাইনাল ফুটবল ম্যাচে। আমাদের টিমে শশাঙ্কই সবচেয়ে ভালো প্লেয়ার। সেই জন্য বিপক্ষ টিমের প্লেয়ার শশাঙ্কর পায়ে চার্জ করে ওর পা ফুলিয়ে দিয়েছিল যাতে ও আর খেলতে না পারে। চোট পেয়ে সেদিন মাঠের বাইরে চলে এসেছিল শশাঙ্ক। শশী কোথা থেকে বরফ জোগাড় করে ওকে অনেকক্ষণ ধরে পায়ে বরফ লাগিয়ে দিয়েছিল। শশাঙ্ক অনেকবার না বলা সত্বেও বরফ দেওয়া বন্ধ করেনি সে। বরং বারবার জিজ্ঞেস করছিল ব্যথা কমেছে কিনা।
শশী ছিল আমাদের ক্লাসের ভালো ছাত্রদের একজন। খুব ফর্সা আর রোগা ছিল সে। চোখ দুটো ছিল বড় বড় এবং বেশ মায়াময়। কিন্তু গলার স্বর ছিল খুবই মিহি। সেই সময় আমাদের সকলের গলার স্বরেই পরিবর্তন আসছিল কিন্তু শশীর গলার স্বর প্রায় একই রকম রয়ে গিয়েছিল। যেটা ওর নরম স্বভাবের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যেত। নিজেকে খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখত। হাল্কা সেন্ট লাগিয়ে ক্লাসে আসত। হাতে একটা রুমাল রাখত সবসময়, যেটা দিয়ে বারে বারে মুখ মুছত ও।
ডাকাবুকো ও জেদি শশাঙ্কর পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিল না। শশী মাঝে মাঝেই ক্লাসের ফাঁকে জোর করেই ওকে পড়া বুঝিয়ে দিত, যাতে ও শিক্ষকদের সামনে অপদস্থ না হয় এবং পরীক্ষায় ভালো করে। হয়তো সেকারণেই শশাঙ্ক পরীক্ষায় পাস করে যেত। শুনেছিলাম স্কুলের বাইরে শশাঙ্ক বেশিরভাগই বখাটে ছেলেদের সঙ্গেই মেলামেশা করত। তবে ও খেলাধুলোতে ছিল চৌকস। ওর শখ ছিল সময় পেলেই প্রিয় সাইকেলটি নিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। অত ভালো সাইকেল চালাতে আমি আর কাউকে দেখিনি। মাঝে মাঝে আমাদের ওর সাইক্লিং স্কিল দেখাত। সত্যি কি অসাধারণ কন্ট্রোল, কি দুর্দান্ত ব্যাল্যান্স। অবাক হবার মত। বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না তার। বাবা মারা যাবার পর ওর মা এক দর্জির দোকানে সেলাই ইত্যাদি করে, কখনো ঠোঙ্গা বানিয়ে ওকে মানুষ করছিল। শশী ওকে লেখাপড়ায় সাহায্য না করলে হয়ত এতদিনে তার স্কুলের পাট চুকে যেত। দুজনে দু'রকম হওয়াতেও মনে হতো ওরা বেশ ভালো বন্ধু। কিন্তু কোথায় যে ওদের মিল বুঝতে পারতাম না আমরা। মাঝে মাঝে শশীর কোন পরীক্ষায় নম্বর কম এলে স্যারেরা বলতেন ‘শশাঙ্কর সঙ্গে বেশি না মিশে নিজের পড়াশোনায় মন দে। না হলে তুইও কোনদিন ফেল করে যাবি।’
গতবার স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ‘ডাকঘর’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। দারুণ হয়েছিল নাটক। বিশেষ করে মালিনীর মেয়ে সুধার ভূমিকায় যে মেয়েটি অভিনয় করেছিল, সে ছিল অসাধারণ। যেমন সুন্দর অভিনয় তেমনি সুন্দর দেখতে লাগছিল তাকে। আমাদের বয়েজ স্কুল, সকলেরই তাই আগ্রহ হয়েছিল এই মেয়েটি কে তা জানার জন্য।
নাটক শেষ হবার পরে অবশ্য জেনেছিলাম নাটকের পরিচালক অবিনাশ স্যার শশীকেই ‘সুধা’র পার্টে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই ছিল নাটকের সবচেয়ে বড় চমক। অমলের জন্য বলা ওর সেই সংলাপ ‘সুধা তোমাকে ভোলে নি’ তখন কিছুদিন আমাদের মুখে মুখে ফিরত। সেই থেকে শশীকেও কিছুটা রাগাবার জন্যই আমরা ‘সুধা’ নামেই ডাকতে শুরু করলাম। শশী অবশ্য দেখতাম রেগে যাবার বদলে বেশ খুশিই হতো এবং কোনরকম আপত্তি করত না। সব দিক থেকে ভালো হলেও শশীর বাড়ির লোকের একটাই চিন্তা ছিল। অত নরম মনের মানুষ হয়ে শশী কি করে ভবিষ্যৎ জীবনের ঝড়ঝাপটা সামলাবে। স্যারেরাও ওকে বোঝাতেন ‘শশী একটু শক্ত হ। অত নরম হলে কিভাবে জীবন চালাবি? বড় হয়ে তোকে তো অনেক লড়াই করতে হবে। তখন আঘাত পেলে সইবি কি করে?’ অবশ্য সবাই ভাবত সময়ের সঙ্গেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ক্লাস এইটে উঠতেই স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় শশীর একটা কবিতা বেরিয়েছিল। মন ছুঁয়ে যাওয়া কবিতা। বাংলার স্যার ক্লাসে এসে শশীর কবিতার খুব প্রশংসা করেছিলেন। কবিতার প্রথম কয়েকটা লাইন আমার মনেও বেশ গুঞ্জন তুলেছিল। ‘ও আমার একলা শালিখ, একলাটি পথ চলিস / সাহসী তুই, এপাশ ওপাশ/ জোড়া খুঁজিস? তবু না পাস? / আমার সঙ্গে খেলবি যদি, আমায় একটু বুঝিস / আমার কাছে রোজ সকালে মনের কথা বলিস’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এক একলা শালিখের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছিল সে।
যাই হোক, এভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষার পরেই আমাদের বাঁকুড়ার পাট চুকল। বাবা ছিলেন ওখানকার বিডিও। ওনার পদোন্নতি ও বদলির সুবাদে আমরা কলকাতায় চলে এলাম আর মফঃস্বলের স্কুল ছেড়ে আমি ভর্তি হলাম উত্তর কলকাতার এক নামকরা স্কুলে।
রিসর্টের সুইমিং পুলটা খুব সুন্দর। নীল জলের মাঝে চিৎ হয়ে ভেসে ভেসে অনেকক্ষণ ধরে আকাশ দেখছিলাম। দুটো চিল আকাশে ভাসতে ভাসতে কখনো কাছাকাছি চলে এসে আবার দূরে চলে যাচ্ছিল। চিলেরা বোধ হয় এভাবেই ভালবাসে, বন্ধু হয় আবার দূরেও চলে যায়। আকাশে ওদের ভেসে থাকার আনন্দ আমার জলে ভেসে থাকার আনন্দের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
এখানে একজন শিল্পী দুদিনের একটা পেইন্টিং ওয়ার্কশপ করলেন যার শীর্ষক ছিল ‘মুক্তি’। বর্তমান সময়ের বেশ নামকরা শিল্পী তিনি। নানা মুক্তির কথা বললেন। মানে মুক্ত চিন্তা, মুক্ত জীবন ইত্যাদি ইত্যাদি। মনকে, চিন্তাকে নানা বেড়াজাল থেকে বের করে আকাশের ব্যাপ্তিতে মিশিয়ে দিতে বললেন তিনি। সেই চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ছবির ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে বললেন। সঙ্গে ছিলেন ওনার একজন সহযোগী শিল্পী যিনি আবার ওনার শিষ্যও। অংশগ্রহণকারীদের পেইন্টিং-এ সাহায্য করছিলেন তিনিই। কিছু বক্তৃতা, কিছু স্লাইড শো চলছিল সঙ্গে সঙ্গে। তুলি বা ব্রাশ ধরা থেকে শুরু করে কিভাবে পেইন্টিং শেষ করতে হবে সব বৃত্তান্ত মাথায় জায়গা করে নিচ্ছিল ধাপে ধাপে। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা। আমি বরাবরই ছবি ভালবাসতাম। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে গিয়েছি অনেকবার। এখন, বিশেষ করে ব্যস্ত কর্মজীবন শেষ করে কলকাতায় আসার পর, ছবির প্রতি টান বেশ বেড়েছে। হঠাৎই কোন এক বন্ধুর পরামর্শে এই ওয়ার্কশপে নাম লিখিয়েছিলাম। কোলকাতা থেকে দূরে নদীর পারের এই রিসর্টে দুদিনের একটা সুন্দর আউটিংও হল আবার ছবির জগতে ডুবে থাকাও হল।
দুদিন একসঙ্গে থাকার ফলে শিল্পী রঞ্জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও জমে উঠেছিল খুব। ওয়ার্কশপ শেষ হবার পর উনি আমাকে আরো ছবি দেখার নেমন্তন্ন করলেন ওনার কলকাতার স্টুডিওতে। অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের সকলের সঙ্গে আমিও কয়েকটা ছবি আঁকলাম। অনেকদিন পর ব্রাশ ধরে দেখলাম এখনো আমার ছোটবেলার মফঃস্বলের স্কুলে যা শিখেছিলাম, তা ভুলিনি। স্কুলের নয়ন স্যারের ছবি আঁকার ক্লাসে স্যারের কয়েকজন প্রিয় ছাত্রের মধ্যে আমি ছিলাম একজন। নয়ন স্যার আমাদের মধ্যে ছবির প্রতি একটা ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। দেখলাম ভেতরে কোথাও এই বিদ্যাটা ও উৎসাহটা থেকে গিয়েছিল। হয়ত বিভিন্ন আর্ট এক্সিবিশনে যাওয়াতেই মানসিক চর্চাটা জারি ছিল।
কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে, ভেজা রাস্তা দিয়ে আমার গাড়িটা একটা গলির মোড়ে এসে দাঁড়ালো। আর ভেতরে যাওয়া যাবে না। রাস্তা পাকা হলেও বেশ সরু। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। উত্তর কলকাতার এই গলিগুলো বেশ নস্টালজিক। এদিকেই একটা গলিতে স্কুল জীবনের শেষের বছর কয়েক কেটেছে আমার। রাস্তার দুপাশে পুরনো আমলের দোতলা বাড়িগুলো অতীতের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ দুপুরের আলোতে বেশ অদ্ভুতুড়ে মনে হচ্ছে প্রায় নিঃঝুম গলিটাকে। জনাদুয়েক পথচারী রয়েছে রাস্তায়। একটা পান-বিড়ির দোকান খোলা আছে দেখলাম এক কোণে। ওই দোকানে শিল্পী রঞ্জনের ঠিকানা জিজ্ঞেস করে একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সবুজ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কড়া নাড়ব কিনা ভাবতে ভাবতেই দরজার ওপরে একটা কলিংবেলের সুইচ দেখতে পেলাম। বেল বাজাবার মিনিট দুয়েক পরে শিল্পীর সেই সহযোগী দরজা খুলে আমাকে ভেতরে আসতে বললেন। ‘রঞ্জনদা ওপরেই আছেন, আপনি এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান।’ সহযোগীর কথাতে সিঁড়ি চড়তে গিয়েই দেখলাম ওপরে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন শিল্পী রঞ্জন স্বয়ং। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘এখানে আসতে অসুবিধা হয়নি তো?’ আমি বললাম, ‘না পান-বিড়ির দোকানের একটি ছেলে বাড়িটা দেখিয়ে দিল।’
বসার ঘরে যেতে যেতে কথায় কথায় শিল্পী রঞ্জন জানালেন যে দেশে-বিদেশে অনেকের কাছে শিখলেও, ওনার বাবার কাছেই হয়েছিল তার ছবি আঁকায় হাতেখড়ি। আমার উৎসাহ অনেকটাই বেড়ে গেল যখন শিল্পী বললেন তার বাবার স্কুল জীবন কেটেছিল বাঁকুড়ার এক মফঃস্বলে। ওনাদের জায়গাটার নাম জেনেই বললাম ‘ওই জায়গার খুব কাছেই আমার স্কুলজীবনের প্রথম দিকটাও কেটেছিল।’ দেখলাম শিল্পী নিজের রুচিমাফিক সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন বাড়িটা। দোতলায় উঠেই বসার খোলামেলা পরিসর। বাইরের গলিটা যেমন সরু, বাড়ির ভেতরটা মোটেই সেরকম নয়। কাজের লোক চা দিয়ে যাওয়াতে সুদৃশ্য সোফায় বসে চা পান করলাম। আরও খানিক গল্প হল। তারপরে পাশের ঘরে স্টুডিওতে ঢুকলাম। স্টুডিও বড় হলেও বেশ অগোছালো। মনে হচ্ছে উনি কয়েকটা কাজ একসঙ্গে শুরু করেছেন এবং কাজ করতে করতেই এই মুহূর্তে বেরিয়ে এসেছেন আমার জন্য। ঘরে আরও দুয়েকজন পেইন্টিং এর কাজ করছে। এরাও ওনার ছাত্র বলেই মনে হল। হয়ত কোন আসন্ন প্রদর্শনীর প্রস্তুতি চলছে। সারা ঘরে কাগজ, বই আর আঁকার সরঞ্জাম ছড়ান। দু-তিনটে ক্যানভাস ফ্রেমে লাগানো অবস্থায় মেঝেতে দাঁড় করানো। অসম্পূর্ণ ছবি রয়েছে প্রত্যেকটা স্ট্যান্ডে। চারদিকের দেওয়ালে টাঙানো আছে বেশকিছু ছবি। সবই শিল্পী রঞ্জনের আঁকা। ছবি দেখার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীর কাছে প্রত্যেকটি ছবির ছোট ছোট ভূমিকা শুনতে শুনতে প্রায় ঘন্টাখানেকের ওপরে সময় কেটে গেল। বিকেলের মরা আলো এখন আর ঘুলঘুলি চুঁইয়ে ভেতরে আসতে পারছে না। এবারে বের হব কিনা ভাবছি। হঠাৎই চোখে পড়ল এই বড় ঘরটার পেছনদিকে একটা ছোট ঘরের দরজা আধখোলা রয়েছে। ভেতরেও কিছু ছবি টানানো আছে মনে হল।
--ওখানেও কিছু ছবি আছে মনে হচ্ছে, ওগুলো তো দেখলাম না?
--হ্যাঁ আছে কয়েকটা, কিন্তু ওগুলো আমার আঁকা নয়, আমার বাবার আঁকা। ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন।
আমি উৎসাহ দেখালাম- ‘বাহ, দেখা যেতে পারে ছবিগুলো?’
--হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেখা যেতে পারে, চলুন না।
ঢুকলাম ওই ছোট্ট ঘরটাতে। চারদিকের দেওয়ালে খান দশেক ছবি টানানো। বেশিরভাগই পোর্ট্রেট, আর খানদুয়েক ল্যান্ডস্কেপ। রিয়েলিজমের সঙ্গে অনেকটা ফ্যান্টাসি মেশানো ছবি সব। অদ্ভুত রঙের খেলায় যেন মেতে উঠেছেন শিল্পী।
বললাম--‘বেশ দুর্বোধ্য ঠেকছে ছবিগুলো। বিশেষ করে রঙের ব্যবহার।’
--হ্যাঁ বাবার চিন্তাধারা ছিল সমান্তরাল। যদিও স্কুল ছাড়া বিশেষ কোনো আর্টের শিক্ষা তার ছিল না। নিজের মনেই পেইন্ট করতেন। কিন্তু ওনার চিন্তাধারাটা বেশ অন্যরকম। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন ওনার ভাবনার কথাগুলো।
--বাঁকুড়াতেই এঁকেছেন ছবিগুলো?
--হ্যাঁ, তবে বেশিরভাগ ছবি মফঃস্বলের বাড়িতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটা উদ্ধার করে এখানে রেখেছি। আমি প্যারিসে বেশ কয়েক বছর পেইন্টিং শিখেছিলাম। সেই সময়েই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর।
ছোট ঘরটা থেকে বের হওয়ার জন্য আধখোলা দরজাটা পুরো খোলার সময় হঠাৎই চোখে পড়লো পাল্লার ঠিক পেছনের দেওয়ালে একটা ছবি টাঙানো আছে। দরজার পাল্লার জন্য কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে সেটা। পাল্লা সরিয়ে সামনে গিয়ে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম ছবিটা দেখে।
একটি কিশোর এবং একটি কিশোরী দুজনে দুজনের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে আকাশের পর্দা ভেদ করে দুজনে কোন এক সর্বব্যাপী মুক্তির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে সূর্যাস্ত হচ্ছে। একি সূর্যাস্তই হচ্ছে, নাকি সারা পৃথিবী রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। নাকি সূর্য থেকেই রক্তক্ষরণ হচ্ছে ক্রমাগত? এত লাল হয় নাকি সূর্যাস্তের রং? অদ্ভুত ছবি। খুব অস্পষ্ট ভাবে ছবির নিচের দিকে একটা টাইটেল লেখা বাংলায় ‘সই।’ একদম নিচে লাল রং দিয়ে তুলির আঁচড়ে লেখা ‘এস’ শব্দটি। শিল্পীর নাম। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় জিজ্ঞেস করলাম--‘আপনার বাবার নাম কি ‘এস’ দিয়ে শুরু?’
--হ্যাঁ ওনার নাম ছিল সৌরিন।
--কিছু মনে করবেন না, আপনার বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত আমার বয়সীই হতেন। আমিও ওখানকার একটা স্কুলে পড়েছি ছোটবেলায়। ‘রাধানাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়।’ আমি ক্লাস এইট অবধি পড়েছি ওখানে। আপনার বাবা কোন স্কুলে পড়তেন, জানতে পারি?
--না। আমি ঠিক বলতে পারব না বাবার ছোটবেলার স্কুলের কথা।
কেন জানি না ছবিটা বেশ টানছিল আমাকে। অদ্ভুত রঙের জন্য? নাকি কিশোর, কিশোরী দুজনের জন্য? কিছুটা অভদ্রতা হবে জেনেও বলেই ফেললাম-
--ছবিটা আরেকবার দেখতে পারি?
--হ্যাঁ নিশ্চয়ই, চলুন।
আবার ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকলাম। রক্তরাগে রাঙানো ছবিটার দিকে মনোযোগ দিলাম। কিশোরীর চোখ দুটো বেশ ময়াময়। চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা। আর কিশোরটি বেশ স্বাস্থ্যবান। ভুরুর ওপরের কাটা দাগের আভাস বেশ কঠিন করে তুলেছে তার চাহনিকে। দুজনেই যেন কোন মুক্তির আনন্দে মেতে উঠেছে। পেছনে সূর্য রক্ত ছড়াচ্ছে। কিশোরীর লাল শাড়ি আর কিশোরের লাল জামা, দুটোই যেন সূর্যাস্তের রঙ ধার করেছে। এই লাল রং কি তাদের কোন আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের প্রতীক? অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম ছবিটা। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরের রাস্তায়। বাইরেও সূর্যাস্তের রং লালই মনে হল। যেন আমার চোখে লেগে থাকা ছবির রঙই ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে।
বেশ রাত হয়েছে। বাড়ি ফিরে অবধি ছবিটা নিয়েই ভাবছিলাম। কিশোরের মুখের আদল আর ভুরুর কাটা দাগটা মনের ভেতর থেকে বার বার বাইরে আসার চেষ্টা করছে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। কোথাও কি দেখেছি এই মুখ? হয়তো ছোটবেলায় দেখা। আমার আই-ক্লাউডে ছোটবেলার বেশ কিছু ছবি আমি স্ক্যান করে রেখে দিয়েছি বিভিন্ন সময়ে। ওখানেই ছবিগুলোর মধ্যে খুঁজতে লাগলাম সেই মুখ। বেশিরভাগই আমার কলেজ জীবন এবং কিছু স্কুল জীবনের ছবি। কোলকাতার স্কুলের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন, কিছু গ্রুপ ফটো, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমার মফঃস্বলের স্কুলের কোন ছবি এখনো পর্যন্ত পেলাম না। সেইসময় অবশ্য ফটোগ্রাফ খুব বেশি তোলা হত না। এভাবে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ফুটবল টিমের সাদা কালো ছবি খুঁজে পেলাম। আরে এ তো সেই বাঁকুড়ার স্কুলের ফুটবল টিমের ছবি। ছবিতে নিজেকে খুঁজে পেলাম দ্বিতীয় সারির মাঝ বরাবর। পাশের ছেলেটিকে দেখেই চমকে উঠলাম। ভুরুর উপরে অস্পষ্ট একটা কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে যেন। আরে এ তো শশাঙ্ক। মনে পড়ল, কলকাতায় বারো ক্লাসে পড়ার সময় কারো কাছে পেয়েছিলাম দুঃসংবাদটা। সেই দুর্দান্ত সাইকেলবাজ শশাঙ্ক এক বিকেলে তার প্রিয় সাইকেলসহ চলন্ত বাসের চাকার তলায় পিষ্ট হয়ে একটা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছিল।
ফটোতে ওর কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে মনে হল ওই ছবির কিশোরের দাঁড়াবার ভঙ্গিটাও এরকমই। যেন এই ফটোগ্রাফ থেকেই ছবিটা আঁকা হয়েছে। কিন্তু এখানে শশাঙ্কর পাশে তো আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার কাঁধেই ও হাত রেখেছে। তবে কি আমার ছবি সরিয়ে সেই কিশোরীর ছবি কল্পনা করেছেন শিল্পী? ভাবনাটা আসতেই এবারে যেন কিশোরীকেও চেনাচেনা মনে হল। আরে এ তো অনেকটা শশীর মুখের আদল। শশীর কি কোন বোন ছিল? যতদূর জানি শশী ছিল তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ভাবতে ভাবতে সেই ডাকঘর নাটকের মালিনীর মেয়ে সুধার মুখ মনে পড়ল। এ যেন সুধারূপী শশীরই স্কুল জীবনের সেই মুখ। সেইরকমই বড় বড় চোখ। মায়াময়। সেই রকম মুখ, চোখ, গাল। কে এঁকেছে এই ছবি? শিল্পী সৌরিন কি চিনতেন শশীকে? নাকি সৌরিন নন, নয়ন স্যারের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র শশী নিজেই এঁকেছে এই ছবি। এই ভাবনাটাই জড়িয়ে ধরল আমায়। ছবিতে দুজনেই রয়েছে লাল রঙের আধারে। কিন্তু শশী এই বেশে কেন? কপালে টিপ, ঘাড় ছোঁয়া চুল, শাড়ি, ব্লাউজ, লাল ঠোঁট। তবে কি শশীর এই রূপ ওর জোর করে ঢেকে রাখা মনের গভীরের কোন মুক্ত ভাবনা। ভুল শরীরের খাঁচায় আটকে থাকা আসল সত্ত্বা ছবির মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে সমস্ত নিষেধের বেড়াজাল ভেঙে।
শিল্পী সৌরীনকে আমি চিনি না। এই ছবির মানুষগুলো শশী আর শশাঙ্ক না হয়ে অন্য যে কেউ হতে পারে। এই ফ্যান্টাসি মিশ্রিত ছবিতে পেইন্টব্রাশের স্ট্রোকে ফুটিয়ে তোলা মুখের থেকে কাউকে চেনা মুশকিল। তবে কেন আমার মনে এল ওদেরই কথা? জানি না। মনে হলো একলা শালিখের চেপে রাখা মনের ব্যথা যেন মুক্তির আনন্দ হয়ে ওই ছবিটার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।