ভীমের ওসব ব্যাপার নেই। তার ধৈর্য সবার চেয়েই কম। আগামী কালকের যুদ্ধে তার করণীয়, এবং অন্য আরও দু-চারটি পরিকল্পনার কথা শুনেই তার ধৈর্য হারিয়ে গেছে। সে মোটা কথার মানুষ। সূক্ষ্ম পরিকল্পনাগুলিকে ভ্যাজর ভ্যাজর ছাড়া তার কিছুই মনে হয় না। এটুকু তো সে বুঝেই গেছে যে, কাল তার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল দুঃশাসন বধ। বাকি যুদ্ধটুকু তার কাছে নস্যি। আলোচনার মাঝপথে উঠে এলেও ভীমকে কেউ কিছুই বলল না। সবাই জানে সে ওরকমই। যুধিষ্ঠির বা বাসুদেবকে সে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে বটে, কিন্তু যা তার ভাল লাগে না সেখানে সে বেপরোয়া। দুঃশাসনকে মারার সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার যে জড়িয়ে আছে সেটা অবশ্য ভীমকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়েছে। তা নইলে যা মাথাগরম লোক সে, একবার মারামারি শুরু করলে কিছুই আর মনে রাখবে না।
দুঃশাসন বধের সঙ্গে জড়িয়ে-থাকা দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞাটা সত্যিই ভুলতে বসেছিল ভীম। ভাগ্যিস ওই পর্যন্ত শুনে তবে উঠে এসেছে!
অক্ষক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরদের সর্বস্বান্ত করেও দুর্যোধনদের রাগ মুছে যায়নি। ওদের অনেকেরই মনে এত ময়লা যে ভাবা যায় না। খেলার ফলাফল হয়ে যাওয়ার পরে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো দুঃশাসন দ্রৌপদীকে খুবই অসম্মান আর হেনস্থা করে। বেচারা দ্রৌপদী কোনও দোষই করেনি। স্বামীরা পাশা খেলবে কিনা তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকারই তার নেই। তাছাড়া সে জানতই না যে তাকেও পণ করে স্বামীরা জুয়া খেলবে। তবু একঘর লোকের সামনে তাকে বীভৎসভাবে অপমানিত হতে হল। ভীম তখনই মারমুখী হয়েছিল। কিন্তু সব খেলাতেই খেলোয়াড়দের নিয়ম মানতে হয়। ইচ্ছেমতো কিছুই করা যায় না। তাই পাণ্ডবদের শ্রদ্ধেয় কুরুমুখ্যরাও চুপ করে বসেছিলেন। পরিস্থিতির কাছে তাঁরাও অসহায়। এই পরিস্থিতির জন্য অবশ্য বড় ভাই যুধিষ্ঠিরও দায়ী কম নন। তাঁর অনেক ভাল ভাল গুণ থাকলেও জুয়ায় মারাত্মক নেশা। একবার হেরে ভূত হয়ে চলে যাওয়ার পরও শকুনিমামার কথায় ফিরে এসে দ্বিতীয়বারও সর্বনাশা খেলায় জড়িয়ে পড়েন। এবারে হেরে কপালে জুটল বনবাস আর অজ্ঞাতবাস। মোট তেরো বছরের কালক্ষয়। অনেক বিষয়েই অন্য ভাইদের সঙ্গে যুধিষ্ঠির আলোচনার প্রয়োজনই মনে করেন না। দ্রৌপদীকেও তিনি এই দ্যুতক্রীড়ায় পণ রেখেছেন একার সিদ্ধান্তে। অথচ দ্রৌপদীর ওপর পাঁচ পাণ্ডবেরই সমান অধিকার। কিংবা, অধিকার আসলে কারোই নেই। দ্রৌপদীকে ধন-সম্পদের মতো ব্যবহার করাটাই তো তাঁর আসল অপমান। সুতরাং দ্রৌপদীর বিষয়ে পাণ্ডবরাও ধোয়া তুলসীপাতা নন, ভীমের মাঝে-মাঝেই এরকম মনে হয়।
ঘর-ভরা লোকজনের মাঝে একজন নারীর কাপড় ধরে কোনও পুরুষ টানাটানি করলে সেই নারী অবলা হলেও দপ্ করে জ্বলে উঠবেই তার মাথায় আগুন। দ্রৌপদীকে অবশ্য অবলা যায় না। সে অন্তঃপুরবাসিনী হলেও পুরুষ সমক্ষে অপমানিত হওয়ার সময় কুরুবৃদ্ধদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে ছাড়েনি। প্রবল পুরুষ দুঃশাসনকেও সে অনেকক্ষণ ধরে একার চেষ্টায় যথেষ্ট বাধা দিয়েছে, তাতে দুঃশাসনের প্রচুর শক্তি ক্ষয়ও হয়, সে হাঁপাতে থাকে, কিন্তু টানাটানির ফলে যখন কাপড়চোপড় আর ঠিক রইল না দ্রৌপদীর, একরাশ কালো চুল এলিয়ে পড়ল, তখন রাগের মাথায় প্রথমেই ভীম চমকে দেবার মতো একটা প্রতিজ্ঞা করে বসল। জেঠতুতো ভাইদের সঙ্গে যদি যুদ্ধ হয় কোনওদিন, ভীম দুঃশাসনের পরাজিত বুকটা খুঁড়ে তা থেকে সদ্য শোণিত যদি না পান করতে পারে— ন পিবেযং বলাদ্বক্ষো ভিত্ত্বা চেদ্রুধিরং যুধি—তো সে তার বাপ-ঠাকুর্দার বংশের ছেলেই নয়। পাঁচজন স্বামী এবং আত্মীয়-স্বজন পরিবৃত হয়েও দ্রৌপদীর এতক্ষণ নিজেকে অনাথা মনে হয়েছে, ভীমের এই ঝকঝকে প্রতিবাদে ধোঁয়ার মধ্য থেকে উজ্জীবিত আগুনের মতো দ্রৌপদীও এবার সেই নির্বোধ দুর্বৃত্তকে সাংঘাতিক এক কথা বলে বসল। তার বুক ছিন্নভিন্ন করে যে-রক্ত ভীম সংগ্রহ করে আনবে সেই রক্ত চুলে মেখে তবেই সে এরপর খোলা চুল খোঁপা করে বাঁধবে, তার আগে নয়।
একজন মানুষ আরেকজন লোককে খুন-জখমের কথা মাঝে মাঝেই বলে, কিন্তু কেউ কারো রক্ত খাবার কথা ভাবতেও পারে না। রাগ বা দুঃখের সময় মানুষ না ভেবেচিন্তেই অনেক কিছু বলে ফেলে। অনেক সময়ই দেখা যায় সেসব কথা একেবারে যুক্তিহীন। চুলের সৌন্দর্যের জন্যও মেয়েরা চুলে অনেক প্রসাধন-দ্রব্য লাগায় বটে, কিন্তু চুলের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে রক্তের কোনও সম্পর্কই নেই। দুঃশাসনের কদর্য হাত চুল ছুঁয়েছে বলে যদি তার রক্ত দিয়ে চুল পবিত্র করার কথা ভাবে দ্রৌপদী, তাহলেও তা অযৌক্তিক। চুলে রক্ত লাগালে তো আরওই অমিলন হয়ে যাবে চুল। তবু এসব মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথারও সাংঘাতিক গুরুত্ব।
কিন্তু ভীম ভাবে, এসবও শুধুই সুবিধামতো প্রতিজ্ঞা। অনেক কথাই অনেকে রাখতে পারেনি এমন উদাহরণ কালে-কালে যথেষ্ট আছে। ভীমের এই ভাবনা পরেও মহাভারতের অনেক জায়গাতেই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। ভীমের এও মনে হয়, সেদিন সে হঠাৎ যুদ্ধের কথা বলল কেন? তখনও তো দূর-দূর পর্যন্ত কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধের নামগন্ধই নেই। সে এমন কিছু দূরদর্শীও নয় যে দূর-ভবিষ্যৎ দেখতে পাবে! তাছাড়া দ্রৌপদীকে বাজি রাখার আগে যুধিষ্ঠির নিজেকে সহ বাকি চার ভাইকেই পণ রেখে পাশা খেলে হেরেছে। ভীমরা সবাই তখন কৌরবদের ক্রীড়নক ছাড়া কিছুই নয়। এরকম একজন দাসানুদাস যুদ্ধের কথা বলে কী করে? এও তো খেলার নিয়মের বিরোধিতা!
যাইহোক, দ্রৌপদীর কথা রাখার সময়টা একেবারে দোর গোড়ায় এসে গেছে। আর মাত্র কয়েকটি প্রহর পেরোলেই দুঃশাসনকে পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হবে। এখন রাতদুপুর। দুঃশাসনের ঘুমন্ত মুখটা মনে পড়ছে ভীমের। আশ্চর্য, রাগফাগ আর কিছুই হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, তার ও দ্রৌপদীর বুদ্ধিহীন প্রতিজ্ঞাগুলির মতোই দুঃশাসনের সেদিনের কাণ্ডটিও আহাম্মুকি ছাড়া আর কিছুই নয়। এজন্য দুঃশাসনের আফশোষ হওয়াই স্বাভাবিক। তারই ছোট ভাই বিকর্ণর কথা ভেবেও তার লজ্জা হওয়া উচিত। একেবারে অল্প বয়সি ছেলে হয়েও দাদাদের কাজকর্মের সে-ই সোচ্চার প্রতিবাদ করে। কিন্তু এরকম যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে এমন-সব দুর্বলতার কথা কাকেই বা বলবে দুঃশাসন! অনুতাপ যদি হয়েও থাকে, ভবিষ্যতেও সে-কথা দুঃশাসন কখনও প্রকাশ করতে পারবে বলে মনে হয় না। দুর্যোধন, কর্ণ আর মামা শকুনির একটা কল্প আত্মম্ভরিতার ঘেরাটোপে সে বন্দি। তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে অনেক সময়ই তার সম্পর্কে অনেক কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা হয়ে থাকে। দুঃশাসন সেসব বিশ্বাসও করে। সুতরাং তথাকথিত বীরপুরুষের এরকম মেয়েলি দুর্বলতা শুধু হাস্যকরই নয়, একটা বড়সড় অপরাধও বলেও গণ্য।
লোকের বিচারবুদ্ধির সমালোচনা করতে গিয়ে মনে-মনে হেসে ফেলল ভীম। সে ভাল করেই জানে, মহাবীর হিসেবে দিগ্বিদিকে তার সুনাম থাকলেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে গেলেই সে হোঁচট খায়। আত্মীয়পরিজনরা তার বুদ্ধি-বিবেচনাকে মোটেও বিশ্বাস করে না।
ছোটবেলার কিছু কিছু কথাও মনে পড়ছে ভীমের। দুঃশাসন নামে তার এই জেঠতুতো ভাইটি প্রথম থেকেই একেবারে ব্যক্তিত্বহীন। দাদা দুর্যোধনের কথাতেই ওঠে-বসে। ছোটবেলা থেকেই পাণ্ডবদের মেরে ফেলার যত চক্রান্ত, তাতে দুঃশাসনের মতামত নেওয়া হয়নি এ-কথা জোর দিয়েই বলা যায়। অবশ্য গোটা কৌরব বংশের নিয়মই কমবেশি এরকম। বড় দাদা যা বলবে তাই হবে। পাণ্ডবদের সম্পর্কটি সেই তুলনায় অনেক বেশি খোলামেলা। অগ্রজদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পাণ্ডবদেরও চারিত্রিক গুণ হলেও অন্ধভক্তির জায়গা সেখানে নেই। দ্রৌপদীর হেনস্থার সময়, ঘটনার কাণ্ডারী, জুয়াড়ি জ্যেষ্ঠভ্রাতার দিকে সভার মাঝেই ভীম অকথা-কুথার বর্ষণ ঘটিয়ে দেয়। ভীম বলল, দাদা, অনেক জুয়ার কারবারিরই পোষা মেয়েমানুষ থাকে। তারাও কিন্তু তোমার মতো নয়। সেই মেয়েমানুষদের প্রতিও ওদের যথেষ্ট দয়ামায়া থাকে— ন তাভিরুত দীব্যন্তি দয়া চৈবাস্তি তাস্বপি। একবার রেগে গেলে ভীমের কিছুক্ষণ সেই রাগ উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। একসময় ক্রোধে অন্ধ হয়ে ভীম বড় ভাইয়ের সর্বনাশা হাত দুটি পুড়িয়ে দিতে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সহদেবকে আগুন আনতে বলল— বাহু তে সম্প্রধক্ষ্যামি সহদেবাগ্নিমানয়। অর্জুন তাকে শান্ত না করলে কী হতো বলা যায় না। কৌরবরা অন্যায়কারী বড় ভাইয়ের প্রতিও এই আচরণের কথা ভাবতেই পারবে না। দ্রৌপদীকে হেনস্থা করার কুকীর্তিটি দুঃশাসনের মাথা থেকে বেরোয়নি। সে অপদার্থ বলেই দাদার ইচ্ছে পূরণের নামে এক অনন্য নারীর কাছে বীরত্ব দেখাতে যদৃচ্ছ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।
কিন্তু দুঃশাসনকে মারার যে পণ করে বসে আছে দ্রৌপদী, তা পুরোপুরি অন্যের ভরসায়। তার নিজের দুঃশাসনকে সরাসরি শাস্তি দেওয়ার প্রশ্নই নেই, স্বামীদের সহায়তা ছাড়া। কিন্তু যে-স্বামীরা এত বড় ঘটনার সময়ই হাত-পা গুটিয়ে বসে রইল, পরে তাদের ওপরই বিশ্বাস রেখে দুষ্কৃতি দমনের প্রতিজ্ঞা করা কি ঠিক? আবার একটু হাসি পেল ভীমের। সে শুধু লোকের সমালোচনাই নয়, আত্মসমালোচনাও তো করছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে না-ঘুমিয়েই ভীম রাতের তিন প্রহর পার করে ফেলল। নারাচ নামের লোহার তীক্ষ্ণ ফলাওয়ালা অসংখ্য তীরের মতো কালান্তক ঠান্ডা হাওয়া শিবিরে ঢুকে আসছে। ব্রাহ্মমুহূর্তের এখনও খানিকটা দেরি। তবু আর বিছানায় থাকা গেল না।
অন্যদিন বিছানা ছাড়ামাত্রই ভীম তার প্রিয় অস্ত্রশস্ত্রগুলিকে পরীক্ষা করে। মনে-মনে নিজের মতো করে যুদ্ধনীতি তৈরি করে খানিকক্ষণ। যাকে মারবে সেদিন তার মৃত্যুকালীন ভয়ার্ত মুখটা মনে করে ভারী আমোদ পায়।
কিন্তু আজ গদাটা ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে হল না। দূর থেকেই এমন ভারী মনে হল সেটাকে! ভীমের কাছেও ভারী বলে কিছু আছে নাকি? নিজের দুর্বলতায় ভীম অবাক হল না। তার মনে হল, দেহের বলই তো শেষকথা নয়। মনোবল বলেও একটা ব্যাপার আছে। অনেক ভাল বা মন্দ এই অদৃশ্য শক্তি দিয়েই ঘটানো যায়। আবার এর অভাবে দশাসই একজন মানুষও একেবারে হীনবল হয়ে পড়তে পারে। দুঃশাসনের মুখটা মনে পড়লেই তার বুক হু-হু করে উঠছে। দু-পক্ষের দুই বড় দাদার রক্তচক্ষুর আড়ালে এই দুই ভাইয়ের প্রায়ই ভাব জমে যেত একসময়। বিকর্ণ নামে দুঃশাসনের সরল-সিধে ভাইটি এসেও যোগ দিত দাদাদের সঙ্গে। তখন তীর ছোড়াছুড়ি, কিংবা গদা নিয়ে খেলার চেয়েও ভাল লাগত বসে-বসে গল্প করতে। অন্য হিংসা-বিবাদের চেয়ে এই কথাই ভীমের আজ বারবার মনে পড়তে লাগল।
শিবিরে থাকতে পারল না ভীম। বাইরে বেরিয়ে পায়চারি করতে-করতে একসময় অনেকটা দূরে একজায়গায় চলে এল। শুকনো ঘাসপাতা পোড়ার গন্ধ নাকে এল।
এমন সময় দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা। বেশি করে চোখে পড়ল তার একঢাল ভেজা এলোচুল। চান করে নতুন পট্টবস্ত্র পরেছে দ্রৌপদী। আজ বুঝি তার খুব আনন্দ। বেলা দ্বিপ্রহরের মধ্যে ফলাফল এসে যাবে। ফলাফল একদম নিশ্চিতই। তবু সেই খবর পাওয়া মাত্র তার বুকে বেজে উঠবে আনন্দের বাজনা।
মনটা ভীমের খারাপ হয়ে খারাপ হয়ে গেল।
দ্রৌপদী বলল, আপনি এদিকে কোথায়? আমি তো শুনেছি যুদ্ধের আগে আপনি রণক্ষেত্রেই কিছুক্ষণ পায়চারি করে বেড়ান। এ তো বিপরীত দিক।
ভীম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল।
দ্রৌপদী বলল, আজ আমার একটা ব্রত পালনের দিন। চলুন একটু পায়েস রাঁধব, দেখবেন। সময় আছে হাতে?
মেয়েরা সারা বছরই অনেক অজানা ঠাকুরদেবতার ব্রত পালন করে। ভীম ভাবল, দুঃশাসনের মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে দ্রৌপদী বুঝি সেরকমই এক রক্তপায়ী দেবতার পুজো দেবে।
দ্রৌপদীর সঙ্গে কয়েক পা গিয়ে ভীম দেখল, চোখ-বোজা শান্ত এক গ্রাম্য দেবতার পাথুরে মূর্তি। তার সামনে নানা উপাচার। ধূপ-ধুনো জ্বলছে। জায়গাটার চারপাশে ঝোপঝাড়। কিন্তু দেবতার জায়গাটা নিকানো উঠোনের মতো ঝকঝকে করছে।
ভীমকে একটা আসন দিল দ্রৌপদী। মারাত্মক ঠান্ডা লাগছে ভীমের। দ্রৌপদী তার গায়ের উত্তরীয়ের মতো ঊর্ধ্ববাসটি খুলে ভীমের গায়ে জড়িয়ে দিল।
দুঃশাসন যখন জোর করে দ্রৌপদীর বস্ত্র কেড়ে নেয়, তখন সে তাকে প্রচুর শাণিত বাক্যে আঘাত করে, সেই নারীই আজ স্বেচ্ছায় তার বস্ত্র আরেক পুরুষের গায়ে জড়িয়ে দিল।
ভীম হঠাৎ বলল, দ্রৌপদী, দুঃশাসনের ওপর তোমার খুব রাগ তাই না?
দ্রৌপদী এটা-সেটা কাজ করতে-করতেই বলল, সেদিন সত্যিই খুব খারাপ লেগেছিল। প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। এখন আর অতকিছু নেই।
ভীম বলল, ঘটনাটার পর বেশ কিছুকাল কেটে গেল। সবাই তো আর রাগ পুষে রাখতে পারে না।
দ্রৌপদী বলল, আমি যতদূর আপনাকে চিনি, আপনি রাগি মানুষ হতে পারেন, কিন্তু ক্রোধ আপনারও বেশিদিন থাকে না।
ভীম একটু চুপ থেকে বলল, আচ্ছা দ্রৌপদী, দুঃশাসনকে যদি না মেরে ফেলি?
দ্রৌপদী একদৃষ্টে ভীমের মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, তাতে আমার কোনও অসুবিধা নেই। আমি বরং সেটাই চাই।
ভীম বলল, কিন্তু তোমার চুল বাঁধার প্রতিজ্ঞা?
দ্রৌপদী স্বর্ণ থালিতে মস্ত একটা পাকা তাল এনে রাখল।
তাল পাকে ভাদ্রমাসে, সেই ভাদ্রমাস কবে পেরিয়ে গেছে।
দ্রৌপদী বলল, আমি কোনও একটা কারণে এই দেবতার কাছে মানত করেছিলাম, অসময়ের পাকা তালের ক্ষীর দিয়ে পুজো দেব। সেই কারণ অবশ্য আমি আপনাকে বলব না। মেয়েদের অনেক ঘরোয়া কারণ থাকে, সেসব পুরুষদের শুনতে নেই। কিন্তু দেখুন না, ঠিক জুটেও গেল পাকা তাল। আসলে কী জানেন, তাল পেকে গেলেও অনেক সময় গাছেই অনেকদিন থেকে যায়। দু-একটা ঝরে পড়ে মাসে-দশে।
ভীম অনেক প্রাকৃতিক ব্যাপার সম্পর্কেই কিছুই জানে না। সে খাওয়াদাওয়া আর যুদ্ধবিগ্রহ নিয়েই সারা জীবন ব্যস্ত। শুধু আজই কেন যেন সরু সরু ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো নানা চিন্তা ভেতর থেকে উঠে আসছে।
ভীম আবার বলল, কিন্তু তোমার চুল বাঁধার প্রতিজ্ঞা, দ্রৌপদী?
দ্রৌপদী একটু হেসে বলল, সে আপনি বললে আমি এক্ষু্নি বেঁধে নিতে পারি।
দ্রৌপদীর কথা শুনে ভীমের বুকটা ভরে গেল। ভাইদের মধ্যে অর্জুনের সঙ্গেই দ্রৌপদীর ভাব বেশি। আর যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদী ভীষণ শ্রদ্ধা করে। ভীমের সঙ্গে দ্রৌপদীর শারীরিক সংসর্গ মাঝে মাঝে হয়েছে বটে, কিন্তু সে একেবারে যান্ত্রিক। কামকলার নামমাত্র সেখানে থাকেনি। নর্মসঙ্গিনীর মতো এরকম মেলামেশার সুযোগও কখনও ঘটেনি।
ভীম উৎফুল্ল হল, তবু তার মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞা একেবারে মূল্যহীন হয়ে যাবে? সে আনমনে মাথা নাড়তে লাগল।
দ্রৌপদী বলল, আপনি যা ভাবছেন তা হবে না। আমার প্রতিজ্ঞাও থাকবে। এদিকে আসুন দয়া করে। ওই পাকা তালকেই দুঃশাসনের বুক ভেবে চিরে ফেলুন। আমি তালটা বিদীর্ণ করতে পারছি না। ওটার শাঁস আমার দরকার।
ভীম অক্লেশে, অবহেলায় নয়, যেন ভীষণ যুদ্ধে তালকে পরাজিত করে তার বুকটা দু-ফাঁক করে ফেলল।
দ্রৌপদী বলল, সবকিছু তো আক্ষরিক হয় না। সত্যি সত্যি একজনের বুক চিরে তাকে মেরে ফেলা কী বীভৎস ব্যাপার ভাবুন তো! আর, সত্যি করে বলুন তো কোনও মানুষের রক্ত আপনি বাস্তবিকই খেতে পারবেন?
ভীম বলল, খেতে পারব কী, তোমার কথা শুনেই আমার বিবমিষা হচ্ছে।
শোণিত পানের কথাটি যে বেশ উদ্ভট তা দ্রৌপদীর এই স্বামীটি নিজেও সেদিনই বুঝতে পেরেছিল। দ্রৌপদীর মনে হল, তাই হয়তো সেদিন ওই কথা বলার সময় স্বামী সভাসদদের বলেছিলেন, এমন কথা আপনারা আগেও শোনেননি, ভবিষ্যতেও শুনতে পাবেন না— নোক্তপূর্বং নবৈবন্যৈর্ন চান্যো যদ্বদিষ্যতি। কিন্তু কালান্তক রাগের সময় কোনও অযৌক্তিক উচ্চারণেই আড়ষ্টতা থাকে না।
দ্রৌপদী বলল, তাই তো বলছি, তালের মাধ্যমে দুঃশাসনকে ছিন্নভিন্ন করে আপনি যথেষ্ট ধর্মবুদ্ধির পরিচয় দিলেন। দুঃশাসন বধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তো শুধু আমার আর আপনার। যুদ্ধের এই সতেরোতম দিন থেকে তার সঙ্গে আমাদের আর কোনও সম্পর্কই থাকবে না। তাই মহাভারতে আর কোথাও তার প্রয়োজন নেই।
ভেজা চুল এলো খোঁপা করে তালের ক্ষীর রাঁধতে বসল দ্রৌপদী। তার কবরীর দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল ভীম।
ব্রাহ্মমুহূর্ত কাছে চলে আসছে। রান্নার অপূর্ব অলৌকিক ঘ্রাণ আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।
বিপক্ষ শিবিরে আড়মোড়া ভেঙে প্রথমেই এই গন্ধ পেল দুঃশাসন। তার মনপ্রাণ ভরে গেল। কিছু না ভেবেই সে বেরিয়ে পড়ল এর উৎস সন্ধানে।
অচিরেই পৌঁছে গেল উৎসস্থলে। দ্রৌপদী ও ভীমকে দেখে আড়ালে লুকিয়ে রইল দুঃশাসন।
দ্রৌপদীকে দেখে তার বাস্তবিকই খারাপ লাগছে। মহল থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসার সময় দ্রৌপদী রাগে-দুঃখে তাকে অভব্য ও দুর্জন বলেছিল বটে, তবু তার কথায় ছিল অনুনয়— সে রজঃস্বলা, এক কাপড়ে আছে। তাকে যেন জনসমক্ষে না নিয়ে যাওয়া হয়— একঞ্চ বাসো মম মন্দবুদ্ধে! সভাং নেতুং নার্হসি মামনার্য— নারীত্বের এই অনিবার্য অসহায়তায় দুঃশাসনের দু-চোখ ছাপিয়ে জল এসে গেল এখন।
দুঃশাসন বধ সমাপন করে দ্রৌপদীর হাতের তালের ক্ষীর খেতে বসেছে ভীম। সেই গন্ধে আড়ালের দুঃশাসনও একেবারে মোহাবিষ্ট হয়ে গেল। একটি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে সে চোখ বুজে বসে রইল। বন্ধ চোখের ওপারে তার নানারকম অনুভূতি হচ্ছে। ভীমের গায়ে দ্রৌপদীর পট্টবস্ত্রটি ভেসে উঠছে বারংবার। একবার মনে হল, সেই অপূর্ব অভূতপূর্ব গন্ধটি তাকে মরণোত্তর স্মৃতিপথে দ্রৌপদী ও ভীমের সেই উজ্জ্বল দৃশ্যটির কাছে নিয়ে যাচ্ছে। সেটি যে তার নিজেরই রক্তের সুবাস, এ-কথা, সে আরেকবার চোখ খোলার আগেই আকাশ ও পৃথিবীর আপেক্ষিক আর্দ্রতায় মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
{পুনশ্চ— মহাভারতে দুঃশাসনের রক্ত পানের কথা ভীমের মুখে একাধিক জায়গায় শোনা গেলেও দ্রৌপদীর চুলে রক্ত মাখার প্রতিজ্ঞাটি কোথাও নেই। দ্রৌপদীর এরকম উবাচ আছে ভট্টনারায়ণ রচিত (আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী) বেণীসংহার নামক সংস্কৃত নাটকে। ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যে মাঝে মাঝেই মহাকাব্যের কাহিনীর পুনর্নির্মাণ ঘটেছে। এরকম নাটকের সংখ্যাই অগণিত। মূল কাব্য থেকে উপাদান নিয়ে নাটক রচিত হলেও অনেক সময় সেখানেও মেলোড্রামার অবতারণা করতেই হয়, তখন আধুনিক স্রষ্টাটির মহাকবির কাছে মনে-মনে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে কিছুটা স্বাধীনতা না-নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। বেণীসংহার-এও সেরকম অনেক ব্যাপার আছে। কিন্তু এখানেও দ্রৌপদী যার রক্তে কেশ সিক্ত করার কথা বলেছে সে দুঃশাসন নয়, দুর্যোধন। দুঃশাসনের অভব্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে সবরকমের সাহিত্যেই দ্রৌপদী তাকে প্রচুর মেয়েলি তিরস্কার করেছে বটে, কিন্তু কোথাও দুঃশাসনকে মর্মন্তুদ শাস্তি দেওয়ার কথা তার মনেই আসেনি। দুঃশাসন নামের এই অযোগ্য লোকটিরও দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করার প্রবল ইচ্ছে ছিল একসময়, না পেয়ে কষ্ট পেয়েছে। নারীরা এমন ঘটনা কখনও ভোলে না। তাদের প্রতিও নারীদের করুণাধারাই ঝরে শেষ পর্যন্ত। মহাকাব্যের অতলস্পর্শী মানসে এরকম হাজারো অনুসন্ধান সম্ভব যুগ-যুগান্ত ধরে।}