মেজকার ম্যান্ডোলিন একটা ঘটনা। একবার খুকু মাসী আমাদের বাড়ি বেড়াতে এল। কদিন থাকবে। আমার তো খুব আনন্দ। সন্ধ্যেবেলায় মাসীর সঙ্গে ফুচকা খেতে যাব। কিন্তু মেজকার বাজনা শুনে মাসী কেমন যেন মোহিত হয়ে গিয়েছিল। মেজকার ঘরে গিয়ে গল্প করেছিল অনেকক্ষণ ধরে। সেদিন রাতে সেজকাকী কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। মা রাতে বাবাকে ফিসফিস করে বলেছিল, শুনে ফেলেছিলাম – “মিঠুকে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। ও মেজর বাজনা শুনে তো ঢলে পড়েছে। এদিকে সেজ তো বিগড়ে গেছে। এসব ঝামেলায় জড়ানোর কোন ইচ্ছেই আমার নেই।” মাসীকে কি বলা হয়েছিল জানি না, কিন্তু পরদিন বাবা অফিসে বেরোনোর সময় যখন মাসীকে সঙ্গে নিয়েই বেরোচ্ছে, মায়ের সঙ্গে মাসী একটাও কথা বলেনি। ঝকঝকে সেজকাকীকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। মেজকা সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেও যথারীতি বাজাচ্ছিল একইভাবে। কিন্তু সেজকাকী নিজের ঘর থেকে মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল –“তোমার কাছে একটু বসব, দিদি?” মা অবাক হয়ে বলে উঠেছিল –“ওমা! এ আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে! আয়। বোস।” তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে সেজকাকীকে হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখে ফেলেছিলাম। মা কাকীর পিঠে স্নেহের হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ম্যান্ডোলিনের সুর তখন সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমাকে মেজকার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ধমক খেতে হয়নি। কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই চলে গিয়েছিলাম। এয়ারলাইন্সে চাকরি করা সেজকা যখন বহুদিন পর পর কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে ফিরত, সেসময় মেজকার বাজনা স্থগিত থাকত না, শুধু সেজকাকীকে আর একাগ্রচিত্তে শুনতে দেখা যেত না। কিন্তু সত্যিই কি সেজকাকী বাজনা থেকে দূরে চলে যেতে পারত আদৌ! বুঝতাম না, পরিবারের বড় হিসেবে মা কাউকেই কেন কিছু জিজ্ঞেস করত না বা বলত না। প্রচুর জায়গায় মেজকা বাজাতে যেত। ফুরফুরে মেজাজের গৌরবর্ণ দীর্ঘদেহী রাজপুত্র মেজকা যেন বাসযোগ্য পৃথিবীর ওপার থেকে কদিনের জন্য এসে পড়েছে আমাদের মাঝখানে। শোনা যায় একবার পণ্ডিত রবিশঙ্করকে বাজনা শোনানোর সৌভাগ্য হয়েছিল মেজকার। শোনার পর মেজকাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন পণ্ডিতজী। কিন্তু সেদিন রাত থেকেই সেজকাকীর ধূমজ্বর। সেই জ্বর সারতে সারতে পেরিয়ে গিয়েছিল পণ্ডিতজীকে মতামত জানানোর দিনও।
মেজকার ম্যান্ডোলিন একটা ঘটনা। তখন উথালপাথাল সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সমাজ। উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেউই আর সন্ধ্যের পর নিজের এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও যেত না। বোমা, গুলির আওয়াজে অভ্যস্ত আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এটাই সভ্যতা। কিন্তু মেজকা তার ডেকার্স লেনের টিউশনটা ছাড়েনি। বাবা, মা, এমনকি সেজকাকী পর্যন্ত নিষেধ করত। কিন্তু মেজকা হেসে বলত –“আমায় কেউ মারবে কেন! আমি তো ওদের কোন ক্ষতি করিনি।” কিন্তু মেজকার যে সঙ্গীতশিক্ষক, তাঁর ভাই ছিলেন বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। একদিন রাত্রি আটটা নাগাদ কাজ-করা পাঞ্জাবী পরিহিত মেজকা তাঁর ম্যান্ডোলিন বক্স নিয়ে ফিরছিল। দোকানের ঝাঁপ ফেলা অন্ধকার রাস্তায় থমথমে ভাব। হঠাৎ একদল ছেলে ঘিরে ফেলল তাঁকে। সবার মুখ কাপড়ে ঢাকা, হাতে চকচকে অস্ত্র। মেজকা একটু বিচলিত হল না।
“কোত্থেকে ফেরা হচ্ছে?”
“আমি একজন ম্যান্ডোলিন শিক্ষক। ডেকার্স লেন থেকে টিউশান করিয়ে ফিরছি।”
“আপনার শুভঙ্কর ভট্টাচার্যর বাড়িতে যাওয়া-আসা আছে না?”
“আছে। উনি আমার শিক্ষাগুরু।”
“দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে নিশ্চয়ই চেনেন?”
“বিলক্ষণ চিনি। মাস্টারমশাইয়ের ভাই। তবে এখন আর ও বাড়িতে বহুদিন হল দেখতে পাই না।”
এরপর আর কোন কথা নেই। একটি ছেলে এমনভাবে আচমকা ধাক্কা মারল মেজকাকে যে ম্যান্ডোলিন বক্সটা ছিটকে পড়ে গেল। মেজকা ঝাঁপিয়ে পড়ে বক্সটাকে তুলে নিয়ে ম্যান্ডোলিনটা বের করে এমনভাবে হাত বোলাতে লাগল যেন একটি শিশুকে অপত্যস্নেহ ঢেলে দিচ্ছে তার অভিভাবক। ছেলেগুলোর কাছে এই অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও কেউ যে এমন নিস্পৃহ থাকতে পারে, এ তারা কোনওদিন দেখেনি। তাদের অপেক্ষমান অস্ত্রের মুখোমুখি হয়েও মেজকা বলল, “একটা রিকোয়েস্ট করি? হয়ত এক্ষুণি কিছু একটা ঘটবে। কেন ঘটবে জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে। তা ঘটুক। শেষের আগে একবার আমার সন্তানকে আদর করি?” এই বলে মেজকা ম্যান্ডোলিনে সুর লাগালো। সেই আবছায়াময় রাস্তার কর্কশ নৈঃশব্দে যেন ঢেউ খেলল সুরের প্লাবনে। মেজকার দুচোখ ভিজে উঠেছিল, কারণ যে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, শুভঙ্কর ভট্টাচার্যর বাড়িতে মেজকার যাওয়া-আসা আছে কিনা, মুখ ঢাকা থাকলেও মেজকা তাকে ঠিক চিনতে পেরেছিল। এককালের স্টুডেন্ট প্রভাস। শৌখিন প্রকাশ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে প্রভাস বাজনা শিখতে এসেছিল। ভালোই শিখছিল। হঠাৎ একদিন আসা বন্ধ করে দিল। আর যোগাযোগও রইল না। আজ… বাজনা থামানোর পর মেজকা দেখল ওরা কেউ কোত্থাও নেই। দুচোখ মুছে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মেজকা ভাবছিল, জীবন এক আশ্চর্য হেঁয়ালি! এই গোটা ঘটনা একজন লুকিয়ে দেখে ফেলেছিল বলে আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম। এরপর সেজকাকীর কান্নাকাটিতে ও মায়ের বোঝানোয় মেজকার ডেকার্স লেনের টিউশনিটা আর রইল না।
মেজকার আগে এক এক করে বাবা, মা, সেজকা সবাই চলে গিয়েছে। ছোটকা তো ছোটবেলাতেই তিনদিনের জ্বরে মারা যায় শুনেছি। বৃদ্ধ শয্যাশায়ী মেজকার দেখভাল এখন আমিই করি। সেজকাকীরও যথেষ্ট বয়স হয়ে গেল। কোন ছেলেমেয়ে নেই বলে আমিই এঁদের পুত্রসম। অগাধ স্নেহ, অপ্রতুল সম্পত্তি সব আমাকেই দিয়েছে। আর সেজকাকী আমাকে অতিরিক্ত দিয়েছে মেজকাকে নিয়ে তাঁর অদ্ভুত ফ্যাসিনেশনের গোটা অধ্যায়, যা ইনফ্যাচুয়েশনও নয়, আবার তার কোন বাস্তব আদলও ছিল না। শুধুমাত্র এই ডেলিকেসিকে সম্মান দিতেই আমি কোন বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াইনি। কারণ নতুন একজন এসে এই সম্পর্কসাঁকোকে এর মত করে আদৌ উপলব্ধি করতে পারবে কি না, এ নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। জটিলতা বাড়িয়ে তোলার চেয়ে জীবনে শান্তি পাওয়ার পথ নির্মাণ করতে পারা অনেক বেশি জরুরি। মেজকা যেদিন মারা যায়, সেজকাকী বলেছিল, “তোর খুকুমাসীকে আর জানাতে হবে না। বয়স হয়েছে তো, উদ্বিগ্ন হবে, অসুস্থ হয়ে পড়বে… কি দরকার!” আমি অবাক হইনি, এমনটাই যেন প্রত্যাশিত ছিল। মেজকার পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন হওয়ার পর সেজকাকী আমাকে বলেছিল, “প্রাণ থাকতে এই ম্যান্ডোলিনের কোন অমর্যাদা যেন না হয়, দেখিস।”
আজ ম্যান্ডোলিনটার চকচকে গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মনে পড়ে যাচ্ছে কবেকার কথাগুলো…