• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | গল্প
    Share
  • দুটো অণু গল্প : রাহুল রায়



    নন্দিতার প্রতিশোধ

    নন্দিতা ঝিনুক কুড়োতে ব্যস্ত ছিলো সমুদ্রের ধারে। হঠাৎ চোখে পড়লো বালির মধ্যে একটি ছোট জিনিষ লুকিয়ে আছে, চাঁদের আলোয় বেশ ঝলমল করছে। কী এটা? হাতে তুলে নিতেই তার গায়ে যেন বিদ্যুতের শক লাগলো। আরে জিনিষটা কেমন যেন থরথর করে কাঁপছে। এ কী, এ যে জীবন্ত! এদিকে হাতে কী যেন লেগেছে। কেমন যেন চটচট করছে। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে সে দেখতে পেল ওর হাতে ধরা একটা শুকিয়ে-আসা রক্তের রঙের হৃদপিণ্ড, আর সেটাতে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে বিঁধে রয়েছে একটা ছুরি – সেটাই চাঁদের আলোয় চকচক করছে। ঘটনার আকস্মিকতা ও অবাস্তবতার ঘোর কাটিয়ে উঠতেই নন্দিতার মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা।

    পুরীতে আসার পর থেকেই একটা গান নন্দিতার মনে গুনগুনিয়ে চলেছে – ‘জীবন যখন ছিল ফুলের মত, পাপড়ি তাহার ছিল শত শত’। নয় নয় করে প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল। সুপ্রতীকের সঙ্গে তখন দারুণ প্রেম চলছে। তবু সে যখন প্রস্তাব করল ‘চলো না আমরা কাউকে না বলে দুদিনের জন্য ইলোপ করি,’ লজ্জায় তার দু-কান লাল হয়ে গেছিল। মুখে না, না, খুব লজ্জার ব্যাপার হবে- ইত্যাদি বললেও জীবনকে নিয়ে একটা দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের সম্ভাবনায় মনটা যেন ডানা মেলেছিল সম্ভাবনার আকাশে। কান লাল করে রাজি হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিল বাড়িতে কী বলবে? শেষে অফিসের কাজে দুদিন দিল্লি যেতে হবে বলে বাড়ির বড়দের বুঝিয়েছিল। খুব বেশি মিথ্যে নয়। কাজের খাতিরে ন-মাসে-ছ-মাসে বাইরে যেতেই হয় নন্দিতাকে।

    সেই দুদিনের আনন্দ, লজ্জা, উষ্ণতা, নিবিড় সান্নিধ্যের কথা নন্দিতার কাছে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় পারফিউমের একটা গন্ধের মত রয়ে গেছে। এতদিন বাদে ঠিক মনে পড়ে না, কিন্তু যখন পড়ে তখন সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরে। একটা আনন্দ, একটা শিহরণ তাকে ঘিরে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হারিয়ে যায়। যেমন পুরী থেকে ফেরার কয়েক মাসের মধ্যেই সুপ্রতীক হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাতই। নন্দিতা যখন খবর পায়, ততক্ষণে সব শেষ। একটা মস্ত বড় ট্রাক তার স্কুটারের পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল। কিছু বোঝার আগেই সব শেষ।

    আবার পুরীতে আসা। ইতিমধ্যে শরীরে যৌবন চলে গিয়ে মধ্য বয়সে। নন্দিতার জীবনে আর কোন পুরুষ আসেনি। কিন্তু এখানে আসার পর থেকেই সেই কুড়ি বছর আগের মাত্র দুটো দিন সব রূপ-রং-স্পর্শ নিয়ে ফিরে এসেছে। সেই নিবিড় আলিঙ্গন, সেই প্রথম শারীরিক পরিতৃপ্তির কথা বার বার তার শরীরে শিহরণ এনে দুকান রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মনে গুনগুনিয়ে আসছে –‘বসন্তে যে হত সে যে দাতা/ ছড়িয়ে দিত দুচারটি তার পাতা/ তবু তাহার বাকি রইত কতো।’ সেই স্মৃতির বেশ কিছুটা মনে রয়ে গেছে, আর অনেকটাই ঝরে পড়ার মুখে। তবু নন্দিতার শরীর-মনের আগুন ধিক-ধিক করে জ্বলছে।

    এইসব ভাবতে ভাবতে কখন দু- চোখ ভরে ঘুম এসেছে নন্দিতা জানতে পারে নি। হঠাৎ একটা খস-খস শব্দে সে জেগে উঠলো। কিছুক্ষণ চুপ। হয়তো মনের ভুল। নাঃ, আবার সেই শব্দ – মনে হচ্ছে কে যেন পা ঘষটাতে-ঘষটাতে তার বিছানার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। মনের ভুল? ইতিমধ্যে নন্দিতা পুরোপুরি জেগে উঠেছে। নাঃ, ওই তো, ওই তো আবার। ঘরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে কিছু দেখা যাচ্ছে না, আর এইজন্যই বোধহয় শব্দটার ভার কানের মধ্যে দুরমুশ পিটছে। হঠাৎ মনে হোল সুপ্রতীক ফিরে এসেছে। কিন্তু এ কিরকম আসা! নন্দিতা বুঝতে পারলো যে সারা গায়ে কিলবিল করে ঘামের ধারা নেমেছে। ভয়। একটা কালো ভয় ঘিরে ধরেছে।

    কিছু করা দরকার। হঠাৎ মনে পড়ে গেল বিছানার পাশের টেবিলে একটা পেপার-কাটিং নাইফ পড়ে আছে। আজই সন্ধ্যেবেলা এটা হাতে নিয়ে নন্দিতা ভেবেছে আজকার যুগে, যেখানে খামের চিঠি প্রায় প্রাগৈতিহাসিক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে এই খাম খোলার জন্য ছুরির কী প্রয়োজন। মনে পড়তেই নন্দিতা সেটা তুলে নিয়ে সেই শব্দ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়েছে। আর কী আশ্চর্য ব্যাপার- সব একেবারে নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল।

    পরের দিন সকালে নন্দিতা সব কিছু খুব ভাল করে খুঁজে দেখেছে। কোথাও কিচ্ছুটি নেই। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার – সেই ছুরিটা গেল কোথায়?

    নন্দিতা হাতের মধ্যে ধরে রাখা হৃদপিণ্ডটার দিকে আবার তাকালো। এখন আর ভয়, গা–শিরশিরানি – কিছুই নেই। মনের মধ্যে খালি প্রশ্ন – কেন, কেন সুপ্রতীক আমার শরীর-মন সবকিছু জাগিয়ে দিয়ে হঠাতই সব কিছু শূন্য করে চলে গেল। সে জানে এতে সুপ্রতীকের কোন হাত ছিল না। কিন্তু কোথাও কি, কোথায় কি একটা প্রতিহিংসা জেগেছিল? নন্দিতা মাটিতে বসে পড়ে ঝর-ঝর করে কেঁদে ফেললো। হৃদপিণ্ডটা তখনো তার হাতে ধরা।

    ঘেঁটোদা



    আজ দশমী। পাড়ার পুজোর থীম ছিল লাইভ ঠাকুর। পাড়ার মিষ্টির দোকানের ময়রা হয়েছিল গণেশ, বলিউডের স্বপ্নে বিভোর ঋত্বিক হয়েছিল কার্ত্তিক, পাড়ার হার্টথ্রব চিনির বোন মিনি হয়েছিল লক্ষ্মী, আর বঙ্কুর বোন খুকু হয়েছিল সরস্বতী। দুর্গা কে হবে? পাড়ার মস্তান ঘেঁটোদা নিদান দিলেন কালিকার দিদি দুর্গাই হবে মা-দুর্গা, আর ঘেঁটোদা হবে অসুর। চুল তো বড়ই আছে, আর গোঁফ দুটো ছাঁটা চলবে না কয়েকদিন। ব্যাস। শোনা যায় দুর্গার প্রতি ঘেঁটোদার বেশ একটু দুর্বলতা আছে। তাই বুকের ওপর ত্রিশূল নিয়ে দাঁড়ালে সে আপত্তি করবে না। বেশ একটু রোম্যান্টিকই হবে। দুর্গা প্রথমদিকে একটু গাঁইগুঁই করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। বুকের ওপর দাঁড়িয়ে এতদিনের তার দিকে তাকিয়ে শিষ দেওয়া আর হেঁড়ে গলায় ‘কে তুমি নন্দিনী, আগে তো দেখিনি’ গান গাওয়ার শোধ নেওয়া যাবে। কটা দিন বেশ নির্বিঘ্নে কাটলো। খালি ঘেঁটোদাই বুকে চিন-চিনে ব্যথা নিয়ে একটু কমপ্লেন করেছিল। কে যেন চুপি-চুপি বলেছিল – দিলমে দর্দ। এদিকে ঠাকুর সাজানোর এরকম অভিনবত্ব দেখে ভিড়ে ভিড়াক্কার। এসব কাটিয়ে এসে গেল দশমী। কিন্তু বিসর্জন হবে কী করে? আবার ঘেঁটোদার মাথায়ই বুদ্ধিটা এলো। সবাই ঠাকুর সেজে লরীতে উঠুক, আর সঙ্গে থাকুক ছোট একটা ঠাকুর। সেটাকে বিসর্জন দেওয়া যাবে। এই না হলে ঘেঁটোদা। মস্তান হলে কী হবে, মাথায় ঘিলু একেবারে কিলবিল করছে।

    গঙ্গায় পৌঁছে সবায়ের মন খুব খারাপ। এই কদিন ঠাকুরের সাজে, আর লোকের ভিড়ে ময়রা, মিনি, ঋত্বিক, খুকু, দুর্গার নিজেদের কেমন যেন ঠাকুর-ঠাকুর মনে হচ্ছিল। জীবনে এরকম সুযোগ কি আর আসবে! সবই ঘেঁটোদার কৃতিত্ব। এদিকে মাটির ঠাকুর বিসর্জন দিতে সবাই লরী খালি করে গেল, খালি দুর্গা আর ঘেঁটোদা নো-পাত্তা। ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে সবাই ফিরে এসে দেখে লরীর মধ্যে ঠাকুর-সাজা দুর্গা অসুরের সাজে ঘেঁটোদার বুকের ওপর একটা বাঁশের কঞ্চি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    বছরখানেক কাটল। হঠাৎ দেখা গেল দুর্গার বাড়িতে প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হয়েছে। শীগগিরই শোনা গেল সানাইয়ের সুর। বিয়ের দিন টোপর-মাথায় ঘেঁটোদা ঢুকছে। পেছনে ময়রা, মিনি, ঋত্বিক, খুকুর দল। কে যেন ফুট কাটল – বিয়ের আগেই এতোগুলো বাচ্চা।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments