• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | গল্প
    Share
  • আমাদের সেই পোড়োবাড়িটা : ফয়সাল রাব্বি



    আমরা প্রায়ই বাড়িটার বারান্দায় বসতাম। বেশ পুরোনো বাড়ি। ছোপ ছোপ খসে পড়া পলেস্তারা, মাকড়সার জাল আর টিকটিকির অবাধ চলাফেরা দেখতাম। পাশেই বাঁশপাতার ঝিরঝিরি, ঝিঁঝিঁপোকার একটানা ঝিঁঝিঁইই আর দু'একটা অপরিচিত পোকার চেনা শব্দ শুনতাম। ওপরে ফাটল-ধরা ছাদে রডের বদলে ব্যবহার করা রেললাইনের ইস্পাতও আমাদের দৃষ্টি এড়াতো না। ছাদের ফাটলের পাশেই একজোড়া টোনাটুনির ঘর; কখনো কখনো বাচ্চাগুলো চিঁইচিঁই করতো। মা শালিক উড়ে এসে নির্বিঘ্নে বাচ্চাদের খাওয়াতো। দেয়াল আর ছাদের উপরের কোণগুলো সব মাকড়সার দখলে। নিচের কোণগুলো সব পিঁপড়ের – বাস্তিল দুর্গের মত তারা ঢিবি বানিয়েছে। ঘুণে খাওয়া দরজার কাঠের ক্ষতগুলোতে সাম্রাজ্য গড়েছে মৌমাছি ধরণের কয়েকটা পোকা – কিছুক্ষণ পর পর কাদার ছোট দলা দু’পায়ে নিয়ে উড়ে এসে সাম্রাজ্য বাড়িয়ে নিচ্ছে দেখতাম। আমরা বিস্ময়ে ভাবতাম এ বাড়িতে কারা থাকত! পাশেই ঘন আদিম জঙ্গল; অযত্নে একা বেড়ে উঠেছে। নাম-না-জানা লতাগুল্মগুলোও আমাদের খুব পরিচিত ছিল। কিছুদূর এগোলেই একটা কূপ। কূপের নিচে তাকানোর সাহস আমাদের কখনোই হয় নি। আমাদের মধ্যে কে যেন বলেছিল কূপের নিচে তাকালেই বুড়ির কাটা মাথাটা দেখা যায়। আমরা কূপের আশপাশ না গেলেও জঙ্গলের অনেকটা পথই হেঁটেছি; বিড়ালের বাচ্চার খোঁজে। কখনো সাপ দেখে উলটো দৌড়ে চলে এসেছি বাড়িটার বারান্দায়। কখনো টিফিন পিরিয়ডের আধঘন্টা পেরিয়ে গেলেও আমরা টের পেতাম না। দেরিতে ক্লাসে আসার জন্য স্যারের হাতে কত পিটুনি খেয়েছি আমরা! পরদিন আবার এসেছি।

    এখানে, এই বারান্দায় বসে লুডো খেলতাম আমরা। বিরক্তিকর সব বকবকানির চেয়ে এখানে বসে থাকাটা শান্তির ছিল। আমাদের মধ্যে একজন সিগারেট নিয়ে এসেছিল একদিন। ব্ল্যাক সিগারেট। সবার হাতেখড়ি সেদিনই, এখানেই। এই বারান্দায় বসে নির্বিঘ্নে সিগারেট খেতাম আমরা। কারণ এই জঙ্গলা পরিত্যক্ত বাড়ির আশপাশে কেউ আসে না ভুলেও। শুধু স্কুলের পিয়ন সংক্ষিপ্ত রাস্তায় বাড়ি যেতে এই জঙ্গলের পথ বেছে নিতেন সহসা। কোনো কোনো দিন বিদঘুটে শব্দ করে তাকে ভয় পাইয়ে দিতাম। এ বাড়ি নিয়ে ভৌতিক গল্পের শেষ নেই - এ বাড়িতে থাকতেন একা এক বুড়ি। তার বহু মানতে পাওয়া ছেলেকে হারিয়ে একা মরেছেন এ বাড়িতে। মাংস-পচা গন্ধ যেদিন বেরোলো, সেদিনই প্রতিবেশী বুঝলো বুড়ি মরেছে। তারপর বুড়ির শাপেই নাকি এখানকার বেশ ক'জন ছেলেও উধাও হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, আর কখনো ফিরে আসে নি। এ কারণে আমাদের এখানে আসতে একপ্রকার নিষেধাজ্ঞাই ছিল।

    আমরা বাড়িটাকে নিয়ে এইসব গল্প অন্যকে বলার সময় দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই বলতাম। আর তখন সত্যিই আমাদের শরীরে ভয়ে কাঁটা দিত; মরে মাংস-পচার ব্যাপারটায় গা ঘিনঘিন করে উঠত। কিন্তু যখন স্কুল ফাঁকি দিয়ে এখানে আসতাম – দিনের বেলা - আমাদের কিছু মনেই হত না। যেন আমরা আমাদের গোপন নিরাপদ আস্তানায় এসেছি। টিফিনের পাঁচ টাকা দিয়ে ব্ল্যাক সিগারেট কিনতাম। সিগারেট টানতে টানতে লুডো খেলতাম আমরা। লাল ইটের টুকরো দিয়ে ছক কেটে লুডোর ঘর আঁকা হত। প্রায় প্রতিদিনই নতুন ছক আঁকতে হত। তাতে পুরো বারান্দাটা অনেকগুলো লাল ছকে ভরে উঠেছিল, আর ব্ল্যাক সিগারেটের অসংখ্য মোথা। আমরা মাঝেমধ্যে ভাবতাম, বাড়ির মালিক যদি হুট করে একদিন ফিরে এসে আমাদের দেখতে পায়! মালিক এলে দেখতো, কয়েকটা বখাটে তার বাড়িটাকে নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছে। আর টিকটিকি, মাকড়সা-সহ অসংখ্য অচেনা পোকামাকড় তার চোখ এড়াতো। শুধু আমাদের ওপরই নেমে আসতো অশ্লীল বাক্যবাণ। কিন্তু তেমনটা হয় নি, অন্তত এখন পর্যন্ত! আমাদের মধ্যে একজন যুক্তি দিত, বুড়ির হারিয়ে যাওয়া ছেলের বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, এইসব গল্প আমাদের বাবা-মায়েরও ছোটবেলার। এতো পুরোনো অলীক গল্প বিশ্বাস করার কোনো মানেই হয় না। সুতরাং, আমরা বাড়িটার বারান্দায় বসে নির্বিঘ্নে লুডো খেলি৷ আর সিগারেট টানি। বাবা বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকতেন, বাবার সঙ্গে তেমন একটা কথা হতো না আমাদের। শুধু রেজাল্ট খারাপের পর, ব্রীজের পাশের লিচুবাগানের লিচু চুরির পর, ক্লাসের মারামারির অভিযোগের পর বাবার গর্জন শুনতাম। ব্যস্ত বাবা কিংবা ঘরে থাকা মাও আমাদের সিগারেট খাওয়ার কথা কখনো জানতে পারেন নি। মাঝেমধ্যে ভাবতাম, ধরা পড়লে আমাদের কী হত! মা থাপ্পড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দিতেন, বাবা লাঠি দিয়ে হাড়গোড় ভাঙতেন। কিংবা সঙ্গদোষের কথা ভেবে ইস্কুল বদল করে দিতেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হত না। সেখানেও আমরা দল পাকাতাম। শিক্ষকের টিটকিরি, গালি, পড়াশুনা না পারার ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের মনে একটা করুণ বেদনার মত লেগে থাকত। বাড়িতে এলেই মা পড়তে বলতেন। দূর থেকে আসা বাবার হুন্ডার শব্দ শুনলেই আমরা গলা ছেড়ে পড়তাম। আর লোডশেডিং-এর অপেক্ষায় থাকতাম। আর স্কুলে গেলেই টিফিন পিরিয়ডের অপেক্ষায়। টিফিনের ঘন্টা বাজলেই বাড়িটার বারান্দায় যেতাম, সিগারেট জ্বালাতাম, লাল ইটের টুকরো দিয়ে লুডোর ছক কেটে লুডো খেলতাম। ওই খেলাটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। খাবার বিরতিতে, কিংবা অফিসের কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই আমরা খেলি। এমনও হয়েছে যে, লুডো খেলতে খেলতে আমরা বাড়িটার বারান্দায় গড়াগড়ি খেতাম। সেই জঙ্গলের পথে ছোট্ট বিড়ালের পেছনে ছুটতাম, ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁঝিঁইই আর শালিকের বাচ্চার চিঁচিঁইই আমাদের মগজে সূচের মত হানা দিত। তারপরই বসের বকাঝকায় আমাদের সম্বিৎ ফেরে। আমরা কাজে মনোযোগ দিই। খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করায় আমাদের কারো কারো পদোন্নতি হয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান - বেতনের প্রতিটা পয়সা উসুল করে নেয়। বসের গালি আর কাজ ঠিকমতো করতে না পারার গ্লানি আমাদের মনে গভীর বেদনার ছাপ হয়ে থাকে। তাই আমরা কাজ করতে করতে সিগারেট খাই। বেনসন সিগারেট, একটার পর একটা - যেহেতু শ্বাস নেওয়ার আর কোনো উপায় নেই। আমাদের ভুঁড়ি বাড়ে, বেতন যেমন বাড়ে বছরে বছরে। আমাদের ছেলেপুলেরাও বাড়ে একই হারে।

    আমরা জ্যামে বসে প্যাঁ-পুঁ শুনতে শুনতে মোবাইলে লুডো খেলি, কমোডে বসেও। লাল ইটের টুকরায় কীভাবে লুডোর ছক কাটতে হয় ভুলে গেছি ইতোমধ্যে। ইদানীং সব কিছুই ভুলে ভুলে যাই; এন্টিবায়োটিক খাওয়ার সময়সীমা, দুপুরে কী খেয়েছি, কাকে কী বলেছি - এসব। আমাদের মধ্যে কারো কারো মাথায় টাক পড়েছে। আর চুল-দাড়ি সাদা হয়েছে সবারই। এন্টিবায়োটিক কোর্স ঠিকভাবে শেষ না করার কারণে কারো কারো এন্টিবায়োটিক রেসিসট্যান্স হয়ে গেছে। আমরা প্রায় সবাই রোগে শীর্ণ। বার্ধক্যে। বাবা-মাদের দেখেছি, কীভাবে মুখের টান টান চামড়া ঝুলে যায়। আমাদেরও একই দশা। সারাদিন ইজি চেয়ারে দুলতে দুলতে সিগারেট খাই। ইদানীং সিগারেট খেতেও কষ্ট হয়। আমরা কেউ কেউ কাশতে কাশতে অজ্ঞান হয়ে যাই, কারো হার্ট এটাক হয়। তারপর মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে যেতে যেতে সেই পোড়োবাড়িটার বারান্দায় বসি, লুডো খেলি। মহাসড়কের বিশাল ব্যস্ত-চটুল রাস্তার কোনো এক জায়গায় হুট করে একটা নিরীহ রাস্তা নেমে নির্জন গ্রামের দিকে যায়। আমরাও সেদিকে যাই। ওরা চলে যায় বিভিন্ন দিকে। আমি খুঁজতে থাকি বুনো আমগাছটা। খুঁজেও পাই। আরোও অনেক বুনো গাছ বেড়ে উঠেছে আশপাশ। ঢাকা পড়েছে আমাদের বাড়িটা। অচেনা সব পোকার দখলে এর দেয়ালগুলো। আমি বারান্দায় দাঁড়াই, লাল ইটের টুকরায় আঁকা অচেনা সব ছক দেখি। আমি 'মা' বলে ডাকি। টিকটিকি টিকটিক করে ওঠে, কেউ দরজা খোলে না। মাকে খুঁজতে অবহেলায় বেড়ে ওঠা জঙ্গলের দিকে হাঁটি। কোথাও না পেয়ে শেষে সাহস করে কূপটার দিকে মুখ বাড়াই।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments