মুভি মাল্টিপ্লেক্সের আলো-আঁধারি থেকে বাইরের প্রখরতায় হাতে হাত ধরে বেরিয়ে আসছিল ওরা দুজন – অতনু আর মিমি। মিমির চোখেমুখে তখনও হট, রোম্যান্টিক মুভির ঘোর।
“তুই একটা যা-তা!” ফিসফিসিয়ে বলল সে, “ছ'বছরের মধ্যে একবারও, একবারও হাত ধরার ওপরে উঠতে পারলি না!”
অপ্রস্তুত অতনু বলল, “সেসব কি পালিয়ে যাচ্ছে? দুটো বছর দে। ক্যাম্পাস, চাকরি, তারপর তো – যা খুশি।”
“ঢ্যাঁড়স!” বিলোল কটাক্ষ হেনে বলল মিমি, “নে, এগো। আমার আবার বাড়িতে কারফিউ।”
“ফিলিং এক্সাইটেড! আর মাত্র তিনটে মাস। তারপর ট্রেনিং কমপ্লিট হলেই প্লেসমেন্ট – বেঙ্গালুরু বা চেন্নাই। তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”
“আমার আবার কীসের আপত্তি?” নির্লিপ্তভাবে বলল মিমি, “তা, তোর কম্পানি অনসাইটে পাঠায় না?”
“হয়তো পাঠায়, জয়েন করলে বুঝতে পারব। তবে আমার অত গরজ নেই। একটা মোটামুটি চাকরি, সুখের সংসার, এর বেশি কিছু এখন আমার রেডারে নেই।”
“অ!”
“তবে ট্রেনিংয়ের এই তিন মাস তোকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলে বুকটা কেমন করছে। তোর?”
“সে তো করবেই, ন্যাচারালি। তা’বলে ট্রেনিংয়ে যাবি না? তিনটে মাস, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।”
“ট্রেনিংয়ে নাকি খুব চাপ, হাঁফ ছাড়তে দেয় না। রেগুলার কন্টাক্ট না করতে পারলে কিছু মনে করিস না। অবশ্যই মেসেজ দিস।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তা আর বলতে!” মিমি এবার সোজা অতনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বল তো তোকে এখানে কেন ডেকেছি?”
“কেন? মানে, পার্কটা সুন্দর।”
“তোর মনে আছে, প্রায় আট বছর আগে আমরা প্রথম কোথায় দেখা করেছিলাম?”
“এ-এখানে।”
“হ্যাঁ। এখানে সবাই কেন আসে জানিস? নিরিবিলিতে প্রেম করতে! আর তুই হাঁদারাম কিনা আট বছরে আমাকে একবারও –” মিমি হঠাৎ অতনুকে জড়িয়ে ধরে তার দু গালে দুই পাপড়ি ঠোঁটের ছাপ এঁকে দিল। তারপর অপ্রস্তুত সঙ্গীর হাত ঝাঁকিয়ে বলল, “নে, আয়। হ্যাপি জার্নি।”
সত্যিই চাপ। সকাল থেকে সন্ধে কোনো ফুরসত নেই। তারপরেও দুটি খেয়েই অ্যাসাইনমেন্ট। তারই মধ্যে দু-একটা দিন বের করে যদি বা ফোন করা গেল, মিমি হয় তোলে না নয় দায়সারা উত্তর দিয়ে ছেড়ে দেয়। বোঝে ওদের রক্ষণশীল পরিবার, অত রাতে কল করলে – তবু মন যে মানে না।
তাও যদি বা একরকম ছিল, হঠাৎ একদিন শুনল, “এই নাম্বারটি বৈধ নয়।” বার বার চেষ্টা করেও লাগল না। কী ব্যাপার? কোথাও গেল, নাকি সিম পাল্টাল? আবার খারাপ কিছু হল না তো?
বোন সীমা বোধহয় ওদের কেসটা জানে। তাকে ট্যাপ করবে? অনেক কষ্টে দ্বিধা কাটিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিগ্যেস করল – ন্যাকা বোন কিছু জানে না।
“এখন ওসব ছাড়। ভালো করে ট্রেনিংটা নে।” ন্যাকা এখন গার্জেন!
অতনু অগত্যা তাই করে। আর তো মাত্র ক'টা দিন –
“কোথায় যাচ্ছিস, দাদা? দাঁড়া।”
“মানে?”
“মিমিদির বিয়ে হয়ে গেছে।”
“বি-য়ে?”
“হ্যাঁ। ওরা লন্ডন চলে গেছে। তোকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে।”
কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা ছিঁড়ল অতনু। আবেগবর্জিত সংক্ষিপ্ত চিঠি:
“টাইপ মিসম্যাচ। ভেবে দেখলাম, ব্যাপারটা তাই। তুই ব্রিলিয়ান্ট, তোর টাইপ ঠিক পেয়ে যাবি।
আমি অনেক দূর যেতে চাই, অনেক কিছু পেতে চাই। চললাম। দেখি।”
একটা টনটনে যন্ত্রণা। বুক উছলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। তরঙ্গের মতো উঠছে, পড়ছে, কিন্তু উপশম নেই। হাত-পা কাটা গেলে কি এমন লাগে?
একমাত্র রেহাই, ঘুম। কিন্তু চোখে ঘুম আসে কই? উঠে বসল অতনু – বাবার প্রেসক্রিপশন!
আর ড্রাগিস্টগুলোও হয়েছে তেমন! সাতটার বেশি কিছুতেই নয়। “আর এই ক'টাও ওঁর হাতে নয়, আপনার কাছে রেখে একবারে একটা দেবেন। বোঝেনই তো, বয়স্ক মানুষ – কখন মতিভ্রম হয়।”
যাক, তিন দোকান ঘুরে একুশটা পাওয়া গেছে। হয়ে যাবে। এবার সে ঘুমোবে, একটানা ঘুম। সব যন্ত্রণা, ক্ষোভ, অভিমান, বঞ্চনার নিশ্চিন্ত পরিসমাপ্তি।
“অতনু, অতনু –”
অস্পষ্ট আবছায়ার ওপাশে এক অপরূপার মুখ। মিমি? না তো! কোনো দেবী?
আবছায়া ক্রমে সরছে। তার মুখের ওপর ঝুঁকে আলতো করে ডাকছেন এক অপরিচিতা। সাদা অ্যাপ্রন, স্টেথোস্কোপ – ডাক্তার!
“অতনু, চোখ মেলো – তুমি ভালো হয়ে যাবে। তোমাকে ভালো হতেই হবে।” আকুলস্বরে বলে চলেছেন তিনি।
“ভালো হব – কেন?”
“ওদের জন্য।” ডাক্তার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
কাঁচের দেওয়ালের ওপাশ থেকে তাকিয়ে তিনটি ফ্যাকাশে মুখ – মা, বাবা, সীমা। হঠাৎ অতনুর চোখ সজল হয়ে উঠল, “ডক্টর, আমি বাঁচব?”
“তোমাকে বাঁচতেই হবে। আমরা পাম্প করে অধিকাংশ ট্যাবলেট বের করে দিয়েছি। তবু যেটুকু সিস্টেমে গেছে, তার বিষক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে তোমায় এখন জেগে থাকতে হবে।”
তারপর ডাক্তার একটু থেমে বললেন, “তবে এটুকু সম্ভব হচ্ছে তোমার তৎপর বোনটির জন্য। তোমার খিঁচুনি দেখে সব বুঝতে পেরে ও তোমাকে গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যেই এখানে এনে না ফেললে –“
অবসন্ন লাগছে। তবু অতনু জোর করে চোখের পাতা খুলে রাখল। বলল, “আপনার নাম, ডক্টর?”
“নীলম সিনহা।”
“আপনি তো চমৎকার বাংলা বলেন, ডঃ সিনহা।”
“আমরা তিন জেনারেশন কলকাতাবাসী। আর নো ফর্মালিটি প্লীজ, জাস্ট কল মী নীলম।”
রাত অনেক। তবু অতনু কষ্ট করে জেগে আছে। সে এখন বিপদমুক্ত, ডক্টর বলেছেন ঘুমোতে বাধা নেই। তবু সে চোখ বুঁজে জেগে আছে। কারণ, কাল তার ঘুমের মধ্যে এক পরী এসেছিল। সে তার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে গেছে। আজ অতনু তাকে জাগরণে পেতে চায়।
“আমরা তোমাকে শতকরা আশিভাগ সুস্থ করে দিয়েছি। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে তোমাকে মনে জোর আনতে হবে। চেষ্টা করো অতনু, চেষ্টা করো।”
“কিন্তু আমি যে চোখ বুঁজলেই একটা কালো দেওয়াল দেখি, নীলম। তার ওপাশে আশা নেই, ভালোবাসা নেই, জীবন নেই।”
“জীবনকে ভালোবাসো, অতনু। তাহলে জীবন তোমাকে আবার দু'হাত ভরে সব দেবে। তোমাদের বয়স অল্প, মৃত্যু তোমাদের কাছে অবাস্তব, তাই তোমরা জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারো। কিন্তু দেখো পাশের ঘরের বৃদ্ধাকে – বয়স আর রোগ তার শরীর ধ্বংস করেছে। প্রতি অঙ্গে মৃত্যু থাবা বসিয়েছে। তবু সে ভয়ার্ত চোখে আমার হাত চেপে ধরে বলে, ‘ডাক্তার, আমাকে বাঁচাও!’
ঐ বৃদ্ধার কাছ থেকে শেখো, জীবনকে কীভাবে আঁকড়ে ধরতে হয়।”
এখন অতনু চোখ বুঁজে কথাগুলো ভাবছে আর পরীর অপেক্ষা করছে। কিন্তু প্রতীক্ষা সফল হবে কি? পরীরা তো নাকি স্বপ্নেই আসে।
দরজাটা খুট করে খুলে গেল। ঢুকল ডক্টর নীলম। মনিটরের দিকে চেয়ে তার মুখে ফুটে উঠল খুশির হাসি। তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে এসে অতনু ঘুমিয়েছে কিনা পরীক্ষা করে তার কপালে একটা আলতো চুমু দিয়ে আবার নিঃশব্দেই চলে গেল।
জীবনকে ভালোবাসলে জীবন দু’হাতে সব ফিরিয়ে দেয়!
অতনু এখন বেডে। বিকেলে দেখা করতে এসে মা বললেন, “ডাক্তার মেয়েটি তোর জন্য যা করছে, ভাবা যায় না। আহা রে, আমাদের যদি অমন একটা বৌ হত!”
“মা!” মৃদু ভর্ৎসনা করলেও অতনু মনে মনে হাসল। সে জানে, আজ রাতেও তার ঘরে পরী আসবে।
এতদিন পর সে ভরসা করতে পারছে, একমাস পরে চাকরিটাতে জয়েন করতে পারবে।
অতনু এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আজ সে বাড়ি ফিরবে। নীলমের এবেলা ডিউটি নেই। তবু দেখা গেল, ডিসচার্জের সময় সে হাজির।
“আমাদের আবার কবে দেখা হবে, নীলম?” অনেক চেষ্টায় সাহস করে বলল অতনু।
“কোন দুঃখে? সুস্থ হয়ে গেলে কেউ আর ডাক্তারের কাছে আসে?”
“কিন্তু তুমি যে প্রতি রাতে –”
“তুমি যখন ঘুমের ভাণ করতে তখন তোমাকে চুমু দিতাম? দিতাম, যাতে তোমার মনের ক্ষতগুলি সারে। যাতে তোমার বুকে ভালোবাসা আর বাঁচার ইচ্ছে ফিরে আসে। তুমি এখন সুস্থ, আমার কাজও শেষ।”
“তুমি তাহলে আমার জন্য যা যা করেছ, শুধু ডাক্তার হিসেবে?”
“তাছাড়া কী? ডাক্তারের কি মন থাকতে আছে, ফীলিং থাকতে আছে? তোমার জন্যে আমি – একফোঁটাও চোখের জল ফেলব না!”
“নীলম!”
আলগোছে চোখ মুছে নীলম বলল, “যাও অতনু, অতীতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাও। তুমি অনেক দূর যাবে। আর একটা কথা সত্যি হোক মিথ্যে হোক বিশ্বাস করতে পারলে শান্তি পাবে – প্রত্যেক পুরুষের জন্য একজন নারী অপেক্ষা করে আছে। চলার পথে তোমার নারীকে তুমি একদিন ঠিক খুঁজে পাবে।”
বেশ ক'বছর কেটে গেছে। মিমি, ডঃ নীলম আজ অতীত। অতনুর জীবনে এখন চন্দ্রাণী।
অতনু হাসপাতাল থেকে ফেরার কিছুদিন পর মিমি কীভাবে যেন খবর পেয়ে সীমাকে ফোন করেছিল। “মিমিদি কেঁদে কেঁদে বলছিল – ও যে আমায় এতটা ভালোবাসত, কখনো বুঝিনি। আমি একটা অমানুষ, ওর পা ছোঁয়ারও যোগ্য নই। পারলে যেন আমায় ক্ষমা করে দেয়।”
শুনে অতনু স্মিত হেসে সীমার সাহায্যে মিমির ই-ঠিকানায় তাকে ও তার স্বামীকে আগামী দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ই-কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিল।
ক'বছরই বা হয়েছে, ইতিমধ্যেই মিমির স্মৃতি ঝাপসা। ডঃ নীলমের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। তবু অতনু তাকে ভোলেনি। কোনোদিন ভুলবে না।
চন্দ্রাণীর সঙ্গে আলাপের সূত্রপাতেই অতনু তাকে মিমি আর ডঃ নীলমের কথা খুলে বলেছে। শুনে চন্দ্রাণী ছলছল চোখে বলেছিল, “ওরা তোমায় খুব কষ্ট দিয়েছে, তাই না? আমি আর দেব না।”
আবার কোনো আবেশের মুহূর্তে সে হয়তো বলে ওঠে, “কী দেখে তুমি আমাতে মজলে গো? কোনো দিক থেকেই তো আমি তোমার যুগ্যি নই।”
“তোমার বুকে যে বড় শান্তি, চন্দ্রা।”
“আহা রে, এসো! দু'দণ্ড থাকো।”
দয়িতার হৃৎস্পন্দন শুনতে শুনতে অতনু বোঝার চেষ্টা করে, শেষ অবধি সে তার নারীকে খুঁজে পেল কিনা।