• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • খবরের কাগজ : অচিন্ত্য দাস



    সে অনেকদিন আগের কথা। হাতে হাতে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এ সব তো ছিলই না, নতুন জিনিস বলতে কোলকাতায় তখন সবেমাত্র টিভি চালু হয়েছে। আমরা তখন ওই সিক্স কি সেভেনে পড়ি। আমাদের ক্লাসে ধ্রুব বলে একটা ছেলে ছিল – ভীষণ চালাক বলে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ধানিপটকা। দুষ্টু বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওর কিন্তু পড়াশুনোর বুদ্ধিও ছিল। বেশি পড়াশুনো করত না বলে নম্বর বেশি পেত না, কিন্তু আমরা জানতাম ও যদি আরও খানিকটা পড়াশুনো করে তাহলে ফার্স্ট বয় সরোজ কিংবা সেকন্ড বয় প্রশান্তর জায়গা নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

    সেবার আমাদের ইস্কুলে বাংলা পড়াতে একজন নতুন শিক্ষক এলেন। আশুতোষবাবু। হাসিখুশি মানুষ, অন্য শিক্ষকদের মতো অত রাগ বা মেজাজ নেই। কদিনেই তিনি আমাদের বড়দার মতো হয়ে গেলেন। বাংলা ব্যাকরণ, রচনা, সারাংশ লেখা-- এই সব করাতেন ক্লাসে।

    একদিন ক্লাসে এসে বললেন কাল-পরশু দুদিন ছুটি, একটা রচনা লিখতে দিচ্ছি, বাড়ি থেকে লিখে আনবে সকলে। রচনার শিরোনাম ‘খবরের কাগজ’। সকলে একেবারে নিজের মতো করে লিখবে। বইতে ‘সংবাদপত্র’ গোছের রচনা অনেক থাকে – বই থেকে কেউ টুকবে না। নিজে ভাববে, লিখবে নিজের মতো করে। যেমন ধর, খবরের কাগজ কতরকমভাবে মানুষের প্রয়োজনীয় বন্ধু হয়ে উঠেছে। যার লেখা সব থেকে নতুন ধরনের হবে তাকে আমি একটা প্রাইজ দেব।

    ‘বই দেখে রচনা লিখবে না’ – এটা আমাদের কাছে নতুন কথা ছিল না। এ তো সকলেই বলেন। কিন্তু ক্লাসে বাংলা রচনা লিখে প্রাইজ!! আমরা এমন কথা কখনো শুনিনি। ক্লাসে বেশ একটা হৈচৈ পড়ে গেল। দুদিন পরে, মানে সোমবারের ক্লাসে দেখা গেল সকলেই দু-আড়াই পাতা লিখে এনেছে। ফার্স্ট বয় সরোজ প্রথমে নিজের লেখা পড়ল। খুব ভাষাটাষা দিয়ে দারুণ লিখেছিল। স্যার ভালো বললেন। শেষ বাক্যটা ছিল – ‘সংবাদপত্র না থাকলে আমরা কূপমণ্ডুক হয়ে যাব’। কে একজন বলল – স্যার শেষের কথাটা বুঝলাম না, গুফো বন্দুক না কী যেন বলল। স্যার বুঝিয়ে দিলেন কূপমণ্ডুক মানে কুয়োর ব্যাঙ। তারা কুয়োর ভেতরেই সারা জীবন কাটায়। কুয়ো ছাড়া বাইরে যে আরও অনেক কিছু দেখার আছে তা জানে না।

    ক্লাস শেষ হতেই ধ্রুব মানে ধানিপটকা সরোজকে বলে বসল “তুই একটা কূপমণ্ডুক।” সরোজ ভীষণ রেগে গেল। বলল “কেন?” ধানি বলল, “তুই তো নিজে লিখিসনি, কুয়োর ব্যাঙের মতো বই দেখে লিখেছিস।” এতে সরোজ আরও রেগে গেল। আমরা দুজনের হাতাহাতি ছাড়ালাম।

    পরের দিন আরও কজনের খাতা দেখে স্যার আলোচনা করে বলে দিলেন কার কেমন হয়েছে। তারপর ধ্রুবর পালা, ও উঠে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করল।

    “খবরের কাগজ না থাকলে দেশে খাদ্যসমস্যা দেখা দিত। কারণ …” বলার সঙ্গে সঙ্গে সকলে অবাক হয়ে ধানিপটকার দিকে তাকালো। এমনকি স্যারও। দম নিয়ে ধানি পড়ল, “কারণ খবরের কাগজ না থাকলে ঠোঙাও থাকত না। তাহলে মুদির দোকানে চাল-ডাল-নুন সব এক জায়গায় থলিতে নিতে হতো। চাল-ডাল মিশে যাওয়াতে খিচুড়ি ছাড়া কিছু রান্না হতো না, আর অতটা নুন মিশে আছে বলে সে খিচুড়ি কেউ খেতেও পারত না। এই জন্যই খাদ্যসমস্যা দেখা দিত। খবরের কাগজের মোড়ক বা ঠোঙা না থাকলে আরও অনেক রকম রান্না করার জিনিস মিশে একাক্কার হয়ে যেত। রান্না করাই যেত না।”

    ক্লাস সুদ্ধু ছেলেরা হাসতে শুরু করেছে। আশুতোষবাবুর মতো ঠান্ডা মেজাজের মানুষেরও মনে হচ্ছে যে ছেলেটাকে একটা থাপ্পড় মেরে বসিয়ে দেন। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন নতুন কথা লিখতে – যা কোনো বইতে নেই, যা সচরাচর কেউ ভাববেও না, লিখবেও না। ছেলেটা তো তাই করেছে। একে তো কিছু বলা যাবে না। এমন সময় ঘন্টা পড়ে গেল।

    পরের দিন বাংলা ক্লাসে সকলে উৎসুক হয়ে আছে ধানিপটকা আজ কী বলে। স্যার আসতে সে উঠে দাঁড়িয়ে খুব শান্ত গলায় পড়তে শুরু করল, “খবরের কাগজ না থাকলে খাদ্য সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে আসতো বেড়াতে যাওয়ার সমস্যা। ট্রেনের সীটগুলো এতো নোংরা থাকে যে কাগজ পেতে বসতে হয়। মেজমামার সঙ্গে বর্ধমান গিয়েছিলাম, মেজমামা আগেই বলে দিয়েছিলেন তোরা একটা করে গোটা খবরের কাগজ নিয়ে আসবি। যে আনবে না সে ট্রেনে উঠবে না।”

    ক্লাসে আবার হাসির লহর উঠল। ধ্রুব অবশ্য একটুও হাসছে না। সে তার খাতার দিকে তাকিয়ে পড়ে যাচ্ছে। স্যার বললেন, “না, রচনায় এরকম ব্যক্তিগত কথা দেওয়া যায় না। বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা না বলে পরিবহনের ক্ষেত্রে কাগজের কোনো ভূমিকা থাকলে সেটা লিখতে পার।”

    ধ্রুব বলল, “ঠিক স্যার, আমি এরপর পরিবহনের ব্যাপারেই লিখেছি। খবরের কাগজ দিয়েই সব থেকে সহজ ও কম খরচের পরিবহন হতে পারে। জলে এবং আকাশে। ইংরিজি খবরের কাগজের পাতা একটু মোটা হয়, তা দিয়ে খুব সুন্দর নৌকো বানানো যায়। জাহাজও হয় তবে কাগজ চার-চৌকো করে কেটে নিতে হবে। জলে ভাসালে অনেক দূর অবধি চলে যায়। আর এরোপ্লেন, জেটপ্লেন, রকেট এসব করা তো আরও সোজা। চারতলার বারান্দা থেকে ছাড়লে হাওয়ায় ভেসে ভেসে সে কোথায় চলে যায়।”

    আশুবাবুর হাসিও পাচ্ছে, রাগও হচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না। তিনি নিজেই বারবার করে বলে দিয়েছিলেন যে সকলে যেন নতুন রকমের রচনা লেখে। তাই ধৈর্য হারালে চলবে না। ছেলেটাকে দিয়ে কাজের কথা লেখাতেই হবে।

    স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, “শোনো, তুমি বড় এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছ। বিষয়ের ভেতরে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের বিষয় সংবাদপত্র বা খবরের কাগজ। আমি কতগুলো বিন্দু মানে পয়েণ্ট দিয়ে দিচ্ছি, লিখে নাও। কাল সেইমতো রচনা লিখে নিয়ে আসবে।”

    ভারি শান্ত হয়ে ধ্রুব বলল, “ঠিক আছে স্যার, আপনি যেমন বলবেন তেমনি লিখব। পয়েন্টগুলো লিখে নেব স্যার?”

    “হ্যাঁ, লিখে নাও।”

    আশুবাবু সতর্ক হয়ে গেছেন। ছেলেটাকে এমন কিছু নিয়ে লিখতে দিতে হবে যে সে আজেবাজে লাইনে যেন যেতেই না পারে। বললেন, “ধর কোনো বিতর্কিত বিষয়…”

    “স্যার, কী তর্কিত … কী যেন বললেন?’

    আশুবাবু বোর্ডে ‘বিতর্কিত’ কথাটা লিখে দিলেন। মানেও বুঝিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “যে বিষয় বা অবস্থা বা বস্তু নিয়ে মতবিরোধ আছে, অর্থাৎ তা ভালো না খারাপ তা নিয়ে মানুষের সংশয় আছে, তা খবরের কাগজের পাতায় রাখা হয়। মানুষ তা দেখে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারে। এই ব্যাপারটা উদাহরণ সহকারে লিখবে।

    স্যার ভেবেছিলেন এই চালে ধানিপটকা মাত হয়ে যাবে, কিন্তু দেখলেন ছেলেটার চোখে চকিতে একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল। ব্যাটা নিশ্চয়ই উল্টোপাল্টা কিছু লিখবে। নাঃ, একে আর একটু চাপে রাখতে হবে। গলা ঝেড়ে স্যার বললেন, “আরও গোটা দুই পয়েন্ট লিখে নাও। এক: অপরাধ জগৎ এবং খবরের কাগজের ভূমিকা। দুই: খেলাধূলা আর তিন: ব্যবসাবাণিজ্য ও খবরের কাগজ।”

    আসলে আশুবাবু কিছুতেই বলতে পারছেন না যে খবরের কাগজ পড়তে হয়, পড়লে কত খবরাখবর পাওয়া যায়, কত জ্ঞান লাভ হতে পারে। কারণ এ সব কথা তো সব বইতেই আছে। তাঁর ক্রমশ মনে হতে লাগল নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়ছেন। পয়েন্টগুলো ভালো হলো কি? ছেলেটা কি জব্দ হবে না তাঁকেই ঘোল খাইয়ে দেবে!

    আমাদের মাথায় অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ইংরেজি কিছুই আর ঢুকছে না। আমরা ইস্কুলে গিয়ে শুধু অপেক্ষা করে থাকি আশুবাবুর বাংলা ক্লাসের জন্য। ধানিপটকা এবার কী লিখে আনে কে জানে!

    আশুবাবুও টের পাচ্ছেন খবরের কাগজ পড়ে যে খবর জানা যায় এই কথাটা এই দুষ্টু অথচ বুদ্ধিমান ছেলেটি কিছুতেই লিখবে না। একটা চ্যালেঞ্জের মতো দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা।

    আশুবাবু এলেন। আজ তিনি আশা করে আছেন যে এমন কঠিন কঠিন পয়েন্ট দিয়েছেন যে এবার ধ্রুবকে বলতেই হবে খবরের কাগজ পড়তে হয়, তা থেকে অনেক কিছু জানা যায়।

    ধ্রুব মানে ধানিপটকা বলল, “স্যার, প্রথম পয়েন্টটা ঠিক গুছিয়ে লিখতে পারলাম না। ওই যে ‘বিতর্কিত’ পয়েন্টটা স্যার। ভালো-খারাপ নিয়ে মতভেদের ব্যাপার যে খবরের কাগজের পাতায় রাখা হতে পারে তার উদাহরণ মুখে মুখে বলছি। আপনি যদি বলেন ঠিক হয়েছে তাহলে কাল লিখে আনব। আর বাকি পয়েন্টগুলো লিখে এনেছি স্যার।”

    “ঠিক আছে, বল।”

    “স্যার, আমার ছোটকা আমাকে খালি বলে – একদম চুরনগুলি খাবি না, যা তা জিনিস দিয়ে বানায়। অসুখে পড়ে যাবি।

    “কিন্তু সেদিন স্যার আমাদের ক্লাবের সঙ্গে অন্য পাড়ার ফুটবল ম্যাচ ছিল পার্কে। আমাদের গোলকিপার পিকলু ক্যাপটেন অঞ্জনদাকে বলল যে ওর পেটব্যথা করছে। অঞ্জনদা বলল – দু-দুটো গোল এত কম সময়ের ভেতর গপাগপ খেয়ে ফেললি, তাই পেটব্যথা করছে। তোর গোল-পোস্টের পেছনেই চুরনওয়ালা বসেছে। ছুট্টে যা, দুটো গুলি খেয়ে নে, এক্ষুনি সেরে যাবে।

    মানে চুরনগুলি জিনিসটাকে কেউ বলে ভালো, কেউ বলে খারাপ। মতবিরোধ স্যার। চুরনওয়ালারা ছোট ছোট চৌকো চৌকো করে কাটা খবরের কাগজেই চুরনগুলি রেখে মশলা ছড়িয়ে হাতে দেয় – মতভেদওয়ালা জিনিস তো, তাই ওরা খবরের কাগজের পাতা ব্যবহার করে।”

    কোথা থেকে কী যে এনে ফেলছে ছেলেটা। উফ! ক্লাসসুদ্ধু হেসে খুন, তাঁরও হাসি পাচ্ছে কিন্তু তিনি শিক্ষক, হেসে ফেলা তাঁর সাজে না। গম্ভীরস্বরে বললেন, “এটা আর তোমার লিখতে হবে না। কিচ্ছু হয়নি। পরের পয়েন্টগুলো পড়ে শোনাও।

    ধানিপটকা খাতা নিয়ে পড়তে শুরু করল। ওর মুখে অবশ্য একটুও হাসি দেখা যাচ্ছে না।

    “এক নম্বর ‘অপরাধ জগৎ’। খুনীরা অনেক সময় ভয় দেখিয়ে চিঠি দেয়। যেমন – গয়নার বাক্সটা না দিলে তোমার গলাকাটা যাবে... এইসব। কিন্তু নিজের হাতে লিখলে তো হাতের লেখা দেখে পুলিস বুঝে ফেলবে। তাই তারা খবরের কাগজ থেকে অক্ষর কেটে কেটে আঠা দিয়ে সেঁটে চিঠি বানায়। অনেক গোয়েন্দা গল্পেই এই ঘটনা দেখা যায়। খবরের কাগজ না থাকলে খুনীদের নিজের হাতেই চিঠি লিখতে হতো এবং গোয়েন্দা বা পুলিসের হাতে ধরা পড়ে যেত।

    “এরপর ব্যবসাবাণিজ্য। যারা পুরোনো খবরের কাগজ বাড়ি বাড়ি এসে কিনে নিয়ে যায় তারা ভীষণ চালাক ব্যবসায়ী। দাঁড়িপাল্লা এমন কায়দা করে ধরে যে এক কিলো নিচ্ছে বলে অনেক কাগজ নিয়ে চলে যায়। খবরের কাগজ না থাকলে এরাও থাকত না, আর এরকম চুরি করা ব্যবসাও থাকত না। ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে খবরের কাগজের ভূমিকা এখানে দেখা যাচ্ছে।”

    আশুবাবু বুঝলেন এ ছেলের সঙ্গে তিনি পেরে উঠবেন না। রাগ হলেও তিনি বুঝতে পারছেন ছেলেটির মাথায় রোজই নতুন নতুন বুদ্ধি গজায়।

    ধানিপটকা পরের পয়েন্টে চলে গেল। খেলাধূলা। বলল, “খবরের কাগজ না থাকলে আমরা সকলে খেলা দেখতে গিয়ে বেড়াতে যাওয়ার মতন অসুবিধায় পড়ে যেতাম। খেলার মাঠে সিমেন্টের স্টেডিয়াম বা কাঠের গ্যালারি যাই থাক না কেন, কেউ পরিষ্কার করে না। খবরের কাগজ না পেতে বসা যায় না। সকলেই বাড়ি থেকে খবরের কাগজ আনে বসার জন্য। যদি খবরের কাগজ না থাকত, তাহলে দর্শকরা আসতই না খেলা দেখতে। আর দর্শক না আসাতে খেলোয়াড়রা উৎসাহ না পেয়ে পেয়ে একদিন খেলা ছেড়েই দিত। খবরের কাগজ আছে বলেই ক্রিকেট, ফুটবল, হকির খেলোয়াড়রা এত বিখ্যাত হতে পেরেছে।”

    আশুবাবুকে এমন বিপাকে কখনো পড়তে হয়নি। কী বিচ্ছু ছেলেরে বাবা! তবু শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। আশুবাবু বললেন, “কিন্তু ধর কোথায় কী হচ্ছে তা জানতে হবে, তখন জানবে কী করে?”

    ধানিপটকা খুব নিরীহ মুখে বলল – “খুট করে…”

    “মানে?”

    “স্যার খুট করে রেডিও কিংবা টিভি চালিয়ে দিলেই হবে। রেডিও-টিভিতে ভালো কোনো অনুষ্ঠান হয় না স্যার, সারাদিন শুধু খবর আর খবর। কোথায় কী হয়েছে বাড়ির লোকেদের সব মুখস্থ হয়ে যাবে স্যার।”

    স্যার এবার নিজেই একটু হেসে ফেললেন। তাও হাল না ছেড়ে বললেন, “সে নয় হলো। কিন্তু খবরের কাগজের সাহায্যে যে অনেক মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় তা জান না?”

    ধ্রুব একটু ভেবে নিয়ে বলল, “তা জানি স্যার। একটা খবরের কাগজ নিয়ে ওটাকে পাকিয়ে চোঙ্গা বানাতে হবে আমাদের। চানাচুরওয়ালাদের মতো। রাস্তায় দঁড়িয়ে ওতে মুখ লাগিয়ে প্রথমে একটু হো হো করে চেঁচালে অনেক লোক জমা হয়ে যাবে। তারপর চোঙাতে মুখ লাগিয়ে জোরে জোরে বললে সবাই শুনতে পাবে স্যার।”

    স্যার আর কিছু না বলে রণে ভঙ্গ দিয়ে ক্লাস ছেড়ে চলে গেলেন। ঘণ্টাও পড়ে গিয়েছিল অবশ্য। এরপর আশুবাবু আর কোনোদিন রচনা লিখতে দিতেন না, সারাংশ, সন্ধিবিচ্ছেদ এই সব করাতেন।

    ***

    গরমের ছুটি পড়ার আগের দিনটায় আমাদের ইস্কুলে খুব মজা হতো। সেদিন আমাদের স্কুল-ড্রেস না পরে এলেও চলত। কোনো ক্লাসেই পড়াশুনো হতো না। কুইজ, বোর্ডে ছবি আঁকা এসব হতো।

    শনিবার সকলে রংচঙে জামা পরে এসেছে কারণ সোমবার থেকে গরমের ছুটি। আশুবাবুর পিরিয়ড ছিল। উনি সেদিন ক্লাসে এলেন বড় একটা ব্যাগ নিয়ে। ব্যাগ থেকে প্রথমে বার করলেন একটা বড় সন্দেশের বাক্স। কড়াপাকের বড় বড় তালশাঁস সন্দেশ। সবাইকে বিলি করে দিলেন। বললেন, “তোমরা সকলেই ‘খবরের কাগজ’ নিয়ে ভালো রচনা লিখেছ এবং চেষ্টা করেছ। তার জন্য সবাইকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছি।”

    কড়াপাকের বড় বড় সন্দেশ। আমরা সবাই গপাগপ খেলাম। দারুণ ছিল।

    তারপর তিনি ধানিপটকাকে ডাকলেন। বললেন, “আমি অনেক ভেবে তোমার প্রচেষ্টাকেই ফার্স্ট প্রাইজ দিলাম!”

    বেশ মোটা একটা নতুন বই থলি থেকে বার করলেন আশুবাবু। বইটির নাম ‘কিশোর গল্প সংকলন’। আমারা সকলে খুশিতে টেবিল চাপড়ে বলে উঠলাম, “থ্রী চিয়ার্স ফর ধানিপটকা !!!” আশুবাবু ধ্রুবর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “দুষ্টুবুদ্ধিতে তোমার মাথাটা যে ভর্তি তা সকলেই জানে। আর তুমি যা রচনা লিখেছ তা লিখলে পরীক্ষায় রচনাতে শূন্য পেতে। শুধু তাই নয়, অন্য উত্তর থেকেও পরীক্ষক হয়তো রেগে গিয়ে নম্বর কেটে নিতেন। আসলে তুমিও তা ভালো করেই জানো – তুমি যথেষ্ট বুদ্ধি রাখ, কখনোই পরীক্ষায় এসব আজেবাজে লিখতে না।

    তবে ধ্রুব, তোমার মধ্যে একটা বিরল ক্ষমতা আছে। এ জিনিস লাখে বা কোটিতে দু-একজনেরই হয়তো থাকে। সবাই যা ভাবে, সবাই যা দেখে তার বাইরে তুমি নতুন কিছু ভাবতে পার। রচনার জন্য নয়, তোমার এই ক্ষমতার জন্যই তোমাকে প্রাইজ দিচ্ছি। ধ্রুব, তুমি বড় হয়ে যাই করো, যাই হও, এই ক্ষমতাটি কিন্তু ধরে রেখো। কি, মনে থাকবে তো!”

    পুরস্কার নেওয়ার আগে ধ্রুব আশুবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। আমরা সকলে উঠে দাঁড়িয়ে তাল মিলিয়ে হাততালি দিয়েছিলাম। আর আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে সে হাততালি চলেছিল অনেকক্ষণ ধরে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments