সুপির ভালো নাম সম্পূর্ণা। কিন্তু অত খটমট নামে তাকে কেউ ডাকে না, এমনকি ইস্কুলেও। তা সুপি লেখাপড়ায় ভালো। এই তো ক্লাস সেভেনে কী ভালো ভালো নম্বর পেয়েছে। ইংরাজিতে আশি, বাংলায় পঁচাত্তর, ইতিহাস, ভূগোল আর বিজ্ঞানে নব্বইয়ের ঘরে। আর অঙ্ক? ওখানেই সমস্যা। অঙ্কতে সুপি কোনদিন সুবিধে করতে পারে না। বোঝে না যে তা নয়, কিন্তু পরীক্ষায় অঙ্ক করতে গেলেই অসাবধানের ভুল অনেক হয়ে যায়। পাঁচ পনেরোয় যে পঁচাত্তর হয় তা সে জানে, কিন্তু সেবার একটা অঙ্কতে ভুল করে পঁয়ষট্টি লিখে ফেলল। ব্যাস, তারপর সরলের অঙ্ক আর মেলে! যেখানে ওপর নিচে কাটাকুটি হয়ে উত্তর হবার কথা তিন, সেখানে ওর শেষ লাইনে উত্তর এল তেরোর তেত্রিশ! দেখেই ও বুঝল কোথাও একটা ভুল হয়েছে, সেটা ভেবে আরও ঘাবড়ে গেল। পরের গোটা কয়েক অঙ্কও গুলিয়ে গেল।
ক্লাস এইটে অনেক বই, অঙ্কের বইই তিনটে। মার সঙ্গে বসে নতুন ক্লাস শুরু হবার আগের দিন সন্ধে বেলায় বইখাতায় মলাট দিচ্ছিল। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল – ট্রিং ট্রিং।
সুপির জেঠু এসেছেন। জেঠু খুব বড় কলেজের অধ্যাপক কিন্তু ভীষণ মজার মানুষ। এসেই একটা বড় চকলেটের মোড়ক বার করে বললেন, “সুপি, তুই শুনলাম এবার শেষ পর্যন্ত টায়টায় পাশ করে ক্লাশে উঠতে পেরেছিস তাই এটা তোর জন্য।”
মা বললেন, “টায়টায় নয়, ভালো নম্বরই পেয়েছে। শুধু অঙ্কটায় কোনোরকমে পাশ করেছে। এ বছর অঙ্কের জন্য বাড়িতে টিউটর রাখতে হবে।”
“অঙ্কই তো আসল! অঙ্ক না করতে পারলে অনেক রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তা সেবার তো আমার কাছে যখন অঙ্ক নিয়ে বসেছিল তখন তো দেখলাম বুঝতে-টুঝতে পারে…”
“তা হতে পারে। ওদের টীচার বলছিলেন যে কেয়ারলেস মানে অসাবধানের ভুল বড় বেশি করে। বললেন বাড়িতে আরও অনেক অনেক অঙ্ক অভ্যাস করতে হবে।”
“আমার জানা এক ভালো টিঊটার আছে, চাই তোমাদের?”
“চাই বৈকি। বাড়িতে আসতে পারবেন না কি ওনার কাছে পাঠাতে হবে?”
“উনি বাড়িতেই থাকবেন।”
মা-মেয়ে দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, “অ্যাঁ!”
ডবল ‘অ্যাঁ’ শুনে জেঠু হো হো করে হাসতে লাগলেন কিছুক্ষণ। তারপর হাসি থামলে হাত ব্যাগ থেকে একটা চকচকে ঝকঝকে কলম বার করে বললেন, “এই নে তোর অঙ্কের টিউটর। জানিস একবার হাইস্কুলে অঙ্ক পরীক্ষায় খুব লম্বা প্রশ্নপত্র দিয়েছিল। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় করছি – এমন সময় পেনের কালি আসা বন্ধ হয়ে গেল। ফুরোবার কথা নয়, সকালেই তো কালি ভরেছি। মেঝের দিকে হাত সরিয়ে দু-একবার ঝাড়তেই কালি এসে গেল। অঙ্কে মন দিলাম। কিন্তু হয়েছে কী, কালির একটা বিন্দু খাতায় পড়ে একটা সাত কে পয়েন্ট সেভেন করে দিয়েছে। তাড়াহুড়ো তো ছিলই, খেয়াল করলাম না। শেষ করেই বুঝলাম কোথাও একটা ভুল হয়েছে। কিন্তু তখন অনেক অঙ্ক বাকি, তাই ফিরে দেখার সময় নেই। ভুল হওয়া অঙ্ক, সময়ের চাপ সব মিলিয়ে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাই সেবার খুব খারাপ নম্বর এনেছিলাম--”
“তারপর?” সুপি জিগেস করল।
“তারপর সব শুনে তোর ঠাকুর্দা আমাকে একটা পেনের সেট কিনে দিলেন। একটা বাক্সে দুটো কলম – একটা কালি ভরতে হয় আর একটা বল-পয়েণ্ট। খুব দামী কলম, বিলেত থেকে আনানো…”
মা ততক্ষণ চা নিয়ে এসেছে। জেঠু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “আমি একটা জিনিস দেখলাম, বুঝলি। কলমটার ভেতর কী একটা যাদু আছে। ওটা নিয়ে যে অঙ্কই করতে যাই, ঠিক ছাড়া ভুল হয় না কখনও, কখনোই নয় …”
সুপির তেমন বিশ্বাস হলো না। বলল, “সত্যি?”
জেঠু বললেন, “হ্যাঁ রে একেবারে সত্যি। এই কলম হাতে পাওয়ার পর থেকে কোনো পরীক্ষায় কোনো অঙ্ক আমি ভুল করিনি। কী আশ্চর্য তাই না!”
সুপির তখনো বিশ্বাস হয়নি। বলল, “সে তুমি অঙ্কে ভালো তাই, কলম কি আর অঙ্ক জানে!”
জেঠু বললেন. “অতশত জানি না রে। মোটকথা এই কলমটায় যাদু আছে। এটা তোকে দিয়ে যাচ্ছি, রিফিল ভরা আছে, ফুরোলে বাবাকে বলবি ভরে দিতে। একটু দামী হয় তবে যে কোনো বড় দোকানেই পাওয়া যায়। যাক গে, কথা হচ্ছে এবার থেকে এটা নিয়ে তুই অঙ্ক পরীক্ষায় বসবি। হ্যাঁ, দেখিস রে সুপি, এই এতদিনের কলমটার সুনামটুকু যেন থাকে। কলম হলে কী হয়েছে, এর মানসম্মান বলে কি কিছু থাকতে নেই! অঙ্ক ভুল হলে এর সুনাম, মানসম্মান সব জলে ভেসে যাবে।”
জেঠু চলে গেলেন।
কদিন পরে অঙ্কের ক্লাশ টেস্ট। সুপি গেছে জ্যাঠামশায়ের কলমটা নিয়ে। প্রশ্নপত্র পেয়ে কলম বার করে প্রথম অঙ্কটা করতে যাবে এমন সময় মনে হলো কলমটা যেন কিছু একটা বলছে তাকে – শোনো, সাবধানে অঙ্ক করো। উল্টোপাল্টা ভুল করে আমার সম্মানটুকু নষ্ট কোরো না যেন। তোমার হাতে পড়ে আমার এতদিনের সুনামটা মাটি না হয়ে যায়!
সুপির মনে হলো তাই তো। এ কলমে জেঠু কোনোদিন কোনো অঙ্ক ভুল করেনি। সুপির মনটা সজাগ হয়ে রইল, পাছে কোথাও ভুল হয়ে যায়!
দুদিন পর খাতা বেরোতে গোটা ক্লাশ, বাড়িতে বাবা-মা সকলেই অবাক। পঞ্চাশে পঞ্চাশ! ফোনে জেঠুর কাছে খবর যেতে উনি বললেন, আগেই বলেছিলাম, কলমে যাদু আছে। ওরে সুপি, একটাতে তো পুরো নম্বর পেয়েছিস, কিন্তু সে আনন্দে পরের পরীক্ষায় কলমের সুনাম যেন নষ্ট না হয়!”
সেই থেকে সুপি অঙ্কতে ভালো নম্বর পেতে লাগল, পরীক্ষায় তার কোনো অঙ্কই ভুল হয় না। শক্ত অঙ্ক এলেও সে একমনে ভাবে। ওর মনে হয় কলম যখন আছে তখন রাস্তা ঠিকই বেরিয়ে যাবে। অঙ্কটা যখন প্রশ্নপত্রে দিয়েছে তখন এর সমাধান নিশ্চয় আছে – সমাধানের রাস্তা সে আজকাল নিজে নিজেই বার করে ফেলছে। কলমটা তাকে মনে করিয়ে দেয় – আমার সুনামটা রাখিস রে।
বোর্ডের পরীক্ষায় সুপি খুব ভালো ফল করল। বিশেষ করে অঙ্কতে। টিউটর ছাড়া শুধু মাত্র একটা কলমের জোরে এতখানি উন্নতি! এমন কথা কেউ কোনদিন শুনেছে?
***
এখন সুপি বি এস সি পাশ করে এম এস সি তে ভর্তি হয়েছে। প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে তাই অঙ্ক আর নেই। সেদিন সুপি তার পড়াশোনার বইএর তাক আর টেবিলটা গোছাচ্ছিল। এক পুরোনো খাতার পেছনে পড়ে থাকা জ্যাঠামশায়ের কলমটা চোখে পড়ে গেল। কলমটা তার ভারি প্রিয়, যেন তার কাছের বন্ধু। সুপি কলমটা একটা কাপড় দিয়ে মুছেটুছে টেবিলের ওপর রাখল।
ও মা! সুপির মনে হলো সেই ক্লাস এইটের অঙ্ক পরীক্ষার দিনটার মতো কলম তার সঙ্গে কথা বলছে!!
“তাহলে সুপি, তোমাকে কীরকম বছরের পর বছর অঙ্কতে ভালো ভালো নম্বর পাইয়ে দিলাম। তুমি তো অঙ্ক কিস্যু বোঝো না, হি হি...”
“কে বলেছে বুঝি না। আমিই করতাম আর বাহবা পেতে তুমি। ‘সুনাম নষ্ট হবে’, ‘সম্মান মাটিতে মিশে যাবে’ এই সব বলে চালাকি করে আমাকে দিয়ে ঠিক অঙ্ক করিয়ে নিতে। অঙ্কতো আমিই করতাম – তোমার সুনাম নষ্ট হতে পারে সেই ভয় খুব মন লাগিয়ে করতাম, এই যা।”
কথাটা বলেই সুপির মনে হলো, এই রে। বড্ড কড়া কথা বলে ফেললাম বোধ হয়। সে কলমটা নিয়ে আদর করে চুমু খেয়ে টেবিলে রাখল। এবারে কলম যেন বলে উঠল, “হুঁ, তাহলে দেখছি আমার কায়দা, আমার চালাকি সব ধরে ফেলেছ। ধরেই যখন ফেলেছ তখন তো তোমার কাছে আমার আর থাকা চলে না।”
“মানে!”
“মানে তুমি এবার ঠিক তোমার ছোটবেলার মতো কাউকে খুঁজে বার করো যে ঠিকমতো মনোযোগ দেয় না বলে অঙ্কতে কম নম্বর পায়। দেখবে সেও তোমার মতো হঠাৎ সব অঙ্ক ঠিক করে ফেলছে! তবে হ্যাঁ, গল্পটা ঠিক করে বলতে হবে কিন্তু। তা না হলে আমার সুনামটুকু আর থাকবে না, হি হি…”
তার এত প্রিয় কলমটা চলে যেতে চাইছে বলে সুপির চোখে প্রায় জল এসে পড়ল, কিন্তু তারপরেই সে বুঝলো কলম ঠিকই বলছে। অঙ্কে ভালো করতে পারছে না এমন কাউকে খুঁজে দেখতে হবে – তাকে সে দিয়েই দেবে কলমটা।