সেই আরাধ্য দেশে যাওয়ার প্রস্তাব পেলাম একদল শখের আলোকচিত্রিদের কাছ থেকে। বেড়ানো গৌণ, ছবি তোলাই উদ্দেশ্য। এঁদের বেশিরভাগ ভারতের পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকের বাসিন্দা। বঙ্গসন্তান আমরা দুজন, আমি আর আমার দীর্ঘদিনের সুহৃদ সৌমেন্দু। সে আবার আমার ক্যামেরাবাজির গুরুও বটে। ভিয়েতনাম যাওয়ার সব চেয়ে ভালো উড়ান কলকাতা থেকে। বিমানবন্দরে সব সহযাত্রীরা ঈর্ষা প্রকাশ করলেন আমাদের সৌভাগ্যে। সৌমেন্দু উত্তম রসগোল্লা খাইয়ে তাঁদের দুঃখ উপশম করলো।
আরও পূবের দিকে তাই ভিয়েতনাম আমাদের সময় থেকে ঘন্টা দেড়েক এগিয়ে। আমরা হা নয় বিমানবন্দরে যখন নামলাম সেখানে তখন নিঝুমরাত। দুটি বাস আমাদের নিয়ে গেল একটা ছোট্ট হোটেলে। দু তিন ঘন্টা ঘুমের পরেই আমাদের দিতে হবে লম্বা পাড়ি, উত্তরে সা পা-র উদ্দেশ্যে।
ভোরবেলা আমরা তেরোজন উঠলাম একটা নিচু ছাদওয়ালা মিনিবাস-এ। পরের সাতদিন আমরা একটা বড় সময় কাটাব এই বাসে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে আর আমাদের ভ্রমণ-আয়োজক ত্রা-ত্রন-ডুং ওরফে রকি-র কথা শুনে। রকি অস্ট্রেলিয়ায় অনেকদিন থেকেছে। ইংরেজি বলে ঝরঝরে। সে নিজেও দক্ষ আলোকচিত্রি। চমৎকার মানুষ। খুঁটিনাটির দিকে তার নজর। প্রথমেই সব্বাইকে দেওয়া হল একটা ছোট্ট জলের বোতল, কাঁচের। সারথি আর রকি-র মাঝখানে রয়েছে একটা বিশাল জলের ড্রাম। কাঁচের বোতলের জল ফুরিয়ে গেলেই রকি আবার সেখান থেকে ভরতি করে দিচ্ছে। প্লাস্টিক জঞ্জাল না বাড়ানোর এই পদ্ধতি আমাদের মনে ধরলো।
পথ চলেছে সাঁইসাঁই করে উত্তরে। খুব ভিড় নেই। আমেরিকানরা তো শুনি টন টন বোমা ফেলেছিল। যুদ্ধের সব ক্ষতই তো দেখছি এরা বেমালুম সারিয়ে ফেলেছে। ছোটনাগপুর-এর মত খর্বাকৃতি পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে রাস্তা। তবে আরও সবুজ।
আমাদের পাশের আসনে বসে আছেন মহারাষ্ট্র থেকে আসা এক টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষা। তাঁর নাম দুর্গেশনন্দিনী। বললেন ওঁর বাবা-র প্রিয় লেখক ছিলেন বঙ্কিম। অতীত গৌরবে আমরা দুই বঙ্গ সন্তান পুলকিত হলাম। আমাদের সামনের আসনে বসেছে সুরেশ ভিল্লা, বাড়ি তার গুজরাট। মুখে তার সবসময় অনাবিল হাসি। আর কাউকে সে গম্ভীর হতে দিচ্ছে না। আমরা দুজন বাদে সবাই প্রায় ঘোর নিরামিষাশী। তাঁরা বস্তা ভরতি করে এনেছেন নানা ভাজাভুজি, শুকনো খাবার এবং অকাতরে বিলোচ্ছেন। আমরা একটু কিন্তু কিন্তু করলে সামনের দিকে বসা মুম্বাই থেকে আসা ডাক্তার দম্পতি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস বড়ে আশ্বাস দিচ্ছেন ওষুধও তাঁরা এনেছেন যথেষ্ট। এই প্রাথমিক আলাপ পরিচয় হতে হতেই বাস থামল রাস্তার পাশের এক সুবিশাল রেস্তোরাঁয়। নানা রকমের ফল, মিষ্টি রুটি, কফি ইত্যাদি দিয়ে প্রাতঃরাশ সারা হল। ওয়াশরুম, রকি যেমনটি আশ্বাস দিয়েছিল, পরিচ্ছন্ন।
আধো ঘুমে পৌঁছে গেলাম সা পা। ছবি অভিযানের মুখড়া। ছিমছাম ছোট্ট পাহাড়ি শহর সা পা, অনেকটা সিমলা গোছের। তবে অত উঁচু নয়, অত ঠান্ডাও নেই। শহরের মাঝখানে একটা বড় লেক। আমাদের হোটেল লেকের কাছেই। একটু হেঁটে একটা মোড় ঘুরলেই একটা নিরিবিলি চার্চ। তার ছায়ায় বসে হাস্যময়ী মেয়েরা হস্তশিল্পের টুকিটাকি বিক্রি করছে। রাত্তিরবেলা আরও সুন্দরী সা পা। কিন্তু রকি আমাদের নিয়ে যেতে চায় পাহাড়ি গ্রামের গহিনে।