(ভোর রাতে ঠিক যখন বারান্দা ঘেঁষে ওঠা টিকোমা গাছে পাখির অস্পষ্ট কিচিমিচি হতে শুরু হয়েছে, তুতুন ঘুম ঘুম স্বরে বললে, ‘মা আমরা বেশ যাত্রা দলের লোক—।’ ‘তা বেশ তো, কোথায় পালা করতে যাব আমরা?’ ‘ কেন? খড়্গপুরের প্রেম বাজারে, তাপ্পরে ঝাড়গ্রামে, কেশিয়াড়ীতে, ভসরাঘাটে—’ খড়্গপুরে থাকাকালীন যা যা জেনেছে আউড়ে গেল-- আমিও একটা লেখার ছক পেয়ে গেলাম।)
শীতের আমেজ বাতাসে, ভোরের কুয়াসায় চারদিকে নীলচে সবুজ আভা। সেই আধো আলোয় কোমরে দা গুঁজে খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি ঝোলাতে চলেছে রস সদাগর। দূ-উ-উ-উ-রে দেখা যায় বাঁশিআলা চাঁদ মহম্মদ চলেছে বাঁশির গোছা কাঁধে। তার বাঁশির মন-কাড়া সুর মাঠঘাট ছাপিয়ে যাচ্ছে। কেন জানি না ও বরাবর ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই কোনো দেশে সাকিন নাই--’ বাজাতেই ভালোবাসে। জিগালে বলে ‘বলতো লালন কি জাত?’, বলেই গায় ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে--’। খানিক পরে যায় ঢোলা জামা-পরা রাম দাদু গোলাপি বুড়ির চুল বেচতে, টিং টিইইং ঘণ্টি বাজিয়ে।
বহুবারের দেখা এসব, তবু ভোর বেলা একখান পুরোনো কাঁথা গায়ে দাঁতন চিবুতে চিবুতে নকুল অধিকারীর রোজই দেখতে বেশ লাগে, যেন নতুন নতুন ঠেকে। সে আনমনে দাঁতন মুখেই উদ্ধব গোঁসাইকে শুধালে, ‘কি গোঁসাই, ঝাঁপি খুলবা নাকি? মনডা ক্যাবল যাই যাই করতাসে; মনে শুনছি যাত্রা গানের বাঁশি। চোখে ভাসতেছে খোলা মঞ্চর সাদা হ্যাজাক বাতি আর মঞ্চ ঘিইর্যা চাদর মুড়ি দেওয়া মগন মানুষজনের ভিড়।’ উদ্ধব সিকিটাক বিড়িটায় সুখটান দিয়ে ফিক করে হেসে বললে, ‘পাশাপাশি শুই বইল্যা কি একরকম ভাবি না কি বলতো?’ তা মন্দ বলিস নাই, যা পান্তোটা খায়ে বাক্স খুলে দ্যাখ দেখি রং তুলি, পরচুলা গোঁফ, সিলিকের জ্যাকিট ধুতি, তলোয়ার গদা কী আছে? সামনেই হাটবার, শ্যাম ঠাকুরের দোকানে তা’লে একবার ঢুঁ মারতি হয়।’
নকুল আনন্দে মাটির উঠানে এক পাক নেচে, দুটো কাঁচা লঙ্কা গাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে গেল পান্তা বাড়তে। ঘরে দুটো কাঁসি, একটা কাঁসার অন্যটা কলাই করা। কেউ বলেনি তবুও নকুল ভক্তি করে উদ্ধবকেই কাঁসার থালটাই বরাবর এগিয়ে দেয়। সাথে থাকে ঘুঁসি মেরে দু-টুকরা করা কাঁচা পেঁয়াজ।
এমনিতে ওদের দেখলে খেতমজুর ছাড়া কিছু মনে হয় না। আর সম্বৎসর তো ওরা ওই কাজই করে। রোপাইয়ের সময় ধানটা, কলাইটা খেত মালিকের জমিতে রোপণ করে। হেমন্তে পাকা ফসল কেটে মাড়াই করে মালিকের গোলায় তুলে দেয়। বদলে পায় ক পালি ধান আর কটা টেকা, তাইতেই খুশি। নিজেদের ঢেঁকিশালেই ধান কুটে নেয়। পিছনের ছোট সব্জি খেত থেকে এনে রাঁধে কুমড়ো পালঙের লাবড়া, আর সাথে লঙ্কা লেবু; তাতেই পরমানন্দ।
দুগ্গো পুজোয় ওরা ঢাক কাঁসি নিয়ে শহরে যায় বইকি, কিন্তু আসল রূপ খোলে শীতের কটা মাসে। তখন যেন পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুন কেউ বেরিয়ে আসে। নকুলের একটু ফর্সাটে গোলগাল চেহারা, ও সাজে মা সীতা কখনো বা বেউলা সতী। জানকীর দুখভরা মুখ বা লক্ষ্মীন্দরকে বাঁচাতে বেউলার পাগলপারা নাচ দেখে চার চারটে গেরামের লোক চোখের জল রুধতে পারে না, আর উদ্ধবের রাবণ সাজে সীতাহরণ দেখে কে বলবে এই সেই চেনাজানা লুঙ্গি পরা একটু ঝুঁকে পড়া উদ্ধব গোঁসাই।
এবার অবশ্য চোখের জলটলে নকুলের বিশেষ সায় নাই। চারদিকেই তো ঠকে যাওয়া মাইনষের হায় হায়, কোথায় সুবিচার? তাই থাক ওসব, নেচে কুঁদে যদি একটু হাসা যায় ক্যামন হয়! মণি টুনি, মা মাসি বুড়োদাদু সবাইকে হাসাতে হবে-- ভাবতে বসে নকুল।
নকুলের ভাবনাচিন্তার পর এইরকম একটা ছোটখাটো নাটিকা দাঁড়ালঃ
মঞ্চটা হ’ল কেশিয়াড়ীর সর্বমঙ্গলার নাটমন্দির।
হ্যাজাক আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেল শ্রীভগবানবেশী উদ্ধব খানিক রং চটে যাওয়া নীল ব্রোকেড ঢাকা কাঠের চেয়ারে উবু হয়ে বসে ঘুমে ঢুলে ঢুলে চমকে চোখ খুলছেন আবার ঝিমুচ্ছেন। দুপাশে বাহারে পাখা ধরা পাখাধারী।
ঝমঝম করে করতাল বাজল। ক্ল্যারিওনেট বাঁশি আর হারমোনিয়ামের কালোয়াতি সুরে দর্শকের মাঝ দিয়েই খানিক ছুটে মঞ্চে ঢুকল নাদুসনুদুস ভুঁড়িধারী গোপাল ভাঁড়রূপী নকুল। সে ঢোকামাত্র চারপাশের দর্শক হো হো করে হেসে উঠল, চ্যাংড়া ছেলের দল দু আঙ্গুল মুখে পুরে খানিক সিটিও মেরে দিলে।
গোপাল শ্রীভগবানকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললে ‘এজ্ঞে আমি গোপাল—।’ দুপুরের ভাত ঘুমটা কেঁচে যাওয়াতে শ্রীভগবান ভুরু কুঁচকিয়ে বললেন, ‘তা এখেনে এলে ক্যামনে?’ গোপাল হাত জুড়ে বল্লে, ‘প্রভু, আমাদের বিজ্ঞানীর ম্যাজিক চপ্পল পরে উড়ে এসেছি। আপনের লেগে এনেছি সুগন্ধী নস্যি, একবার নাকে নিন, তারপর জমিয়ে শুনুন আসার কারণ।’
শ্রীভগবানের মুখ দেখে মনে হ’ল কিছু না বললেও খুশিই হলেন। এক টিপ দু নাকে নিয়ে হ্যাঁচ্চো রবে যেন মাথাটা ছাড়ল। বললেন, ‘এবার বলো।’
গোপাল করজোড়ে বললে, ‘প্রভু বহু দূর হতে আসছি। একটু বসব কি? আর, এক ঘটি জল, সঙ্গে চারটে বাতাসা হলে গলাটাও ভিজতো এই আর কি।’
শ্রীভগবান দ্বারীকে জলপানের হুকুম করে সিধে হয়ে বসলেন--।
গোপাল বাতাসা কটা মুখে ফেলে গলায় জল ঢেলে বলতে শুরু করল: ‘হে দেব, সারা পৃথিবীটা তো ঠগে ঠগে উচ্ছনে গ্যাছে, সামনেই ভোট, মানুষজন ভেবে সারা কাকে ভোট দিলে সুদিন আসবে, আপনি কিছু না করলে তো আর কিছু বাঁচে না,---।’
ভগবান খানিক চোখ বুঁজে মাথা চুলকিয়ে বললেন, ‘আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না; মানুষ জাতিকে আমি বিচারবুদ্ধি দিয়েছি—ভালোমন্দের বিচার যদি সে না করতে পারে—'
গোপাল বলে, ‘ঠাকুর ভালোমন্দের বিচার জানলে কি হবে, ভালোকে ভালো বলার সাহস কই? মন্দকে মন্দ বলার জো নেই, মেরে-ধরে বাস্তুছাড়া করে দিচ্ছে--’।
‘ও বাপু তুমিই ঠিক করো, তোমার তো ভারি জম্পেশ মাথা।’—ঠাকুরের অগাধ বিশ্বাস গোপালের ওপর।
গোপাল মুচকে হেসে বললে, ‘বেশ, সগ্গে যখন এসেছি, ঊর্বশী ঠাকরণের নাচ তো দেখে যাই, এমন বেড়ে বাগান, এট্টু বেড়িয়ে নিই-- কটা রসাল ফল চেখে দেখি--তারপর না হয়--।’
ভোটের দিন সকালে ভালোই ভোট পড়ল। দুপুরে সব কিছু খানিক ঝিমিয়ে পড়তে দেখা গেল ভোট অফিসারদের কানে কানে কিছু বলে গোপাল ভোটবাক্সের গায়ে লাল সবুজ কী গুঁড়ো যেন মাখিয়ে দিলে। তার কিছু পরেই কটা ষণ্ডা অফিসারদের হাত বেঁধে যেই ভোটবাক্স ওঠাতে গ্যাছে অমনি ‘বাবা গো, মাগো, চোখ জ্বলে গেল, হাত ফুলে ঢোল হল যে, কেটে পড়ি রে—’! আর কেটে পড়া! হুইসেল বেজে উঠল, কালো ভ্যানে কোমরে দড়ি পরে সারি দিয়ে সব শ্রীঘরের হাওয়া খেতে গেল।
গোপাল পিপুল গাছের আড়াল থেকে সব দেখলে। মনে হ’ল আকাশ থেকে ফুলের মত কিছু ওর মাথায় এসে পড়ল---।
সগ্গে শ্রীভগবান মিচকি হেসে ঝিমুতে শুরু করে দিলেন। নাটকে অন্তত দুষ্টের দমন দেখে মার খাওয়া গরিবগুর্বো তো মহা খুশি। গোপালবেশী নকুল আর শ্রীভগবানকে হেঁটে নামতে হ’ল না মঞ্চ থেকে। হলুদ গাঁদার মালা পরে ভিড়ের মাথায় চড়েই ওরা নাটমন্দির পার হ’ল। চাঁদনি রাতে এবড়োখেবড়ো মেঠো আল ধরে সাইকেল চেপে যেতে যেতে নকুল উদ্ধবকে শুধোলে—'কি গোঁসাই আজ কচি পাঁঠার ঝোল দিয়ে গরম ভাত তো?’
গল্প শুনে তুতুন ফিক করে হেসে বললে, ‘আমি কিন্ত নকুল আর তুমি উদ্ধব গোঁসাই।’