আমার বাবারা তিন ভাই। আমার বাবা বড়। বাবা রেলে চাকরি করে। আমার সেজো কাকা আমাদেরই পাশের গ্রামের একটি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করে। ছোট কাকার সোনা-রূপার দোকান। কেবল মেজো কাকুর কোনও কাজ নেই।
আমরা ছোট থেকেই দেখে আসছি মেজো কাকুকে বাড়িতে বসে থাকতে। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে আমার বাবা অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেত। ছোট কাকা বেরোতো সকাল আট-টায়। আর সেজো কাকু বেরোতো বেলা সাড়ে দশটায়, যেহেতু ইস্কুল পাশেই। সাইকেলে যেতে মিনিট পনের-কুড়ি সময় লাগে।
সবাই যখন কাজে চলে গেল, বাড়িটা ফাঁকা ও নিঝুম হয়ে গেল। মা-কাকিমারা ভোরে উঠেই মুখটুখ ধুয়ে নিয়ে, উনানে আঁচ দিত। চা, জলখাবার, ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ বা ডিম—ঝটপট করে রান্না করে ফেলত। কারণ বাবা খেতে বসবে সাতটায়। সঙ্গে টিফিনও নিয়ে যাবে। ছোট কাকা রুটি-তরকারি খেয়ে দোকানে যেত, দুপুরে ফিরে এসে ভাত খেত। কিন্তু যাই হোক না কেন, রান্না সাতটার মধ্যে কমপ্লিট হওয়া চাই। ফলে মা-কাকিমারা দম ফেলার ফুরসত পেত না।
তারপরে? সকলে কাজে বেরিয়ে গেলে, মা-কাকিমারা রকের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে, সামনে পা ছড়িয়ে বসে দম নিত। কেউ ঢক ঢক করে জল খেত, কেউ বলত, আর এক কাপ করে চা হলে ভালো হয়। তখন মা হাঁক দিত, ও মেজো ঠাকুরপো—
তখনই মেজো কাকু নিজের ঘরটা থেকে বের হত। সকালেই চা খাওয়া হয়ে যেত মেজো কাকুর। আর চা খাবার আগে, খুব ভোরে উঠোন ঝাঁট দিয়েছে। মাঠে গিয়ে আমাদের জমিগুলো একবার দেখে এসেছে। গোলঘর পরিষ্কার করে, গরুকে জাব দেওয়া হয়ে গেছে। হাঁসগুলোকে ছেড়ে দিয়ে এসেছে কামারদের পুকুরে। এইসব কাজ নিঃশব্দে করে কখন ঘরে এসে সেঁধিয়েছে কাকু, কেউই তা খেয়াল করত না। কিন্তু কাজগুলি হয়ে যেত ঠিকঠাক সময় মতন।
বাবা-কাকারা সকলে বেরিয়ে গেলে, যেন মায়ের এই হাঁকটার জন্যে অপেক্ষা করত মেজো কাকু। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসত ঘরটি ছেড়ে। আর উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে, দো-ফলা আমগাছের নীচে এক মুঠো মুড়ি রেখে বলত, আয় তারা, আয়। কই গেলি রে?
‘তারা’ আর কেউ নয় মেজো কাকুর পোষা এক শালিক পাখি। পোষা মানে তাকে যে খাঁচায় বন্দি রাখা হয়েছে, তা নয়। সে ছাড়াই থাকে। বনের পাখি। তবে সে আমাদের বাড়ি ছেড়ে যায় না। আর গেলেও পাড়ার মধ্যেই থাকে। এ-বাড়ি, ও-গাছ ঘোরে-ফেরে। তারপরে দুপুরে, খিদে পেলে, ফিরে আসে। মেজো কাকুর হাত থেকে খাবার তুলে নিয়ে খায়।
কেবল তারা নয়, আমাদের বাড়িতে ঠিক অমনি করে একটা বিড়াল ও কুকুর থাকে। এরাও আমাদের কেউ নয়। তবুও তারা আমাদের হয়ে গেছে। বিড়াল ইতিউতি ঘোরে, আর খাবার সময় হলেই আমগাছের নীচে যেখানে পুরানো মালসা-হাঁড়ি রাখা থাকে, সেখানে থাবা গেড়ে বসে থাকে। দুপুরে খাওয়া হয় আর ও বলতে থাকে ম্যাও-ম্যাও। কাকু বিড়ালের নাম দিয়েছিল, ‘মন্টু’। আর কুকুরের নাম- ‘ঘন্টু’।
বাবা-কাকারা যতক্ষণ বাড়িতে থাকত, আমরা কেউই মেজো কাকুর ছায়াকেও বাড়ির মধ্যে ঘুরপাক খেতে দেখতাম না। কাকুর ঘর থেকে কোনোরকম আওয়াজও আসত না।
দুপুরে খেতে বসে আমরা কখনই কাকুকে খাবার নিয়ে কোনও অভিযোগ-অনুযোগ করতে শুনিনি। খাবার কম পড়লেও মুখ ফুটে কোনোদিন চাইতও না। যা পাতে পড়ত, তাই খেয়ে নিঃশব্দে কাকুকে উঠে যেতে দেখতাম। আমরা, ভাইবোনেরা, তখন ভাবতাম মেজো কাকু কম খায়।
অথচ, মেজো কাকু কী না করত আমাদের জন্য! ছোটবেলায় আমাদের প্রত্যেককে স্নান করানো, গা মোছানো, সাইকেল চাপিয়ে স্কুলে দিয়ে আসা-নিয়ে আসা। বই-খাতায় সুন্দর করে মলাট দেওয়ার কাজ করত। খেলার মাঠ থেকে সন্ধেবেলা আমাদেরকে ধরে আনা। আবার কখনও আমাদের সকলকে নিয়ে, ছিপ ফেলতে পুকুর পাড়ে বসে যাওয়া। কিংবা বাঘাটিতে যাত্রা দেখতে নিয়ে যাওয়া। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমাদের গ্রামের এমেচার যাত্রাপালায় মেজো কাকু অভিনয় করত। প্রতি সন্ধেবেলা মেজো কাকু আমাদের সকলকে নিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াতে বসত। গল্প বলত।
আমরা বলতাম, কাকু, তুমি চাকরি করো না কেন?
কাকু একটা শ্বাস ফেলে বলত, হল নারে!
হল না কেন?
একবার একটা দরখাস্ত করেছিলাম, বুঝলি। পোস্টাপিসে। কিন্তু পরে পোস্টটা গরমেন্ট তুলে দেয়। ফলে আমার আর চাকরি করা হল না।
ক্রমে আমরা বড় হয়ে গেলাম। তখন বাবা-কাকার কাছে শুনেছিলাম, মেজো কাকু নাকি ছোট থেকেই খুব কুঁড়ে। ফলে না-হল চাকরি, না-হল ব্যবসা, না-হল সংসার। বাবা বলে, আসলে মেজোর মধ্যে কোনও উচ্চাশা ছিল না। ফলে জীবনে কিছুই করতে পারল না।
এখন আর মেজো কাকুকে আমাদের দরকার হয় না। আমরা বাইরে টিউশনি পড়তে যাই। নতুন স্কুল, নবতম বন্ধুবান্ধব—আমাদের সেই ছোটবেলার জীবন থেকে মেজো কাকু কেমন যেন নীরবে, নিঃশব্দে সরে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে স্কুল বা টিউশনি ফেরত আমরা মেজো কাকুকে দেখতাম। মাঠের ধারে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছে। আমরা মাঝে মাঝে সাইকেল থামাতাম। বলতাম, মেজো কাকু, সন্ধে হয়ে এল, বাড়ি ফিরবে না?
অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মেজো কাকু কেমন যেন চমকে যেত। বলত, এই যাই।
বা শুনতাম, সন্ধের সময় মেজো কাকু এখন আর ঘরের মধ্যে থাকে না। পাশের সরকার পাড়ায় হরিনামের দল আছে একটা। সেখানে বসে বসে কাকু খোল বাজায়। কেত্তন করে।
শারীরিকভাবে কাকু ছিল দুর্বল। তবুও দেখতাম, কিষাণ যখন কাটা ধান জমি থেকে মাথায় তুলছে, মেজো কাকু হাত লাগাচ্ছে। কাকে ধান বেচা হল, কত ধান গলায় উঠল—সব হিসেব সন্ধেতে বাবাকে বুঝিয়ে কেমন যেন ঝাড়া-হাত-পা হয়ে যেত মেজো কাকু। নীরবে নেমে যেত দুয়ার থেকে। উঠোন পেরিয়ে চলে যেত নিজের সেই একটেরে ঘরের দিকে।
এইভাবেই চলছিল। কিন্তু এমন একটা সময় এল, যখন আমরা আবিষ্কার করলাম, আমাদের সকলের কাছ থেকে মেজো কাকু কবেই মুছে গেছে। বাড়িতে যে একটা মানুষ আছে, সেটা যেন আমরা ক্রমে বিস্মৃত হচ্ছিলাম।
এরপরে আরও দিন গেল। আমাদের কেউ চাকরি পেল, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেল। বাবা-কাকা অবসর নিয়েছে। ছোট কাকা নিজে আর দোকানে তেমন যায় না, তার বড় ছেলে দীপক এখন দোকানে বসে। বাড়িতে সকলেই থাকে এখন। কিন্তু তবুও বাড়ি আজ আর গমগম করে না। দিনের কাজকর্ম এখন অনেক বেলাতেই শুরু হয়।
এমনি করেই দিন চলছিল।
আমি ব্যঙ্গালোরে থাকি এখন। আইটি সেক্টরে কাজ করি। ছুটির দিনে বাড়িতে ফোন করি। মা-বাবার সঙ্গে, সেজো কাকা, কাকিমাদের সঙ্গে কথা হয়, বাড়ির অন্যদের সঙ্গেও কথা হয়; কিন্তু কোনোদিন মনেই হয়নি মেজো কাকুর সঙ্গে একটু কথা বলি। বরাবরই মনে হয়েছে, মেজো কাকু উঠোনের অন্যপ্রান্তে থাকে, সেখানে কে আর ফোন নিয়ে যাবে। মেজো কাকুর নিজস্ব কোনও ফোন নেই। আমরাও কিনে দিইনি।
একদিন নাইট ডিউটির মাঝে ভুতো ফোন করল। ভুতো সেজো কাকুর বড় ছেলে। ও বাড়িতেই থাকে। এখন মাস্টার্স করছে। এত রাত্রে ফোন যখন, নিশ্চয় কিছু এমার্জেন্সি। ফোন তুলে বললাম, বল।
ও বলল, নীলুদা, মেজো কাকুর শরীর খারাপ। সম্ভবত হার্ট এট্যার্ক। স্থানীয় হাসপাতাল কলকাতার হাসপাতালে রেফার করেছে। আমরা একটা এম্বুল্যান্সে করে কাকুকে নিয়ে পিজি যাচ্ছি।
যা। ডাক্তার কী বললে, আমাকে জানাস।
বলে ফোন কেটে দিলাম। তারপরে কী মনে হল, ঘুরিয়ে ভুতোকে আবার ফোন করলাম। ফোন ধরে ভুতো বলল, বলো দাদা।
বললাম, শোন ভুতো। কাকুকে কলকাতার কোনও সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিস না।
তাহলে!
কলকাতার সেরা হার্টের নার্সিংহোমে নিয়ে যা কাকুকে। সব খরচ আমার।
আর তুমি?
ফ্লাইট ধরে কাল সকালেই আমি কলকাতা পৌঁছে যাচ্ছি।
আচ্ছা। তুমি যা বলবে।
বললাম বটে, তবে কলকাতা পৌঁছতে বিকেল পার হয়ে গেল। ততক্ষণে মেজো কাকুর অপারেশন সারা। বুকে স্টেন্ট বসেছে। কাকুর শরীর যে ভেতরে ভেতরে এত খারাপ, আমরা কেউই জানতাম না। কাকু নিজেও কাউকে কিছু বলেনি।
জ্ঞান আসার পরে কাকু খুব অবাক হয়ে গেল। দামি ঘর, দামি পর্দার হাসপাতাল । মাথার কাছে ডাক্তার দাঁড়িয়ে, নার্স ছুটোছুটি করছে। কোনোক্রমে, ইশারায়, হাত নেড়ে বললে, এত খরচ করলি কেন? সরকারি হাসপাতালই ভালো ছিল।
আমি বললাম, সারাজীবন তুমি আমাদের জন্যে অনেক কিছু করেছ। ছুটির দিনের দুপুরে আমাদের কত গল্প বলেছ। পড়িয়েছ। আরও কত কিছু করেছ, সব আমাদের মনে নেই। তবে জানি, নিজের জীবনটা তুমি আমাদের জন্য বিলিয়ে দিয়েছ। সে তুলনায় আমরা কী-ই বা ফিরিয়ে দিতে পেরেছি তোমায়? তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে চলো।
দেখি মেজো কাকু কাঁদছে।
বাড়ি ফিরে মেজো কাকুর জন্য একজন ট্রেন্ড আয়া রাখা হল। মা বললে, মেজো ঠাকুরপো, এতদিন এই পরিবারের জন্য তুমি অনেক কিছু নীরবে করে গেছ, আজ তা আমাদের ফেরত দেবার পালা।
এখন আর মেজো কাকু ঠিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারে না। উঠোনের মধ্যে চলাচল সীমাবদ্ধ। আয়া তার হাত ধরে থাকে।
সেই শালিক, সে তো কবেই মরে গেছে। কতদিন হয়ে গেল! এখন মেজো কাকুর কাছে এক কাঠবেড়ালি আসে। মেজো কাকুর হাত থেকে সে বিস্কুটের টুকরো তুলে নেয়। মেজো কাকু কাঠবেড়ালির নাম দিয়েছে--সাহেব।