মাস দেড়েকের মধ্যে আমার বান্ধবী দিল্লী থেকে পালাচ্ছে। যবে থেকে তার চণ্ডীগড়ের কলেজে অ্যাডমিশানের খবর পেয়েছি, আমি উপরে খুব স্বাভাবিক দেখালেও, ভিতরে ততটা ছিলাম না। পম্পা মুখার্জি অবশ্য উৎফুল্ল মুডে আছে সবসময়। তার কতটা ভান আর কতটা নতুন কলেজে যাওয়ার উদ্দীপনা সেটা সে আমাকে বুঝতে দিচ্ছিল না।
আমাদের সেই শেষ গ্রীষ্মাবকাশে সমস্ত কাজ আর বন্ধু-বান্ধবদের সাহচর্য বাতিল করে পরের কয়েকটা দিন সারাবেলার জন্য পম্পা আমার পথের সঙ্গী হয়ে যায়। আমরা চাণক্যপুরীতে গিয়ে একটা হলিউডের কমেডি সিনেমাও দেখে এলাম। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মামিমার তোষকের তলা থেকে সরানো একশো টাকার নোটটা ফেরত দিয়েছিলাম। সেটা পরের দিনই আবার না বলে ধার নিতে হল।
আমরা দুজন তখন রেসকোর্স হয়ে, তিন মূর্তি ভবন থেকে সাউথ ব্লক পর্যন্ত নিউ দিল্লীর নির্জন ও চওড়া রাস্তায় কালোজাম আর অর্জুন গাছের ছায়ায় হেঁটে যেতাম। আমার বান্ধবীর মাথার উপরে ভাসত জাপানী স্টিলের ছাতা, যার তলায় আমাকেও ঢোকাবার জন্য সে আমার গা ঘেঁষে হাঁটত। আমরা ভবিষ্যত নিয়ে কোনো আলোচনা করতাম না। অতীত বলতে ছিল মাত্র কয়েকটা দুপুর, যেগুলো আমরা পম্পা ঘরে বসে আকাশবাণীর গান শুনে কাটিয়ে দিয়েছি। তাই আমাদের কথা হত একটুর জন্য যা ঘটেনি সেই অগণিত সম্ভাবনাদের নিয়ে। রাস্তা থেকে কেনা কালোজাম খেতে খেতে পম্পা মুখার্জিকে বলতে শুনতাম – ধর যদি আমাদের দেখা না হত? ভাবা কী কঠিন, তাই না? কোনোদিন আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তবেই এই প্রশ্নটার ঠিক উত্তর খুঁজে পাবি।
আমি ভাবতাম – কী উৎকট এই মেয়েটার চিন্তার খেই! এবার আমার নিশ্চয়ই মনে হবে এই লুত্যেনের দিল্লী যদি আধখানা তৈরি হয়ে থেমে যেত! বা যদি এই বিরাট লাল পাথরের চাঁইগুলো রয়ে যেত পাহাড়ের ভিতর? হয়তো আমি হতাম গালিবের প্রিয় কোনো শুঁড়িখানার ছোকরা চাকর, আর পম্পা হত কোনো মোঘল বাঈজীর মেয়ে। এমন দুনিয়া রয়েছে যেখানে আমাদের দেখা হয়নি, বা হতে হতেও হল না, বা হবার পর বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।
একসঙ্গে যখন একটা স্টিলের ছাতার তলায় হাঁটছি, তখনও আমরা জানতাম সেই অশরীরী জগতগুলো আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না।
ওয়েলিংডন ক্রেসেন্টে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরির তৈরি ডাণ্ডী মার্চের বিরাট এগারোটা মূর্তি দেখার পর হঠাৎ দিল্লীপ্রেমে ব্যাকুল মুহ্তরমাটি বায়না ধরেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে বসানো রামকিঙ্কর বৈজের যক্ষ আর যক্ষিণীর মূর্তিদুটোও দেখে যাবে। এই গরমে আবার অতদূর যেতে হবে শুনে আমি তাকে কাছাকাছি কোথাও বসে কোল্ড কফি খাওয়ার লোভ দেখাতে লাগলাম। অবশ্য দুজনেরই ভাগ্য ভালো, একটা বাস এসে হাজির। সেটাতে করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে এসে নামার পর আমি আঙুল তুলে মূর্তিদুটো দেখাতে যাচ্ছিলাম। পম্পা আমাকে চাপা গলায় বকে দেয়। - আঙুল দেখাস না অসভ্য ছেলে। সে আর কিছু না বললেও আমি বুঝেছি কেন। রামকিঙ্করের অতিকায় যক্ষিণীর প্রাইভেট পার্ট্স্ সদম্ভে দৃশ্যমান। দিল্লীর বাইরে থেকে যারা আসে তারা হাঁ করে চেয়ে থাকে। শুনেছিলাম দেশের কর্ণধাররা আমাদের এই লজ্জার হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল নেহেরুজীর ভারত, যক্ষিণী বেঁচে যায়।
আমার আদবওয়ালী সঙ্গিনীর নির্দেশ অনুযায়ী তার সঙ্গে উলটোদিকের ফুটপাথ দিয়ে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে চার পাঁচবার আসা যাওয়া করলাম। বহুদিন আগে আমাদের ইস্কুলের মহেন্দ্রবাবু পার্লামেন্ট হাউস ট্যুরের সময় দূর থেকে এই দানবের মতো মূর্তিদুটো দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ভালো করে দেখে নাও, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমস্ত সোনা এদের ভিতর লুকোনো আছে’। তারপর থেকে আমরা সেটাই বিশ্বাস করতাম। পম্পাকে বললাম – টোটোদা আর আমি ছেলেবেলা থেকে ঠিক করে রেখেছি একদিন এই যক্ষটাকে চুরি করব।
- যক্ষিণীটাকে নয় কেন? সে অমনি জিজ্ঞেস করে।
আমি বললাম - যুক্তি অনুসারে দুটোকেই নেওয়া উচিত। কিন্তু টোটোদার ইচ্ছে খুসরো, মীর, গালিবের এই শহরে মানুষকে তার ব্যর্থতা আর নশ্বরতার কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য রামকিঙ্করের অন্তত একটা পাহাড়ের মতো অচল মূর্তি থাকুক। আমরা দুজনেই ভাবতাম যক্ষিণীটাকে দেখতে অনেক ভালো। এই টেকো যক্ষটা আমাদের কারোই তেমন পছন্দ হত না।
পম্পা প্রথমে বলেছিল – উফ্, টোটোর যে কী চাল মারার স্বভাব! ওকে তোর গুরুঠাকুর বানাস না জয়। কিন্তু পরে কনট প্লেসের দিকে যাওয়ার পথে সে স্বীকার করে যক্ষিণীর পাশে যক্ষকে একদম মানাচ্ছে না। - মনে হচ্ছে বেচারার কাকু, বা স্কুলমাস্টার। মুখও কী প্রচণ্ড ব্যাজার! বলল সে।
আমি বললাম - মামাবাড়িতে সবাই বলে রামকিঙ্কর আগে যক্ষকে বানিয়েছিলেন। তারপর তার চোখের সামনে যক্ষিণীর সারা গায়ে ছেনি দিয়ে অসম্ভব যত্নের সঙ্গে একটা একটা করে ত্রুটি মুছে দেবার কাজ শুরু হয়। ঘর্মাক্ত কলেবরে মাস্টার শিল্পী সারারাত ধরে তন্ময় হয়ে কাজ করে যেতেন। তিনি লক্ষ করেননি যক্ষের মুখ থেকে ক্রমশ হাসি মুছে যাচ্ছে। কারণ সে বুঝতে পারছিল এই যক্ষিণীকে তার জন্য নয়, পৃথিবীর সবার জন্য বানানো হচ্ছে। যক্ষিণীর মধ্যে এত মানুষের কৌতূহল আর দীর্ঘশ্বাস এসে জড়ো হবে যে সে তাকে কোনোদিনও নিজের করে নিতে পারবে না। লোকে বলে পরে যখন মূর্তিদুটোকে পাশাপাশি বসানো হয় তখন সবার সঙ্গে রামকিঙ্করও বিস্মিত হয়ে দেখেছিলেন এই কদিনে যক্ষের বয়স যেন দু-কুড়ি বছর বেড়ে গেছে। - এটা আপনি কী করলেন, মাস্টরজী? পণ্ডিত নেহেরু পর্যন্ত অনুযোগ করেন। বেচারা রামকিঙ্কর ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিলেন। কোনো জবাব নেই।
হতবাক বান্ধবীর বিস্ময় উপচে পড়া মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আমি তাড়াতাড়ি যোগ করলাম - বিশ্বাস করো, এসব আমার বড়মামার নিজের চোখে দেখা। যাহোক, টোটোদা আর আমি ঠিক করেছি বুড়ো যক্ষটাকে ভেঙে তার ভিতর থেকে সব সোনা বার করে নেব।
- ওঃ মাই প্রভু-উ-উ-উ! কী ভেজাল মাল! কী ভেজাল মাল! নেহেরুকে অবধি ফ্যামিলির গল্পে ঢুকিয়েছিস তোরা!! আর কত বানাবি? উঃ! পম্পা উচ্চগ্রামে আমার মামাবাড়ির ইতিহাসকে নস্যাৎ করতে করতে চলল।
নেহেরুভিয়ান আমলের পুরোনো খবরেই যদি এই অবস্থা হয় তো সে যখন শিমলাতে বেড়াচ্ছিল তখন দিল্লীতে আমি যে নতুন কীর্তির ক্ষেত চষেছি সেই বিপর্যয়ের বিবরণ দিলে কী হবে? চিন্তা হয়ে গেল। কতটা বলা উচিত তাও বুঝতে পারছি না। অন্তত ডক্টর বাজাজ আমাকে যেভাবে একটা এক্সপেরিমেন্টের ইঁদুরের মতো খাঁচায় পোরার চেষ্টা করেছেন সেটা জানানো দরকার। তারাবাঈ কাহার আর তার সন্দেহজনক বালকবর ভীমার সঙ্গে সদ্য আরম্ভ করা হাফ-লিগাল বিজনেসটারও একটু আভাস দেওয়া উচিত। পরে অন্যদের মুখে নিন্দে শোনার আগে আমার কাছে জেনে রাখা ভালো।
পম্পাকে বললাম – আমি একটা সত্যিকারের যক্ষ আর যক্ষিণীকে চিনি। তাদের কাছে হাত পাতলে তারা সোনা বের করে দেয়। তাদের মধ্যেও যক্ষিণীটাকে যক্ষের চেয়ে অনেক ভালো দেখতে। আমার মনে হয়, এটাই যক্ষদের নিয়ম।
– আবার শুরু! এই যে তিন সপ্তাহ পাহাড়ে ছিলাম, সবচেয়ে বেশি কী মিস্ করেছি বল তো?
- কী?
- তোর গুল! বলে পম্পা নিজেই হা হা হি হি করে অনেকটা হাসার পর বলল – মাইণ্ড করলি না তো?
আমি তাকে বললাম – তুমি যদি মাইণ্ড না করো, কফি খেতে খেতে আরো কিছু শোনাই তবে আজ।
হেঁটে কনট প্লেসের দিকে যাওয়ার পথে চড়া রোদ্দুর পেরিয়ে যখন প্রকাণ্ড এক একটা নীম, অশ্বত্থ, বা কালোজাম গাছের ছাতার নিচে আশ্রয় নিচ্ছিলাম তখন আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে এবং একজন অন্যজনকে দেখতে পাচ্ছি না। নিজেদের একটা অন্য জগতের প্রাণীর মতো আলো আর ছায়ার মধ্যে আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখার আশায় আমরা খুব আস্তে হাঁটছিলাম, আর আমি কল্পনা করছিলাম আমরা কয়েকশো বছর আগের মোঘল যুগে ফিরে গিয়েছি। আমার নাম হরফন জাসুস আর আমার সঙ্গিনী কোনো কেতাবী নবাবের ছোটি বেগম। ফ্যান্টাসি অলীক হলেও তার বাস্তবিক ইতিহাস ছিল। দু বছর আগে আমার বয়স যখন চৌদ্দ আর সে পড়েছে ষোলোয়, তখন আমার লেখা হরফন নামক এক অল্প আয়ুর বদকিস্মত জাসুসের প্রথম গল্পটা পড়ে ফেলে সে। সেই গল্পে ছোটি বেগমের খুব ছোট এবং অর্ধস্ফুট একটা চরিত্র এঁকেছিলাম। ছো্টি বেগমের বিষয়ে এর বেশি কেন লিখতে পারিনি সেটা পম্পাই একমাত্র বুঝেছিল। পরে একদিন আমরা দুজন যখন তার ঘরে বসে রেডিও শুনছি তখন আমার চেয়ারের হাতলদুটো গেটের মতো দু হাতে আগলে ধরে সে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। সে জানত আমার পালাবার পথ রুদ্ধ, কারণ তাকে আমি ছুঁতে সাহস পেতাম না। পম্পা আমাকে ভরসা দিয়ে বলেছিল – মেয়েদের বিষয়ে লিখতে এত ভয় হলে তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস কী করে? আমি কি একটা রক্ত মাংসের রিয়েল মেয়ে নই? আসলে তোর ভয় হল সেই সব ছেলেদের, যাদের তুই নিজের আদর্শ মনে করে বখে যাওয়ার তাল করেছিস। সেই বজ্জাতগুলো মেয়েদের সহ্য করতে পারে না।
- কখনোই আমার আদর্শ সেরকম কেউ নয়। আমি প্রতিবাদ করে বলেছিলাম।
পম্পা আমাকে অগ্রাহ্য করে বলে – মেয়েদের এড়িয়ে চললে কি লেখক হওয়া যায়? পাড়ার দাদারা কী বলবে না বলবে ভেবে কাঁটা হয়ে থাকিস না। তোকে নিজের মতো হতে হবে। ভয় পাস না, আমি তোর সঙ্গে থাকব। মনে করবি আমি তোর গল্পের ভিতরে একটা ছায়ার মতো সকলের চোখের আড়ালে থেকে তোর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছি। আমাকে পেরিয়ে কেউ তোকে ছুঁতে পারবে না।
তার পর থেকে পম্পা মুখার্জিকে আমি আমার গল্পের ছোটি বেগম চরিত্রটার জায়গায় দেখতে শুরু করি, যে আমাকে নির্ভয়ে এমন জিনিস বলতে সাহায্য করবে, বা এমন জায়গায় সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, শিমলিপুরে থেকে আমি যা বলতে সাহস পেতাম না বা যেখানে যেতে পারতাম না।
- তুমি মাঝে মাঝে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছ কেন? আলো থেকে অন্ধকারে এসে পম্পাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।
– তুই তো মাঝে মাঝে গাছের আড়ালে না গিয়েও পুরো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিস। পম্পা বলল। - ভূত কিংবা জিন নয়তো? লোকে বলে দিল্লীর রাস্তায় এখনো অনেক অভিশপ্ত জিন ঘুরে বেড়ায়। তারপর সে হঠাৎ উৎসাহ পেয়ে বলতে শুরু করে - লোকে যা বলে তার কিছুটা তো সত্যিই হবে। আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি জিন আর মানুষরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। জিনের ভিতরে যে আগুন জ্বলে, তার কাছাকাছি এলে মানুষ সে দিকে যাবেই। আর তার পর থেকে সে জ্বলে পুড়ে মরে। সেই জন্য আমার বেশ চিন্তা। কারণ বুঝতেই তো পারছিস, সেরকম একটা অঘটন কিছু না হয়ে থাকলে নিজের চেয়ে দু-ক্লাস নিচের একটা ছেলের সঙ্গে আমি নির্লজ্জ হয়ে ঘুরছি কী করে?
- জ্বলে পুড়ে মরার ব্যাপারটা সত্যিকারের ভেজাল মাল। তাছাড়া আমি জিন নই। তোমার মতো মানুষ।
- কী করে জানা যাবে? তোর তো বার্থ সার্টিফিকেটও নেই। কেউ জানে না কোত্থেকে এলি। পম্পা আমার চোখে চোখ রেখে উকিলদের মতো অভিযোগ করল।
- তোমার আছে? ক্লাস টেনের অ্যাডমিট কার্ড ছাড়া আর কিছু আছে তোমার?
- না, আমারও নেই। কিন্তু অনেকের মায়ের মতো আমার মা আমাকে কুড়িয়ে পাওয়া বলে না! পম্পা অভিনয় চালাতে না পেরে অন্যদিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে বলল।
সে আমার ছোটবেলার আরেকটা ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করছিল। বছরখানেক আগে একটা দুর্বল মুহূর্তে তাকে অনুরোধ করেছিলাম বন্ধুত্ব বেশি পাকবার আগে সে যেন আমার কুলশীলের ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে নেয়। সেদিন তাকে ঘটনাটা বলি। আমার বয়স যখন বছর পাঁচেক তখন ত্রিপুরা থেকে বৃন্দাবন দর্শনে আসা এক আত্মীয় দিল্লীতে আমাদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। তিনি উপহার হিসেবে হাতে করে কাগজের একটা মাত্র ঠোঙা এনেছিলেন। তার ভিতর থেকে একটা মাত্র মাঝারি সাইজের চমচম উদ্ধার হয়। পূজোর মরসুম, বাড়িতে অনেক লোক। আমি সবচেয়ে ছোট। চমচম শুনে দাদা-দিদিরা আমাকে ছিটকে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা অবশ্য শীগ্গীরই বুঝেছিল অতজনের মধ্যে একটা চমচম ভাগ করা যায় না। ঠিক হয় লটারিতে যার নাম উঠবে সে মিষ্টিটা পাবে। এক বাটি মুড়ির মধ্যে চমচমটাকে রেখে যখন সবাই লটারি করবে বলে গোল হয়ে বসেছে, তখন মামিমা বাটিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল – এটা জয় খাবে, তোমরা সবাই যাও। তারপর তো তুমুল হট্টগোল। সেদিন মা আর মামিমার সঙ্গে মামাও আমাকে দাদা-দিদিদের কোপ থেকে আড়াল করার জন্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওই দিন কোনো এক সময়ে মামা বেখেয়ালে বলে ফেলে – কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। যদি আমরা তার একটু বেশি যত্ন না নিই তো নরকে আত্মীয়স্বজনের কাছে গিয়ে মুখ দেখাব কী করে? আর কী? মামার কথা শুনে সমস্ত শোরগোল একদম বন্ধ। জমাট নীরবতা নেমে এসেছে আসরে। দিদি জিজ্ঞেস করল – তাহলে কি জয় পৈতৃক সম্পত্তি পেতে পারে না? মামা বলে – সেটা পারবে, কিন্তু পিতামহ বা প্রপিতামহের আমলের বংশানুক্রমিক সম্পত্তি শুধু তোরাই পাবি। ঢাকায় আমাদের আদি বাড়ির পিছনে রাক্ষসবট গাছের নিচে এক ঘড়া মোহর আছে। তার ম্যাপ আমি তোদের জন্য তুলে রেখেছি। সেই মোহরের একটাও ওকে দিতে হবে না, তবে আজ চমচমটা ওর জন্য ছেড়ে দে। পরে শুনলাম দাঁত গজাবারও আগে নাকি এলাহাবাদের রাস্তায় এক অজ্ঞাতকুলশীল শিশুকে হামাগুড়ি দিয়ে কুম্ভমেলার দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল। মাকে দেখে সে দিক পরিবর্তন করে। সেই শিশু হলাম আমি। গল্পটা বলার সময়ে মা আর মামিমা আমাকে বড়ো করার পুরস্কার হিসেবে চমচমের দু-দিক থেকে একটু একটু ভেঙে নিজেদের জন্য নিয়েছিল।
আমার দয়ার সাগর বান্ধবী এই ঘটনাটা জানার পর থেকে সুযোগ পেলেই আমাকে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে বলে।
পম্পাকে বললাম – জিন-উইন কুছ নহীঁ, আমি একটা হি-গোট। নিজের বিষয়ে কিচ্ছু লুকোই না। তুমি জানতে না চাইলেও নিজের সমস্ত ইতিহাস গড়গড় করে বলে দিই। অথচ তোমরা দেখো কেমন সেয়ানা। জিজ্ঞেস করলেও নিজের বিষয়ে কিছু জানাও না।
- ঠিক আছে বাবা, অত নালিশ করিস না। আমিও তোকে আমার কিছু গোপন কথা বলব। কিন্তু কী বলব বল? আমি তো কুড়িয়ে পাওয়া নই। মায়ের সঙ্গে মুখের এত মিল। দেখলেই বোঝা যায় কার মেয়ে।
- এমন কিছুই নেই যেটা অন্যদের জানাও না? একেবারে খোলা বই তোমরা?
- থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই গোপন রাখার মতো আছে কিছু। ভালো ভালো জিনিস আছে। সে সব কি চাইলেই তোকে বলে দেওয়া যায়? তারপর তো তুই বিশ্বময় চাউর করে আসবি। মুখে ছিটকিনি আছে নাকি তোর?
গজগজ করে বললাম - তুমি যে আমাকে স্পেশাল বন্ধু হিসেবে ধরো সেটা কি আমি কাউকে বলেছি? টোটোদা ছাড়া আমাদের বাড়িতেও কেউ জানে না। তোমার সঙ্গে আমার যে কথা হয় তার একটা শব্দও আমি কাউকে বলি না।
- হুম্ম্ম্। আচ্ছা, আচ্ছা। আজ তোকে একটা সিক্রেট বলে দেব। এটা টোটোও জানে না। আয় কাছে এসে দাঁড়া।
আমি কালোজাম গাছের নিচে পম্পা মুখার্জির ছাতার তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সে বলল – আমরা নাম পম্পা কী করে হল জানিস? বাবা-মা রাখেনি এই নাম। কে দিয়েছে বলতো?
- দাদু-দিদা? মামা-টামাদের কেউ?
- না। আরেকবার ট্রাই কর।
- পাড়ার কোনো বৃদ্ধ মহাপুরুষ? গুরু-টুরু? সাধু বা ভণ্ড সাধু?
- না, না, না। এদের কেউ না। যে নামটা রেখেছে সে মানুষও হতে পারে, ভূতও হতে পারে। জিন, পরী, যক্ষ, ক্রিমিনাল সে যে কেউ হতে পারে। আসল ব্যাপারটা শুনলে অবাক হয়ে যাবি। কে এই নামটা রেখেছে সেটা আমরা কেউ জানি না। বলতে পারিস যেমন তোর শরীরটা একটা রাস্তায় পাওয়া শরীর, তেমন আমার নামটা একটা কুড়িয়ে পাওয়া নাম। আমার বান্ধবী দারুণ একটা রহস্য বলতে পারার আনন্দে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি কোনো জবাব দিইনি। তবে সিক্রেটটা আউট হয়ে যাবার পর পম্পা আর আমি আরো একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। যেন নিজেদের গোপনীয়তাগুলো এখন একজোট হয়ে আমরা রক্ষা করব। পম্পা চণ্ডীগড়ে যাওয়ার আগে আমার কাছে তার ব্যক্তিগত ইতিহাসের কৌটো থেকে একটা হীরে-জড়ানো গয়না রেখে যাবে।
এদিক ওদিক দেখে নিয়ে পম্পা খুব মৃদু গলায় বলতে শুরু করে। - কি হয়েছিল বলি। তোরা তো এক বা দুই ক্লাসে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলি। আমি এসেছিলাম আরেকটু বড়ো বয়সে। ক্লাস ফোরের মাঝামাঝি। সবে কলকাতা থেকে উপড়ে আমাদের দিল্লীতে নিয়ে এসেছে বাবা। বছরের মাঝখানে কোনো স্কুলে ভর্তি করা যায় না, তখন পাড়ার তনু মাসি বললেন – রবীন্দ্র শিক্ষাভবনে আমার চেনা জানা আছে। সেখানে ভর্তি করে নেবে। বাবার সঙ্গে একদিন এসে হাজির হলাম। ফর্ম টর্ম ভরার পর বিরাগবাবুর কাছে পাঠানো হল ফি জমা করার জন্য। বিরাগবাবু এখন রিটায়ার করে গেছেন, তখন তাঁকে রাগী বাবু বলত সবাই। প্রাইমারি ক্লাসের সর্বেসর্বা ছিলেন।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালো করে জানি। বিরাগব্রত দাস। বৈরাগীই ছিলেন শুনেছি।
- হ্যাঁ, কেমন বৈরাগী বলছি সেটাও। তো বিরাগবাবু আমার নাম দেখেই চটে লাল। ফায়ার বললে কম হয়, কনফ্ল্যাগারেশান। পুরো বিল্ডিংয়ে আগুন ধরে গেলে আমরা আশ্চর্য হতাম না। কী নাম বলা হয়েছিল জানিস তুই?
- মানে? তোমার যা নাম। পম্পা নয়?
- না রে। আমার পুরোনো নাম ছিল চম্পা। চম্পাকলি। ভয়ানক লজ্জা পেয়ে বলল পম্পা।
- গুড লর্ড! আমি গাছের কাণ্ডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এরকম একটা সিক্রেট বেরোবে ভাবতেও পারিনি। - চম্পাকলি! এরকম নাম, আমাদের যুগে…?
পম্পা ঘাড় নাড়িয়ে বলল – বৃদ্ধ মহাপুরুষের কথা বলেছিলি তুই? এই নামটা সেরকম একজনের কাছ থেকে আসে। বাবা-মা না পারছিল গিলতে, না পারছিল ফেলতে। ছোট করে চম্পাই বলা হত। কিন্তু আমরা পরে জেনেছিলাম বিরাগবাবুর বউ তাঁকে দশ বছর আগে ছেড়ে পালিয়ে যান। তারপর থেকে দুটো ছেলেকে বিরাগবাবু একা মানুষ করেছিলেন। সেই পালানো বউয়ের নামও ছিল নাকি চম্পাকলি। বিরাগবাবু ভাবলেন বাবা ওনার সাথে মস্করা করার জন্য এই নামটা লিখে দিয়েছে। ফর্ম-টর্ম অমনি ফরফর করে ছেঁড়া হয়ে ডাস্টবিনে চলে গেল। বিরাগবাবু বললেন – সীট নেই, অ্যাডমিশান হবে না। আমাদের অবস্থাটা চিন্তা করে দেখ একবার!
আমি হাঁ করে শুনছিলাম। বললাম – অবিশ্বাস্য! চিন্তা করা যায় না। কে জানে তোমাদের সেই বৃদ্ধ মহাপুরুষই বিরাগবাবুর বউকে নিয়ে পালিয়েছিলেন কিনা। তাহলে দুর্ভাগ্যের সার্কল্ কমপ্লিট হয়ে যেত। কী করলে তারপর?
- কী করব? আমার তো দশ বছর বয়স। বাবা দিল্লীতে কাউকে চেনে না। ভালো করে হিন্দীও বলতে জানি না কেউ। কোথায় যাব? আমাদের অফিস থেকে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাইরে করিডরে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় বুড়ি চাপরাশি সুলক্ষণা আমাদের কাছে চলে আসে। তোর মনে আছে সুলক্ষণাকে?
- হ্যাঁ, মনে আছে। তার বরের অসুখ করার পর সে রিটায়ার করে যায়।
- বরের গলায় ক্যান্সার হয়েছিল। ছেলেরা হাল ছেড়ে দেয়। সুলক্ষণা ছাড়েনি। বম্বেতে নিয়ে গিয়ে সারিয়ে আনে। সেদিনও সুলক্ষণা ছাড়া কেউ আমাদের বাঁচাতে আসেনি, যে জন্য আজও আমরা তার কথা খুব মনে করি। বাবার সঙ্গে তার খানিকটা আলোচনা হয়। সুলক্ষণা একটু একটু বাংলা বুঝত। সে তো আমার নাম শুনেই কপালে চাপড়াতে শুরু করেছে। তারপর ভিতরে গিয়ে আরো দু-চারজন অফিসের কর্মচারীর সাথে কথা বলার পর ফিরে এসে সে বলল – বিরাগবাবুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করা হচ্ছে। চিন্তা নেই, ফর্ম আরেকবার ভরে দাও, তবে এবার ওই নামটা আর লিখো না। বাবার তখন এমন একটা নার্ভাস অবস্থা, কী লিখবে ঠাহর পাচ্ছে না। সুলক্ষণাকে বলল – কী নাম দেব? তুমিই একটা কিছু বলে দাও যেটা বিরাগবাবুর পছন্দ হবে। তখন সুলক্ষণা বলল – আমার ছোট ননদের মেয়েটাকে একদম তোমার মেয়ের মতো দেখতে। মাঝে মাঝে স্কুলে আমার কাছে আসে। বিরাগবাবু তাকে খুব ভালোবাসেন। তুমি ওর নামটা লিখে দাও।
- সেই নাম হল পম্পা?
- আরে, না। বাঙালি না হলে পম্পা নাম কার হবে? পুরোটা শোন আগে। সেই মেয়েটার নাম ছিল গুলাবো। দিল্লীর রোদ্দুরে আমার মুখটা তখন তেতে লাল হয়ে গেছে, তাই আমাকে নাকি তার মতো দেখতে হয়েছিল। যাহোক, ফর্মে লেখা হল গুলাবো রানী মুখার্জি। ইষ্ট নাম জপতে জপতে বাবা সেই ফর্ম হাতে আমাকে নিয়ে আবার বিরাগবাবুর কাছে গিয়ে উপস্থিত। এবার বিরাগবাবু ফর্মটা ছিঁড়লেন না। আমাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন – ক্লাস ফোরের পক্ষে মেয়েটাকে বড্ডো বড়ো বলে মনে হচ্ছে। স্কুলে আসতে হলে একে স্কার্টের ঝুল আরো আধ ইঞ্চি বাড়াতে হবে।
- যাঃ। অসম্ভব! হতে পারে না। বানিয়ে বলছ এসব।
- কবে যে তোর চোখ খুলবে? মা নিজের হাতে স্কার্ট বানিয়ে দিত। হাঁটু থেকে অন্তত এক ইঞ্চি নিচে ঝুলত তখনও। তা সত্ত্বেও বিরাগবাবু বুঝে গেলেন সেটা দেড় ইঞ্চি নামেনি। বয়স মাত্র দশ, আমি সবার সামনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি। বাবা সই টই করে আমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। তারপর সোজা বাড়িতে এসে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
- কিন্তু… কিন্তু, গুলাবো রানী নাম তো তোমার স্কুলের খাতায় নেই! সেখানে তো পম্পাই লেখা আছে।
- পুরো একদিনের জন্য আমি গুলাবো হয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে তারপর গুলাবো থেকে পম্পা হয়ে গেলাম জানতে চাস? পম্পা আমার গালে টুস করে একটা টুসকি মেরে দিয়ে বলল – সেটা এই গল্পের পার্ট টু। আরেকদিন বলব বাকিটা বুঝলি, কী বল?
চম্পাকলি ওরফে গুলাবো জান আবার গাছের আশ্রয় ত্যাগ করে ফুটপাথে হাঁটতে শুরু করেছে। ধীরে সুস্থে কোনো তাড়া ছাড়া এবার চলেছে আমার বান্ধবী। গত দুবছরে আমার চেয়ে অনেক বেশি বড়ো হয়ে যাওয়ার ফলে কালিদাসের যুগের শ্রোণীভারে অলসগমনা কোনো অচেনা যুবতী এসে যেন ভর করেছে তার মধ্যে। হতভম্ব আমি ছুটে গিয়ে তার ছাতার নিচে মাথাটা একটু গুঁজে দিয়ে বললাম – কেউ এইভাবে মাঝপথে গল্প ঝুলিয়ে রাখে না। এটা অন্যায়। আমি তোমার সঙ্গে করেছি এরকম কোনোদিন?
- তুই যা করিস আমাকেও তাই করতে হবে নাকি? আমরা গল্পের একেকটা পর্ব একেকদিন বলি। তোর গল্প তো পঁচিশবার পালটায়। আমি যা বলি সেটা একবার বলি। ফাইনাল। একটাও মিথ্যে পাবি না আমার মধ্যে। এরকম জিনিস পেতে গেলে একটু সাধনা করতে হবে না? মনে কর তোর এখন প্রোবেশন চলছে। আগে আমার বাবা-মা’র বিশ্বাস অর্জন কর। স্কুলের বাউন্ডারি টপকে গিয়ে আরেকটু বড়ো-সড়ো হ। যে কথাগুলো আজ তোকে বললাম তা কতজনের কাছে রটাস দেখি আগে।
- এ কী রিডিকুলাস যুক্তি! তোমার নাম কোথা থেকে এল, সেই প্রধান রহস্যটারই তো সমাধান হয়নি। এটাকে আদৌ পর্ব বলা যায় না।
- কেন বলা যাবে না? পর্বের শেষে কাহিনীর একটা কোনো উদ্দেশ্য বা ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। আমার অ্যাডমিশান হয়ে গেল। একটু চিন্তাভাবনা করলে পর্বের শেষে একটা উপলব্ধিও হতে পারে। সেটা হয়নি তোর? সুলক্ষণাকে যদি সেদিন আমরা করিডরে না পেতাম, তাহলে কি রবীন্দ্র শিক্ষাভবনে আমি ভর্তি হতাম? আর আজকে কি তুই আমার ছাতার নিচে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে হাঁসের মতো প্যাঁকপ্যাঁক করতে পারতিস? ওই একটা ছোট্ট ঘটনা না ঘটলে আমাদের হয়তো কখনও দেখা হত না। এটা ভেবে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না তোর?
না ভাবছি কিছু, না কোনো কাঁটা টের পাচ্ছি। শুধু মনে হচ্ছিল আমার এ প্রোবেশন কোনোদিনও শেষ হবে না। একটা বিধুর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। - তুমি সত্যিই বাকিটা বলবে না তাহলে আজ?
পম্পার চলা থেমে গেছে। চোখ পাকিয়ে সে আমাকে বলল – আজ তোকে কতটা দিয়েছি তুই সেটা বুঝতে পারছিস? দু-দুটো সিক্রেট নাম আউট করে দিলাম আর কৃতজ্ঞতা জানাবার বদলে আমাকে রিডিকুলাস বললি? ছি-ছি-ছি। পৃথিবীতে আর কেউ জানে এই নামগুলো? আমাদের জেনারেশনে শুধু আমি জানতাম। এবার জানলি তুই। আমার সিক্রেট জানিয়েদের লিস্টে মা-বাবার পর তুই! নাম্বার টু! তারপর সে আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল - হে প্রভু, ছেলেটাকে বুদ্ধি দাও। দু বছরের মধ্যে ওকে নাম্বার টু করে দিয়েছি, তাও তার বায়না মেটেনি! এখন সে এক লাফে নাম্বার ওয়ান হতে চায়!
সেই ভর্ৎসনার দৃষ্টির সামনে শুকিয়ে গিয়ে আমি বললাম – না, না, না। কোনো তাড়া দিচ্ছি না। যা বলেছি ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে নিচ্ছি। আরো কয়েকটা বছর যাক। তার আগেই হয়তো বেরিয়ে পড়বে আমি কারো পোষা জিন। ছিপি খোলা পেয়ে বোতল থেকে তিড়িং করে বেরিয়ে এসেছি। নিজের থেকে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাব একদিন। তখন আর বলারও দরকার থাকবে না।
তারপর আমি ফুটপাথ থেকে পম্পা ওরফে গুলাবো খাতুনকে মায়ের অফিস দেখিয়ে দিই। কৌতূহলে পম্পা কাছে গিয়ে দেখতে চেয়েছিল। তাকে বুঝিয়ে বলতে হয় কেন ওইদিকটা যাই না। যদি মায়ের কলিগ কি সেকশানের কারো সাথে দেখা হয়ে যায়, তারা ঠিক মাকে গিয়ে বলে দেবে আমার চুলে তেল-জল ছিল না, জামা নোংরা ছিল, কিংবা আমি একটা অচেনা মেয়ের সাথে রাস্তায় অসভ্যের মতো ঘুরছিলাম।
এলাকাটা এড়িয়ে আমরা অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরপথে যখন আরো এগিয়েছি আর অফিস পাড়া থেকে একটু দূরে লুত্যেনের দিল্লীর পুরোনো গাছগুলো আবার আমাদের ভিড়ভাট্টা থেকে ছিঁড়ে অন্য কোনো যুগের মন্থর সময়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পম্পা আমাকে বলল – ভয় নেই, বার্থ সার্টিফিকেট লাগবে না তোর। পরিচয় কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না। জিন, না যক্ষ, না মানুষ সেটা ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আমাদের পাড়ায় বলে জিন হলে তার মুখ দিয়ে যখন তখন কৃমির মতো কিলবিল করে বেরোবে মাথামুণ্ডুহীন বক্ওয়াস। দিনকে বলবে রাত, রাতকে বলবে দিন। পোকা-মাকড়, আবর্জনা জিনিস দেখলে তার চোখ চকচক করে উঠবে। একটা ভদ্র, সভ্য মানুষের মতো সে কখনোই হতে পারবে না। লাহোর থেকে আসা সবাই বলে তার সঙ্গে ভাব করলে মানুষের ভাগ্যে অনেক দুঃখ আছে।
আমি দিল্লীর ছত্রভঙ্গ, পরাস্ত জিনদের সমর্থনে বলেছিলাম – দেখো, মানছি যে লাহোর একটা শিল্পীদের শহর। সেখানে তহজীব আছে, জীবন ছিল। কিন্তু দিল্লীর মতো উজাড় দরবারের খাঁ খাঁ রাস্তা সেখানে কোথায়? কোথায় সেখানে নিরালা দুপুরের বন্ধ মণ্ডী কিংবা কুচা আর গলিতে ফুঁপিয়ে-বিনিয়ে আটকে থাকা সাত আটশো বছর আগেকার কান্নার ধ্বনি? জিনরা যা কিছুর মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে বাঁচে সে সব ভাঙাচোরা জিনিসে আমাদের শহরটা বোঝাই। কীসের জন্য তাহলে তারা লাহোরে যাবে? আর চণ্ডীগড়ের মতো পালিশ করা খেলনা-নগরে পাঠিয়ে দিলে তো তারা দমবন্ধ হয়ে মরবে। যাই হোক, আমি তোমাকে জিন আর মানুষের বন্ধুত্বের প্রাচীনতম ঘটনাটা বলতে পারি। এটা একমাত্র দিল্লীর পুরোনো বাসিন্দারা পুরুষানুক্রমে জানে। তোমার পাড়ার লোকেরা জানবে না, কারণ পার্ক টাউন তৈরিই হয়েছে নিউ দিল্লী বানাবার সময়ে, এবং সেখানকার সমস্ত লোক এসেছিল পার্টিশানের পরে। দেখবে এই গল্পটাতে স্পষ্ট বলা আছে যে বাস্তবে জিনরাই আকৃষ্ট হয় মানুষদের প্রতি, কারণ তাদের নসীব হল কারো গোলাম হয়ে থাকা। তবে মানুষের সঙ্গে তাদের ভাব হয়ে গেলে তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয় না।
- মানে দুজনেরই জীবন অর্ধেক নষ্ট হয়, তাই তো?
- অর্ধেক না সিকি, সেটা শোনার পরে তুমি ঠিক করে নিও। একা আমি নয়, বহু লোক এই কিস্সা ছোটবেলা থেকে শুনে মুখস্থ করে নিয়েছে। এই গল্পটা না জেনে দিল্লী ছাড়া হল ডিগ্রী না নিয়ে কলেজ ছাড়ার মতো নিরর্থক।
দিল্লী ছেড়ে যাওয়ার আগে জিনদের গল্পটা ভালো করে শোনার জন্য পম্পা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হল। নিজের চুলগুলো দু-হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে সে বলল – বোরিং হবে না তো?
- ওফ্ফো, বুড়ো বুড়িরা যে গল্প ছড়ায় তা বোরিং হবে না? আমি যে কাহার বুড়ির কাছে প্রথমবার শুনি সে ফোকলা দাঁত দিয়ে চুষে চুষে এর সমস্ত রস বার করে নিয়েছিল।
- বাঃ, বাঃ চমৎকার! ডেলিশাস!
- হুরী আর জিনরা যে প্রাচীন নামগুলো ব্যবহার করে তার কিছু কিছু আমরা জানি।
বুড়ো নীম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বুড়োদের মতো শুরু করেছি। যেন একটা ষোলো বছরের চারাগাছ নই, কোনো দেড়শো বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ নীমের খসে পড়া ডাল। আমি বললাম - হুরী আর জিনদের সব নাম হারায়নি এখনো। যেমন হুরীদের সবচেয়ে প্রিয় যে নামগুলো আমরা জানি তা হল রিম, সিম, তিম, জিস্মিন ইত্যাদি। প্রাচীন আর পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া জিনদের মধ্যে তুমি পাবে বাজির, দাই, ইসাফ, হিলাল প্রভৃতিদের। আর পৃথিবীর জন্মের আগের সময় থেকে যারা আছে তাদের কারো কারো নাম নুবেদ, গাম, আরা, কিংবা নেবুচ্।
- মাই ডিয়ার মিথ্যের জাহাজ, এই সব জিনের নাম তুই পেলি কোথায়? পম্পা তার আঙুল দিয়ে চুলের বুরুশ করা থামিয়ে চোখা হয়ে আমায় প্রশ্ন করল।
- কিছু পড়েছি, কিছু শুনেছি। সেই সব চটি বই তোমরা পড়ো না, কারণ সেগুলো এমন বাজে কাগজে এত সস্তায় ছাপা যে কপাল থেকে এক ফোঁটা ঘাম চুঁইয়ে পড়লে তা পুরো বইটাকে ফুটো করে বেরিয়ে যায়। চুল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া বান্ধবীকে বললাম আমি। - আমি এই গল্পের কিচ্ছু বানাইনি। বিভিন্ন জায়গায় শোনা এবং পড়া। তখন আমি এত ছোট যে এর অর্ধেকের মানে বুঝতাম না। গল্পে দুটো জিনের কথা বলা হয়। তাদের নাম হুশার আর আনশার।
- ঝুট কী দুকান, গুবলে ফেলেছিস এর মধ্যে। তোর আগের নামগুলোর মধ্যেও এ দুটো ছিল না।
- না, না, এ নামগুলো আলাদাই হবার কথা, কারণ এরা একটু অন্য ধরনের জীব। ফেরেশ্তান জিন বলে এদের। ফেরেশ্তান জিনরা হল জিনদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো আর ক্ষমতাশালী। হুশার আর আনশার নামের এই দুই যমজ ভাই আফাক, মানে ঊষার, দুটো দিক পাহারা দিত, যাতে আকাশ আর জমিনে যত হিন-জিন-ঘুল-মারীদ আর অন্যান্য আগুনের জীবরা আছে, তারা কেউ এই দুই দুনিয়ার তামাশা ছেড়ে বাইরে না পালাতে পারে।
- হে মাই ঠাকুর। এই নতুন জন্তুগুলো আবার কোত্থেকে উড়ে এল স্টেজে? হিসেব রাখতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি।
- তোমার সবেতে সন্দেহ। দিল্লীর পুরোনো মানুষরা সবাই জানে হিন-জিন-ঘুল-মারীদ এরা সব জিনদেরই কাজিন ভাইবোন। যেমন বাঘ, সিংহ, চিতা, বেড়াল এই সমস্ত ফেলাইন স্পিশিসদের কাজিন বলা হয়। হয়তো ঘুল আর মারীদ একটু আলাদা। নেকড়ে বা হাউণ্ডের মতো। এর বেশি গভীরে জানতে হলে আরবি ফারসিতে পণ্ডিত হতে হবে। তুমি চাইলে না হয় সেটাই হব।
- দরকার নেই। আমি মেনে নিচ্ছি। আগে বোল।
- ধন্যবাদ। আসল কথাটা হল এই যে সমস্ত আগুনের জীবকে পৃথিবী আর আকাশের মধ্যেকার খাঁচাটায় বন্ধ রাখতে হয়, যাতে তারা বাইরে গিয়ে তাণ্ডব না করতে পারে। জমিন আর আসমানের মধ্যে চিরদিনের জন্য কয়েদ হয়ে থাকাই জিনের ভাগ্য ছিল। সেই দুর্দান্ত হুশার আর আনশারের এমন তাকৎ ছিল যে তাদের এক কোসের মধ্যে কোনো জিন কি ফেরেশ্তা ভুলেও চলে গেলে তার ওড়ার শক্তি চলে যেত, কথার বদলে গলা দিয়ে শুধু গোঁ গোঁ শব্দ হত আর দম আটকে আসত। একমাত্র নেবুচের মতো বুড়ো থুত্থুড়ে কিছু জিন – যারা আদৌ দম নিচ্ছে না মরেই গেছে বোঝা যায় না – তারা এদের কাছে যেতে পারে। তাই এই দুই পাহারাদারদের জিম্মায় আফাক একদম সুরক্ষিত থাকত। কিন্তু যেখানে ফেরেশ্তার কেরামতি চলে না সেখানে মানুষের ধোখা-ও-ফরেব, অর্থাৎ ছলনা আর জুয়াচুরি, কাজ করে যায়। কিস্মতের এমন মার যে দুই ভাই একসঙ্গে ভালোবেসে ফেলল দুই যমজ বোনকে, যারা শাহজাদী হলেও ছিল রক্ত-মাংসের মানুষ। তারপর শব-এ-বরাতের দিন, যখন সমস্ত হুরী আর পরীরা আকাশ থেকে নেমে আসে মানুষদের সঙ্গে রাতটা কাটাবার জন্য আর যখন সকলের তক্দীরের তাসগুলো আসমানের জোব্বা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া হয় কার ভাগ্যে কী আছে সেটা তাকে দেখিয়ে দেবার জন্য, তখন হুশার আর আনশার তাদের একটা করে চোখ আফাকের দরজায় আটকে দিয়ে একটা মাত্র চোখ নিয়ে মাটিতে নেমে এসেছিল তাদের প্রিয় সহার আর শবান নামের দুই শাহজাদীর কাছে।
পম্পা মুখার্জি ওরফে গুলাবো রানী আমার গল্পের ছোটি বেগমের মতো নিয়তির অবিচারে অটল বিশ্বাস রেখে বলল – আমি জানি কী হবে। এরা যাদের ভালবাসত তাদের সঙ্গে দেখাই হল না, তাই তো?
আমি বললাম – দেখা তো হল। কিন্তু তারা যে আসবে সেটা দুই বোনের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল বাড়ির জালিম লোকেরা এবং দুটো ফেরশ্তান জিন একসঙ্গে ধরবার লোভ সামলাতে পারেনি। সেদিন যখন ফেরেশ্তারা দুই বোনের ঘরে বিছানায় আরাম করে শুয়ে ছিল আর শাহজাদীরা একসঙ্গে বাগানে ঘুরে ঘুরে সিতারাদের কাছ থেকে ভালো বরাত চেয়ে নিচ্ছিল, তখন সুলতানের বাঁদীরা গিয়ে ঘুমন্ত দু-ভাইয়ের ঠোঁটে খতম-কহানী-যো-লে-চাট বলে একটা খতরনাক বিষ লাগিয়ে দিয়ে আসে। এই সর্বনাশা বিষের ফল এই যে ঘুম থেকে উঠেই যদি কেউ এটা চাটে তাহলে এক পলকের পর তার সমস্ত স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
- দু-ভাই উঠেই নিজের ঠোঁট চেটেছিল নাকি? গুলাবো থাকতে না পেরে বলে উঠেছিল। যেন সে পারলে গল্পে ঢুকে দুটো উজবুককে ভালোভাবে বুঝিয়ে শিখিয়ে দেয় যে সকালে উঠে মুখ ধোওয়ার আগে কোনো ভদ্র বা শরীফ কিসিমের মানুষ নিজের ঠোঁট চাটে না।
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম - সেটা তো করবেই, কুকুরের যে রকম বাঁকা লেজ সোজা হয় না, জিনদের সেরকম ঠোঁট চাটার বদভ্যেস যায় না। তবে ঠোঁট চাটার পর এক পলক পড়ার আগে দু-ভাই বুঝে যায় কী ঘটেছে। ফলে হুশার আর আন্শা্রের চোখের সেই পলকটা একবার উঠে আর পড়েনি, সেটা চোখেই আটকে ছিল। এখন তারা দু-ভাই তো যে-সে লোক নয়, আফাকের বিশিষ্ট ফেরশ্তা। আফাকের পাহারাদারের চোখ যখন আটকে যায় তখন কী হয় বলোতো?
- ডিজাস্টার? মানে কয়ামত?
- প্রায় তাই। সময়ের পাগলা ঘোড়া থেমে যায়।
- অর্থাৎ?
- কেউ নড়তে পারে না। সেদিন পৃথিবীর সমস্ত মানুষ ও প্রাণী যে যেখানে ছিল সঙ্গে সঙ্গে পাথরের মূর্তির মতো জ্যান্ত জমে গিয়েছিল। একমাত্র শাহ্জাদীদের গায়ে হুশার আর আনশারের গরম নিঃশ্বাস পড়েছিল বলে শুধু তারা দুজনেই ঘুম থেকে জাগে, এবং জেগে দেখে দুনিয়ার এই হাল। এমনকী বাগানের বুলবুল পাখিটা পর্যন্ত চোঁচ ফাঁক করে আকাশের দিকে মুখ করে বসে আছে, কিন্তু তার গলা দিয়ে গান আর বেরোচ্ছে না।
- তাহলে শাহজাদী আর ফেরেশ্তাদের আলাদা হতে হয়নি? আশা নিয়ে বলল গুলাবো জান। - এখানেই তো গল্প শেষ হতে পারে। আরো আছে নাকি?
- আছে আরেকটু। শোনো। পুরো একশো বছর তারা একসঙ্গে ছিল। এই একশো বছরে হুশার আর আনশার একবারও চোখের পলক ফেলেনি। দুই বোন যখন হাই তুলতে তুলতে ঘুমোতে যেত, তখন দু-ভাই ঘুমোবে না বলে বসে বসে তাস খেলত। তাস খেলতে খেলতে তারা এমন উস্তাদ হয়ে যায় যে খেলাটাকে আরও শক্ত বানাবার জন্য অনেক নতুন তাসও আবিষ্কার করে ফেলে। আর যখন দুই বোন জেগে থাকত তখন তারা চারজন মিলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দেশভ্রমণ করে বেড়াত। ফলে এই একশো বছরে তাদের অসংখ্য ছেলেপুলে হয়ে সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
অসংখ্য ছেলেপুলের উল্লেখে গুলাবো একেবারে আহ্লাদিত হয়ে গিয়েছিল। সে বলল - বাঃ, বাঃ। এ তো ভালোই গল্প। এতে আর দুঃখের কী আছে? দিল্লীর লোকেদের মতে জিনরা মানুষের বন্ধু হলে কিছু মন্দ হয় না তাহলে, কী বল?
- হ্যাঁ, তোমাকে তো বলেছিলাম এদের জীবনের সবটা ব্যর্থ হয়নি। তোমার মনের জমি নরম, তাই গল্পের এই প্রথম পর্বটা ভালো লেগে গেছে। কিন্তু এর পর কী হল? পার্ট টু-টাও জেনে নাও, আমি লুকোব না কিছু। একশো বছর পর, একদিন দুই শাহজাদী এমন অসুখে পড়ল, যে স্পষ্ট বোঝা গেল তারা মানুষ, যাদের একদিন না একদিন মরতে হবেই। সেদিন দুই ফেরেশ্তানা ভাইয়ের চোখ দিয়ে অঝোরে গড়াতে শুরু করে জল আর তারা বুঝতে পারে যে জলের সঙ্গে চোখের পলকও অর্ধেকটা নেমে এসেছে। তখন বাকি অর্ধেক পলকের মধ্যে নিজের ভবিষ্যত তাদের কাছে কাঁচের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আর তারা দুই ফুঁয়ে দুই শাহজাদীকে পৌঁছে দিয়েছিল আফাকের দুই প্রান্তে। যতক্ষণে তাদের পলক পুরোপুরি পড়ল আর পৃথিবীর সমস্ত পশু ও মানুষ তাদের একশো বছরের ঘুম থেকে জাগল, ততক্ষণে হুশার আর আনশার নিজেদের দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছেলেপুলেদেরও লুকিয়ে ফেলেছিল কোথাও। কেউ তাদের আর খুঁজে পায়নি। মানুষরা পরে হুশার আর আনশারকে আবিষ্কার করে জানোয়ারদের মধ্যে। যখন তারা নিজেদের নাম পর্যন্ত মনে করতে পারে না। তক্দীরকে কে এড়াবে? শেষ পর্যন্ত জালিম মানুষরাই জিতে যায়। হুশার আর আনশারকে বন্দী করে হাব্শী গোলামের মতো সেই জালিমরা নিজেদের যুদ্ধগুলোতে লড়তে পাঠিয়ে দিতে লাগল। যে সুলতান যুদ্ধে জিতত সে-ই কবজা করে নিত দু ভাইকে। এইভাবে হাজার হাজার বছর ধরে দুজন গুণী ও ক্ষমতাশালী আকাশপাড়ের জিন, মানুষের মক্কারী-ও-ধোখেবাজীর, মানে প্রতারণা আর ছলনার, কাছে পরাস্ত হয়ে তাদের গোলামী করতে থাকে। এটাই হল জিনদের পরিণতি। যাদের অনেকে এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে ভেঙে পড়া আর পুরোনো শহরগুলোতে ঘুরে বেড়ায়।
- শেষের দিকে গল্পটা বেশ দুঃখের হয়ে গেছে, খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর স্বীকার করে আমার বান্ধবী। - একদিক থেকে ভালো যে যতদিন তাদের মনে ভালোবাসা ছিল আর তারা নিজেদের পরিচয় ভুলে যায়নি, ততদিন তাদের স্বাধীনতাও ছিল। কিন্তু শাহজাদীদের কী হল সেটা তো বললি না। তারাও কি তাদের ছেলেপুলেদের মতো লুকিয়ে পড়ল?
- না, না। তারা যখন আফাকের দুই প্রান্তে দুটো দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছোয়, তখন দেখা যায় সেই দরজার গায়ে আটকানো একটা করে চোখ তাদের দিকে চেয়ে স্বাভাবিকভাবে পলক ফেলছে। যেমনটা তারা একশো বছরে দেখেনি। তখন মুগ্ধ শাহজাদীদের চোখগুলোও উড়ে গিয়ে সেই দরজায় আটকে যায়।
- চোখ তো গেল দরজায়। আর বাকি দেহটা?
- তোমার ভাগ্য ভালো, এই প্রশ্নের উত্তরও কোনো কোনো বইয়ের ফুটনোটে লেখা থাকে বলে আমার অজানা নয়। হাঁটু থেকে দেড় ইঞ্চি নিচ অবধি স্কার্ট পরা নবাগতা চম্পাকলিকে একটা জরাজীর্ণ শহরের ধ্বংসরেণু মাখা রহস্যগুলো চিনিয়ে দিতে পেরে গর্বিত হচ্ছিলাম আমি। তাকে বললাম - তুমিই ভাবো, চোখ চলে যাওয়ার পর দেহ আর কোথায় যেতে পারে? সকাল আর সন্ধ্যের আবছা আলোয় যাদের কোনো জবাব হয় না সেই পহেলীগুলো যেখানে যায়, লোকে বলে সেখানেই নিজের ঠিকানা পেয়েছিল তারা।
পম্পা আরো খানিকক্ষণ আনমনা হয়ে থাকার পর ছড়ানো চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলল - আমি জানতাম।
হনুমান রোড ধরে রিভোলি সিনেমার পিছন দিক দিয়ে ম্যাড্রাস হোটেলের অভিমুখে গেলে কফি হাউস। নিউ দিল্লীর এই পাড়াগুলোতে এলে পম্পার সব ঘুরে দেখা চাই। জনপথ বরাবর কনট প্লেসের সাদা পিলারগুলোকে লক্ষ্য করে সে সটান হেঁটে চলেছিল। রিগাল বিল্ডিংয়ের বাঁকে আমরা সানগ্লাস, বেল্ট, টুপি, কিউরিও, আর ফ্যাব্রিক পেইন্ট করা রঙিন জামার স্টলগুলোতে থামতে থামতে চলেছি। সস্তায় যদি একটা আলাদীনের প্রদীপ পাওয়া যায়। নামমাত্র ভিড়। আমরা ছাড়া যারা এই দোকানগুলোতে হুল ফোটাচ্ছে তারা কেউ সাউথ ইণ্ডিয়ার অফিস থেকে আসা কাজের মৌমাছি, কয়েকটা আমাদের বয়সী গ্রীষ্মাবকাশের উদ্দেশ্যহীন বোলতা। রিগাল সিনেমার ফুটপাথে এক দিশী মহিলা বিদেশী টুরিস্টদের উপযুক্ত দামে রাজস্থানী মিনিয়েচার বিলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমরা নিরাশ হয়ে রিগালের পাশে কফি আর ডোনাটের দোকানে উঁকি মেরে দেখলাম কোনো বসার জায়গা খালি নেই। পম্পা অনুরোধ করলে সাধারণত দোকানের বয়রা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেয়। এদের ছেলেটা সারেণ্ডার করল। সে বলে - ফ্যানটা ইচ্ছে করে খারাপ করে দিয়েও কাউকে তুলতে পারছি না। দেখুন না, একটা করে কোল্ড ড্রিংক নিয়ে সবাই লঙ্গর ফেলে বসে গেছে।
সুতরাং আমরা বাবা খড়ক সিং রোড ধরে রিভোলি সিনেমার উপরের কফি হাউসেই চলে আসি। গরম হলেও একটা ইষদুষ্ণ রুক্ষ হাওয়া চলার ফলে ঘাম হচ্ছিল না। কফি হাউসের বিরাট খোলা ছাদে বুড়োদের একটা বড়ো দল আকাশের নিচে বসে বাজখাঁই গলায় আড্ডা দিচ্ছে আর রাম্মি খেলছে। দলে মহিলা না থাকলে ভিতরের ঠাণ্ডা ঘরে বসার অনুমতি নেই। পম্পার পিছু পিছু এলে আমি সেই সুবিধেটা কখনো ছাড়ি না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম খোলা জানালার ধারে একটা শ্রেষ্ঠ টেবিল খালি হয়েছে। একগাদা কাপ, ডিশ, আর গ্লাস ছড়ানো এখনো। পম্পাকে বললাম – ওই টেবিলটার ব্যবস্থা করিয়ে দাও না? সে একটিও শব্দের অপচয় না করে লাল পাগড়ি পরা একজন ছোটখাটো চেহারার প্রৌঢ় বেয়ারাকে এমন মনভোলানো একটা হাসি দিয়ে সেদিকে আঙুল দেখাল যে তিনি ‘আইয়ে আইয়ে’ বলতে বলতে সত্বর টেবিলটা পরিষ্কার করে দিলেন।
আমার বান্ধবী দুটো কফি আর আমার জন্য একটা উত্তপম চেয়েছিল। কিন্তু সেগুলো তৈরি হবার আগেই তার জন্য একটা পাতলা স্যাণ্ডউইচ চলে আসে। বেয়ারা জানালেন সেটা ফাউ, যা আমি কফি হাউসে কাউকে কোনোদিন পেতে দেখিনি। পম্পা আবার তার ছেলেভোলানো হাসিটা বার করে বলল – ওঃ কী লাভলি স্যাণ্ডউইচ! কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব? এর সঙ্গে একটু আইস-কোল্ড জল পেলে যে কী ভালোই না হয়!
এক মিনিটের মধ্যে বেয়ারা যখন ফিরলেন তখন তাঁর ট্রে থেকে দুটো জল ছাড়াও পম্পার ‘ভইয়ার’ জন্য আরেকটা স্যাণ্ডউইচ নেমেছে। অবাক হাসিতে নুয়ে পড়ে পম্পা এবার সাবধান করে দেয় – আর কিছু আনবেন না প্লীজ। এই ছেলেটা যা পেটুক, ও সমস্ত দোকান খেয়ে নেবে। তারপর আর চলতে পারবে না।
বিগলিত প্রৌঢ়টি যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন আমি তাঁর ঢোলা সাদা ইউনিফর্ম আর শুকতলা ক্ষয়ে যাওয়া পাম্প-শু দেখতে দেখতে নতুন ক্যানভাসের কেড্স পরা গুলাবোকে বললাম – তুমি সত্যি এগুলো পয়সা না দিয়ে নেবে?
চম্পাকলি ওরফে গুলাবো বসে ছিল কনট সার্কেলের দিকে মুখ করে। তার সামনে উন্মুক্ত আকাশ। আমার সম্মুখে খোলা ছাদ। আমি তাকে পাশ থেকে দেখছি। সে অপাঙ্গে আমায় এক ঝলক দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, যার অর্থ – বড়োদের ব্যাপারে তুই নাক গলাচ্ছিস কেন? যা পেয়েছিস চুপচাপ খা।
চুপচাপ খেতে শুরু করলাম। পম্পা ইশারায় আমাকে স্যাণ্ডউইচ আগে খেয়ে নিতে বলেছিল। বুঝলাম, সে চাইছে যাতে সেটা ফেলা না যায়। পরে বোঝা গেল প্ল্যান একটু আলাদা, কারণ পাশ থেকে খানিকটা ছিঁড়ে নেবার পর তার স্যাণ্ডউইচও সে আমার পাতে পাস করে দিয়েছিল, যেন তারটা সে শেষ করেছে এবং যা পড়ে আছে সব আমারই না খাওয়া অংশ।
বাবা খড়ক সিং মার্গ থেকে হাওয়া এসে কপাল আর ঠোঁটের উপরে জমা ক্লান্তির চিহ্নগুলো মুছে দিচ্ছে। আমি আমার সামনের খোলা ছাদে বসা বুড়োদের দলটাকে দেখছিলাম, যারা রাম্মির ফাঁকে ফাঁকে ঘোড়ার রেসের বেটিং নিয়ে হিসেব কষছিল। মাঝে মাঝে সেগুলো একটা খাতায় টুকে ফেলা হচ্ছে। কেন জানি না আমি বুঝেছিলাম এই হাওয়াই শার্ট, চামড়ার চটি, পুরু সোনার আংটি, রোমশ দেহ, আর গালি-গলৌজে অলঙ্কৃত বদজবান ভাষার অধিকারী চরিত্রগুলো অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসাদার। গোল মার্কেট আর কনট প্লেসে যে দোকানগুলো এরা কুড়ি বা তিরিশ বছর আগে বাড়ির গয়না আর বাসন বিক্রি করে দাঁড় করিয়েছিল সেগুলো এখন সাফারি স্যুট পরা নতুন প্রজন্মের হাওয়ালে, যারা ইচ্ছে করলে ইম্পালা গাড়ি কিনতে পারে, কিন্তু যাতায়াত করে বাজাজের স্কুটারে। বুড়ো বাবারা দোকানে একবার ঢুঁ মারার পর এখানে বসে তাদের মটকা আর রেসের বাজিগুলো ধরে, এবং সন্ধ্যে হলে কাকেদা’র মুরগী ধ্বংস করে হুইস্কির সন্ধানে বেঙ্গলি মার্কেটের কোনো আড্ডায় উপস্থিত হয়। এদের মধ্যে ধবধবে সাদা কুর্তা পরা সবচেয়ে শৌখীন লোকটা কারো ছেড়ে যাওয়া খালি চেয়ারে পা তুলে বসে উর্দু পত্রিকা পড়ে চলেছে। হয়তো তার নিজেরই লেখা গজল। আমি সেই লোকটা হতে চেয়ে এই জিনভর্তি শহরের কাছে নিজের জন্য একটা সহজ ও মুনাফেদার ব্যবসা ভিক্ষা করছিলাম।
আমার বান্ধবী এমনভাবে বসেছে যে আমি ছাড়া তার মুখ কেউ দেখতে পাচ্ছে না। সে তাকিয়ে ছিল রিভোলির উপরের আকাশের দিকে। - জয়, তুই কি কোনো কঠিন বিপদে পড়েছিস? সে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে। কীভাবে যেন সে বুঝেছিল তার কাছ থেকে একটা কিছু লুকোবার জন্য আমি কখনো যক্ষ আর কখনো জিনের গল্প বলে আমাদের দুজনকেই সারাদিন ভুলিয়ে রেখেছি।
আসলে গত তিন সপ্তাহে যে কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছি সেগুলো তাকে কোনো ঠাণ্ডা বাতাবরণে বসে শোনাব বলে এতক্ষণ কনট প্লেসে ঘুরেছি যুৎসই জায়গার খোঁজে। এই কাণ্ডগুলোর মধ্যেই কি রয়েছে আমার কঠিন বিপদের ইঙ্গিত? তাহলে পম্পার জানা উচিত, কারণ আমার বিপদ তার ঘাড়েও আপদ হয়ে নামতে পারে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করি?
গলা খাঁকারি দিয়ে ঢিল ছুঁড়লাম একটা – ছোটবেলায় শিমলিপুরে আমার খেলার সঙ্গী ছিল তারাবাঈ নামের একটা নীল চোখের মেয়ে।
কাহারের মেয়ে তারার পুরো নাম হল নীলীতারা। অজানা কারণে তার দুটো চোখের মণিই ছিল নীল। তারার সঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহে আমার একটা গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সম্পর্কটা বিজনেস পার্টনারি, অর্থাৎ লেনদেনের, এবং সেটা নিঃসন্দেহে অবৈধ আর সম্ভবত বেআইনি।
গুলাবো-জান হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – এইরকম একটা মেয়ে তোকে একদিন আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে আসবে। সেটার জন্যই তৈরি থাকতে বলছিস। তাই না?
আলোচনা অন্য পথে চলে যাচ্ছে বুঝে তাড়াতাড়ি বললাম - আমি একটা বাছুর নাকি, যাকে যে কেউ খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে নিতে পারে?
- এরকম তো হয়। নইলে তুই ওর নীল চোখের কথা বলবি কেন? ও কি তোর বয়সী?
- আরে বাবা, আমার চেয়ে তিন-চার বছর বড়ো। একটা বর আছে, নাবালক হলেও যে যথেষ্ট কাজের। পম্পাকে শান্ত করার জন্য বললাম। - প্রবুদ্ধদের ড্রাইভার স্যামসন লিম্বু এই যক্ষ-যক্ষীর জন্য ইধর-কা-মাল-উধর করে। এই সব চরিত্ররা, যাদের তুমি আইটেম বলতে পারো, একটা ভিন্ন পৃথিবীতে থাকে। গুলের পৃথিবী। সেখানে অ্যানাস্থেসিয়া ছাড়া বেবাক সার্জারি হয়। একটা নদী নিয়মিত লাশ দিয়ে যায়। বৃদ্ধরা মরবে বলে খাওয়া বন্ধ করে। সেখানে ভূষণ বলে একটা পাকিস্তানের স্পাই আছে, যার সঙ্গে এক দল ছেলে আজ রাতে একটা অবাস্তব দুনিয়ায় নকল ভেড়িয়া শিকার করতে যাবে। সেই অবাস্তব কলোনিতে আমার দাদু, আমার জন্মেরও পাঁচ বছর আগে ঠিক করে ফেলেছিলেন তাঁর ছেলে-মেয়েরা কেউ সেখানে থাকবে না। তুমি বা আমি সেই পৃথিবীর নই। আমার একটা ছায়া শুধু সেখানে আটকে গেছে যতদিন না মায়ের ফ্ল্যাটটা তৈরি হয়।
- জয়, তুই পার্কটাউনে আমাদের বাড়িতে এসে থাক না? মা-বাবাকে রাজি করিয়ে নেব। আমার তো মনে হয় খুব খুশি হবে ওরা।
- পারলে রাজি করাও। কিন্তু তুমি নিজেই যখন দিল্লীতে থাকবে না তখন আমাকে আমার কলোনির হাত থেকে বাঁচাবে কে?
পরে কফি হাউসের বরফ দেওয়া ঠাণ্ডা কফির সামনে বসিয়ে এক এক করে এই গরমের ছুটির ঘটনাগুলোর সঙ্গে আমার অগ্রজা ও অভিজ্ঞতায় বড় বান্ধবীকে ওয়াকিবহাল করতে শুরু করি। সে যখন স্ট্র দিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল, তখন আমার লুকোনো দুষ্মন্তের চোখ পাশ তাকে শকুন্তলার মতো দেখছিল আর কল্পনা করছিল যে কফির সঙ্গে স্ট্র বেয়ে তার ঠোঁটের ফাঁক গলে আমি নিজেই তার শরীরে ঢুকে পড়ে নিজেকে ঠাণ্ডা করে নিচ্ছি। গল্পগুলো শোনাবার পর পম্পাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম – এবার বলো আমার কি কোনো বিপদ হতে পারে?
পম্পা দুহাতের উপর থুতনি রেখে শুনছিল। সে সোজা হয়ে বসে বলে – জয়, তোকে একটা কথা রাখতেই হবে। ওই বদমাইশ ডাক্তার বাজাজটার সঙ্গে আবার যদি কোনোদিন দেখা করতে যাস তাহলে টোটো কিংবা অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাবি।
আমি বললাম – গতবারও তো আমার বন্ধু দুফিকে নিয়ে যেতে চাইছিলাম। বুড়ো আমাকে গায়ের জোরে গাড়িতে ঢুকিয়ে নেয়। সেটাই যদি আবার করতে চায় তাহলে কি ওর গলায় ঘুঁষি মেরে দেব? সার্জেন সাজলে কী হবে, রিফ্লেক্স খুব স্লো, সে আটকাতে পারবে না।
পম্পা ক্ষেপে গিয়ে বলল – ছাগল হয়ে গেছিস নাকি? খবরদার! নো মারামারি। এই গরমের ছুটির বাকি কটা দিন আমার সঙ্গে নিরাপদ হয়ে থাকবি। তারপর শুধু স্কুল আর বাড়ি। বরং, মিস্ তারার সঙ্গে তুই থাকলে আমার চিন্তা কম। বাজাজের চেয়ে সে অনেক গুণ সুস্থ।
তারপর একটু থেমে সে বলে – কিন্তু, নীল চোখওয়ালীটাকে নিয়েও তো সমস্যা।
আমি বললাম – আমার মতে একটুও না।
- কেন? তিন সপ্তাহে এত কাণ্ড করে ফেলেছিস, তিন বছর নিজেকে কী করে সামলাবি সেটা বুঝিয়ে দে। পম্পা কনুইতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো মুষ্টিবদ্ধ দুহাতের সেতু থেকে চিবুক তুলে বলল - আমি চণ্ডীগড়ে গিয়ে নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করতে পারি যাতে।
এর কী জবাব দেব? আমাদের প্রৌঢ় বেয়ারা বুড়োদের টেবিলে গিয়ে গ্লাস আর কাপগুলো তুলে জায়গাটাকে তাশ খেলার উপযোগী করে দিচ্ছিল। বুড়োরা কেউ তিনটে আধুলির, কেউ একটা টাকার বকশীশ নামিয়ে রাখছে। সব মিলিয়ে এই টেবিল থেকে নিয়মিত আট দশ টাকার টিপ্স্ নির্গত হয়। তাও এরা কোনোদিন একটা ফাউ স্যাণ্ডউইচ পেয়েছে কিনা সন্দেহ।
সাদা কুর্তা পরা লোকটা পত্রিকা থেকে চোখ না সরিয়ে একটা দশ টাকার নোট, একটা খালি গোল্ড ফ্লেক ফিল্টারের প্যাকেট, আর তার শেষ সিগারেটটাও উপহার হিসেবে রেখে দিয়েছে টেবিলে। বেয়ারাকে কিছু বলতে হয়নি, সে জানে তাকে একটা নতুন প্যাকেট এনে দিতে হবে। আমি শৌখীন লোকটাকে ভালো করে দেখে বুঝতে চেষ্টা করলাম লাহোরে সে কোনো সঙ্গিনীকে ফেলে এসেছিল কিনা। নইলে, সকলের মধ্যে বসেও সে এরকম আলাদা হয়ে আছে কেন?
পম্পা আর আমার জন্য একটা করে লিমকা আনালাম। যতক্ষণে সেটা এল ততক্ষণ আমি ভাবছিলাম নিজের সব কথা কি বলা উচিত? সেটা কি সুস্থ, বা একটা বয়স্ক মানুষের মতো কাজ? কিন্তু গল্পের কোনো অধ্যায় অনুক্ত রেখে দিয়ে আমি স্বস্তি পাই না।
আমাদের কোণের টেবিলে আমরা সবার থেকে দূরে আকাশের দিকে মুখ করে বসে ছিলাম। লিমকা খেতে খেতে আমি পম্পাকে বললাম – তুমি তো জানো আমি তোমাকে একটা দুশ্চরিত্র দুষ্মন্তের মতো সব দিক থেকে লুকিয়ে দেখি।
পম্পা মুখার্জির মুখ অন্যদিকে মুখ ফেরানো। সে আড়চোখে আমাকে দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে - সবাই টের পায়। শকুন্তলাও জানত।
- এটা আমি কেন করি জানো?
- মহা দুশ্চরিত্র, তাই। তারপর দিল্লীওয়ালী আমার মুখোমুখি হয়ে বসে বলল - অন্য কারণ থাকলে দিল্লী ছাড়ার আগেই জানাস। পরে যদি মনে না থাকে?
এক ঢোঁক শীতল পানীয় গিলে ফেলে আমি বললাম - আচ্ছা। আজই বলে দিচ্ছি তাহলে। দয়া করে পাগল ভেবো না আমায়। আমার মনে হয়, কালিদাসের জায়গায় আমি হলে দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার গল্পটা একটু অন্যরকম হত। আমার গল্পে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে লুকিয়ে দেখত, কিন্তু কখনো স্পর্শ করত না। তারপর একদিন যখন শকুন্তলা ঘুমোচ্ছে, তখন দুষ্মন্ত চুপিচুপি গিয়ে শকুন্তলার নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে তার শরীরে ঢুকে পড়ে হারিয়ে যেত। তাকে আর কেউ খুঁজে পেত না। অনেক অনুসন্ধানের পর অমাত্য আর আখেটের সঙ্গীরা হতাশ হয়ে ফিরতে বাধ্য হত রাজধানীতে। শুধু শকুন্তলা বুঝতে পারত দুষ্মন্ত কোথায়।
- এর মানে কী? তুইও কি আমার মধ্যে ঢুকে পড়তে চাস?
- আমি তোমার নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে তোমার বডিতে ঢুকে পড়তে চাই কি? হ্যাঁ। আমি তোমার মধ্যে ঢুকে তোমার মতো করে আস্তে আস্তে লিমকা খেতে চাই। তোমার নখ দিয়ে টেবিলের মাথায় বিলি কাটতে চাই। তোমার গাঢ় বাদামি মণি দিয়ে চোখের প্রত্যেকটা কোণ ছুঁয়ে আসতে চাই। তোমার কান দিয়ে আমি তোমার পছন্দের গানগুলো শুনতে চাই। তোমার চোখ দিয়ে এই ধুলো আর পাথরের শহরটাকে দেখতে চাই। তোমার মন দিয়ে শবানের দিনগুলোকে উপভোগ করতে চাই। তোমার মতো চেয়ারে বসার আগে সাবধানে পোষাক সমান করে নিয়ে তোমার জিভ দিয়ে ঠাণ্ডা কফির স্বাদ পেতে চাই। তোমার রক্তের ভিতরে ঢুকে, তোমার হাত ব্যবহার করে কপালের চুল সরিয়ে, তোমার গলায় শুধু নিজেকে শুনিয়ে খুব আলতো করে বলতে চাই – …মাই…নেম…ইজ…পম্পা…! যাতে আর কোনোদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে না হয়। তারপর তোমার হালকা সুতির স্কার্ট আর ব্লাউজের ভিতর তোমার মতো চুপ করে বসে নিজের বুকের আওয়াজ শুনতে চাই। আমি তোমাকে লুকিয়ে যখন দেখি, তখন এই কথাগুলোই আসলে ভাবি...।
সময়ের পাগলা ঘোড়া থেমে গেছে। আর বলা হল না আমার।
পম্পা নিঃশব্দে ঝর ঝর করে কাঁদতে শুরু করেছিল।