মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জালের ক্রমবর্ধমান প্রসার এবং দ্রুত অগ্রগতি মানুষকে অনেক বেশি জ্ঞানতৃষ্ণ করে তুলেছে। বিশেষত, পারস্পরিক যোগাযোগ ও নানাবিধ তথ্যের প্রাবল্য, মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল--এ সমস্ত কারণে বিশ্বের বহু মানুষের কাছেই আন্তর্জাল আজ এক প্রয়োজনীয় মাধ্যম। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ ইনটারনেট-এ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন, লিখছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা, পেশ করছেন নতুন তথ্য, ছবি আঁকছেন, শোনাচ্ছেন ও শুনছেন নিত্যনতুন সঙ্গীতপ্রবাহ, এমনকি সচল চিত্র পর্যন্ত পেশ কছেন এবং উপভোগ করছেন। অবশ্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্যে পূর্ণ তথ্যের এই ভাণ্ডারটি অতি বৃহৎ, এবং ততোধিক অগোছাল। মনে করুন, দাঁড়িয়ে আছেন ন্যাশনাল লাইব্রেরির দ্বারপ্রান্তে, লাইব্রেরির প্রতিটি বইয়ের প্রত্যেকটি পাতা আলাদা করে স্তূপাকৃতি আকারে লাইব্রেরির যত্রতত্র ছড়ানো ছেটানো। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক দিন, অসংখ্য নতুন তথ্যপূর্ণ ছেঁড়া পাতা যুক্ত হচ্ছে সেই সব স্তূপ-এর উপর। স্তূপাকৃতি সেই জ্ঞানভান্ডারের মধ্যে আপনাকে খুঁজে নিতে হপবে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য, এবং বলা বাহুল্য, সে বড় সহজ কাজ নয়। কোথাও কোন ঠিক নেই, যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা গল্প, প্রবন্ধ, সংবাদ, স্থির এবং চলমান চিত্র, সংগীত ইত্যাদির মধ্যে থেকে যে আপনি চাইছেন, শুধুমাত্র সেই তথ্যটুকুই বেছে নেওয়া অতীব দুরূহ, প্রায় অসম্ভব বললেই হয়। আন্তর্জালের সমস্যাটি অনেকটা সেই রকম, কিন্ত সৌভাগ্যের বিষয়, তার একটি সামান্য সমাধানও আছে। আন্তর্জালের বিভিন্ন বিন্দুতে ছড়িয়ে আছে নানাপ্রকার আন্ত(র্জাল) সন্ধানী (search engine), এবং এই সব অনুসন্ধানী প্রোগ্রাম আন্তর্জালে সঞ্চরমান গবেষকের পরম মিত্র। যে কোন বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করার প্রয়োজন? Yahoo (http://www.yahoo.কম) দিয়ে শুরু করুন। এর পর বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে….। এমনকি, শুধুমাত্র ভারতবর্ষের জন্যে-ও রয়েছে একটি স্বতন্তর্য আন্তর্সন্ধানী “খোঁজ” (http://www.khoj.কম) নামে। সুতরাং, excite (http://www.excite.কম), altavista (http://www.altavista.কম), বা infoseek (http://www.infoseek.কম) –এর দৌলতে আন্তর্জালে বিচরণ এবং জ্ঞান সঞ্চ্যন করতে বাধা কোথায়?
প্রশ্নটি একটু অন্যভাবে করা যাক। জানার অসীম আগ্রহে, হয়তো বা পারস্পরিক মেলবন্ধনের তাড়নায় আমরা আন্তর্জালকে বেছে নিয়েছি ভাষা এবং ভাব প্রকাশের বাহন রূপে ও সেই সূত্রে ক্রমবর্ধমান জ্ঞান ভাণ্ডার রূপে উপস্থাপিত হয়েছে ইনটারনেট। কিন্তু আমাদের প্রালব্ধ তথ্য কতখানি নির্ভেজাল? আমরা যা জানছি তা সত্যিই যথার্থ তো? তথ্য প্রকাশের সনাতন মাধ্যম বলে বই, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র ও প্রবন্ধ সংকলন-কে আমরা স্বীকার করে নিয়েছি। এমন নয় যে বই মানেই নির্ভেজাল, সর্বদা সৎ এবং নিষ্ঠ তথ্যের উৎস। বইয়ের মধ্যেও অসৎ মানুষ তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছেন, এবং সে সব ধরাও পড়েছে বহুবার। কিন্তু আন্তর্জাল এক নতুন মাধ্যম। এর বিকাশ ঘটছে প্রতিনিয়ত। যে কেউ, যখন ইচ্ছা তাঁর বক্তব্য পেশ করতে পারেন ইনটারনেট-এ। তার সবটুকু খাঁটি না হলেও চলবে। বই, চলচ্চিত্র ইত্যাদি সনাতন মাধ্যমের এমন কয়েকটি বিষয় আছে, যা আন্তর্জালে প্রকাশিত কোন বক্তব্যের ক্ষেত্রে অপ্রযোজ্য। বই লিখতে হলে লেখকের একজন প্রকাশকের প্রয়োজন, যিনি বই ছাপতে আগ্রহী হবেন, একজন সম্পাদকেরও প্রয়োজন আছে। তারপর রয়েছে সেই বইয়ের সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ। পুরো ব্যাপারটি অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ব্যায় সাপেক্ষ। নানা কারণে সাধারণ মানুষের কাছে বই এবং চলচ্চিত্র বেছে নেওয়ার একটা সুযোগ থাকে, এবং তাদের উৎকর্ষতার একটা নিরপেক্ষ মাপকাঠি-ও খুব দুর্লভ নয়। কিন্তু ইনটারনেট-এ প্রকাশিত তথ্যের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি পুরোপুরি খাটে না। ইনটারনেট-এ কোন বক্তব্য প্রকাশ করতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন নেই, এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই বহু পাঠকের কাছে নিজের বক্তব্য পেশ করাও খুব কঠিন নয়। তৃতীয়ত, আন্তর্সন্ধানীর কল্যাণে যখন কোন বিষয় লেখা একটি আন্ত(র্জাল) পত্র (web page)-এর সন্ধান পাওয়া গেল, পাঠকের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে সেই পত্র বা page-টি কতখানি খাঁটি তথ্যে পূর্ণ। পাঠকের পক্ষে ঐ বিষয়ের উপর বহু তথ্যপূর্ণ সন্ধান পেলেও সেই সব তথ্যের উৎকর্ষতার ভিত্তি সম্বন্ধে নি:সন্দিগ্ধতার অবকাশ সচরাচর থাকে না।
আন্তর্জালে প্রকাশিত বিষয়সমূহের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়: কয়েকটি যেমন গুরুগম্ভীর আলোচনা ও জটিল বিষয় নিয়ে, যেমন নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন (http://www.nejm.অর্গ), কয়েকটি পাতা দৃষ্টিনন্দন এবং ভ্রমণ জাতীয় উপভোগ্য বিষয় নিয়ে তৈরী, যেমন ন্যশনাল জিওগ্রাফিক (http://www.nationalgeographic.com/features/96/selway/index.হটমল) –এর এই পাতাটি। আবার কয়েকটি বিষয়বস্তু শুধুই হাস্য পরিহাস এবং চুটকি জাতীয় বিষয়ে ভরা। এবং সেই কারণে কোন একক মান নির্দ্দিষ্ট করা প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জালে প্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য বিষয়ের উৎকর্ষতা নিয়ে এইজাতিয় বিতর্ক নতুন নয়। ম্যাসাচুসেট্সের ব্যাবসন কলেজের লাইব্রেরিয়ান, হোপ টিলম্যান-এর মতে, সাধারণ ভাবে পাঁচ বা ছটি মাপক নির্ণয় করা যেতে পারে যে কোন আন্ত(র্জাল) স্থল বা website-এর মান নির্ধারণে--এক, কি উদ্দেশ্যে আন্তর্স্থল-টি তৈরী সেই বিষয়ে যোগ্যতা, তিন, ঐ একই বিষয় নিয়ে অন্য সমকালীন প্রাপ্য আন্তর্স্থল বা অন্য মাধ্যমে প্রকাশিত লেখার সঙ্গে সামঞ্জস্য, চার এই স্থলে প্রণীত তথ্যাবলী কতখানি স্থিতিশীল, এবং যে ধরণের সফট্ওয়্যার-এর প্রয়োজন তা কতখানি প্রযোজ্য (Tillman, http://www.tiac.net/users/hope/findqual.হটমল). টিলম্যান-এর মাপকাঠি অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই বহু ছাত্র বা গবেষক, বা যাঁরা নেহাত শখের জন্য আন্তর্স্থল তৈরী করেন, তাঁদের লেখা website-এ মূল্যবান বস্তু থাকলেও তার অবমূল্যায়ন হওয়ার সুযোগই বেশী, কেন না এঁরা অনেকেই সেভাবে পরিচিত নন। দ্বিতীয়ত, প্রধানত দুই ভাবে আন্তর্জালে তথ্যের আদান প্রদান হয়--নীরস, শুধুমাত্র লেখার মাধ্যমে অথবা ছবি, লেখা কখনো সংগীত, ইত্যাদির বর্ণময় সংমিশ্রণে (যেমন এই আন্তর্স্থল-টি)। সেক্ষেত্রে কী হবে তাদের মান নির্ধারণের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত মাপকাঠি? বই এবং জার্নালকে যেভাবে নির্ণয় করা হয়, সেইভাবেই ইনটারনেটকে মাপতে চেয়েছেন অনেকে। টিলম্যান-এর মাপনির্ণয়ের উপর আর একটি মাত্রা যুক্ত করেছেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লিজা ইঞ্চলিফ। তথ্যের যথার্থ এবং স্থিতিশীলতা ও লেখকের যোগ্যতা ব্যতিরেকে তাঁর মতামত অনুযায়ী, আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত, আন্তর্পত্র তৈরীতে কতটা সম্ভাব্য পাঠকের কথা ভেবেছেন লেখক? এ ছাড়াও আছে খরচার হিসেব। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় বা অফিসের সূত্রে ইনটারনেট পড়েন, অনেকেই অর্থ ব্যায় করেন আন্তর্জাল সেবা বা interenet service নেবার জন্য। কোন কোন ক্ষেত্রে অনেককে প্রতিমাসে ঘন্টাপিছু অর্থ গুনতে হয় ইনটারনেট-এ থাকবার কারণে। সেই জন্য তথ্যপূর্ণ একটি পাতা কত দ্রুত আন্তর্স্থল-এ পাঠানো যায়, সেই ব্যাপারটিকেও হিসেবের মধ্যে রাখার যুক্তি পেশ করেছেন হিঞ্চলিফ (Hinchcliffe, http://alexia.lis.uiuc.edu/janicke/Evalutae.হটমল)। মাপ নির্ণায়নের আরও বিস্তৃত, প্রায় রন্ধনপ্রণালীর মত করে প্রশ্নাবলী তৈরী করেছেন Purdue বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান স্কোলত্স্ (Ann Scholz) (http://thorplus.lib.purdue.edu/library_info/instruction/gs175/3gs175/evaluation.হটমল)। তার সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে আন্তর্জালে কপিরাইট সংক্রান্ত বিতর্ক (http://www.benedict.com/internet.হটমল) ।
লক্ষণীয় বিষয়, আন্তর্স্থলের মান নির্ধারণের মাপ আর কেবলমাত্র তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে সীমিত নেই। তার একটা বাণিজ্যিক প্রয়োজনও দেখা দিয়েছে। আন্তর্জালের অসামান্য বিস্তারের পথ বেয়ে আন্তর্স্থলের মান নির্ণয় করতে একাধিক বাণিজ্যিক আন্তর্সন্ধানী এবং সংস্থা এগিয়ে এসেছেন। অনেক ‘স্থল’-এই তাই দেখা যায় lycos top 5 percent (http://point.lycos.com/categories/index.হটমল). Magellan (http://www.mckinley.com/magellan/) বা Argus (http://www.clearinghouse.net/) –এর ছাপ। কিসের ভিত্তিতে কয়ার এই ক্রমিক স্থান নির্ণয়? Lycos(http://www.lycos.com/help/top-5help2.হটমল) এবং Argus (http://www.clerainghouse.net/ratings.হটমল) উভয় তরফেরই মান নির্ণয়ের-এর ভিত্তি বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা এবং উৎকর্ষতা কে কেন্দ্র করে। কিন্তু বিষয় বস্তু যতই বর্ণময় হোক না, তা কতখানি সত্যনিষ্ঠ সেই প্রশ্ন রয়েই গেছে। সেই ব্যাপারে সচেতনতার দায়িত্ব আমাদের সকলের উপর।
আন্তর্জালের নিরীখে দীর্ঘ ২৭ বছর পরে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ আন্তর্জাল ঠিকানা তামাদি হয়ে গেছে। তাই সেগুলিকে পুরোনো নামেই নিষ্ক্রিয় করা হল -- সম্পাদক [এপ্রিল, ২০২৪]