কেউ কেউ নিজেদের জন্যে একটি ধর্ম প্রণয়ন করেছেন এবং তার ভিত্তিতে নিজেদের identity প্রদান করেছেন, যেমন ইহুদীরা। কেউ ত্বকের রঙের ভিত্তিতে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন, কেউ ভৌগোলিক স্তরে ব্যাপারটাকে দেখেছেন, কেউ আবার ভাষার ভিত্তিতে দেখেছেন identity-র সমস্যাটিকে। Identity যদি ধর্মের ভিত্তিতে হয় তাহলে তার মধ্যে sub-identity বা সংকীর্ণতার অনু-পরিচয় হয়তো ভাষার ভিত্তিতে হয়েছে। আবার এর উল্টোটাও হয়েছে।
মানবসভ্যতা যতই জটিল রূপ ধারণ করছে, ততই একই মানুষের বা একই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন identity-এর ছাপ পড়তে শুরু করেছে। যেমন বাঙালী সুন্নি মুসলমান যাঁরা সুর্মা উপত্যকা থেকে আগত। যেমন বাঙালী বৌদ্ধ যাঁরা আসাম বা গোয়ালপাড়া থেকে আগত, যাঁরা নিজেদের চট্টগ্রাম থেকে আগত বাঙালীদের আলাদা ভাবেন। আবার এই দুই গোষ্ঠীর বৌদ্ধরাই নিজেদেরকে চাকমাদের থেকে আলাদা ভাবেন। কিন্তু যখন ধর্মভিত্তিক বিভাজনের প্রশ্ন আসে এঁরা কিন্তু একই বর্গে নিজেদেরকে দেখতে চান। ভারতীয় মুসলমানেরা বাঙলাদেশ বা পাকিস্তানের মুসলমানদের থেকে নিজেদের আলাদা করে ভাবেন এবং চিন্তা চেতনা ও মতাদর্শে নিজেদেরকে অন্য গোত্রের ভাবেন, কিন্তু আবার ধর্মীয় প্রশ্নে এঁরা সবাই মুসলমান। ভারতের শিয়ারা লাহোরের হত্যাকাণ্ডে কষ্ট পান কিন্তু আবার ভারত পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে ভারতের পক্ষ নেন।
Sub-identity-র ঝামেলা কিন্তু স্তরবিন্যাসের প্রশ্ন। এক একটি স্তরের প্রশ্নের সামনে এক এক ধরণের গোষ্ঠীভুক্ততা জন্ম নেয়। তাই বাবরী মসজিদ বিতর্কে সব মুসলমান এক জায়গায় দাঁড়ান, লাহোরের হত্যাকাণ্ডে সব শিয়ারা এক জায়গায় দাঁড়ান আবার ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে সব বাঙালী মুসলমান বাঙলার পক্ষে দাঁড়ান।
মজাটা হচ্ছে, বিশ্লেষণের জন্যে যতই জটিলতা এসে যায় ততই মানবসভ্যতা কোন না কোন icon-এর দিকে ঝুঁকে পড়ে। Icon তখন identity নির্ণয়ের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এক একটি গোষ্ঠী এক একটি icon-এর তলায় ঐকবদ্ধ হয়। রামায়ণ মহাভারতের মত epic-এ বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলো নিজেদের icon দ্বারা চিহ্নিত করেছিল। Old Testament-এ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলো এক একটি icon দিয়ে নিজেদের অন্যদের থেকে আলাদা করত। ইসলামেও কুরেশিরা অন্যদের থেকে নিজেদের আলাদা করবার জন্যে একধরনের পদবীর সাহায্য নিয়েছিল। তার পর বাঁধ ভেঙে গেল পদবী দিয়ে নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার। সৃষ্টি যতই বিশেষ থেকে বিশেষতর রূপ নিল ততই তা আরো বেশী করে icon- নির্ভর হয়ে উঠল, ‘আমরা’ এবং ‘তারা’-র বিভাজন করতে থাকল এবং বহুধা বিভিন্নতার মধ্যে নিজের identity-কে আরো জোর দিয়ে প্রকাশ করতে থাকাল; এর ওপর যে-কোন রকমের আঘাতকে মতাদর্শিক স্তরে আত্মজ করে নিল, আরো সচেতন হয়ে উঠলো identity রক্ষার প্রশ্নে। আজকের বাঙালী মুসলমান যখন নিজের নামকরণ করেন অমিতাভ সিরাজ তখন তিনি এটা ভালোভাবে জেনেই করেন যে অমিতাভ নামটি বৌদ্ধ myth-এর অন্তর্ভুক্ত। তবুও ওটাই তাঁর চাই কারণ ঐ রকম নাম অবাঙালীরা রাখবেন না। আবার তাঁর মুসলমান ঐতিহ্যটাও দরকার এই নিয়েই পরিচয়ের খেলা।
দ্বৈত থেকে অদ্বৈতর দিকে এগোনো একটা দর্শন বটে তবে দ্বৈতের হাজার বিশেষত্বের মধ্যে দিয়েই তো experimental journey বা অভিজ্ঞতা অর্জনের যাত্রা। এই যাত্রাই আমাদের বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটায়, আমাদের পৃথিবীর নতুন থেকে নতুনতর রূপের সাথে মোলাকাত করায়।
‘আর্য’ কথাটা ব্যুৎপত্তিগত অর্থে কিন্তু ‘ভদ্রলোক’ বা কোন উন্নাসিক বিভাজন নয়। আর্য (ঋ ধাতু ণ্যৎ প্রত্যয়) কথাটির অর্থ যে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে ভ্রমণ করে, বা নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে। আর্যসভ্যতা যা ভারতের বাইরে থেকে এসেছিল, ধরে নিয়েছিল যা তারা আরো বিস্তৃত হবে। ঠিক সেইরকম ভাবেই ইসলাম ও Syrian Orthodox Christianity এসেছিল ভারতে, কিন্তু তারা সবাই এখানে ঘাঁটি গেড়ে রয়ে গেছে। এখানেই যাত্রা শেষ করেছে। যখনই কোন সভ্যতা কোথাও থিতু হয় তখনই তার একটা নিজস্ব identity-র দরকার হয়ে পড়ে। চলমান জাতির এই প্রয়োজন কম। আর্যরা তাই ভেবেছিল যে নতুন identity-র আর প্রয়োজন নেই। প্রারম্ভিক পর্যায়ের ইসলামও তাই ভেবেছিল। কিন্তু তা তো আর হল না, নদীমাতৃক আলুলায়িত জমি (alluvial soil-এর এটা একটা ভালো আদুরে নামকরণ হতে পারে) সবাইকে নিজের বাঁধনে বেঁধে নিল। শুরু হল বাসস্থান ও বর্ধিস্থানের মাতৃকরণের প্রক্রিয়া। এসে গেল “জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী”, এসে গেল “এইখানে তোর দাদীর কবর”…, শুরু হল “খিড়কি দূয়ারের পুকুরকে মা গঙ্গা হিসেবে দেখা” আর “বিবির ঘাটের গসল কে ফোরকের পানি” হিসেবে জ্ঞান করার। জান হওয়া ভিটে যাওয়ার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হল কারণ “ঐখানে তোর দাদীর কবর…”, ঐখানেই যে “চোদ্দ পুরুষের পদচিহ্ন”।
জননী জন্মভূমির সাথে সাথেই আসে সমস্ত আনুষঙ্গিক স্মৃতি ও icon. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসে মাতৃভাষা। কারো কারোর কাছে identity-টা শুধুই ধর্মের বা জাতের। অনেক বিবদমান ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় যে নিজেদের জন্মের সময়ের ধর্ম দিয়েই নিজেদের পরিচয় দেয় তারা। কারোর কাছে আবার ভাষাটাই প্রধান। এই প্রধান- অপ্রধান নির্ভর করে জাতিটির বিকাশের ইতিহাসের উপর।
গান্ধীজি নিজের ভাষাকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও কুন্ঠা বোধ করেননি। জিন্না নিজের ভাষা (গুজরাটি)-কে হেলায় অস্বীকার করতে দুবার ভাবেননি, উর্দু ছিল তাঁর কাছে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র মাত্র, এর বেশী কিছু নয়। কথাও বলতেন না ঐ ভাষায়। পড়তে পারতেন না, শিক্ষক নিযুক্ত করেও পড়তে শেখেন নি। তাঁকে ইংরেজি অক্ষরে লিখে দিতে হত। অন্যদিকে, অনেক বাঙালীর কাছে মাতৃভাষার ওপরে আর কিছুই হয় না, হতে পারে না। এমনকি বঙ্কিমও তাঁর ‘বন্দেমাতরম’ মৈথিলি ও বাঙলা ঘেঁষা সংস্কৃততে লেখেন। এই ব্যাপারটা পুরোটাই জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাসের ওপর নির্ভরশীল। বাঙলাসভ্যতা শুরুই হয় ভাষাকে ভিত্তি করে, বিভিন্ন ধর্মের সম-অবদানের মধ্যে দিয়ে। প্রথমে বিদ্রোহী বৌদ্ধ, তার পর অস্বীকৃত অন্ত্যজ হিন্দু, তার পর স্বাধীনচেতা বাগী মুসলমান, তারপর ক্রিশ্চান মিশনারি, তারপর আর্যাবর্ত- দ্বারা- লাঞ্ছিত উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং আর সবাইকার এই ভাষা তৈরী করেছে এমন এক সভ্যতা যেখানে ভাষাই একমাত্র মাতৃদুগ্ধ।
জাতি গঠনের ইতিহাসে এটা একটা অদ্ভুত প্রাকৃতিক নিয়ম। কোন কোন জাতিগোষ্ঠী ধর্মকে ভাষার চাইতে বেশী গুরুত্ব দেন কেউ আবার ভাষাকে সবার ওপরে স্থান দেন। এখন ভাষাকে ধর্মের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়েছে। ভারতে বিজেপি হিন্দীকে হিন্দুত্বের সঙ্গে মেলানোর প্রয়াস করছে, আর বাঙলাদেশ জামাত বাঙলাকে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা করছে। এই হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিভাজনকে প্রস্তুরীভূত করার মোক্ষম প্রয়াস--যা একপ্রকার বৃটিশ যুগ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া।
অবশ্য বাঙলাকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের সাথে জুড়ে দেওয়া বেশ ঝামেলার--হিন্দুত্ববাদীরা সেটা বুঝে গেছেন। তাই হিন্দুত্বর স্লোগানগুলোকে হিন্দীতেই লিখতে হয়। কি আর করা, বিজেপি-র তো আর নজরুল বা মধুসূদনকে বাদ দিয়ে বাঙলা গড়া সম্ভব নয়, একইরকমভাবে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দকে বাদ দিয়েও কি বাঙলা সম্ভব?
বাঙলাভাষা বাঙালী সংস্কৃতি ও বাঙলার ইতিহাসকে ধরে রেখেছে। এটা খুবই অনবদ্য, আনোখা, unique. বাঙলার যাবতীয় মানবিক ও সামাজিক বিকাশ গড়ে উঠেছে বাঙলাভাষাকে কেন্দ্র করে। তাই বাঙলাভাষা একটা গর্ব, একটা ঐতিহ্য, একটা মর্যাদা, একটা স্লোগান হিসেবে একাকার হয়ে উঠেছে। যখনই কোন কিছু একটা জাতির আবেগের বিষয় হয়ে ওঠে তখনই একটা unifying icon-এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর এই icon-ই আবার নতুন করে জাতিকে ঐকবদ্ধ করে এবং নতুন করে নিজেদের গর্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়, অর্থাৎ আবেগের স্ফুলিঙ্গ আবেগের দাবানল সৃষ্টি করে। আবেগ থেকে আসে স্বপ্ন, আর স্বপ্ন নতুনকে সৃষ্টি করে। ভাষা আমাদের কাছে এমন একটা আবেগ।
এ ধরনের identity কিন্তু প্রায় সর্বদাই কোন না কোন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আসে, আর এই সংগ্রামের থেকেই কোন না কোন ছেঁড়া তমসুকের অংশ একেকটা icon-এ পরিণত হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সুভাষ বোস হলওয়েল মনুমেন্ট্-কে এরকম একটা icon-এ পরিণত করেছিলেন। গিরীশবাবুর দৌলতে আমরা পলাশীর প্রান্তরকে একটা icon হিসেবে দেখেছিলাম। ঠিক এরকমই একটা icon হয়ে উঠলো একটি দিন, একটি তারিখ--একুশে ফ্রেব্রুয়ারি। ঐ দিন ঢাকা শহরে ছাত্রদের ওপর গুলি চলেছিলো, আন্দোলন ছিল বাঙলা ভাষার স্বীকৃতির। বাঙলা ও বাঙালীর কাছে একুশে ফ্রেব্রুয়ারির মূল্য কী, তা কীভাবে সংগ্রাম-এর আগুনে শুদ্ধ হয়ে একটি জাতির icon হয়ে উঠেছে বোঝার জন্য এর ইতিহাস আরেকবার স্মরণ করা দরকার।
রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার--এই নামগুলো আজকাল দুই বাঙলার প্রায় সবাই যাঁরা কাগজ পড়েন তাঁদের কাছে জানা। মজাটা হচ্ছে এঁদের প্রত্যেকেরই পৈতৃক ভিটে ছিল মুর্শিদাবাদ জেলায়। ৪৭-এর ভাঙা স্বাধীনতা যখন বাঙলাকে ভেঙে দু টুকরো করল, এঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে গিয়েছিলেন।
৪৮ সালে জিন্না সাহেব পুরাতন পল্টন ময়দানে বক্তব্য রাখলেন যে “Urdu, only Urdu will be the national language of Pakistan.” জিন্না নিজে উর্দু শিখেছেন তার কয়েক বছর আগে। তখন উর্দু লিখতে পারেন না। নিজে গুজরাটি ইসমাইলি খোজা হয়ে তিনি দেখলেন ভারতীয় মুসলমানদের উর্দুর পিছনে ঐকবদ্ধ করা যায়, কারণ পাকিস্তানের কোন জনজাতির ভাষা উর্দু নয়। জিন্না সাহেবের পাকিস্তানের আন্দোলনের পিছনে কিন্তু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর (যেগুলো নিয়ে পাকিস্তান গড়ে উঠেছে) কোন সমর্থন ছিল না, এইসব প্রদেশগুলোকে একটা সাংস্কৃতিক শিক্ষা দেওয়ার শখ ওনার অনেকদিনের। তামিল মুসলমানেরাও পাকিস্তানে যায় নি। সুতরাং পড়ে রইল বাঙালীরা, যারা পাকিস্তান আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল।
জিন্না ভাবলেন এই সুযোগে একটা কাল্পনিক কৌম তৈরী করা যাবে, যার অস্তিত্ব নেই তবে নতুন করে তৈরী করা যায়। পূর্ব বাঙলায় কবি গোলাম মুস্তফা সহ বহু ‘বিদ্যাদিগ্গজ’ আরবী অক্ষরে বাঙলা লেখার বিধান দিলেন। নিজে খুব কথঞ্চিত উর্দু জানা সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে উঠেপড়ে লাগলেন। কিন্তু সেদিনের জনসভায় এক তরুণ ছাত্রনেতা (শেখ মুজিবর রহমান) এক দঙ্গল দামাল ছেলে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন- “No! No!” তখনকার ছাত্রনেতা গাজিউল হক তো বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে স্লোগান দিলেন।
বাঙালী মুসলমান দেখলো যে পাকিস্তান করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশী কুরবানি দিয়েছে তারা, দেশ ভাগের ফলে বাঙালীর প্রাণকেন্দ্র কলকাতা হারিয়েছে তারা। জিন্না যতই কলকাতার জন্য অশ্রুপাত করুন না কেন, শেষ বিচারে বংশদণ্ডজনিত ব্যথাটা কিন্তু বাঙালী মুসলমানই পেল। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠলো--যখন সমগ্র পাকিস্তানে বাঙলা সবচেয়ে বেশীসংখ্যক লোকের ভাষা, কেন বাঙলা রাষ্ট্রভাষা হবে না?
কিন্তু দাবী করলেই তো পাওয়া যায় না। ৪৮ সাল থেকে বাঙলার দাবিতে আন্দোলন শুরু হল। এদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র-বিরোধীরা ক্ষমতায় আসতে শুরু করলেন। মোনেম খান, আয়ুব খানেরা তখন প্রায় ক্ষমতার দোরগোড়ায়। নাজিমুদ্দিনের মত বিবেকহীন লোকেরা তখন ক্ষমতায়। ১৯৫০ সালে রংপুরে কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন দমন করাবার প্রয়োজনে জঘন্যতম পাশবিক অত্যাচার করা হল কৃষক নেত্রী ইলা মিত্রের ওপর। কম্যুনিস্ট এবং সর্বোপরি হিন্দু হওয়ার জন্যে তাঁর ওপর এই দৃষ্টান্তমূলক অত্যাচার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে বিধানসভায় তখন বিরোধীরা হচ্ছেন মূলত হিন্দুনেতৃত্বের কংগ্রেস পার্টি (পাকিস্তান), ফজলুল হক-এর কৃষক প্রজা পার্টি এবং সদ্য ভারত থেকে যাওয়া সুরাবর্দি সাহেবের দল। এঁরা সবাই অসাম্প্রদায়িক, ফজলুল হক তো আবেগের চোটে বলেই ফেললেন যে পশ্চিমবাঙলা আর পূর্ববাঙলার মধ্যে সীমানা তুলে দেওয়া উচিত।
এতগুলো পাখিকে এক ঢিলে মারার জন্যে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শুরু করলেন বাঙলার স্বায়ত্তশাসনের দাবীর বিরুদ্ধে অভিযান। শুরু হল নতুন করে হিন্দু তাড়ানো, শুরু হল রবীন্দ্রনাথের গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রয়াস। মোনেম খান তো অধ্যাপক আব্দুল হককে বলেই ফেললেন “আপনারা করেন কি, নিজেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না?”
এই পরিবেশকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি তরুণ বাঙালী মুসলমান সমাজ। তাঁরা তখন সবে নতুন শিক্ষার ছোঁয়া পাচ্ছেন। বাঙলা-বিদ্বেষী সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁরা আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন তখন।
এতদিন বৃটিশরা দোষী বা হিন্দুরা দোষী, এই বলে পার পাওয়া যেত, কিন্তু আজ একটি স্বাধীন দেশে আর কোনভাবেই যখন মানুষের আত্মমর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না, তখন তরুণ সমাজ আত্মপরিচয়ের স্থাপনার মধ্যে দিয়েই মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইলো।
১৯৫২ সালের আটই ফাল্গুন বা ২১-এ ফেব্রুয়ারি সকালে পূর্বঘোষিত কার্যক্রম অনুযায়ী ছাত্ররা প্রতিবাদসভায় যাবার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁদের পরনে ছিল শ্বেতশুভ্র সূতির কাপড়। নগ্ন পায়ে হাঁটছিলেন এঁরা। এই form বা আঙ্গিকটি কিন্তু অবিভক্ত মুসলিম লীগের নরমপন্থী অংশও নিতে চেয়েছিলেন ১৯৪৬-এর ১৬ই অগাস্টের কাল-করাল দিনে। আবুল হাসিমের নেতৃত্বে এই অংশের কাছে ১৬ই অগাস্ট ছিল বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে বাঙালী মুসলমানদের লড়াইয়ের শুভারম্ভের দিন। অবশ্য ইতিহাস জানায় যে অবাঙালী সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের ছিল অন্য এক রকমের পরিকল্পনা। এই আঙ্গিকই আবার ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে দ্বিতীয়বার আখ্যায়িত হল।
মজা হচ্ছে ১৬ অগাস্ট মুসলিম লীগের যে অংশ ভিতর থেকে সেই আঙ্গিককে কটাক্ষ করে আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিয়ে গেল, সেই নেতারাই তখন পূর্বপাকিস্তানে ক্ষমতার আসনে। এরা ঐ নির্দিষ্ট আঙ্গিককে চিনতে দেরী করল না। ক্ষমতার সম্পূর্ণ সুযোগ নিল এরা। স্বাধীন পাকিস্তানে সরকার প্রথম গণহত্যা ঘটাল ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। তখন তারা বাঙালী রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে, তাই খোদ রাজধানীতেই গুলি চালানোর সাহস তারা করতে পারল। মুহূর্তের মধ্যে খবর অন্যান্য জেলা শহরগুলোতে পৌঁছে গেল এবং সেখানেও ছোটোখাটো প্রতিরোধ গড়ে উঠলো। বিরোধী নেতৃত্ব বিধানসভা বয়কট করলেন, ছাত্ররা মাঠে নেমে পড়লেন, বুদ্ধিজীবিরা সব একসূত্রে আওয়াজ তুললেন মাতৃভাষার স্বাভিমান প্রতিষ্ঠায়। মহিলারা বেরিয়ে পড়লেন ঘেরাটোপ ভেঙে। যা শুরু হল তা হল বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের এক চলমান জীবনালেখ্য, শুরু হল বাঙালীর এক নিরবচ্ছিন্ন মম-অর্তি। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ লাগল পূর্ব-বঙ্গে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়। আর পাশাপাশি শুরু হল সীমান্তের এপারে পশ্চিমবাঙলায় বাঙলা ভাষাকে একটি রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে দেখার দিন।
আজ তাই দুই বাঙলার পাড়ায় পাড়ায় শিশু কিশোরেরা নগ্নপদে প্রভাত ফেরি করে একজন অখ্যাত কবি-সাংবাদিকের লেখা গান গেয়ে-- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি?” বিংশ শতকের শেষ ভাগে আর কোন বাঙলা গান এত সামগ্রিকভাবে আমাদের নজর কাড়তে পেরেছে কিনা, এত ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে পেরেছে কিনা আমার জানা নেই।
একুশে আজ সমগ্র বাঙালী জাতির সবচেয়ে বড় ঐকবদ্ধ icon. পশ্চিমবাঙলায় একুশে প্রাদেশিক উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়, কয়েক বছর ধরে ছুটিও ঘোষণা করা হচ্ছে। বিদ্যালয়ের শিশুরা দুই বাঙলায় একই সঙ্গে প্রভাত ফেরিতে বেরোয়। বাঙালী সর্বত্রই আর একবার শপথ নেয় মাতৃভাষার ওপর যে কোনরকমের আঘাতের যথাযথ প্রত্যুত্তর দেওয়ার।
রবীন্দ্রনাথকে যদি বাঙলার icon হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাহলে আজ দলমত নির্বিশেষে একুশে-ও একই স্বীকৃতির দাবিদার। একুশে আজ আর কোন দিন নয়, কোন তারিখ নয়, কোন আন্দোলনও নয়। একুশে মানে আমাদের ভালোবাসা, একুশে মানে আমাদের স্বাভিমান একুশে মানে আমাদের স্বাধীনতা। একুশে মানে আমাদের বাঙলা।