হাজার বছরের বাংলা কবিতা-—বীতশোক ভট্টাচার্য সম্পাদিত; প্রকাশক—বাণীশিল্প, ১১৩এ কেশবচন্দ্র স্ট্রীট, কলকাতা ৭০০০০৯; প্রচ্ছদ—প্রণবেশ মাইতি; অনুকথন—অমলেন্দু বসু; প্রথম প্রকাশ- অক্ষয় তৃতীয়া, ১৩৮৮; দাম—ষোল টাকা; পৃষ্ঠা ১৯৪; দ্বিতীয় সংস্করণ—১৯৮৬; দাম—তিরিশ টাকা
বাংলা ভাষার বয়েস গোল সংখ্যায় ধরলে হাজার বছর। কবিতা দিয়েই এই ভাষার শুরু—গদ্য সেই বয়েসে অর্বাচিন। বাঙালির জীবনের সঙ্গে কবিতা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত—জীবনে একটিও কবিতা লেখেননি বা নিদেনপক্ষে কবিতা লেখার কথা ভাবেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। কবিতা নিয়ে বাঙালি খায়, হাগে, ঝগড়া করে, প্রেম করে, পূজো করে, হাসে, কাঁদে, ভালোবাসে, লজ্জা পায়। কবিতা ছাড়া জীবন বৃথা, সংস্কৃতি বৃথা, ঐতিহ্য বৃথা। রামায়ণ, মহাভারত—তাও কবিতা; কীর্তন, পাঁচালি—তাও কবিতা, খনার বচন, লক্ষ্মীর ব্রতকথা, ছেলেভুলানো ছড়া: সবই কবিতা। মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে বৈষ্ণব পদাবলী; বাউল গান থেকে শুরু করে মিছিলের স্লোগান; হাজার বছর আগের চর্যাগান থেকে গতকালের শোনা সুমনের গান—সবই কবিতা। তাই তো ঈশ্বরবাবু, বঙ্কিমবাবু ও অন্যান্যদের কল্যাণে গত দেড়শো-দুশো বছর বাঙালিদের কেটেছে গদ্য ও পদ্যের যুগ্ম গার্হস্থ্যে। তার আগের শতকগুলিতে ছিল কবিতার একচ্ছত্র একাধিপত্য। সম্পাদকের জবানীতে—“হোক ঘুড়ির কাগজে ছাপা বিয়ের পদ্য, বটতলায় লাল কালিতে ছাপা বিষ-ঝাড়ার মন্ত্র, সহজে হোমিওপ্যাথি শেখার পুস্তিকা, হাসপাতালের দেওয়ালে পরিবার-কল্যাণের বিজ্ঞাপন কিংবা সেনসাসের প্রণালীপত্র—বাঙালির কাছে সবই কবিতা এবং কবিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আর কবিরাও হোন চাষী আদিবাসি শিকারি শিক্ষক বাউল বেকার কবিরাজ বাতুল বিপ্লবী—কবিতায় তাঁদের কারো কোথাও হারিয়ে যাওয়ার মানা নেই।”
এবং বিভিন্ন কবির কবিতা একসঙ্গে সংযুক্ত করে সংকলন গড়ে তোলার ব্যাপারটিও কবিতার মতোই প্রাচীন। চর্যাগীতিকোষ: আমাদের প্রথম কবিতা, বাংলা ভাষার প্রথম সংকলনগ্রন্থ। মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে বৈষ্ণব পদাবলীর বিভিন্ন সংকলনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। অসংখ্য কবিদের অবদান এসে মিশেছে এখানে: সংস্কৃতে, ব্রজবুলিতে, মৈথিলীতে ও বাংলায়। প্রথম দিকে “পদ” বলতে বোঝাত শ্রীকৃষ্ণের বা শ্রীচৈতন্যের পাদপদ্ম বা পদালংকার। পদাবলী অর্থে গীতিকবিতা হয়েছে এই আধুনিক কালে। “হাজার বছরের বাংলা কবিতা” সংকলনটিতে সম্পাদক বীতশোক ভট্টাচার্য এই দীর্ঘ সময়সীমার ভিতরে বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও বিবর্তন, বৈচিত্র্য ও অগ্রগতি এবং বিরোধ ও সমন্বয়ের একটি সাবলীল স্থিরচিত্র তুলে ধরেছেন আমাদের বিস্মিত চোখের সামনে।
বইটি খুলেই প্রথম পাতায়, আমরা দেখতে পাই বাংলা ভাষার বিবর্তনের একটি সজীব উদাহরণ। অতিপরিচিত একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তি—কিভাবে লেখা যেতে পারে আধুনিক, মধ্যযুগীয় ও প্রাচীন বাংলায় এবং সেইসঙ্গে আরো প্রাচীন মাগধী অপভ্রংশ ও মাগধী প্রাকৃত ভাষায়। (চিত্র দ্রষ্টব্য) পূর্বসূত্র পর্যায়ে শিল্প-সাহিত্য-সমাজ সংক্রান্ত কিছু শব্দ ও পরিভাষার অর্থ এবং ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন “ঘুমপাড়ানি গান—এক ধরণের ছড়া, লোকসাহিত্যের একটি অংশ। শিশুকে ঘিরে নির্যাতিত মায়ের স্বপ্নসাধ আকাঙ্ক্ষার আবিষ্ট স্নেহসিক্ত ক্ষেত্রে এর উদ্ভব। একে রাইমের মধ্যে ফেলা যায় না।”
“প্রাসঙ্গিক” নামক ভূমিকায় সম্পাদক বাংলা কবিতার বিবর্তনের একটি আভাস দিয়েছেন এবং তুলে ধরেছেন পূর্ববর্তী এই ধরনের সংকলনগুলির সীমাবদ্ধতা। প্রায় সকলেই প্রাচীন যুগ ও মধ্য যুগকে ভীষণভাবে অবহেলা করেছেন—“তুলনা করলে সাম্প্রতিক সংকলকদের মধ্যে তথাকথিত আধুনিকমনস্কতা পীড়াদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উনিশ বিশ শতক অভ্যাসবশেই এসব সঞ্চয়নে যেন সিংহভাগ পেয়ে থাকে।” এছাড়াও মৌখিক এবং লোকায়িত ভাষায় রচিত কবিতাগুলিও বর্জিত হয়। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষায় ইসলামি রচনাপ্রসঙ্গগুলিও তার যথাযথ পরিচয় পায় না। সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে হাজার বছরের বাংলা কবিতার প্রধানতম সাফল্য একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংকলন হিসেবে—কোন একটি বিশেষ সময়খণ্ড এখানে অশোভন প্রাধান্য পায়নি। চর্যাপদ থেকে শুরু করে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত ‘তিন পয়সার পালা’র গান এখানে সম্মানের সঙ্গে উপস্থিত। কিন্তু এছাড়াও আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য এই সংকলনের—কবিতাগুলি ভীষণভাবে মাটির ও প্রাণের কাছাকাছি—সমাজ, জীবন, মানুষ যেখানে স্পষ্টভাবে উপস্থিত। চোখের জল, বা কপালের ঘাম বা পিঠের চাবুকের দাগ মধুর রসের মলমের প্রভাবে মুছে ফেলা হয়নি।
২০৫টি কবিতা আছে এই সংকলনে। মোটামুটি ভাবে অর্ধেকের কিছু বেশি (১১০টি) শেষ দুশো বছরে লেখা—নিধুবাবু/ লালন ফকির থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত। সেই হিসেবে প্রথম ৮শো বছর অবহেলিত হয়নি। অনেক পরিশ্রমে, প্রাচীন পুঁথিপত্র গবেষণা করে বাংলা কবিতার আদি ও মধ্যযুগের রচনার অজস্র উদাহরণ তুলে ধরেছেন সম্পাদক। এর আগেকার সংকলনগুলিতে দেখা যেত উনিশ ও বিশ শতকের আধিপত্য। “ভিকটোরিয় কবিতার কোন সংগ্রহ থেকে ফিটজেরাল্ডকে বাদ দেওয়া যেমন শক্ত বাংলা কবিতা সংকলন থেকে কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাদ দেওয়া তার চেয়ে আরো কঠিন কাজ।” এই সংকলনে কৃত্তিবাসের কবিতা গ্রথিত হয়েছে ৫টি। রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি—তাই তাঁর ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবেন না। কিন্তু মাইকেল মধূসুদন দত্তের ১১টি কবিতা এখানে আছে শুনলে অনেকেই চোখ কপালে তুলবেন। ভেবে দেখতে গেলে, বাংলা কবিতায় মধূসুদনের কাব্যকৃতির অভিঘাত এতটাই গভীর। কতোরকমের ছন্দ, মিল, আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন তিনি—ধ্রুপদী মহাকাব্য থেকে শুরু করে মধুর গীতিকবিতা, নিটোল চতুর্দশপদী থেকে শুরু করে বলিষ্ঠ অমিত্রাক্ষর—সবেতেই তিনি সমান পটু। “ভাস্কর যেমন একখণ্ড পাথর কেটে মূর্তি বানান, মধূসুদন তেমনি নানা ভাষা ও সাহিত্য ছেনে বাংলা কবিতার ভাবমূর্তি তৈরী করে দিয়ে গিয়েছেন।”
তৃতীয় স্থান পেয়েছেন মুকুন্দ চক্রবর্তী—তাঁর রচিত চণ্ডীমঙ্গল থেকে ৯টি কবিতাংশ স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। “…প্রাণ স্বাস্থ্য, সমাজের সব স্তর সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, সঙ্গত অতিশায়ন ও শান্ত শ্লেষে বাংলা কবিতায় মুকুন্দের জুড়ি নেই।” এর পরে, ভারতচন্দ্র রায়ের ৬টি, ঘনরাম চক্রবর্তী, কৃত্তিবাস ও রামপ্রসাদ সেনের ৫টি করে, কৃষ্ণদাস কবিরাজ ও হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৪টি করে। প্রায় প্রতিটি কবিতার জন্য রয়েছে সংক্ষিপ্ত টীকা, পরিচায়িকা অংশে—অনেক মূল্যবান তথ্যে-ভরা এই অংশটি। এর পর বাংলা কবিতার সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের একটি তুলনামূলক সময়সারণী দেওয়া হয়েছে। সবশেষে অমলেন্দু বসু রচিত অনুকথন সেই তুলনায় ম্লান—নতুন কোন মাত্রা যোগ করতে ব্যর্থ হয় এই বিপুল কাব্যসম্ভারের কোলাহলে।
৪২ সংখ্যক কবিতা মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলের সখীসংবাদ অংশের “চাল ধার করতে এসে সই সইএর মাথার উকুন বেছে দিচ্ছে—ছবিটি সরাসরি বাংলার লোকজীবন থেকে তুলে নেওয়া।” মধ্যযুগেও খিদে ছিলো, উকুন ছিলো, মানুষ মানুষকে সাহায্য করতো আপদে বিপদে—
আঁচল ভরিয়া সই দিল খৈ মুড়িমোদ্দা কথাটা হল কবিতার বাস্তবতা ঊনবিংশ শতাব্দীর ইওরোপে থেকে বাংলায় আমদানি হয়ে আসেনি, এখানেই ছিলো আমাদের ধানে-চালে, ঘাসে-পাতায়, অস্থি-মজ্জায়। পরবর্তী কবিতা এই একই লেখকের “নিদয়ার প্রসব বেদনা”—>
চাপিয়া বসিল দোঁহে চৌখন্ডী পিঁড়ি।।
ফুল্লরা দুকাঠা চালু মার্গিল উদ্ধার।
কালি দিব বল্যা সেই কৈল অঙ্গীকার।।
আইসহ প্রাণের সই, বৈস গো বাহিনি।
মোর মাথে গোটা কত দেখহ উকিনি।।
হইল উদর ভারি বসিলে উঠিতে নারিহতে পারে অনভিজাত মানুষের মুখের ভাষা, কিন্তু কী জীবন্ত, কীরকম ভানহীন, কী অসাধারণ আধুনিক! “বাংলা কবিতায় প্রসববেদনা বর্ণনায় কোন ট্যাবু নেই… জ্যামিতিক চাপ ও খাড়া টানে গর্ভবতীর ছবি যেমন ফোটে, এ কবিতার টানটোন তেমনি অভ্রান্ত, সহজ। শারীরিক যন্ত্রণা একটি সত্য ঘটনা এবং তা এই রচনার বিষয়।”
শুইলে ফিরাইতে নারি পাশ।
চাহিতে না পারি হেট সূচে যেন বিন্ধে পেট
দূর হইল জীবনের আশ।
৭৪ সংখ্যক কবিতাটি ভারতচন্দ্র রায় রচিত অন্নদামঙ্গলের “রাজার বিদ্যাগর্ভ শ্রবণ”—
ঘরে আইবড় মেয়ে কখন না দেখ চেয়ে
বিবাহের না ভাব উপায়।
অনায়াসে পাবে সুখ দেখিবে নাতির মুখ
এড়াইলে ঝির বিয়াদায়।।
প্রাসঙ্গিক টীকা: “ভয় ক্রোধ ভালোবাসার মৌল মিশ্রণে অংশটিতে এমন রং ধরেছে ভারতচন্দ্রের কবিতায় যার তুলনা নেই। রাণীর কথা সনাতনী বাঙালিনীর উচ্চারণ এবং এরকম গর্ভপাত যেহেতু এখনো এদেশে অনুমোদন পায়নি তাই তা আজও প্রাসঙ্গিক। সমস্যাটি সেদিন উচ্চশ্রেণী সংক্রান্ত, আজও মোটামুটি তাই।” ভারতচন্দ্রের সেন্স অফ হিউমারটিও এখানে ভীষণ চোখে পড়ে।
৮৫ সংখ্যক কবিতাটি শেখ ফয়জুল্লার গোরক্ষবিজয় কাব্যের অন্তর্গত “ভীমরতি”। “কামবোধ একটি কৃষিনির্ভর ব্যাপার, জংগলের জীবনে শুদ্ধ মৌনতা আছে কামতাড়না নেই... বুড়ো বয়েসের লোলুপ অথচ অশক্ত ভীমরতির এটি একটি সুন্দর ছবি।”
দেখিবা বুড়ার বল ধরি যদি বলে১৩৯ সংখ্যক কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের “আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার।” সংলগ্ন টীকাটি পড়ে চমকে উঠতে হয়—“রবীন্দ্রনাথের এ কবিতা পড়ে স্পেন ও আয়ার্ল্যান্ডের দুই বড়ো কবি হিমোনেথ ও য়েটস আধুনিক ঋজু নিরাভরণ কাব্যরীতি প্রতিষ্ঠার প্রেরণা পান।”
তুই কুচ মদ্ধিয়া তুলিয়া লৈব কোলে।।
কাঞ্চলি ফাড়িমু তোর খসামু কবরী
আমার ঘরেতে আসি যাইতে চায় ফিরি।।
প্রণবেশ মাইতির প্রচ্ছদটি মন টানে। প্রকাশনাটি বিশেষ যত্নের সঙ্গে করা—ছাপার ভুল প্রায় নেই বললেই চলে। কেবল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “এই যুদ্ধ” কবিতাটির শেষে ছাপা হয়েছে একটি তারিখ—খুব সম্ভবত এই কবিতার রচনাকাল। আশা করি দ্বিতীয় সংস্করণে ভুলটি সংশোধিত হয়েছে।
বাংলা কবিতার এই অসামান্য সংকলনটির একাধিক সংস্করণ প্রকাশ নিঃসন্দেহে একটি ভাল লক্ষণ। শেষ মলাটে গোপাল হালদারের মন্তব্যটি পড়ে (“এমন গ্রন্থ সম্পাদনার জন্য যোগ্যতা থাকা দরকার। অধিকার থাকা চাই। পরিশ্রমও করা দরকার। এসব এডিটিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হওয়া উচিত।”) আপন মনে বলে উঠি—“সাধু! সাধু!”