সেই ব্যক্তিগত শক্তিকে নিয়েই আমার যে নোটবুক তৈরি হয়েছিলো প্রায় দশ বছর ধরে, তাকেই আজ খুলে পড়ছি।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, মনে পড়ে আমি প্রথম দেখি ১৯৮১-এর ১১-ই নভেম্বরে। কোন এক সংস্থা (নাম মনে নেই) শক্তিকে নিয়ে কলকাতার একাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ একটা তিন ঘন্টার টানা অনুষ্ঠান ছকে ফেলে- শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি সন্ধ্যা। শক্তির বন্ধু ও প্রেমীজনের ভিড়ে সেই প্রথম শক্তির কবিতাপাঠ শুনলাম। সামান্য সুর ধরানো অসম্ভব ভরাট কন্ঠের উচ্চারণ।
সেদিন শক্তির কবিতার সেই ব্যক্তিগত সত্তা হঠাৎ ভেসে উঠেছিলো উপর জলে। নানাজনের কথায়, স্মৃতিচারণায়, ঠাট্টায় প্রহসনে, দর্শকের প্রশ্নে শক্তির ব্যক্তিগত কবিতা শরীর ফিরে পাচ্ছিলো। একটি স্যুভেনির-ও প্রকাশ করা হয় সেদিন, যেখানে শক্তিকে ঘিরে অনেক গভীর প্রশ্ন ছিলো, ছিলো শক্তির অনেক সুচিন্তিত উত্তর, স্বীকারোক্তি। ব্যক্তিগত শক্তিকে আমি সেদিন থেকেই প্রথম আবিষ্কার করতে শুরু করি। শক্তির কবিতায় অনেক অস্বচ্ছতা পটু হাতে সেদিন কখনো শক্তিই মুছে দিচ্ছিলেন, এই যে অপ্রচলিত শক্তির মধ্যেও আমি অনেক প্রথাবিরোধ, পরীক্ষা নিরীক্ষা, শব্দের, ফর্মের আরো কিছু দুর্লভ নমুনা দেখতে পেয়েছিলাম।
শক্তির একটা খুব ব্যক্তিগত কবিতার চরে উঠে পড়ি।
“আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
অবনী, বাড়ী আছো?”
(অবনী, বাড়ী আছো)
অনেককে এই কবিতাটিকে ‘স্যুররিয়ালিস্টিক’ তকমা দিতে দেখেছি। যেভাবে পল এলুয়ার, রবেয়ার দেনো, ল্যুই আরাগঁ, ঝাক প্রেভের বা সাঁ জন পের্সকে স্যুররিয়ালিস্টিক বলে চিনেছি শক্তিকে তা মনে হয়নি। ঠিক রুদ্ধ চেতনা বা অধিচেতনার থেকে এই লেখা নয়। শক্তি বলছিলেন, কিভাবে এই কবিতা পাওয়া। খড়গপুরে গিয়েছিলেন কলকাতার জঙ্গল থেকে সাময়িক নির্বাসন নিয়ে। উঠেছিলেন বন্ধু মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ীতে। মানবেন্দ্র তখন হিজলী স্কুলের শিক্ষক। মানব বাড়ীতে ছিলেন না সেই সকালে, শক্তিকে বলে গিয়েছিলেন ফিরতে রাত হতে পারে। শক্তির ভাষায় ‘বাড়ীতে শুধু আমি আর অনেক মদ’। সারা সকাল বারান্দায় বসে দেখতে পাচ্ছিলেন একবার রোদ ঝলসে উঠছে আকাশে, একবার মেঘ। সামনে দুটো একটা রাখাল ছেলে গরু চরিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই দৃশ্য বুনে দিয়েছিলো-
“এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙমুখ সবুজ নালি ঘাস
দুয়ার চেপে ধরে
অবনী, বাড়ী আছো?”
(অবনী বাড়ী আছো)
শক্তি বলছিলেন, ওঁর টনটনে জ্ঞান ছিলো, মানব ফিরবে, কড়া নাড়বে, তখন খুলে দিতে হবে। ওই কড়া নাড়ার প্রতীক্ষাই শক্তির সেই অদৃশ্য দ্বিতীয় সত্তা (অবনী) কে জাগিয়ে তুলেছিলো। খুব সাধারণ, সহজ কয়েকটা ঘটনা, দৃশ্য তার ভিতর থেকে শক্তির বোধ কিভাবে উঠে আসছে আমি বুঝতে পারলাম। মদ যে তাঁর অনুভবের বিস্তৃতি ঘটাতো এই ধাঁচের আরো অনেক কবিতায় সেটা বোঝা যায়। এক আপাত অন্ধকারাচ্ছন্ন চেতনার একাধিক মাত্রায় বেড়ে যাওয়া শক্তির আরো অনেক কবিতার বিষয়। অনেকে মনে করেন ডিলান টমাসের কবিতাভাবনার প্রক্রিয়াও অনেকটা এই ধরনের। লক্ষ্য করি, শক্তির সেই সমস্ত কবিতার পরিবেশ গড়ে তুলেছে প্রগাঢ় প্রকৃতি। সেখানে ছবি নেই অতটা, সরাসরি চিত্ররূপময় নয় যেটা শক্তির সমসাময়িক প্রাণবেন্দু বা অলোক সরকারের কবিতায় প্রচুর পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই প্রকৃতি নৈসর্গিক, কখনো শহুরে। যেমন-
“পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে দেয়ালে দেয়ালে, কার্নিশে কার্নিশ
ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ী ফেরার সময় বাড়ীর ভিতরে বাড়ী, পায়ের ভিতরে পা, বুকের ভিতরে বুক”
(সে বড় সুখের সময় নয়)
মনে আছে, সন্তোষকুমার ঘোষ শক্তিকে টেনে নিয়ে এসেছিলেন এই কবিতায়। বলেছিলেন, আমার প্রিয়, পরিচিত, প্রতিদিনকার শক্তিকে এখানে দেখি। এখানে নিসর্গ নেই, রাস্তা, বাড়ী, দেয়াল, কার্নিশ আর পুলিশভ্যানের কলকাতা। মাঝরাতে। মাতাল শক্তি বাড়ী ফিরছে টলমলে কলকাতা হাতে নিয়ে। এর কিছু পরের ছত্রে, সম্ভবত এই প্রথম আমরা মৃত্যুকে পাই শক্তির কবিতায়
“তুলে ছুঁড়ে ফেলে গাড়ীর বাইরে, কিন্তু অন্য গাড়ীর ভিতর
যেখানে সবসময় অপেক্ষা করে থাকে—পলেস্তারা মুঠো করে বটচারার মতন
কেউ না কেউ যাকে তুমি চেনো না
অপেক্ষা করে থাকে পাতার আড়ালে শক্ত কুঁড়ির মতন
মাকড়সার সোনালী ফাঁস হাতে—মালা
তোমাকে পরিয়ে দেবে—তোমার বিবাহ মধ্যরাতে”।
শক্তি খানিকটা লজ্জা পেয়ে সেদিন বলেছিলেন, “আসলে কালো গাড়ীর ব্যাপারটা বানানো, আমি কখনো কোনো কালো গাড়ীতে চড়িনি।” এর বেশ কিছু বছর পরে এক দৈনিকে শক্তি কলকাতার জেল নিয়ে লিখেছিলেন যার শীর্ষক ছিলো- “কলকাতার সব জেলে রাত কাটিয়েছি”। আচ্ছন্নতার প্রকোষ্ঠেই শক্তির এই মৃত্যুবোধ জন্মায়, কুঁড়ির পিছনে মাকড়সার জাল মৃত্যুর মালা মনে হয়।
৮০’ দশকের গোড়ার থেকেই এই মৃত্যুবোধ ভারী এবং বহু ব্যবহৃত, সনাতনী করে তুলতে থাকে শক্তির কবিতাকে। সেই সময়েই, ৯০ সালের গোড়ায় শক্তির সঙ্গে আমার খুব ব্যক্তিগত মোলাকাত প্রফুল্ল সরকার স্ট্রীটে। শক্তি তখন মদ কমিয়ে দিয়েছেন ডাক্তারের নির্দেশে।
৮১-র সেই শীতের সন্ধ্যায় আরো অনেকে প্রশ্নের মুখোমুখী বসেছিলেন সিরিয়াস শক্তি, কতকটা বিহ্বল। ‘অবনী বাড়ী আছো’ কবিতাপাঠের অনুরোধে একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন- “ওটা অনেকবার পড়েছি। এবার থাক। মঞ্চে আমার মেয়ে বসে আছে। ওটা পড়লে, ও উঠে চলে যাবে।” প্রশ্ন উঠেছিলো- কেমন করে লেখা শুরু। শক্তি ফিরে যাচ্ছিলেন সেই দেশবন্ধু পার্কের দিনগুলোয় যখন প্রায়ান্ধাকারে বসে কবিতা পড়া-শোনা হতো।
পানীয়ের কথা উঠলেই শক্তির ছবিটা ক্রমশ মিথিকাল হতে শুরু করে। অজস্র গল্প কিলবিলিয়ে উঠতে থাকে স্মৃতিতে। এর কিছু বহুবিদিত, কিছু হয়তো মনগড়া, কিছু সত্যি আর অল্প কিছু প্রত্যক্ষ করা। ১৯৮১-এর সেই সন্ধ্যার পর শক্তিকে নিয়মিত দেখতাম কলকাতা পুলিশের তদানীন্তন আই জি রথীন ভট্টাচার্যের (লাচ্চু) বাড়ীতে। লাচ্চুদার ছোটছেলে বুজো (উদ্দালক) আমার বন্ধু। লাচ্চুদার মতো সাহিত্যপ্রেমী বা সাহিত্য পড়ুয়া পুলিশের বড়কর্তা কল্পনাতীত। শক্তি এবং অন্যান্য কবিদের আনাগোনা সবসময় বিপত্নীক লাচ্চুদার বাড়ীতে। মাঝরাতে শক্তির হাজিরাও ছিলো একরকম নিয়মিত। ট্যাক্সি ভাড়ার প্রয়োজনে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে- ‘বুজো, জয় (বুজোর দাদা)’ করে ডাকতেন। হাসির আরো রশদ ছিলো। লাচ্চুদার সেই পুলিশ কোয়ার্টারে অসম্ভব সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এক কর্মচারী থাকতো- মোহন সিং। বুজোকে ওর ডেসিগনেশন জিজ্ঞেস করলে ও বলতো ‘আর্দালি’। এই যুগে লাচ্চুদা ‘আর্দালি’ রাখেন বলে আমরা বুজোকে নিয়ে হাসতাম। শক্তির খুব ভয় ছিলো মোহন সিংকে। রঙীন রাতের মাঝামাঝি লাচ্চুদার বাড়ীতে ঢুকে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির উপরের মোহন সিংকে তাক করে শক্তির সেই ‘ছায়ার সাথে যুদ্ধ’ অসাধারণ। বক্সার শক্তির সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে চাইবাসার দিনগুলোর গল্প শুনেছিলাম। ‘জঙ্গলের দিনরাত্রি’ যা সন্দীপন আমাকে বলেছিলেন ‘সুনীলের বানানো গল্পের বিরুদ্ধে ঐটা আমার প্রতিক্রিয়ার লেখা’- সেই উপন্যাসের অনেকটা জুড়ে আছে শক্তির সেই মিথিকাল চেহারা। অনেকের মুখে শোনা আরো অনেক গল্পের মধ্যে আছে কবি অভী সেনগুপ্তের একটা বর্ণনা- পেটের গন্ডগোলের সময়ে হুইস্কির মধ্যে ইলেকট্রল গুলে শক্তির মহৌষধ পান।
১৯৮১-এর সেই সন্ধ্যায় শক্তি বলেছিলেন লেখার সময় তিনি কখনো মদ্যপান করেন না। শক্তির মিথ্-এর সঙ্গে শক্তির কবিতার কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আমিও কোনদিন খুঁজে পাইনি। তবে অবিশ্রান্ত ভ্রমণের উপচার ওঁর কবিতাকে ক্রমাগত আঁটো করতো, উদ্দীপ্ত করতো। ‘চলো, বেড়িয়ে আসি’-র মতো ভ্রমণপঞ্জিকা বাংলা ভাষায় বিরল।
এক বন্ধু কবির লেখা সমালোচনা করেছিলেন, যে ক্ষুব্ধ হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো- তুমি লিখে দ্যাখাও না। ‘যম’ শক্তির প্রথম কবিতা। পাঠিয়ে ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর কাছে ‘কবিতা’ পত্রিকায়। লেখক-সম্পাদকের তিন-চারটে ইটারেশন চলেছিলো লেখা পাকা হওয়ার আগে। সেই শুরু।
জীবনানন্দের প্রভাব? শক্তি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেননি; তাঁর দেশজ শব্দের ব্যবহার, কিছু প্রত্যক্ষ প্রভাব যেমন-
“নীল অত্যাচারে মাতে ডুবন্ত জাহাজ
নিকটে, জলের কোল অশ্রুশিক্ত, বিষন্ন, করুণ”
(পরোক্ষ)
এবং “অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে” (শক্তির প্রথম বই)-এর প্রচুর কবিতা। শক্তি বলেছিলেন, ওঁর প্রথম বই প্রকাশের পর সুনীলকে বইটা দিলে, সুনীল আপত্তি করলেন প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম নিয়ে। সমস্ত কবিতায়, যতোই কাব্যগুণ থাক, জীবনানন্দের নিরবচ্ছিন্ন বাতাবরণ। ‘হে প্রেম হে নৈ:শব্দ্যে’-তে শক্তি সম্পূর্ণ নিজস্ব হয়ে ফিরে এলেন।
এরই মধ্যে শক্তি গদ্যেও হাত দিলেন। কবিরা গদ্যে সবসময়েই নতুন ভাষা ও ভঙ্গি নিয়ে আসে। গদ্যের আঙ্গিকেরও আপাদমস্তক রদবদল হয়। বাংলা সাহিত্যের এই ঘটনা অনিয়মিত হলেও ঘটেছে। সুভাষ, নীরেন, অনেকেই কবিতার চৌকাঠ পেরিয়ে গদ্যে এসেছেন। বহু পূর্বে জীবনানন্দ। শক্তি প্রথম এলেন ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসে। বলা যায়, এমনকি জীবনানন্দের গদ্যও এতো প্রাণবন্ত হয়নি যতোটা ‘কুয়োতলা’। মতান্তর আছে অবশ্যই। অনেকের মতে, শক্তি গদ্যকার হিসেবে ব্যর্থ কারণ ‘কুয়োতলা’র ভাষা গদ্যের নয়। তবু আমার মনে হতো শক্তি কবিতার ভাষা, নানা দেশজ শব্দ, কবিতার শব্দভঙ্গি, প্রতিমা গদ্যে নিয়ে গদ্যকে উদ্ভাসিত করেছিলেন। শেষের উপন্যাসে “দাঁড়াবার জায়গা”-তে, শক্তি সেই ভাষাকে ত্যাগ করলেন পুরোপুরি। হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর প্রথাগতভাবে গদ্যপন্থী। তবে এই আত্মজৈবনিক উপন্যাস নানা কারণে অনেকের মনে থাকবে।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র যে সঞ্জয়, ষাট দশকের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে শক্তি, সুনীল, সন্দীপন এবং অন্যান্যরা চাইবাসা বেড়াতে যান। সেখানে ওঁরা দীর্ঘদিন থেকে যান। সেই সময় ‘হাওয়া ৪৯’-এর বর্তমান সম্পাদক, ষাট দশকের আরেক কবি সমীর রায়চৌধুরীর বাড়ীতে ওঁরা বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেটাই শক্তির জীবনের প্রথম প্রেমের সময়। সমীর রায়চৌধুরীর শ্যালিকার যাতায়াত ছিলো। শক্তির সেই সুবাদেই আলাপ এই মেয়েটির সঙ্গে। একদিন, বিকেলের আলো দুপাশের শালবনে মরে আসছে, সেই সময়ে, দ্রুত চুম্বনের পর লজ্জায় ছুট লাগিয়ে খোলা চুলের মেয়েটি পালিয়ে যায়। শক্তি, বিহ্বল মুখ তুলে দেখতে পান অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। শালবনটা যেন একটু আগের বাহুবন্ধনের মতো ঘিরে ফেলছে। সেই অনুভূতি থেকেই জন্ম নেয় পরবর্তীকালের বিখ্যাত কবিতা
“কোথা বসে ছিলে যাবার সময় দেখছি শুধুই
ঝরছে পাতার শিখর গলানো কার এলোচুল
অবসাদ আর নামে না আমার সন্ধ্যে থেকে
ছুটে কে তুলিলে শালবন, ঘনবন্ধন চারিধারে”
(অন্ধকার শালবন)
১৯৮১-এর সেই সন্ধ্যায় সন্তোষকুমার ঘোষ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এক সাহসী শক্তিকে। প্রচুর নির্লজ্জ শব্দ শক্তি কবিতায় ব্যবহার করেছেন, এবং তাদের কবিতায় শুষেও নিয়েছেন, যেমন—“পড়ে আছে ফলমূল, স্বপ্নরাজ কুকুরের বীচি”, অথবা “শিল্পের প্রস্রাবরসে পাকে গন্ড, পাকে গুহ্যদেশ” বা সেই চতুর্দশপদী থেকে
“সুর্যের হত্যার সাক্ষী আমরা তিন উল্লুক কাঁহাকা
পোঁদের জ্বালায় হু হু করতে করতে দিক্বিদিকহারা”
শক্তিকে সেদিন কোন দর্শক রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন। শক্তি বলেছিলেন- রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে ‘জল-আলো-হাওয়ার মত’ এখনো: তবে আমরাই তাঁকে একাডেমিক খোঁচাখুঁচিতে প্রাণান্তকর করে তুলেছি। নিজের ভাষা নিয়েও যে রবীন্দ্রনাথের ধরনে লেখা যায়, সেটা প্রমাণ করতেই ‘ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো’।
জামশেদপুরে কৌরব পত্রিকার লেখকদের সঙ্গে যখন আমার কবিতা লেখার ‘শুঁয়োপোকা’ অবস্থা কাটছে, তখন শক্তির অনেক লেখা, হস্তাক্ষর কৌরব সম্পাদক কমল চত্রবর্তীর কাছে দেখেছি। শক্তির মৃত্যুর পর ‘কৌরব’ শক্তি-সংখ্যা বের করেছিলো। শক্তি ‘কৌরব’ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে নানাভাবে কাগজটার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। মনে পড়ে এই কৌরবেই প্রথম বেরিয়েছিলো শক্তির অসাধারণ কবিতা- “পূরবী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতো”। সমসাময়িক নির্জনতাপ্রিয় কবি স্বদেশ সেন-এর কথা শক্তি শেষ জীবনে প্রায়ই বলতেন। বলতেন, ‘স্বদেশ, নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো চিরটাকাল। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে ৯০-সালের ফেব্রুয়ারির দুপুরে শক্তির সঙ্গে ওই একবারই অনেক কথা হয়েছে, কৌরব, জামশেদপুর, চাইবাসা, স্বদেশ-কমল-বারীনের লেখালেখি নিয়ে, নিজের সনেট নিয়ে। আজ-ও আমার মনে হয় শক্তির চতুর্দশপদী তেমন জনপ্রিয় হয়নি যদিও, ওর মধ্যে প্রচুর গবেষণার মশলা রয়েছে। এর আগে বা পরে কখনো শক্তি নিজেকে কোন ফর্মের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ভাঙাচোরা করেননি, কখনো হিমেনেথ-এর মতো কবির প্রভাব পড়েননি।
শক্তিকে আরো কয়েকবার নানা জায়গায়, অখনো লাচ্চুদার বাড়ী, কখনো বইমেলায়, কখনো জামশেদপুরে “কৌরব” দপ্তরে দেখেছি। সামান্য বাক্যব্যয়মাত্র হয়েছে। মদ্যপানের মিথ তখনো তাঁকে ছাড়েনি। তরুণ কবিদের বিরুদ্ধাচার খানিকটা জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছিলো যদিও। তবু শক্তি সেইরকমই ম্যাজিশিয়ান তখনও, মদের খোঁজে আয়ান রশিদ খানের সঙ্গে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন বইমেলা থেকে, দূরদর্শনের কবিতাপাঠ শেষ করে সুরার আসরে তরুণী কবির ঠোঁটে অসতর্ক চুমু এঁকে দিচ্ছেন, বন্ধু অমিতাভ দাশগুপ্তকে ছোটাচ্ছেন ট্যাক্সির খোঁজে।
১৯৯০ সালের শেষদিকে “কৌরব” পত্রিকায় পাঠানো কয়েকটা জরুরী নোটের সঙ্গে ভুল করে শক্তি একটা ছোট অসমাপ্ত গল্প পাঠান। শক্তির আরেক ভ্রমণোপাখ্যানের মুখবন্ধের মত-
“জলপাইগুড়ি বিভাগের পুলিশের প্রধান কর্তা আমাদের নেমন্তন্ন করে পাঠালেন। সপ্তা দুয়েক হাতে নিয়ে চলে এসো। আমি সব বাংলো বুক করে রাখবো। সঙ্গে পাহারাদার সমেত গাড়ি। বাকি খরচা খরচা তোমাদের। হয়তো ডুয়ার্সে ঘুরেছো আগে। কিন্তু আমি যেভাবে ঘোরাবো, সেভাবে কোনদিন ঘুরতে পারবে না। শীত বেশি নেই। তবু অল্পস্বল্প শীতের জামাকাপড় আনবে। জঙ্গলে ঠাণ্ডা একটু বেশী।
চিঠি লিখে দিন ঠিক করে চলে গেলুম। আগস্টের মাঝামাঝি। হাতে দশ দিনের ছুটি। স্টেশনে গাড়ি রেখেছিলেন। সেই গাড়ি নিয়ে সোজা ওঁর বাংলোয়। দোতলা, সাহেবি আমলের বাড়ী। সামনে পিছনে এবং চারদিকেই বাগান। তিস্তার ধারে দোতলায় বসলে আর পাখা লাগে না।
তিনি আমাদের জন্য দোতলায় অপেক্ষা করছিলেন। যেতেই বললেন, হাত মুখ ধুয়ে চা খাও আগে তারপর আলোচনা হবে। পাশে দাঁড়ানো আর্দালিকে চা দিতে বললেন।
সেদিন রাতে আমরা জলপাইগুড়ি থাকলুম। ঠিক হলো পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে সোজা শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি বাজার থেকে চারদিনের চাল ডাল তেল কিনে প্রথমে কালীঝোরা বাংলো”…..
(‘কৌরব’ পত্রিকার সৌজন্যে)
এইখানেই গল্পের শেষ। জিগ্যেস করা হলে শক্তি বলেছিলেন- একটা ভূতের গল্প লিখতে বসেছিলুম, এরপর আর এগোয়নি। এইরকমই শক্তির কথার মেজাজ। সাধারণের মধ্যে নাটকের মহড়া করা।
শক্তির মৃত্যুর খবর পাই অনেক পরে। তখন বম্বেতে আছি। শক্তির মৃত্যুর অন্তত সপ্তাহ দুয়ের পরের হিন্দুস্তান টাইম্স একদিন রবিবার খুলে দেখি শক্তির ছবি, ওঁর উপর প্রবন্ধ। প্রবন্ধের উপর ঝুঁকে পড়তেই প্রথম পরিচ্ছেদেই শক্তির মৃত্যুর খবর পেলাম। কেমন ঠাট্টা মনে হয়েছিল। তারপর নেমে আসতে হল মাটিতে। মনে পড়ে যাচ্ছিলো অনেক বছর আগের দূরদর্শনের একটা অনুষ্ঠান; শক্তি ও সুনীল কৃত্তিবাসের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করছিলেন; সুনীল হঠাৎ ঠোঁট টিপে শক্তিকে বললেন- তুমি তো তখন বিড়ি খেতে। শক্তির সেই অস্বস্তি হেসে ওঠার মত। মনে পড়ে যাচ্ছিলো মুক্তমেলায় চিৎকার করে তুষার রায় শক্তিকে নিয়ে ব্যঙ্গকবিতা পড়ছেন-
“এখন আছো ড্রাই মার্টিনি
আগে তো খেতে তাড়ি
নন্দের বাগানে আনন্দের খোঁজে
যাও অবনীর বাড়ী”।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো শক্তি আর আমার বাবার একই বছরে জন্ম।