কিন্তু সব মিলিয়ে কীরকম সেই বেঁচে থাকা? সেই ‘অন্যরকম’ বেঁচে থাকাটার সঙ্গে আমার রোজকার বেঁচে থাকাটার কোন যোগযূত্র আছে কি? থাকলে সেটা কোথায়? এই যে আজ, বিশশতকের চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, ‘আপনার বেঁচে থাকাটা ঠিক কী রকম?’ অর্থগম্য একটা উত্তর চট্ করে দেওয়া কি সম্ভব হবে আমার পক্ষে? এই যে আমি সকালে বাপমায়ের কাছে একরকম, দুপুরে কর্মস্থলে আরেকরকম, সারাদিন একশোটা মিথ্যে কথা বলে; পারিপার্শ্বিকের কাছে পুরোটাই গোপন রেখে সাঁঝের বেলা লাইব্রেরিতে কিম্বা ক্লাবে মগ্ন করি নিজেকে—আমরা শতধাবিস্তৃত টেনশান, চকিতে উচ্চারিত প্রেম, বিচিত্রগামী চেতনা, আরো বিচিত্রগামী অবচেতনা—সব মিলিয়ে আমার আমিটা যে ঠিক কেমনতরো—এই জটিলতম প্রশ্নের মুখোমুখি হই কি আমরা কখনো?
সেই জটিলতম প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন আমাদের, রবীন্দ্রনাথ। বারবার।
অথচ সব মিলিয়ে আমাদের রবীন্দ্রচর্চার ইতিবৃত্ত কিন্তু খুব বিচিত্র। রবীন্দ্রনাথ নিজে যখন ‘বিসর্জন’ নাটকে অভিনয় করেন তখন তাঁর ষাট পেরিয়েছে। কিন্তু মঞ্চে তিনি পুরোপুরি যুবক জয়সিংহ, একথা প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন আমাদের। ‘বিসর্জন’ নাটকে পুরোহিত রঘুপতি জয়সিংহকে রাজহত্যায় প্ররোচনা দিয়ে যখন বলেন—‘কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ? এ জগৎ মহাহত্যাশালা’—বিশ্বব্যাপী মারণযজ্ঞের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সংলাপটা খুব আজকের বলে মনে হয় না কি আমাদের?
সত্যজিৎ রায়ের ‘শাখাপ্রশাখা’ ছবির সেই দিকভ্রান্ত যুবকটির কথা মনে পড়ে। চোখের সামনে অনেক দর্শন, অনেক আদর্শের পতন ও ব্যর্থতা দেখে সে বলে যে এই জটিল সময়ে ভালো-মন্দ ঠিক-বেঠিক তার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের নাটকে দিশাহীন যুবক জয়সিংহ নির্ভার হতে চায় নিজেকে ভোগসুখের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে—
“….থাক চিন্তা
থাক আত্মদাহ, থাক বিচার বিবেক—
কোথাও যাও ভাইসব, মেলা আছে বুঝি নিশিপুরে?”
জানি না কেন ‘নিশিপুর’ শব্দটা আমাকে বরাবর আধুনিক মেট্রোপলিটন-এর নাইটক্লাব মনে করিয়ে দেয়।
শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ‘বহুরূপী’ প্রযোজিত ‘রক্তকরবী’ রবীন্দ্রনাটক প্রযোজনার ইতিহাসে যুগান্ত এনে দিয়েছিল। এই নাটকের ‘যক্ষপুরী’ যেন মঞ্চে নিয়ে আসে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত জীবনের ধারাভাষ্য।
চন্দ্রা— কতদিনে তোমার কাজ ফুরবে?বহুরূপীর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ যেন চলে এলেন অনেকটা হাতের নাগালের মধ্যে, ‘রক্তকরবী’তে আমরা অনেকেই ছুঁয়ে নিলাম আবার আজকের বেঁচে থাকার এক ধরনের চালচিত্র।বিশু—পাঁজিতে তো দিনের শেষ লেখে না। একদিনের পর দুদিন, দুদিনের পর তিনদিন, সুড়ঙ্গ কেটেই চলেছি, এক হাতের পর দু হাত, দু হাতের পর তিন হাত। তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দু তাল, দু তালের পর তিন তাল। তাই ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা। ফাগুভাই, তুমি কোন সংখ্যা?
ফাগুলাল—পিঠের কাপড়ে দাগা আছে, আমি ৪৭ ফ।
বিশু—আমি ৬৯ ঙ। গাঁয়ে ছিলাম মানুষ, এখানে হয়েছি দশ পঁচিশের ছক। বুকের উপর দিয়ে জুয়াখেলা চলছে।
কমিউনিকেশানের দিক থেকে সর্বজনগ্রাহ্য হওয়ার চেষ্টা নাটকের ক্ষেত্রে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ভাষা’ অনেক সময়েই কমিউনিকেশানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ভাষার অর্থ ছাড়াও ধ্বনিমাধুর্য সাধারণ শ্রোতার কানকে আকৃষ্ট করবেই। ‘সরোবর কি ফেনার নুপূর পরা ঝরণার মত নাচতে পারে?’—এ জাতীয় বাক্যবন্ধে অর্থের আগেই কানকে তৃপ্ত করে এক অনুপম সাঙ্গীতিক অভিজ্ঞতা।
কিন্তু নৃত্যনাটক নামে যে মাধ্যমটি সৃষ্টি করলেন রবীন্দ্রনাথ, তাতে সংগীত, নৃত্য, নাটক সবকিছুর এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটে গেল। এই সমন্বয় কিন্তু আকস্মিক নয়। প্রাচীন ভারতের নাট্যশাস্ত্রে ‘কায়িক’ বা শরীরী অভিনয়কে ‘বাচিক’ বা সংলাপধর্মী অভিনয়ের সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুখের ভাষা অঞ্চলবিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে কিন্তু শরীরের ভাষার আবেদন সার্বিক। ভাষা না বুঝলেও নৃত্যভঙ্গি দেখে আমরা ধরে নিতে পারি কোনটি নিবেদনের, কোনটি অনুরাগের, কোনটি বা তিরস্কারের প্রতিবিম্ব। আধুনিক পৃথিবীতে ‘টোটাল থিয়েটারের’ যে ধারণা ধীরে ধিরে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাটকের ধারণা তার কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
সমসাময়িককালে কলকাতার ডান্সার্স গিল্ড সুখ্যাত ড: মঞ্জুশ্রী চাকীসরকারের নৃত্যনির্মিতিতে রবীন্দ্রনৃত্যনাটকের যে আধুনিক মঞ্চভাষ্য রচনা করেছে তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনুভব করবার অভিজ্ঞতা হয়ত আমেরিকার অনেক দর্শকের ঘটেছে। রবীন্দ্রনাটক নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে আরও কয়েকটি দল। মুখের ভাষায় ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে শরীরী অভিনয় দিয়ে অনুভবকে বাঙ্ময় করার প্রয়াসে রচিত হচ্ছে অনেক মঞ্চনির্মাণ। পিটার ব্রুকের থিয়েটার ভাবনায় (‘মহাভারত’ মনে পড়বে অনেকেরই) যেমন শরীরী অভিনয়, মুদ্রা ও নানারকম মাইম ও দেহভঙ্গি একধরনের সার্বজনীন নাট্যভাষা রচনা করে, রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়নেও এই ধরনের বিশ্বজনীন নাট্যভাষা নির্মাণের প্রয়াস চলছে। নৃত্যনাটকগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হল এই যে সঙ্গীতের মোড়ক ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ এই সৃষ্টিগুলিকে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে সরিয়ে রাখতে চান নি—সংগীত বরং বিষয়কে একটা সার্বজনীন মাত্রা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নিজের কথা অনুসরণ করে বলা যায় যে পুলিশ-কেসের রিপোর্ট হিসেবে শ্যামা-চণ্ডালিকা রচনা করা হয় নি। কিন্তু মজা এইখানেই যে অনুসন্ধানের চোখ নিয়ে দেখলে পাওয়া যেতে পারে অপ্রত্যাশিত উন্মোচন। ‘শ্যামা’ নাটকে শ্যামা নগরসুন্দরী; কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে বেছে নেবার অধিকার তাঁর শৃঙ্খলিত। শ্যমা যখন প্রেমিক বজ্রসেনকে নিয়ে রাজপূরী থেকে পালিয়ে যায় তখন রাষ্ট্রশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে প্রহরী তার পিছনে ছোটে। ‘এমন ক্ষতি’ রাজার ‘সবে না’ জাতীয় অবমাননাকর মন্তব্যও আমরা তার মুখে শুনতে পাই। খুব সাম্প্রতিক কালে কীভাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক রাজকন্যা আলোকচিত্রীদের তাড়নায় ট্র্যাজেডির শিকার হলেন তা আমরা দেখেছি। এ জাতীয় সমীকরণ হয়ত কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিসরলীকরণের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে আমাদের, তবু ধ্রুপদী সৃষ্টি আমাদের রোজকার বেঁচে থাকাটাকে কোথাও ছুঁয়ে যায়। যায়ই।
অনেকে অভিযোগ তোলেন এ-সব দুর্বোধ্য। বরং এভাবে বলা সহজ—যা বুঝি না তা দেখবো কেন? অথচ বুঝতে যে হবেই এমন দাবী কি সবসময়েই করেন কোনো স্রষ্টা? কবিতার ক্ষেত্রে তো আমরা অনেকে মেনেই নিয়েছি যে মানে বোঝাবার দায় নেই আর কবিতার;—কবিতা শুধু প্রাণিত করতে জানে। মঞ্চের বেলায় যদি এই সত্যটাকে আমরা মানতে না চাই, তাহলে হয় মুখ ফিরিয়ে নেব অথবা চিৎকার করে উঠব ‘ডাকঘর’ নাটকের মাধব দত্তের মত—“ঠাকুর্দা, তুমি অমন মূর্তিটির মতো হাতজোড় করে নীরব হয়ে আছ কেন? আমার কেমন ভয় হচ্ছে। এ যা দেখছি এ সব কি ভালো লক্ষণ! এরা আমার ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে কেন? তারার আলোতে আমরা কি হবে?”
ঠাকুর্দা বলেন—চুপ করো অবিশ্বাসী! কথা কয়ো না।
ঠাকুর্দার মত সমাহিত দর্শকের কাছে রবীন্দ্রনাথ বা পঁচিশে বৈশাখ সেই তারার আলো। রাতে শুতে যাবার আগে সেই তারার পানে একটিবার না চাইলে ঘুমই আসবে না।