বর্তমান ভারতের বেশ কিছু চিন্তা উদ্রেককারী সমস্যার সঙ্গে কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদ জড়িত। শিখ সন্ত্রাসবাদীরা বাস থেকে হিন্দুদের নামিয়ে AK47 দিয়ে গুলি করে মারছে। দিল্লীর রাজপথে বোমা ফাটছে, ULFA উগ্রবাদীরা চা বাগানের অধিকারীদের অপহরণ করে নিচ্ছে, কাশ্মীরীরা এমন সব কাণ্ড করছে যে তাদের পিটিয়ে ঠান্ডা করতে গিয়ে বিদেশে বদনাম কিনতে হচ্ছে আমাদের সেনাবাহিনীকে। মোদ্দা কথা, বিচ্ছিন্নতাবাদ আমাদের শান্তিতে বাঁচতে দিচ্ছে না। আমাদের গণতন্ত্রের পয়লা নম্বরের শত্রু বলেই মেনে নিতে হবে বিচ্ছিন্নতাবাদকে।
বিচ্ছিন্নতাবাদ কিন্তু শুধু ভারতেরই সমস্যা নয়, এমনকি ভারতের চেয়ে ধনী ও শক্তিশালী দেশেও কমবেশি পরিমাণে বিচ্ছিন্নতাবাদ আছে। ক্যানাডার কথাই ধরা যাক। ধনী দেশ বলে প্রচুর ভারতীয় নাগরিক ক্যানাডিয়ান নাগরিকত্ব নিতে একপায়ে খাড়া। কিন্তু ক্যানাডার Quebec প্রদেশের প্রচুর ফরাসীভাষী চান Quebec ক্যানাডা থেকে পৃথক একটি দেশ হোক। বৃটেনে স্কটিশ ন্যাশানালিস্টরা আছেন, আছেন কর্নিশ ও ওয়েল্শ্ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এঁরা মাঝে মাঝেই ইংল্যান্ডের লোকেদের ছুটি কাটাবার বাড়িগুলি জ্বালিয়ে দিয়ে থাকেন। আইআরএ তো বোমাবাজি করেই চলেছে। ওদিকে ফ্রান্সে আছেন বাস্ক্ আর কর্সিকানরা। কর্সিকানরা নিয়মিত সরকারি কর্মচারীদের খুন করে থাকেন। বাস্ক্-রাও তাই করেন, কিন্তু স্পেনে। স্পেনকে আবার বাস্ক্ ছাড়াও যুঝতে হয় ক্যাটালানদের সঙ্গে। ইটালির জনপ্রিয় নর্দার্ন লীগ চান উত্তরে ইটালির Padanio একটি আলাডা রাষ্ট্র হোক। স্লোভাকিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চেকোস্লোভাকিয়াকে ভেঙে দুভাগ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এরকম বেশ কয়েকটি দেশ বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়েই চমৎকার বেঁচেবর্তে আছে। আমরাও কি সেরকম কিছু পারি না? “বিচ্ছিন্নতাবাদ” আর “দেশদ্রোহিতা” নিয়ে এত চেঁচামেচি করেও কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যাটা বেড়েছে, কমেনি। আশির দশকে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আচ্ছাসে পিটিয়ে দেবার পর এখন পাঞ্জাব শান্ত। কিন্তু পাঞ্জাবিরা আনন্দে ধেই ধেই করে নেচে উঠছেন না।
উল্টে রেগে গিয়ে দাবি করছেন যে পুলিশী অত্যাচারের একটা বিহিত হক। আস্তে আস্তে বোঝা যাচ্ছে যে কাশ্মীরীরা সাংঘাতিক বিচ্ছিন্নতাবাদী তো বটেই উপরন্তু মার খেয়েও মত পাল্টানোর নাম নিচ্ছেন না। উত্তর-পূর্বের কয়েকটি উপদ্রুত অঞ্চল নিয়ে আর মন্দ কিছু বলবো না। অপহরণ, গেরিলা আক্রমণ, গণহত্যা এইসব খোলাখুলি চালু হয়ে গিয়েছে।
প্রথমটা হল এই বিশ্বাস যে বিচ্ছিন্নতাবাদ আমাদের এক জবরদস্ত্ শত্রু যাকে ছলে-বলে কৌশলে হারাতেই হবে। আমাদের আইনে তো চিরকালই ধরে নেওয়া হয়েছে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানেই রাষ্ট্রের শত্রু, তা যে যতই অহিংস, শান্তিকামী বা অন্যান্য বিষয়ে শ্রদ্ধার পাত্র হোক না কেন। তাকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত যে কোন কঠিন শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। যেমন ১৯৫৩ সালে দিল্লী থেকে সন্দেহ করা হয় যে শেখ আবদুল্লা একটু বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঝুঁকেছেন। কাশ্মীরের সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও শেখ আবদুল্লাকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে “Public Safety Act” নামের বেশ দুর্বোধ্য একটি ধারায় কোনভাবে ফেলে দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর প্রায় দুই দশক ধরে জেলের ভিতর আর বাইরে করেই ওনাকে কাটাতে হয়। শাবির শাহ নামের আরেকজন শান্তিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতাবাদীকে একই কারণে বহু বছর জেলে কাটাতে হয়। কয়েক বছর আগে তাঁর মুক্তির সময় জম্মু ও কাশ্মীরের জনতা তাঁকে বীরের সম্বর্ধনা জানায়।
শেখ আবদুল্লাকে ১৯৬৪-এ যখন মুক্তি দেওয়া হয় তখনও ঠিক এরকমই সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল। Times of India-য় হেডলাইন বেরোয়- “ABDULLAH SET FREE HERO’S WELCOME GIVEN IN JAMMU”। লেখা হয় যে “Sheikh Abdullah received a hero’s welcome today on his release after spending continuously five years and five months in captivity. About 1,00,000 people lined the streets and cheered him as he was taken in procession to the dak bungalow from the special jail… The three-mile route through which the Sheikh was taken in a flower-bedecked jeep was packed with people. Balconies, terraces and every other vantage point was occupied… Sheikh Abdullah came out into the court compound, where he was besieged by a small crowd that had collected there. Slogans hailing him as their leader rent the air, as the people milled around him.” অল্পদিন পরেই অবশ্য দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে আবার জেলে পুরে ফেলা হয় তাঁকে।
এটা কি একধরনের অসুস্থ মানসিক দ্বন্দ্ব বা schizophrenia-র লক্ষণ? বিপুল জনপ্রিয় এবং বিন্দুমাত্র সন্ত্রাসবাদে যাঁদের সায় নেই সেইসব রাজনীতিজ্ঞদের জেলে পুরে কি সত্যিই জাতির স্বার্থরক্ষা হচ্ছে? আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হল এই যে- এরকম ভাবে চললে অহিংস বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কি নিরুপায় হয়ে সন্ত্রাসবাদের দিকে চলে যাবেন না?
পৃথিবীর অভিজ্ঞতা তাই বলে। ষাটের দশকে FLQ (Front de la liberation du Quebec)-র নেতৃত্বে ক্যানাডায় একটি রক্তক্ষয়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম চলছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদী দলটি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিককে অপহরণ করে খুন করলে বিখ্যাত “October Crisis”-এর সূচনা হয় যখন ক্যানাডা সরকার “War Powers Act” ধারাটির শরণাপন্ন হন। এই ধারায় বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করা সম্ভব হত। কিন্তু ক্যানাডার জনতা ধারাটিকে অতিরিক্ত কঠোর ও দমনমূলক মনে করে এবং সরকার ধারাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
ভারত হলে কঠোর পুলিশী ব্যবস্থা নেওয়া হত- যার ফলে কিছু যুবসম্প্রদায় উগ্রপন্থী দলে গিয়ে ঢুকতো। ক্যানাডা সে ভুল করে নি। সেখানে Quebec-এর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আইনসম্মতভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে দেওয়া হয়। খুব শীগ্গিরই পৃথকবাদীদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। Quebec-এর আঞ্চলিক সরকারটি বহুবছর ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদী দল “Parbi Quebecois” গঠন করে আসছে। এমনকি ক্যানাডার সংসদে বহুকাল যাবৎ “Bloc Quebecois” দলের সদস্যসংখ্যা ছিল সর্বাধিক। অর্থাৎ ক্যানাডার সংসদে বিপক্ষ দলের নেতাই ছিলেন একজন অন্যতম বিচ্ছিন্নতাবাদী- Lucien Bouchard.
ক্যানাডার অখণ্ডতাবাদীদের কাছে ব্যাপারটা যেমনই ঠেকুক- ভারতের পথ অনুসরণ করে Parbi Quebecois আর Bloc Quebecois-কে বেআইনি ঘোষণা করে সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জেলে পুরে দিলে যে Quebec-এ অন্তহীন রক্তপাত ছাড়া আর কিছুই হত না একথাটা সবাই স্বীকার করেন। এখনও Quebec ক্যানাডার অংশ কারণ Quebec-এ অখণ্ডতাবাদীরা অল্পের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিলেন দুটি referendum বা গণমতদানে (কয়েক বছরের মধ্যেই আরো referendum হবে স্থির করা আছে)। FLQ-এর মত উগ্রপন্থী দলগুলি একেবারেই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছে এবং Quebec-এর ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নটি ঝুলে থাকা সত্ত্বেও সেখানকার জীবনযাত্রা খুবই শান্তিপূর্ণ।
এবার বাজারচলতি দ্বিতীয় ধারণাটায় আসা যাক। ভারতে আমাদের আরেকটি দৃঢ় বিশ্বাস এই যে বিচ্ছিন্নতাবাদ শিকড় গেড়ে ফেললেই রক্তপাত, সন্ত্রাসবাদ এসব দেখা দেবেই। কিন্তু Quebec-এর উদাহরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে উগ্রবাদী দলগুলির শক্তির উৎস যে জনতা তাকে যদি রাজনৈতিক মত প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে রক্তপাত ও সন্ত্রাসবাদ এড়ানো সম্ভব। সোজা বাংলায়, নিজেদের মতামত শান্তিতে জানাতে পারলে লোকজন বোকার মত রক্তপাতের পথে যাবে কেন?
এসব কিছুটা নির্ভর করছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জনসমর্থন কতটা তার উপর। যেমন ফ্রান্সের “Pays Basque”-দের তেমন জনসমর্থন নেই, তাই ফ্রান্স এদের খুব একটা গা করেনি। কিন্তু স্পেন খুবই জনপ্রিয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দলকে (যাদের রাজনৈতিক অঙ্গগুলি নির্বাচনে ১০-১১ শতাংশ ভোট পায়) পাত্তা না দিয়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসবাদী সংগ্রামের সম্মুখীন হয়েছে। ক্যানাডায় তো বিরাট একটি রাজ্যের প্রায় অর্ধেক লোক বিচ্ছিন্নতাবাদী। তা দমন করতে গেলে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। সুতরাং ক্যানাডা দমনের পথেই যায় নি।
এসব করতে গেলে অবশ্য আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া এবং হয়ত কিছু প্রদেশের সত্যি সত্যিই পৃথক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে মেনে নিতে হবে। এইখানেই আসল জায়গায় ব্যথাটা ওঠে আমাদের। যদি কাশ্মীর বা নাগাল্যান্ডকে আলাদা হতে দিই তাহলে দুদিন পরে পুরো দেশটাই ছারেখারে চলে যাবে না তা কি বলা যায়? অসম্ভব নয়, কিন্তু গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা অন্যরকম শিক্ষাই দেয়। বিচ্ছিন্নতাবাদ কিন্তু ছড়ায় নি। ছোঁয়াচে রোগ নয় বলেই মনে হয়। পাঞ্জাব আর কাশ্মীরের চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী যুগে গুজরাট, উড়িষ্যা বা এমনকি তামিলনাড়ুতেও কেউ তাদের অনুসরণ করতে চায় নি। তেলেঙ্গানা, বিদর্ভ, সৌরাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, উত্তরখণ্ড প্রভৃতি সমস্ত গণআন্দোলনগুলিই ভারতের মধ্যে থেকেই নতুন আঞ্চলিক বিভাজন সংক্রান্ত আন্দোলন ছিল।
Quebec বা Scotland এর বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে আমাদের দেশের কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদের পার্থক্যটা কোথায়? একটা সহজ পার্থক্য এখানেই যে আমাদের দেশের লোকেরা গরীব। গরীব ভুখা মানুষের হারাবার মত কিছু নেই। তারা সহজেই অস্ত্র ধরতে পারে।
কিন্তু ক্যানাডার সরকার যদি ভারত সরকারের মত দমনমূলক আইন চালাতে থাকে তাহলে যে Quebec-এর লোকেরাও বন্দুক তুলে নেবে একথা যে কোন রাজনীতিজ্ঞই স্বীকার করবেন। এর মানে এই যে Quebec-এ পাঞ্জাব বা কাশ্মীরের মত সহিংস আন্দোলন তৈরি করার জন্য সেখানকার মানুষদের ভারতীয় জনতার মত গরীব করে দেবার প্রয়োজন নেই। ভারত সরকার স্বাধীনতার পর থেকে যে নীতি অনুযায়ী চলছে সেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বেআইনি ঘোষণা করে জেলে পোরার নীতি অনুসরণ করলেই চলবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গে সঠিকভাবে সহাবস্থান করতে চাইলে আমাদের মেনে নিতে হবে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের মত সংখ্যালঘু বিচ্ছিন্নতাবাদী জনমতেরও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পথ অনুসরণ করার ক্ষমতা আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র থেকে আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে যে দমনমূলক মানসিকতা পেয়েছি এবং যা আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিজ্ঞ ও সরকারি অধিকারী একমাত্র উপায় বলে বুঝিয়ে দিতে চান- তা দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পথ খুঁজে নিতে পারি। প্রথম পদক্ষেপ হবে সংবিধানের বাক্স্বাধীনতার অধিকারে পৃথকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী মতবাদ প্রকাশ করার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এটা হলে শাবির শাহের মত বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অহিংসবাদী লোকেরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন এবং রক্তক্ষরী সন্ত্রাসবাদ থেকে জনসমর্থনকে টেনে নিতে পারবেন তাঁদের অহিংস বিশ্বাস ও নীতির দিকে। এবং এর জন্য কাউকেই নিজের নীতি বিসর্জন দিতে হবে না। দুভার্গ্যবশত ফারুক আবদুল্লা ছাড়া আর কেউই কোনরকম নীতি অনুসরণ করার ব্যাপারটাতেই তেমন উৎসাহ দেখান নি।