আমার স্মৃতিতে চিরন্তন হয়ে আছে যে ছবিটি সেটি একটি শিশুর-- সে একটা চত্বরে জমা একদল পায়রার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে রয়েছে; কাছেই দাঁড়ানো বাবা-মার মুখ না-বোঝা-খুশিতে উজ্জ্বল। ছবি দেখতে গেলে আমাদের অনেকেরই এই বাবা-মার দশা হয়-- শিল্পীর কথাটি সহজে বুঝতে পারি না। চিত্রকলা হ’ল সেই জানলাটি যেখানে উঁকি দিলে দেখতে পাই শিল্পীর যা একান্ত নিজবাস-- এক কল্পলোকের সৌধগুলি শিল্পী যা নিবেদন করেছেন হয়তো কোন বিশেষ মুহূর্তকে অমর করে রাখতে, কোন দৃষ্টিকোণকে তুলে ধরতে, কিংবা নিয়তির এক পরিহাসের উদ্দেশ্যে। আপনি আমি শিল্পীর সেই বিশেষ মানসলোকে পৌঁছতে না পারলেও ছবি দেখতে দেখতে আচমকা যেন অন্য এক সত্যকে অনুভব করতে পারি।
এই ছবিগুলি শিল্পী শ্রী অভিশংকর মিত্রের আঁকা। শ্রী মিত্র একজন কলিকাতা-বাসী শিল্পী। ১৯৮৯ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছেন। গণেশ হালুর-এর ছাত্র। বিশেষ বিষয় ছিল Western Painting. পরে, তিনি গণেশ পাইনের ঘন সান্নিধ্যে আসেন এবং আছেন। তাঁর কাজের একক ও গ্রুপ প্রদর্শনী একাধিকবার বিড়লা অ্যাকাডেমী অব ফাইন আর্টসে (কলকাতা) হয়ছে এবং শেষে আর্ট গ্যালারী (মুম্বই)-তে একক প্রদর্শনীও হয়েছে। নিউ দিল্লীর আর্ট-টু-ডে এবং মুম্বইয়ের দুর্গা আর্ট গ্যালারী-প্রমুখ সংস্থার সংগ্রহেও আছে তাঁর ছবি। সম্প্রতি ভারতের স্বাধীনতার ৫০-তম জয়ন্তী উপলক্ষ্যে দিল্লীতে IFACS-এ অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর পশ্চিম বঙ্গ বিভাগে তাঁর ছবি স্থান পেয়েছে।
আমি পেশাদার শিল্পসমালোচক নই তাই আমার কোন বিশেষ মত প্রকাশের দায়ভারও নেই। পাঠকদের অনুরোধ করি তাঁরা “দর্শক” হয়ে এই ছবিগুলিকে উপভোগ করে নিজ নিজ মত গড়ে তোলেন। এই ছবিগুলিতে সুন্দর রঙের ব্যবহার আমাকে যে বিশেষ ভাবের জগতে নিয়ে যায়, আমি বলবো, সেটাই আমার ভালোলাগার কারণ হিসেবে যথেষ্ট।
ছবিগুলির স্টাইল আমাকে Egon Schiel¬¬-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। উনি হলেন তথাকথিত ‘ভিয়েনা ১৯০০’ আর্টিস্ট। এঁর স্কেচগুলির যন্ত্রণাবিকৃত প্রতিকৃতির উপরের বলিষ্ঠ রঙের সংঘাতমুখের ব্যবহার ছিল যৌবনের বিধ্বংসী শক্তির প্রতীক (দ্র: Agony 1912)। শ্রী মিত্রের কাজগুলি অবশ্য আরো অনেক মৃদু সুরের। সবকটি ছবিই তাদের ভারতীয়ত্বের কথা মনে পড়াতে ভোলে না।
শ্রী মিত্রের মত বেশীরভাগ শিল্পীরই প্রথম দিকের ছবিতে কারিগরি কৌশল ও টেকনিক প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তুলনায় কম নজর পায় সুন্দরের বিশেষ চেতনার অভিব্যক্তি, যাকে শিল্পীরও শিল্পী, Agnes Martin, বলেছেন an awareness of perfection.
শতাব্দীর গোড়াকার Schiele-এর নগ্ন বাস্তবতা থেকে Agnes Martin বা Ad Reinhardt-এর মত আমেরিকান মডার্নিস্টদের zen-সুলভ বিমূর্ত সুষমায় উত্তরণের পথ, আমার বিশ্বাস, দীর্ঘ ও দুর্গম। এ ব্যাপারে মার্টিনের উপদেশ: “শিল্পীর কাজ নয় জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা করা-- সব মানুষী শিক্ষা, বোধবুদ্ধি, ভাগ-বিভাজন, আর্টের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়-- তা শুধু মনকে বেঁধে রাখে, যে মনই যোগাবে শিল্পীকে তার অনুপ্রেরণা।”
আর Reinhardt-ও এর অনুরণন তোলেন: “ছবি আঁকা এক বিশেষ, আলাদা কাজ-- ধ্যানের ও মননের বিষয় আমার কাছে-- কোন শারীরিক বা সামাজিক খেলা নয় এ। যত রকম চেতনা সম্ভব—আধ্যাত্মিক, নিবিড় শান্তি, গূঢ়, সুসমঞ্জস। স্থান নেই এতে কোন স্বয়ংক্রিয়তার, দুর্ঘটনার বা দৈবাৎ-এর, স্থান নেই কোন মনের উদ্বেগ প্রকাশের বা দুশ্চিন্তা মুক্তির। (শিল্পী হবেন) নির্লিপ্ত, নিষ্কাম, চিন্তাশীল, অতীন্দ্রিয়। ভণ্ডামি নয়, জোর করে খাপ খাওয়ানো নয়, নির্যাতন নয়, নয় কোন নির্বোধের মত একটার সঙ্গে একটা জিনিশ গুলিয়ে ফেলা।”
শ্রী মিত্রের কল্পরাজ্য এই ছবিগুলি। আশা করা যায় ভবিষ্যতে তিনি এখানে আরো অনেক সৌধ নির্মাণ করবেন আমাদের উপভোগের জন্য। এবং সময়ের সাথে তাঁর ভাব প্রকাশের জন্য নিজস্ব নান্দনিক ভাষাও ঠিক করে ফেলবেন। তখন কোন পূর্ব-পশ্চিম ভাগের কথা আর মনে পড়বে না। শুধু থাকবে সেই “universal awareness of perfection”।
যোগাযোগের ঠিকানা: শ্রী অভিশংকর মিত্র, পো: অ: হরিনাভি; ২৪ পরগনা; পশ্চিম বঙ্গ ৭৪৩৩৫৯। ফোনেঃ