সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়-এর প্রথম তথ্যচিত্র “Free To Sing” বিষয় ও বক্তব্যে বেশ পরিণত। ৫৭ মিনিটের এই ছবির কেন্দ্রবিন্দু শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়, তাঁর “হয়ে ওঠা গান” এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে তাঁর বিতর্কিত জেহাদ। সুমন সম্পর্কিত প্রচুর তথ্যবহুল এই ছবি সুমন-ভক্তদের (এবং বিরোধিদেরও) অবশ্য দ্রষ্টব্য। তথ্যচিত্রের প্রথম থেকেই নামে “Sing”-এর অক্ষরে আর Woody Guthrie-র উক্তিতে “political overtone”-টি খুব স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও সুমনের গানের প্রতি নিখাদ প্রেমও গুরুত্ব পেয়েছে সুদীপ্তর পরিচালনায়। সংগীতের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা এবং “জীবনমুখী গান” বাঁধার অনুপ্রেরণা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। সুমনের গান লেখার পদ্ধতি (গায়কের ভাষায় “cooking”), অর্থাৎ একটি উড়ো পঙ্ক্তি অথবা টুকরো বাক্যের ওপর ভর দিয়ে লিখে ফেলা গান, তারপর সুরসৃষ্টি, গায়ক নিজেই যত্নসহকারে বর্ণনা করেছেন। সুমনের সমাজসচেতনেতা এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে গুছিয়ে আলোচনা করেছেন পরিচালক। শুধু Voice of America-য় থাকাকালীন উনি কিভাবে নিকারাগুয়া যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হলেন সে ব্যাপারে আরেকটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। সেটা যে নিছক romanticism নয়, এই ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই সমালোচকের ধারণা।
সুমন যে বিশেষ ভাবে কলকাতা-কেন্দ্রিক, সে সত্য লুকানোর চেষ্টা করেননি পরিচালক--প্রথম গান থেকেই সেটি পরিষ্কার। কলকাতার অসংখ্য টুকরো মহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে যা কলকাতাপ্রেমীদের দারুণ appeal করবে, সুমনের গানের “visual aspect” সুদৃঢ় করা ছাড়াও। এর ওপর এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে অসাধারণ সাবটাইটেল (বিশেষ করে গানগুলির অনুবাদ)। তবে “hand-held” ক্যামেরায় কয়েকটি ছোট ছোট “jerk” একটু অস্বস্তিজনক। অন্যদিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সম্বন্ধে সুমনের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট জানা যায় ওনার নিজের কথায়-- “… to me, music is more expression than creation.” তথ্যচিত্রের শুরুতে সুমনের ভাষ্য--“I am a practising musician, I make my living this way”, প্রমাণ করে যে শুধুমাত্র জনহিতার্থে উনি গিটার কাঁধে রাস্তায় নামেন না। পরিচালককে ধন্যবাদ উনি এ ব্যাপারে কোন বিতর্কের অবকাশ রাখেননি। এই তথ্যচিত্র যে সুমনবন্দনা নয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাধারণ শ্রোতাদের সাক্ষাৎকার থেকে। পরিচালকের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই, কিন্তু আরও কিছু উঁচুদরের সঙ্গীতবোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হলে ভাল হত (নচিকেতা, মৌসুমী ভৌমিক, তরুণ ভট্টাচার্য, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের “নাগরিক” গোষ্ঠীর প্রতিনিধি মন্তব্য করেছেন)।
সামগ্রিকভাবে ছবিটির টেকনিকাল মান বেশ উঁচু হলেও কয়েকটি অসংলগ্ন “cut” এবং হঠাৎ “zoom out” মাঝে মাঝে খাপছাড়া লেগেছে (কলকাতার কিছু শটে)। সুমনের সঙ্গে মুখোমুখি শটে “big close up”-এর ব্যবহার একটু বেশি বলে মনে হয়। আর পরিচালক নিজে কি অবগুন্ঠিতই থাকতে চেয়েছেন? এক-আধবার প্রশ্নকর্তাকে দেখালে ছবিটি একটু ভিন্ন মাত্রা পেত বলে মনে হয় (যেমন শ্যাম বেনেগালের তোলা সত্যজিৎ-এর ওপর তথ্যচিত্র)। সুমনের স্ত্রীর (মারিয়া চট্টোপাধ্যায়) বাংলায় সাক্ষাৎকার বেশ চমক লাগায়। এছাড়া অধিকাংশই ইংরেজিতে বক্তব্য রেখেছেন (যেটা স্বাভাবিক)। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে পীট সীগারকে নিয়ে তলা অংশের কয়েকটি মুহূর্ত, ওনার সঙ্গে সুমনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কথা জানানো ছাড়া, তথ্যচিত্রের মান উন্নয়নে খুব একটা সাহায্য করেনি।
তথ্যচিত্রের শেষ অংশটিতে রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে এবং ছবিটি শেষও হয়েছে অনেকটা “black tone”-এ। একটু কম নেতিবাচকভাবে বা আরেকটু আশার আলো দেখিয়ে কি শেষ করা যেত না? বিশেষত: একজন শ্রোতার মতে যখন সুমনের গানের শেষে আশার আলো থাকে। তাছাড়া সুমনের এই শংকা বাস্তবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে নিয়ে সন্দেহ আছে। পশ্চিমবঙ্গে সুমনের এখন যা “stature” তাতে আইনের বাইরে গিয়েও তাঁর এবং তাঁর পরিবারের (মারিয়ার মুখে শোনা গেছে-- “খুন করে ফেলবে”) কতটা ক্ষতি করা সম্ভব সে ব্যাপারটি তর্কসাপেক্ষ। সুমনের গানের মত এক্ষেত্রেও যদি বিরুদ্ধমতপোষণকারীদের পরিচালক ক্যামেরার সামনে আনতেন, ভাল হত। সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গের যে অনিশ্চয়তা সুমনকে দেশের বাইরে যেতে বাধ্য করেছিল, আজকের পরিস্থিতি তার থেকেও মারাত্মক কিনা জানা গেল না। বিক্ষিপ্তভাবে দেখানো সুমনের “live” অনুষ্ঠান, এবং মুক্তকন্ঠে সরকার ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে তাঁর “crusade” ঘোষণা দেখে, সুমন যে পায়ে শেকল পরে আছেন, সেই ধারণা বদ্ধমূল হয় নি।
Free To Sing?-- এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব দর্শকদের।
FREE TO SING?
পরিচালনা-- সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদনা-- এনায়েত করিম বাবুল
চূড়ান্ত কাট্ (Final Cut) ও ধ্বনি-- স্কট ল্যাঙ্কাস্টার
চিত্রগ্রহণ-- সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় ও অমিত সেন
সংগীত-- পীট সীগার
কার্যকরী প্রযোজক-- গার্গী মুখোপাধ্যায়