• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৩ | জানুয়ারি ২০২৪ | গল্প
    Share
  • এই তো জীবন : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

    ঘিয়া নদীর ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সুজয়। কোমর অবদি ঢালাই রেলিং। সামনেই এই খিরিশ গাছ। প্রায় নদীর কিনারা থেকে বেড়ে উঠেছে গাছটা। ডালপালা মেলেছে আকাশের দিকে। সে নদীর দিকে তাকাল। নরম কাদামাটিতে হাজারো পায়ের ছাপ। সুজয় শুনেছে ঘিয়া হল ভাগীরথীর শাখা নদী। গতকালও নদীতে কিছু জল ছিল। এখন খুব সামান্য পরিমাণ জল আছে বিক্ষিপ্ত কিছু কিছু জায়গায়। পাড়ের নরম কাদামাটিতে বীজ পুঁতেছে কেউ।

    রাস্তার পাশেই স্ট্যান্ড দিয়ে সাইকেলটা রেখেছে সুজয়। কাত হয়ে আছে তার দ্বি-চক্রযান। ব্রিজের রেলিং-এ দু’হাতের ভর দিয়ে সাইকেলটাকে দেখল সে। শীতের রোদের ছায়া ফেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। কোনো সাইকেল যে এতটা বোদামার্কা হতে পারে, তা সুজয়ের ধারণাতে ছিল না। সাইকেলটার ফুল চেন কভার আছে। প্যাডেল ঘোরালেই নানারকম আওয়াজ বেরোয়। যেন মাল্টি-মেসিন কারখানা। বিরক্তিতে সে লাথিও কষিয়েছিল কয়েকবার। তাতে শব্দ পাল্টাল, কিন্তু বন্ধ হল না।

    সাইকেলটা অবশ্য তার নয়। অফিসের। যাতায়াতের সুবিধের জন্য তার বস তাকে দিয়েছেন। ট্রেন ধরতে যাবার পথে সে এখানে দাঁড়ায় রোজ। পাঁচ-সাত মিনিট ধরে এখানে দাঁড়িয়ে সে নদী দেখে। এখানের উন্মুক্ত প্রকৃতি দেখে। বলা আছে, কাজ ছাড়লে সাইকেল অফিসে জমা দিয়ে যেতে হবে।

    আমাকে একটু পৌঁছে দেবে বাবা?

    সুজয় ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। লাল পাড়, সাদা শাড়ির এক বৃদ্ধা পায়ে পায়ে কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার কাত হয়ে থাকা সাইকেলের সামনে। বৃদ্ধার একমাথা কাঁচাপাকা চুল। ছোট্ট, ক্ষীণ শরীর। পৌষের এই শীতেও তার গায়ে সামান্য একটা চাদর। বৃদ্ধা তার দিকে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে।

    যাবে কোথায়?

    একটু মাজিনান যাব। পৌঁছে দেবে, বাবা? খুব ভালো হয়।

    মাজিনান এখান থেকে দশ মিনিট লাগে সাইকেলে। সেটা আদিবাসী পাড়া। ওর দুটো গ্রাম পরেই সুজয়ের অফিস। সে একটি এনজিওতে কাজ করে। সেন্ট্রাল গরমেন্টের একটি প্রোজেক্টে সে কাজ করে। সেটি হল কেবলমাত্র মাধ্যমিক পাশ এসসি ও এসটি ছেলেমেয়েদের জন্য। নিখরচায় টাইপ ট্রেইনিং সেন্টার। সেখানে সে টাইপ শেখায়। তাই অফিসের সকলে তাকে টাইপ মাস্টার বলে ডাকে।

    সে বৃদ্ধাকে না-করতে পারল না। কিন্তু দু-চাকা সাইকেল গড়াতে না গড়াতে সে বুঝল, বুড়ির বোঝা যতটা না ভারি, কথার ভার তার চেয়ে বেশি। সুজয়ের বাড়ি কোথায়, সে অতদূর থেকে এখানে কেন, কি কাজ করে সে, কত টাকা মাইনে, বিয়ে করেছে কিনা, বাড়িতে আর কে কে আছে, বাবা কি করে, ভাইবোন কটা—এইসব হাজার প্রশ্নে সুজয়ের মাথা ও কান ঝালাপালা করে দিল। সুজয়ের মনে হল, বুড়িকে দিই নামিয়ে। হেঁটে ফিরুক বুড়ি।

    সব কথার উত্তর দিচ্ছিল না সুজয়। একটি প্রশ্নের উত্তর করে, বাকি দশটা প্রশ্নের জবাব হুঁ-হা দিয়ে সারে। ইতিমধ্যে বুড়ি তাকে নাতি নাতি করে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। সঙ্গে তুমি ছেড়ে ‘তুই’তে নেমে এসেছে। সাইকেল চালাতে চালাতে সুজয় ভাবছিল, বুড়ি কী খায়?

    আসলে তার মন ভালো নেই। তিনমাস হল মাইনে বন্ধ। যদিও যে প্রোজেক্টে সে কাজ করে সেই প্রোজেক্টের টাকা দিল্লি থেকে আসেনি, তবুও এনজিওতে হাজার কাজ হয়, নানা প্রোজেক্ট চলে। কেন্দ্রের প্রোজেক্ট, রাজ্যের প্রোজেক্ট। তার প্রোজেক্টে টাকা না-এলেও অন্য প্রোজেক্টে তো আসে। সেখান থেকেও কিছু কিছু করে সুজয়কে কি এনজিও সেক্রেটারি দিতে পারেন না? খুব পারেন। কিন্তু দেবেন না। এটা হল একটা সুচতুর ঢ্যামনাপনা!

    এসব নিয়ে তার বাড়িতেও ঝামেলা। একটা বয়সের পরে যদি বাড়ি থেকে টাকা নিতে হয় তো, সেখানে দুর্দশার শেষ থাকে না। এখন তার সাতাশ বছর বয়স। এখনও তাকে বাড়িতে হাত পাততে হয়। রোজই সে ভাবে এই ছাতার চাকরি ছেড়ে দেবে। কিন্তু করবেটা কী?

    বাড়ির সামনে নেমে বুড়ি তার হাত ধরে টানে। বলে, চল নাতি। আমার বাড়িতে চল।

    দেরি হয়ে যাবে ঠাকুমা। আর একদিন আসব।

    না, তুই চল। পরে আর আসবিনে, সে কি জানি নে ভাবিস?

    বলে বুড়ি তাকে হাত ধরে টেনে বাড়ির ভেতরে ঢোকায়। উঠোনের চারপেয়েতে বসতে দেয়। বুড়ির কিশোরী নাতনি চিনির জল করে দেয়। জলের উপর মৃত একটি ক্ষুদে পিঁপড়ে ঘুরপাক খায়। স্টিলের গ্লাস। একটি স্টিলের রেকাবিতে শশা আর গাজর কুচিয়ে দিয়ে যায়। সঙ্গে এক ছিটে বিট নুন।

    বুড়ির আছে দুটি ঘর। দুটিই মাটির। মাথায় খড় চাপানো। উঠোনের চার-পাঁচটি মুরগি বাচ্চা খেলা করে। তারা সুজয়ের পায়ে পায়ে ঘোরে। নানারকম তাদের রং। উঠানের একদিকে একটা দোপাকা উনুন। ঘরের দেওয়ালের একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা অবদি কালো রং। বাড়ির পিছনে কলাবাগান। ডালিম গাছ।

    বুড়ি বলে, ওর মাসির ঘরেই গেছিলাম। সেও আমার এক মেয়ে। তবে ভালো মেয়ে। বর নিয়ে সংসার নিয়ে আছে। আর ও আমার কাছে থাকে। ছোট থেকেই ও আমার কাছে আছে। ইস্কুল যায়।

    কোন ক্লাসে পড়ো?

    মেয়েটি বলে, নাইন।

    রুপু, নাতিকে ফুল দে।

    বাড়ির একপাশে গাঁদা গাছ। লাল হলুদ গাঁদাফুল থোকা থোকা হয়ে ফুটে আছে। মেয়েটি কটি ফুল তুলে সুজয়ের হাতে দিয়ে কেমন জানি লজ্জা পায়। সুজয়ের বেশ লাগে। মেয়েটিকে দেখতেও খারাপ নয়। কালো হলেও একটা মিষ্টতা আছে। রোগা রোগা গড়ন। চোখ দুটি একেবারে কাজলকালো।

    সুজয় বলে, তুমি কোন স্কুলে পড়ো?

    আপনাদের অফিসের কাছে যে স্কুল আছে, সেখানেই।

    আমায় চেনো?

    হ্যাঁ। বলে সে ঘাড় করে। বলে, অনেকেই চেনে। আপনি টাইপ শেখান। মাধ্যমিক পাশ করে আমিও টাইপ শিখতে যাব। আমাকে শেখাবেন তো?

    নিশ্চয়।

    বুড়ির বাড়িতে বেশ রোদ। সোজাসুজি রোদ এসে মাটিতে বিঁধে যাচ্ছে বলেই মাটিয়ে কখনও শ্যাওলা ফুটে ওঠে না।

    সুজয় উঠে পড়ল বলল, আজ যাই ঠাকুমা। অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে।

    মেয়েটি দুয়ারের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নীল চুড়িদার। পাজামা সাদা। পায়ে সাদা নূপুর। চুলের বিনুনি একটি এসে পড়েছে তার সুগঠিত বুকের উপর। সুজয়ের মনে হল, মেয়েটি কিছু বলতে চায়। কী?

    বুড়ি বলল, আবার আসিস নাতি। সর্ষে উঠলে মনে করে আসবি। সর্ষে দেব। মাছের ঝাল করে খাবি।

    সুজয় দেখে মেয়েটি দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। কিছু বলার জন্য অধর উন্মুখ। সুজয়ও কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল।

    বুড়ি বলল, কিছু বলবি নাতি?

    বলার ছিল সুজয়ের। কিন্তু বলা হল না। দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, না।

    সে আবার ঘুরল রুপুর দিকে। পনের বছরের মেয়েটার মধ্যে এমন একটা টান আছে, রূপের এমন জেল্লা আছে, যা সুজয়কে তার দিকে ঘুরতে বাধ্য করল। সুজয় বলল, কিছু বলবে রুপু?

    রুপু হাসে। মাথা নাড়ে। একগাল হাসি তার মুখে।

    সুজয়ের হাসি আসে না। তবে ভালো লাগে। মনটা অনেকটা হাল্কা হয়ে যায়। কিন্তু রুপু কী বলতে চেয়েছিল?

    সাইকেল চালিয়ে সে একাই ফিরে এল মুইদিপুর ব্রিজের উপর। নিচে সেই গঙ্গানদী বয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির মুখটা তার মনে পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটির নামটাও খুব সুন্দর। রুপু হাঁসদা। কি সুন্দর বাড়ি তাদের। কি সুন্দর সেখানের আকাশ-বাতাস আর পরিবেশ। মুরগির বাচ্চারাও কম সুন্দর নয়। কি সুন্দর পায়ে পায়ে ঘোরে।

    এনজিও সেক্রেটারি বলে, এত টাকা টাকা করো কেন সুজয়? সমাজসেবা করতে এসে অত টাকা টাকা করলে হবে? কাজ করো, টাকা এলে পাবে। তোমার টাকা তো আমি মেরে দিচ্ছি না।

    আর এখানে?

    রুপুর মা নেই। সে একজনের সঙ্গে পালিয়েছে। রুপুর বাপও কম যায় কিসে? বন্ধুর বউকে তুলে নিয়ে এসেছে। বিয়ে করেছে। এখন দুটিতে মিলে থাকে নিজের ঘরেই। এইসব ডামাডোলের ভেতর রুপুর জীবনটা নষ্ট হচ্ছে দেখে বুড়িটা তাকে নিয়ে চলে আসে। রুপু তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। এখন সে নাইনে উঠে গেছে। বুড়ি তার আপন দিদিমা।

    বুড়ির টাকা নেই। সে নিজে মাঠেঘাটে খেটে যা পায় তাই দিয়ে চলে। সঙ্গে আছে পশুপালন। সেসব বেচেও দু পয়সা লাভ হয়। রুপুর পড়ার পাশাপাশি বিকেলে ঘরে বসে লকেটের কাজ করে।

    বুড়ির আছে আতিথেয়তা। ভালোবাসা, মমত্ববোধ। বুড়ির হয়ত কিছু জমি আছে, বা নেই। নইলে সে কেন বলে, পরের বার আসিস, কিছু সর্ষে দেব। অথচ সেইসময় ঠোঁটে যে প্রশ্নটা এসেছিল, সেটা বলতে পারেনি সে বুড়িকে। সে বলতে চেয়েছিল, আমাকে একটা চাকরি দিতে পারো বুড়িমা? সাধারণ মাইনের একটা যে-কোনো চাকরি। দেবে?

    সে বুড়িকে বলতে পারেনি। এখানেই পারল না। এখানে কেউ নেই। আছে ঘিয়া নদী, গাছপালা আর নিঃসীম প্রকৃতি। তা-ও সে বলতে পারল না, একটা চাকরি দিতে পারো কেউ, যেখানে কিছু টাকা মাসের শেষে হাতে পাব; পারো?

    সে বলতে পারে না। বদলে নদীর পাড়ের ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরতেই পকেট থেকে গাঁদাফুলগুলো গড়িয়ে যায় মাটিতে। ওতে আছে রুপুর স্পর্শ। রুপু কী বলতে চেয়েছিল? সে চলে আসার পরে কাউকে বলেছে কি? পাখিদের, হাঁসেদের, মুরগির বাচ্চাগুলোকে? নাকি তারই মতন অব্যক্ত হয়ে রয়েছে রুপুর গলার স্বর?

    শুয়ে শুয়ে সেই ফুল কয়টি দেখতে থাকে সুজয়। যেন সেগুলি ফুল নয়, তার আর রুপুর অব্যক্ত সেই কথাগুলো পড়ে আছে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments