রোহনের বাবা বনবিভাগের বড় অফিসার। যোশীপুরে থাকেন। যোশীপুর রোহনের খুব ভালো লাগে। একবার সে বাবা-মার সঙ্গে কোলকাতা গিয়েছিল – কোলকাতা তার একটুও ভালো লাগেনি। রাস্তায় দিন-নেই রাত-নেই গাড়ি, বাস, তিন-চাকা অটো, মোটর-সাইকেল চলছে তো চলছেই। খুব আওয়াজ আর ধোঁয়া। একই জায়গায় অনেকগুলো করে বাড়ি, বাড়িগুলো ছোট ছোট। খেলার জায়গা নেই, খেলতে যেতে হয় পার্কে – সে আবার এত দুর যে অটো করে যাওয়া-আসা করতে হয়।
তার চেয়ে যোশীপুর অনেক ভালো। সব বাড়িতে খোলা জায়গা আছে, বাগান আছে। রাস্তায় দুটো-একটাই যা গাড়ি চলে। কত খেলার জায়গা চারিপাশে। আর আছে গাছ। অনেক গাছ, নানা রকমের। এখানে ঘাস খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। মা বলে যে জঙ্গলের কাছে তো তাই মাটি খুব ভালো। জঙ্গলের কাছে মানে খুবই কাছে বলা যায়। যোশীপুরের পাশেই সিমলিপালের বিরাট অরণ্য। ঘন জঙ্গলের পাশে হলে কি হবে, যোশীপুরে কিন্তু সব আছে। বাজার-হাট, হাসপাতাল, ইস্কুল। রোহনের ইস্কুলটা তো খুব বড়। আশেপাশেও অনেক বাড়িঘর তাই রোহনের বন্ধুও অনেক।
মা বললেন, “সব বন্ধুদের নাম একটা কাগজে লেখ দেখি রোহন, নয়ত দু-একজন বাদ পড়ে যেতে পারে।” আসলে এই মঙ্গলবার রোহনের সাত বছরের জন্মদিন, সবাইকে না ডাকলে চলে?
রোহনের লিখতে ভালো লাগে না, ভালো লাগে শুধু ছবি আঁকতে। তাও আবার শুধু হাতির ছবি। বড় হাতি, বাচ্চা হাতি, হাতির পাল এইসব ছবি। রোহন হাতি অনেক দেখেছে। পোষা হাতি, বুনো হাতি সব রকম। হাতি দেখতে পেলে ওর খুব ভালো লাগে। একবার বাবার সঙ্গে ওরা জঙ্গলের ভেতর বেড়াতে গিয়েছিল। একটা ঝরনার ধারে হাতির পাল দেখেছিল। হাতিরা জল খাচ্ছিল। অনেকগুলো হাতি। বাচ্চা হাতিগুলো ওদের মায়ের পেটের তলায় তলায় কী সুন্দর হাঁটছিল। বাবা বলেছে যে হাতিরা শান্ত প্রাণী। কেউ কিছু না করলে ওরা কাউকে কখনও আক্রমণ করে না। অত বড় দেহ আর অত গায়ের জোর – তবু শুধু গাছপালা লতাপাতা খেয়ে থাকে। অন্য কোনো প্রাণীকে মেরে খায় না।
রোহনের মনে হয় হাতির মতো বন্ধু আর হয় না। খুব ভালো কিছু হলে রোহন হাতির ছবি আঁকে, আবার মনখারাপ হলেও তাই।
মনখারাপ করা খবরটা এল শুক্রবার। মঙ্গলবারেই বাবার জরুরি মিটিং আছে ভুবনেশ্বরে। বাবাকে সোমবার বিকেলের দিকে বেরিয়ে যেতে হবে গাড়িতে। মঙ্গলবার সারাদিন কাজ। তারপর ফিরতে ফিরতে বুধবার বিকেল হয়ে যাবে। অনেক বড় মিটিং – যোশীপুর, সিমলিপালের অনেকে যাবে। রোহনের বাবাকে যেতেই হবে।
এদিকে জন্মদিনের জন্য সবাইকে বলা হয়ে গেছে, খাবারের আয়োজন মানে অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে – এখন আর পিছিয়ে দেওয়া যায় না। মহা মুশকিল। বাবা বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা যেমন জন্মদিনের পার্টি করছ তেমনি করো। আমি নয় সে দিনটা থাকব না কিন্তু পরের দিনই তো চলে আসব।”
রবিবার ইস্কুল ছুটি কিন্তু রোহনের মনটা একটুও ভালো নেই। সে সারাদিন বসে বসে একটা পুরোনো ক্যালেন্ডারের পেছনের বড় সাদা পাতায় অনেকগুলো হাতি আঁকল। রংও দিল – হাতিরা কালো আর ছাইছাই, আর চারপাশের গাছপালা সবুজ। বেশ সুন্দর এঁকেছিল। সোমবার ইসকুল যাবার আগে বাবার ঘরের দরজায় ছবিটা সেলোটেপ দিয়ে লাগিয়ে দিল। তারপর কী যেন ভেবে ছবির নিচে লিখল ‘আমার হাতি বন্ধুরা’।
রোহনের বাবা সোমবার বিকেলের দিকে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেন। অনেকটা পথ, যেতে যেতে সূর্য ডুবল, গাড়ি চলল হেড-লাইট জ্বালিয়ে। রাস্তার দুপাশে জমাট বন-জঙ্গল। অন্ধকারে বড় গাছগুলো দেখে মনে হয় এক একটা দৈত্য যেন। রাস্তা খালিই ছিল কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, নাহ, রাস্তা তো বন্ধ!!
ড্রাইভার গাড়ি রাস্তার এক পাশে এনে থামিয়ে দিল। রোহনের বাবা বললেন – “হুঁ, গাড়ির ইঞ্জিন, আলো সব বন্ধ কর। গাড়ি থেকে নামবে না, শব্দও কোরো না। এরা কতক্ষণে আমাদের রাস্তা ছাড়বে কে জানে!”
একপাল হাতি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। চলছে না, কিছুই করছে না, শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। রোহনের বাবা অনেক দিন বনজঙ্গলে কাজ করছেন – উনি জানেন হাতিরা কখনো কখনো চলতে চলতে এক জায়গায় থেমে যায়। তারপর কতক্ষণ যে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে তার কোনো ঠিক নেই। পুরো একটা দিনও হতে পারে। আর এই অবস্থায় শব্দ করে বা আলো জ্বেলে তাদের তাড়ানো বেআইনি আর বিপজ্জনক। ফোন করে ভুবনেশ্বরে জানাতে ওরা বলল, “যোশীপুরের দিকটায় আজ কী হয়েছে বলুন তো, অনেকেই ফোন করছে যে হাতির জন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে।”
একটু পরে তারা খবর দিল, মিটিং বাতিল – এতজন না আসতে পারলে মিটিং হবে কী করে!
সুতরাং যাওয়া হলো না। গাড়ি ঘুরিয়ে ড্রাইভার বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরল। অনেকটা চলে এসেছিল তাই ফিরতে ফিরতে সেই রাত্তির একটা বেজে গেল।
সকালে চায়ের টেবিলে বাবাকে দেখে রোহন তো ভীষণ খুশি। তবে বাবা যখন ফিরে আসার কারণটা বলছিলেন, রোহন তখন মুচকি মুচকি হাসছিল। হাতির পালের ছবি এঁকে রোহনই তো মনে মনে বলেছিল – “হাতি বন্ধুরা, তোমরা বাবাকে একদম যেতে দিও না, রাস্তা আগলে থাকবে।”
*****
সে সব কত বছর আগেকার কথা। রোহনের বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ওঁরা এখন দিল্লীতে থাকেন। রোহন বিদেশে থাকে, ইউনিভারসিটিতে পড়াশুনো করতে এসেছে। এদেশে অবশ্য হাতি নেই, এক চিড়িয়াখানা ছাড়া।
এদেশের ঘড়ি অনুযায়ী কাল রোহনের জন্মদিন যদিও দেশে এখন তার জন্মদিনের তারিখ এসে গেছে। অনেক বন্ধুরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেলে রোহনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
আজ সন্ধেবেলা একা একা বসে রোহনের সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ছে। তার সেই সাত বছরের জন্মদিনের কথা। রোহন এখন আর ছেলেমানুষ নয় তবু তার আজও কেমন যেন মনে হয় হাতিরা সেদিন তার মনের কথা শুনতে পেয়েছিল। হাতিরা বাবাকে ইচ্ছে করেই যেতে দেয়নি – রাস্তা আগলে দাঁড়িয়েছিল। তারা বুঝেছিল বাবা না থাকলে কী করে চলবে? সকাল হলেই তাদের বন্ধু রোহনের জন্মদিন এসে যাবে যে।