মধুপুরের ওপরে প্রেসিডেন্সির বন্ধু সমরের লেখা বাংলা - ইংরাজি দুটো বই-ই মন দিয়ে পড়লাম, কোন কোন গল্প একাধিকবার। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ দিন অবধি বই দুটো মাঝেমাঝেই পড়তে হবে।
আসলে মধুপুর নামটাই আমাকে নষ্টালজিক করে তোলে। কেন? বলছি।
আমাদের বিয়ের মাস তিনেক পর জানা গেল আমার স্ত্রী, সুমনা এক বিরল গোত্রের টিউবারকুলোসিসে আক্রান্ত। এরপর কয়েক মাস 'ওষুধে ডাকতারে অস্থি যখন করলে জরজর, তখন বললে হাওয়া বদল করো'। অতঃপর নানা পরামর্শের পর ঠিক হলো বাঙালির সস্তা, পরিচিত ও প্রিয় হাওয়া বদলের ঠিকানা মধুপুরই হবে আমাদের গন্তব্য। অফিসের এক সমবায় সমিতির দশ টাকা দৈনিক ভাড়ার হলিডেহোম এক মাসের জন্যে ভাড়া নিয়ে তুফান মেলের unreserved কামরায় চড়ে সন্ধ্যের মুখে মধুপুরে নেমে হলিডেহোমে পৌঁছলাম। আমার সিনিয়র সহকর্মী, বিপত্নীক বিশ্বদার পৈতৃক বাড়ির দুটো ঘর নিয়ে হলিডেহোম। তার মধ্যে ছোটটি আমাদের জন্যে বরাদ্দ। বিশ্বদা'র বিধবা মা-ই কেয়ারটেকার। কাঠ কাঠ গলায় থাকবার শর্তাবলী বললেন। প্রথম সাক্ষাতেই মনে হলো ওনার সাথে একমাস কাটানো সুখকর হবে না। কিছু অসুবিধা হয়নি এমন নয়, কিন্তু আমাদের চলে আসার দিন উনি কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। তার অন্যতম কারণ অবশ্যই ওনার মা-মরা নাতি-নাতনি, আনতু আর বুবাই, যারা স্কুলছুটিতে মধুপুরে এসে দু-একদিনের মধ্যেই আমাদের, বিশেষতঃ সুমনার খুব ন্যাওটা হয়ে উঠেছিল।
আমরা যে ঘরে উঠেছিলাম সেটা ছিল খুবই ছোট। ঘরের খাটটা ছিল আরো ছোট। কিন্তু তখন আমাদের মিলিত ওজন এখনকার মিলিত ওজনের ষাট ভাগ, সময়টা শীতকাল এবং বিয়ের তখনও একবছর পূর্ণ হয়নি। ফলে ঐ ছোট ঘরে, ছোট খাটে একমাস কাটাতে বিশেষ কষ্ট হয়নি। আর মধুপুরের আনাজ - মাছ - মুরগি - মিষ্টির স্বাদ তখন অনবদ্য। আমাদের দাম্পত্যের সবচেয়ে সুখকর সময় বোধহয় সেটাই ছিল। প্রসঙ্গত আমার বেতন তখনও চার অঙ্কে পৌঁছয়নি।
দুই ভাইবোন, আনতু - বুবাই মধুপুর ছাড়ার পরই হলিডেহোমের দ্বিতীয় ঘরে এলেন আমার আর এক সিনিয়র সহকর্মী, গোবিন্দদা। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী - পুত্র - শাশুড়ি এবং শ্যালিকা তুলুন আর তার দেড় বছরের ছেলে, বুড়ো। কাউকেই আগে দেখিনি। অথচ বুড়ো প্রথমবার আমার কোলে উঠেই আর নামতে চায় না। ক্রমে তার খেলা, বেড়ানো, তেল মাখা, চান করা, খাওয়া সবই আমার কাছে। রাতে শুতে যাওয়ার সমযটুকু ছাড়া তুলুন ওকে কাছেই পেতোনা। আমি এড়াতে চাইলে প্রবল কান্না। শুনেছিলাম তুলুনের স্বামীর আসতে দেরি আছে।
রোজ বিকেলে আমরা হাঁটতে বেরোতাম স্টেশন অবধি। শেরু নামের এক স্থানীয় কুকুর কি কারণে জানি না রোজ আমাদের অনুসরণ করে স্টেশনে যেত, আবার আমাদের পেছন পেছনেই ফিরে আসতো। ওকে কোনদিন কিছু খেতেটেতে দিতাম বলেও মনে পড়ে না। আমি বলতাম, ও আমাদের নীরব পাহারাদার। জীবনে যে সব রহস্যের কোন ব্যাখ্যা পাইনি তার মধ্যে এটা অবশ্যই একটা।
যাইহোক, একদিন আমি, সুমনা আর তুলুন হাঁটতে বেরিয়েছি। বুড়ো যথারীতি আমার কোলে, মাঝে মাঝে সুমনারও। বাজারের কাছে একটা জায়গায় বুড়োকে সুমনার কোলে ছেড়ে আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি (গত প্রায় কুড়ি বছরে একটাও খাইনি)। এমন সময় তুলুন ছেলের গায়ে হাত রেখে সুমনাকে জিজ্ঞেস করল, এর বাবা কোন কলেজে পড়েছে?
সুমনা হতভম্ব, মানে?
কেন, তোমার বর, ঐ যে দেবুদা, সিগারেট টানছে, কোন কলেজে পড়েছে, জানো না? তুলুন বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল।
কি বলছো, তুলুন? ছেলেটা তোমার, ওর বাবা আমার বর কেন হবে, তোমার বরই তো ওর বাবা, সে কোন কলেজে পড়েছে, তা তো তুমিই জানবে, আমায় জিজ্ঞেস করছো কেন?
তুলুনের এবার খেয়াল হলো। দেখেছ কি কাণ্ড! বুড়োটা দেবুদার সাথে সবসময় এমন লেপ্টে আছে যে নিজের ছেলের বাবার নাম গুলিয়ে গিয়ে তোমার বরকেই আমার ছেলের বাবা ভাবছি।
ঘটনাটা শোনার পর আমি সেদিন কোন প্রতিক্রিয়া দিতে পারিনি, আজও এর ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম।
(লেখক পরিচিতি: দেশ বাঁকুড়া, তবে জন্ম - কর্ম সবই কলকাতায়। জীবনের তৃতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৯-এ উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে তিন বছর কাটিয়ে গ্র্যাজুয়েট। ১৯৭৩-এ ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকে যোগদান এবং টানা প্রায় চল্লিশ বছর বর্ণহীন কর্মজীবনের শেষে ২০১৩তে অবসর গ্রহণ। বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ১৯৬৯-৭২র প্রাক্তনী এবং স্কুলের প্রাক্তনী সমিতির সাথে সাবেগে ও সক্রিয় বাঁধনে জড়িত। বাকি জীবনটা এইভাবে কাটিয়ে দিতে পারলে আর কিছু চাই না। আর মাঝে মধ্যে কিছু লিখতেও ভালোবাসি। একজনেরও যদি পড়ে ভালো লাগে, সেটাই আমার সর্বোত্তম সুখ।)