এই কাহিনী ২০২০ সালের মার্চ মাস এবং তার পরবর্তী সময়ের
“বউদি কাল আসব না কিন্তু, জনতা কার্ফু।” শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করতে করতে চুপচাপ শুনল সুতপা, কোন সাড়া দিল না। কথাটা সকালেই শুনেছে। করোনা ভাইরাসের গতি কমানোর জন্য এটাই নাকি দাওয়াই।
“তাহলে একটু ময়দা মেখে রেখে যেও, আর থোড়টাও কেটে দিও।”
এই জনতা কার্ফু তার মাথা খারাপ করে দেবে, একে রবিবার বাপ-ছেলের হাজার ফরমায়েশ থাকে তাতে মঞ্জু না এলে অসুবিধার একশেষ। কী মনে করে বিপ্লবকে ফোন করল, “দোকানপাট তো কাল বন্ধ থাকবে তুমি বরং আসার পথে পাঁচ কিলো আলু, এক কিলো পিঁয়াজ আর এক ডজন ডিম নিয়ে নিও।”
“আমি তো একটু চিকেন নিয়ে যাব ভাবছিলাম।”
“সে আনো, তবে আলুটালুগুলো ভুলো না।”
পনেরো দিন হয়ে গেল। জনতা কার্ফু এখন পাকাপাকি লকডাউন। ফলে মঞ্জুর পাত্তা নেই। করোনা ভয়ানক ছোঁয়াচে ও অপ্রতিরোধ্য। সারা পৃথিবীতে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে। বিপ্লব আজকাল ভয়ংকর পিটপিটে, ফলে সুতপা যে মঞ্জুর খোঁজ নেবে বিপ্লবের তাতেও আপত্তি। তাও একবার ফোন করেছিল। মঞ্জুর মা ধরেছিল, “লকডাউন চলছে গো, কেউ তো কাজে বার হচ্ছে না।”
সুতপা মঞ্জুকে একবার ফোনটা দিতে বলেছিল, “উ রেশন ধরতে গেছে” বলে কেটে দিয়েছিল ওর মা। চারদিকে থৈ-থৈ করছে কাজ। বিপ্লব হেল্প করছে না তা নয়, তবে অভ্যাস না থাকার জন্য সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি করছে। টুটুনও নেমে এসে কাজে হাত লাগাতে চাইছে কিন্তু সুতপা ওকে সোজা ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ম্যাথস, ফিজিক্স দুটোই বাকি, তারপরই জেইই মেইনস - এখন অন্য কিছু ভাবার দরকার নেই।
কেমন একটা অস্বস্তির মধ্যে ঘুম ভেঙ্গে গেল সুতপার। খুব গুমোট লাগছে, একটু ঠাহর করে বুঝল লোড শেডিং। মোবাইল দেখল, তিনটে চল্লিশ। কাল কিছুতেই ঘুম আসছিল না, বিপ্লবের অফিস নেই তাই অনেক রাত পর্যন্ত টিভি দেখছে। আওয়াজটা ঘর পর্যন্ত ভেসে আসে, ফলে ওর ঘুমের দফারফা। জানালাটা খুলে ফ্যানটা চালিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল মেঘের আওয়াজে। রীতিমত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ঘড়িতে চোখ রাখল। সর্বনাশ, সওয়া সাতটা, অর্থাৎ এক ঘন্টা লেট। তারপরই মনে পড়ল লকডাউন চলছে, বিপ্লবের অফিস নেই। কিন্তু সংসার দাঁড়াবে না, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল বয়ে যাওয়া সময়কে ধরে ফেলার জন্য।
* * * *
কতবার করে চেষ্টা করেও পিসিমণিকে ধরতে পারছে না মিতুল। বারবারই সুইচড্ অফ পাচ্ছে। এবার না পেলে পিসেকেই ফোন করবে।
“হ্যালো মিতুল কোথায় তুই? ভালো আছিস তো? ফোন করেছিলি দেখলাম।”
“তুমি ফোন সুইচড্ অফ করে রাখ কেন গো? সাত-আট বার ট্রাই করে এতক্ষণে পেলাম।”
“চার্জ ছিল না রে। তা তোর খবর কী?”
“আমি আজ ভোররাতে তোমার বাপের বাড়ি ঢুকেছি। অফিস বন্ধ, ওয়ার্ক ফ্রম হোম – দিগ্বিদিক না তাকিয়ে ফ্লাইট ধরেছি। ফ্ল্যাটে তালা দিয়েছি কিনা মনে নেই। সূর্য ওঠারও আগে মাতৃদেবীকে অবাক করে ঘরে ঢুকেছি।” মিতুল কলকল করে উঠল।
“খুব ভালো করেছিস বাবু। বৌদি খুব চিন্তা করছিল। তা কুশলের কী খবর? আছে কেমন?” মিতুলটা একইরকম রয়ে গেল। উদোমাদা।
“বোধহয় ভালোই আছে। এসেছি সেটা এখনও জানাইনি ওকে।”
“কেন রে?”
“তুমি তো সবই জান পিসি। ওর খুব ইগো। আমি যে ওর ইগো স্যাটিসফাই করার জন্য চলে আসিনি সেটা ওকে বুঝতে হবে। এই পরিস্থিতি না হলে কলকাতায় আসতামই না আমি। আর শেষপর্যন্ত আমাদের বিয়েটা টিঁকবে কি না কে জানে।” গলাটা ভারি হয়ে যায়।
কুশলের কথাটা বোধহয় না তুললেই হতো। দুজনের মধ্যে একটা বড় ফাঁক তৈরি হয়েছে। মেয়েটার বাড়ি আসার খুশিটা নষ্ট হল কি? দুজনেই পরিণত, খুব বেশি বলা যায় না।
সুতপা খুব আস্তে ডাকল, “মিতুল, একটা কথা বলব? রাগ করিস না, সংসার করতে হলে একটু ফ্লেক্সিবল হতে হয়। আর সংসার ভাঙ্গা খুব সহজ, গড়াটাই কঠিন। যা করবি একটু ভেবে করিস। কুশল কিন্তু মানুষ খারাপ নয়।”
মিতুল একটু সময় নেয়, “বাদ দাও, কেমন আছ তুমি? ভাইয়া, পিসাই সব ভালো তো? পিসাইয়ের তো ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। সবাই নিশ্চয়ই ঘরে।”
“এখন সবাই ঘরে, সবাই ঠিকঠাক। শুধু আমিই বেঠিক রে – মঞ্জুরানী লকডাউন করেছেন। বুঝতেই পারছিস।”
দুজনেই খুশিমনে ফোন ছাড়ে। সুতপার কাছে মিতুলের ফোন লকডাউনের দমচাপা পরিবেশে একঝলক টাটকা হাওয়া। মিতুলের কাছে পিসি বন্ধু। সহজ, প্রাণময়। মায়ের মত দুশ্চিন্তায় ঠাসা নয়। পিসি আবার বৌদিঅন্ত প্রাণ। এখন পিসির কথাটাই মিতুল ভাবছে। ঝোঁকের মাথায় কুশলকে কোন খবর না দিয়ে এবাড়িতে ওঠাটা বোধহয় ঠিক হয়নি।
দুই
অনেকদিন বাদে কলকাতার শহরতলিকে চলন্ত ট্যাক্সির ভেতর থেকে সময় নিয়ে দেখছে মিতুল। সকালের মায়াবী আলোয় বড় মনোরম লাগছে। লকডাউনের বাজারেও বাবুয়ার চেনা একজনের ট্যাক্সি জোগাড় করা গেছে। কলকাতা তার নিজস্ব ঢঙে দিনটাকে এগোতে দিচ্ছে। কেমন মনে হচ্ছে আগে যেন এই রাস্তাগুলো খুঁটিয়ে দেখা হয় নি। ব্যাঙ্গালোর আর কলকাতার আবহাওয়া প্রকৃতিতে একেবারে ভিন্ন, বিশেষত এই চৈত্রমাসে। ঐ ব্যস্তসমস্ত, কেজো শহরটাকে এইসময় ওর বেশ লাগে। বিশেষ করে ছুটির পর ঘরে ফেরার সময়—যখন মুঠো খুলে একটু সময় ও খরচ করতে পারে, একটা অটো ছেড়ে দিয়ে পরেরটার জন্য অপেক্ষা করতে পারে, এলোমেলো হাওয়া তখন মনটাকে কলকাতার হাঁসফাঁস গরম মনে পড়িয়ে দেয়। তার কাছে তখন কলকাতাকে খুব নিষ্ঠুর মনে হত। অথচ আজ এই কাজহীন সকালে লকডাউনে থমকে যাওয়া কলকাতাকে খুব মায়াময় লাগছে। সেটা কি সে কুশলকে অনেকদিন পর দেখবে বলে? এলোমেলো ভাবনার ডানায় ভর করে কুশলের ফ্ল্যাটের নিচে নেমে পড়ল। এত সকালে আসাটা কি ঠিক হলো? পিসিমণির একটা কথায় দুম করে চলে আসার কী দরকার ছিল?
বেল দিয়েছে অনেকক্ষণ, দরজা খোলার নাম নেই। এই রে যদি কুশল না উঠে থাকে? আরেকবার বেল দেবে না ফোন করবে, নাকি ফিরেই যাবে যখন ভাবছে তখনই ঝড়াস করে দরজাটা খুলে কুশলের ঘুমে ভেজা মুখটা দৃশ্যমান হল। মিতুলকে দেখে বাকি ঘুমটা সরে গিয়ে বিস্ময়কে জায়গা ছেড়ে দিল। কিন্তু ঐ বিস্মিত চোখে লহমায় যে খুশি ঝিকিয়ে উঠল তা মিতুলের চোখ এড়াল না। ঘরে ঢুকেই সে রান্নাঘরে ঢুঁ মারল – যাক চা, কফি, চিনি রয়েছে। গ্যাস লাইটারের জন্য পিছন ঘুরতেই কুশল এগিয়ে এল। “আমি কিন্তু ভালো চা করতে শিখে গেছি।”
“আমাকে হঠাৎ দেখেও কিছু বললে না যে।”
গভীর চোখ বলে উঠল, “হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত।” সামলাতে সময় লাগল, আবেগটাকে গলাতেই লুকিয়ে ফেলল, “জলটা বসাও, বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে আসি।”
অনেকদিন পর অতিপরিচিত জায়গাকেও অচেনা লাগে। বাথরুম এলোমেলো কিন্তু পরিষ্কার। কোণের ব্র্যাকেটে হাল্কা বেগুনি ফুল সাজানো। কুশল কোনদিনই শৌখিন নয় বরং এককালে মিতুলেরই এইসব বায়না ছিল। তখন কুশল গা করত না। সে একটা কাল ছিল, দুজনে হুড়োহুড়ি করে রেডি হওয়া--যা হোক কিছু নাকেমুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়া। সন্ধ্যে নামার আগে পরে বাড়ি ফেরা। গল্প করতে করতে রান্নার সময় পার হয়ে যেত, তাই নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে খাবার অর্ডার করে ডিনার করত ওরা। কয়েক মুহূর্তে মনে মনে সেই রামধনু সময় পার করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল মিতুল।
তিন
লকডাউন এখন দু-মাসের পুরনো। চারিদিকের পরিস্থিতি সুতপার মাথায় ঘাই মারে। এই অল্প সময়ে কত লোকের প্রাণ চলে গেল, যারা বেঁচে রইল তাদের মধ্যে কত মানুষ যে চাকরি হারিয়েছে তার হিসেব নেই। গরীব মানুষ যাদের তেমন জমানো টাকা নেই তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। সরকারি সাহায্য যা পাওয়া যায় সব প্রয়োজন তাতে মেটে না। টিভিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার যে মর্মান্তিক ছবি দেখা গেছে তা যে-কোন মানুষের কাছে বিভীষিকা বলে মনে হবে। এর কি কোন শেষ নেই? সে বিশ্বাস হারাতে চায় না, কিন্তু ভরসা করার মত কিছুও সে পাচ্ছে না।
ফোনটা বাজছে কিন্তু বিপ্লব শুনতে পাচ্ছে না, টিভির আওয়াজে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ভীষণ জোরে টিভি চালায় ও। আজকাল সুতপার মনে হয় বিপ্লবের সূক্ষ্মবোধগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ফোনটা এনে ওর হাতে দিয়ে আওয়াজটা কমিয়ে টিভির সামনে বসল। সন্ধ্যে সাতটার খবর হচ্ছে। ভালো লাগে না আর টিভি দেখতে, এত খারাপ খবর সব। বিপ্লবের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আজকাল রাজীবদার ফোন যেন একটু বেশি-ই আসছে, আজও অনেকক্ষণ কথা বলছে। অফিসের কোন দরকার হয়ত।
পুরোনো দিনের কথা মনে ভিড় করে। বিয়ের প্রথম প্রথম স্বামীর সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে খুউব ইচ্ছে করত। ওরও আগ্রহের অভাব ছিল না। কিন্তু পাঁচজনের সংসারে আলাদা হবার সুযোগ রাতে ছাড়া মিলত না। দুজনে বেরনো বা সিনেমা যাওয়া শাশুড়িমা ভালোভাবে নিতেন না। ননদ প্রিয়াকে সঙ্গে নিতে হত। ফলে মাঝে মাঝে মাকে দেখতে যাবার নাম করে দুজনে এলোমেলো ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু দু-চারদিনের বেশি ইচ্ছে হয় নি। এখানে নিজের বাড়িতে এসে যখন ছেলে সামলে, সংসার সামলে থিতু হল বিপ্লবের ব্যস্ততা ভীষণভাবে বেড়ে গেল। এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো বা শুধু নিজেদের নিয়ে থাকার সময় হারিয়ে গেল। আর আজ একমাসের ওপর হল বিপ্লব ঘরে। এখন যথেষ্ট অবসর আছে দুজনেরই অথচ নিজেদের সময় কাটানো, আবোল-তাবোল গল্প করা বা এ ওর পিছনে লাগা আর হয় না। এটা কি শুধু বয়স বাড়া? না অতিমারীর আতঙ্ক, নাকি তারা পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেছে? তাদের সময় কখন বয়ে গেছে কে জানে? সে সংসারের ঘেরাটোপে আটকা আর বিপ্লব হয় দূরদর্শন নয় সমাজমাধ্যমে বাইরের পৃথিবীর স্বাদ-গন্ধ নেবার জন্য উদগ্রীব। তার সঙ্গে দুটো গল্প করার থেকে ফোনে কলিগদের সঙ্গে গল্প করতে বেশি ভালোবাসে। সে মনে মনে খুব কষ্ট পায়।
ফোন টেবিলে রেখে পাশে এসে বসল বিপ্লব।
“রাজীব আর তনু আজ বারবিকিউ করছে ওদের বাগানে। প্ল্যানটা কার জান? তোজোবাবুর, মায়ের মত হয়েছে ছেলেটা – ভারি আমুদে।”
হাসিমুখেই একমত হল সুতপা কিন্তু বুকের ভেতর পিন ফুটল। সে সারাদিন সংসারের যাবতীয় ঝক্কি সামলাচ্ছে সেটার কোন দাম নেই। তার ছেলেটা দিনরাত এক করে পড়ছে, যাতে তার জন্য বাবা-মাকে কোন চিন্তা করতে না হয়, তার কোন প্রশংসা বিপ্লব করে না অথচ . . .। তাছাড়া এই ভয়ংকর সময়ে বারবিকিউ করাটা স্বাভাবিক? বিপ্লবের খুশিটা কেমন মোটাদাগের মনে হল। ঘরবন্দী না হলে অনেককিছুই অজানা থাকত। খারাপ লাগাটাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে রাতের খাবার দিতে গেল।
চার
কষ্ট করে নিজের নিশ্বাস–প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছে মিতুল। আজকাল ঠাম্মার কাছেই শোয়। তার আর কুশলের সম্পর্কের টানাপোড়েন এবাড়ির সবাইকেই অস্বস্তিতে রেখেছে। আজ ফিরে আসা খুব কঠিন ছিল। সারা ফ্ল্যাটজুড়ে তার ব্যবহারের জিনিষগুলো তাকে পিছু টানছিল। কুশলও চাইছিল না, কিন্তু দুজনের কেউই মুখ ফুটে কিছু বলেনি। সন্ধ্যে নামলে ও যখন উঠতে যাবে কুশল বলেছিল, “না গেলেই নয়?” ও নিজেও থাকতেই চাইছিল কিন্তু ওর অহং বলল, “বলে আসিনি, অন্য আরেকদিন।”
কুশলের মুখে ম্লান হাসিটা বুঝিয়ে দিল ওর অজুহাতটা কত ঠুনকো। ও উঠে পড়েছিল ফিরে আসার জন্য কিন্তু কুশল ছাড়েনি, ওর বাইকেই তালতলার মোড় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। মোড়টা মিতুলের বাড়ির থেকে সাত-আট মিনিটের হাঁটাপথ। মিতুল বারবার বলেও বাড়ি আনতে পারল না। সবাইকে এড়িয়ে বিছানার নিভৃতে আশ্রয় নিয়েও ও সচেতন ছিল পাছে ঠাম্মা কিছু জানতে চায়। ঘুমের ভান করাই নিরাপদ ছিল। ব্যাঙ্গালোরের এককামরার ফ্ল্যাটটাকে মনে পড়ছে। এই সাবেকি পালঙ্কে ঠাম্মার পাশে শুয়ে ওই ফ্ল্যাটটাকে কেমন খেলাঘর বলে মনে হচ্ছে।
খেলাঘরই বটে। আই টি-র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী মিতুল ওরফে আত্রেয়ীর সঙ্গে সেক্টর ফাইভের চাকুরে কুশলের বিয়ে হয় বছর তিনেক আগে। বিয়ের আগেই আলাপ-মেলামেশা। মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ে। মিতুলের একটা স্টার্ট-আপে চাকরি হয়েই ছিল, কলকাতাতেই। কুশলেরও সেক্টর ফাইভে কাজ। বিয়ের মাস ছয়েকের মাথায় - যখন দাম্পত্য ঠিক অভ্যাসের মধ্যে ঢোকেনি, এ্যাডভেঞ্চার হয়েই ছিল - মিতুল ব্যাঙ্গালোরে একটা দারুণ অফার পায়। নতুন বিয়ের উন্মাদনা তখনও কাটেনি, কুশলও একেবারেই চাইছিল না, কিন্তু মিতুল পারেনি অফারটা ছেড়ে দিতে। স্বীকৃতি আর অর্থ দুই-ই তাকে টেনেছিল। চাকরি, সহকর্মী এবং পরিবেশ সবই পছন্দসই হওয়ায় মিতুলের মন লেগে গেল। প্রথমদিকে কুশল মাসে বারদুয়েক ম্যানেজ করে ঘুরে আসত অথবা মিতুলও বিনা নোটিশে এসে চমকে দিত। ও প্রাণপণ ওর ব্যাঙ্গালোরের এককামরার ফ্ল্যাটটাকে ঘর বানাতে চাইত, স্বপ্ন দেখত কুশল একটা ভালো জব পেয়েছে ওখানে – ওদের নিজস্ব পৃথিবী গড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাস্তবে দুজনেরই ব্যস্ততা বাড়ছিল, আসা-যাওয়া অনিয়মিত হচ্ছিল। বছর দেড়েক বাদে যখন কুশল সত্যিই ওখানে সুযোগ পেল কিন্তু তাও জয়েন করার কোন আগ্রহ দেখাল না, মিতুল ফেটে পড়েছিল।
“ঠিক কী চাও তুমি? সংসারটা করতে চাও, না চাও না? আর কতদিন এইভাবে ভেসে থাকব?”
“প্রশ্ন তো সেখানেই মিতুল। আমাকেই আসতে হবে কেন? তুমি ফিরতে পারবে না কেন? আমার কাজের জায়গায় আমি খুশি, কলকাতা আমার বা বলা যায় আমাদের শহর। সংসার করতে হলে আমাকেই স্যাক্রিফাইস করতে হবে কেন?”
“এভাবে তো আগে বল নি, তোমার যে এখানে থাকার ইচ্ছে নেই তা একবারও বুঝতে পারিনি। তাছাড়া এখানে আমার যা স্যালারি বা পজিশন তার কোনটাই ওখানে পাওয়া সহজ নয়, কিন্তু তুমি তো এখানে আরও ভালো অফার পাচ্ছ, তাহলে?”
“তোমার পজিশন বা স্যালারি গুরুত্বপূর্ণ হলে আমার ভালোলাগা বা ভালোবাসা দাম পাবে না কেন? আমাদের দুজনের কাছের মানুষরাও ওখানে – ভেবেছিলাম তুমি নিজেই বুঝবে। কিন্তু তুমি কেরিয়ার নিয়ে অবসেসড। ভবিষ্যতে এ নিয়ে কথা না হলেই ভালো লাগবে।” ধীর গম্ভীর পায়ে ঘর ছেড়েছিল কুশল। একবুক অভিমান চুপ করিয়ে দিয়েছিল ছটফটে মেয়েটিকে। কাজের অজুহাতে সেই রাতেই কলকাতা ফেরে কুশল। অভিমান জমে জমে পাথর। পাথর জমে জমে পাহাড়। ডাকাও হয় নি, ডাকও আসেনি। যেটা ছিল ছোট্ট একটা চিড়, ক্রমে সেটা ফাটল, তারপর . . .। প্রতিদিন আশা করেছে কুশল হঠাৎ করে এসে ওকে চমকে দেবে। হয়ত ওকে জোর করে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে একা ঘরে ভীষণ লোভ হত ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে কিন্তু হেরে যাবার ভয়, চাকরির নিরাপত্তা পথ আটকেছে। সময় বয়ে গেছে, মিতুলের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। আজকাল সপ্তাহে দু-একবারের বেশি কথা হয় না। কদাচিত হোয়াটস অ্যাপে জোকস শেয়ার ব্যস। কেউ কারোর সীমানা অতিক্রম করে না। এইটুকুই অবশিষ্ট আছে। বাইরে পাখির ডাকে চমকে ওঠে মিতুল। ভিজে চোখে মোবাইল টেনে সময় দেখে, রাত আড়াইটে। উঠে জল খায়, চোখে মুখে জল দেয়। বিছানায় ফিরে জোর করে চোখ বোজে। তাহলে আজ গিয়েছিল কেন? শুধুই কি পিসিমণির প্ররোচনায় না ওই অজুহাতটা ওর মনের গোপন ইচ্ছেটাকে সুযোগ করে দিয়েছিল? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আর সারাদিনের সুখটুকু মনে মনে চাখতে চাখতে চোখ জুড়ে ঘুম নামে।
পাঁচ
ছড়ানো মনটাকে আজ একটু গোছাতে বসেছে সুতপা। ওর চারপাশটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। ও ওর কাছের মানুষদেরও যেন চিনতে পারছে না। আজ একুশ বাইশ বছর একসঙ্গে থাকার পর কেমন অচেনা মনে হচ্ছে সবথেকে কাছের মানুষটাকে। মনের ভেতর হাতড়ে পুরনো ছবিগুলোকে ধরতে চাইছে ও - মধুযামিনীর সেই দিনগুলো, যখন খুব হিসেব করে লাঞ্চ বা ডিনার করত ওরা। এমনও হয়েছে রাতে স্বর্গদ্বারের রাস্তায় ঠেলার খাবার খেয়ে ওরা পয়সা বাঁচিয়েছে, কিন্তু মন ছোট হয়নি ওর। বেসরকারি ফিনান্স কোম্পানির সামান্য অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিল বিপ্লব, মাইনে ভদ্রস্থ ছিল কিন্তু পয়সা ওড়াবার মত অবস্থা ছিল না। মনে আছে সেই প্রথম বেড়াতে গিয়ে একটা কটকী চাদর কিনে দিয়েছিল বিপ্লব। ও ভীষণ খুশি হয়েছিল, কিন্তু মনে মনে ইচ্ছে হচ্ছিল মিতুলের জন্য কিছু কিনতে। মিতুল তখন বছর চারেকের ফুটফুটে মেয়ে, পিসিমণির ভারি ন্যাওটা। সুতপাকে চমকে দিয়ে বিপ্লব মিতুলের জন্য ওড়িশা সিল্কের জামার কাপড় আর রুপোর ফিলিগ্রি করা তোড়া কিনেছিল। দামটা তখন ওদের সাধ্যের বাইরেই ছিল। সুতপা একটু লজ্জা পেয়েছিল কিন্তু অসম্ভব খুশি হয়েছিল। ওই উপহারটুকুর মধ্যে বিপ্লবের মনের মাধুরী মিশেছিল।
আর আজ? কথায় কথায় জিনিস কিনে আনে। কত গ্যাজেটস ওদের বাড়িতে! আর সব জিনিসের দাম নিয়ে বড়াই করে। গত পূজোয় নিজেই পছন্দ করে একটা কাঞ্জিভরম নিয়ে এল। অত সুন্দর শাড়িটা পাবার আনন্দ ঠিকঠাক অনুভব করার আগেই বিপ্লব রসিকতা করেছিল, “বারো হাজারী শাড়ি, ছ্যাঁকা খেও না আবার।” একমুহূর্তে সব আনন্দ ম্লান হয়ে গেছিল।
“এত দাম দিয়ে না আনলেই পারতে--” এর বেশি কোন কথা যোগায়নি ওর মুখে।
পুরনো শাড়ির ভাঁজ খোলার মত একটু একটু করে স্মৃতির পরত খুলতে থাকে। তার স্বামীকে সে সত্যি কতটা চেনে? বাইশ বছরে একটানা পনেরো দিনের বেশি সারাক্ষণ একে অপরকে দেখা হয়নি। তাই বোধহয় ওর আজ বিপ্লবকে এত অচেনা ঠেকছে। এই ঘরবন্দীত্ব তার এত বছরের পুরনো স্বামীকে নতুন করে চেনার সুযোগ দিয়েছে। গভীরভাবে চেনাজানা হয়ে ওঠেনি অথচ শরীরে শরীর মিলিয়ে তৃপ্ত হয়েছে রাতের পর রাত, তারই বীজ শরীরে ধারণ করে মা হয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতির স্বাদ পেয়েছে। বিপ্লব ব্যস্ত থেকেছে নিজের কাজ নিয়ে, একের পর এক টার্গেট সামনে রেখে ও শুধু দৌড়েছে, আর ওর পেছন পেছন সুতপা দৌড়তে বাধ্য হয়েছে। যদিও দুজনের দৌড়ের ধরন ছিল আলাদা। বিপ্লব মইয়ের মাথা দেখতে পেয়েছিল, আপ্রাণ চেষ্টা করছিল সেই মাথায় পৌঁছতে। উঠছিলও যত, বদলেও যাচ্ছিল তত। সুতপা আমল দেয়নি। ওদের নিজস্ব আলাদা সময় বলে আর কিছু ছিল না। ওরও নিজের দৌড় ছিল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংসার সামলানো, বিপ্লবের আর টুটুনের সবটা যেন মসৃণভাবে চলে সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখাকেই ও নিজের ভালোবাসা বলে ধরে নিয়েছিল।
কিন্তু আজ এত কেন ভাবছে সুতপা? এই লকডাউনের বিপ্লবকে অচেনা লাগছে বলে? এত মানুষ এত ভাবছে অথচ ওর কোন দুশ্চিন্তা দেখছে না। ওর ব্যক্তিত্বের কেমন যেন বদল ঘটে গেছে। ইদানীং ওর অকারণ বড় বড় কথা তার অসহ্য লাগে। ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করবে ভাবে কিন্তু সুযোগ হয় না। লকডাউনের ঠিক আগেই রাজারহাটে দুম করে একটা থ্রি-বেডরুম ফ্ল্যাট বুক করল, সুতপা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছিল। এত পয়সা কোথা থেকে যোগাড় হবে জানতে চাইলে বলেছিল ওর একজন পরিচিত এটা করছে, ওকে অনেক ছাড় দিচ্ছে। ইনস্টলমেণ্ট দিতে অসুবিধা হবে না। এই লকডাউনের বাজারে সব খরচ বিপ্লব সামলাচ্ছে কী করে? সুতপার জানতে চাইতে ভয় করে।
ছয়
ওয়ার্ক ফ্রম হোম ব্যাপারটা মোটেই সুবিধার লাগছে না মিতুলের। এ যেন কাজও নেই আর অবসরও নেই অবস্থা। কোম্পানি দিব্যি লোড বাড়িয়ে চলেছে আর ওর মোটেই কাজে মন লাগছে না। বাড়িতে ও থাকায় একটা ছুটি ছুটি হাওয়া বইছে। বাবুয়ারও ছুটি, কাজে তাই মিতুলের আলস্য। দু-ভাইবোনে চুটিয়ে আড্ডা হচ্ছে। অথচ ব্যাঙ্গালোরে দিব্যি অফিসের কাজ বাড়িতে করত। আজ বেশ ওয়ার্কলোড আছে অথচ মন বসছে না। একসময় এই কাজটা ওর ভীষণ আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অবশ্যই একটা কারণ ছিল। অথচ তিনবছরের মাথায় দাঁড়িয়ে আজ ওর আর ফিরে যেতে মন চাইছে না। কাজটা ও ভালোইবাসে, মাইনেও দারুণ কিন্তু পরিজনদের উত্তাপ পায় না। শূ্ন্য ঘর ওর ক্লান্তি বাড়িয়ে দেয়। কুশল ওকে ক্যারিয়ারিস্ট বলেছিল কিন্তু ও মোটেই সারাজীবন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেনি। যা পেয়েছে তাই-ই মন দিয়ে করে গেছে। এই চাকরিটা ওকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, নিরাপত্তা দিয়েছিল আর একটুকু বাসার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
হিজিবিজি ভাবনার মধ্যে কুশলের মেসেজ ঢুকল, “কখন ফ্রি আছ? একটু কথা ছিল।” মিতুলের ভেতরটা শিশিরভেজা ঘাসের মত কোমল হয়ে গেল। মাসদেড়েক আগে একটিদিনের কয়েকঘন্টা সময় তাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। কুশলের সারা ফ্ল্যাটে ওর জিনিষগুলো তেমনি রাখা আছে। এখনও কুশল ওর কাছে নেই কিন্তু মনে হয়েছে এই তো হাতের কাছেই আছে মানুষটা, ডাকলেই সাড়া দেবে। ও হ্যাংলার মত চেয়েছে কুশল এসে ওকে নিয়ে যাক। কিন্তু গতানুগতিক কথার বাইরে কথা এগোয়নি এই মাঝের সময়টাতে, “ফ্রি-ই আছি, বলতে পার”-- চিন্তা সরিয়ে মেসেজ করল। আরও মিনিটদশেক পর ফোনটা এল।
“আমি কিছুদিনের জন্য থাকছি না। আমাকে দরকার তোমার হবে না, তবু মনে হোল তোমায় একবার না বলে যাওয়া ঠিক হবে না।”
“এই লকডাউনে কোথায় যাবে?”
“গত একবছর আমি ‘শৈশব’ নামে একটা সংগঠনের হয়ে কাজ করি। দুঃস্থ বাচ্চাদের নিয়ে কাজ। ওখানে যাওয়া এখন খুব দরকার, তাই . . .
“বল নি তো কোনদিন?”
কুশল কোন সাড়া দেয় না। নীরবতা অগ্রাহ্য করে মিতুল বলে, “কুশল, আমিও যাই না তোমার সঙ্গে।”
“তুমি!” কুশলের গলায় বিস্ময়। “তুমি তো যুক্ত নও।”
“আমি তোমার বউ, তুমি যুক্ত মানেই আমিও যুক্ত।” কত সহজে মিতুল বলল কথাটা, নিজেই অবাক।
“তোমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পরিস্থিতি এখন খুব খারাপ।”
“আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে রেডি হচ্ছি আর তুমি আমাকে আধঘণ্টার মধ্যে তুলছ।” উত্তরের সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল চিরকালের জেদী মিতুল। একটু সময় নিল কুশল, তার ভেতরে একটা আবেগ তৈরি হচ্ছে। মিতুল কি এখনও নিজেকে তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে? ও তো নিজের কথা একবারও ভাবল না। কোভিড নাইন্টিনের ভয়াবহতা তো কারোর অজানা নেই। এই মেয়েটাকে ছেড়ে সে আছে কেন?
মিতুল ভাবল কুশল এমন করে কথা বলল যেন ও দু-চার দিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেছে আর কুশল সংসারের সমস্যা ওর সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে। এইসময়ে বাইরে গিয়ে কুশলেরও যদি করোনা হয়? ভাবনাটাতে ও শিউরে উঠল। চার-দেওয়ালের ঘেরাটোপে আটকা মিতুল নিজেকে নতুন করে জানছে। এতদিন ধরে দুজনের মধ্যে বেড়ে ওঠা ফাটলটাকে ওর অহেতুক মনে হল। এই বিপন্ন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ও বুঝল খুবই তুচ্ছ কারণে জীবনের অনেক সোনালি মুহূর্ত ওরা হারিয়ে ফেলেছে। মৃত্যুমিছিলের অভিঘাত সব মেকি দূরত্ব এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। ক্রমে সমস্ত অহং গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল আর এক অপার শান্তির অনুভব মেয়েটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
তাহলে কি ভয়ংকর অতিমারী দুই যুবক-যুবতীকে নতুন করে বুঝতে শেখাল? বিভীষিকারও কি ভালো দিক হতে পারে?
সাত
ঘরের ভেতরে শুধু চাপ চাপ অন্ধকার। সুতপা অন্ধকার ভালোবাসে না কিন্তু কোন আলোর মুখোমুখি হবার সাহস আজ আর নেই। তার সাজানো সংসারটা আজ ভাঙনের মুখে। দুপুরে অসময়ে কাজ ছেড়ে উঠে এল বিপ্লব, তার চেহারা বিপর্যস্ত। মনটা কেমন কু গেয়ে ওঠে।
“কি হয়েছে? শরীর খারাপ?”
“টুটুন কোথায়?”
“ও তো এইমাত্র নিজের ঘরে গেল, মক টেস্ট আছে।”
“আমি একটু একা থাকতে চাই তপা।” অবাক অবাক। কতদিন পরে এইভাবে নিজের নাম শুনল বিপ্লবের গলায়। চোখ ভিজে উঠল, আকুল গলায় বলে উঠল, “কি হয়েছে গো তোমার, বল না আমায়। ভয় করছে আমার।”
একটু একটু করে শোনে সব। অফিসের তরফে পার্টির সঙ্গে ডিল করার দায়িত্ব বিপ্লবের। বেসরকারি ফিনান্স কোম্পানি, প্রয়োজনে দ্রুত যেমন ধার দেয় তেমনি ধার শোধে গাফিলতিতে কোম্পানি নির্মম। ধারের জন্য বন্ধকী সম্পত্তি তারা নিলামে তোলে। বিপ্লব এবং রাজীব সেই নিলামে তোলা সম্পত্তি অনৈতিকভাবে পাইয়ে দেবার পথ ধরেছিল। অবশ্যই মোটা টাকার বিনিময়ে। প্রথমে কেউ বোঝেনি। ক্রমে তাদের দু-হাতে খরচ করা সন্দেহের কারণ হয়। ওরা টের পায়নি কিন্তু কোম্পানি ইনভেস্টিগেশন করাচ্ছিল। আজ সাসপেন্সন অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে চাকরি তো যাবেই, জেল-হাজত হওয়াও অসম্ভব নয়। সুতপা অবশ, পাথর হয়ে গেছে শুনতে শুনতে। কখন হল এমন? এ কার সঙ্গে অন্ধবিশ্বাসে সে কাটাচ্ছে বছরের পর বছর? এত লোভ বিপ্লবের? তীব্র বিতৃষ্ণা দলা পাকাতে থাকে মনের ভেতরে। কতক্ষণ লেগেছিল চেতনা ফিরে পেতে জানে না। কোন কথা, কোন দোষারোপ, কোন বিরূপ ব্যবহার করে নি সে। শুধু পায়ে পায়ে সরে এসেছিল।
রাত ঘন হয় নিজের নিয়মে। এ বাড়িটা আজ শুনশান। ছেলে নিয়মমাফিক খেতে চেয়েছিল। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে নিজের আর বাবার খাবার বেড়ে নিতে বলেছে। কিছু একটা আঁচ করে সে চুপচাপ সরে গেছে। প্রতিটি পল গুনে গুনে সময় পার হচ্ছে। কী করবে সুতপা এখন? ইচ্ছে হচ্ছে এমন জায়গায় চলে যেতে যেখানে কেউ ওকে খুঁজে পাবে না। ও তো এতকিছু চায় নি। সুখী গৃহকোণ, স্বচ্ছল ভাতকাপড়, দু-চারটে শখ মেটানো আর সন্তানের সুস্থিতি, এইতো মাত্র তার চাহিদা ছিল। এ কলঙ্কের ভাগী সে কেন হবে? প্রচণ্ড রাগ ক্রমে বুক নিংড়ানো কান্না হয়ে গলে গলে পড়তে থাকে। অবুঝ মায়া বুকের ভেতর চারিয়ে যেতে থাকে। সারা পৃথিবী অস্তিত্ব বাঁচাতে চেষ্টা করছে, লড়াই করছে এক অপ্রতিরোধ্য শত্রুর সঙ্গে। তাহলে সেই বা কেন হাল ছেড়ে দেবে? এটাও তো একটা মারী, এক গভীর অসুখ। তার ভালোবাসার মানুষটাকে সঠিক পথ খুঁজতে সাহায্যে করবে সে। তার পাশে দাঁড়াবে। সুতপা উঠে দাঁড়াল। সুতপা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।